ত্রয়স্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ – বিজয়া
টিকারামের বড়ই স্ফূর্ত্তি, সে গোঁপে চাড়া দিয়া ছাতি ফুলাইয়া ডাউল রুটির ধ্যান করিতে করিতে সকলের অগ্রে অগ্রে চলিয়াছে। সম্মুখে কুকুর দেখিলে দৌড়িয়া গিয়া তাড়া করিতেছে, বৃষভ বা গাভী দেখিলে লাঠীর গুঁতা মারিতেছে। দেওয়ানজী হর্ষোৎফুল্ল-নয়নে শ্বশুর মহাশয়ের সহিত কথোপকথন করিতে করিতে যাইতেছেন—বৃদ্ধের মুখে আজ হাসি দেখা দিয়াছে। প্রভুর জয়লাভ হইয়াছে—ভীমের আর আনন্দের সীমা নাই, সেই উৎফুল্ল মনে তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ হেলিয়া দুলিয়া চলিয়াছে, সে একরকম নৃত্য বলিলেও চলে। নিরানন্দ কেবল রতনশর্ম্মা—তাহার পাপভারাক্রান্ত হৃদয় অনুতাপে দগ্ধ হইতেছে, সে এখন উদ্দেশ্যহীন, উদ্যমহীন—কলের পুতুলের ন্যায় গমন করিতেছে।
কজ্জলার মনস্কামনা পূর্ণ হইয়াছে—ব্রতফল লব্ধ হইয়াছে—সঙ্কল্প সিদ্ধ হইয়াছে—তথাচ তাহার মলিন মুখমণ্ডলে অন্তরের অসহ্য যন্ত্রণা বিকাশ পাইতেছে। রত্নাকে ম্রিয়মাণ দেখিয়া তাহার হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছে—রবি রাহুগ্রস্ত হইলে পৃথিবীর কি আর সে প্রফুল্লভাব থাকে? কজ্জলা, রত্নার দুঃখে দারুণ দুঃখিনী।
এইভাবে গ্রাম অতিক্রম করিয়া তাঁহারা সকলে মাঠে আসিয়া পড়িলেন, দেখিলেন—অনন্ত হরিৎ-সাগর মৃদুসমীরে তরঙ্গিত হইতেছে—এ শোভা পৃথিবীর আর কোন দেশে দেখিতে পাইবে না। শরতে জগজ্জননী বঙ্গদেশে অন্নপূর্ণারূপে মূর্ত্তিমতী—তাই বঙ্গদেশে বিশ্বমাতার শারদীয়া মহাপূজা। এ মহাপূজা পৃথিবীর আর কোন দেশে হয় না—এ হৃদয়োন্মত্তকর মহোৎসব আর কোন দেশে দেখা যায় না।
মাঠের উপর দিয়া একটি প্রশস্ত কাঁচা রাস্তা চলিয়া গিয়াছে। এই রাস্তা ধরিয়া আমাদের যাত্রিগণ প্রকৃতির অপূৰ্ব্ব শোভা দেখিতে দেখিতে চলিলেন এবং ক্রমে পূর্ব্ববর্ণিত সেই তালপুকুরের ধারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। পুষ্করিণীর উত্তরদিক দিয়া রাস্তাটি বাঁকিয়া গিয়াছে, যাঁহারা অগ্রে যাইতেছিলেন, তাঁহারা সেই বঙ্কিম-পন্থায় ঘুরিয়া গেল, কজ্জলা অবসর পাইয়া, রত্নাকে সম্মোধন করিয়া বলিল, “একটু আস্তে যাও, তোমার সহিত অনেক কথা আছে।”
রত্না। কি?
কজ্জলা। তুমি এখন কোথা যাবে?
রত্না। হাল ছাড়িয়া দিলে নৌকা যেমন স্রোতে ভাসিয়া যায়, আমার অবস্থা এখন ঠিক সেইরূপ। আমার এখন আর কোন উদ্দেশ্য নাই— চেষ্টাও নাই;কি করিব জানি না, কোথা যাইব জানি না, কোথা গেলে, কি করিলে আমার এ নিদারুণ হৃদয়জ্বালা জুড়াইবে জানি না—কজ্জলা, আমি অনেক পাপ করিয়াছি—আমার মনের ভিতরে যেন ভীমরুলের চাক হইয়াছে—যন্ত্রণা আর আমার সহ্য হয় না, এইবার আমি পাগল হইব। দয়াময়! না, না, আমি কোন্ মুখে তাঁর দয়া প্রার্থনা করিব। এ পাপমুখে তাঁর পবিত্র নাম গ্রহণ করিতে আমার সাহস হয় না—আমার পাপের কি প্রায়শ্চিত্ত আছে!
কজ্জলা। তুমি যদি এমন হ’লে, তবে আমার দশা কি হবে?
রতন ফ্যাল্ ফ্যাল্ করিয়া ক্ষণেক কজ্জলার মুখপানে চাহিয়া রহিল, তাহার পর বলিল, “কজ্জলা তুই আজ এমন কথা আমায় বলি কেন?”
কজ্জলা। স্বামী পাগল হ’লে, স্ত্রীর দশা কি হয়, তা কি তুমি জান না?
রত্না। তুই কি আমার স্ত্রী?
কজ্জলা। আমি হরিহর শিরোমণির কন্যা—তোমার জন্যই সৰ্ব্বত্যাগিনী।
রত্না। অ্যাঃ—অ্যাঃ, আহা! কেন তুমি আমার জন্য এত ক্লেশ—এত কষ্ট স্বীকার করেছ? আমি তোমার অযোগ্য স্বামী—আমি পিশাচ—তুমি দেবী।
কজ্জলা। স্বামী যত কেন দোষী হউন না, তবু তিনি স্ত্রীর দেবতা। যে স্বামীর সেবা করতে না পেলে, স্বামীকে সন্তুষ্ট করতে যে না পারলে, তার জীবনই বৃথা। চল, এখন হরিপালে চল—না হয়, আমার বাপের বাড়ীতে চল।
রত্না। কজ্জলা, লোকালয়ে আর আমি মুখ দেখাইব না, সংসার আমার আর ভাল লাগিবে না। স্বর্গেও আমার সুখ নাই—আমার মনে নরক—স্বর্গও এখন আমার পক্ষে নরক।
কজ্জলা। তুমি অত হতাশ হচ্ছ কেন? দীনভাবে দয়াময়ীর শরণাপন্ন হও, তিনি প্রসন্ন হ’লে আবার তোমার মনে শান্তি আসিবে।
রত্না। আমি তাহাই করিব, কুপুত্র যদি হয়, কুমাতা কখনও নয়। যতদিন বাঁচিব, মায়ের চরণতলে পড়িয়া কাঁদিব, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিব, তাঁর কৃপা প্রার্থনা করিব—কজ্জলা, তুমি ঘরে যাও—আমি আর দেশে থাকিব না।
কজ্জলা। আমায় ছাড়িয়া কোথা যাইবে? যখন তোমায় প্রসন্ন করতে পেরেছি, তখন আর ত তোমায় ছাড়িব না। তুমি যেখানে যাইবে, আমিও সেইখানে যাইব। তুমি মায়ের চরণতলে পড়িয়া কাঁদিবে—আমি ভিক্ষা করিয়া আনিব। তোমার সেবা করিয়া এ জীবন কাটাইব।
রত্না। কলা, আমার জন্য তুমি কেন এত ক্লেশ স্বীকার করিবে, আমি তোমায় ত একদিনের জন্যও সুখী করি নাই।
কজ্জলা। আমার কাজ আমি করিব; তোমার সেবা করাতেই আমার সুখ, তোমায় ছাড়িয়া সে সুখে আমি বঞ্চিত হইব কেন?
রত্না। বুঝিলাম, আজিও যে হিন্দুজাতি বিদ্যমান আছে, সে কেবল হিন্দু মহিলাদিগের ধৰ্ম্মবলে। কজ্জলা, তুমি কি আমার সহিত গ্রীষ্মের প্রচণ্ড-রৌদ্রে, শীতের নিদারুণ হিমে এবং বর্ষার অবিশ্রান্ত ধারায় বনে বনে, পৰ্ব্বতে পৰ্ব্বতে ভ্রমণ করিতে পারিবে? তত কষ্ট তোমার কি সহ্য হইবে?
কজ্জলা। তোমার মুখ দেখে আমি সকল দুঃখ, সকল যন্ত্রণা ভুলে থাকব।
রত্না। তবে এস, আমরা অন্যত্রে গমন করি, আর উহাদের সহিত যাইবার প্রয়োজন কি? কজ্জলা। আমায় একবার দেওয়ানের স্ত্রীর সহিত দেখা করতে হবে।
রত্না। আচ্ছা, তুমি এস, আমি এইখানে তোমার অপেক্ষায় রহিলাম।
“দেখিও, আর অধর্ম্ম করিও না, আর আমায় পরিত্যাগ করিও না। আমি না আসিলে এখান হইতে যাইও না,” বলিয়া কজ্জলা দ্রুত যাইয়া অগ্রবর্ত্তী যাত্রীদিগের সহিত মিলিত হইল।
দেওয়ান তাহাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসিলেন, “ঠাকুরটি কোথায় রহিলেন?”
কজ্জলা। তিনি আসিলেন না, কোথা চলিয়া গেলেন।
দেওয়ান। তিনি যে আসিবেন না, তাহা তাঁহার ভাবগতিক দেখিয়া অনেকক্ষণ বুঝিয়াছি। এখন তোমার আমি কি করিব বল। তোমা হইতেই আমার ধন মান সকলই রক্ষা হইয়াছে, এখন তোমাকে সুখী করা আমার সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য—তোমার কি চাই বল
কজ্জলা হাসিয়া বলিল, “আমি যাহা চাহিব, তাহা তুমি আমায় দিবে?”
দেও। অবশ্য দিব।
কজ্জলা। আমি ঐ গহনার বাক্সটি চাই।
দেও। খালি বাক্সটি?
কজ্জলা। এই ত, এখনই ঢোক গিলিতেছ—
দেওয়ান কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, “না, না, আমি জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম, গহনা সমেত বাক্সটি চাই কি?”
কলা। তা না ত কি? খালি বাক্স কে চায়?
হলধর। উনি তামাসা করিতেছেন।
দেওয়ান কজ্জলার মুখপানে চাহিলে, কজ্জলা গম্ভীরভাবে বলিল, “যদি দিতে কষ্ট বোধ কর চাহি না। তুমি আমার যে উপকার করিয়াছ, তাহাই যথেষ্ট। আমি তোমার সামান্য মানরক্ষা করিয়াছি, তুমি আমার প্রাণ রক্ষা করিয়াছ, তোমার ঋণ আমি কখনই পরিশোধ করিতে পারিব না।”
দেওয়ান কি ভাবিয়া ভীমকে ডাকিয়া বলিলেন, “ঐ বাক্সটা এঁকে এখনই দাও।”
ভীম বিষণ্ণবদনে বাক্সটি কোমর হইতে খুলিয়া কজ্জলার হস্তে দিল। কজ্জলা বাক্স লইয়া দেওয়ানকে আশীর্ব্বাদ করিয়া সকলকে পশ্চাতে রাখিয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেল। যাত্রিগণ কেহ ক্রুদ্ধ, কেহ দুঃখিত, কেহ বা বিরক্তভাবে নীরবে গমন করিতে লাগিলেন—”হরিষে বিষাদ”।
এদিকে কজ্জলা প্রাণপণে দ্রুত চলিয়া রত্নপুরে আসিয়া উপস্থিত হইল। রত্নপুর অতি ক্ষুদ্র গ্রাম, তথায় ভদ্রলোকের বসতি অতি বিরল – কাহারও বাটীতে দুর্গোৎসব হয় নাই—গ্ৰাম্য লোকেরা গ্রামান্তরে প্রতিমা বিসর্জ্জন দেখিতে গিয়াছে—গ্রাম নিস্তব্ধ—গোবিন্দরামের বাটীও নিস্তব্ধ। পুরীর নিভৃত দেশে দেওয়ানের সহধর্ম্মিণী একাকিনী বসিয়া নীরবে রোদন করিতেছেন— কে যেন বিষাদের প্রতিমা গড়িয়া হেথায় রাখিয়া গিয়াছে। দূরে “দাদা গো, দিদি গো, প্রতিমাকে কোথা রেখে এলি গো” এই বিষাদজনক বাজনা বাজিতেছে। সূর্য্য অস্ত গমন করিয়াছে—সমস্ত প্রকৃতি যেন বিষাদসাগরে নিমগ্ন হইতেছে।
এমন সময়ে “এই যে মা আমার এখানে বসে,” বলিয়া কজ্জলা আসিয়া বিনোদিনীর সম্মুখে দাঁড়াইল। তাহাকে দেখিয়া বিনোদিনী আরও আবেগ সহকারে কাঁদিতে লাগিলেন।
“না মা, আর কেঁদ না, মা দুর্গা তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছেন, দেওয়ানজী বাড়ী আসিতেছেন, আর ভাবনা কি? এই নাও গহনা পর।”
এই বলিয়া কজ্জলা গহনার বাক্সটি তাঁহার সম্মুখে রাখিয়া দিল।
বিনোদিনী বিস্মিত হইয়া একবার তাহার মুখপানে চাহিয়া পরক্ষণেই তাহার পায়ে ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, “মা সত্য করে বল, তুমি কে।”
এমন সময়ে সেই দাসীটা আসিয়া জুটিল, ব্যাপার কি বুঝিতে না পারিয়া হতভম্বের মত দাঁড়াইয়া রহিল।
কজ্জলা। আমি কাঙ্গালিনী, এখন চাবিটা নিয়ে এস, তোমায় সাজাইয়া একবার চক্ষু সার্থক করি। এমন সময়ে পাড়ার দুইটি ছোট মেয়ে আসিয়া অবাক হইয়া মজা দেখিতে লাগিল—নিমাই ও ছুটিয়া আসিয়া সে-ও অবাক।
বিনোদিনী। থাক্ মা, এখন থাক্
“না, তা হবে না, এখনি গিয়া চাবি আন,” বলিয়া কজ্জলা তাহার হাত ধরিয়া বলপর্ব্বক উঠাইয়া দিল।
বিনোদিনী গৃহ হইতে চাবি আনিয়া কজ্জলার কাছে বসিয়া বলিলেন, “তুমি গহনা পরাইয়া দিলে, আমার অপরাধ নিও না মা, আমায় সত্য করিয়া বল, তুমি কে? আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি, তুমি ঠাকুরাণী।”
“না, আমি কাঙ্গালিনী,” বলিয়া সে বিনোদিনীকে হাত ধরিয়া চৌকীর উপর বসাইয়া নিজে তাহাকে গহনা পরাইতে লাগিল এবং সেই অবসরে আপনার পরিচয় দিতে লাগিল—কত কত কথায় কত কাঁদাইল।
পরিচয় শুনিয়া বিনোদিনী তাহার প্রতি অধিকতর আকর্ষিত হইলেন, বলিলেন, “পূর্ব্বে সাবিত্রীর কথা শুনিয়াছিলাম, আজ সেই সাবিত্রীকে স্বচক্ষে দেখিলাম।”
অলঙ্কারবিন্যাস সমাপ্ত হইলে কজ্জলা তথা হইতে গমন করিল এবং স্বামীসহ মিলিত হইয়া কোথায় চলিয়া গেল। রাঘব ও তাহার অনুচরবর্গের কি হইল, তাহা আমরা জানি না।