Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি (১৯৬৫) – ফেলুদা || Satyajit Ray » Page 4

ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি (১৯৬৫) – ফেলুদা || Satyajit Ray

ফেলুদা হল আমার মাসতুতো দাদা। ও আর আমি আমার বাবার সঙ্গে দার্জিলিং-এ বেড়াতে এসে শহরের নীচের দিকে স্যানাটোরিয়ামে উঠেছি। স্যানোটোরিয়াম ভর্তি বাঙালি; বাবা তাদেরই মধ্য থেকে সমবয়সী বন্ধু জুটিয়ে নিয়ে তাসটাস খেলে গল্পটল্প করে সময় কাটাচ্ছেন। আমি আর ফেল্যদা কোথায় যাই, কী করি, তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামান না।
আজ সকালে আমার ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরী হয়েছে। উঠে দেখি বাবা রয়েছেন, কিন্তু ফেলুদার বিছানা খালি। কী ব্যাপার?
বাবাকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘ও এসে অবধি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেনি। আজ দিনটা পরিষ্কার দেখে বোধহয় আগেভাগে বেড়িয়েছে।’
আমি কিন্তু মনে মনে আন্দাজ করেছিলুম যে ফেলুদা তদন্তের কাজ শুরু করে দিয়েছে, আর সেই কাজেই বেরিয়েছে। কথাটা ভেবে ভারী রাগ হল। আমাকে বাদ দিয়ে কিছু করার কথা তো ফেলুদার নয়।
যাই হোক্‌, আমিও মুখটুখ ধুয়ে চা-টা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
লেডেন লা রোডে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডটার কাছাকাছি এসে ফেলুদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমি বললাম, ‘বা-রে, তুমি আমায় ফেলে বেরিয়েছ কেন?’
‘শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিল–তাই ডাক্তার দেখাতে গেস্‌লাম।’
‘ফণী ডাক্তার?’
‘তোরও একটু একটু বুদ্ধি খুলেছে দেখছি।’
‘দেখলে?’
‘চার টাকা ভিজিট নিল, আর একটা ওষুধ লিখে দিল।’
‘ভাল ডাক্তার?’
অসুখ নেই তাও পরীক্ষা করে ওষুধ দিচ্ছে–কেমন ডাক্তার বুঝে দ্যাখ; তার পর বাড়ির যা চেহারা দেখলাম, তাতে পসার যে খুব বেশি তাও মনে হয় না।’
‘তা হলে উনি কখনওই চিঠিটা লেখেননি।’
‘কেন?’
‘গরিব লোকের অত সাহস হয়?’
‘তা টাকার দরকার হলে হয় বইকী।’
‘কিন্তু চিঠিতে তো টাকা চায়নি।’
‘ওই ভাবে খোলাখুলি বুঝি কেউ টাকা চায়?’
‘তবে?’
‘রাজেনবাবুর অবস্থা কাল কী রকম দেখলি বল তো?’
‘কেমন যেন ভিতু ভিতু।’
‘ভয় পেয়ে মনের অসুখ হতে পারে, জানিস?’
‘তা তো পারেই।’
‘আর মনের অসুখ থেকে শরীরের অসুখ?’
‘তাও হয় বুঝি?’
‘ইয়েস। আর শরীরের অসুখ হলে ডাক্তার ডাকতে হবে, সেটা আশা করি তোর মতো ক্যাবলারও জানা আছে।’
ফেলুদার বুদ্ধি দেখে আমার প্রায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। অবিশ্যি ফণী ডাক্তার যদি সত্যই এত সব ভেবে-টেবে চিঠিটা লিখে থাকে, তা হলে ওরও বুদ্ধি সাংঘাতিক বলতে হবে।
ম্যালের মুখে ফোয়ারার কাছাকাছি যখন এসেছি তখন ফেলুদা বলল, ‘কিউরিও সম্বন্ধে একটা কিউরিয়সিটি বোধ করছি।’
‘কিউরিও’র মানে আগেই শিখেছিলাম, আর কিউরিয়সিটি মানে যে কৌতূহল, সেটা ইস্কুলেই শিখেছি।
আমাদের ঠিক পাশেই ‘নেপাল কিউরিও সপ’। রাজেনবাবু আর অবনীবাবু এখানেই আসেন।
ফেলুদা সটান দোকানের ভেতর গিয়ে ঢুকল।
দোকানদারের গায়ে ছাই রঙের কোট, গলায় মাফলার আর মাথায় সোনালি কাজ করা কালো টুপি। ফেলুদাকে দেখে হাসি হাসি মুখে করে গিয়ে এল। দোকানের ভেতরটা পুরনো জিনিসপত্রে গিজগিজ করছে, আলোও বেশি নেই, আর গন্ধটাও যেন সেকেলে।
ফেলুদা এদিও-ওদিক দেখে গম্ভীর গলায় বলল, ‘ভাল পুরনো থাঙ্কা আছে?’
‘এই পাশের ঘরে আসুন। ভাল জিনিস বিক্রি হয়ে গেছে সব। তবে নতুন মাল আবার কিছু আসছে।’
পাশের ঘরের যাবার সময় আমি ফেলুদার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম, থাঙ্কা কী জিনিস?’
ফেলুদা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘দেখতেই তো পাবি।’
পাশের ঘরটা আরও ছোট–যাকে বলে একেবারে ঘুপ্‌চি।
দোকানদার দেওয়ালে ঝোলানো সিল্কের উপর আঁকা একটা বুদ্ধের ছবি দেখিয়ে বলল, ‘এই একটাই ভালো জিনিস আছে–তবে একটু ড্যামেজড্‌।’
একেই বলে থাঙ্কা? এ জিনিস তো রাজেনবাবুর বাড়িতে অনেক আছে।
ফেলুদা ভীষণ বিজ্ঞের মত থাঙ্কাটার গায়ের উপর চোখ ঠেকিয়ে উপর থেকে নীচে অবধি প্রায় তিনি মিনিট ধরে দেখে বলল, ‘এটার বয়স তো সত্তর বছরের বেশি বলে মনে হচ্ছে না। আমি অন্তত তিনশো বছরের পুরনো জিনিস চাইছি।’
দোকানদার বলল, ‘আমরা আজ বিকেলে কিন্তু এক লট মাল পাচ্ছি। তার মধ্যে ভাল থ্যাঙ্কা পাবেন।’
‘আজই পাচ্ছেন?’
‘আজই।’
‘এ খবরটা তাহলে রাজেনবাবুকে জানাতে হয়।’
‘মিস্টার মজুমদার? ওনার তো জানা আছে। রেগুলার খদ্দের যে দু-তিন জন আছেন, তাঁরা সকলেই নতুন মাল দেখতে বিকেলে আসছেন।’
‘অবনীবাবুও খবরটা পেয়ে গেছেন? মিস্টার ঘোষাল?’
‘জরুর!’
‘আর বড় খদ্দের কে আছে আপনাদের?’
‘আর আছেন মিস্টার গিলমোর–চা বাগানের ম্যানেজার। সপ্তাহে দু দিন বাগান থেকে আসেন। আর মিস্টার নাওলাখা। উনি এখন সিকিমে।’
‘বাঙালি আর কেউ নেই?’
‘না স্যার।’
‘আচ্ছা দেখি, বিকেলে যদি একবার ঢুঁ মারতে পারি।’
তার পর আমার দিকে ফিরে বলল, ‘তোপ্‌সে, তুই একটা মুখোশ চাস?’
তোপ্‌সে যদিও আমার আসল ডাকনাম নয়, তবু ফেলুদা তপেশ থেকে ওই নামটাই করে নিয়েছে।
মুখোশের লোভ কি সামলানো যায়? ফেলুদা নিজেই একটা বাছাই করে আমাকে কিনে দিয়ে বলল, ‘ এইটেই সবচেয়ে হরেনডোস্‌–কী বলিস?’
ফেলুদা বলে ‘হরেনডাস্‌’ বলে আসলে কোনও কথা নেই। ‘ট্রিমেনডাস্‌’ মানে সাংঘাতিক, আর ‘হরিবল্‌’ মানে বীভৎস। এই দুটো একসঙ্গে বোঝাতে নাকি কেউ কেউ ‘হরেনডাস্‌’ ব্যবহার করে। মুখোশটা সম্বন্ধে যে ওই কথাটা দারুন খাটে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই।
দোকান থেকে বেরিয়ে ফেলুদা আমার হাত ধরে কী একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। এবারও দেখি ফেলুদা একজন লোকের দিকে দেখছে। বোধ হয় কাল রাতে যাকে দেখেছিল, সেই লোকটাই। বয়স আমার বাবার মতো, মানে চল্লিশ-বেয়াল্লিশ, গায়ের রঙ ফরসা, চোখে কালো চশমা। যে স্যুটটা পরে আছে সেটা দেখে মনে হয় খুব দামি। ভদ্রলোক ম্যালের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পাইপ ধরাচ্ছেন। আমার দেখেই কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল, কিন্তু কোথায় দেখেছি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
ফেলুদা সোজা লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে ভীষণ সাহেবি কায়দার উচ্চারণে বলল, ‘এক্সকিউজ মি, আপনি মিস্‌ঠা ছ্যাঠাঝি?’
ভদ্রলোকও একটু গম্ভীর গলায় পাইপ কাপড়ে বলল, ‘নো, আমি অ্যাম নঠ্‌।’
ফেলুদা খুবই অবাক হবার ভান করে বলল, ‘স্ট্রেঞ্জ–আপনি সেণ্ট্রাল হোটেলে উঠেছেন না?’
ভদ্রলোক একটু হেসে অবজ্ঞার সুরে বলল, ‘না। মাউণ্ট এভারেস্ট্‌। অ্যাণ্ড আই ডোণ্ট হ্যাভ এ টুইন ব্রাদার।’
এই বলে ভদ্রলোক গটগটিয়ে অবজারভেটলি হিলের দিকে চলে গেলেন। যাবার সময় লক্ষ করলাম যে তার কাছে একটা ব্রাউন কাগজে মোড়া প্যাকেট, আর কাগজটার গায়ে লেখা ‘নেপালি কিউরিও শপ।’
আমি চাপা গলায় বললাম, ‘ফেলুদা, উনিও কি মুখোশ কিনেছেন নাকি?’
‘তা কিনতে পারে। মুখোশটা তো আর তোর-আমার একচেটিয়া নয়। …চ’, কেভেনটার্সে গিয়ে একটু কফি খাওয়া যাক।’
কেভেনটার্সের দিকে যেতে যেতে ফেলুদা বলল, ‘লোকটাকে চিনলি?’
আমি বললাম, ‘তুমিই চিনলে না, আমি আর কী করে চিনি বলো। তবে চেনা চেনা লাগছিল।’
‘আমি চিনলাম না?’
‘বা রে। কোথায় চিনলে? ভুল নাম বললে যে?’
‘তোর যদি এতটুকু সেন্স থাকে। ভুল নাম বলেছি হোটেলের নামটা বের করার জন্য। সেটাও বুঝলি না? লোকটার আসল নাম কী জানিস?’
‘কী?’
‘প্রবীর মজুমদার।’
‘ও হো! হ্যাঁ ঠিক, বলেছ! রাজেনবাবুর ছেলে, তাই না? যার ছবি রয়েছে তাকের উপর? অবিশ্যি বয়সটা এমন অনেক বেড়ে গেছে তো।’
শুধু যে চেহারায় মিল তা নয়–গালের আঁচিলটা নিশ্চয় তুইও লক্ষ করেছিল–আসল কথাটা হচ্ছে, ভদ্রলোকের জামা-কাপড় সব বিলিতি। স্যুট লণ্ডনের, টাই প্যারিসের, জুতো ইটালিয়ান, এমন কী রুমালটা পর্যন্ত বিলিতি। সত্য বিলেত-ফেরত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।’
‘কিন্তু ওঁর ছেলে এখানে রয়েছে সে খবর রাজেনবাবু জানেন না?’
‘বাপ যে এখানে রয়েছে, সেটা ছেলে জানে কি না সেটাও খোঁজ নিয়ে দেখা দরকার।’
রহস্য ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে, এই কথাটা ভাবতে ভাবতে কেভেন্টারের দোকানে পৌঁছলাম। দোকানের ছাতে যে বসার জায়গাটা আছে, সেটা আমার ভীষণ ভাল লাগে। চারদিকে দার্জিলিং শহরটা, আর ওই নীচে বাজারটা দারুন ভাল দেখায়।
ছাতে উঠে দেখি, কোণের টেবিলটায় চুরুট হাতে তিনকড়িবাবু বসে কফি খাচ্ছেন। ফেলুদাকে দেখতে পেয়েই হাত তুলে তাঁর টেবিলে গিয়ে বসতে বললেন আমাদের।
আমরা তিনকড়িবাবুর দু দিকে দুটো টিনের চেয়ারে বসলাম।
তিনকড়িবাবু ফেলুদাকে বললেন, ‘ডিটেক্‌শনে তোমার পারদর্শিতা দেখে খুশি হয়ে আমি তোমাদের দুজনকে দুটো হট্‌ চকোলেট খাওয়াব–আপত্তি আছে?’
হট্‌ চকোলেটের নাম শুনে আমার জিভে জল এসে গেল।
তিনকড়িবাবু তুড়ি মেরে একটা বেয়ারাকে ডাকলেন।
বেয়ারা এসে অর্ডার নিয়ে গেলে পর তিনকড়িবাবু কোটের পকেট থেকে একটা বই বার করে ফেলুদাকে দিয়ে বললেন, ‘এই নাও। একটা এক্সট্রা কপি ছিল–আমার লেটেস্ট্‌ বই। তোমায় দিলুম।’
বইয়ের মলাটটা দেখে ফেলুদার মুখটা হাঁ হয়ে গেল।
‘আপনার বই মানে? আপনার লেখা? আপনিই ‘গুপ্তচর’ নাম নিয়ে লেখেন?’
তিনকড়িবাবু আধ-বোজা চোখে অল্প হাসি হেসে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললেন।
ফেলুদার অবাক ভাব আরও যেন বেড়ে গেল।
‘সে কী! আপনার সব ক’টা উপন্যাস যে আমার পড়া! বাংলায় আপনার ছাড়া আর কারুর রহস্য উপন্যাস আমার ভাল লাগে না।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ! ব্যাপারটা কী জানে? এখানে একটা প্লট মাথায় নিয়ে লেখার জন্যই এসেছিলাম। এখন দেখছি, বাস্তব জীবনের রহস্য নিয়েই মাথা ঘামিয়ে ছুটিটা ফুরিয়ে গেল।’
‘আমার সত্যিই দারুন লাক্‌–আপনাদের সঙ্গে এভাবে আলাপ হয়ে গেল।’
‘দুঃখের বিষয় আমার ছুটির মেয়াদ সত্যিই ফুরিয়ে এসেছে। কাল সকালে চলে যাচ্ছি আমি। আশা করছি, যাবার আগে তোমাদের আরও কিছুটা হেলপ্‌ করে দিয়ে যেতে পারব।’
ফেলুদা এবার তার এক্‌সাইটিং খবরটা তিনকড়িবাবুকে দিয়ে দিল।
‘রাজেনবাবুর ছেলেকে আজ দেখলাম।’
‘বল কী হে?’
‘এই দশ মিনিট আছে।’
‘তুমি ঠিক বলছ? চিনতে পেরেছ তো ঠিক?’
‘চোদ্দ আনা শিওর। মাউণ্ট এভারেস্ট হোটেলে গিয়ে খোঁজ করলে বাকি দু আনাও পুরে যাবে বোধ হয়।’
তিনকড়িবাবু হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
‘রাজেনবাবুর মুখে তার ছেলের কথা শুনেছ?’
‘কাল যা বললেন, তার বেশি শুনিনি।’
‘আমি শুনেছি অনেক কথা। ছেলেটি অল্পবয়সে বখে গিয়েছিল। বাপের সিন্দুক থেকে টাকা চুরি করে ধরা পড়েছিল। রাজেনবাবু তাকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। ছেলেটি গিয়েওছিল তাই। ২৪ বছর বয়স তখন তার। একেবারে নিখোঁজ। রাজেনবাবু অনেক অনুসন্ধান করেছিলেন, কারণ পরে তাঁর অনুতাপ হয়। কিন্তু ছেলে কোনও খোঁজখবর নেয়নি বা দেয়নি। বিলেতে তাকে দেখেছিলেন রাজেনবাবুরই এক বন্ধু। তাও সে দশ-বারো বছর আগে।’
‘রাজেনবাবু তাহলে জানেন না যে তাঁর ছেলে এখানে আছে?’
‘নিশ্চয়ই না। আমার মনে হয় ওঁকে না জানানোই ভালো। একে এই চিঠির শক্‌, তার উপর…’
তিনকড়িবাবু হঠাৎ থেমে গেলেন। তার পর ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, ‘আমার বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে। রহস্য উপন্যাস লেখা ছেড়ে দেওয়া উচিত।’
ফেলুদা হাসতে হাসতে বলল, ‘প্রবীর মজুমদার যে চিঠি লিখে থাকতে পারেন, সেটা আপনার খেয়াল হয়নি তো?’
‘এগজ্যাক্টলি। কিন্তু…’
তিনকড়িবাবু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।
বেয়ারা হট্‌ চকোলেট এনে টেবিলে রাখতে তিনকড়িবাবু যেন একটু চাগিয়ে উঠলেন। ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, ‘ফণী মিত্তিরকে কেমন দেখলে?’
ফেলুদা যেন একটু হকচকিয়ে গেল।
‘সে কি, আপনি কী করে জানলেন আমি ওখানে গেস্‌লাম?’
‘তুমি যাওয়ার অল্পক্ষণ পরেই আমিও গেস্‌লাম।’
‘আমাকে রাস্তায় দেখেছিলেন বুঝি?’
‘না।’
‘তবে?’
‘ডাক্তারের ঘরের মেঝেতে একটা মরা সিগারেট দেখে জিজ্ঞেস করলাম, কে খেয়েছে। ডাক্তার ধূমপান করেন না। ফণীবাবু তখন বর্ণনা দিলেন। তাতে তোমার কথা মনে হল, যদিও তোমাকে আমি সিগারেট খেতে দেখিনি। কিন্তু এখন তোমার আঙুলের গায়ে হলদে রঙ দেখে বুঝেছি, তুমি খাও।’
ফেলুদা তিনকড়িবাবুর বুদ্ধির তারিফ করে বলল, ‘আপনারও কি ফণী মিত্তিরকে সন্দেহ হয়েছিল না কি?’
‘তা হবে না? লোকটাকে দেখলে অভক্তি হয় কি না?’
‘তা হয়। রাজেনবাবু যে কেন ওকে আমল দেন জানি না।’
‘তাও জানো না বুঝি? দার্জিলিং-এ আসার কিছু দিনের মধ্যে রাজেনবাবুর ধম্মকম্মের দিকে মন যায়। তখন ফণীবাবুই তাকে এক গুরুর সন্ধান দিয়েছিলেন। একই গুরুর শিষ্য হিসাবে ওদের যে প্রায় ভাই-ভাই সম্পর্ক হে!’
ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, ‘ফণী মিত্তিরের সঙ্গে কথা বলে কী বুঝলেন?’
‘কথা তো ছুতো। আসলে বইয়ের আলমারিগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলুম।’
‘বাংলা উপন্যাস আছে কিনা দেখার জন্য?’
‘ঠিক বলেছ।’
‘আমিও দেখেছি, প্রায় নেই বললেই চলে। আর যা আছে, তাও আদ্যিকালের।’
‘ঠিক।’
তবে ফণী ডাক্তার অন্যের বাড়ির বই থেকেও কথা কেটে চিঠি তৈরি করতে পারে।’
‘তা পারে। তবে লোকটাকে দেখে ভারী কুঁড়ে বলে মনে হয়। এ ব্যাপারে অতটা কাঠখড় পোহাবে, সেটা কেন যেন বিশ্বাস হয় না।’
ফেলুদা এবার বলল, ‘অবনী ঘোষাল লোকটা সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা?’
‘বিশেষ সুবিধের লোক নয় বলেই আমার বিশ্বাস। ভারী ওপর-চালাক। আর ও সব প্রাচীন শিল্প-টিল্প কিছু না। ওর আসল লোভ হচ্ছে টাকার। এখন খরচ করে জিনিস কিনছে, পরে বিদেশিদের কাছে বিক্রি করে পাঁচগুণ প্রফিট করবে।’
‘ওর পক্ষে এই হুম্‌কি-চিঠি দেওয়ার কোনও কারণ থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয় কি?’
‘সেটা এখনও তলিয়ে দেখিনি।’
‘আমি একটা কারণ আবিষ্কার করেছি।’
আমি অবাক হয়ে ফেলুদার দিকে চাইলাম। ওর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।
তিনকড়িবাবু বললেন, ‘কী কারণ?’
ফেলুদা গলাটা নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘যে দোকান থেকে ওঁরা জিনিস কেনেন, সেখানে কিছু ভাল নতুন মাল আজ বিকেলে আসছে।’
এবার তিনকড়িবাবুর চোখও জ্বলজ্বল করে উঠল।
‘বুঝেছি। হুম্‌কি চিঠি পেয়ে রাজেন মজুমদার ঘরে বন্দি হয়ে রইলেন, আর সেই ফাঁকতালে অবনী ঘোষাল দোকানে গিয়ে সব লুটেপুটে নিলেন।’
‘এগজ্যাক্টলি!’
তিনকড়িবাবু চকোলেটের পয়সা দিয়ে উঠে পড়লেন। আমরা দুজনেও উঠলাম।
উৎসাহে আর উত্তেজনায় আমার বুকটা টিপ্‌ টিপ্‌ করছিল।
অবনী ঘোষাল, প্রবীর মজুমদার আর ফণী মিত্তির–তিনজনকেই তাহলে সন্দেহ করার কারণ আছে!
পনেরো মিনিটের মধ্যেই মাউণ্ট এভারেস্ট হোটেলে গিয়ে ফেলুদা সেই খবরটা জেনে নিল। প্রবীর মজুমদার বলে একজন ভদ্রলোক এই হোটেলের ষোল নম্বর ঘরে পাঁচ দিন হলে এসে রয়েছেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress