Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকর || Muhammad Zafar Iqbal » Page 7

বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকর || Muhammad Zafar Iqbal

সকালবেলা শিউলি যখন স্কুলে যায় তখন বল্টু আর খোকন তার সাথে বের হয়ে যায়, তাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে দুজন শহর ঘুরতে বের হয়। শিউলি আগে স্কুলে গিয়েছে বলে তাকে এখানে স্কুলে দিতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু বল্টু আর খোকন পড়ালেখা জানে না, তাদেরকে স্কুলে ঢোকানো ভারি সমস্যা। এখন স্কুলে পড়তে হলে তাদের একেবারে ক্লাস ওয়ানের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সাথে পড়তে হবে, কিন্তু কোনো স্কুলই সেভাবে নিতে রাজি নয়। স্কুলে পড়তে হবে না জেনে বল্টু আর খোকনের দুজনেরই মনে ভারি আনন্দ।

কিছুদিনের মাঝেই অবিশ্যি এই আনন্দে ভাটা পড়ল–মতলুব মিয়া একদিন খবর আনল কাছেই এন, জি. ও-র লোকজন মিলে একটা স্কুল দিয়েছে, যত ভিখিরির ছেলেমেয়েরা সেখানে নাকি পড়তে যাচ্ছে। মতলুব মিয়া শুনেছে অত্যন্ত কড়া একজন মাস্টারনি এসেছেন। পান থেকে চুন খসলে নাকি রক্তারক্তি কারবার হয়ে যায়–বল্টু আর খোকনকে শায়েস্তা করার এর থেকে ভালো উপায় আর কী হতে পারে।

।রইসউদ্দিন খবর পেয়ে বল্টু আর খোনকে সত্যি সত্যি একদিন এই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এলেন। বাসায় কাজের ছেলেমেয়েরা, টোকাই, মিস্ত্রিরা এই স্কুলে পড়তে আসে বলে এটা শুরু হয় দুপুরবেলা, দুঘণ্টা পরে ছুটি। প্রথম কয়েকদিন বল্টু আর খোকন বেশ উৎসাহ নিয়েই গেল, কিন্তু যখন সত্যি সত্যি অক্ষয়-পরিচয় করিয়ে পড়াশোনা শুরু হয়ে গেল তখন তাদের উৎসাহ পুরোপুরি উবে গেল। ঘর থেকে স্কুলে যাবার নাম করে তারা বের হত, কিন্তু কোনোদিন যেত বাজারে, কোনোদিন রেল-স্টেশনে। তারা মনে করেছিল ব্যাপারটা কোনোদিন ধরা পড়বে না, কিন্তু দেখা গেল ব্যাপারটা এত সহজ নয়। সন্ধ্যেবেলা শিউলি পড়তে বসেছে এবং বল্টু আর খোকন মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে যোললাগুটি খেলছে ঠিক তখন দরজায় একটা শব্দ হল। মতলুব মিয়া দরজা খুলে দেখে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের একজন ভদ্রমহিলা। সাধারণ একটা শাড়ি পরে এসেছেন, চোখে চশমা, কাঁধ থেকে বড় একটা ব্যাগ ঝুলছে। মতলুব মিয়াকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “এইখানে কি বল্টু আর খোকন থাকে?”

মতলুব মিয়া কানে আঙুল দিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে বলল, “থাকার কথা না, কিন্তু এখন থাকে।”

বল্টু আর খোনকে পেয়ে মনে হল ভদ্রমহিলা খুব আশ্বস্ত হলেন। ঘরের ভেতরে ঢুকে বললেন, “আমি কি ওদের গার্জিয়ানের সাথে কথা বলতে পারি?”

মতলুব মিয়া ঘাড় বাঁকা করে বলল, “কী করেছে ঐ দুই বদমাইশ আমাকে বলেন। পিটিয়ে সিধে করে ছেড়ে দেব। আমাকে চিনে না। হু!”

ভদ্রমহিলা বললেন, “না, এটা পিটিয়ে সিধে করার ব্যাপার নয়–আর সত্যি কথা বলতে কী, যে-সমস্যা পিটিয়ে সমাধান করা হয় সেটা সমাধান না করাই ভালো।”

ভদ্রমহিলা কী বলছেন মতলুব মিয়া ঠিক বুঝল না, কিন্তু ভান করল সে পুরোটাই বুঝেছে।

“আমি কি একটু ওদের গার্জিয়ানের সাথে কথা বলতে পারি?”

“জি। আপনি বসেন, আমি ডেকে আনি।”

রইসউদ্দিন খালিগায়ে লুঙ্গি পরে বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। একজন ভদ্রমহিলা দেখা করতে এসেছে শুনে লুঙ্গি পালটে প্যান্ট আর একটা ফুলহাতা শার্ট পরে বাইরে এলেন। ভদ্রমহিলা তাঁকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বললেন, “আমার নাম শিরিন বানু, এই এলাকায় বাচ্চাদের যে-স্কুলটা ভোলা হয়েছে আমি তার শিক্ষিকা। বল্টু আর খোকন আমার স্কুলের ছাত্র, তাদের নিয়ে একটু কথা বলতে এসেছিলাম।”

রইসউদ্দিন মহিলাদের সাথে ঠিক কথা বলতে পারেন না। খানিকক্ষণ হাঁ করে থেকে বললেন, “ও হ্যাঁ। মানে ঠিক আছে কিন্তু মানে ইয়ে, ও হ্যাঁ। বেশ তা হলে-”

শিরিন বানু বললেন, “আমি কি বসতে পারি?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, বসেন।”

শিরিন বানু বসলেন। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “বল্টু আর খোকন দুজনই অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে। আমার ধারণা তাদের আই কিউ একশো চল্লিশের বেশি হবে। এদের সাথে আপনার সম্পর্কটা ঠিক কীরকম একটু জানতে চাচ্ছিলাম।”

রইসউদ্দিন তখন কীভাবে শিউলি, বল্টু এবং খোকনের পাল্লায় পড়েছেন ব্যাপারটি বুঝিয়ে বললেন। শুনে শিরিন বানু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, “আপনি তো সাংঘাতিক মানুষ! আপনি জানেন আজকাল আপনাদের মতো মানুষ খুব বেশি পাওয়া যায় না?”

রইসউদ্দিন ঠিক বুঝতে পারলেন না শিরিন বানু জিনিসটা প্রশংসা করে বলেছেন কি না, তাই অনিশ্চিতের মতো মাথা নেড়ে মুখে খানিকটা হাসি মাখিয়ে বসে রইলেন। শিরিন বানু বললেন, “আমার স্কুলে বল্টু আর খোকন হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছাত্র। কিন্তু তারা গত তিনদিন থেকে স্কুলে আসছে না।”

“সে কী!” রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “মতলুব মিয়া যে বলল তারা স্কুলে যাচ্ছে!”

“না। যাচ্ছে না।”

“আপনি দাঁড়ান, আমি ডেকে জিজ্ঞেস করি।”

বল্টু আর খোকনকে ডাকা হল এবং ঘরে ঢুকে শিরিন বানুকে দেখে দুজনেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। চেয়ারে রইসউদ্দিন এবং দরজায় মতলুব মিয়া না থাকলে দুজনেই উঠে একটা দৌড় লাগাত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শিরিন বানু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “কী ব্যাপার মিস্টার বল্টু এবং মিস্টার খোকন? আমাকে চিনতে পেরেছ?”

দুজনে ফ্যাকাশে মুখে মাথা নাড়ল শিরিন বানু বললেন, “আমি খোঁজ নিতে এলাম। স্কুলে আসছ না কেন?”

দুজনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। শিরিন বানু বললেন, “কী হল, কথা বলছ না কেন?”

বল্টু কিছু-একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। শিরিন বানু বললেন, “বলে ফেলো, কী বলতে চাও।”

বল্টু শেষ পর্যন্ত খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে বলল, “পড়ে কী হবে?”

শিরিন বানু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমাকে জিজ্ঞেস করো ‘পড়ে কী হবে না, দেখি বলতে পারি কি না।”

“পড়ে কী হবে না?”

“পড়ে সাঁতার শেখা যায় না, পানিতে নামতে হয়। পড়ে সাইকেলও চালানো যায় না, সাইকেলে উঠে প্র্যাকটিস করতে হয়। এ ছাড়া মোটামুটি সবকিছু বই পড়ে করা যায়।”

চোখের মাঝে দুষ্টুমি ফুটিয়ে খোকন জিজ্ঞেস করল, “বই পড়ে ওড়া যায়?”

“যায়। হ্যাঁন্ড-গ্লাইডার দিয়ে মানুষজন পাখির মতো আকাশে ওড়ে। বই না পড়লে তুমি হ্যাঁন্ড-গ্লাইডার ডিজাইন করতে পারবে না। যা-ই হোক এখন আসল কারণ বলো, স্কুলে কেন আসছ না?”

বল্টু বলল, “পড়তে ভালো লাগে না।”

খোকন বলল, “কিছু বুঝি না।”

শিরিন বানু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “তা হলে তো কোনো সমস্যাই নেই। কাল থেকে স্কুলে যাবে।”

“কেন আপা?”

“তোমাদের যেন পড়তে ভালো লাগে আর পড়ে যেন সবকিছু বোঝ আমি তার ব্যবস্থা করব।”

“কীভাবে?”

“গেলেই দেখবে।”

“আর যদি না যাই?”

“যদি না যাও তা হলে আমি বই-খাতা নিয়ে বাসায় চলে আসব।”

বল্টু আর খোকন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে শিরিন বানুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, আপা নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছেন। এটা তো সত্যিই হতে পারে না যে স্কুলের একজন আপা পড়ানোর জন্যে বাসায় চলে আসবেন।

পরের দিনটা বল্টু আর খোকন খুব অশান্তি নিয়ে কাটাল। স্কুলে তারা আর যাবে না ঠিক করে ফেলেছে। আর কয়দিন পরেই শিউলির ছোট চাচা এসে শিউলিকে নিয়ে আমেরিকা চলে যাবেন, তখন বল্টু আর খোকন যে যার মতো চলে যাবে। এই অল্প কয়দিন তারা একসাথে আছে, তিনজনই এমন ভান করছে যে তারা যেন আপন ভাইবোন! আসলে তো সেটা সত্যি না, কাজেই ভালো জামাকাপড় পরে বড়লোকদের বাচ্চার মতো স্কুলে গিয়ে আর কী হবে?

সন্ধ্যেবেলা সত্যি সত্যি তো আর স্কুলের আপা চলে আসবে না, কিন্তু সত্যিই যদি চলে আসেন তার জন্যে বল্টু আর খোকন ব্যবস্থা করে রাখল। আপাকে এমন একটা শিক্ষা দিয়ে দেবে যে আপা আর জন্মেও এইমুখো আসবেন না! কী করা যায় সেটা নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছে, তাদের মাথা থেকে বেশি বুদ্ধি বের হয়নি, কিন্তু শিউলি অনেকগুলো বুদ্ধি দিয়েছে। এইসব ব্যাপারে শিউলির বুদ্ধি একেবারে এক নম্বুরি! চিনি না দিয়ে লবণ আর মরিচের গুঁড়ো দিয়ে চা, আপার চিরুনিতে চুইংগাম চিবিয়ে লাগিয়ে দেওয়া, মাটির ঢেলা দিয়ে চকলেট তৈরি করা, দরজার উপরে ঠোঙার মাঝে ময়দা ভরে রাখা যেন দরজা খুলতেই মাথার উপরে এসে পড়ে–এইরকম অনেকগুলো বুদ্ধির ধারা করে রাখা হল।

সন্ধ্যের একটু পরে সত্যি সত্যি শিরিন বানু এসে হাজির হলেন। বল্টু আর খোকনকে পড়াতে এসেছেন শুনে মতলুব মিয়া তাঁকে তাদের ঘরে নিয়ে গেল, চেয়ারে বসিয়ে বলল, “খামোখা চেষ্টা করছেন আপা, বদের হাড়ি এরা, জীবনেও পড়বে না।”

“চেষ্টা করে দেখি।”

“কোথায় আর চেষ্টা করছেন? বেত কই আপনার? বেত ছাড়া চেষ্টা হয় নাকি?”

শিরিন বানু কিছু বললেন না, কিছুক্ষণের মাঝে বল্টু আর খোকন অপরাধীর মতো মুখ করে এসে হাজির হল। মজা দেখার জন্যে পিছুপিছু এল শিউলি। এই বাসায় যে-জিনিসটা কেউ এখন পর্যন্ত ভালো করে লক্ষ করেনি শিউলির সেটা প্রথমেই চোখে পড়ল। এই মহিলাটি যদি তাঁর চুলকে শক্ত করে পেছনে টেনে না বেঁধে একটু ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ছড়িয়ে দিতেন, চোখের চশমাটা খুলে ফেলতেন, এরকম সাদাসিধে একটা শাড়ি না পরে সবুজ, জমিনের উপর হালকা কাজ করা একটা শাড়ি পরতেন, ঠোঁটে একটু লিপস্টিক লাগিয়ে মুখের কঠিন ভাবটা সরিয়ে মুখে একটা মিষ্টি হাসি দিতেন তা হলে তাঁকে রীতিমত সুন্দরী বলে চালিয়ে দেওয়া যেত।

শিরিন বানু অবশ্য নিজের চেহারা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামান বলে মনে হল না। ব্যাগ থেকে বই-খাতা বের করে বল্টু আর খোকনকে পড়াতে শুরু করে দিলেন। স্বরবর্ণ শেষ করে ব্যঞ্জনবর্ণে যেতে-না-যেতেই বল্টু তাকে থামিয়ে বলল, “আপা!”

“কী হল?”

”আপনি যে পড়াতে এসেছেন সেজন্যে খুব খুশি হয়েছি।”

“তোমরা খুশি হয়েছ শুনে আমিও খুশি হয়েছি।”

“আপনি খুশি হয়েছেন শুনে আমরাও খুশি হয়েছি। আমরা তাই আপনার জন্যে দুইটা চকলেট নিয়ে এসেছি।”

“চকলেট! বাহ্! কী চমৎকার! চকলেট আমার সবচেয়ে ফেবারিট।”

বল্টু তখন কাঁপাহাতে আপার হাতে দুইটা চকলেট তুলে দিল। সারাদিন খেটেখুটে চকলেটটা তৈরি হয়েছে। মাটির ঢেলা সাথে মরিচের গুঁড়া। উপরে খয়েরি রং দেখে চকলেটই মনে হয়। আপা ব্যাগ খুলে ভেতরে চকলেট দুটি রাখলেন। বললেন, “বাসায় গিয়ে খাব।”

আবার পড়াশোনা শুরু হল। বল্টু তখন সাবধানে আপার ব্যাগ খুলে তার চিরুনিটা বের করে সেখানে একটা চুইংগাম লাগিয়ে দিল। তার হাতের কাজের কোনো তুলনা নেই, আপা কিছু টের পেলেন না। চুইংগামটা আগেই চিবিয়ে নরম করে টেবিলের তলায় লাগিয়ে রাখা ছিল–একেবারে পাকা কাজ, কোনো ভুলত্রুটি নেই। আরও খানিকক্ষণ কেটে গেল, খোকন হঠাৎ মাথা তুলে বলল, “আপা!”

“কী হল?”

“চা খাবেন?”

“না খোকন, চা খাব না। থ্যাংকিউ।”

“চা খাবেন না?” খোকনকে হঠাৎ বিচলিত দেখা গেল, “চা না খেলে কেমন করে হবে? চা খেতেই হবে আপা।”

“খেতেই হবে?”

“হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে তা হলে খাব।”

“আমি চা নিয়ে আসি আপা।”

খোকন ঘর থেকে বের হয়ে গেল এবং প্রায় সাথে সাথে এক কাপ চা নিয়ে এল। শিরিন বানু দীর্ঘদিন থেকে দুষ্টু ছেলেমেদের নিয়ে কাজ করে আসছেন, তাদের দুষ্টুমি ধরে ফেলার তার একটা আলাদা ক্ষমতা রয়েছে। এবারেও হঠাৎ করে খোকনের চায়ের কাপ নিয়ে আসার ভঙ্গিটা দেখে তাঁর মাথায় একটা সন্দেহ উঁকি দিল। চায়ের রং এবং সেখান থেকে বের হওয়া মরিচের সূক্ষ্ম একটা ঘ্রাণ দেখে তাঁর সন্দেহটা পাকা হয়ে গেল, কিন্তু শিরিন বানু তাঁর ভাবভঙ্গিতে সেটা প্রকাশ করলেন না। কাপটা নিজের কাছে টেনে নেবার ভঙ্গি করে এক ফোঁটা চা আঙুলে লাগিয়ে নিলেন এবং পড়ানোর ফাঁকে একসময় অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে জিবে লাগিয়ে সেটা চেখে দেখলেন, ভয়ংকর তেতো এবং ঝাল, উকট একটা গন্ধও রয়েছে সেখানে। দুষ্টু ছেলেমেয়েগুলো কী করতে চাইছে বুঝতে তার একটুও দেরি হল না। চায়ের কাপটা মুখের কাছে নিয়ে খাবার ভঙ্গি করে হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, “শুধু আমি একা খাব সেটা কেমন করে হয়?”

“আমরা খেয়েছি আপা। আপনি খান।”

শিরিন বানু কোনো কথা না বলে পিরিচে খানিকটা চা ঢাললেন, সেটাকে ঠাণ্ডা হওয়ার মতো সময় দিলেন, তারপর খোকনের গাল ধরে আদর করার ভঙ্গি করে বললেন, “আমার সাথে একটুও খাও খোকন।”

খোকনের মুখ আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে মাথা নাড়তে থাকে এবং হঠাৎ করে টের পায় তার গালটি আদর করে ধরে রাখলেও তার একটুকু নড়ার উপায় নেই। বাচ্চাদের তিতকুটে ওষুধ খাওয়ার সময় মায়েরা যেভাবে ছোট বাচ্চার মুখ ধরে রেখে সেখানে ওষুধ ঢেলে দেয় অনেকটা সেভাবে শিরিন বানু খোকনের মুখে খানিকটা চা ঢেলে দিলেন। খোকনের চোখ গোল গোল হয়ে গেল, ভয়ংকর বিস্বাদ চা এক ঢোক খেয়েও ফেলল, তারপর লাফিয়ে উঠে তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাগল। শিরিন বানু মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে বল্টুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “চা খেয়ে অভ্যাস নেই খোকনের, একফোঁটা চা খেয়ে কী করছে দেখেছ?”

বল্টু দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল, কিছু-একটা বলতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই। আপা তার গালটা ধরে ফেলেছেন। হাসিহাসি মুখে করে বললেন, “তুমি তো চা খাও, তাই না?”

বল্টু মাথা নাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। আপাকে দেখে বোঝা যায়

কিন্তু তার আঙুলগুলোতে অসম্ভব জোর। মনে হয় জানালার শিক এক আঙুলে বাঁকা করে ফেলবেন। বল্টু কিছু বোঝার আগে আপা তার মুখ ফাঁক করে সেখানে খানিকটা চা ঢেলে দিয়েছেন। মনে হল কেউ বুঝি তার মুখের ভেতরে পেট্রল ঢেলে সেখানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বল্টু সারা ঘরময় ছোটাছুটি করতে থাকে, কী করবে বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত জানালার কাছে গিয়ে কুলি করে চাটুকু বের করে দিল।

শিরিন বানু মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বললেন, “কী হল তোমাদের? একটু চা খেয়ে এরকম লাফালাফি করছ কেন?”

বল্টু মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, “চা–চা’টা ঠিক করে তৈরি হয় নাই।”

“ঠিক করে তৈরি হয় নাই?”

“না। ভু-ভু ভুল করে ঝাল দিয়ে দিয়েছে।”

“তাই নাকি? শিরিন বানু খুব অবাক হবার ভান করলেন, “ঝাল চা তো কখনো শুনিনি! দেখি কেমন।”

শিরিন বানু কাপ থেকে সুড়ৎ করে এক চুমুক চা চুমুক দেবার ভান করে বললেন, “বেশি ঝাল তো নয়, খাওয়া যাচ্ছে। তোমরা খাবে আরেকটু?”

খোকন আর বল্টু জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “না আপা, না।”

“কেন না?”

“খু-খু-খুব ঝাল লেগেছে।”

শিরিন বানুর চোখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “মিষ্টি কিছু খেলে মুখের ঝাল কেটে যাবে। আমার কাছে আছে। এসো।”

শিরিন বানু তার ব্যাগ থেকে দুটি চকলেট বের করলেন, একটু আগে বল্টু এবং খোকন তাকে চকলেট দুটি দিয়েছে। মোড়ক না খুলেই এখন তিনি বলতে পারেন এগুলো নিরীহ চকলেট নয়। শুধু তাই না, ব্যাগ খুলে তিনি আর একটা জিনিস আবিষ্কার করলেন, তাঁর চিরুনিটার মাঝে কীভাবে জানি খানিকটা চিউয়িংগাম আটকে রয়েছে, মাথার চুলে চিউয়িংগাম লাগিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি তিনি বহুঁকাল থেকে জানেন। তাঁর সামনে বসে থেকে এই দুইটি বাচ্চা কীভাবে তার ব্যাগ খুলে সেখানে তাঁর চিরুনিতে চিউয়িংগাম লাগিয়ে দিয়েছে তিনি চিন্তা করে পেলেন না, কিন্তু যেভাবেই সেটা করে থাকুক সেটার জন্যে তাদের বাহবা দেওয়া উচিত। শিরিন বানু অবিশ্যি তখন-তখনই কোনো বাহবা দিলেন না, তাঁর মুখে মুগ্ধ হওয়ার কোনো চিহ্নও ফুটে উঠল না।

চকলেট দুটি দেখেই বল্টু এবং খোকনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, শিরিন বানু সেটা দেখেও না-দেখার ভান করলেন, বললেন, “এসো বল্টু, এসো খোকন, চকলেট খেয়ে যাও।”

তারা নিজে থেকে এল না বলে শিরিন বানু মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে তাদের ধরে আনলেন, চকলেটের মোড়ক খুলে তাদের মুখে চকলেট গুঁজে দিলেন। কাজটি খুব সহজে করা গেল না, মৃদু ধস্তাধস্তি করতে হল। চকলেট মুখে নিয়ে তারা মুখ বিকৃত করে কয়েক সেকেন্ড বসে থেকে বাথরুমে ছুটে গেল।

বাথরুম থেকে মুখ ধুয়ে যখন ফিরে এসেছে তখন বল্টু আর খোকন দুজনেই মোটামুটি দুর্বল হয়ে এসেছে। স্কুলের যে-আপাটিকে খুব সহজেই একটা বড় শিক্ষা দিয়ে দেবে বলে ভেবেছিল, সেই কাজটি এখন আর খুব সহজ মনে হচ্ছে না। কাজটি যে প্রায় অসম্ভব হতে পারে সে-ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হয়ে গেল যখন দেখল আপা হাতে তার চিরুনিটা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তাদের দেখে মিষ্টি করে হেসে বললেন, “আমি যখন তোমাদের মতো ছোট ছিলাম তখন চকলেট খেতে কী যে ভালো লাগত! তোমরা দেখি একেবারেই চকলেট খেতে চাও না!

বল্টু আর খোকন কী বলবে বুঝতে পারল না, খানিকটা হতভম্বের মতো শিরিন বানুর দিকে তাকিয়ে রইল। শিরিন বানু বললেন, “তোমাদের সাথে তো

রীতিমতো কুস্তি করতে হল, দেখো তোমাদের চুলের কী অবস্থা! কাছে এসো, চুল ঠিক করে দিই।”

বল্টু আর খোকন কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল, ভাঙা গলায় বলল, “লাগবে না আপা, লাগবে না।”

“কেন লাগবে না! কী মিষ্টি তোমাদের চেহারা–চুল আঁচড়ে নিলে আরও কত সুন্দর দেখাবে। এসো, কাছে এসো।”

কাঁচপোকা যেভাবে তেলাপোকাকে টেনে আনে আপা সেভাবে দুজনকে টেনে এনে চুল আঁচড়ে দিলেন। তাদের মাথায় কোথায় চিউয়িংগামটা লেগেছে সেটা এখন আর পরীক্ষা করার উপায় নেই।

চুল আঁচড়ে মোটামুটি ভদ্র সেজে দুজন আবার পড়তে বসল, যে-জিনিসটা শেখাতে স্কুলের অন্য ছেলেমেয়েদের কয়েক সপ্তাহ লেগে যায় এই দুজন সেটা এক ঘণ্টার মাঝে শিখে ফেলল। এই আশ্চর্যরকম বুদ্ধিমান দুজন বাচ্চার জন্যে শিরিন বানু নিজের ভেতরে এক গভীর মায়া অনুভব করলেন, কিন্তু সেটা আর তাদের সামনে প্রকাশ করলেন না।

বিদায় নেবার সময় উঠে দাঁড়াতেই বল্টু আর খোকনের চোখে হঠাৎ করেএক মুহূর্তের জন্যে একটা উত্তেজনার চিহ্ন দেখে শিরিন বানু বুঝতে পারলেন তাকে নাস্তানাবুদ করার ব্যাপারটি এখনও শেষ হয়নি। কী হতে পারে সেটা একটু অনুসন্ধান করতেই দরজার ওপর রাখা ঠোঙাটা তার চোখে পড়ল। সেটা না দেখার ভান করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ কিছু-একটা মনে পড়েছে এরকম ভঙ্গি করে দুজনকে ডাকলেন, বল্টু আর খোকন খুব সহজেই তার ফাঁদে পা দিল। বল্টু আর খোকনকে স্কুলসংক্রান্ত কিছু-একটা উপদেশ দিয়ে দুজনকে দুই হাত ধরে রেখে নিজের সামনে রেখে শিরিন বানু দরজায় হাত দিলেন।

সাথে সাথে দরজার উপরে খুব সাবধানে বসিয়ে-রাখা ঠোঙাটা উলটে নিচে পড়ল, এর ভেতরে ময়দা বা আটা যেটাই রাখা ছিল সেটা উপুড় হয়ে পড়ল দুজনের মাথায়। এমনিতে দুর্ঘটনাটা ঘটলে এত নিখুঁতভাবে তাদের মাথায় পড়ত কি না সন্দেহ ছিল, কিন্তু শিরিন বানু চোখের কোনা দিয়ে ঠোঙাটাকে লক্ষ করে দুজনকে ঠেলে ঠিক সময় ঠিক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন। মাথার উপর সরাসরি এক ঠোঙা ময়দা পড়ার পর দুজনের যা একটা চেহারা হল সে আর বলার মতো নয়! শিউলি তাদের দেখে পেটে হাত দিয়ে যেভাবে হি হি করে হাসতে শুরু করল যে তার শব্দে বসার ঘর থেকে রইসউদ্দিন এবং রান্নাঘর থেকে মতলুব মিয়া এসে হাজির হল।

যে-ময়দা দিয়ে সকালে পরোটা তৈরি হয় নাশতা করার জন্যে, বল্টু আর খোকন কেন সেটা মাথায় দিয়ে বসে আছে সেটা ব্যাখ্যা করা খুব সহজ হল না। শিরিন বানু খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে দেখলেন কিন্তু সেটা তাঁর জন্যে হজম করা খুব কঠিন হয়ে পড়ল। হাসি চেপে কোনোরকমে চলে যাবার আগে শুধু তাদের মনে করিয়ে দিলেন বল্টু আর খোকন যদি পরদিন স্কুলে না যায় শিরিন বানু পরদিন আবার চলে আসবেন।

বল্টু আর খোকনের মাথায় সেখানে চিউয়িংগাম লেগে গেছে সেটা দূর করা খুব সহজ হল না। এরকম সময় যা করতে হয় এবারেরও তাই করা হল খানিকটা চুল কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলতে হল। সামনে থেকে সেটা দেখা যাচ্ছিল

বলে বল্টু আর খোকন বেশি বিচলিত হল না, কিন্তু পিছন থেকে দেখে হাসতে হাসতে শিউলির চোখে পানি এসে গেল। সে চোখ মুছে বলল, “এই বল্টু আর খোকন, এই আপা তোদের একেবারে ছাগল বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।”

বল্টু চোখ পাকিয়ে শিউলির দিকে তাকাল। শিউলি হাসি থামিয়ে বলল, “খামোখা আপার সাথে লাগাতে যাবি না। কাল থেকে সময়মতো স্কুলে যাবি।”

বল্টু আর খোকন কিছু বলল না, কিন্তু তারা টের পেয়ে গেছে স্কুলে তাদের যেতেই হবে। যে-স্কুলে হাজির না হলে স্কুলটাই বাসায় হাজির হয়ে যায় তার থেকে রক্ষা পাবার উপায় কী?”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *