বংশ প্রদীপ
আমি বেশ কয়েকদিন আগে দিদির বাড়ি বেনারস মাসখানেকের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার এক সান্ধ্য ভ্রমণ সাথী দুখী দুখী ভাবে জানালেন জানেন আমার মা কোলকাতার এক নার্সিং হোমে কোমর ভাঙার পর থেকে আছেন। এমনি সুস্থ ,ওই হুয়িল চেয়ার ওনার সাথী।মাস গেলে প্রায় সত্তর হাজার টাকা পেনশন পান। বাবা সরকারি অফিসে বিশাল উঁচু পোস্টে চাকরি করতেন। বাবার কল্যানীতে ফ্ল্যাট,চাকদহ মদনপুর আছে, সেখানে তিনতলা রাজপ্রাসাদ।বড়দা ডাক্তার, বৌদি নার্স ,আর ওনাদের দুই ছেলে ও ডাক্তার। ছেলেরা সব বাইরে থাকে। দাদা ও বৌদি কোলকাতায় দুই ক্যামরার ছোট ফ্ল্যাট কিনে থাকে। আমি কোলকাতায় গেলে গেস্ট হাউসে উঠি।কারণ যার বাড়িতে মায়ের স্হান নেই !বোনের জায়গা কোথায় হবে! আমার ছোট ভাই ও ডাক্তার ,তার অবশ্য ছন্নছাড়া জীবন।চাকরীর সূত্রে বৌ ও বাচ্চা থেকে বহুদূরে।ছোট ভাইয়ের ছেলে ও ডাক্তার। কিন্তু কারর ঠাকুমা,মা বা শাশুড়ি কে দেখতে যাবার সময় নেই। আমি বললাম আপনি যদি নিয়ে আসেন। উনি বললেন তা ভেবেছি। আমার স্বামী হার্টের রুগী।তা সত্ত্বে চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার গর্ভধারিনী মা এত দূরে বসে আসতে পারবেন না।কোমরটা এখন এক জায়গার শুয়ে থেকে অসার হয়ে গেছে। তাছাড়া এখন তো অ্যালজাইমা হয়ে গেছে । শুধু জামাই মাসে মাসে বেনারস থেকে গিয়ে দেখে আসে।তখন জামাই এর সাথে খুব গল্প করে। দাদা কোলকাতাতে থেকে বৌয়ের সাথে পার্টি করছে কিন্তু মা কে দেখতে যায় না। আমার মা খুব শিক্ষিতা ছিলেন।মা তো গৃহবধূ ছিলেন।তিন ভাই বোনকে পড়িয়েছে মা। বাবা তো সময় পেতেন না। কেউ আর অতীত মনে রাখে না। সন্তানেরা,নাতিরা ডাক্তার হয়েও তাঁদের আপনজন নার্সিং হোমের অপরিচিত নার্স ,ডাক্তারের অধীনে আছেন।ঈশ্বর একটা উপকার করেছেন অ্যালজাইমা রোগ দিয়ে । অতীত স্মৃতি কিছু কিছু ভুলে যেতেই হয়। কিন্তু তোমার স্বামীকে তো তোমার মা চিনতে পারেন,গল্প করেন। কিছু সম্পর্ক কষ্ট পেতে পেতে ইচ্ছে করে ভুলে যেতেই হয়। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন সান্ধ্য কালীন ভ্রমণসঙ্গী ।তারপর হাতে আমায় তিন-চারটে গল্পের বই দিলেন।মলাটগুলো ধূসর লাগছে। আমি বললাম আপনার লেখা বই! তখন ভদ্রমহিলা খিলখিল করে হেসে বলেন আমি বাংলা লিখতে পারি না, এমনকি পড়তেও না। তারপর শুনলাম ব ইগুলো ওনার মায়ের লেখা,যিনি নার্সিং হোমে নিজের পেনশনের টাকায় জীবন অতিবাহিত করছেন। বাদবাকি মায়ের পঁয়ত্রিশ হাজার সড়িয়ে রাখছে দাদা। কেননা মারা গেলে ঘটা করে ডাক্তার বন্ধুদের পার্টি দিতে হবে।তখন বসবে রঙিন জলের ফোয়ারা। তখন শ্রাদ্ধ বাসরে অশ্রুসিক্ত চোখে বলবেন , আপনারা ঠিক করে খাবেন। বুঝতে পারছেন আমাদের মনের অবস্হা। কাঁদতে কাঁদতে বলবেন জানেন , আমার মা যা খেতে ভালো বাসতেন তাই তাই রান্না হয়েছে। এরকম ঘরে ঘরে নানান কাহিনী মিষ্টি মধুর গল্প পাবেন।তবে ভগবান আছেন”one swallow doesn’t make a summer”এক মাঘে শীত যায় না। আপনি যেমন কর্ম করবেন ঠিক তেমন ফল পাবেন। আমি বলি ঈশ্বর মাসীমাকে আর কষ্ট দিও না।তুলে নাও তুমি। নিজের সন্তান,বংশপ্রদীপ থেকে ও নেই।ভাগ্যিস বরের পেনশন পান,নাহলে হয়তো কোনোদিন বিষ ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে ফেলত। লোভী স্বার্থপর সন্তানেরা গর্ভধারিনী মা কে কি করে ভুলে থাকছে,তা ঈশ্বর জানেন।