Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বত্রিশ সিংহাসন || Nihar Ranjan Gupta » Page 3

বত্রিশ সিংহাসন || Nihar Ranjan Gupta

সিংহাসনটি চুরি যাবার আনুপূর্বিক ঘটনা

কিরীটীর অনুরোধে রাজাবাহাদুর সিংহাসনটি চুরি যাবার আনুপূর্বিক ঘটনা বললেন।

সেদিন শনিবার, অমাবস্যা। তার উপরে সকাল থেকেই আকাশটা ছিল মেঘাচ্ছন্ন। সারাটা দিন লাইব্রেরী ঘরে কাটিয়ে ত্ৰিদীপনাথ সন্ধ্যার দিকে অন্দরমহলে যাবেন বলে উঠেছেন, এমন সময় হঠাৎ যেন তঁর মাথাটা ঘুরে উঠল। তাড়াতাড়ি সোফার ওপরে বসে পড়লেন। শরীরটার মধ্যে কেমন যেন অস্থির-অস্থির করছিল। ঐ দিনই সকালের ট্রেনে তার শ্যালক মেডিক্যাল কলেজের পাস-করা ডাক্তার শশাঙ্ক তার দিদিকে নিতে এসেছিল। সে সংবাদ পেয়ে ছুটে আসে এবং সকলে মিলে তাঁকে নিয়ে গিয়ে তাঁর শয্যার ওপরে শুইয়ে দেয়। শশাঙ্ক তাঁকে পূর্ণ বিশ্রাম নিতে বলে। রাত্রে আর অন্য কিছু না খেয়ে এক গ্লাস গরম দুধ খেয়েই শুয়ে পড়েন; মাঝরাত্রে একবার ঘুম ভেঙেছিল, তাঁর মনে আছে যে রাজবাড়ির পেটা ঘড়িতে তখন রাত দুটো ঘোষণা করছে। বাকি রাতটা আর তঁর ঘুম হয়নি। পরের দিন তাঁকে একটু সুস্থ দেখে তাঁর স্ত্রী ও শ্যালক দুপুরের গাড়িতে কলকাতায় চলে গেলেন। বেলা চারটের সময় যে স্বর্ণকার সোনার গোপাল নির্মাণ করছিল, সে এসে সিংহাসনের মাপটা জানতে চায়। কেননা যে মাপ সে পূর্বে নিয়ে গিয়েছিল, সেটা সে হারিয়ে ফেলেছে। তাঁর ধরণা হচ্ছে, সোনার মূর্তির নীচেকার অংশ যেন একটু বড় হয়ে গেছে। সেই সময় রাজাবাহাদুর আয়রন সেফ খুলে ঝাপি তুলে দেখেন ঝাপি শূন্য; সিংহাসন তার মধ্যে নেই অথচ তাঁর স্পষ্ট মনে আছে, মাত্র দুদিন আগেও একবার যখন তিনি সেফ খোলেন, ঝাপি খুলে দেখেছিলেন সিংহাসন ঝাঁপির মধ্যে আছে।

সেফের মধ্যে যে ঝাঁপিতে সিংহাসন আছে সকলেই তা জানত, না?

হ্যাঁ, কিংবদন্তীর মতই সিংহাসনের অস্তিত্বটা কারো কাছেই গোপন ছিল না।

তবে ঝাঁপির মধ্যে যে ঐ সেফে সেটে থাকত, সেটা আমি, আমার স্ত্রী ও মা ছাড়া আর চতুর্থ ব্যক্তি কেউই জানত না।

আর কেউ জানত না। আপনি ঠিক জানেন?

নিশ্চয়ই।

আপনার মা বাইরের কারো কাছে কোনদিন গল্পচ্ছলেও কি বলে থাকতে পারেন না?

পারেন, কিন্তু আমি আমার স্ত্রী ও মাকে ভালভাবেই চিনি, তাঁদের কেউ অন্যের কাছে সে কথা বলতে পারেন না।

কথায় বলে স্ত্রীলোকের মন, গোপনকে গোপন না রাখাটাই তাদের ধর্ম। জানেন না মহাভারতে যুধিষ্ঠির তাঁর মা কুন্তী দেবীকে কি অভিসম্পাত দিয়েছিলেন!। কিন্তু যাক সে কথা। ওটা সামান্য একটা কিংবদন্তী মাত্র। হ্যাঁ ভাল কথা, আপনার ভৃত্য ভজু তো শুনেছি। এ বাড়িতে বহুকাল আছে, সেও জানত না?

না। তবে সে এ ঘরে প্রায়ই আসে।

কখনও কি মনে হয়েছে, আপনি সিন্দুক খুলেছেন সে এসে পড়েছে?

না, সিন্দুক খোলবার আগে বরাবরই আমি ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিই।

আচ্ছা, আপনার ঘরের এই গুপ্তদ্বারের কথা। আপনি ছাড়া আর কেউ জানে?

আমার মা আর আমার স্ত্রী।

হুঁ, আমার মনে পড়ছে সেই কিংবদন্তী। মনে মনেই কিরীটী কথাগুলো উচ্চারণ করলে।

আপনি যখন ঘুমোন, তখন আপনার সেফের চাবি কোথায় থাকে?

আমার লেখবার ড্রয়ারে।

ঘুমোবার সময় আপনার শয়নকক্ষের দরজা তো বন্ধই থাকে, না?

হ্যাঁ।

সে রাত্রেও ছিল? মানে যেদিন আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন?

হ্যাঁ। ঘুম ভেঙে উঠে তাই দেখেছিলাম, দরজা ভিতর থেকে বন্ধই ছিল।

আচ্ছা, এই গুপ্ত দ্বারের কথা তাপনার কাকামশাই জ্ঞানদাশঙ্করবাবুও জানতেন না?

না, আমার বাবাই জানতেন এবং মৃত্যুশয্যায় আমাকে বলে যান।

আপনার খুড়োমশাইয়ের সঙ্গে তো কই পরিচয় হল না? তিনি কি এখানে নেই?

আছেন। কাল পরিচয় করিয়ে দেব। চমৎকার লোক। আলাপ করে সুখী হবেন। আমায় অত্যন্ত স্নেহ করেন।

পরের দিন সকালে ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে কিরীটী গত রাত্রের সেই ঝাঁপিটি কোলের ওপর নিয়ে দেখেছিল।

ঝাঁপির ভিতরটা দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা জিনিস তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সূক্ষ্ম রুপাের তারের সঙ্গে সেটা আটকে আছে। আনন্দে উত্তেজনায় তার চোখের দৃষ্টি জ্বলজ্বল করে উঠল। জিনিসটা সে ঝাঁপির মধ্যে থেকে বের করে পকেটে রেখে দিল।

এমন সময় দরজায় করাঘাত শোনা গেল। কিরীটী উঠে দরজা খুলে দিল। ঘরে প্রবেশ করলেন রাজাবাহাদুর এবং তাঁরই মত সুশ্ৰীগড়ন আর একজন প্রৌঢ়। প্রৌঢ়ের পরিধানে দামী মিহি ঢাকাই ধুতি, গায়ে দামী শাল।

ইনি আমার কাকা, জ্ঞানদাশঙ্কর রায়। রাজাবাহাদুর বললেন।

নমস্কার। কিরীটী হাত তুলে নমস্কার জানাল।

এ-কথা সে কথার পর কিরীটী সহসা প্রশ্ন করল, শেষরাত্রের দিকে সেতারের বাজনা শুনছিলাম, রাজাবাহাদুর!

হ্যাঁ, রাজাবাহাদুরই ভোররাত্রের দিকে সেতার বাজাচ্ছিলেন। উনি একজন নামকরা সেতার-বাজিয়ে। কথাটা বললেন জ্ঞানদাশঙ্কর।

সত্যি, চমৎকার হাত আপনার রাজাবাহাদুর!

হ্যাঁ, লক্ষ্মেীতে শিক্ষণ করেছিলাম। আমীর খাঁর কাছে। শুনেছেন বোধ হয় তার নাম?

হ্যাঁ, ওদিকটায় আমারও একটু ঝোক আছে কিনা। আমি কিছু কিছু চর্চা করি।

বটে! কি বাজান আপনি?

এস্রাজ ও ব্যাঞ্জো। সামান্যই শিখেছি।

রাজাবাহাদুর অত্যন্ত খুশী হয়ে উঠলেন। ঠিক হল সন্ধ্যার দিকে একটু গান-বাজনা করা যাবে। এরপর রাজাবাহাদুর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিরীটী খুড়োমশায়ের সঙ্গে গল্প করতে লাগল। অনেকক্ষণ ধরে। খুড়োমশায়ের কাছে রাজাবাহাদুর বলেছিলেন, কিরীটী তার পরিচিত বন্ধু! শ্ৰীনগরে বেড়াতে এসেছেন দু-চার দিনের জন্য।

রাজাবাহাদুরের মুখেই কিরীটী শুনেছেন, সিংহাসনটার ওজন প্রায় তিন পোয়া হবে। খুব একটা ভারী জিনিস নয়। তার ইচ্ছা ছিল, বাড়ির অন্যান্য সকলকে ডেকে সে দু-চারটা কথাবার্তা বলে, কিন্তু রাজাবাহাদুর বলেছেন, আর দু-একদিন বাদে কৌশলে তাকে সে কাজ করতে হবে। ঘৃণাক্ষরে যেন কেউ তার এখানে উপস্থিতির উদ্দেশ্য না টের পায়। তা হলেই সমস্ত ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবে।

পরের দিন দ্বিপ্রহরে রাণীসাহেবা শ্ৰীনগরে ফিরে এলেন। রাজাবাহাদুরের মুখে সেকথা শুনে কিরীটী তার নিকট এক অদ্ভুত প্রস্তাব উত্থাপন করল। সে বলল, সিংহাসন চুরি যাওয়ার ব্যাপারটা রাণীসাহেবকে বলতে হবে এবং সেটা আমারই সামনে।

অনুরোধটা যেন কেমন! কিন্তু এই কদিনের আলাপেই রাজাবাহাদুরের কেমন একটা শ্ৰদ্ধা জন্মে গিয়েছিল কিরীটীর ওপরে। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন।

রাজাবাহাদুরের চিন্তান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে সহাস্যে কিরীটী বললে, আমি বুঝতে পারছি, আপনার কোথায় সঙ্কোচ হচ্ছে রাজাবাহাদুর! কিন্তু অনুসন্ধানের ব্যাপারে ওটা অপরিহার্য। তাছাড়া ভেবে দেখুন, আপনার উৎসবের দিন সমাগত, যেমন ভাবেই হোক আমাদের মিলিত চেষ্টা করতেই হবে হাত সিংহাসনটি পুনুরুদ্ধারের জন্য।

রহস্যের কোন সূত্র কি আপনি পেয়েছেন মিঃ রায়?

সামান্য কয়েকটা সূত্র ধরে একটা অসম্পূর্ণ মীমাংসায় পৌঁছেছি মাত্র।

ঐদিনই সন্ধ্যায় রাজাবাহাদুর কিরীটীর প্রস্তাবমত রাণীসাহেবার কাছে কিরীটীর সামনেই ঘটনাটি প্রকাশ করবেন।


সন্ধ্যার অল্প পরেই কিরীটীর কক্ষে সকলে মিলিত হলেন।

রাণীসাহেবকে দেখে কিরীটী মুগ্ধ হয়েছিল, শুধু দৈহিক সৌন্দর্যের দিক দিয়েই নয়, তীক্ষবুদ্ধির সংযতস্বভাবা রাণীসাহেবা সত্যিই একটা রত্ন-বিশেষ। রাজকীয় সম্মানের উপযুক্তা।

দু-চার মিনিট সাধারণ আলাপ-আলোচনার পর সহসা কিরীটী তীক্ষ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে রাণীসাহেবার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, রাণীসাহেবা, আপনি এখনও শোনেননি, কেন আমি আপনাদের প্রাসাদে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছি?

রাণীসাহেবা তাঁর পরিপূর্ণ দৃষ্টি কিরীটীর প্রতি তুলে ধরেন।

আপনি জানেন, আপনাদের গৃহদেবতার প্রতিষ্ঠার উৎসব সমাগত, কিন্তু একথা এখনও জানেন না যে, সেই উৎসবে কত বড় বিষ্ম এসে দাঁড়িয়েছে। আপনাদের পূর্বপুরুষের তৈরী আসন্ন উৎসবের প্রধান অঙ্গ মূল্যবান বত্ৰিশসিংহাসনটি আপনাদের শয়নকক্ষের আয়রন সেফ থেকে অপহৃত হয়েছে।

কিরীটী দেখলে, সংবাদটি শুনে রাণীসাহেবার সমগ্র শরীর যেন মূহুর্তে বংশপত্রের মত সহসা বারেকের জন্য কেঁপে উঠে পরীক্ষণেই আবার স্থির হয়ে গেল। সহসা তিনি যেন ঘটনার আকস্মিকতায় পাথরের মত স্তব্ধ অনড় হয়ে গেছেন! অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে ক্ষণকাল তিনি কিরীচীর সপ্রশ্ন কঠিন দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলেন, তার পর পার্শ্বে উপবিষ্ট স্বামীর দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ অথচ দৃঢ়স্বরে প্রশ্ন করলেন, একথা তো তুমি আমায় বলেনি? কণ্ঠস্বরের ভিতর দিয়ে যেন একটি কঠিন ভৎসনার সুর মূর্ত হয়ে উঠল। বললেন, একথা কি সত্যি?

হ্যাঁ মালতী, এ ঘটনায় আমি একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছি।

কবে এ দুর্ঘটনা ঘটল?

সম্ভবত যেদিন তুমি তোমার বাপের বাড়ি যাও, তার আগের দিন রাত্রে।

মানে যে রাত্ৰে তুমি অসুস্থ হয়েছিলে?

হ্যাঁ।

সে রাত্রের কথা আপনার সব মনে আছে। রাণীসাহেবা? প্রশ্ন করল এবারে কিরীটী।

কি আপনি জানতে চান বলুন?

সে রাত্রের আনুপূর্বিক ঘটনা সব আমায় বলুন, যতটা আপনার মনে আছে।

সন্ধ্যার দিকে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমার ভাই শশাঙ্ক সেদিন এখানে ছিল, তারই সাহায্যে ওঁকে আমরা ওঁর শয়নকক্ষে নিয়ে যাই। শয্যায় শুইয়ে দেওয়ার পর উনি যেন কেমন অজ্ঞানের মত রইলেন, ডাকলে সাড়া দেন না, চোখ দুটো বোজা, ক্ষীণ শ্বাস-প্রশ্বাস।

কতক্ষণ আমন অবস্থায় ছিলেন?

রাত্রি একটার পর আমি ঘুমাই, তখন পর্যন্ত ওই অবস্থায়ই ছিলেন। শেষের দিকে ঘুমের ওষুধ দেওয়ায় বোধ করি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

কে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল?

আমার ভাই শশাঙ্ক ডাক্তার। সে-ই দিয়েছিল।

রাত্ৰি কটা পর্যন্ত আপনার ভাই আপনাদের শয়নকক্ষে ছিলেন?

তীব্র দৃষ্টিতে রাণীসাহেবা কিরীটীর দিকে তাকালেন, পরে শান্ত স্বরে বললেন, তা রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত হবে। তার পর তাকে আমি একপ্রকার ঠেলোঁঠুলে শুতে পাঠাই।

সে রাত্রে আপনার ভাই শুতে যাওয়ার পর, যতক্ষণ আপনি জেগে ছিলেন, আপনাদের শয়নকক্ষে কোনরকম অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক কিছু দেখেছিলেন বলে আপনার মনে হয়?

না।

সে রাত্রে কখন আপনার ঘুম ভাঙে?

শেষ রাত্ৰে।

তখন রাজবাহাদুর জেগে ছিলেন?

হ্যাঁ, জেগে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন।

হঠাৎ কিরীটী রাজাবাহাদুরের দিকে তাকিয়ে একটি অদ্ভুত অনুরোধ জানাল, রাজাবাহাদুর, আর একটি অনুরোধ আপনার কাছে আমার আছে।

বলুন।

আমি রাণীসাহেবকে একাকী কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই অর্থাৎ এ ঘরে আমি ও রাণীসাহেবা ছাড়া আর তৃতীয় কেউ থাকবে না।

বেশ তো, করুন। রাজাবাহাদুর উঠে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ ভাবে কিরীটী বসে রইল। ঘরের মধ্যে অখণ্ড স্তব্ধতা। ইতিমধ্যে সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে ঘরখানি অবলুপ্ত হয়েছিল। কিরীটী উঠে পকেট থেকে দেশলাই বের করে ফস করে সামনের শ্বেতপাথরের টেবিলের ওপরে রক্ষিত মোমবাতিটা জ্বালাল। নিমেষে। ঘরের অন্ধকার দূরীভূত হল।

রাণীসাহেবা মাথা নীচু করে বসে ছিলেন। কিরীটী রাণীসাহেবার দিকে একবার তাকিয়ে প্রশ্ন করল, রাণীসাহেবা, আপনার স্বামী কি সেদিনকার মত আর কখনও পূর্বে অসুস্থ হয়েছিলেন?

রাণীসাহেবা কিরীটীর দিকে চোখ তুলে চেয়েই, আবার দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন।

না।

এর আগে কখনও কোনদিনও আমনি অসুস্থ হন নি?

না।

আপনার ভাইয়ের পুরো নাম কি?

শশাঙ্কশেখর সান্যাল।

ডাঃ শশাঙ্কশেখর সান্যাল-আমি এক সান্যালকে জানি নামকরা ম্যাজিসিয়ান!

সেই ম্যাজিসিয়ানই আমার ভাই। আপনি তাকে চেনেন?

চিনি না, তবে দু-চারবার তাঁর মেসমেরিজম দেখেছি ইউনিভারসিটি ইনষ্টিটিউটে। তিনি একজন নামকরা বীণাবাদকও বটে, তাই না?

হ্যাঁ।

আপনার স্বামীও শুনেছি চমৎকার সেতার বাজান!

হ্যাঁ।

আচ্ছা, আপনি এবার যেতে পারেন রাণীসাহেবা।


পরের দিন সন্ধ্যার দিকে কিরীটী কলকাতায় চলে গেল। বলে গেল, দিন দুয়েকের মধ্যেই ফিরবে, এবং সত্যি-সত্যিই দিন দুই বাদে আবার ফিরে এল। মূর্তি প্রতিষ্ঠার আর মাত্র দুদিন বাকি আছে।

এসে শুনল রাণীসাহেবার ভাই ডাঃ সান্যালও এসেছেন।

দ্বিপ্রহরের দিকে রাজাবাহাদুরই স্বয়ং রাণীসাহেবার ভাইকে কিরীটীর ঘরে এনে আলাপ করিয়ে দিলেন। সুশ্ৰী চেহারা, দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। গায়ের রং উজ্জ্বল গৌরবর্ণ। বেজায় হাসি-খুশী ও আমুদে। কিরীটী ডাঃ সান্যালের সঙ্গে আলাপ করে মুগ্ধ হল।

কথায় কথায় কিরীটী ডাঃ সান্যালকে বললে, আপনার মেসমেরিজম করা দু-একবার আমি দেখেছি ডাঃ সান্যাল, আজ একবার দেখান না!

ডাঃ সান্যাল হাসতে হাসতে বললেন, বেশ তো, খাওয়াদাওয়ার পর হবে’খন আজি রাত্রেই। জামাইবাবু চমৎকার মিডিয়াম। চট্ট করে ওঁকে মেসমেরাইজ করা যায়।

তাই নাকি, রাজাসাহেব! আমিও এককালে যখন ফোর্থ ইয়ারে পড়ি যাদুকর গণপতির কাছে মেসমেরিজম বিদ্যা শিক্ষা করেছিলাম।

সত্যি? আপনিও জানেন নাকি?

সামান্যই, তবে ভাল মিডিয়াম হলে কখনও কখনও কৃতকার্য হয়েছি।


রাত্রি তখন বোধ করি নটা সাড়ে নটা হবে।

ঠিক হল আগে কিছুক্ষণ গান-বাজনা হবার পর ম্যাজিক শুরু করা যাবে।

কিরীটীর ঘরেই সকলে সমবেত হয়েছেন; কিরীটী, রাজাবাহাদুর জ্ঞানদাশঙ্কর, ডাঃ সান্যাল ও রাণীসাহেবা মালতী দেবী।

প্রথমে সকলের অনুরোধে কিরীটী ব্যাঞ্জো বাজালে। সকলেই মুগ্ধ হল। তার পর রাজাবাহাদুর। তাঁরও বাজনার হাত চমৎকার।

সর্বশেষ পড়ল ডাঃ সান্যালের পালা। কিন্তু তিনি তার পার্শ্বস্থিত খাপে মোড়া প্রকাণ্ড বীণাখনির দিকে সন্দেহে একবার দৃষ্টিপাত করে সখেদে বললেন, আমার বীণার একটা অংশ গাড়িতে আসবার সময় ফেটে গেছে। আজ বীণা থাক। আপনাদের আজ আমি বঁশের বাঁশী শোনাব। ডাঃ বাঁশীতে সুর দিলেন। বাঁশীতেও তাঁর শক্তি অদ্ভুত। মূহুর্তের মধ্যে তিনি ঘরের মধ্যে অপূর্ব সুরের জাল সৃষ্টি করলেন সামান্য সেই বাঁশের বাঁশীতেই, বীণাখনি পাশেই পড়ে রইল। বাজানা থামবার পর আবার সকলের অনুরোধে ডাঃ সান্যাল বাঁশী তুলে নিলেন। এবার তিনি বাজালেন জয়-জয়ন্তী সুর। নিশীথের নিস্তব্ধতায় সামান্য বাঁশের বাঁশী থেকে যে সুরের ঝর্ণ প্রবাহিত হল তা সত্যই অপূর্ব।

বাজনা শেষ হতেই কিরীটী আচমকা উঠে দাঁড়াল, রাজাবাহাদুর, এবারে আমি আমার ম্যাজিক দেখাব। কিন্তু তার আগে আমি ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে রাখি। ঘরের মধ্যে এখন যাঁরা উপস্থিত আছেন, তাদের মধ্যে দুজন, কাকাবাবু ও ডাঃ সান্যাল, আপনাদের কাছেই বিশেষ করে আমার ক্ষমা চাওয়া; কেন যে ক্ষমা চেয়ে রাখছি, এর পর যা ঘটবে, সেটা থেকেই আপনারা দুজনে সহজেই বুঝতে পারবেন। কিন্তু যাক সে কথা। রাজাবাহাদুর, আপনি আমার সামনে এসে বসে, আমার চোখের দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে থাকুন তো। আমার চোখে একটা অদ্ভুত নীল আলো লুকানো আছে। ম্যাজিকের প্রভাবে সেটা সকলের দৃষ্টিগোচর করতে পারি। একে একে আমি সকলকেই দেখােব। শুরু হোক রাজাবাহাদুর থেকে।

মৃদু হেসে রাজাবাহাদুর কিরীটীর সামনে এসে বসলেন, তাকালেন কিরীটীর চোখের দিতে।

ভালো করে আনন্যমনা হয়ে একদৃষ্টি তাকান। দেখতে পাবেন। শুধু ভাবুন আমার চোখ দুটি।-ভুলে যান জগৎ সংসার সব কিছু। ভুলে যান। আপনি কে, কোথায়, কেন? শুধু আমার চোখ-হ্যাঁ, আমার চোখ…

এক মিনিট, দু মিনিট করে মিনিট দশেক কেটে গেল। রাজাবাহাদুর ও কিরীটী পরস্পর চোখের দিকে তাকিয়ে। ঘরের সব কটি প্রাণী বাক্যাহারা।

সহসা কিরীটীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল। এ যেন সে কিরীটীর একটু আগে শোনা কণ্ঠস্বর নয়। বৰ্জগভীর নির্দেশ বের হয়ে আসে কিরীটীর কণ্ঠস্বরে, রাজাবাহাদুর।

মন্ত্ৰমুগ্ধ রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বরে শোনা গেল, বলুন! যেন বহু বহু দূর হতে ভেসে আসছে।

আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?

হ্যাঁ। ক্ষীণ উত্তর।

আপনাদের পূর্বপুরুষের বত্রিশ সিংহাসনটি চুরি গেছে না?

হ্যাঁ ঘরের একমাত্র জ্ঞানদাশঙ্কর চমকে উঠলেন, কিরীটীর ইঙ্গিতে চুপ করে রইলেন।

আপনি জানেন সেটা কোথায় আছে?

না তো।

নিশ্চয়ই জানেন। আজ থেকে ঠিক তেরো দিন আগে এমনি একটি রাত্রির কথা মনে করুন। মনে করে দেখুন। নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন। সে রাতের কথা মনে পড়ছে এখন?

হ্যাঁ, পড়ছে। সহসা এমন সময় অতর্কিতে দপ করে ঘরের মধ্যের একটিমাত্র মোমবাতি নিভে গিয়ে নিশ্চিদ্র আঁধারে সমগ্র ঘরখানি যেন দৃষ্টি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল! মালতী দেবী অর্ধস্ফুট কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন। আলো জ্বালাতেও বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল।

রাজাবাহাদুর তেমনি ভাবেই স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে আছেন, মাথাটা নীচের দিকে ঝুলে পড়েছে, চোখ দুটি অর্ধনিমীলিত, যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুমুচ্ছেন।

অখণ্ড নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কিরাটাই আবার সর্বপ্রথম বললে রাজাবাহাদুরকে সম্বোধন করে, আপনিই রুপোর ঝাঁপিটা আপনার শয়নঘরের আয়রন সেফ থেকে সে রাত্রে বের করে নিয়ে আসেন, কেমন তাই না? বলুন, কোথায় রেখেছেন সেটা?

হ্যাঁ—কিন্তু আমার মনে পড়ছে না কোথায় রেখেছি সেটা! না, মনে পড়ছে না।

এরপর ধীরে ধীরে কিরীটী রাজাবাহাদুরের মোহনিদ্রা ভাঙিয়ে দিল। ঘরের সব কয়টি প্রাণীই নির্বাক। কারো মুখে কোন কথা নেই। যাদুমন্ত্ৰে যেন সকলেই বাক্যহীন হয়েছে।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *