Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বাঞ্ছারাম তাঁর দিদি হৈমবতীকে বললেন

বাঞ্ছারাম তাঁর দিদি হৈমবতীকে বললেন, “দিদি, আকাশে যখন রসগোল্লাটা ওঠে, তখনই আমার ঠিক খিদে পায়।”

বাঞ্ছারাম যা বলেন, তাঁর দিদি হৈমবতী তাতেই সায় দিয়ে যান। কারণ, তিনি কানে শোনেন না। বাঞ্ছারামের আবোল-তাবোল কথা তাঁর কানে এক বর্ণও ঢোকে না। এ কথাটা শুনেও হৈমবতী বললেন, “তা তো ঠিকই।”

ল্যাবরেটরির বারান্দায় বাঞ্ছারাম একটা ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন। পাশে একটা মোড়ায় বসে হৈমবতী। হৈমবতীর বয়স আশির কোঠায়। বাঞ্ছারামের চেয়ে বাইশ বছরের বড়। এই দিদিই বাঞ্ছারামকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছিলেন। নিঃসন্তান এই দিদির কাছে বাঞ্ছারাম সন্তানের মতোই। বরাবরই

তাঁর যত আব্দার সব এই দিদির কাছে।

সন্ধের পর আকাশে বড়-সড় পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। বাঞ্ছারাম চাঁদের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “ইশ, কী বিরাট রসগোল্লা! কারা যে বানায়! রসে একেবারে টৈ-টুম্বুর।” বলে মুগ্ধ হয়ে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন চাঁদের দিকে। তারপর বাচ্চা ছেলের মতো আদুরে গলায় বললেন, “ও দিদি, আমি রসগোল্লা খাব। খিদে পেয়েছে।”

হৈমবতী মাথা নেড়ে বললেন, “যা বলেছিস। ছেলেটা নিশ্চয়ই খঙ্গপুর থেকে মাসির বাড়ি গেছে। আজ পর্যন্ত একটা চিঠি নেই।”

বাঞ্ছারাম বিরক্ত হয়ে দিদির দিকে তাকালেন। তারপর “হুঁ! যতো সব।” বলে উঠে গিয়ে নিজের গবেষণাগারে ঢুকে আলো জ্বাললেন।

গবেষণাগারের অবস্থা অবশ্য শোচনীয়। চারদিকে মাকড়সার জাল, ঝুল, নোংরা। যন্ত্রপাতিও বেশির ভাগই পুরনো আর অকেজো। তবু নেই-নেই করেও ল্যাবরেটরিতে শিশি বোতল বুনসেন বানার, নানারকম ধাতব পাত্র, রাসায়নিক, ছোটখাটো বিচিত্ৰদৰ্শন কলকজা বড় কম নয়। বাঞ্ছারাম দরজাটা বন্ধ করে গম্ভীরভাবে একটা চেয়ারে বসলেন। চেয়ারটা কিছু অদ্ভুত। দেখতে সাধারণ চেয়ার হলেও তার পায়ার বদলে চারটে চাকা লাগানো। চেয়ারের তলায় একটা পিপের মতো বস্তু রয়েছে। বাঞ্ছারাম চেয়ারে বসে একটা হাতল টানতেই একটা কলকল শব্দ হল, পিপেটা ঘুরতে লাগল আর চেয়ারটাও আস্তে-আস্তে চলতে লাগল। এটা হচ্ছে বাঞ্ছারামের আবিষ্কার, জ্বালানিহীন সুলভ জলচালিত যান। পিপের মধ্যে নানা খোপে জল ভরে রাখা আছে। হাতল টানার সঙ্গে সঙ্গেই সেই খোপগুলির মধ্যে কয়েকটা উল্টে যায়। জল গিয়ে অন্য পাত্রে পড়ে। আবার সেই পাত্রগুলো উল্টে যায়। এরকম ভাবে পিপের মধ্যে জলে একটা গতি সঞ্চারিত হয়। পিপেটা ঘুরতে থাকে আর সেই ঘূর্ণনে চেয়ারটাও চালিত হয়।

চেয়ার চালিয়ে বাঞ্ছারাম ল্যাবরেটরির ভিতরে কিছুক্ষণ এলোমেলো ঘুরে বেড়ালেন। একটা টেবিলের কাছে থেমে চেয়ে রইলেন ভুরু কুঁচকে। টেবিলে একটা বিল্ট-ইন-বেসিন। বেসিনের কলের সঙ্গে লাগানো ছোটো একটা জলবিদ্যুৎ যন্ত্র। বহুঁকাল আগে, বড় কাজে যখন তেমন হাত দেননি বাঞ্ছারাম, তখন এইসব মজার জিনিস তৈরি করতেন। জলের ট্যাপ খুললেই জেনারেটর চালু হবে। তাই দিয়ে একটা গোটা ঘরের আলোপাখার ব্যবস্থা। এক পয়সা খরচ নেই।

তবু এগুলোর পেটেন্ট নেননি বাঞ্ছারাম। তাঁর মাথায় হিট অ্যামপ্লিফিকেশনের যে স্বপ্ন ছিল, তা কাজে করতে পারলে জগৎজোড়া খ্যাতি হবে। পৃথিবীর অশেষ মঙ্গল ঘটবে। তাই ছোটোখাটো আবিষ্কারগুলোকে তিনি বিশেষ মূল্য দেননি। আজও দেন না।

চেয়ার চালিয়ে তিনি জানলার ধারে এলেন। সেখানে একটা টেবিলের ওপর কাঁচের একটি গোলক। গোলকটির দিকে নিৰ্ণিমেষ চোখে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। অর্ধেক আকাশের ছায়া পড়েছে গোলকে। গ্রহ-নক্ষত্রের নিখুঁত ছবি। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

ঘুরতে-ঘুরতে বাঞ্ছারাম এলেন ল্যাবরেটরির মাঝখানে মস্ত টেবিলটার ধারে। টেবিলের ওপর আজও রয়েছে কলসির মতো দেখতে বড়-সড় একটা ধাতব পাত্র। তলায় একটা ফুটো। এই যন্ত্রটাই ছিল বাঞ্ছারামের জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ। সবচেয়ে বড় সাধনা। সফল হলে পৃথিবীর মানুষ উপকৃত হত। মাত্র একটা মোমবাতির আগুনের তাপ থেকে কলকাতার মতো মস্ত একটা শহরের যাবতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারত। একটা দেশলাই কাঠির আগুনে এক কেটলি জল ফোঁটানো যেত। একটুখানি তাপকে বহুগুণ বাড়ানোর এই যন্ত্র তৈরিতে তিনি সফল হয়েছিলেন কিনা তা আজ আর তাঁর মনে নেই। শুধু মনে আছে, যন্ত্রটি যখন প্রায় তৈরি করে ফেলেছেন, তখন একদিন হঠাৎ এই টেবিলের ধারে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন তিনি হাসপাতালে। আর তার পর থেকে কিছুই আর তাঁর তেমন মনে পড়ে না। হিট অ্যামপ্লিফিকেশনের কোনো কাগজপত্রও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। একেবারে শেষ হওয়ার মুখে এসেও যন্ত্রটা অসম্পূর্ণ হয়ে পড়ে আছে আজও।

বাঞ্ছারাম মাথায় হাত দিয়ে যন্ত্রটার দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “রসগোল্লা! রসগোল্লার চেয়ে আর কী ভাল থাকতে পারে পৃথিবীতে?”

“আজ্ঞে আছে। রসগোল্লার চেয়েও ভাল জিনিস আছে।” টেবিলের তলা থেকে কে যেন বেশ জোরের সঙ্গে বলে উঠল।

বাঞ্ছারাম বললেন, “হতেই পারে না।”

“সে আপনি আমার খুড়িমার হাতের কচুর শাক খাননি বলে বলতেছেন। খেলে আর বলতেন না।” বলে টেবিলের তলায় পাতা একটা শতরঞ্চির বিছানা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল রঘু। বাঞ্ছারামের বহু পুরনো চাকর। বেরিয়ে এসে সে একটা হাই তুলে বলল, “আরো আছে। রাজশাহির রাঘবসাই। খেয়েছেন? ঢাকার বাখরখানি?”

বাঞ্ছারাম ধমকে উঠলেন, “রসগোল্লা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাদ্য।”

রঘু রেগে গিয়ে বলল, “সেইজন্যেই তো লোকে আপনাকে পাগল বলে।”

বাঞ্ছারাম কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে বললেন, “এখনো বলে?”

“বলে বই কী।” বাঞ্ছারাম চোখ পাকিয়ে বললেন, “আজ বলেছে?” রঘু মুখ গোমড়া করে বলল, “রোজ বলে। আজই বা বলবে কেন?”

“তা তুই তাদের কী জবাব দিলি?”

“জবাব দেওয়ার কিছু নেই। আমি তো বরাবরই বলে আসতিছি যে দাদাবাবুটা একটা আস্ত পাগল। তাঁর এই জাদুঘরে ঢুকলে এই যন্তরটা ফোঁস করে, ঐ যন্তরটা ফাঁস করে, এই যন্তরটা চলতে লাগে, তো আর একটা যন্তর ভূতের নেত্য করে। এই। পাগলাঘরের মোড়ল যিনি, তাঁরে পাগল কবো না তো কী?”

“তাহলে তুইও বলিস?”

“বলি।”

“আজ বলেছিস?”

“এই তো বললাম। আপনি একডা পাগল।”

বাঞ্ছারাম কটমট করে রঘুর দিকে চেয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর বলেন, “আচ্ছা, যা, আজ ছেড়ে দিলাম। আর কখনো বলিস না।”

রঘু সেই ছেলেবেলা থেকে বাঞ্ছারামের সঙ্গে আছে। তিন কূলে তার আর কেউ নেই। সে লেখাপড়া শেখেনি, আর বাঞ্ছারাম মস্ত পণ্ডিত। তবু রঘু বরাবর প্রায় সর্ব বিষয় নিয়েই বাঞ্ছারামের সঙ্গে রীতিমত ঝগড়া করেছে। তাদের মতের মিল নেই। শুধু অন্তরের মিল আছে। রঘু বাঞ্ছারামকে দারুণ ভালবাসে।

রঘু আর একটা হাই তুলে বলে, “বাবামশাইয়ের কথাটা যদি শুনতেন। যদি ওকালতিটা পড়তেন, তবে আজ আর এই অবস্থা হত না। ওকালতির মতো জিনিস আছে? আমাদের গ্রামের বসন্ত উঁকিলকে দেখলে দারোগাবাবুও ঘোড়া থেকে নেমে পড়তেন।”

একথা ঠিক যে বাঞ্ছারামের বাবা অক্রুরবাবু চেয়েছিলেন, ছেলে উঁকিল হোক। বাঞ্ছারাম তা হননি। আর ব্যাপারটা রঘুর বিশেষ ভাল লাগেনি। রঘু সেই নিয়ে রোজই খোটা দেয়।

বাঞ্ছারাম তাঁর জল-গাড়ি চালিয়ে ঘরের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে বললেন, “আসলে আমি পাগল নই। আমি আসলে কাজের কথাটা ভুলে যাই। ঠিক সময়ে ঠিক জিনিসটা মনে পড়ে না। তুই লোককে একটু বুঝিয়ে বলিস তো।”

“কী বলব?”

“আমি পাগল নই।”

“আচ্ছা বলব। এখন খেয়ে শুয়ে পড়বেন চলুন।”

গভীর রাতে বাঞ্ছারাম বিছানা ছেড়ে চুপি-চুপি উঠে পড়লেন। পা টিপেটিপে এসে ল্যাবরেটরি খুলে ভিতরে ঢুকলেন। দরজাটা সাবধানে ভেজিয়ে দিয়ে এসে দাঁড়ালেন অসম্পূর্ণ হিট অ্যামপ্লিফায়ারটার সামনে। কী যেন প্রায়ই তাঁর মনে পড়ি-পড়ি করে। কিন্তু একটুর জন্য মনে পড়ে না। স্মৃতিশক্তি বড়ই দুর্বল।

কপালটা ডান হাতের দুই আঙুলে চেপে ধরে ভ্রু কুঁচকে বাঞ্ছারাম তাঁর সাধের যন্ত্রটার দিকে চেয়ে থাকেন। তাঁর মনে হয়, কেউ যদি তাঁকে যথেষ্ট রসগোল্লা খাওয়ায়, তাহলে তাঁর মাথার এই ধোঁয়াটা কেটে যাবে। কিন্তু কেউই তাঁর কথা শোনে না। তাঁর খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে ডাক্তারের নির্দেশ খুবই কড়া।

অনেকক্ষণ কপালটা চেপে ধরে থেকে তিনি একটা চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর যন্ত্রটার সারকিট খুলে বিভিন্ন অংশে হাত বোলাতে লাগলেন।

হঠাৎ ঘাড়ে শিরশির করে একটু হাওয়া লাগল। উত্তুরে হাওয়া। বাঞ্ছারাম ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। ল্যাবরেটরির দরজা-জানালা সবই বন্ধ থাকার কথা। হাওয়া আসবে কোত্থেকে? অন্যমনস্ক বাঞ্ছারাম উঠলেন। উত্তরের কাঁচের জানালাটার কাছে এগিয়ে গিয়ে বাইরে তাকালেন একটু। আকাশে জ্যোৎস্নার বান ডাকছে। একটু কুয়াশাঘেরা জ্যোৎস্না। ভারী রহস্যময়। তাঁর আবার রসগোল্লার কথা মনে পড়ল।

ভাল করে জ্যোৎস্না দেখার জন্য একটু ঝুঁকতেই তাঁর হাতের ঠেলায় জানালার একটা পাল্লা খুলে গেল। বাঞ্ছারাম বিরক্ত হলেন। পইপই করে রঘুকে বলা আছে, ল্যাবরেটরির জানালা বা দরজার ছিটকিনি যেন খুলে রাখা না হয়। জানালাটা আবার সাবধানে বন্ধ করে ছিটকিনি লাগালেন তিনি। তার পর আবার যন্ত্রটার সামনে এসে বসলেন। তাঁর কেবলই মনে হয়, একদিন তাঁর সব কথা হঠাৎ মনে পড়ে যাবে। আর সেদিন যন্ত্রটাও কাজ করতে শুরু করবে। একটুখানি তাপকে একশ গুন, হাজার গুণ, লক্ষ গুণ, কোটি গুণ বাড়িয়ে তুলতে থাকবে তাঁর এই যন্ত্র। দুনিয়া থেকে তাপ ও বিদ্যুতের সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে।

বাঞ্ছারাম তাঁর সাধের যন্ত্রটার নানা অংশ নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর হাত থেমে গেল, শরীরটা শক্ত হয়ে উঠল। চোখের পলক পর্যন্ত পড়ছে না। কেন এমন হয় তা বাঞ্ছারাম জানেন। কেউ যদি আড়াল থেকে লুকিয়ে তাঁর দিকে চেয়ে থাকে, ঠিক তখনই এরকম হয়। অন্য কোনো সময়ে এরকমটা হয় না। বাঞ্ছারাম বুঝতে পারলেন, আড়াল থেকে কেউ তাকে লক্ষ করছে।

কিন্তু কে?

বাঞ্ছারাম আস্তে-আস্তে নিজের শরীরটাকে চেয়ারে ছেড়ে দিলেন। ঘাড় হেলিয়ে চোখ বুজে রসগোল্লার কথা ভাবতে লাগলেন। ছেলেবেলায় মতি ময়রার দোকানে ভিয়েনঘরে গিয়ে গরম রসগোল্লার একটু রস পাওয়ার আশায় যখন দাঁড়িয়ে থাকতেন তখন চোখে পড়ত, মস্ত কালো এক কড়াইতে টইটম্বুর রস ফুটছে আর তাতে শয়ে শয়ে পিং পং বলের মতো রসগোল্লা লাফাচ্ছে, নাচছে, দুলছে। কী যে সুন্দর সেই দৃশ্য। চোখ বুজে সেই দৃশ্যটা মনশ্চক্ষে দেখতে লাগলেন বাঞ্ছারাম। দেখতে-দেখতে শরীরের আড়ষ্ট ভাবটা কেটে গেল। ঘাড়ে আবার শিরশির করে একটু উত্তুরে বাতাস এসে লাগল। অর্থাৎ উত্তরের জানলাটা আবার কেউ খুলেছে।

বাঞ্ছারাম ঘাড় ঘোরালেন। অনুচ্চ স্বরে বললেন, “কে? কে ওখানে?”

কেউ জবাব দিল না। কিন্তু বাতাসের ঝাঁপটায় একটা পাল্লা ঠাস করে বন্ধ হয়ে গেল। বাঞ্ছারাম অবাক হয়ে আপন মনেই বলে উঠলেন, “আশ্চর্য! আমি কি পাগল হয়ে গেলাম নাকি? জানালাটা এইমাত্র বন্ধ করে দিয়ে এলাম, নাকি করিনি?”

বাঞ্ছারাম আবার উঠলেন। জানালার দিকে এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। মাথাটা তাঁর একেবারেই গেছে। যাঃ বাবা! দরজাটাই যে বন্ধ করতে ভুলে গেছেন! ল্যাবরেটরির দরজার দুটো পাল্লাই হাঁ হাঁ করছে খোলা!

দরজার দিকে এগোতে গিয়ে বাঞ্ছারামকে আবার থমকাতে হল। দরজার পাল্লা দুটো সাবধানে বন্ধ করে দিল কে যেন, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না।

বাঞ্ছারাম আপনমনেই হাসলেন। রঘু যে তাঁকে পাগল বলে, সে তাহলে এমনিতে নয়! পাগল তাহলে তিনি বটেন! কথাটা ভেবেই বাঞ্ছারাম খুব হোঃ হোঃ করে হাসলেন। হাসতে হাসতে চোখে জল এসে গেল।

খানিকক্ষণ হেসে নিয়ে গায়ের আলোয়ানে চোখের জল মুছে সামনে তাকিয়ে দেখেন সামনের টেবিলে কাঁচের মস্ত বকযন্ত্রটার পাশে একটা ডলপুতুল দাঁড়িয়ে আছে। সাহেব ডলপুতুল, মাথায় টুপি, পরনে সুট, গলায় টাই, চোখের তারা কটা।

বাঞ্ছারাম আবার হেসে উঠতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ডলপুতুলটা ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে চাপা স্বরে বলল, “শাট আপ!”

কথাকওয়া পুতুল নাকি? বাঞ্ছারাম খুশিই হলেন। তাঁর একটা ছেলে আছে। ছেলেটা কত বড় হয়েছে তা তাঁর জানা

নেই। তবে ছেলের নাম যে রতন, তা তাঁর মনে আছে। এই ডলপুতুলটা রতনকে দেবেন। ছেলেটা খুশি হবে। এই ভেবে বাঞ্ছারাম পুতুলটার দিকে হাসি-হাসি মুখ করে এগিয়ে গেলেন। বেশ পুতুল। কথা কয়, হাত-পা নাড়ে।

বাঞ্ছারাম হাত বাড়িয়েছিলেন, কিন্তু পুতুলটাকে ধরতে পারলেন না। তার আগেই পিছন থেকে একটা ভারী হাত তাঁর ঘাড়টা চেপে ধরল। এরকম জোরালো হাত কারো থাকতে পারে, তা বাঞ্ছারামের জানা ছিল না। ঘাড়ে ধরে হাতটা প্রায় তাঁকে শূন্যে তুলে ফেলল। তারপর কয়েকটা ঝাঁকুনি দিয়ে আবার মেঝের ওপর দাঁড় করিয়ে দিল। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও পারলেন

বাঞ্ছারাম। গলা বুজে এল, চোখে অন্ধকার দেখলেন, মাথাটা পাক খেল। দাঁড়ানোর পরও টলমল করে পড়ে যাচ্ছিলেন। সেই হাতটা তাঁর ঘাড় ধরে আছে বলে পড়লেন না। মুখটা ঘোরাতে পারছিলেন না বাঞ্ছারাম। তবে একপলক আবছা দেখলেন, যে-লোকটা তাঁর ঘাড় ধরে আছে সে অন্তত ছ ফুট তিন-চার ইঞ্চি লম্বা এবং বিশাল তার স্বাস্থ্য। একখানা আস্ত দানব।

এমনিতেই বাঞ্ছারামের মাথার ঠিক নেই, এখন ভয়ে আরও গুলিয়ে গেল। এ কি দুঃস্বপ্ন?

টেবিলের ওপর দাঁড়ানো ডলপুতুলটা গম্ভীরভাবে তাঁকে দেখছিল। বাঞ্ছারাম দম ফিরে পেয়ে যখন হাঁফাচ্ছেন, তখন পুতুলটা তীক্ষ্ণ স্বরে ইংরিজিতে বলল, “সেই জিনিসটা কোথায়?”

বাঞ্ছারাম এবার ভাল করে ঠাহর করে বুঝলেন, সামনের ডলপুতুলটা আসলে পুতুল নয়। বেঁটে একটা লোক। এত বেঁটে যে, প্রায় বামনবীর বলে মনে হয়। কিন্তু বামনদের চেহারায় যেমন মাঝে-মাঝে বিকৃতি দেখা যায়, এর তেমন নয়। বেঁটে হলেও এর চেহারাটা বেশ সুষম গঠনের। বয়সও খুব বেশি নয়।

বাঞ্ছারাম হাঁফাতে-হাঁফাতে জিজ্ঞেস করলেন, “কোন জিনিসটা?”

“হিট অ্যামপ্লিফিকেশনের সারকিট ডিজাইন। আমরা তোমাকে মোট দশ মিনিট সময় দেব। চটপট সেটা বের করে দাও।”

বাঞ্ছারাম চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকেন। কিছুই মনে পড়ে

তাঁর। শুধু মনে হয়, এখন তাঁর কিছু রসগোল্লা খাওয়া দরকার। বুকটা ধড়ফড় করছে, খাসের কষ্ট হচ্ছে, ঘাড়টা টনটন করছে। রসগোল্লা খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি কঁকিয়ে উঠে বললেন, “গিভ মি সাম রসগোল্লা।”

কথাটা বলার সঙ্গে-সঙ্গেই ঘাড়ে আর-একটা ঝাঁকুনি। এত জোর সেই ঝাঁকুনি যে, বাঞ্ছারাম কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান হারালেন প্রবল যন্ত্রণায়।

জ্ঞান ফিরে এলে দেখেন, তিনি চেয়ারে বসে আছেন। সামনে আর-একটা চেয়ারে সেই বেঁটে সাহেব। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সেই প্রকাণ্ড দানব। দানবটার হাতে একটা রবারের দেড় হাত লম্বা পাইপ।

বেঁটে লোকটা বলল, “সেটা কোথায়?”

“কোন্টা?” থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করেন বাঞ্ছারাম।

“হিট অ্যামপ্লিফিকেশনের ডিজাইন আর ফরমুলা?”

“নেই। আমার কাছে নেই। আমি রসগোল্লা খাব।”

চোখের পলকে দানবটা এগিয়ে এগিয়ে এল। রবারের হোসটা মুখের সামনে নাচিয়ে হিন্দিতে বলল, “পাগলামি একদম সারিয়ে দেব। মারের চোটে সব পাগলামি সেরে যাবে। বুঝলে? ঠিক-ঠিক বাতচিত করো। সাহেব যা জানতে চাইছে, তার জবাব দাও।”

বাঞ্ছারাম ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁর যে কিছু মনে নেই! তিনি কী করবেন?

বেঁটে সাহেবটা ধীর গম্ভীর স্বরে একটু ভাঙা ইংরিজিতে বলল, “শোনো ব্যানার্জি, রবিন তোমার ফরমুলা পায়নি। তোমার ফরমুলা তোমার কাছেই আছে। আমরা জানি। বাঁচতে চাও তো বের করে দাও। নইলে তোমার চোখের সামনে আগে তোমার ছেলেকে আমরা খুন করব। তারপর ধীরে-ধীরে, অনেক কষ্ট দিয়ে তোমাকেও।”

বাঞ্ছারাম অস্থির বোধ করলেন। বললেন, “আমার ছেলে যে ছোট্ট। তাকে মারবে? তাকে মারবে কেন?”

বেঁটে লোকটা একটু হাসল। ক্রুর হাসি। বলল, “তোমার ছেলে মোটেই ছোট নয়। যথেষ্ট বড়। নামকরা বক্সার।”

বাঞ্ছারাম মাথা নেড়ে বললেন, “আমার ছেলেকে তোমরা মেরো না। ফরমুলা নিয়ে যাও।”

“সেটা কোথায় আছে?”

“বোধহয় ওই আলমারিতে। ওই যে লোহার আলমারি। খোলাই আছে।”

বেঁটে লোকটা চোখের ইঙ্গিত করল। দানবটা গিয়ে আলমারি খুলল। পুরনো কাগজপত্র আর কিছু ফাঁইল আজও অযত্নে পড়ে আছে চারটে তাকে। দানবটা ঝটপট সব কাগজপত্র নামাল। ঘন্টাখানেক ধরে তন্ন-তন্ন করে খুঁজল। তারপর রক্ত-জল করা ভয়াল চোখে তাকাল বাঞ্ছারামের দিকে।

বেঁটে লোকটার ভুরু কোঁচকানোই ছিল, এবার হঠাৎ চোখে একটা রাগের বিদ্যুৎ খেলে গেল। চাপা গলায় চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, “জিনিসটা আলমারিতে নেই। তুমি কি আমাদের সঙ্গে রসিকতা করছ?”

বাঞ্ছারাম নিজের কপাল টিপে ধরে ভয়ার্ত গলায় বললেন, “আমার যে কিছু মনে থাকে না। কী করব?”

দানবের মতো লোকটা রবারের হোস হাতে এগিয়ে এল। বাঞ্ছারাম ভয়ে কুঁচকে যাচ্ছিলেন। চোখে অবোধ দৃষ্টি। কিছুতেই মনে পড়ছে না, ফরমুলাটা কোথায় রেখেছেন।

দানবের হাতের রবারের হোসটা তাঁর বাঁ হাতে একটা মুগুরের মতো এসে লাগল। বাঞ্ছারামের মনে হল হাতটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল বুঝি। কনুই থেকে সমস্ত হাতটা অসাড় হয়ে ঝিনঝিন করতে লাগল। চোখে লাল নীল হলুদ ফুলঝুরি দেখতে লাগলেন। “বাবা গো” বলে একটা অস্ফুট আর্তনাদ করলেন। মুখটা বেঁকে গেল ব্যথার তাড়নায়। ঠোঁট দিয়ে গাজলা বেরোতে লাগল। চোখ উল্টে গেল।

দানবটাই ট্যাপ থেকে এক কোষ জল এনে ঝাঁপটা দিলে মুখে। বাঞ্ছারাম চোখ খুললেন। বেঁটে লোকটা ঠাণ্ডা গলায় বলল, “তোমার মতো বিখ্যাত লোককে মারধোর করতে আমাদের খারাপ লাগছে। কিন্তু এটাও সত্যি যে, তুমি আগুন নিয়ে খেলা করছ। তোমার আবিষ্কার যদি তোমার কাছেই লুকোনো থাকে, তবে তা দিয়ে পৃথিবীর মঙ্গল হবে না। পৃথিবীর স্বার্থেই তোমার আবিষ্কারটা আমাদের জানা দরকার।”

বাঞ্ছারাম ছেলেমানুষের মতো আদুরে গলায় বললেন, “আমি দিদির কাছে যাব। আমি রসগোল্লা খাব।”

বেঁটে সাহেবটা রসগোল্লা চেনে না। বয়স্ক লোকের দিদির কাছে যাওয়ার বায়নাও তার বোঝার কথা নয়। উপরন্তু বাঞ্ছারাম কথাটা বললেন বাংলায়। তারপর ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে

লাগলেন।

শত্রুপক্ষ তাঁকে কাঁদার জন্য মিনিট পাঁচেক সময় দিল। তারপরই দানবটা এসে তাঁর ডান কব্জিটা চেপে ধরল। কিন্তু তা সাধারণ চেপে ধরা নয়। যে কায়দায় ধরল, তাকে বলে জুড়োস থাম্ব লক। শিরা স্নায়ু ইত্যাদি নিরিখ ব্রা ধরা। একটু চাপ দিলেই গা দিয়ে ঘাম ছাড়ে, প্রাণ বলে পালাই-পালাই, শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। চাপ আর-একটু বাড়ালে যে-কোনো মজবুত কব্জি ভেঙে বা অকেজো হয়ে যেতে পারে। বাঞ্ছারাম মূক যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন। এই শীতেও তাঁর পাঞ্জাবি ভিজে গেল ঘামে। মাথা ঘুরতে লাগল, বমি বমি ভাব হতে লাগল।

দানবটা বলল, “বলো! বলো! শিগগির বলো!” কিন্তু কী বলবেন বাঞ্ছারাম? তাঁর পাগলাটে মাথায় ঘোলা জলের মতো আবছা হয়ে গেছে স্মৃতি। তাঁর ঠোঁট নড়তে লাগল। তিনি বলতে চাইলেন, “মেরো না! আর মেরো না! ছেড়ে দাও।”

আবার বুকের ওপর মাথা ঝুঁকে পড়ল বাঞ্ছারামের। মুখে গাজলা। চোখ ওল্টানো। আবার জলের ঝাটকা।

কিন্তু জ্ঞান ফিরলেও আতঙ্কে বাঞ্ছারাম বোধবুদ্ধিহীন হয়ে গেছেন। তার ওপর শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। ঘাড় ছিঁড়ে পড়ছে, দুটো হাতই অনড় হয়ে গেছে ব্যথায়। চোখ-ভরা জল।

বেঁটে লোকটা চেয়ার থেকে নেমে সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, “আমরা খবর রাখি, তোমার পাগলামিটা অভিনয় মাত্র। অনেক দিন ধরেই তুমি পাগল সেজে আছ। কাজেই আমাদের সঙ্গে অভিনয়ের চালাকি কোরো না। মনে রেখো, এখানেই ব্যাপারটা শেষ হবে না। আমরা তোমার ছেলেকে তোমার সামনে খুন করব। আর আমরা যা বলি, তাই করি।”

বাঞ্ছারাম ককিয়ে উঠলেন বিভীষিকা দেখে। গোঙাতে গোঙাতে বললেন, “ফরমুলাটা কোথাও আছে। আমার ছেলেকে মেরো না। বড় ছোট্ট ছেলে, মা-মরা দুঃখী ছেলে। তাকে মেরে না।”

বেঁটে লোকটা কব্জির ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, “তোমাকে চব্বিশ ঘন্টা সময় দিচ্ছি। কাল ঠিক এই সময়ে আমরা আসব। রাত দেড়টা নাগাদ। যদি তখন আমরা জিনিসটা হাতে না পাই, তাহলে যা হওয়ার তাই হবে। পুলিসকে বা আর কাউকে খবর দিও না। তাতে লাভ নেই।”

বাঞ্ছারাম মাথা নাড়লেন। মুখে কথা আসছিল না। বামন আর দানব নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।

পরদিন যখন ল্যাবরেটরিতে এসে তাঁকে আবিষ্কার করল রঘু, তখন তাঁর একশ তিন ডিগ্রী জ্বর। চোখ টকটক করছে লাল। অবিরল ভুল বকছেন, “রতনকে ওরা মেরে ফেলবে। ফরমুলাটা কোথায়? ফরমুলাটা?”

ডাক্তার এসে ওষুধ দিল। তাঁর হাতে পায়ে কোনো কালশিটে বা চোখে পড়ার মতো মারের দাগ নেই। শুধু দুটো হাতই আড়ষ্ট আর সামান্য ফোলা। ডাক্তার তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে চলে গেল।

দুপুরে ঘুম ভাঙল বাঞ্ছারামের। জ্বর একটু কম, ব্যথা থাকলেও অসহ্য নয়। ঘুম থেকে জেগে অসহায়ের মতো সিলিং-এর দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। কী করবেন? ফরমুলাটা যে কোথায়, তা তাঁর জানা নেই।

বাঞ্ছারাম কষ্টেসৃষ্টে উঠলেন। তারপর ল্যাবরেটরিতে এসে চুপ করে বসে রইলেন। খুব মন দিয়ে ভাববার চেষ্টা করলেন বহুদিন আগেকার ঘটনাটা। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না।

রাতে খেয়ে-দেয়ে শুতে গেলেন। কিন্তু ঘুম এল না। গভীর রাতে চুপিচুপি উঠে এলেন ল্যাবরেটরিতে। অন্ধকার ল্যাবরেটরি। দরজায় আজ তালা নেই। কেবল ভেজানো। ভিতরে পা দিলেন। আলোর সুইচের দিকে হাত বাড়িয়েছেন, কিন্তু ছুঁতে পারলেন না। তার আগেই একটা ভোয়ালে এসে তাঁর মুখ চেপে ধরল। তিনি জ্ঞান হারালেন।

রতন যখন সকালবেলায় বাড়িতে এসে পৌঁছল, তখন পাড়া-প্রতিবেশী এবং পুলিস জমা হয়েছে। বুড়ি পিসি চুপ করে বসে আছে। রঘু হাপুস নয়নে কাঁদছে। রতনকে দেখে কান্না বাড়ল। “খোকাবাবু গো, কতাকে কারা গুম করেছে।”

সদ্য জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাড়ি ফেরার আনন্দ মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। তবু পিসি বা রঘুর মতো ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া বা ভেঙে পড়ার মানুষ নয় সে। সকলের এলোমেলো কথা থেকে যা

বুঝল, তা হল, ভোরে রোজকার মতো ল্যাবরেটরি ঝাড় দিতে এসে রঘু দেখে, তালাটা ভাঙা, ঘরের জিনিসপত্র ছত্রখান আর বাঞ্ছারামের চশমাজোড়া পড়ে ভেঙে আছে। তিনি কোথাও নেই। বাঞ্ছারামের প্রাতঃভ্রমণ করার অভ্যাস নেই। বলতে কী, গত এক বছর তিনি বাড়ির বাইরে একা কখনোই যাননি।

পুলিসের অবশ্য ধারণা, তিনি কোথাও গেছেন এবং ফিরে আসবেন। যাদের মাথা খারাপ, তাদের গতিবিধি সম্পর্কে নিশ্চয় করে তো কিছু বলা যায় না।

রতনকে দেখে পিসির থতমত ভাবটা খানিক বাদে কেটে যাওয়ার পর পিসি বলল, “যত যাই হোক, আমাকে না বলে সে কোথাও যাওয়ার মানুষ নয়। শরীরটাও খারাপ ছিল।”

রতনের মা নেই। বাবাকে সে গভীরভাবে ভালবাসে। এই খবরে সে গুম হয়ে গেল। খড়গপুরে জন এবং রোলোর সঙ্গে আলাপ না হলে সেও পুলিসের মতোই ধরে নিত, বাবা কোথাও বেড়াতে গেছেন এবং এসে যাবেন।

রতন রঘুকে জিজ্ঞেস করল, “রঘুদা, কিছু চুরি গিয়েছে বলে। জানো?”

রঘু বলল, “তা সেই যন্তরটা তো দেখছি না!”

“কোনটা? হিট অ্যামপ্লিফায়ার?”

“সেইটেই।”

রতন নিঃশব্দে ল্যাবরেটরিতে এসে ঢুকল। সে ডিটেকটিভ নয়। সূত্রানুসন্ধানের চোখও তার নেই। তার বাবার শরীর খুব খারাপ যাচ্ছিল। বিছানা থেকে ওঠেননি। অথচ আজ সকালেই তিনি নিজে থেকে কোথাও চলে যাবেন এটা বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। উপরন্তু অত বড় হিট অ্যামপ্লিফায়ার যন্ত্রটাই বা যাবে কোথায়? সে তন্ন তন্ন করে চারদিক খুঁজল। চোরেরা তাদের আগমন তেমন গোপন করেনি। অনেকগুলি কাগজপত্র মেঝেয় পড়ে আছে। লোহার আলমারির একটা পাল্লা এখনো খোলা। টেবিলের ড্রয়ার হাঁটকানো। ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট ওল্টানো। খুব রুক্ষ হাতে এবং বেপরোয়াভাবে কেউ ঘরটা সার্চ করেছে। অর্থাৎ তার বাবাকে যদি কেউ গুম করে থাকে, তবে যারা সে কাজ করেছে তারা বুক ফুলিয়েই করেছে। এর বেশি আর কিছু রতন বুঝতে পারল না।

রতনের বন্ধুবান্ধবরা সে এসেছে শুনে দেখা করতে এসেছিল। রতন তাদের সঙ্গে বেশি কথাটথা বলল না। তার ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে রাগে আর অসহায়তায়। কিন্তু গায়ের জোরে এই রহস্যের কিনারা হওয়ার নয়। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, বুদ্ধি খাটাতে হবে।

বেলা গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। তার মধ্যে অন্তত বার পাঁচেক থানায় হানা দিল রতন। দারোগা-পুলিসরা নানা অপরাধীকে সামলাতে ব্যস্ত। বাঞ্ছারামের খবর তারা পায়নি।

বাবার কী অসুখ হয়েছিল তা পিসি আর রঘুর কাছে জানতে চাইল রতন।

রঘু বলল, “তা তো জানি না। সারারাত ঐ জাদুঘরেই বসে ছিলেন। সকালে আমি গিয়ে যখন কাণ্ডখানা দেখি, তখন গা

পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে, চোখ টকটকে লাল। ভুলভাল বকছেন।”

“কী বলেছিল মনে আছে?”

রঘু মাথা চুলকে বলল, “একে পাগল, তায় জ্বরের ঘোরে আবোল তাবোল কথা সব বেরোচ্ছিল মুখ দিয়ে। আমার অত স্মরণ নেই।”

“একটু স্মরণ করার চেষ্টা করো বাপু।”

রঘু ভেবে-চিন্তে বলল, “একবার যেন বলছিলেন বেঁটে লোকটা ভীষণ শয়তান। ওরা খোকাকে মেরে ফেলবে। খুব সাবধান।”

“আর কিছু?”

“না। ঐ কথাটাই ঘুরে-ফিরে কয়েকবার বলেন। তারপর ‘ও দিদি, রসগোল্লা খাব, স্নান করব না, এইসব বলতে লাগলেন।”

রসগোল্লা খাওয়ার কথাটা বাঞ্ছারামের মুদ্রাদোষের মতো ছিল, কাজেই তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। তবে ‘বেঁটে লোক এবং ‘খোকাকে মেরে ফেলবে’ এই কথা দুটোর মধ্যে কিছু সূত্র থাকতে পারে। থানায় গিয়ে সে কথাটা দারোগাবাবুর কাছে বলল।

ও-সি ব্যস্ত মানুষ। তবু সদ্য জাতীয় চ্যামপিয়নশিপের খবরটা আজই কাগজে পড়েছেন, রতনের ছবিসহ। তাই বেশ খাতির করে বসতে দিলেন। বললেন, “ওসব প্রলাপ লোকে জ্বর হলে বলেই থাকে। ও থেকে কিছু আন্দাজ করা শক্ত।”

রতন গম্ভীর গলায় বলল, “তবু আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন কোনো বেঁটে লোককে এই অঞ্চলে দেখা গেছে কি না।”

ও-সি হেসে বললেন, “বেঁটে বা লম্বা লোকের অভাব কী? তবু আপনি যখন বলছেন, দেখব খুঁজে।”

এরপর রতন তার বাবার নিরুদ্দেশ হওয়ার খবরটা টেলিফোনে খবরের কাগজের অফিসগুলিতেও জানিয়ে দিল। বাঞ্ছারাম একসময়ে নামকরা বৈজ্ঞানিক ছিলেন। খবরটা ওরা ছাপতেও পারে।

রতন এখন বুঝতে পারছে, জন খুব মিছে কথা বলেনি। তার বাবার আবিষ্কারটা হয়তো তেমন এলেবেলে ব্যাপার ছিল না এবং হয়তো সেই কাজে তিনি সাফল্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে। গিয়েছিলেন। হয়তো সফল হয়েও ছিলেন। জন লোকটাকেও তার খুব বিশ্বাস হয় না। তাকে আমেরিকায় নিয়ে যেতে চায় জন, সঙ্গে বাবাকেও। এই প্রস্তাবটাও সন্দেহজনক। বক্সার হিসেবে রতন যত ভালই হোক, আমেরিকার পেশাদার মুষ্টিযুদ্ধের জগতে সে এক টিপ নস্যি। সেখানকার বক্সাররা ক্ষুরধার দক্ষ। বক্সিংয়ের অনেক মুষ্টিযোগ তারা জানে। রতনকে দিয়ে তাই জন সেখানে ব্যবসা সহজে জমাতে পারবে না। কিন্তু সেক্ষেত্রে যদি রতনের বাবা বাঞ্ছারামকে সে হাতের মুঠোয় পায়, তাহলে তার লাভ অনেক বেশি।

জগতের লোভ লালসা নিষ্ঠুরতার হাত থেকে নিজের অসহায় বাবাকে বাঁচানোর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না রতন। রাতে সে ভাল করে খেল না। ঘুমোতে পারল না।

মাঝরাতে উঠে তার বাবা মাঝে-মাঝে ল্যাবরেটরিতে গিয়ে বসতেন। এটা তাঁর নেশার মতো ছিল।

গভীর রাতে রতনও বিছানা ছেড়ে উঠল। একটা আলোয়ান জড়িয়ে ধীরে-ধীরে গিয়ে ল্যাবরেটরির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। আলো জ্বেলে বাবার চেয়ারটায় চুপচাপ বসে রইল অনেকক্ষণ। মাথায় কোনো বুদ্ধি আসছে না। বাবার জন্য দুশ্চিন্তায় মাথা পাগল-পাগল লাগছে।

বসে থাকতে থাকতে একটু ঝিমুনি এসেছিল বোধহয়, হঠাৎ শিরশিরে ঠাণ্ডা একটা বাতাস তার ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিতেই সে চোখ মেলল। বক্সিং করে বলেই তার স্নায়ু সতেজ ও সজাগ। সমস্ত শরীরটা চোখের পলকে চিতাবাঘের মতো তৈরি হয়ে গেল।

এক লাফে রতন দরজার দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে লাগল।

কিন্তু দরজার কাছে পৌঁছুবার আগেই দরজাটা আস্তে খুলে গেল। রতন অবাক হয়ে থমকে দাঁড়ায়। চৌকাঠে হাসিমুখে জন দাঁড়িয়ে।

“তুমি!” তেতো গলায় রতন বলে।

জন মাথা নেড়ে বলল, “আমিই। এ ফ্রেন্ড। তুমি কি ভয় পেয়েছ?”

রতনের মাথার মধ্যে নানারকম কথা আসছে। জন যে সাদাসিধে লোক নয় তা সে খড়ঙ্গপুরেই টের পেয়েছিল। এখানে তার মাঝরাতে হঠাৎ আগমনও নিশ্চয়ই সাধু উদ্দেশ্যে নয়। রতন। চাপা স্বরে বলল, “কেন এসেছ? কী চাও?”

জন হাসিমুখেই বলে, “উত্তেজিত হোয়ো না। সত্যি বটে যে, আমি অনেকটা চোরের মতোই এসেছি। তুমি যে এখানে থাকবে, তা আমার জানা ছিল না।”

রতন রাগে ফুঁসছে। ঘন-ঘন শ্বাস ছাড়ছে। কে বা কারা তার বাবাকে নিয়ে গেছে, তা সে জানে না। কিন্তু ঘটনাটায় জনের হাত থাকতেই পারে। জন ছাড়া তার বাবার ব্যাপারে কাউকেই সে আগ্রহী হতে দেখেনি। দাঁতে দাঁত পিষে সে বলল, “আমার বাবাকে কারা চুরি করে নিয়ে গেছে তা তুমি জানো?”

জন সত্যিকারের অবাক হয়। তার সাদা মুখ আরো সাদা হয়ে যায় হঠাৎ। অপলক চোখে সে কিছুক্ষণ রতনের দিকে চেয়ে থেকে বলে, “তোমার বাবাকে চুরি করেছে? কী আশ্চর্য ব্যাপার!”

কিন্তু জনের কথাবার্তায় প্রতিক্রিয়ায় একটু উঁচুদরের অভিনয় রয়েছে বলে মনে হয় রতনের। তার অসহায় বুড়ো পাগল বাবাকে নিতান্ত ব্যবসায়িক কারণে চুরি করে নিয়ে গিয়ে এরা না জানি কত কষ্ট দিচ্ছে। রতনের মাথার ঠিক ছিল না। হঠাৎ সে ফিসফিস করে বলল, “ন্যাকামি কোরো না জন। তুমি খুব ভালই জানো।”

জন একটা হাত বাড়িয়ে রতনের কাঁধ ধরে বলল, “তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না জানি। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য খারাপ কিছু নয়।”

“খারাপ নয়? তবে এত রাতে চুরি করে আমার বাবার ল্যাবরেটরিতে ঢোকার মানে কী?”

জন একথার জবাব দিতে পারল না। শুধু মাথা নেড়ে বলল, “আমি দুঃখিত, তোমরা ভারতীয়রা বড্ড বেশি আবেগপ্রবণ। যুক্তি দিয়ে বিচার করলে বুঝতে পারতে আমি চোর নই।”

“আলবাত চোর। বাবার গবেষণা হাত করার জন্য আমার বাবাকে তুমি চুরি করেছ।”

জন একটা ধমক দিল। “শাট আপ রতন।”

এইটুকু প্ররোচনারই প্রয়োজন ছিল। শুকনো বারুদে আগুন লাগলে যেমন হয় তেমনি একটা রাগ জ্বলে উঠল রতনের ভিতরে। গায়ের আলোয়ানটা এক ঝটকায় ফেলে দিয়ে সে বাঁ হাতে বিষাক্ত একটা ঘুষি মারল জনের মুখে। সেই ঘুষি সহ করার মতো বেশি মানুষ নেই। জন “ওফ” শব্দ করে ছিটকে পড়ল দরজার পাল্লায়। তারপর গড়িয়ে পড়ল মেঝেয়।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরের অন্ধকার বারান্দা থেকে দরজার চৌকাঠে উদয় হল রোলো। এক পলক সে জনের নিথর শরীরটার দিকে চেয়ে রইল, তারপর মুখ তুলে তাকাল রতনের দিকে। দুটো চোখ ধকধক করছে হিংস্রতায়।

কিন্তু রোলো তাড়াহুড়ো করল না। ধীর পায়ে জনকে ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকল, তারপর নিঃশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল। ঘুরে রতনের মুখোমুখি হল সে। মুখে কথা নেই। কিন্তু তার দুই মুষ্টিবদ্ধ হাত দেখেই বোঝা যায় সে কী চাইছে।

রতনও তাই চায়। বাবার জন্য তার দুঃখ এবং আক্রোশ তাকে পাগল করে তুলেছে। সে চায় প্রতিশোধ। হিংস্র চোখে সেও

রোলোর চোখে চাইল। মুখোমুখি রক্তলোলুপ দুই বাঘ। ৫০

একটা কি দুটো সেকেন্ড পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল তারা। তারপরই পিছল সাপের মতো রোলো এগিয়ে আসে। দুর্বোধ একটা শব্দ করে মুখে। তার বাঁ হাত এত দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসে যে, রতন হাতটা ভাল করে দেখতেই পায় না। সুব্বাও এত দ্রুত ঘুষি মারতে পারে না নিশ্চয়ই। কিন্তু রতনের রিফ্লেক্স খুব ভাল কাজ করছে আজ। সে চকিতে তার মাথা সরিয়ে নেয়। এক কদম সরে যায় ডাইনে। তারপর একটা ক্রস চালায় রোলোর কানের পাশে। আশ্চর্য! রোলো রতনের দিকেই চোখ রেখেছিল। ইচ্ছে করলে ঘুষিটা এড়াতেও পারত, কিন্তু সে চেষ্টা করল না। কিন্তু রতন টের পেল তার ঘুষিটা যেন একটা শক্ত পাথরের দেয়ালে গিয়ে লাগল। কবজি চিনচিন করে উঠল ব্যথায়। যে ঘুষিতে ভারতের যে কোনো প্রথম শ্রেণীর মুষ্টিযোদ্ধার পড়ে যাওয়া উচিত, তা অনায়াসে হজম করে রোলো ফিরে দাঁড়াল।

রতন দেখল রোলোর গার্ড নেই। এই সুযোগ। সে চকিত পায়ে নিজেকে গুছিয়ে অ্যাটাকিং পোজিশনে সরে এসে ডান পা বাড়িয়ে দুর্দান্ত একটা সোজা ঘুষি চালাল রোলোর মাথায়। রতনের কনুই শরীরে লাগানো ছিল ঘুষি মারবার সময়। শরীরের ওজনটাকে সে ঘুষিতে সঞ্চার করতে পেরেছে। লাগলে বোমার মতো কাজ হত। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে রোলো সীল মাছের মতো একটা গোঁত খেয়ে নিচু হয়ে ঘুষিটা ভাসিয়ে দিল মাথার ওপর। আর সেই নিচু কুঁজো অবস্থা থেকেই ছোট্ট একটা জ্যাব করল রতনের পাঁজরে।

ককিয়ে উঠল রতন। একটা জ্যাব যে কী সাংঘাতিক জোরালো হতে পারে তা তার এতকাল ধারণা ছিল না। পাঁজরে লাগার সঙ্গে সঙ্গে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তবু রতন তো

বক্সার। বহু মার খেয়েছে। এক লাফে অনেকটা পিছিয়ে গেল সে। পায়ের কাজে রোলোর বাড়ানো ঘুষিগুলোর কয়েকটা এড়িয়েও গেল। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল, রোলো তার চেয়ে বা সুব্বার চেয়ে বা ভারতের সেরা যে কোনো বক্সারের চেয়েও অনেক বেশি দক্ষ মুষ্টিযোদ্ধা।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড রতন নিজেকে বাঁচাতে পারল। তারপরই নানা দিক থেকে বিষাক্ত সাপের ছোবলের মতো রোলোর ঘুষি এসে পড়তে লাগল।

রতনের কপাল ফেটে রক্ত পড়ছে। ঠোঁটে ঢুকে গেছে দাঁত। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তবু সেও বারবার তার প্রতিপক্ষের মুখে মাথায় তার ঘুষি জমিয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু রোলোর রাক্ষুসে ঘুষির তুলনায় তার ঘুষি নিতান্তই দুর্বল। শুধু রোলোর বাঁ ভূর ওপর একটা জায়গা একটু কেটে সামান্য রক্তপাত হচ্ছে। সেও হচ্ছে হাতে গ্লাভস না থাকার দরুন। তা ছাড়া রোলোর আর কিছুই হয়নি।

রতন ক্রমে-ক্রমে পিছু হটছে। সরে যাচ্ছে ঘরের কোণের দিকে। আসলে সরছে না। রোলোই তাকে কুট কৌশলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে এমন একটা জায়গায়, যেখান থেকে রতন পালাতে পারবে না। উপর্যুপরি ঘুষি এসে পড়ছে তার মাথায় মুখে চোয়ালে। এক একবার সে কনুই বা বগলে চেপে ধরেছে বটে রোলোর হাত। কিন্তু পরমুহূর্তেই রোলো ছাড়িয়ে নিচ্ছে নিজেকে। সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক হল রোলোর ডাবল অ্যাকশন পাঞ্চ। একই সঙ্গে ঘুষি এবং কবজির মার।

শেষ পর্যন্ত লড়াই কোথায় গড়াত কে জানে। হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ স্বর ডাকল–”রোলো! স্টপ!”

রোলো থামল। ক্রুর চোখে রতনের দিকে একবার চেয়ে

আস্তে-আস্তে পিছিয়ে গেল। দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে বাঁ ভূর ওপরে কাটা জায়গাটায় চেপে ধরল।

রতন হাঁফাচ্ছিল। জীবনে কখনো সে কারো কাছে এক নাগাড়ে এত মার খায়নি। এরকম শক্ত প্রতিপক্ষের সঙ্গে অবশ্য পাল্লাও দিতে হয়নি তাকে। কিন্তু সে আজ বুঝতে পারল, বক্সিং-এর এখনো অনেক কিছুই তার অজানা।

জন উঠে দাঁড়িয়েছে। ডান চোয়ালটা এখনো লাল। মাথাটা ঝাঁকিয়ে সে একটু হাসল। তারপর রতনের দিকে চেয়ে বলল, “কনগ্রাচুলেশনস, রতন। আমি আজ পর্যন্ত রোলোর সঙ্গে এতক্ষণ কাউকে লড়াই চালিয়ে যেতে দেখিনি।”

রতন বেসিনে উপুড় হয়ে মুখে জলের ঝাঁপটা দিল কিছুক্ষণ। দম ফিরে পেয়ে সে বলল, “রোলো খুব ভাল বক্সার। কিন্তু তাতে প্রমাণ হয় না যে, তোমরা ভাল লোক।”

জন একটা টেবিলের ওপর উঠে বসে বলল, “আমরা তা প্রমাণ করতে ব্যস্ত নই। কারণ হয়তো আমরা তেমন ভাল লোক নইও। আইনের চোখে অন্তত নয়। তবে আমাদের উদ্দেশ্য খারাপ নাও হতে পারে।”

“কী করে বুঝব?” রতন ফুঁসে উঠে বলে।

জন হাত তুলে তাকে শান্ত হওয়ার ইঙ্গিত করে মৃদু স্বরে বলে, “তোমার বাবাকে আমরা চুরি করিনি। এটা বিশ্বাস করো। তাঁকে চুরি করে আমাদের লাভ হত না। ডাকাত আর বিপ্লবীদের মধ্যে একটু তফাত আছে।”

“কারা ডাকাত?” রতন জিজ্ঞেস করে। “যারা তোমার বাবাকে চুরি করেছে। কিন্তু তার আগে ঘটনাটা আমাকে বলো। আমাকে বুঝতে দাও কী হয়েছে। শুধু গায়ের জোরে সব সমস্যার সমাধান করতে যেও না।”

লজ্জিত হয়ে রতন একটু হাসল।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress