Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

প্যান অ্যাম-এর একটি বোয়িং ৭৪৭

প্যান অ্যাম-এর একটি বোয়িং ৭৪৭ জাম্বো জেট বিমানের প্রথম শ্রেণীতে আজ একজন ভি আই পি হংকং থেকে লন্ডন যাচ্ছেন। বিমানসেবক ও সেবিকারা তটস্থ। বিমানটি কিছুক্ষণ পরেই লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে নামবে। ভি আই পি যাত্রীটি অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে মাঝে-মাঝে তাঁর দামি হাতঘড়িটির দিকে চেয়ে দেখছেন। ভূ কোঁচকানো, চ্যাপটা মুখে রাজ্যের বিরক্তি এবং উৎকণ্ঠা। তাঁর সামনে ও পিছনের দুটি-দুটি চারটি সারিতে সাদা পোশাকের দেহরক্ষীরা বসে আছে। তাদের সকলেরই চেহারা কুস্তিগির বা মুষ্টিযোদ্ধাদের মতো। প্রত্যেকের কাছেই শক্তিশালী ওয়াকিটকি, আগ্নেয়াস্ত্র ইত্যাদি রয়েছে।

ভি আই পি যাত্রীটির জন্য খাদ্য পানীয়ের কোনও অভাব নেই। কিন্তু তিনি কোনও খাদ্যই গ্রহণ করেননি। শুধু একবার খানিকটা জল খেয়েছেন, তাও সন্দিহান মুখে। এমনকী বিমানসেবিকাকে তিনি ভাঙা-ভাঙা ইংরিজিতে জিজ্ঞেসও করেছেন, জলের মধ্যে বিষ বা ঘুমের ওষুধ নেই তো!

ভি আই পি যাত্রীটি হচ্ছেন চিনের দেশত্যাগী বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ ডক্টর ওয়াং। তাঁর বেঁটেখাটো, পেটমোটা চেহারাটা দেখলে কিছুতেই তাঁকে বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক বলে মনে হয় না। বরং কমিক চরিত্রের অভিনেতা বলেই বেশি মনে হয়। ডক্টর ওয়াং খুবই অস্থিরচিত্ত মানুষ। তিনি স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছেন না। অন্তত দশবার টয়লেটে গিয়ে মুখে-চোখে জলের ঝাঁপটা দিয়েছেন। বারবার রুমালে মুখ মুছছেন। বিড়বিড় করে কথা বলছেন। আপনমনে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাচ্ছেন। অন্তত বিশবার বিমানসেবিকাকে প্রশ্ন করেছেন, লন্ডন পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগবে।

তাঁর নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে চাপাস্বরে কথা বলে হাসাহাসি করছে।

আজ প্রথম শ্রেণীতে যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। ডক্টর ওয়াং বসেছেন সামনের দিকে। পিছনের দিকে মাত্র কয়েকজন যাত্রী আছেন। তাঁরা সবাই শ্বেতাঙ্গ। কোনও এশিয়াবাসীকে আজ প্রথম শ্রেণীতে উঠতে দেওয়া হয়নি।

হঠাৎ বিমানে ঘোষণা হল, বিমান আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হিথরো বিমানবন্দরে নামবে।

ওয়াং খুব উত্তেজিত হয়ে উঠে পড়লেন। ফের বসলেন। জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখলেন।

একটু বাদেই লন্ডন শহরের বিপুল বিস্তার দেখা গেল। লন্ডন ওয়াং-এর কাছে অচেনা জায়গা নয়। তিনি বহুবার বিভিন্ন কনফারেন্সে যোগ দিতে লন্ডনে এসেছেন। তবু যেন প্রথম দেখছেন এমন কৌতূহল নিয়ে চেয়ে রইলেন নীচের দিকে।

বিমান ধীরে-ধীরে নামল এবং একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ভূমিস্পর্শ করল।

ওয়াং তাড়াতাড়ি তাঁর অ্যাটাচি কেসটা নিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন, একজন সিকিউরিটি গার্ড তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে পথ আটকে বলল, “ডক্টর, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আপনার নিরাপত্তার জন্য আপনাকে আমরা অন্য দরজা দিয়ে নামাব।”

ডাক্তার ওয়াং রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন, “মূর্খ। আমাকে বেশি গুরুত্ব দিলে শত্রুপক্ষের নজর আমার ওপরেই বেশি পড়বে–এটাও জানো না? আমাকে অন্যান্য যাত্রীর সঙ্গে মিলেমিশে নামতে দাও।”

নিরাপত্তারক্ষী মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের ওপর হুকুম আছে, পাইলটের পাশের দরজা দিয়ে আপনাকে নামাতে হবে।”

ডক্টর ওয়াং হতাশভাবে মাথা নাড়লেন।

প্লেনের সামনের ডান দিকে যে-দরজা দিয়ে খাবারদাবার ইত্যাদি বিমানে ভোলা হয় ওয়াংকে নিয়ে নিরাপত্তারক্ষীরা সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল। নীচে একখানা গাড়ি টারম্যাকে অপেক্ষা করছিল। বুলেট প্রুফ গাড়ি। সামনে ও পিছনে দুটি পুলিশের গাড়ি।

ডাক্তার ওয়াং খুব বিরক্তির সঙ্গে এসব লক্ষ করলেন। প্রতিবাদ করে লাভ নেই বলে প্রতিবাদ করলেন না। সোজা গিয়ে গাড়িটায় উঠে বসলেন। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ছুটে চলল। তাঁকে পাশপোর্ট দেখিয়ে ইমিগ্রেশনের বাধা টপকাতে হল না। গাড়ি বিমানবন্দর পেরিয়ে ছুটে চলল হ্যাঁরোর দিকে।

ডক্টর ওয়াং বিড়বিড় করে বললেন, “সব নষ্ট হয়ে গেল! সব নষ্ট হয়ে গেল!”

পাশের সিকিউরিটি গার্ড বলল, “কী নষ্ট হয়ে গেল ডক্টর ওয়াং?”

ওয়াং জবাব দিলেন না। ভ্রূকুটি করে সামনের দিকে চেয়ে রইলেন।

লন্ডনে উঁচু বাড়িঘর বিশেষ দেখা যায় না। বেশির ভাগ বাড়িই দোতলা বা তিন তলা। পুরনো বাড়ির সংখ্যা খুব বেশি। কারণ ইংরেজরা প্রাণে ধরে পুরনো কিছুই ভাঙতে বা বদলাতে চায় না। এ ব্যাপারটা ওয়াং-এর বেশ ভালই লাগে। তিনি লন্ডন শহরের দৃশ্য দেখে বেশি খুশি।

একটা মস্ত ফটকওলা বাড়ির ভিতরে গাড়িটা এসে ঢুকল। চারদিকে কড়া পাহারা। বাড়িটা লন্ডনের অন্যতম সেফ-হাউস। কাকপক্ষীও সহজে গলতে পারে না। ভিক্টোরিয় ধাঁচে তৈরি প্রকাণ্ড বাড়িটায় আরাম-বিলাসের যথেষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। আছে সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট, ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা, জিমন্যাশিয়াম ইত্যাদি। ওয়াং অবশ্য আরাম-বিলাসের দিকে মোটেই ভূক্ষেপ করলেন না। সোজা নিজের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে এসে টেলিফোন নিয়ে বসলেন। চটপট বোতাম টিপে নম্বর ধরলেন।

ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠস্বর বলল, “ইয়েস।”

ওয়াং বললেন, “শোনো। আমি লন্ডনে পৌঁছেছি। এরা আমাকে একটা সেফ হাউসে তুলেছে। আমার সন্দেহ, এরা আমার টেলিফোনে আড়িপাতা যন্ত্র বসিয়ে রেখেছে এবং আমার সব কথা টেপ করা হচ্ছে। এরা চিনা ভাষাও অবশ্যই জানে। সুতরাং আমি সাঙ্কেতিক ভাষায় কথা বলছি।”

“হ্যাঁ ডক্টর ওয়াং, বুঝতে পেরেছি। আপনি কত নম্বর সঙ্কেতে কথা বলবেন?”

“চার নম্বর।”

“ঠিক আছে।”

কথা অবশ্য বেশি বললেন না ডক্টর ওয়াং। একটা সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন করলেন। একটা সংক্ষিপ্ত জবাব এল। ওয়াং এর পর তিনটি বাক্য বললেন। একটি বাক্যে জবাব এল। ডক্টর ওয়াং এর পর মোট কুড়িটি শব্দ উচ্চারণ করলেন, তার মধ্যে বারকয়েক বনি নামটা ছিল। তারপর টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন ওয়াং। তাঁর মুখে তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠল।

ওদিকে বেসমেন্ট বা মাটির নীচেকার পাতালঘরে একটি অত্যাধুনিক শব্দধারক যন্ত্রকে ঘিরে তিনজন লোক পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিল। ডক্টর ওয়াং-এব সব কথাই তারা শুনেছে এবং টেপ করে নিয়েছে। একজন অন্যজনকে বলল, “জন, চার নম্বর সঙ্কেত কাকে বলে জানো?”

“না ফ্রেড, জানি না।”

“বনি নামে কাউকে চেনো?”

“না, চিনি না।”

“তোমার কি মনে হয় না যে, ডক্টর ওয়াং অত্যন্ত ধূর্ত লোক?”

“তা তো বটেই। এশিয়াবাসীদের অধিকাংশই খুব ধূর্ত। ওয়াং আরও বেশি। তবে ধূর্ত হলেও লোকটা প্রতিভাবান। মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে বিশ্ববিখ্যাত হতে যথেষ্ট এলেম লাগে ভাই।”

“তা তো বটেই। প্রতিভার সঙ্গে ধূতামি যোগ হলে খুবই বিপজ্জনক। অথচ লোকটাকে দেখলে হাসিই পায়।”

“আর হেসো না ফ্রেড। ডক্টর ওয়াং মোটেই হাসির খোরাক নন। আমার মনে হয় লন্ডনে ওঁর অনেক শাগরেদ আছে। যার সঙ্গে উনি কথা বললেন সেও একজন। ফোন নম্বরটা কোথাকার বলো তো?”

ফ্রেড মাথা নেড়ে বলল, “ডক্টর ওয়াং তোমার বা আমার চেয়ে অনেক বেশি ধূর্ত জন। ফোনটা করেছেন উনি চেরিং ক্রস আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের একটি পাবলিক বুথের নম্বরে। লোকটি ওই বুথে ঢুকে অপেক্ষা করছিল। সবই আগে থেকে ঠিক করা ছিল নিশ্চয়ই।”

“সে তো বটেই। বনি নামটা মনে রেখো। আমাদের জানতে হবে এই বনি কে।”

“আমাদের সবই জানতে হবে ফ্রেড!”

“কিন্তু কাজটা খুব সহজ হবে না জন।”

ওদিকে ফোন করার পর ডক্টর ওয়াং খুব খুশির ভাব দেখাচ্ছেন। তিনি গরম জলে স্নান করলেন এবং খুশির চোটে স্নান করতে করতে চিনা ভাষায় একটু গানও করলেন। বলা বাহুল্য, তাঁর গানের গলা নেই।

স্নানের পর তিনি খাবার ঘরে গিয়ে দেখলেন অতি সুস্বাদু সব চিনা খাবার তাঁর জন্য সাজিয়ে রেখে সেবকেরা অপেক্ষা করছে।

সন্দেহাকুল গলায় তিনি প্রশ্ন করলেন, “খাবারে বিষ নেই তো? বা ঘুমের ওষুধ?”

খেয়ে উঠে তিনি তাঁর ঘরে এসে কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। তারপর টিভি খুলে খবর শুনতে লাগলেন। বি বি সি’র সংবাদে ডক্টর ওয়াং সম্বন্ধে খবরে বলা হল, চিন সরকার জানিয়েছেন ডক্টর ওয়াং মোটেই চিন ছেড়ে পালিয়ে যাননি। তিনি চিনেই আছেন। তাঁর পালিয়ে যাওয়ার খবরটি সম্পূর্ণ বানানো।

ডক্টর ওয়াং সামান্য হাসলেন। ধীরে ধীরে রাত্রি গম্ভীর হল। ওয়াং ঘড়ি দেখলেন। তারপর টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে তিনি বাইরে বেলোনোর পোশাক পরে নিলেন। অ্যাটাচি কেসটা খুলে তিনি চারটে ডটপেন বের করে তিনটে পকেটে গুঁজে রাখলেন, একটা নিলেন ডান হাতে। তারপর ঘরের আলো নিবিয়ে পনেরো মিনিট অপেক্ষা করার পর দরজা খুলে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলেন।

লিভিং রুম পেরিয়ে বাইরে বেরোনোর দরজা। দরজার বাইরে অবশ্যই পাহারাদার আছে। আছে শিকারি ককরও। সুতরাং, সেদিকে গেলেন না ওয়াং, তিনি ডানধারে একটা জানালার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে দেখলেন। মস্ত লন। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ফ্লাড লাইটের আলোয় জায়গাটা দিনের বেলার মতোই ঝকঝক করছে।

জানালাটা খুলে ওয়াং লঘু পায়ে একটা লাফ দিয়ে নীচে। পড়লেন। কোনও শব্দ হল না বটে, কিন্ত প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিদ্বেগে একটা ডোবারম্যান ককর ছুটে এসে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওয়াং দেওয়ালে সিঁটিয়ে গিয়ে কুকুরটার চেয়েও তৎপরতায় ডটপেনটা তুলে বোম টিপতেই পিং করে একটা সূক্ষ্ম উঁচ গিয়ে কুকুরটার গলায় বিঁধল। তিন সেকেন্ডের মধ্যে নেতিয়ে পড়ল কুকুরটা। ওয়াং নড়লেন না। দ্বিতীয় কুকুরটা অবশ্যই আসবে।

দেড় মিনিট পর দ্বিতীয় কুকুরটা এল। নিঃশব্দে এবং চিতাবাঘের মতো মসৃণ গতিতে। ওয়াং এবার আগের চেয়ে তৎপরতায় কুকুরটিকে ঘুম পাড়ালেন। তৃতীয় কুকুরটা এল আরও দেড় মিনিট পর। তারপর এল চতুর্থ কুকুর।

চারটে কুকুরকে নিষ্ক্রিয় করে ওয়াং রুমালে কপালের ঘাম মুছে। নিলেন।

তাঁর হিসেবমতো মোট ছ’জন সশস্ত্র প্রহরী বাড়িটা পাহারা দিচ্ছে। সামনের দিকে চারজন, পিছনে দুজন। ওয়াং একটা ঝোঁপের আড়ালে গুঁড়ি মেরে ভাল করে চারদিকটা লক্ষ করলেন। একটা মেপল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে একজন গার্ড চুয়িংগাম চিবিয়ে। যাচ্ছিল। ওয়াং পাল্লাটা মেপে নিলেন, তারপর আর-একটা ডটপেন পকেট থেকে নিয়ে তাক করলেন। পিং করে শব্দ হল। প্রহরীটা যেন একটু চমকে উঠল। ঘাড়ে হাত দিল। তারপরই লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

এমন সময় হঠাৎ একটা বজ্রসম হাত এসে খ্যাঁক করে ওয়াং-এর ঘাড় চেপে ধরে টেনে তুলল। বিশালদেহী দ্বিতীয় পাহারাদার। ওয়াং-এর দিকে চেয়ে কর্কশ গলায় বলল, ডক্টর ওয়াং! এত রাতে লন্ডনের হাওয়া তোমার স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল নয়।

ওয়াং অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, “আমি কি তোমাদের কয়েদি?”

“না। তুমি আমাদের সম্মানিত অতিথি। সম্মানিত অতিথিরা যেমন আচরণ করে থাকেন তোমারও সেরকমই করা উচিত।”

ঝাঁকুনির চোটে ওয়াং-এর হাত থেকে ডটপেনটা পড়ে গেছে পকেটে হাত দেওয়ারও জো নেই। এরা এসব ছোটখাটো অস্ত্রের খবর রাখে। সুতরাং, এই ছ’ ফুট লম্বা দানবটির দিকে ওয়াং ভাল করে চেয়ে মাপজোখ করে নিলেন। তারপর নিরীহ হাতটি বাড়িয়ে লোকটার কবজির একটা বিশেষ জায়গা চেপে ধরলেন। অন্য হাতের একটা আঙুল অবিকল ছোরার মতো চালিয়ে দিলেন লোকটার কণ্ঠায়।

বিশাল দানবটি গোড়া-কাটা কলাগাছের মতো পড়ে গেল।

ওয়াং ডটপেন এবং অ্যাটাচি কেসটা তুলে নিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে দেওয়ালটার কাছে পৌঁছে গেলেন। তালাদেওয়া একটা ছোট্ট লোহার ফটক আছে, তালা এবং লোহার ফটক দুটোই অতিশয় মজবুত। পকেট থেকে আর-একটা ডটপেন বের করলেন ওয়াং। বোতাম টিপতেই তা থেকে একটা সরু বিচিত্ৰদৰ্শন ইস্পাতের মুখ বেরিয়ে এল। তালা খুলে ফেলতে দশ সেকেন্ডও লাগল না। রাস্তায় পড়েই ওয়াং অতি দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। অন্তত এক কিলোমিটার হেঁটে তিনি একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এলেন সোহে অঞ্চলের এক সরু রাস্তায়। কেমন যেন গা-ছমছম করা পরিবেশ। ঘিঞ্জি সব গরিব চেহারার বাড়ি। তারই একটার সামনে এসে নামলেন ওয়াং। ডোরবেল টিপলেন। দরজা খুলে একজন বেঁটেখাটো চেহারার চিনা মাথা নিচু করে অভিবাদন করল।

বাড়ির ভিতরে গোলকধাঁধার মতো করিডোর এবং হরেক ছাঁদের সিঁড়ি। তিন তলায় পিছনের দিকে একটা ঘরে চার-পাঁচজন নানা দেশী লোক একটা কম্পিউটার সামনে নিয়ে বসে আছে। কম্পিউটার ছাড়া টিভি মনিটরও আছে। আছে নানা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি। সকলে উঠে ওয়াংকে অভিবাদন জানাল।

ওয়াং-এর ক্রু কোঁচকানো। ঘড়ি দেখে বললেন, “এ জায়গাটার খোঁজ পেতে ওদের তিন-চার ঘণ্টার বেশি লাগবে না। সুতরাং, হাতে সময় বেশি নেই। ভিডিও ক্যাসেটটা চালাও।”

সামনের টিভির পরদায় এন বি সি নিউজের রেকর্ড করা সংবাদটিও ফুটে উঠল। সবটা নয়। শুধু বনির অংশটা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য বনিকে দেখানোও হল। সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্চা। কিন্তু সম্পূর্ণ পঙ্গু।

ওয়াং বারবার রিউইন্ড করে বনির ছবি দেখলেন। সংবাদ ভাষ্য শুনলেন। তাঁর কপালে দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠল।

বেঁটে লোকটা খুব বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “ডক্টর ওয়াং, এইটুকু একটা বাচ্চাকে নিয়ে আপনি অত দুশ্চিন্তা করছেন কেন?”

ওয়াং অত্যন্ত বিরক্তি ও রাগের সঙ্গে বললেন, “মূর্খ! বনি কে তা তোমরা জানো না। কিন্তু আমি একজন বৈজ্ঞানিক, আমি জানি। ওর চোখ দুটো ক্লোজ আপে আনো, দেখতে পাবে।”

সঙ্গে-সঙ্গে কম্পিউটারের সাহায্যে বনির মুখমণ্ডল, বিশেষ করে তার চোখ দুটো সুপার ক্লোজ আপে আনা হল। চোখ দুটি প্রাণচঞ্চল, তাতে বুদ্ধিরও যেন ঝিকিমিকি।

বেঁটে লোকটা অত্যধিক বিনয়ের সঙ্গে বলল, “তা না হয় বুঝলুম। বাচ্চাটা পঙ্গু হলেও নিবোধ নয়। কিন্তু এ আমাদের কী ক্ষতি করতে পারে? এ তো একেবারে সাত আট মাস বয়সের শিশু।”

ওয়াং ঝাঁঝালো গলায় বললেন, “যা জানো না, বোঝ না তা নিয়ে কথা বোলো না। জার্সি সিটির একটা লোকাল নিউজপেপারে কী খবর বেরিয়েছে জানো? বনি বিপদ দেখলে তার চোখের রং বদলে ফেলতে পারে।”

“না, আমি এ খবর জানতাম না। চোখের রং সে কী করে বদলায়? সেটা কি সম্ভব?”

“কী করে বদলায় তা আমিও জানি না। সেইজন্যই আমি আমেরিকা যাচ্ছি। একমাত্র উদ্দেশ্য বনিকে কজা করা। নইলে বনি আমাদের অনেক ক্ষতি করতে পারে।”

“একথাটা বুঝতে পারছি না ডক্টর।”

“তুমি বোকা, তাই বুঝতে পারছ না। বনির লক্ষণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওই পঙ্গু শিশুটি এমন একটি মস্তিষ্কের অধিকারী যা যে-কোনও মেকানিক্যাল ডিভাইসের ওপর আধিপত্য করতে পারে। যখন ও আর একটু বড় হবে তখনই ওর ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যাবে। আমি যে সুপার ব্রাট আবিষ্কার করেছি তা একটি অমিত ক্ষমতাশালী যন্ত্র। দুঃখের বিষয় সেটি কিছু বদমাশ লোক চুরি করেছে। আমি ছাড়া পৃথিবীর কেউ সেটির সম্যক ব্যবহার জানে না। কিন্তু কোনও

অতি মস্তিষ্কের সংস্পর্শে এলে কী হয় তা বলা যায় না।”

এমন সময় ঘরের আর-একজন লোক বলে উঠল, “দেখুন ডক্টর ওয়াং, বি বি সি নিউজে কী বলছে।”

ওয়াং ঝুঁকে পড়লেন। বি বি সি’র নৈশ সংবাদে বলা হচ্ছে, চিন সরকার জানিয়েছেন, য়ুনান প্রদেশের এক জঙ্গলের মধ্যে আজ দ্বিপ্রহরে ডক্টর ওয়াং-এর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। তাকে গুলি করে

হত্যা করা হয়েছে। সুতরাং, দেশপ্রেমী ডক্টর ওয়াং-এর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবরটি একেবারেই ভুল। তাঁর হত্যাকারীকে খোঁজা হচ্ছে।

ওয়াং সোজা হয়ে বসে বললেন, “আর দেরি নয়। এবার পালাতে হবে।”

সবাই নিঃশব্দে উঠে জিনিসপত্র গোছাতে লাগল।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress