বাংলা কবিতার ছন্দ
কাব্যসাহিত্যে ছন্দ সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে আগে ‘মাত্রার’ ধারণা থাকা প্রয়োজন ।
মাত্রা : কাব্যে গতির সমতা রক্ষাকে “মাত্রা” বলে। মাত্রা সময় নিরূপক নির্দেশনা । কোন অক্ষরে কত সময় স্বর অবস্থান করবে , মাত্রায় তা উল্লেখ থাকে। আবৃত্তির ক্ষেত্রে মাত্রা অপরিহার্য। সময়ের পরিমাণ মাত্রা দিয়েই বোঝান হয়। সঙ্গীতে
যেমন : ধা। ধিন। ধিন। ধা। =৪ মাত্রা। তেমনি কাব্যে , ছিপ।খান। তিন।দাঁড় । তিন।জন ।মাল। লা । = ৮ মাত্রা ।
অক্ষর বলতে , আমরা একসঙ্গে কোন বর্ণে কতটা সময় অবস্থান করি—-তার উপর নির্ভর করে ধরা হয় । অক্ষর অনেকটা ইংরেজী ‘সিলেবল’য়ের মত । অক্ষর আর বর্ণ সম্পূর্ণ আলাদা । যেমন ,ক+ল+ম—–এখানে বর্ণ আছে তিনটি কিন্তু যখন শব্দটা উচ্চারণ করি তখন বলি—ক+ লম ,অর্থাৎ অক্ষর এখানে দুইটি । একটি মুক্তাক্ষর এবং অন্যটি যুক্তাক্ষর বা বদ্ধাক্ষর ।
সাধারণত কবিতা লেখা হয় পয়ারের ছন্দে । পয়ার ৮+৬ =১৪ মাত্রার দুইটি পর্ব বিশিষ্ট পদ বা চরণ । প্রতি দুই চরণে অন্ত্যমিল থাকে ।
কবিতায় ছন্দ তিন প্রকার । তাদের নাম,( ১) স্বরবৃত্ত , মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ।
স্বরবৃত্ত ছন্দে , যুক্তাক্ষর ১ মাত্রা , এবং মুক্তাক্ষরও ১ মাত্রা। যেমন , মা। কেঁ ।দে। কয়। মন। জু। লি। মোর। + ওই। তো। ক।চি।মে।য়ে। = ১৪ মাত্রা।
(২) মাত্রাবৃত্ত ছন্দে —মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা আর যুক্তাক্ষর ২মাত্রা। যেমন, “একটি কথার দ্বিধা থরথর চূড়ে , ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী !” এটা এইভাবে দেখানো হলোঃ এ।ক।টি। ক।থা।র/ দ্বি। ধা । থ।র।থ।র।চূ।ড়ে/ ভ।র। ক।রে।ছি।ল / সা।ত।টি / অ।ম।রা।ব।তি/
(৩) অক্ষরবৃত্ত ছন্দে —-মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা , যুক্তাক্ষর—শব্দের প্রথমে ও মাঝে ১ মাত্রা কিন্তু শব্দের শেষে যুক্তাক্ষর ২ মাত্রা । যেমন , হে। বং।গ/ ভান।ডা।রে।ত।ব/ বি।বি।ধ/ র।ত।ন/ ==ভান– যুক্তাক্ষর ,শব্দের প্রথমে বলে ১ মাত্রা। কিন্তু রতনের ‘তন’ শব্দের শেষে বলে –২মাত্রা ।
প্রায় সব কবিরাই স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কবিতা লেখেন। আমাদের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন ।
মাইকেল মধুসূদন “ অমিত্রাক্ষর ছন্দ” নামে একটি ছন্দ প্রবর্তন করেন । এটিও পয়ারের ছন্দ। তবে তিনি চরণের অন্ত্যমিল তুলে দিলেন । পয়ারে যেমন প্রথম চরণে এক দাঁড়ি । অর্থাৎ থামতে হবে , দ্বিতীয় চরণের শেষে ডবল দাঁড়ি । অর্থাৎ বাক্য সম্পূর্ণ হলো । দুই চরণের অন্তে মিল থাকতেই হবে । অন্ত্যমিল আর বিরামের এই বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে পূর্বে কবিরা প্রায়ই অর্থহীন গোঁজামিলের আশ্রয় নিতেন । যেমন ,
“ লাখে লাখে মরে সৈন্য কাতারে কাতার ।
শুমার করিয়া দেখে চল্লিশ হাজার ।।“
মধুসূদন “মেঘনাদ বধ” মহাকাব্য রচনা করতে গিয়ে প্রতি চরণের অন্ত্যমিলের এই প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে অমিত্রছন্দ প্রয়োগ করেন । যেমন ,
“ সম্মুখ সমরে পড়ি/ বীর চূড়ামণি /
বীরবাহু , চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে । কহ হে দেবী অমৃত ভাষিণী ,
কোন বীরবরে বরি সেনাপতি পদে
পাঠাইলা রণে পুনঃ , রক্ষকূলনিধি
রাঘবারি ?”
কবির মতে– প্রতি লাইন বা চরণের শেষে আমি থামবো না , থামবো আমার কথা বা ভাব শেষ হবে , তারপরে । মহাকাব্যের বিস্তৃত পটভূমি আর যুদ্ধের বিশালতা কোন বাঁধনে বাঁধা যায় না । এর ভাবকে উত্তাল নদীর স্রোতের মতোই প্রবাহিত হতে দিতে হয় । তিনি চরণের শেষ থেকে মিত্রতা তুলেদিলেন , যতিপাত ঘটালেন ভাব শেষ হওয়ার পর চরণের শুরুতেই বা মাঝে । ফলে বাংলা কাব্যসাহিত্যে শুরু হলো বাঁধভাঙ্গা স্রোতের অবাধ প্রবাহমানতা ।