Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ফ্রান্‌ৎস কাফকা – 3

১৯৪৬ সালে ফরাসি কম্যুনিস্টরা এক জরিপ চালিয়েছিল: ‘কাফকা কি অবশ্যই পুড়িয়ে ফেলা উচিত?’ — এই শিরোনামে। তাদের যুক্তি ছিল, কাফকা ‘অন্ধকারের সাহিত্যের’ বিপজ্জনক প্রতিনিধিত্ব করছেন, সমাজে কাফকার খুব বাজে প্রভাব পড়তে পারে। খ্রিষ্টানরাও একই রকম কথা বললেন, এমনকি এরিখ হেলারের মতো পণ্ডিত মানুষও। গুন্টার অ্যান্ডার্স তাঁর আলোচনার উপসংহার টানলেন এই কথা বলে: ‘পৃথিবীর যে ছবি কাফকা এঁকেছেন, সে রকম পৃথিবী বাস্তবে হওয়া উচিত নয়; তাতে মানুষের যে রকম আচরণ, সে রকম আচরণ হওয়া ঠিক নয়…ইতিবাচক কিছু হিসেবে তাঁর সাহিত্য কখনোই তাঁর নিজের বা অন্যদের কাজে আসবে না। তবে “সতর্কবাণী” হিসেবে আমাদের জন্য তা কাজে লাগতে পারে।’

ইতির বিপরীতে কাফকার এই নেতিবাচকতার কথা বলতে গেলে সেই ক্লিশে ‘কাফকায়েস্ক’ প্রসঙ্গই বারবার চলে আসে। আমরা যদি ১০০ রকমের ও ধরনের কাফকা-ব্যাখ্যা পাশে সরিয়ে রাখি, এ কথা তো অগ্রাহ্য করা যাবে না যে কাফকার লেখার একেবারে মূলে আছে আধুনিক পৃথিবীতে ব্যক্তির একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা এবং অনাত্মীয় পরিবেশে ‘এই পৃথিবীতে, এই শহরে, আমার পরিবারে পা রাখার ব্যাপারে পুরোপুরি অনিশ্চিত’ মানুষদের কথা ও কাহিনি। কাফকা তাঁর পাঠকের মধ্যেও এই বিচ্ছিন্নতার বোধ জারিত করেন কী সুন্দরভাবে তাঁর লেখায় কোনো দেশ, সময় বা স্থানের নাম থাকে না; এমনকি প্রকৃতির আইনও কাজ করে না (মানুষ পোকা হয়ে যায়), সামাজিক রীতিও মানা হয় না (‘এক গ্রাম্য ডাক্তার’ গল্পের বুড়ো ডাক্তার শীতের নগ্ন পৃথিবীতে ‘এই সবচেয়ে অসুখী সময়ের তুষারের সামনে অনাবৃত হয়ে’ অনন্তকাল ঘুরে বেড়ান); পারিবারিক নিয়মও শ্রদ্ধা করা হয় না (ছেলে বিয়ে করবে তাই বুড়ো বাবা ‘রায়’ গল্পে ছেলেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন)। আরো বেশি স্তম্ভিত হতে হয় তাঁর নিজের লেখা থেকে তাঁর দূরত্বের ব্যাপারটি দেখলে। তাঁর উদ্ভট, নিষ্ঠুর, অবিচারের ঘটনাগুলোয় আমরা দেখি লেখক কত নিস্পৃহভাবে অনুপস্থিত, কখনোই তিনি কোনো পক্ষ নিচ্ছেন না, কখনোই কোনো কিছুতে একটুও অবাক হচ্ছেন না; এর বদলে, সব সময় পক্ষপাতশূন্য, নৈর্ব্যক্তিক এক ভঙ্গিতে গল্প বলে যাচ্ছেন। তাঁর লেখা কেন প্রাসঙ্গিক, কেন আমরা তা পড়ব, এর উত্তরে কাফকার বিখ্যাত ডায়েরি এন্ট্রির কথাটাই মাথায় আসে। আমরা তা পড়ব, কারণ এতে ধরা আছে ‘Das Negative meiner Zeit’ ‘তাঁর সময়ের নেতিবাচকতা।’ কাফকা ডায়েরিতে লিখছেন:

আমি প্রচন্ডভাবে আত্মস্থ করে নিয়েছি আমার সময়ের নেতিবাচক বিষয়গুলো। এমন এক সময়ে আমি বাস করছি যা, অবশ্যই আমার অনেক কাছের, যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আমার কোনো অধিকার নেই, তবে যেন বা এই সময়টার প্রতিনিধিত্ব করার আমার অধিকার আছে।

কাফকার পৃথিবী এ রকম অ্যান্টি-পৃথিবী বলেই, তা ইতিহাসের নেতিবাচক দর্পণ বলেই ফরাসি কম্যুনিস্টরা কাফকা নিয়ে ওরকম ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।

আমরা ফ্রানৎস কাফকার গল্পসমগ্র পড়ব আর সাহিত্যচর্চা তাঁর কাছে কত বড় পূজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ এক এবাদত ছিল তা জানব না, তা হয় না।
কাফকার ডায়েরিতে ও চিঠিতে আমরা দেখি, যতবারই কাফকা বিয়ের চিন্তা করেছেন, ততবারই তাঁর সাহিত্যচর্চাই তাঁর কাছে প্রধান বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে। কোনো ভাষাই নেই এটুকু সত্য বোঝানোর জন্য যে, সাহিত্য তাঁর কাছে তার বেঁচে থাকার জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রেমিকা ফেলিস বাউয়ার একবার যখন বার্লিনে কাফকার চিঠিগুলো এক হাতের-লেখা-বিশারদকে দেখতে দিলেন, সেই লোক বলেছিলেন, এই হাতের লেখা যার, তার ‘সাহিত্যে আগ্রহ’ আছে। ফেলিসকে কাফকা উত্তরে বলেছিলেন: ‘আমার সাহিত্যে আগ্রহ নেই, আমি সাহিত্য দিয়েই গড়া। আমি আর অন্য কিছু না, অন্য কিছু হতেও পারব না।’ তিনি মনে করতেন, বিয়ে করলে তাঁর জীবন থেকে সাহিত্যের জন্য প্রয়োজনীয় নির্জনতাটুকু তিনি হারাবেন। কিন্তু সেই নির্জনতা তিনি যখন খুঁজে পেতেন, তখনো সাহিত্য তাঁর কাছে কঠিন ও হতাশাজনক কিছুই হয়ে থাকত। কাফকার ডায়েরি তাঁর লেখার অক্ষমতা নিয়ে নিজেকে ভর্ৎসনায় ভরপুর। শুধু একবারই তিনি কোনো সচেতন চেষ্টা ছাড়া, স্বাচ্ছন্দে লিখতে পেরেছিলেন। সেই রাতটা ছিল ১৯১২ সালের ২২-২৩ সেপ্টেম্বর রাত, ২২ তারিখের রাত ১০টা থেকে ২৩ তারিখ সকাল ৬টা পর্যন্ত একটানা আট ঘণ্টায় তিনি লিখে ফেলেছিলেন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প ‘রায়’ এবং এটি লেখার মধ্য দিয়েই নিজের লেখনীশক্তি তিনি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন — কাফকা কাফকা হয়ে উঠেছিলেন। পরদিন তিনি ডায়েরিতে লিখলেন: ‘একমাত্র এভাবেই সম্ভব লেখালেখি, একমাত্র এরকম প্রাঞ্জলভাবেই, শরীর ও আত্মা এরকম সম্পূর্ণ খুলে দেওয়ার মাধ্যমেই।’ তাঁর এই প্রথম সাহিত্যিক সাফল্য আসে ফেলিসের সঙ্গে পরিচয়ের মাত্র এক মাসের মধ্যে। তিনি ম্যাক্স ব্রডকে বলেন, গল্পের শেষ লাইনটি লেখার সময় — অর্থাৎ ‘সে সময় সেতুটার উপর দিয়ে পার হচ্ছে রীতিমতো অফুরন্ত স্রোতে যানবাহন’ — এই বাক্যের শেষ শব্দটি ‘Verkher’ (অর্থাৎ traffic বা যানবাহন) লেখার সময় তিনি ভেবেছিলেন ‘শক্তিশালী এক বীর্যপাতের’ কথা। ‘Verkher’ শব্দের জার্মান অর্থ একই সঙ্গে ‘যানবাহন’ ও ‘বীর্যপাত’ বা ‘যৌনমিলন’। এখানে শব্দটি ‘যানবাহন’ অর্থে ব্যবহৃত হলেও, কাফকা যেহেতু ব্রডকে এরকম কথা লিখেছেন, তাঁর মানে কি এই যে তাঁর যৌনকামনা, ফেলিস তা জাগ্রত করার পর, তাঁর লেখালেখির মধ্যে ঠাঁই করে নিয়েছিল?

সফল সার্থক লেখার অনুভূতি কাফকার জন্য শুধু ওরকম চূড়ান্ত আনন্দের কিছু ছিল, কেবল তা-ই নয়; সার্থক কোনোকিছু লেখার মধ্যে দিয়ে তিনি তার জীবনের দুঃখ-কষ্ট থেকেও দূরে সরতে চাইতেন। প্রায়ই দেখা যেত কষ্টের কোনো ঘটনার পরেই কাফকার সৃজনীশক্তি জেগে উঠত। ফেলিসের সঙ্গে বাগ্দান ভেঙে যাওয়ার পরে, ফেলিসের বান্ধবী গ্রেটে ব্লখের সঙ্গে গোপনে প্রেম করবার শাস্তিস্বরূপ বন্ধুদের সঙ্গে হোটেলে ‘বিচারপর্বে’ (tribunal) বসার পরেই, তিনি লিখলেন তাঁর কালজয়ী উপন্যাস বিচার ও মারাত্মক গল্প ‘দণ্ড উপনিবেশে’ দুটি কাহিনিই ন্যায়বিচারের মেটাফর (রূপক)। দুর্গ উপন্যাসটিও তেমন, এটি তিনি শুরু করেন মিলেনার সঙ্গে বিচ্ছেদ হবে হবে এমন সময়ে। লেখার মাধ্যমে জীবনের উচ্চতর দৃষ্টিকোণ অর্জন করে কাফকা তাঁর অর্থহীন আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মগ্লানি থেকে কিছুটা হলেও বাঁচবার পথ খুঁজে পেতেন। ১৯২২ সালে তিনি লিখলেন, লেখালেখির সান্ত¡না এটাই যে এর মাধ্যমে ‘খুনিদের লাইন’ থেকে তিনি বেরিয়ে যেতে পারেন, আর সৃষ্টি করতে পারেন ‘আরো উচ্চতর ধরনের এক দেখার চোখ, উচ্চতর, ধারালোতর নয়; আর সেটা যত বেশি উঁচু হয়, খুনিদের লাইন থেকে (আমার অস্তিত্ব) তত দূরে সরে যায়; সেটা যত তার নিজের গতির আইন মেনে চলে, ততই তার পথ হয়ে ওঠে আরো অগণনীয়, আনন্দময় ও ঊর্ধ্বগামী।’

একই সঙ্গে কাফকা ভাবতেন যে, লেখালেখি তাঁর কাছে নিজের ‘মনশ্চিকিৎসা’র চেয়ে অনেক বেশি কিছু। লেখালেখির মধ্য দিয়ে ‘নবযুগের’ সূচনা হয় বলে ভাবতেন তিনি। ১৯১৬ সালে কাফকা তাঁর প্রকাশকের কাছে স্বীকার করলেন, ‘দণ্ড উপনিবেশে’ গল্পটি আসলেই বেদনাদায়ক একটি গল্প; ব্যাপারটা তিনি ব্যাখ্যা করলেন এভাবে: ‘আমাদের ইতিহাসের এই যুগ, বিশেষ করে আমার এই সময়টি, সত্যিই অনেক বেদনাদায়ক।’ পরের দিকে এসে তিনি তাঁর লেখালেখিকে বললেন ‘ধাঁধায় ভরা এক মিশন’।

এক গ্রাম্য ডাক্তার-এর মতো লেখা লিখে আমি এখনো খুব বেশি হলে ক্ষণস্থায়ী একধরনের তৃপ্তি পেতে পারি, এ ক্ষেত্রে ধরে নিচ্ছি যে ওরকম আরো লেখা আমার পক্ষে সম্ভব (যদিও খুবই অসম্ভব ঠেকছে ব্যাপারটা); কিন্তু সুখ পেতে পারি কেবল তখনই যখন আমার পক্ষে সম্ভব হবে পৃথিবীকে তার শুদ্ধ, সত্য ও পরিবর্তনের-অতীত রূপে তুলে ধরা।

এ কথার কী অর্থ (…’raise the world into the pure, the true, the unchangeable’) তা বোঝা দুরূহ; তবে এটুকু পরিষ্কার যে লেখালেখি তাঁর কাছে ব্যক্তিগত কোনো প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কিছু ছিল। তিনি পৃথিবীর মূল সত্য, আদি ও অপরিবর্তনীয় মূল রূপটিকে তা শুভ হোক আর অশুভ হোক, কিছু যায়-আসে না; অন্তত তাঁর কাছে সত্য রূপ বলে মনে হলেই হলো তাঁর লেখালেখির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে চাইছিলেন। তিনি যখন একই প্রসঙ্গে বলেন, লেখালেখি তাঁর কাছে ‘প্রার্থনা’র মতো, তখন হঠাৎই বিভ্রম বোধ হয় যে (যেমনটা কাফকার লেখার ধর্মীয় ব্যাখ্যাদাতারা বলেন), সত্যিই কি কাফকা নিজেকে ‘পয়গম্বর’ বলে মনে করতেন?

আগেই বলেছি, কাফকার সাহিত্যকর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়েছে অগুনতি রকমের। কোনো কাফকা-ব্যাখ্যারই গভীরে যাওয়ার জায়গা এটি নয়; অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য ওই ছোঁয়াটুকুই যথেষ্ট। তার পরও যতগুলো কাফকা-ব্যাখ্যা হয়েছে (বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাফকা ব্যাখ্যার মোট ১৯ রকমের মূলধারা আছে), যেমন অস্তিত্ববাদী ব্যাখ্যা, মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণবাদী ব্যাখ্যা (তিনি ডায়েরিতে লেখেন যে, ‘রায়’ গল্পটি লেখার সময়ে তাঁর মাথায় ‘ফ্রয়েডের চিন্তা, স্বাভাবিকভাবেই’ এসেছিল), মার্ক্সিস্ট ব্যাখ্যা, মেটাফিজিক্যাল ব্যাখ্যা, সামন্ততান্ত্রিক ব্যাখ্যা, অ্যাবসার্ড সাহিত্যিক ব্যাখ্যা, এক্সপ্রেশনিস্ট ব্যাখ্যা, সামাজিক ব্যাখ্যা, রাজনৈতিক ব্যাখ্যা, ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা, দার্শনিক ব্যাখ্যা, নন্দনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, আত্মজৈবনিক ব্যাখ্যা, আইনি ব্যাখ্যা, ইত্যাদি ইত্যাদি, এর মধ্যে আজও অন্যতম জোরালো ব্যাখ্যা হিসেবে, মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার সূত্রের নিরিখে কাফকা-ব্যাখ্যা এবং অস্তিত্ববাদী দর্শনের আলোকে কাফকা ব্যাখ্যার পাশাপাশি টিকে আছে কাফকা-সাহিত্যের ধর্মীয় ব্যাখ্যা। মৃত্যুর পরে যেহেতু ম্যাক্স ব্রডের হাত ধরেই কাফকার বিশ্বসাহিত্যে প্রবেশ এবং ব্রড যেহেতু বিশ্বাস করতেন কাফকার লেখাকে দেখতে হবে ‘ঈশ্বরহীন পৃথিবীতে ব্যক্তিমানুষের ঈশ্বরকে খোঁজার আধ্যাত্মিক এক নিরন্তর সংগ্রাম হিসেবে’, আর সেই সঙ্গে কাফকার প্রথম ইংরেজি অনুবাদক উইলা ও এডুইন ম্ইুরও যেহেতু সেই বিশ্বাস মাথায় রেখেই কাফকা-অনুবাদ করেন, কাফকার ধর্মীয় ব্যাখ্যাটি তাই রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে ‘কাল্ট’-এর আকার ধারণ করে। আমরা এখানে কাফকার সৃষ্টিকর্মের আজও এই সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যাখ্যাটি নিয়ে সামান্য আলোকপাত করব।
ধেয়ান নামের গল্পসংকলনে আছে কাফকার অন্যতম বিখ্যাত স্কেচ ‘গাছ’। পুরো লেখাটি এ রকম:

যেহেতু আমরা হচ্ছি তুষারে গাছের গুঁড়িগুলোর মতো। আপাত-চোখে ওগুলো কী সুন্দর, তুষারের উপরে, পড়ে আছে মাটিতে; আর হালকা একটা ধাক্কাতেই আমরা ওদের সরাতে পারব মনে হয়। না, আপনি তা পারবেন না, কারণ ওরা শক্ত করে মাটিতে গাঁথা। কিন্তু দেখুন, সেটাও স্রেফ আপাত-অর্থেই।

এই লেখার কী মানে হয়? নিট্শের মতোই কাফকা এখানে বলছেন, ‘পৃথিবীর আর কোনো নিরাপদ ভিত্তি নেই, ভিত্তি সরে গেছে।’ তুষারের মধ্যে বড় হওয়া গাছগুলো দেখে মনে হচ্ছে ওরা দাঁড়িয়ে আছে শক্তপোক্তভাবে, কিন্তু ওদের ধাক্কা দিয়ে সরানো সম্ভব। তবে আমরা সরাতে চাইলেই গাছগুলো থেকে বাধা আসছে, মনে হচ্ছে আমাদের চেয়ে ওদের শিকড় আরো গভীরে পোক্ত। কিন্তু ওদের এই মাটির গভীরের শিকড় একটা ‘ইল্যুশন’ বা অলীক কল্পনা মাত্র। দেখতে যাকে সবচেয়ে পোক্ত ভিত্তির মনে হয়, তার ভিত্তি আসলে অত পোক্ত আদৌ নয়। নিট্শের ক্ষেত্রে এই হালকা ভিত্তির কারণ, ইউরোপে ‘ঈশ্বর মারা গেছেন।’ সেটা এ কারণে শুধু নয় যে, মানুষের ধর্মবিশ্বাস ধসে গেছে; বরং এ কারণেও যে মানুষ চাইছে, বিদ্রোহীর মতো, তাদের নিজেদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ ঈশ্বরের হাত থেকে কেড়ে নিজেদের হাতে নিয়ে নিতে। ইউরোপে ঈশ্বর-অস্বীকারের মধ্যে দিয়ে পৃথিবী তার আগের সেই স্পষ্ট দিগন্তরেখা, স্পষ্ট অর্থ এবং দৃঢ় ভিত্তি হারিয়ে ফেলেছে। যুদ্ধ, নির্যাতন, ক্ষুধা, নিগ্রহ ও নির্বিচার অবিচারের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়ে গেছে যে, আর কোনো সূত্র নেই, শরণ নেই, কিসের বরাতে জীবনকে দেখব তার আর কোনো বিধিমালা নেই, মানুষ আর পারছে না পৃথিবীকে অন্ধকার পথের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া ঠেকাতে; কোনো অভিভাবক নেই, কর্তা নেই, যিনি কিনা আমাদের জন্য তা ঠেকাবেন।

কাফকা বারবার ওরকম এক পরিস্থিতির ছবি এঁকেছেন যেখানে আমাদের অভিভাবক, আমাদের কর্তা, আরো আরো দূরে সরে গেছেন, অনতিক্রম্য দূরে, যেন নির্বাসনে। সে জন্যই কাফকার শ্রেষ্ঠতম একটি লেখা ‘সম্রাটের কাছ থেকে একটি বার্তা’য় (এ বইয়ের এক গ্রাম্য ডাক্তার গল্পসংকলনে আছে) আমরা দেখি সম্রাট তাঁর বার্তাবাহককে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন তাঁর মৃত্যুশয্যা থেকে, কিন্তু সেই ‘অপরাজেয়’, ‘শক্তিশালী’ বাহক নানা গোলকধাঁধার চক্করে পড়ে আমাদের কাছে মৃত সম্রাটের বার্তাটি আর পৌঁছাতেই পারল না। ‘কিন্তু’, গল্পটি এভাবে শেষ হচ্ছে, ‘তুমি বসে থাকো তোমার জানালায়, আর যখন সন্ধ্যা নামে, তুমি স্বপ্নে কল্পনা করে নাও ঐ বার্তার’। ঈশ্বর যদি সত্যিই মারা গিয়েও থাকেন আমরা তবু ঐ ঐশ্বরিক বার্তার আশায় বসে থাকি; কিন্তু যখন কোনো বার্তা, কোনো সাহায্যই আসে না, যখন ধুম করে চাকরি হারিয়ে একটা পরিবার রাস্তায় ভিক্ষার জন্য বসে যায়, বা যখন বিনা বিচারে পুলিশ আমাদের কারাগারে ঢুকিয়ে দেয়, তখন আমরা মনে মনে কল্পনা করে নেই সে বার্তার, খোদার থেকে পাব এমন কোনো সান্তনার।

কাফকার উপন্যাসগুলোতে আমাদের যিনি বাঁচাবেন তাঁর এই অনুপস্থিতি অধিকাংশ সময়েই ধর্মীয় রূপকল্পে তুলে ধরা হয়েছে। আমেরিকা উপন্যাসে নিউ ইয়র্ক শহরের গির্জা দেখা যাচ্ছে কুয়াশার মধ্যে ডুবে আছে, কিন্তু পোলান্ডারের গ্রামের বাড়িতে কোনো গির্জাই নেই, বিল্ডিংটার আধুনিকায়নের কাজে ওটা পরিত্যক্ত করে রাখা হয়েছে। বিচার উপন্যাসের ক্যাথেড্রালটি বিশাল, অন্ধকারাচ্ছন্ন, প্রায় ফাঁকা; জোসেফ কে.র কাছে ওটা মূলত একটা ‘ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশন’। কবরে রাখা যিশুর একটা ছবি, জোসেফ কে. টর্চলাইটের আলোয় ছবিটা টুকরো-টুকরোভাবে দেখতে পাচ্ছে, একবারে পুরোটা কখনো নয়, তারপর একসময় সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল, কারণ ওটা ইদানীংকালের আঁকা একটা ছবি মাত্র। ক্যাথেড্রালের এই অন্ধকার দেখে আমাদের মনে পড়ে নিট্শের পাগলের সেই সর্বনাশা কথা: ‘চার্চগুলো এখন আর খোদার কবর ও মনুমেন্ট ছাড়া আর কী?’ কাফকার শেষ উপন্যাস দুর্গতে আমরা দেখি কীভাবে তিনি কে.র নিজের শহরের চার্চের সঙ্গে এই দুর্গের তুলনা দিচ্ছেন। দুর্গটি দেখতে দুর্গের মতো লাগছে না। তাহলে দুর্গের চেহারা নিয়ে কে.-র যে প্রত্যাশা, তা মিটবে কীভাবে? দুর্গে তো অভিভাবকেরা থাকেন, তাঁদের থাকার জায়গার চেহারাই যদি অমন হয়, তাহলে তাদের নিজেদের চেহারা কেমন হতে পারে? তাহলে এই হচ্ছে গ্রামের মানুষের কর্তার ছবি? আর দুর্গটা যদিও গ্রামের পেছনে অনেক উঁচুতে, কিন্তু ওটা দেখতে তো গ্রামের থেকে আলাদা কোনো কিছু লাগছে না। কাফকা কি এখানে ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে আজকাল মানুষ যে কর্তৃত্বের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে (অর্থাৎ খোদা), তা আসলে তাদের নিজেদের কল্পনা দিয়েই গড়া কোনোকিছু?

বারবার কাফকার লেখার এই ‘চার্চ’ তাঁর সময়ের প্রাগের চিত্রকেই তুলে ধরে, তাঁর ইহুদি পরিবারকে নয়। কাফকার জন্মস্থানের কয়েক গজের মধ্যেই চারটি বিশাল বিশাল চার্চ, পুরো প্রাগ ভরে আছে বিশালায়তন সব চার্চে। খ্রিষ্টধর্ম তাঁর কাছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা হিসেবে একদম তাঁর চোখের সামনেই ছিল সব সময়। তবে তাঁর লেখায় যে চার্চগুলো আছে, তাদের কী ব্যাখ্যা, তা বলা দুরূহ। ‘রায়’ গল্পে গেয়র্গের বন্ধু থাকে রাশিয়ার পিটার্সবার্গে, অর্থাৎ পিটারের শহরে, আমাদের মনে আসে সেন্ট পিটার ও রোমের কথা। তারপর গল্পের সেই বিধ্বংসী দৃশ্য: কিয়েভ শহরের এক যাজক মানুষের অনেক বড় এক ভিড়ের সামনে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তার হাতের তালু কেটে একটা ক্রুশচিহ্ন আঁকলেন। কেন? আর গেয়র্গের বাবা যখন গেয়র্গকে মৃত্যুদ- দিলেন, গেয়র্গ যখন সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নামছে, তখন ঠিকে-ঝি চিৎকার করে উঠল: ‘যিশু’; ব্রিজটা থেকে ঝুলন্ত গেয়র্গকে নিশ্চয় ঝুলন্ত ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মতোই দেখতে লাগছিল। ‘রূপান্তর’ গল্পে পোকা হয়ে যাওয়া গ্রেগরের দিকে তাঁর অভিভাবক পিতা আপেল ছুড়ে মারলেন, সে তখন ‘ঐ জায়গাতেই যেন পেরেকে গেঁথে গেল’ আবার সেই ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ছবি মনে আসে আমাদের। ‘দণ্ড উপনিবেশে’ গল্পে শাস্তিপ্রাপ্ত আসামির আলোকপ্রাপ্তি ঘটে ‘ষষ্ঠতম ঘণ্টায়।’ ‘এক গ্রাম্য ডাক্তার’ গল্পের অসুস্থ ছেলেটিকে জানালা থেকে তাকিয়ে দেখে দুটি ঘোড়া; আস্তাবলে যিশুর জন্মের উল্টো ছবি যেন। ‘এক অনশন-শিল্পী’ গল্পে অনশন-শিল্পী খায় না ‘৪০ দিন’। ঠিক ৪০ দিনই কেন? যিশুর জনহীন-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো, উপোস করা সেই ৪০ দিনের কথাই কি মনে আসে না এটি পড়লে?

বাইবেলের এসব পরোক্ষ-উল্লেখ বিভ্রান্তিকরই ঠেকে, মনে হয় কাফকা খ্রিষ্টধর্মের মূল্যবোধগুলো নিয়ে ক্রিটিক করছেন। নিট্শের পাঠক হিসেবে কাফকা নিঃসন্দেহে ধর্ম নিয়ে নিট্শের সমালোচনাগুলো (বিশেষ করে খ্রিষ্টধর্ম নিয়ে করা যেগুলো) জানতেন। নিট্্শে অস্বীকার করেছিলেন যে খ্রিষ্টধর্মের নৈতিক বিষয় ও ধর্মতত্ত্বের মধ্যে আসমানি কোনো ব্যাপার আছে। নিট্শের হিসেবে নৈতিকতা বিষয়টি ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, কোনো অবিনশ্বর-একক নৈতিকতা বলে কিছু নেই, আর ধর্মীয় নৈতিকতার এত জয়গান এজন্য না যে ওগুলোর মধ্যে আহামরি কোনো উৎকর্ষতা আছে, বরং এজন্য যে, যারা ওগুলো মেনে চলে তারা পৃথিবীতে বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত মানুষ হয়। নিট্শে আরো বলেন, ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্মের যাজক জাতীয় লোকেরা মূলত অসুস্থ, প্রাণহীন, খোঁড়া মানুষ আর তারা তাদের ততোধিক দুর্বল শিষ্যদের ওপর খবরদারি চালায় তাদের কৌশলে, মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়ে। এই আলোকে দেখলে কাফকার ‘রায়’ গল্পের নিজেকে আহত করা সেই যাজক হয়ে ওঠে নিট্শের The Genealogy of Morals-এর অসুস্থ যাজকেরই একটি ছবি, যে যাজকের ক্ষমতার কেন্দ্রে আছে তার শিষ্যদের অসুস্থতার বোঝা বহনের গল্প। আমরা দেখি, ‘রূপান্তর’ গল্পের স্বার্থপর পরিবারটি যখন গ্রেগরের মৃত্যুর খবর পায়, তারা তাদের বুকে, স্বস্তিতে, ক্রুশচিহ্ন আঁকে। আমেরিকা উপন্যাসে কাজের মেয়ে ইয়োহান্না ব্রামার কার্লকে যৌনভাবে ব্যবহার করার পরে একটা কাঠের ক্রুশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করে। ‘এক গ্রাম্য ডাক্তার’ গল্পের ডাক্তার এটা ভেবে ব্যথিত যে তার রোগীরা তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস তাদের অপদার্থ যাজককে বাদ দিয়ে এখন এই বুড়ো ডাক্তারের ওপর অর্পণ করেছে:

তাদের আগের সেই ধর্মবিশ্বাস তারা হারিয়ে ফেলেছে; যাজক বসে আছে বাড়িতে আর তার বেদিতে পরার পোশাক এক এক করে ছিঁড়ে ফেলছে; কিন্তু ডাক্তারের কাছ থেকে তাদের আশা যে তিনি তার শল্যচিকিৎসকের নাজুক হাত দিয়ে সব অসম্ভবকে সম্ভব করে দেবেন।

কাফকার লেখায় উপরের এসব খ্রিষ্টধর্মের সঙ্গে যোগাযোগের উদাহরণের পাশাপাশি ইহুদিধর্ম ও জায়োনিজমের যোগাযোগের বিষয়টা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। দুই ধর্মের তাত্ত্বিকেরাই যার যার মতো করে অসংখ্য উদাহরণ তুলে ধরেছেন কাফকার গল্প, উপন্যাস, ডায়েরি, চিঠি ঘেঁটে। জায়োনিস্ট আন্দোলনের মতো একটি বাস্তবভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি কাবালার (Kabbalah; ইহুদিদের গূঢ় রহস্যময় ধর্মীয় গুপ্তবিদ্যা) দৃষ্টিকোণ থেকেও কাফকাকে দেখা হয়েছে। বিচার উপন্যাসের দৃশ্যকল্পগুলো , যেমন এর বিচারকেরা, দ্বার রক্ষকেরা, এর ঘোঁরানো-প্যাঁচানো সিঁড়িগুলো, বলা হয়েছে কাবালার অনেক সূত্র ও মন্ত্রের সঙ্গে মিলে যায়; যদিও কাফকা বিচার উপন্যাস লেখার সময়ে কাবালা বিষয়ে কতটুকু জানতেন তা নিয়ে বিরাট সন্দেহ আছে। কাফকার ধর্মীয় ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এখানে খ্যাতিমান দার্শনিক ওয়াল্টার বেন্জামিন ও ধর্মতাত্ত্বিক গেরশোম শোলেম (বর্তমানে যাকে কাবালা-বিদ্যা ও আধুনিক জার্মান-ইহুদি চিন্তার অন্যতম বড় স্তম্ভ হিসেবে দেখা হচ্ছে)-এর মধ্যকার বিতর্কের কথা উল্লেখ না করে পারছি না। বেন্জামিন খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন ম্যাক্স ব্রড ও অন্যদের খাড়া করা ‘অনায়াসলব্ধ’ ধর্মীয় ব্যাখ্যা পড়ে (তিনি ব্রডের লেখা কাফকা জীবনীগ্রন্থটি অন্যদের পড়তেই মানা করেছিলেন; তাঁর হিসেবে এতই ফালতু ওই বই); তাঁর ভাষ্যমতে, কাফকার কল্পনাগুলো পৃথিবীতে ধর্মের উদ্ভব ঘটারও আগের সময়কার বিষয়, কাফকার চিন্তার সঙ্গে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের চিন্তার যোগাযোগ আছে, কাফকার এই ‘প্রাচীনতা’ (যদিও তিনি ‘আধুনিকতাবাদী’ বা মডার্নিস্ট লেখকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ) ধর্ম ঘটবার আগের ঘটনা। আর শোলেম উত্তরে বলেছিলেন, যা-ই বলা হোক না কেন, কাফকা ঐশ্বরিক বার্তার আলোকেই তাঁর পৃথিবীর ছবিটি এঁকেছিলেন, কিন্তু সেই বার্তার তিনি পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে যেতে পারেননি, কারণ তিনি বার্তাটির ঠিকভাবে পাঠোদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। শোলেমের মতে, কাফকা ‘নেগেটিভ’ বা ‘নেতিবাচক’ ধর্মতত্ত্বের বার্তাবাহক, ইতিবাচক ধর্মীয় বিশ্বাসের নয়।

যা-ই হোক, আপনি যতই কাফকা পড়বেন, বিশেষ করে তাঁর ডায়েরি, ততই আপনার কাছে পরিষ্কার হবে যে, কাফকার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্মানুরাগী কারো খুশি হওয়ার কিছু নেই। আপনি ধাঁধায় পড়ে যাবেন এটা ভেবে যে, কাফকা কি ঈশ্বরের প্রশংসা করছেন, নাকি ঈশ্বরের সমালোচনা করছেন, নাকি ঈশ্বরের বাণী যে মানুষেরা বহন করে তাদের ব্যাপারে সন্দেহ-অবিশ্বাস-সংশয় প্রকাশ করছেন? আর সেই সঙ্গে কাফকার ঈশ্বর কি খ্রিষ্টান ঈশ্বর, নাকি ইহুদি ঈশ্বর, নাকি অন্য কোনো ধর্মের ঈশ্বর? কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতিই তিনি মিত্রতা দেখাননি– এটুকু পরিষ্কার। যতজন ধর্মবেত্তা ও দার্শনিক কাফকার মন কেড়েছিলেন, তাঁর মধ্যে একমাত্র সোরেন কির্য়েকেগার্ডের (১৮১৩-১৮৫৫) সঙ্গেই ছিল তাঁর কিছুটা বিশেষ এক সম্পর্ক।

১৯১৩ সালে কাফকা প্রথম কির্য়েকেগার্ড পড়েন। তিনি দেখতে পান যে ফেলিস বাউয়ারের সঙ্গে তাঁর বাগ্দান ভেঙে যাওয়ার ঘটনার (যার মূল উৎস ছিল বিয়ে করলে সাহিত্যচর্চায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে এমন একটা ভীতি) সঙ্গে ধর্মের টানে কির্য়েকেগার্ডের রেজিনা ওলসেন-এর সঙ্গে বাগ্দান ভেঙে যাওয়ার ঘটনার মিল আছে। ১৯১৭-১৮ সালে তিনি নতুন করে কির্য়েকেগার্ড পড়া শুরু করেন, ব্রডকে লেখা চিঠিতে বিস্তারিত লিখতে থাকেন কির্য়েকেগার্ড প্রসঙ্গে। কাফকা বিশেষভাবে মুগ্ধ হন কির্য়েকেগার্ডের Fear & Trembling বইয়ের পিতা-পুত্রের কাহিনি — হজরত ইবরাহিম ও তাঁর ছেলে ইসমাইলের কুরবানির কাহিনি– পড়ে। ছেলেকে কুরবানি দিতে রাজি হওয়ার মধ্যে দিয়ে ইবরাহিম সামাজিক নৈতিকতার ঊর্ধ্বে উঠে (অর্থাৎ পুত্রহত্যা করতে রাজি হয়ে) তাঁর পিতৃসুলভ নৈতিকতাবোধ ছাড়িয়ে গিয়ে, খোদার সেবায় সবকিছু উৎসর্গ করতে সম্মত হয়েছিলেন। অর্থাৎ ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রত্যয় খুব ভালোভাবেই সামাজিক নৈতিকতার বিপক্ষেও দাঁড়িয়ে যেতে পারে– এমনটাই বলেছিলেন কির্য়েকেগার্ড। কাফকা বললেন অন্য কথা। ইবরাহিম-ইসমাইলের ঘটনায় তাঁর মনে হলো ধর্মবিশ্বাস আসলে ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত একটি বিষয়, যার নির্ণয় শুধু খোদাই করতে পারেন; এখানে সামাজিক নৈতিকতার আগে – ঐ কুরবানির ঘটনায়– বিবেচনা করতে হবে ব্যক্তির সিদ্ধান্তকে। কাফকার আরো মনে হলো, যে মানুষ তার চরিত্র দৃঢ় রাখতে পারে, তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য অটুট রাখতে পারে (যদিও বাবা-মা ও শিক্ষকেরা সব সময়ে চেষ্টা করেন এটা খর্ব করতে), সেই মানুষের প্রতি শয়তান ও ফেরেশতা, দুই-ই আকৃষ্ট হয়, এর ফলে তার পক্ষে পরম ভালো কাজ ও চরম খারাপ কাজ– দুটোই করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে।

কির্য়েকেগার্ড এভাবেই কাফকাকে তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলো মানবসমাজের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখার চশমাটা ধার দিলেন, ধর্মীয় কাঠামোর আয়তনে জীবনকে দেখার স্পৃহা জাগালেন। কাফকা বুঝতে পারলেন, লেখালেখি শুধু নিজের জন্য নয়, শুধু নিজের সৃজনীক্ষুধা মেটাবার জন্য নয়, বরং এর মাধ্যমে বৃহত্তর মানবসমাজের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব, অর্থাৎ লেখালেখির কোনো উচ্চতর লক্ষ্যও থাকতে পারে। এভাবেই উচ্চতর লক্ষ্যে পৌঁছানোর তাড়না থেকেই কাফকার লেখালেখি তাঁর অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠল, কাফকা তাঁর অস্তিত্বের একটা ন্যায্যতা খুঁজে পেলেন এর মধ্যে দিয়ে। তাঁর লেখার প্রয়োজনটা হয়ে উঠল অস্তিত্ববিষয়ক বা অস্তিত্ববাদী, বা ধার্মিক প্রয়োজন। বিচার উপন্যাস লেখার সময় তিনি ডায়েরিতে লিখলেন:

দু বছর আগে যেমনটা ছিলাম [অর্থাৎ ‘রায়’ গল্প লেখার সময়ে] আজ আর আমি আমার লেখার মধ্যে সেরকম সুরক্ষিত অবস্থায় নেই…তার পরও আমি জীবনের একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছি; আমার রোজকার শূন্য, পাগলাটে, ব্যাচেলরের মতো জীবনের একটা ন্যায্যতা খুঁজে পেয়েছি।

শেষ দিকের কাফকা শুধু তাঁর নিজের জীবনের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি ও একটি কারণ বা ন্যায্যতা খুঁজে ফেরেননি, তিনি সেটি, পয়গম্বরদের মতোই, আমাদের সবারটার জন্যও হন্যে হয়ে খুঁজেছেন। তিনি তখন নিজেকে দেখেছেন তাঁর সময়ের আধ্যাত্মিক অবস্থার প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে। ১৯১৮-র ২৫ ফেব্রুয়ারির নোটবুকে আমরা তাকে এক রহস্যময় আধ্যাত্মিক মিশনের সঙ্গে লড়াইরত দেখি:

আমি যদ্দুর জানি, জীবনের জন্য দরকারি এমন কিছুই আমি সঙ্গে আনিনি, শুধু এনেছি মানুষের চিরকালীন ও সর্বজনীন দুর্বলতাগুলো। এভাবেই…খুব শক্তিশালীভাবেই আামি আত্মস্থ করে নিয়েছি আমার সময়ের নেতিবাচক দিকগুলো…। কির্য়েকেগার্ডকে যেভাবে খ্রিষ্টধর্ম– মানতেই হবে ওই ধর্ম এখন আলগা হয়ে পড়েছে, ব্যর্থ হচ্ছে– জীবনে হাতে ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে, আমাকে তা নেয়নি; কিংবা জায়োনিস্টরা যেভাবে ইহুদিদের প্রার্থনার শালের প্রান্ত– ওটাও এখন আমাদের থেকে পালিয়ে যাচ্ছে– ধরতে পেরেছে, আমি তা পারিনি। আমিই শেষ কিংবা আমিই শুরু।

কাফকা যখন বলেন, তিনি হয় শেষ, না হয় তিনি শুরু, অর্থাৎ তাঁর মধ্যেই আছে একটা সমাপ্তি বা একটা আরম্ভ, তিনি পুরোপুরি ভুল বলেন না। তিনি অর্ধেক ঠিক কথা বলেন। একভাবে দেখলে তিনি সমাপ্তি তো বটেই: তাঁর পথ ধরে আর বেশি দূর যাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়; যে ভয়ংকর পৃথিবী তিনি তাঁর মাথার মধ্যে বয়ে চলেছিলেন, তার সামান্য অংশ মাথায় আনলেও সাধারণ মানুষ স্ট্রোকে বা দুর্ঘটনায় মারা যাবে (এ প্রসঙ্গে কাফকার মৃত্যুতে মিলেনা য়েসেন্স্কার শোকবার্তাটি আবার পড়ুন)। কিন্তু থিমের দিক দিয়ে দেখলে, তিনি শুরু। তাঁর বিশাল ও মহান থিম–এর পূর্বপুরুষ নিট্শে ও কির্য়েকেগার্ডে লুকানো থাকলেও, কথাসাহিত্যে কাফকার আগে কেউ তা ভাষা দেয়নি– হচ্ছে এ পৃথিবীতে বাস করার শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক টেনশন। আমাদের সময়ের আধুনিকতা, উদারনৈতিক চিন্তাচেতনা এবং তথাকথিত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ফাঁকিটা ও ফাঁকটা কাফকা ধরতে পেরেছিলেন। সেজন্যই হয়তো কাফকার লেখা ভর্তি পুরোনো প্রথা ও পুরোনো বিশ্বাসে: পিতা, পিতার শাসন, আদালত, বিচার, দুর্গ, সম্রাট, অবিনশ্বর আইন ইত্যাদি। তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘চীনের মহাপ্রাচীর’ -এ যূথবদ্ধ, একত্রিত এক জাতির কথা বলার সময়, সেই জাতির একজন হতে পারার ‘মহান’ ব্যাপারটির কথা জানানোর সময়, কীভাবে কাফকা কাব্যিক হয়ে ওঠেন! আর ‘আইনের দরজায়’ গল্পে ভেতরে প্রবেশের জন্য দাঁড়িয়ে থেকে থেকে লোকটা যখন ব্যর্থ এক জীবন কাটিয়ে মারা যাচ্ছে, তখন এই বোকা কিনা দেখে যে ‘আইনের দরজাপথ থেকে ভেসে আসছে অনির্বাণ একটা দীপ্তি।’

কাফকার মতো চালাক সম্ভবত আর কেউ ছিলেন না; তাঁর মতো স্বচ্ছতা নিয়ে বিশ্বব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থার ফাঁকগুলোও আর কেউ বোধ হয় ধরতে পারেননি। কাফকার রসবোধ (সেন্স অব হিউমার) নিয়ে চিন্তা করলেই মনে হয়, কীরকম গুরুতর সব পরিস্থিতিকে কীরকম কমিক বানিয়ে ছেড়েছেন তিনি। প্রাগের ‘ক্যাফে স্যাভয়’ তে তিনি যখন বন্ধুদের সামনে বিচার উপন্যাসের শুরুটা পড়ে শোনাচ্ছেন, তখন তিনি ও তাঁর বন্ধুরা হেসে কুটিকুটি। কেন? ওরকম ভয়ংকর এক ঘটনা দিয়ে যার শুরু এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে তার বিছানায় এক সকালে আগন্তুকেরা এসে গ্রেপ্তার করে বসল, বিনা কারণে তা পড়তে গিয়ে কাফকা ওরকম হাসছিলেন কেন? ‘গায়িকা জোসেফিন বা ইঁদুর-জাতি’ গল্পে (এ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত) সংগীতশিল্পী জোসেফিনকে নিয়ে কাফকা ওরকম মারাত্মক ব্যঙ্গ করেন কেন যে, জোসেফিন আসলে গান গায় না, সে অন্য ইঁদুরদের মতোই একটু কিচিরমিচির করে? জোসেফিন ভাবে সে তাঁর জাতির ত্রাণকর্তা, আর গল্পের কথক কিনা বলে, ‘হায় খোদা, জোসেফিন যেন কোনো দিন জানতে না পারে, আমরা যে তাকে শুনি সেটাই প্রমাণ করে যে সে সত্যিকারের কোনো গায়িকা নয়।’ এ কেমন কথা? গল্পে গল্পে কাফকার এই বক্রোক্তি, ঠাট্টা, শীতল রসিকতা কখনো কখনো আমাদের উঁচু লয়ের হাসিতে ফেটে পড়তেও বাধ্য করে ( ‘রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান’, ‘এক ছোটখাটো মহিলা’, ‘দি স্টোকার’, ‘প্রথম দুঃখ’, ‘এক অনশন-শিল্পী’, ‘গায়িকা জোসেফিন’)। কাফকার এই যে জার্মান ভঙ্গিতে রস বা হিউমার, যা কমেডিও নয়, বা চাতুর্যপূর্ণ রসিকতাও (রিঃ) নয়, আসলে জীবনের খুঁতগুলো খুব ভালোভাবে বুঝে গিয়ে সেগুলো নিরাসক্তভাবে মেনে নেওয়ার তাঁর যে ভঙ্গি– যেন তিনি বোঝেন যে কেবল তিনিই ওগুলো বোঝেন, কিন্তু আমরা বোকারা বুঝি না–তারই প্রকাশ। আজ বিশটি বছর ধরে কাফকা পড়ার পরে আমার এই দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে, কাফকার রসবোধ যে বুঝবে, গল্পে গল্পে তাঁর বাঁকা উক্তি ও খোঁটা ও ব্যঙ্গগুলো যে ধরতে পারবে, সে-ই দাবি করতে পারবে, সে কাফকা বুঝেছে।

কাফকার সব প্রধান নায়কেরা দেখবেন একটা মতিবিভ্রমের মধ্যে আছে; পোকা গ্রেগর ভাবছে সে পোকা হয়ে গেছে তো কী হয়েছে, তাকে অফিসে যেতে হবে; জোসেফ কে. তাঁর বিচার হবে বলে সারা জীবন অপেক্ষা করছে; কে. দুর্গের লোকদের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য জীবনটা বরবাদ করে দিচ্ছে; সম্রাটের বার্তাবাহক দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছেই; গ্রাম্য ডাক্তার যতক্ষণে খেলাটা বুঝতে পেরেছেন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে; আইনের দরজায় ঐ বুদ্ধু দাঁড়িয়েই আছে এই অপেক্ষায় যে দরজাটা কবে খুলবে; দণ্ড উপনিবেশে মৃত্যুদণ্ডের পুরোনো প্রথায় বিশ্বাসী লোকটি ভাবছে এই পর্যটক তার ভয়ংকর বিচারব্যবস্থার পক্ষে রায় দিয়ে সব আবার ঠিক করে দেবেন। এদের কারো বিভ্রম, কারো ঘোরই, যেন কাটছে না। এ বইয়ের মোট ৪৬-৪৭টি গল্প-ছোট গল্প-স্কেচের ২৪টিতেই আমরা ওরকম মতিবিভ্রমের (delusion) মধ্যে থাকা চরিত্রের খোঁজ পাই। আমরা অবাক হই, হাসি, ওদের জন্য আমাদের মায়া হয়।

মজার কথা হচ্ছে, কাফকার এ রকম কোনো মতিবিভ্রম বা অলীক বিশ্বাস ছিল না। তিনি পৃথিবীকে অতি, অতি স্পষ্ট করে দেখে ফেলেছিলেন, যেভাবে দেখলে নিজের আর কোনো বিভ্রম থাকে না, কেবল তখন অন্যের বিভ্রম নিয়ে ঠাট্টা করা যায়। কাফকা জেনে গিয়েছিলেন যে ক্ষমতাশালীরা টিকে থাকে বিভ্রম ছড়িয়ে, মিথ্যা বলে আর ভয় দেখিয়ে; আর ক্ষমতাহীনেরা বেঁচে থাকে ঐ ক্ষমতাশালীদের যে ক্ষমতা আছে তা কল্পনা করে নিয়ে। এরা দুই পক্ষই বড় বড় কথা বলে, ফাঁকা আওয়াজ ছাড়ে, কিন্তু ওদিকে এদের আন্ডারওয়্যারগুলো নোংরা, এদের প্রার্থনার পোশাকগুলো ধার করা, এদের বিচারালয়ে পর্নোগ্রাফি পড়ে থাকে সবার চোখের সামনে, এদের ন্যায়বিচারের মধ্যে মানুষ মেরে ফেলাও ন্যায়বিচারের লক্ষণ হিসেবে পড়ে। পার্থিব ক্ষমতাই শেষ কথা, বাকি সব দার্শনিকতা, ধর্ম, আন্দোলন — সব ফাঁকা বুলি; কাফকা খুব ভালোভাবে সেটা বুঝেছিলেন। তাঁর ভাষায় এটাকেই তিনি বলেছিলেন, তিনি তাঁর সময়ের ‘নেতিবাচকতা’কে বুঝেছেন ও সেটির প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

যারা একবার কাফকা পড়েছেন তারা যে মুহূর্তে ধরে ফেলেন যে, কাফকা ‘বুঝেছিলেন’, কাফকা সত্যি জীবন, পৃথিবী, সমাজের সব খেলা ‘বুঝেছিলেন’, তখন তাঁর প্রতি মুগ্ধতা থেকেই তারা আর কখনো কাফকা ছাড়তে পারেন না। একসময় এই পাঠকেরা বুঝে যান যে, ‘কাফকায়েস্ক’ কথাটাও অর্থহীন, এ দুনিয়ার এত অনেক কিছুই ‘কাফকায়েস্ক’ যে, সেটার আর কোনো মানে থাকে না। বেকার যুবক যখন চাকরি পাওয়ার জন্য অফিসগুলোর বারান্দায় ঘুরে ঘুরে বেড়ায় সেটাও ‘কাফকায়েস্ক’; অসুস্থ রোগী যখন বড় হাসপাতালের বিরাট আয়োজনের মধ্যে কোনো ডাক্তার খুঁজে পায় না, যিনি তার সমস্যাটা বুঝবেন, সেটাও ‘কাফকায়েস্ক’; টিভির পর্দায় ধুম করে যখন আমরা দেখি যে ক্ষমতাশালীরা কী সূক্ষ্ম কৌশলে সাধারণ মানুষের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে, সেটাও ‘কাফকায়েস্ক’, আর আদালতের দলিল-দস্তাবেজের মধ্যে আমরা যখন দেখি যে আমাদের ফাইলটা অসহায়ের মতো পড়ে আছে নিচের দিকে, সেটাও কাফকায়েস্ক; আর গভীর রাতে ঘুমের মধ্যে মোবাইল ফোন বেজে উঠলে যে ভয় নিয়ে আমরা সেটা ধরি, আর শুনি ওপাশে, পৃথিবীর কোন প্রান্ত থেকে কে যেন বলে উঠছে ‘হ্যালো’, সেটাও ‘কাফকায়েস্ক’।

আমরা পছন্দ করি কি না-করি, কাফকা আমাদের এই আধুনিক সংস্কৃতির এক অমোচনীয় অংশ হয়ে গেছেন। নিরাপত্তাহীনতা আর আতঙ্কের যে বোধ কাফকা আমাদের মধ্যে জারিত করে গেছেন, আত্ম-উন্নয়নের লাখো বইয়ের কোনোটি পড়েই সেই বোধ আমাদের আর কাটে না। তাঁর ‘সেন্স অব হিউমার’ হাসির ছলে আমাদের দেখিয়ে দেয় যে আমরা কত ভুল, কত বোকা। আমাদের পাপবোধ, হতাশা, ন্যায়বোধ, আশা, পাপমোচন ও ভালোবাসা — সবকিছুর মধ্যেই কত বড় আধ্যাত্মিকতার অভাব ও ফাঁকি। তাই কাফকার আধ্যাত্মিকতা আমাদের জন্য সান্ত¡না হয়ে আসে। তাঁর কল্পনাশক্তির অদ্ভুত লজিক একই সঙ্গে আমাদের বুদ্ধি ও আবেগকে মথিত করে। আমরা বুঝি যে তাঁর নিজের জীবনের সংকট ও সমস্যাগুলো আমাদেরটার থেকে আলাদা কিছু নয়। আমরা বুঝি যে আমাদের মানবসমাজের হৃদয়টি আছে কাফকার ঐ ছোট কয়টি বইয়ের মধ্যেই। তাই আমরা মুগ্ধ হই, আলব্যের কাম্যুর কথার সঙ্গে একমত হই যে, কাফকা বারবার পড়ার জিনিস। ‘আমরা কী?’ এত বড় প্রশ্নের উত্তর যেহেতু সহজ হওয়ার কথা নয়, তাই আমরা কাফকা বারবার পড়ি– যুগে যুগে, দেশে দেশে।

————————————————————-
[ সংগৃহীত ও সম্পাদিত। ঋণস্বীকার – অন্তর্জাল, পাঠকসমাবেশ ও মাসরুর আরেফিন।]

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress