Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বকুল আর নীলা পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। বকুলের ডান হাতে শক্ত করে ধরে রাখা মোরগের বাচ্চা, সেটা মনে হয় তার অবস্থাটাকে বেশ মেনে নিয়েছে, কোনো রকম আপত্তি করছে না। নীলা জিজ্ঞেস করল, “কাকে দেবে এই মোরগটা।”

“খেলার মাকে।”

“খেলার মা? একজন মানুষের নাম খেলা?”

“আসল নাম খেলারানী। এখন বিয়ে করে ইন্ডিয়া চলে গেছে। হিন্দু মানুষ তো তাই গ্রামের মাতব্বরেরা খুব অত্যাচার করে।”

“হিন্দুদের মাতব্বরেরা অত্যাচার করে নাকি?”

“করে না আবার! খেলার মাকেও ইন্ডিয়া নিতে চেয়েছিল, সে যায় নাই। বলেছে এইটা আমার দেশ এইটা আমার মাটি। আমি যাব না। সে আর যায় নাই। মুরগির সদকাটা তারেই দেই, ভাল হবে।”

নীলা মাথা নাড়ল। বকুল মোরগের বাচ্চাটা হাতবদল করে বলল, “তা ছাড়া হিন্দু মানুষ তো, তাকে দিলে অন্য লাভ হবে।”

“কী লাভ?”

“সদকাটা দেওয়াটা মুসলমানদের নিয়ম, আল্লাহ্ খুশি হবে। হিন্দুদের যদি দেওয়া হয় তা হলে ভগবানও খুশি হবে। একই সাথে আল্লাহ্ আর ভগবান দুজনকেই খুশি করা!”

নীলা ভুরু কুঁচকে বলল, “আল্লাহ আর ভগবান একই না?”

বকুল ঘাড় নেড়ে বলল, “জানি না। হলে তো আরও ভালো।”

দুইজন কথা না বলে চুপচাপ কিছুক্ষণ হেঁটে যায়। বকুল একসময় বলল, “তোমাদের ঢাকা শহরে কত কী দেখার আছে। আমাদের এখানে তো দেখার মতো কিছুই নাই। তোমাকে যে কী দেখাই! দেখার মতো জিনিস হচ্ছে গিয়ে জমিলা বুড়ি, মতি পাগলা আর বিশু-চোরা।”

“এরা কারা?”

“জমিলা বুড়ি হচ্ছে ডাইনি বুড়ি।” নীলা চোখ কপালে তুলে বলল, “ডাইনি বুড়ি?”

“সবাই বলে। ছোট বাচ্চা দেখলে জাদু করে ব্যাঙে নাহলে ইঁদুর তৈরি করে বোঝার মাঝে ভরে ফেলে!”

“ধুর!”

“ছয়টা নাকি তার পোষা জ্বীন আছে। সবসময় সে জ্বীনদের সাথে কথা বলে।”

“যাও!”

বকুল দাঁত বের করে বলল, “দেখ নাই তো তাই বলছ যাও। দেখলে দাঁতে দাঁত লেগে যাবে। ফিট হয়ে ধড়াম করে পড়বে মাটিতে।”

“কচু!”

“আমার কথা বিশ্বাস হল না?”

বকুল মুখ শক্ত করে বলল, “চলো তা হলে জমিলা বুড়ির কাছে। যাবে?”

“চলো।”

“পরে কিন্তু আমাকে দোষ দিও না।”

নীলা মাথা নেড়ে বলল, “দেব না।”

বকুল নীলাকে নিয়ে জমিলা বুড়ির বাসায় যেতে যেতে বলল, “জমিলা বুড়িকে না দেখে চলো মতি পাগলাকে নাহয় বিশু চোরাকে দেখতে যাই।

“কেন?”

“ওদের দেখার মাঝে কোনো বিপদ নাই। মতি পাগলাকে সবসময় বেঁধে রাখে–কিছু করতে পারে না। আর বিশু-চোরা হচ্ছে বিখ্যাত চোর। চুরির যদি কোনো কম্পিটিশান থাকত তা হলে বিশু-চোরা গোল্ড মেডেল পেত!”

নীলা চোখ বড় বড় করে বকুলের গল্প শোনে। সে যেখানে থাকে তার আশে পাশের মানুষজন এখানকার মানুষের তুলনায় মনে হয় নেহাত পানশে। মতি পাগলা এবং বিশু চোরার বর্ণনা শুনে বলল, “আগে ডাইনি বুড়িকে দেখি, তার পরে মতি পাগলা আর বিশু চোরাকে দেখব।”

“ঠিক আছে।”

দুজনে গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। এক সময় রাস্তা ছেড়ে মেঠো পথ এবং সবশেষে ক্ষেতের আল ধরে হাঁটতে হয়। গ্রামের একেবারে বাইরে কিছু ঝোঁপঝাড় বনজঙ্গল। তার পাশে একটা ছোট ঝুপড়িমতন। বকুল ফিসফিস করে বলল, “ঐ যে জমিলা বুড়ির বাড়ি।”

“জমিলা বুড়ি কই?”

“বাড়ির বাইরে মাটিতে বসে থাকে।”

“দেখি না তো?”

“মনে হয় ভিতরে আছে।”

“দেখব কেমন করে?”

“দাঁড়াও ডাকি। যদি বের হয়ে আসে দৌড় দিতে হবে কিন্তু।–”

নীলা জোরে দৌড়াতে পারবে তার সেরকম বিশ্বাস নেই কিন্তু তবু সে না করল না। বকুল ঝুপড়িমতন ঘরটায় কাছে গিয়ে ডাকল, “জমিলা বুড়িও জমিলা বুড়ি–”

নীলার বুক ধুকধুক করতে থাকে, মনে হয় এখুনি বুঝি ঘরের ভিতর থেকে ভয়ংকর কিছু বের হয়ে আসবে, কিন্তু কিছুই বের হল না। বকুল আবার ডাকল, “জমিলা বুড়ি, ও জমিলা বুড়ি”

এবারেও কোনো সাড়াশব্দ নেই। বকুল মাথা নেড়ে বলল, “বাড়িতে নেই জমিলা বুড়ি।

নীলা বলল, “কিন্তু দরজা তো খোলা!”

বকুল দাঁত বের হেসে বলল, “জমিলা বুড়ির দরজা সবসময় ভোলা থাকে, ছয়টা জ্বীন বাড়ি পাহারা দেয়, চোরের বাবারও সাহস নেই ভিতরে ঢোকার!”

নীলা বলল, “ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখি?” বকুল বলল”সর্বনাশ!”

নীলা কিন্তু সত্যি সত্যি ঘরের ভিতরে রওনা দিল। বকুলকে আর যা-ই বলা যাক ভীতু বলা যায় না, সেও নীলার পিছুপিছু এল।

ঘরের ভিতরে আবছা অন্ধকার এবং বোটকা একধরনের গন্ধ। কোন মানুষের ঘর যে এত আসবাবপত্রহীন সাদামাটা হতে পারে নীলা চিন্তাও করতে পারে না। ভিতরে এক পা ঢুকতেই চিৎকার করে পিছনে সরে আসে, ঘরের মেঝেতে একজন ডাইনি বুড়ি মরে পড়ে আছে। বকুল সাথে সাথে ছুটে এসে বলল, “কী হয়েছে?”

নীলা হাত দিয়ে দেখাতেই বকুল ফিসফিস করে বলল, “জমিলা বুড়ি!”

“মরে গেছে?”

“মনে হয়।” বকুল সাবধানে এগিয়ে গেল, তার ভয় হতে থাকে হঠাৎ বুঝি জমিলা বুড়ি দাঁত এবং নখ বের করে চিৎকার করে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কাছে গিয়ে সে দেখল খুব ধীরে ধীরে এখনও নিঃশ্বাস পড়ছে, এখনও বেঁচে আছে। জমিলা বুড়ি। বকুল কী করবে বুঝতে পারল না, দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে জমিলা বুড়ি অসুস্থ মনে হয় বাড়াবাড়ি অসুস্থ। সে সাবধানে হাত দিয়ে জমিলা বুড়িকে ছুঁয়ে দেখল, গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। মাথা নেড়ে বলল, “অনেক জ্বর।”

নীলা বলল, “ডাক্তার ডাকতে হবে।”

“ডাক্তার কোথায় পাব? এখানে কোন ডাক্তার নাই।”

“তা হলে?”

“মাথায় পানি দিতে হবে।”

“মাথায় পানি?”

“হ্যাঁ।”

“কীভাবে দেবে?”

“দেখি।”

বকুল বাইরে গিয়ে মোরগের বাচ্চাটাকে ঘরের বারান্দায় একটা খুঁটির সাথে বেঁধে রাখল। তারপর খুঁজে পেতে একটা মাটির হাঁড়ি বের করে পানি আনতে গেল। পাশেই একটা এঁদো ডোবা রয়েছে, সেখান থেকে পানি নিয়ে আসে। ঘরের ভিতরে মাথায় পানি দেওয়া মুশকিল বলে বকুল আর নীলা দুজনে মিলে জমিলা বুড়িকে টেনে বারান্দায় নিয়ে এসে মাথায় পানি ঢালতে থাকে। মিনিট দশেক পর জমিলা বুড়ি ধীরে ধীরে নড়তে থাকে–মনে হয় জ্বর কমছে। একসময় চোখ খুলে তাকায়, ঘোলা দৃষ্টি। দেখে বকুলের বুকের ভিতর কেমন যেন কাঁপতে থাকে। জমিলা বুড়ি ফিসফিস করে বলল, “পানি।”

নীলা সাবধানে জমিলা বুড়ির মুখের মাঝে একটু পানি ঢেলে দেয়। জমিলা বুড়ি জিব বের করে পানিটা চেটে খেয়ে হঠাৎ ফোকলা মুখে হেসে ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি পরী?”

নীলা মাথায় নাড়ল, বলল, “না, আমার নাম নীলা।”

“নীল পরী! উড়তে পার?”

নীলা অবাক হয়ে বকুলের দিকে তাকাল, বকুল ফিসফিস করে বলল, “তোমাকে ভাবছে পরী!”

জমিলা বুড়ি তার শীর্ণ হাত বের করে নীলার মুখ স্পর্শ করে বলল, “বেঁচে থাকো বোনডি। শকুনের সমান পরমায়ু হোক।”

বকুলের চোখ হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠল, নীলার কাঁধ খামচে ধরে বলল, “শুনেছ? শুনেছ?”

“কী?”

“তোমার আর ভয় নেই! অসুখ ভালো হয়ে যাবে তোমার।”

“কেন?”

“শুনলে না জমিলা বুড়ি বলছে, শকুনের সমান পরমায়ু হোক। জমিলা বুড়ির কথা মিছা হয় না! কখনো মিছা হয় না!”

নীলা অবাক হয়ে বকুলের দিকে তাকিয়ে রইল।

খেলার মাকে মোরগের বাচ্চা দিয়ে ফিরে আসতে আসতে নীলা আর বকুলের সন্ধ্যে পার হয়ে গেল। লঞ্চের বাইরে ইশতিয়াক সাহেব খুব অস্থির হয়ে পায়চারি করছিলেন, বকুলের সাথে নীলাকে দেখে তাঁর শরীরে যেন প্রাণ ফিরে এল। নিজের অস্থিরতাকে গোপন করে নরম গলায় বললেন, “কীরে মা! কেমন হল বেড়ানো।”

“আব্বু তুমি বিশ্বাস করবে না কী হয়েছে!”

“কী হয়েছে?”

“একজন ডাইনি বুড়ি আছে তার নাম জমিলা বুড়ি। তার খুব অসুখ।”

“ডাইনি বুড়ির অসুখ হয় নাকি?”

“মনে হয় সত্যিকার ডাইনি বুড়ি না। ভেজাল।”

“তাই হবে। অসুখটাও কি ভেজাল?”

“না আব্বু, অসুখটা ভেজাল না। ভীষণ জ্বর। আমি আর বকুল মাথায় পানি দিয়ে জ্বর কমিয়েছি।”

ইশতিয়াক সাহেব স্থিরচোখে তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন, যে-মেয়েটি একদিন আগেও নিজেই অসুস্থ দুর্বল হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল সে এখন অন্য মানুষের অসুখের সেবা করছে?

“আব্বু–একজন ডাক্তার দরকার। এখানে কোনো ডাক্তার নেই।”

“নেই নাকি?”

“না আব্বু।”

“ঠিক আছে।” ইশতিয়াক সাহেব গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, “শমসের—”

সাথে সাথে নিঃশব্দে শমসের এসে হাজির হল। বলল, “আমাকে ডেকেছেন স্যার?”

“হ্যাঁ। আমাদের একজন ডাক্তার দরকার।”

শমসের উদ্বিগ্ন মুখে বলল, “কার জন্যে স্যার?”

“একজন ভেজাল ডাইনি বুড়ির নাকি খাঁটি জ্বর উঠেছে, তার জন্যে। কতক্ষণ লাগবে?”

শমসের তার হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “আধঘণ্টার মতো লাগবে স্যার।”

“তোমাকে আধঘণ্টা নয়, পুরো একঘণ্টা সময় দিলাম। যাও নিয়ে এসো একজন।”

শমমের হেঁটে চলে যাচ্ছিল তখন নীলা পিছন থেকে ডাকল, “শমসের চাচা!”

শমসের ঘুরে তাকাল। নীলা বলল, “আব্বুর কথা শুনবেন না। আপনি আধঘণ্টার মাঝেই নিয়ে আসেন। অসুখ খুব খারাপ জিনিস! আমি জানি।” শমসের হাসিমুখে বলল, “ঠিক আছে! আমি আধাঘণ্টার মাঝেই আনব।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *