Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বর্ষা এলে ভয় হয় || Subrata Mitra

বর্ষা এলে ভয় হয় || Subrata Mitra

বর্ষা এলে ভয় হয়

এখন মধ্যরাত। রাতগুলো জেগে ওঠে বর্ষার আওয়াজে। পাড়া শুদ্ধু সকলেই এখন ঘুমোচ্ছে। এত রাতে এই পাড়ায় শুধু আমি কেবল জেগে আছি এখন। না আমার ঘরে জল পড়ছে না ।জল পড়ছে না আমার ঘুমোনোর জন্য মশারী টাঙ্গানো খাটেও। তাহলে ঘুম আসছে না কেন? জানিনা। আমি বারবার জানালা খুলে বাইরের দিকে তাকাই আর ভাবি আমার আগের ঘরটির কথা। আমরা আগে যে ঘরটিতে থাকতাম সেই ঘরটি এখনো আছে। তবে আমরা আর ঐ ঘরে থাকি না। কিন্তু এখনো তো অনেক মানুষ আছে যাদের ঐ ভাঙ্গা ঘরটার মতো একটা ঘরও নেই। সেই রকম মানুষেরা এই রাতে কোথায় আছে? কেমন আছে? আমার বউ আর ছেলে পাশের ঘরে নিশ্চিন্তে মনের আনন্দে ঘুমোচ্ছে। আমি কিছুতেই ঘুমোতে যেতে পারছিনা। কারণ বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। আমার পুরনো ঘরটার দিকে বারবার চোখ যাচ্ছে জানালা দিয়ে। ভাবছি এখন তাহলে কত মানুষ না ঘুমিয়ে জেগে আছে। একটা সময় ঘর সংসার আমার স্বপ্নের বাইরে ছিল। কোন স্বপ্নই দেখি নি কোনদিন। শুধু বেঁচে থাকার জন্যই যেটুকু প্রয়োজন সেইটুকু চাহিদার মধ্যেই আমার মনটাকে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছি সর্বক্ষণ। আমার এই অভ্যাসের কারণে আমার কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনেরা আমাকে কিপটে বলতো বা এখনো বলে। বিলাসিতা শব্দটাকে আমি আপন করতে পারিনি কোনদিন। আমাদের বিবাহের বছর দুয়েক আগে থেকেই একটি পৃথক ঘর ভাড়া করে সেখানে একা থাকতাম আমি। টালির ঘর। একটা লাইটের পয়েন্ট। একটা ফ্যানের পয়েন্ট। দুটোর আলাদা আলাদা টাকা ধার্য থাকায় আমি ফ্যান ছাড়াই থাকতাম। শুধু একটি মাত্র আলোর পয়েন্ট থাকতো। কারণ আলো ছাড়া তো কিছুই করা যাবে না। ঐ ঘরটায় ভাড়া থাকাকালীনই আমি বিবাহ করি। আমার নিজের বাড়িঘর না থাকায় আমার বিয়ের সকল অনুষ্ঠান মামাবাড়িতে হয়। বিয়ে করে বউ নিয়ে কয়েক বছর থাকবো বলেই পৃথকভাবে ঘরটি ভাড়া নিয়ে রেখেছিলাম বিয়ের কয়েক বছর আগেই। আমার মামাবাড়ী পিয়ালী কলারিয়ায় আমার বিবাহের সকল অনুষ্ঠান পর্ব শেষ হওয়ার সপ্তাহ দুই পরে সব আসবাবপত্র নিয়ে এসে থাকা শুরু করতে না করতেই বাড়িওয়ালা এবং তার স্ত্রী বিভিন্ন ছলছুতোয় আমাদের পেছনে লাগতে থাকে। রাতে ভাঙ্গা টালির ফাঁকা দিয়ে আমাদের গায়ে জল পড়তো। দীর্ঘদিন ধরে বলা সত্বেও তা ঠিক করে দিতেন না। রাতে বেশিক্ষণ ধরে ঘরে আলো জ্বললে সকালে তার কারণ বলতে হতো। বিয়ের পরে আমি একটা টেলিভিশন কিনেছিলাম। কিন্তু রাতে সেই টেলিভিশন ব্যবহার করতে পারতাম না। বাড়িওয়ালা আওয়াজ শুনলেই বকবেন। একদিন রাতে বাড়িওয়ালার ছোট্ট মেয়ে পেচ্ছাপ করে বাথরুমে জল না দিয়ে চলে এসেছে। পরদিন সকালেই আমার স্ত্রীকে ডেকে বলে, “তুমি বাথরুম করে জল দাওনি?” এরকম আরও একদিন বাড়িওলার বাচ্চাটা বাথরুমের চাতালে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভাত ফেলে রেখেছিল। সেইদিনও বাড়িওলার বউ আমার বউকে অনেক গালমন্দ করেন। নতুন বউ। গ্রামের মেয়ে। বাবা-মায়ের বড় আদরের একমাত্র কন্যা। সে আমার কাছে এসে রাতে বর্ষায় ভিজছে। ঘরের ভিতরে চোরের মত পরাধীন ভাবে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। কি করব? নিজের ঘরবাড়ি না থাকলে এরকমই অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। ঐদিনের ঘটনায় আমার স্ত্রী ভীষণই মন ক্ষুন্ন হয়। সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কাঁদতে কাঁদতে সে কেবল নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে। আমাদের এমন জীবন দশায় ও নিজেকে দুর্ভাগ্যের শিকার বলে মনে করতে থাকে। আমিও কেমন যেন ওর সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছি না। একটা ছোট মন, একটা বৃহৎ লজ্জা কাজ করছে আমার মনের ভেতর। এরকম ধনাঢ্য পরিবারের একটি আদরে মেয়েকে এনে ঠিকমত সম্মানের সাথে থাকতে দেওয়ার যোগ্যতাও নেই আমার? দিন এভাবে গড়াতে গড়াতে একদিন জানলাম আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। আমি বাবা হতে চলেছি। জানতে পারলো বাড়িওয়ালাও। আমাদের বাচ্চা হওয়ার দিন যত এগিয়ে আসছে ততই যেন বাড়িওলার বউয়ের মুখটা কাঠে রান্না করা ভাতের হাঁড়ির পাঁছার মতো কালো হয়ে যাচ্ছে। একদিন ফস্ করে বলেই ফেললেন,” এই সুব্রত শোনো।” আমি অনেক ভয়ে ভয়ে বললাম, “হ্যাঁ বলুন”। দাদা বৌদি দুজনেই এসেছিলেন। বললেন, “তোমাদের ঘর ছেড়ে দিতে হবে”। আমার এবং আমার বউয়ের মাথায় যেন একটা গোটা আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমরা জিজ্ঞেস করলাম।” কেন দাদা? ঘর ছেড়ে দিতে বলছেন কেন? বাড়িওয়ালা দাদা কোন কথা বলতে না বলতেই কার কথা থামিয়ে বৌদি বলে উঠলেন,” ঘরটা সারাতে হবে”। তোমরা যে ঘরে থাকো সেই ঘরটা দিয়েতো জল পড়ে। আমরা দুজনে খুব আকুতি-মিনতি করলাম। দয়া করে আর কয়েকটা দিন আমাদের থাকতে দিন। এর আগেও তো এই ঘরে জল পড়তো বহুদিন ধরে। আর কয়েকটা দিন কষ্ট করে ঠিক কাটিয়ে নেবো আমরা। এইতো সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই আমাদের বাচ্চার ডেলিভারি ডেট দিয়েছেন ডাক্তার বাবু। উনারা আমাদের কোনো কথায় কর্ণপাত করলেন না। পরে বুঝলাম আমার বাচ্চা হওয়ার পরে অনেক অনেক কাপড়-জামা ন্যতা ক্যতা ধুতে অনেক জল লাগবে বলে সেই কারণেই উনারা আমাদেরকে ঘর ছেড়ে দিতে বলেছেন। মাঝখান দিয়ে আমরা পড়ে গেলাম বড় ঝামেলায়। এই অবস্থায় কোথায় ঘর পাই? আমি পোস্ট অফিসে মাসে মাসে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। তখন ডিসেম্বর মাস। মার্চ মাসেই টাকাগুলো পেয়ে গেলে গড়িয়ায় আমার কেনা জমিতে না হয় একটা ঘর করব। কিন্তু এই ডিসেম্বরেইতো বাচ্চা হওয়ার তারিখ! ডাক্তারবাবু বিশ-ই ডিসেম্বর ডেট দিয়েছেন। এদিকে আবার ঘর ছেড়ে দিতে হবে দু-একদিনের মধ্যেই। কোন দিকে কোন ব্যবস্থা না করতে পারায় শেষে সামান্য কয়েক হাজার টাকা দিয়ে তিন ইঞ্চি ইটের দেওয়াল দিয়ে একটি ঘর তৈরি করে দিলেন যথাক্রমে আমার মামা; ছোট শালাবাবু ও তার দু একজন সুপরিচিত সহায়কের ঐকান্তিক উদ্যোগে। তিন ইঞ্চি দেওয়ালের ওপারে এডবেস্টারের ছাউনী। তখনো মেঝে তৈরি হয়নি।ঐ অবস্থাতেই আমার শালাবাবু আর আমি ভিজে মেঝেতেই চটের বস্তা পেতে গৃহ প্রবেশের পর পরবর্তী তিন রাত নিয়ম করে রাত যাপন করি। হঠাৎ করে শুনি বাচ্চাটা পেটের ভিতর নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছে। দিগ্বিদিক হারিয়ে ছোটাছুটি শুরু করি হাসপাতলে। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বেশ কয়েকটা মূল্যবান পরীক্ষা-নিরীক্ষা, স্ক্যান ইত্যাদি করে তার রিপোর্ট নিয়ে পরের দিনই হাজির হয়ে যেতে বলেন হাসপাতলে। যথারীতি পরদিন হাসপাতালে যেতে না যেতেই ডাক্তারবাবু রিপোর্ট দেখে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি নিয়ে নিলেন আমার গর্ভবতী স্ত্রীকে। দিনটি ছিল ১০ ই ডিসেম্বর সোমবার ২০১০ সাল। সেই দিনই রাতে বাচ্চা ডেলিভারির অপারেশন করতে হবে। ঘর ভাড়াও ছেড়ে দিতে হবে। তিন ইঞ্চি দেওয়ালের ঘরটাও তখনও তৈরি হয়নি পুরোপুরি। পকেটে তো এখন পয়সাও নেই কিছু। একমাত্র ভগবান ভরসা। সময়ের হাত ধরে কখন যেন সময়ই আমাদেরকে সমাধানের দরজায় পৌঁছে দিয়েছিল। হাসপাতালেই আমার স্ত্রীর পাশের বেডে এক দম্পতির সাথে আলাপ হয়ে যায়। তারা আমাদেরকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন। তথাপি তখনও মাথার ভিতরে একটাই চিন্তা বারবার ঘুরছে, আজ রাতটা কিভাবে কাটাবো। ভগবানের কৃপায় সেইদিন রাতে আমাদের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। সু-খবরের মাঝেও বিভিন্ন গোলযোগে মন অস্থির সর্বক্ষণ। গত দু’দিন ধরে পুরনো ভাড়া বাড়ির পাশের এক মাসীমা একটি ঘরের খোঁজ নিয়ে এলেন। আমি মাসিমাকে বললাম,” যদি ঐ বজ্জাদ বাড়িওয়ালার মত হয় এরাও”? এই কথা ভেবে আমি সেখানে যেতে প্রথমে রাজি হইনি। পরে বউ বাচ্চার কথা মাথায় রেখে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। কারন আমার জমিতে যে ঘরটা করা হয়েছে ওটা এখান থেকে অনেকটা দূর। তার ওপরে আবার মেঝেতে কাদা।সেই কারণে বাচ্চা হওয়ার পরবর্তী কয়েক মাস কলকাতাতেই থাকার মন স্থির করলাম। তবে এই বাড়িওয়ালার কাছে আমরা আগেই বলে নিয়েছি যে, আমাদের একটা ছোট বাচ্চা হওয়ার কথা। আগের বাড়িওলাটা যত খারাপ ছিল এই বাড়িওলা ঠিক তার উল্টোটা। তাঁরা আমাদের বাচ্চা হওয়ার কথা শুনে খুব খুশি, খুব আনন্দিত। এই বাড়িওয়ালার বড় উঠোনের মাঝখানে এক মস্ত বড় মন্দির আছে। সেখানে তাঁরা আমাদের সদ্যজাত শিশুর জন্য মানসিক করেন। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে আমি দেবতাদের মতো সদস্য বোঝাই এই পরিবারটিকে কাছে পেলাম। এইভাবে বেশ কয়েক মাস যেতে যেতে পোস্ট অফিসে জমানো আমার সেই টাকা ম্যাচুরিটি হওয়ার সময় হয়ে এলো। মনে খুব আনন্দ। জীবনে প্রথম আমি লাখোপতি হব। সেইবারে আমি এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা পেয়েছিলাম। কিন্তু এত টাকা দিয়ে কি হবে তখন? তখন তো আমার একটা তিন ইঞ্চি দেয়ালের ঘর আছে। আমার বউয়ের বাচ্চা হওয়ার সমস্যাও মিটে গেছে। তখন এত টাকা দিয়ে কি হবে? মনে মনে ভাবলাম; আমি তো সারা জীবন ঘর ভাড়া থাকবো না। একদিন তো আমার নিজের ঘরে চলে যেতেই হবে। তাহলে তো এই শহরে যাতায়াত করতে অনেক সময় লেগে যাবে। আমি ঘুম থেকে উঠে যে গাড়িগুলো ধুতে যাই ওগুলো তো আর ধোয়া যাবে না তখন। আর গাড়ি না ধুলে বাবুরা টাকা দেবে না। আর বাবুরা টাকা না দিলে খাবো কি? তাই সকালের কাজগুলো বজায় রাখার জন্য নিজের নতুন ঘরে বউ বাচ্চা নিয়ে যাওয়ার আগেই একটা মোটরসাইকেল কিনে ফেলেছিলাম। অর্থ সমস্যা ও জীবন দশা খানিকটা পাল্টালেও মাথায় জল পড়ার ভাগ্যটা আমাকে তখনো পিছন ছাড়ে নি। বাড়িতে যাতায়াতের রাস্তায় খানিকটা ইট পাতা আর অধিকাংশটাই রাবিশ দিয়ে বেছানো ছিল। আমাদের ঘরে কারেন্ট ছিলনা। চৈত্রের রোদের তাপে তিন মাস বয়সের বাচ্চাটার গায় বড় বড় ফোসকা পড়ে যেত । রোদের সময় রোদ, বর্ষার সময় ভাঙ্গা এডবেস্টার দিয়ে জল পড়তো। আবার বৃষ্টি থেমে গেলে কোথা থেকে যে জল চলে আসতো তা ভগবান জানে। এই অঞ্চলের রাস্তাঘাট ঘরবাড়ি সব জায়গা ডুবে যেত প্রতিবছর বর্ষার সময়। বেশি জল হলে অনেক সময় ঘরের ভিতর সাপ ঢুকে খাটের উপরে আমাদের মশারির ভিতর কাঁথায় জড়িয়ে থাকতো । সে কি বিপর্যয়! এই অঞ্চলে যতবার জল হবে আমরা আগে ভাসবো। এই কারণে প্রত্যেক বছর বর্ষাকালে আমরা ঘরের সব জিনিসপত্র ফেলে অন্যত্র ঘর ভাড়া নিতাম । এইভাবে আমার বাল্যকালের অনেক পুরনো স্মৃতি জলের জন্য নষ্ট হয়ে যায় ।জল-বর্ষা-রোদ ,কোনোটাতেই রেহাই পেতাম না। এডবেস্টারের ছাউনি আর তিন ইঞ্চির সেই ঘরে বসবাস করতে করতেই অনেক কষ্ট ও প্রার্থনা করে আমাদের একটি পাকা ছাদ দেওয়া ঘর নির্মাণের বন্দোবস্ত হলো। আমি এবং আমার বউ দুজনে মিলে ভ্যানে করে ইট বয়েছি সারাদিন-সারারাত। আমার বউও এরকম একটি পরিবারের কন্যা হয়েও আমার কাছে এসে যে কষ্ট স্বীকার করেছে তা কখনোই ভুলবার নয়। আজও বর্ষা আসে। না জানি কত মানুষ এখনো আমার আগের দিনগুলোর মতো অবস্থানেই আছে। তাই বর্ষা নামলে আমার আর ভালো লাগেনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *