আশ্বিন মাসে পুজোর পর
আশ্বিন মাসে পুজোর পর থেকেই নিমাদের মনে হতে লেগেছে যে, সে বুড়ো হচ্ছে। বয়সের হিসেব সে জানে না। কিন্তু বুড়ো যে হচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তা বলে কি নিমচাঁদ এক প্যাকেট তাস একসঙ্গে ধরে দু’হাতে এক টানে ছিঁড়ে ফেলতে পারে না? পারে। দু’মন লোহার বারবেল কি এক ঝটকায় মাথার উপর তুলে ফেলতে পারে না? পারে। হাতের কানা দিয়ে এখনও কি সে নারকোল ফাটাতে পারে না? খুব পারে। মোটা নাইলনের দড়ি দু’হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে কি তার খুব কষ্ট হচ্ছে আজকাল? হচ্ছে বোধহয়, তবে ছিঁড়েও ফেলছে। আর রাজবাড়ির বড় কামানটা যে সেদিন বাগানের উত্তর দিক থেকে তুলে নিয়ে দক্ষিণ দিকে বসাতে হল, তাতে কি গা ঘামাতে হল তাকে? তেমন কিছু নয়।
তবু নিমাদের ক’দিন হল মনে হচ্ছে, বুড়ো হতে আর বিশেষ বাকি নেই। তার বুড়ো বয়স এসে দরজায় কড়া নাড়ল বলে!
সকালে কথাটা তার ছেলে ভীমচাঁদকেও বলল। ভীমচাঁদের বয়স মোটে বারো।
“বুঝলি রে ভেমো, আমি বোধহয় শেষ অবধি বুড়োই হয়ে গেলুম।”
ভীমচাঁদ জানলার কাছে বসেইসকুলের পড়া করছিল। ভারী অবাক হয়ে বলল, “তাই নাকি বাবা? তা হলে তো বড় মুশকিল হল?”
“কেন রে? মুশকিলটা কীসের? বয়স হলে মানুষ তো বুড়োই হয়।”
“কিন্তু নোয়াপাড়ার ছেলেরা যে তা হলে দলবেঁধে আমাকে পেটাবে?”
“তোকে পেটাবে! কেন, তুই কী করেছিস?”
“ওদের ক্লাবের সেক্রেটারি গোবিন্দ নতুন সাইকেল কিনে খুব কায়দা করে চালাচ্ছিল দেখে আমি হিংসের চোটে ঢিল মেরে গোবিন্দর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলুম যে! তখনই ওরা শাসিয়ে রেখেছে, তোর বাবার গায়ে তো আর চিরকাল জোর থাকবে না। যখন বুড়ো হবে, তখন দলবেঁধে তোকে পেটাব। দেখব, তোর বাবা কী করতে পারে?”
নিমচাঁদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তাহলে হাটুরে মার খাওয়ার জন্য তৈরি হ’ রে ভেমো। আমি সত্যিই বুড়ো হতে চললুম।”
“তোমার গায়ে কি আর একটুও জোর নেই বাবা?”
দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে নিমচাঁদ বলল, “না রে বাবা, জোর বল খুবই কমে যাচ্ছে। পরশু দিন শিবাইচণ্ডীতলা দিয়ে আসছিলুম, দেখলুম, আমাদের দাগি ষাঁড় ভোলা বটতলায় শুয়ে আছে। শিং ধরে কতবার ভোলার ঘাড় মুচড়ে দিয়েছি। তা ভাবলুম, আজও একটু মুচড়ে দিই। ঠেলাঠেলি করে তাকে তোলার পর ভোলা রেগেমেগে তেড়ে এল বটে, আর আমিও তার ঘাড় মুচড়ে দিলুম ঠিকই। কিন্তু নাঃ, ঠিক আগের মতো হল না। ভোলাও যেন সেটা টের পেয়ে মিচিক মিচিক হাসছিল।”
ভীমচঁদ খুব চিন্তিতভাবে বলল, “তা হলে তো বড় মুশকিল হল বাবা। ইসকুলের নগেনমাস্টারমশাই পড়া না করলে সবাইকেই খুব বেত মারেন, শুধু আমাকে ছাড়া। তুমি বুড়ো হয়েছ জানলে যে নগেনস্যার আমাকে মেরে পাট পাট করবেন।”
“তা হলে বরং লেখাপড়াতেই মন দে রে ভেমো। আর আমার ভরসায় বসে থাকিস না।”
ভীমচাঁদ কাদো কাঁদো হয়ে বলল, “কিন্তু বাবা, তা হলে যে এখন থেকে লবঙ্গলতা স্টোর্সের বিশে আর বিনা পয়সায় লজেন্স বা চকোলেট দেবে না! গদাইয়ের দোকান থেকে খাতা-পেনসিল বিনা পয়সায় তুলে আনাও চলবে না। ইসকুলে বন্ধুরা পালা করে টিফিনের ভাগ দেবে না।”
নিমাদ দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হাতি কাদায় পড়লে কী হয় জানিস তো? না না, এখন থেকে তোরা সব ন্যায্য পয়সা দিয়েই জিনিসপত্তর কিনিস বাপ! আর গাজোয়ারি করে তুলে আনিস না।”
“ইস, তুমি আর কটা দিন পরে বুড়ো হলে আমি ততদিনে ক্লাস পরীক্ষাটাও পাশ করে যেতাম!”
“উঁহু, আর ওসব নয়। তিন-চার বিষয়ে ফেল মেরেও নতুন ক্লাসে ওঠা আর চলবে না। এখন থেকে সব বিষয়ে পাশ নম্বর পেতে হবে।”
নিমাদের বউ খবর পেয়ে হুলস্থূল হয়ে এসে ঘরের মধ্যে আছড়ে পড়ল, “ওগো, এ কী সব্বোনেশে কথা শুনছি! তুমি নাকি বুড়ো হয়েছ?”
“আহা, তাতে চেঁচামেচির কী আছে? বয়স হলে বয়সের নিয়মেই বার্ধক্য আসে। হুঁ হুঁ বাবা, এ হল অঙ্কের হিসেব।”
“কিন্তু আমার কী দুর্দশা হবে ভেবে দেখেছ? পাশের হাজরাবাড়ির কুঁদুলি বউটা পাড়ার সকলের সঙ্গে নেচে নেচে ঝগড়া করে বটে, কিন্তু আমি কিছু বললে বা দু’কথা শোনালে চুপ করে থাকে, রা-টি কাড়ে না। এখন তো সে আমারও বিষ ঝেড়ে দেবে রোজ। গলার হার ভেঙে এই যে বালা গড়িয়েছি, স্যাকরা কথাটি কয়নি। কিন্তু এখন সে কি মজুরি আদায় না করে ছাড়বে? আমি পাড়ায় বেরোলে লোকে কত খাতির করে রাস্তা ছেড়ে দেয়, রিকশাওয়ালা বিনা ভাড়ায় খেপ দিয়ে দেয়। আর কি ওসব হবে? এখন যে দুধওয়ালাও দুধের দাম চাইবে গো।”
নিমাদ গম্ভীর হয়ে বলল, “ওসব ভুলে যাও গিন্নি। এখন থেকে লোকের সঙ্গে ভাবসাব রেখে চলো। মনে রেখো, গয়না গড়ালে মজুরি দিতে হবে, রিকশায় উঠলে ভাড়া মেটাতে হবে, দুধ খেলে দাম দিতে হবে। আর এটাও যেন খেয়াল থাকে, সেইদিন আর নাই রে নাতি, থাবা থাবা চিনি খাতি।”
না, সেই দিন আর নেই-ই বটে। নিমচাঁদ যে বুড়ো হল! খুব চিন্তিত মুখে পাড়ায় বেরিয়ে খুব ধীরে ধীরে টুকটুক করে হাঁটছিল নিমচাঁদ। বয়স হয়েছে, এখন হুড়দৌড় করে হাঁটাচলা ঠিক হবে না। বুড়ো বয়সের নিয়মকানুন সব মেনে চলতে হবে। অধিক উত্তেজনা বারণ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বন্ধ, হাঁকডাক করা নিষেধ।
সে রাস্তায় বেরোলে চারদিকটা ভারী শুনশান হয়ে যায়, লোকজন সিঁটিয়ে থাকে, বাচ্চারাও কাঁদে না, লোকের কথাবার্তা, চায়ের দোকানে আড্ডা সবই যেন থেমে থাকে। আজও সেরকম হচ্ছে।
তবে এ আর ক’দিন? এরপর একদিন রাস্তায় বেরোলে তাকে দেখে আশপাশের লোকেরা টিটকিরি দেবে, বক দেখাবে, ছেলেপুলেরা পিছনে লাগবে, কেউ আর ফিসফিস করে একে অন্যকে বলবে না, “ওই দ্যাখ, নিমেপালোয়ান যাচ্ছে।’
রাস্তার ধারে একটা নধর ঝুপসি সজনেগাছ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল নিমচাঁদ। নিজের গায়ের জোর-বল নিয়ে আজকাল প্রায়ই তার খুব সংশয় হচ্ছে। তার ঘোর সন্দেহ, আগের মতো ক্ষমতা তার আর নেই। দোনোমনো করে সে গুটি গুটি সজনেগাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে তার দু’খানা মজবুত হাতে গাছটাকে সাপটে ধরে ‘হেঁইও’ বলে একটা হ্যাঁচকা চাড় দিতেই গাছটা কেঁপে উঠে যেন মানুষের গলাতেই চাপা স্বরে বলে উঠল, “বাপ রে! তবে গাছটা ওপড়াল না। নিমাদ আর-একবার দম নিয়ে ফের গাছটাকে সাপটে ধরে চাড় দিতেই গাছটা যেন একটা মর্মর ধ্বনি তুলে বলে উঠল, “হচ্ছেটা কী?’ নিমাদ আর-একবার গভীরভাবে শ্বাস টেনে গাছটাকে শক্ত করে ধরে চাড় মারতেই ঝুম্বুস করে শেকড়বাকড় আর মাটির চাঙড় সমেত গাছটা বিঘতখানেক উপরে উঠে পড়ল। নিমচাঁদ একটা স্বস্তির খাস ছেড়ে গাছটাকে আবার জায়গামতো বসাতেই উপর থেকে হুড়মুড় করে ডালপালা সমেত একটা লোক, “ভূমিকম্প হচ্ছে! ভূমিকম্প হচ্ছে।” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে মাটিতে চিতপাত হয়ে পড়ে গেল।
নিমাদ ভারী অপ্রস্তুত! তাড়াতাড়ি লোকটাকে তুলে দাঁড় করিয়ে ধুলোটুলো ঝেড়ে বলল, “অঘোরখুড়ো যে!”
অঘোরখুড়ো কঁকালের ব্যথায় মুখ বিকৃত করে বললেন, “ভূমিকম্প হচ্ছে যে! টের পাসনি?”
নিমাদ আমতা আমতা করে বলল, “ভূমিকম্প হচ্ছিল নাকি?”
“তোর কি ভীমরতি হল যে, এত বড় ভূমিকম্পটা টের পেলি না! একটা ব্লাডপ্রেশারের ওষুধ তৈরি করব বলে সজনে ফুলের সন্ধানে গাছে উঠেছি কী, অমনি সে কী কাঁপুনি আর দুলুনি রে বাবা! ওঃ, মাজাটা বুঝি ভেঙেই গিয়েছে রে, ডান হাতের কনুইটাও যেন অসাড়। বুড়ো বয়সে হাড় ভাঙলে কি আর জোড়া লাগবে রে বাপ!”
নিমাদের ভারী মনস্তাপ হল। গাছের গোড়ায় ছেড়ে রাখা হাওয়াই চটিজোড়া সে দেখেও তেমন খেয়াল করেনি। বুড়ো বয়সের চিন্তায় ভারী মনমরা হয়েছিল তো! লজ্জিত মুখে সে বলল, “চলুন, আমি বরং কাঁধে করে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।”
“দিবি? তাই দে বাবা! হাঁটাচলা ক’দিনের জন্য বন্ধ হল কে জানে?”
অঘোরখুড়োকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিমচাঁদ জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা খুড়োমশাই, আপনি তো মস্ত কোবরেজ! মানুষের বুড়ো বয়সটা ঠিক কবে থেকে শুরু হয় বলুন তো?”
“ও বাবা, সে বলা খুব শক্ত। কেউ কুড়িতেই বুড়োটে মেরে যেতে থাকে, আবার কেউ নব্বইতেও বুড়ো হতে চায় না। ওর কোনও নিয়ম নেই যে! কেন রে, তোর হঠাৎ বুড়ো বয়সের চিন্তা কেন?”
“না, এই জেনে রাখা ভাল কিনা! তা বুড়ো হওয়ার কি কোনও নিয়ম নেই খুড়ো?”
“তা আছে বই কী, তবে সে বড় জটিল জিনিস, তুই বুঝবি না। এই যে আমি, এই আমাকেই দ্যাখ দেখি, চুরাশি বছর বয়সেও আঁদাড়ে-পাঁদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, গাছগাছালিতে উঠে পড়ছি, দাঁতে চিবিয়ে মাংসের হাড় গুঁড়ো করে ফেলছি।”
“তা বটে। তবে বুড়ো হওয়ার একটা নিয়মও তো আছে। ধরুন, বুড়ো বয়সেও কেউ যদি বুড়ো হতে না চায়, তা হলে কি সেটা ভাল দেখায় খুড়ো? লোকে নিন্দেমন্দও তো করতে পারে? বুড়োদের মধ্যে একটু বুড়োমি না থাকলে কি মানায়?”
“দুর আহাম্মক! তোর মাথায় বুড়ো বয়সের পোকা ঢুকেছে দেখছি। বলি, সত্যিই কি তোর ভীমরতি হল?”
“তা না হবে কেন বলুন? মা ষষ্ঠীর কৃপায় বয়স তো কম হল না! বেশ বুড়োই তো হয়েছি।”
“বটে! তা বুড়ো যে হলি টের পেলি কীসে?”
“আজ্ঞে, গায়ের জোর-বল কমে যাচ্ছে, সেই আগের মতো চটপটে হাত-পা নেই। তারপর ধরুন ক্ষুধামান্দ্যও হতে লেগেছে। দিনমানে এককাঠা চালের ভাত পথ্য ছিল, জামবাটি ভরতি ডাল, তিনপো মাছ, রাতে আশিখানা রুটি, সঙ্গে সেরটাক মাংস। তা এখনও খোরাক কমাইনি বটে, কিন্তু খেয়ে যেন আইঢাই হচ্ছে। তারপর ধরুন, চোখেও কি আর আগের মতো নজর আছে? ওই যে দুরে নারকেল গাছের ডগায় গাছের সঙ্গে গামছা দিয়ে কোমর জড়িয়ে লোকটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ও যে হরেন তা কি আর সত্যিই ঠাহর করতে পারছি? অনুমান করছি ওটা হরেনই হবে। তারপর ধরুন, আপনাদের দক্ষিণের দাওয়ায় যে একটা ন্যাড়ামাথাওলা লম্বাপানা লোক বসে মুড়ি আর শশা খাচ্ছে, তাও কি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি! আন্দাজে বলা! তারপর ধরুন, ওই যে গোচারণ মাঠের ওধারে বটতলায় নামাবলি গায়ে, চোখে চশমা এঁটে একটা লোক হাটুরেদের হস্তরেখা আর কুষ্ঠি বিচার করছে। ও যে আসলে কানু সেটা জানি বলেই বলতে পারছি।”
অঘোরখুড়ো আঁতকে উঠে বললেন, “কানু! কানু চশমা পেল কোথায়? অ্যাঁ! এ নিশ্চয়ই আমার চশমা! ওরে আমাকে নামা! নামা! এক্ষুনি ছুটে গিয়ে পাজিটাকে বমাল ধরতে হবে।”
“উত্তেজিত হবেন না খুড়ো! এই বয়সে উত্তেজনা ভাল নয়। কত চশমা যাবে, কত চশমা ফের আসবেও। কিন্তু উত্তেজনার বশে প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেলে তাকে কি আর হাতে-পায়ে ধরেও ফেরাতে পারবেন?”
অঘোরখুড়ো খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “আমার প্রাণবায়ু নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। প্রাণবায়ু তো বিনি পয়সার জিনিস, কিন্তু চশমার যে অনেক দাম!”
“কানুও তাই বলছিল বটে!”
“কী বলছিল?”
“চশমাটা পরলে নাকি ও ভূত-ভবিষ্যৎ দেখতে পায়।”
“বলিস কী সব্বোনেশে কথা? ওই চশমা পরে আমি বুড়ো হলুম, কখনও তো ভূত-ভবিষ্যৎ দেখতে পাইনি।”
“কিন্তু কানু পায়। নইলে এত লোকের ভূত-ভবিষ্যৎ গড়গড় করে বলে দিচ্ছে কী করে? আর সব ঠিকঠাক মিলেও তো যাচ্ছে।”
“কীরকম?”
“এই তো দিন সাতেক আগে নগেন বৈরাগীকে বলল, “মনে হচ্ছে তোমার কোমরে দড়ি পড়বে হে।’ শুনে ইস্তক নগেন তো গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে মরে। শেষে দারোগাবাবুর কাছে গিয়ে কান্নাকাটিও করে এল। দারোগাবাবু অভয় দিলেন, “ভয় নেই, তোকে গ্রেফতার করলেও কোমরে দড়ি পরাব না। তারপর কী হল জানেন? নগেন বৈরাগী জল তুলতে গিয়ে পা হড়কে কুয়োয় পড়ে গেল। তারপর সেই কোমরে দড়ি বেঁধেই কুয়ো থেকে তুলতে হল তাকে। তারপর মহেশ প্রামাণিকের কথাই ধরুন। ক’দিন আগে মহেশ প্রামাণিককে বলল, “যার নাম ‘ন’ দিয়ে শুরু তেমন জিনিস থেকে সাবধান। কী মুশকিল বলুন তো! মহেশের বাপের নাম নবীন, মা নগেন্দ্ৰবালা, বউ নলিনী, ভাই নরেশ, ছেলে নবকুমার, মেয়ে নীপবালা। মহেশ এখন যায় কোথায়? ভয় খেয়ে সে তার বড় শ্যালকের বাড়িতে গিয়ে ক’দিনের জন্য ঘাপটি মেরে রইল। তা একদিন বারান্দায় বসে পাকা কাঁঠালের ফলার সারছে, হঠাৎ বাড়ির কেলে গোরুটা ধেয়ে এসে মহেশকে গুঁতিয়ে সাত হাত দূরে ছিটকে ফেলে কাঁঠাল খেয়ে গেল। মাজা ভেঙে মহেশ সাতদিন শয্যাশায়ী। পরে জানা গেল সেই গোরুর নাম নাকি ‘নিশিপদ্ম। বুঝুন কাণ্ড!”
“তাই তো রে! তুই যে ভাবিয়ে তুললি! আমার চশমার যে এত গুণ তা তো আমিই এতকাল টের পাইনি!”
“আজ্ঞে, স্বাতী নক্ষত্রের জল, পাত্রবিশেষে ফল। সকলের কি সব কিছু সয় খুড়ো? নীলার আংটি যেমন, কারও হাতে গেলে পৌষমাস, কারও হাতে সর্বনাশ।”
অঘোরখুড়ো খুব চিন্তিত গলায় বললেন, “কথাটা বোধহয় খুব একটা মন্দ বলিসনি। চশমাটার মধ্যে কিছু অশৈলী ব্যাপার থাকলেও থাকতে পারে। ওটা চোখে দিলে মাঝে মাঝে কিম্ভুত সব জিনিস দেখা যায় বটে।”
“কীরকম খুড়ো?”
“আগে ভাবতুম বয়সের দোষে ভুলভাল দেখছি। কিন্তু এখন তলিয়ে ভেবে দেখলুম, সেটা চশমার গুণেও হতে পারে।”
“তা কী দেখতে পান খুড়ো? ভূতটুত নাকি?”
“ভূতও হতে পারে। তবে মাঝে মাঝে চশমাটা খুব আবছা হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ আবছায়া কেটে গিয়ে হয়তো দেখলুম, ঘরের মধ্যে একটা খুব ঢ্যাঙা লোক উবু হয়ে কী যেন খুঁজছে। সাড়া দিতেই ফুস করে কোথায় যেন সটকে পড়ল। তারপর ধর, আমার জানলার ওধারে কদমতলার মাঠ। জ্যোৎস্না রাতে মাঝে মাঝে দেখতে পাই কয়েকটা খুব ঢ্যাঙা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের গায়ের রং যেন কেমন সবজে সবজে।”
“তা হলে ও চশমা আপনি কানুকেই দান করে দিন খুড়ো। ও আপনার সইবে না।”
“দান করে দেব কী রে? ও যে খাঁটি সোনার চশমা! বটুকবুডোর বাতব্যাধির চিকিৎসা করেছিলুম। বটুক খুশি হয়ে মরার আগে চশমাজোড়া আমাকে দিয়ে যায়। আমার চোখেও দিব্যি ফিট হয়ে গেল। দিনের বেলা দিব্যি সব স্পষ্ট দেখা যায়। রাতের দিকেই যা একটু গন্ডগোল হয়।”
“চশমা ছাড়াই যখন আপনি সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, তখন ওই অলক্ষুনে চশমা চোখে দেওয়ার দরকার কী আপনার?”
“তা বটে, তবে কী জানিস, চশমা পরলে একটা ভারিক্কি ভাব আসে। লোকে একটু মান্যিগন্যি করে। চশমা একটা কেতার জিনিস তো! চোখে দিলে বাহারও হয় খুব!”
“যদি অভয় দেন তো একটা কথা কব?”
“কী কথা?”
“বলছিলুম কী, এখন কি আর আমাদের সেই বয়স আছে? এই জাগতিক তুচ্ছ জিনিসপত্রের উপর লোভ করা কি আমাদের শোভা পায়? আমাদের এই বুড়ো বয়সে তো জাগতিক বস্তু ছেড়ে পরমার্থেরই খোঁজ করা উচিত? কী বলেন?”
অঘোরখুড়ো খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “তুই বুড়ো হচ্ছিস তো যত খুশি হ। কিন্তু তোর দলে আমাকে ভেড়াচ্ছিস কেন? আমি মোটেও বুড়ো হইনি।”
নিমচাঁদ ভারী অবাক হয়ে বলল, “হননি? কিন্তু বয়সকালে বুড়ো হলে যে বড় সমস্যা হবে খুড়োমশাই!”
কথায় কথায় বাজারের কাছেপিঠে এসে পড়ায় লোকজন হাঁ করে দেখছিল তাঁদের। খগেন তপাদার বাজার সেরে ফিরছিল, দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করল, “বলি ও অঘোরখুড়ো, ভোটে জিতলেন, না ডবল সেঞ্চুরি করলেন?”
অঘোরখুড়ো খ্যাক করে উঠে বললেন, “তার মানে?”
“আজকাল তো দেখি ভোটে জিতলে, আর ডবল সেঞ্চুরি করলেই লোকে কাঁধে নিয়ে নাচানাচি করে। তা আপনার কোনটা?”
অঘোরখুড়ো ভারী অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “দ্যাখ খগেন, সব সময় রঙ্গ-রসিকতা ভাল নয়। কত বড় ভূমিকম্পটা হয়ে গেল দেখলি না? তার ধাক্কায় গাছ থেকে পড়ে মাজাটা ভেঙে দ’ হয়ে গেলুম, আর তুই রসিকতা করছিস?”
“তা ভূমিকম্প তো হয়েছিল এক বছর আগে, আপনার পড়তে এত সময় লাগল কেন বলুন তো? কত উঁচু গাছ যে, পড়তে এক বছর সময় লাগে?”
অঘোরখুড়ো খেপে গিয়ে বললেন, “তোরা কি নেশা করেছিস নাকি যে, এত বড় ভূমিকম্পটা টের পেলি না! মাত্র দশ মিনিট আগেই তো উপর্যুপরি ঝাঁকুনির চোটে আমি গাছ থেকে পড়লুম।”
বাজারের লোকজন মুখ তাকাতাকি করে বলতে লাগল, “না মশাই, ভূমিকম্প তো মোটেও হয়নি!”
খগেন তপাদার বলল, “ও ভূমিকম্প নয় খুড়ো, ও হল আপনার হৃৎকম্প।”
বিপদ বুঝে নিমচাঁদ ডবল গতিতে হাঁটা দিয়ে বলল, “সবার কথায় কান দেওয়ার দরকার কী আপনার বলুন তো খুড়োমশাই?”
অঘোরখুড়ো কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, “হারে, তুই না বুড়ো হয়েছিস? তোর নাকি হাতে-পায়ে আর আগের মতো জোর নেই! তা হলে এখন এই টাটুঘোড়ার মতো ছুটছিস কী করে?”
“ছুটছি নাকি?”
“আলবাত ছুটছিস!”
“ওইটেই বুড়ো বয়সের দোষ খুড়োমশাই, বয়সটা সব সময় খেয়াল থাকে না কিনা! ভীমরতিই হচ্ছে বোধহয়।”
“তোকে যে ভীমরতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে তা এখন আমি দিব্যি বুঝতে পারছি। ভেবে দেখলুম, যখন সবাই একই কথা বলছে, তখন একটু আগে যেটা হয়ে গেল সেটা মোটেও ভূমিকম্প নয়।”
নিমচাঁদ ভারী অবাক হয়ে বলল, “নয়! তা হলে কী হল বলুন তো?”
“কেউ গাছটা ঝাঁকিয়ে আমাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছিল।”
“এ তো ভারী অন্যায়।”
“তা তো বটেই। তা ভাবছি, অত বড় মজবুত একটা গাছকে ঝাঁকুনি দিয়ে নড়ানো তো যার-তার কম্মো নয়। মস্ত পালোয়ানের পক্ষেই সম্ভব। কী বলিস?”
কাঁচুমাচু হয়ে নিমচাঁদ বলল, “আজ্ঞে, ঠিক ইচ্ছে ছিল না খুড়োমশাই। কী করে যেন হয়ে গেল! বুড়ো বয়সের দোষ বলেই ধরে নিন।”
“বুড়ো বয়সের দোষ হবে কেন রে? এ সব নষ্টামি-দুষ্টামি কি বুড়ো মানুষের কাজ? এ তো করে বাচ্চা বখাটে ছেলেরা! তোর বয়স মোটেও বাড়ছে না, বরং কমছে। তুই আসলে ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছিস।”
চিন্তিত হয়ে নিমচাঁদ বলল, “এ তো বড় ধন্দে ফেলে দিলেন খুড়ো! বয়স বাড়ছে না কমছে, সেটাই যে এখন ঠিক ঠাহর পাচ্ছি না।