ফুলের মধ্যে সাপ
রাস্তাটা যেখানে ঘোড়ার নালের মতো বাঁক মেরেছে সেখানে পৌঁছে বুক জুড়িয়ে গেল অশ্বিনীর। আর, কত লোক। যেদিকে তাকাও গিজগিজ করছে। ট্যুরিস্ট বাসগুলো এখনও আসছে আর মানুষগুলো লাফিয়ে নামছে বালির ওপরে। এতবড় বালির চর এখনই ভরভরন্ত। শীত শুরুর রবিবারে ভিড় হয়ই কিন্তু এত মানুষ কল্পনা করেনি অশ্বিনী।
এখন মাত্র নটা বাজে। একটু আগে ভোঁ বেজেছে। অন্তত ঘণ্টাপাঁচেক সময় আছে হাতে। পাঁচটা খদ্দের বধ করতে পারলে পঞ্চাশ টাকা। তার কুড়ি যাবে বিনোদ মাইতির দোকানে। ব্যাটা আজও চেঁচিয়ে গেছে, অনেক বাকি হয়ে আছে খাতায়। কুড়ি টাকা দিতে হবে রাবণের গুষ্টির পেট ভরাতে। আর দশ টাকায় সন্ধেবেলায় ফুর্তি। পঞ্চাশ টাকা রোজ হলে তো বর্তে যেত সে। ছুটির দিন কিংবা রবিবারে যদি দশ ক্রোশের মধ্যে কোনও হাঁচি না পড়ে তো জমে গেল, নইলে দশ টাকা আয় করতে লাল সুতো বেরিয়ে যায়।
পিচের রাস্তা ছেড়ে বালির চরে নেমে গেল অশ্বিনী। এখন যারা জলে নেমেছে তারা ওর খদ্দের নয়। একটু রয়েসয়ে আরাম করে যারা হাঁটুজলে স্নানে নামে তাদের জন্যে সাড়ে দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে অশ্বিনী। তারপর হোটেলে-হোটেলে খদের খুঁজতে হয়। সেইসব সাহেব মেমরা। যারা সমুদ্র দেখতে আসেন অথচ স্নান করেন শাওয়ারের তলায় তাদের ম্যাসাজ করতে পারলে দিনটা ভালো যায়। মাঝারি কাঠের বাক্সটার শিশি আছে চারটে। তিন রকমের তেল আর একটায় আতর। আছে ছোট তোয়ালে এবং আয়না। তিরিশ টাকার এই সম্পত্তিতে বেশ চলে যায়। অশ্বিনী চারপাশে তাকাল। লম্বা রোগা শরীরটার সবকটা হাড় গোনা যায়। নীল হাফ প্যান্টের ওপর নীল গেঞ্জি। দাড়িটা কামায় রোজ। বিড়ি খায় না, ওতে বড়মানুষদের কষ্ট হয়, বায়ুটা শরীরে থেকে যায়। কিন্তু খইনি খায়। এই সময় একটা অ্যাম্বাসাডার এসে দাঁড়াল। লক্ষ করল অশ্বিনী। বেশ মোটা তিনজন নামল গাড়ি থেকে। একজন মহিলা আর দুজন পুরুষ। পুরুষ দুটোর শরীর ধুতির ওপরে গেঞ্জি আর তোয়ালে। অশ্বিনীর চোখ ছোট হয়ে গেল। এরা চটপট জলে নামবে না। ড্রাইভার একটা বড় সতরঞ্জি নিয়ে সামনে-সামনে হাঁটছে। ভিড় থেকে সামান্য দূরে সেটাকে বালির ওপর বিছিয়ে বসল ওরা।
সকাল বেলায় ঢেউ-এর তেজ বিষঝাড়া সাপের মতন। রাত্রে ফোঁসফোঁসানি এখন নেই। অশ্বিনী সমুদ্রের দিকে তাকাল। তারপর ধীরে-ধীরে দলটার সামনে গিয়ে অভ্যস্ত গলায় বলল, ম্যাসাজ সাব, ম্যাসাজ!
সবচেয়ে মোটা লোকটা তখন হিন্দিতে জ্ঞান দিচ্ছিল, এখানে নামলে সোজা তুমি অস্ট্রেলিয়ায় চলে যেতে পার। তবে এর চেয়ে ভালো বিচ হল গোপালপুর।
অশ্বিনী আবার বলল, ম্যাসাজ সাব, ম্যাসাজ!।
এবার মোটা লোকটা তার দিকে ঘাড় ফেরাল, কি চাই তোমার?
কাছে এগিয়ে গেল অশ্বিনী, ম্যাসাজ করে দেব সাব?ইন্ডিয়ান স্টাইল, আমেরিকান স্টাইল; এমন ম্যাসাজ আর কেউ করতে পারে না। আপনার আরাম হবে, খিদে পাবে, রাত্রে ঘুম আসবে, কাজ করতে উৎসাহ আসবে। পা থেকে মাথা, দশমিনিট দু-টাকা, আধঘণ্টা পাঁচ টাকা, ঘণ্টা দশ। একবার ট্রাই দেবেন সাব!
মোটা লোকটা তার সঙ্গিনীর দিকে তাকাল, ম্যাসাজ করালে মন্দ হয় না, কি বলো?
দ্বিতীয় পুরুষটি বলল, আমার হাসি পায়। বহুৎ কাতুকুতু লাগে।
অশ্বিনী ততক্ষণে হাঁটু মুড়ে বসেছে, স্যার, ম্যাসাজ হল সবচেয়ে সেরা ব্যায়াম। আপনি ব্যায়াম করছেন অথচ আপনাকে একফোঁটা পরিশ্রম করতে হচ্ছে না। আমার ম্যাসাজ নিয়ে জলে নামুন দেখবেন আরাম কাকে বলে। সিলভার জুবিলি এক্সপিরিয়েন্স সাব। কথা বলতে-বলতে বাক্সর ডালা খুলে ফেলল সে।
আধঘণ্টা দুটাকা। মোটা লোকটা মাথা নাড়ল।
মরে যাব সাব। ফিক্সড রেট। এর নিচে পোষায় না।
আরে থোড়া তো কনসেসন করা। ঠিক হ্যায়, চার রুপিয়া।
বউনিটা হাতছাড়া করতে চাইল না অশ্বিনী। গেঞ্জি খুলিয়ে লোকটাকে শোওয়ালো সে। বিশাল থলথলে চেহারা দেখে তার আরাম হল। আঙুলে বেশি জোর দিতে হবে না। খানিকটা তেল পিঠে উপুড় করে ঢেলে বলল, সাহেবের মনে হচ্ছে পেটে খুব বাতাস হয়?
মোটা লোকটা কিছু বলার আগেই সঙ্গিনী মাথা নাড়ল, হাঁ।
হজম হয় না ভালো। সব মেরামত করে দিচ্ছি। তবে একটা কথা, কাউকে বলবেন না অশ্বিনী চার টাকায় শরীরে হাত দিয়েছে। এবার আঙুল চলছিল তার।
মোটা লোকটা উপুড় হয়ে শুয়ে বলল, আউর দাবাও।
অশ্বিনী বলল, হবে সাব আস্তে-আস্তে জোরে। প্রথমে তো আলাপ সারতে হবে, ঝালা আসবে সব শেষে। আপনিও করিয়ে দেখুন না সাব!
দ্বিতীয় লোকটি মাথা নাড়ল, নেহি, এসব আমার পছন্দ হয় না। তারা, চলো আমরা একটু ঘুরে আসি। এ কালা তো এখন আধঘণ্টা এখানে শুয়ে থাকবে।
মোটা লোকটা সঙ্গে-সঙ্গে আপত্তি জানাল, আরে, কোথায় যাচ্ছ তোমরা?
তারা বলল, আতি হ্যায় জি।
মোটা লোকটা আবার বালিতে মুখ গুজল। আধঘণ্টা পরে যখন হাত থামাল অশ্বিনী, তখন লোকটা ঘুমুচ্ছে। দ্বিতীয় লোকটা আর সঙ্গিনী এখনও ফেরেনি। অনেক কষ্টে চারটে টাকা আদায় করে আবার হাঁটতে শুরু করল সে।
এগারোটা নাগাদ মাত্র নটাকা রোজগার হল অশ্বিনীর। দিনটার গতিক সুবিধের নয়। গ্রামে ফেরার মুখেই দোকানদারকে কুড়িটা টাকা আজ দিতেই হবে। ঝাউবনের দিকে এগিয়ে গেল সে। আজকালকার ছেলেছোঁকরা কিছুতেই ম্যাসাজ করায় না। যত দিন যাচ্ছে তত খদ্দের কমছে। মধ্যবয়সি মানুষ ছাড়া কেউ আর তাকে পাত্তা দেয় না। এবার হোটেলগুলিতে টহল মারতে হয়। কিন্তু ওখানে খদ্দের পেলে বেয়ারাগুলো কমিশন খায়। অবশ্য তেমন খদ্দের পেলে কোনও লোকসান নেই। এই সময় লোকটাকে দেখতে পেল সে। কোট প্যান্ট পরা, টাই আছে। গলায় আর মাথায় বারান্দা টুপি। চুরুট খেতে-খেতে লোকটা তাকেই লক্ষ করছে। এরা তার খদ্দের নয়। সমুদ্র দেখতে এসেছে, এখানে কোট প্যান্ট খুলে ম্যাসাজ করাবে না। অশ্বিনী দেখল দুটো সাহেব যেন প্রায় উদোম হয়ে বালিতে শুয়ে রোদ পোয়াচ্ছে। এদের যদি রাজি করানো যায় তাহলে দাঁওটা মোটা হতে পারে। অশ্বিনী কাছে গিয়ে দাঁড়াল, ম্যাসাজ সাব, ম্যাসাজ?
লোকটা হাত নাড়াল, নো ম্যাসাজ। উই ডোন্ট নিউ ইট। শেষ কথাটা বোঝার উপায় ছিল না কিন্তু প্রথমটা থেকেই অর্থ ধরতে পারল অশ্বিনী। গাছগুলোর দিকে তাকাল সে। জোড়ায়-জোড়ায় বসে সমুদ্র দেখছে। ওখানে গিয়ে কোনও লাভ হবে না। ফিরে আসছিল এই সময় লোকটা ডাকল, এই! বারান্দা টুপির সাহেবটার মুখে চুরুট।
অশ্বিনী দ্রুত কাছে গেল, ইয়েস সাব।
ম্যাসাজ কর?
ইয়েস সাব। সিলভার জুবিলি ইয়ার সাব। আমার মতো ম্যাসাজ এখানে কেউ করতে পারে না।
তাই নাকি? এসো আমার সঙ্গে।
পুলকিত হল অশ্বিনী। সাহেব একবারও জিজ্ঞাসা করল না তার দক্ষিণা কত। আধঘণ্টার জন্যে পনেরো টাকা বললে কেমন হয়! অশ্বিনী মনে-মনে হিসেব করতে লাগল। ক্রমশ সে সাহেবের পেছন-পেছন বালিয়াড়ি ছেড়ে পিচের রাস্তায় উঠে এল। সাহেব কোনও কথা বলছেন না। এমন কি সে যে পেছনে আসছে তাও লক্ষ করছেন না। অশ্বিনী খুশি হল। এইসব মানুষই মেজাজি হয়। টাকা দেওয়ার সময় আঙুলে বাত ধরে না। কিন্তু সাহেব যাচ্ছে কোথায়? অশ্বিনীর বুক ছ্যাঁত করে উঠল। ওই হোটেলে তাদের ঢোকা নিষেধ। তাদের মানে যে-কোনও ফিরিওয়ালার। তার কাজটা কি সেটা না বুঝেই ওরা ওকে ফিরিওয়ালার দলে ফেলেছে। যদি সে ভেতরে ঢুকতেই না পায় তাহলে সাহেবের কাজটা করবে কীভাবে? অশ্বিনী ছুটে গিয়ে সাহেবের পাশে দাঁড়াল, সাব, আপনি কি ওই হোটেলে যাচ্ছেন, ওখানে আমাদের ঢোকা নিষেধ করেছে।
কেন?
সবাই এসে ট্যুরিস্টদের খুব বিরক্ত করে তাই।
ও। তা তুমি তো বিরক্ত করছ না! সাহেব এগিয়ে গেলেন।
যথারীতি হোটেলের গেটেই তাকে আটকে দিল। তার বাক্সটা খপ করে ধরে দারোয়ান বলল, অ্যাই কাঁহা যাতা হ্যায়?
সাহেব ঘুরে দাঁড়ালেন, ওকে আমার দরকার, ছেড়ে দাও।
দারোয়ানও জানাল, হকার লোগকো অন্দর যানা মানা হ্যায় সাব।
সাহেব বললেন, একে চিনে রাখো। তেমন কিছু হলে তো ধরতেই পারবে।
দ্বিতীয়বার বাধা পেল কাউন্টারে। সাহেব হেসে বললেন, আমিই নিয়ে যাচ্ছি। যে ছেলেটি ম্যাসাজ করে তাকে নিয়ে আসিনি বলেই প্রবলেম হয়েছে। আপনারা একে চেনেন তো?
কাউন্টারের লোকটি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। সাহেব ইঙ্গিত করল তাকে অনুসরণ করতে। হোটেলের বড় বাড়িতে সাহেব ওঠেননি। অশ্বিনীর মন কুলকুলিয়ে উঠল। আঃমা কালী, জগদম্বা, তোমার কৃপা গো! ওই পেছন দিকের বাগানে যেখানে সাহেব যাচ্ছে সেখানে যে কটেজগুলো আছে তাতে শুধু বড়লোকদের বড়লোক থাকে।
বাগানে বেশ ফুল ফুটেছে। মৌমাছি উড়ছে। গন্ধ ছড়িয়েছে খুব। অশ্বিনীর হৃদয় প্রফুল্ল হল। কটেজে ঢুকে বেল বাজালেন সাহেব। তখনই জানালায় একটি মুখ এবং তারপর দরজা খুলে গেল, ও ডিয়ার, তুমি আমাকে ফেলে কোথায় চলে গেলে! আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।
মেমসাহেবের কানের কাছে ঠোঁট ঘষে আদর করলেন সাহেব, একটু কষ্ট না হলে তুমি তো আমাকে বেশি ভালোবাসবে না ডার্লিং। মাই লিটল মুনিয়াসোনা।
দু-হাতে সাহেবকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে মেমসাহেব অশ্বিনীকে দেখতে পেলেন, এ কে?
কে বলো তো?কাল সারাদিন বলছিলে শরীরটায় যত্ন নিতে পারছ না এখানে এসে। তা আজ সি বিচে এই লোকটাকে দেখলাম ম্যাসাজ করতে। বিউটিফুল। ওর আঙুলগুলো যেন সারা শরীরে। হার্মোনিয়ামের রিড বাজায়। দুটো লোক তো ঘুমিয়ে পড়ল আমার সামনে। হি ক্যান হেল্প ইউ।
অশ্বিনী বিগলিত। এমন করে কেউ কখনও তার প্রশংসা করেনি। এবার থেকে খদ্দের ধরার সময় হার্মোনিয়ামের ব্যাপারটা বলতে হবে। মেমসাহেব তার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সুন্দর শরীর সে কোনওদিন দ্যাখেনি। পঁচিশ বছরে অনেক শরীর সে দেখেছে। বুড়ি যুবতী অনেকের শরীরে ম্যাসাজ করেছে। কিন্তু এ যেন সাক্ষাৎ সরস্বতী। আহা। সচকিত হয়ে সে মাথায় হাত ছোঁয়াল, আমার মতো ম্যাসাজ কেউ করতে পারে না মেমসাব। ইন্ডিয়ান স্টাইল, আমেরিকান স্টাইল, আপনার আরাম হবে, খিদে পাবে, রাত্রে ঘুম আসবে।
কথাটা শোনামাত্র মেমসাহেব খিলিখিলিয়ে হাসলেন, ইজ ইট! ও হনি, ইউ আর সো সুইট। সাহেবকে একটু আদর করে মেমসাব বললেন, ওকে বলো সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ওয়াশ করতে। আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।
সাহেব দেখিয়ে দিলেন কোথায় বেসিন কোথায় সাবান। এরকম পিটপিটানি কারও-কারও থাকে। এসব ধরতে নেই। পরিষ্কার হয়ে বাক্সটা নিয়ে মেমসাহেবের ঘরের সামনে দাঁড়াল অশ্বিনী। টাকাপয়সার কোনও কথা এখন পর্যন্ত হয়নি। নিজেকে শাসন করল সে, অত লোভ বড় খারাপ। মেমসাহেবের পোশাক দেখেই বোঝা যায় পয়সা এদের হাতের ময়লা। না চাইলে হয়তো যা পাওয়া যাবে তা কল্পনার বাইরে। সাহেব তাকে ভেতরে ডাকল।
দম বন্ধ হয়ে গেল অশ্বিনীর। একি দেখছে সে? এত সুন্দরী কোনও মেয়ে হয়? অশ্বিনী জানে। ওটাকে বিকিনি বলে। লাল আঁটো দুটো কাপড় মাখনের মতো শরীরে চেপে বসে আছে। তাকালে দৃষ্টি পিছলে যায়। কোলের ওপর একটা বালিশ নিয়ে মেমসাহেব ঘাড়ের ওপর সাপের মতো। লুটিয়ে থাকা চুলগুলো নিয়ে খেলা করছিলেন। বুকের মধ্যে বাতাস ছিল না অশ্বিনীর। তার শরীর ঝিমঝিম করতে লাগল।
সাহেব একটা সোফায় বসেছিলেন, কি দিয়ে তুমি ম্যাসাজ করবে? দেখি!
উবু হয়ে বসে কাঁপা হাতে বাক্সটা খুলল অশ্বিনী। শিশিগুলো এবং তোয়ালে দেখাল। সঙ্গে-সঙ্গে মেমসাহেব নাক কুঁচকে বললেন, নট দ্যাট টাওয়াল। ইস, তেল চিটচিটে হয়ে গেছে। তুমি এই টাওয়াল ইউজ করবে। হাত বাড়িয়ে তোয়ালে তুলে ছুঁড়ে দিলেন মেমসাহেব।
সাহেব জিজ্ঞাসা করল, ওটা কীসের তেল? দেখি?
শিশিগুলো একে-একে তুলে ধরল অশ্বিনী। একটা তেল সে নিজে যত্ন করে বানায়। এতে হাড় শক্ত হয়। কথাটা শুনে মেমসাহেব শিশিটা নিয়ে নাকের কাছে তুললেন, নট ব্যাড স্মেল। শুরু করো। প্রথমে কি করতে হবে?
উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ুন।
ইউ গেট লস্ট ডার্লিং। হেসে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন মেমসাহেব। সাহেব ক্যারি অন গোছের কিছু বলে পাশের ঘরে চলে গেলেন। আঙুলে তেল লাগিয়ে মেমসাহেবের মাখনে চাপ দিল সে। আঃ, আঙুল ডুবে যাচ্ছে যেন। মেয়েমানুষের শরীর এত রহস্যময় হয়। সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকে শাসন কল অশ্বিনী। না, বেচাল নয়, তোমার কর্তব্য তুমি করো। চোখ বন্ধ করল সে। সিলভার জুবিলির অভ্যেস আঙুল ঠিক চলতে শুরু করল। একটু পরে আর মেমসাহেবের নরম মাখন শরীর নয়, লাল বিকিনির রহস্য নয়, একটি মানুষের শরীরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আরাম দেওয়ার সাধনায় মগ্ন হয়ে গেল শুধু দশটা আঙুলের কারুকাজে। আর হাত যখন সরে এল শরীর থেকে তখন মেমসাহেব নিশ্চল। মৃদু নিশ্বাস পড়ছে। চকচকে শরীরটা পরম তৃপ্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। তোয়ালেটা মেমসাহেবের শরীরে বিছিয়ে দিয়ে বাক্স নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। আর তখনই সাহেবকে দেখতে পেল। সাহেব বললেন, গুড। তুমি শুধু ভালো ম্যাসাজই করো না, ব্যবহারও ভালো। তারপর পকেট থেকে ব্যাগ বের করে দুটো কুড়ি টাকার নোট বের করে বললেন, কাল সকালে আসবে। আমরা দুপুরে বেরিয়ে যাব।
প্রায় আভূমি নমস্কার করল অশ্বিনী। এতটা সে আশা করেনি। আজ আর তার কোনও সমস্যা নেই। সাহেব বললেন, ওই তেলটা মনে হচ্ছে সত্যি ভালো। ম্যাসাজ করে কেউ ওকে আজ পর্যন্ত ঘুম পাড়াতে পারেনি। ওটা রেখে যাও। কাল তো আসছ, ম্যাসাজ করে যাওয়ার সময় নিয়ে। যেও। নইলে এখন হয়তো আবার কাউকে ওই তেলই লাগাবে।
খুশি মনে শিশিটা বাক্স থেকে বের করে টেবিলে রেখে দিন অশ্বিনী। বয়ে গেছে আর কাউকে ম্যাসাজ করতে। টাকা তো হলই, কিন্তু চোখের গায়ে যে ছবিটা সেঁটে আছে এবং সেটা মুছতে সে। নারাজ।
আট টাকার দিশিতে প্রাণ ভরে গেল অশ্বিনীর। আজ সে কারও সঙ্গে রাগারাগি করেনি। দোকানদারকে কুড়িটা টাকা দিয়েছে, বউকেও। এখন মাঝরাত্রে ঘুমের ঘোরে বউ-এর শরীরে হাত পড়তেই মনে হল নরম মাখনের যত্ন করে তৈরি শরীরটা তার পাশেই। এই অন্ধকারে সে আদর শুরু করল। এবং তখনই বউ চাপা গলায় বলে উঠল, হঠাৎ এত যত্ন? কোন দিকে সূর্য উঠল, আজ?
অশ্বিনীর আঙুল থেমে গেল। পাশ ফিরে শুতে-শুতে বলল, এখন রাত, সূর্য উঠবে কেন? ম্যাসাজ করা প্র্যাক্টিশ করছিলাম। ঘুমোও।
মেমসাহেবদের গলার স্বরও শরীরের মতো রহস্যময় হয় কি করে ভাবছিল সে চোখ বন্ধ করে।
দশটা নাগাদ আজ আবার সেই ঘরে। শুধু তফাত হল সাহেব নেই। সাহেব গেছেন গাড়ি নিয়ে মোড়ের গ্যারাজে। কি একটা গোলমাল হয়েছে ইঞ্জিনে। মেমসাহেব বললেন, কাল তুমি আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ওটা কী স্টাইল?
ইন্ডিয়ান মেমসাহেব।
আজ আমেরিকান স্টাইল করো। ওতে কি হয়?
মাথা নিচু করে অশ্বিনী বলল, ওতে শরীরে জোয়ার আসে। রক্তে ঢেউ ওঠে।
সত্যি? খুশিতে চিৎকার করে উঠল, ওঃ, আই কান্ট ওয়েট। শুরু করো প্লিজ।
আজ শরীরে কালো বিকিনি। শাঁখের গায়ে কালসাপ পেঁচানো। দম বন্ধ হয়ে গেল অশ্বিনীর। কোনওরকমে বলল, আমার তেলটা কোথায়?
উপুড় হয়ে শুয়েই হাত বাড়িয়ে টেবিলটা দেখিয়ে দিলেন মেমসাহেব। শরীরে বল নেই। যেন
সাপের ফণার নিচে ব্যাং হয়ে পড়েছে ওটা। তবু শিশিটা নিয়ে এল সে। কাল যতটুকু তেল রেখেছিল ততটুকুই আছে। মেমসাহেব বললেন, তোমরা নাম কী?
অশ্বিনী।
অ্যাঁ, অশ্বিনী? তোমার কি ঘোড়ার মতো শক্তি? খিলখিল হাসি উঠল। আচ্ছা অশ্বিনী, তুমি তো এত মেয়েকে ম্যাসাজ করো, নিজেকে ঠিক রাখোকি করে?
অশ্বিনী শিশির মুখ খুলল, রাখতে হয় মেমসাহেব। আমরা হলাম গিয়ে ডাক্তারের মতো। মেয়েছেলে ব্যাটাছেলে বলে কোনও ভেদাভেদ করতে নেই। নইলে ব্যাবসা গোটাতে হবে। পেট বড় জ্বালা মেমসাহেব।
আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে। ওখানে গেলে তোমাকে আমি বড়-বড় ক্লায়েন্ট দিতে পারব। নাউ, শুরু করো।
হাতে তেল মাখিয়ে ছোট-ছোট আঘাত দেওয়া শুরু করল অশ্বিনী। তার চোখ বন্ধ। এখন সে ডাক্তার। আঘাত দিচ্ছে কিন্তু মেমসাহেবের শরীরে ব্যথা লাগছে না। প্রতি শিরায় ছোট-ছোট টোকা। গ্রন্থিতে-গ্রন্থিতে সামান্য মোচড়। কিছুক্ষণ পরেই সাহেব এলেন। আর ততক্ষণে মেমসাহেবের সমস্ত শরীরে জোয়ার, রক্তে ঢেউ।
পঞ্চাশ টাকা দিয়ে তাকে বিদায় করলেন সাহেব। কিন্তু শিশিটা রেখে দিলেন। এত ভালো তেল তিনি কলকাতায় নিয়ে যাবেন। মেমসাহেব তখন সত্যিকারের উত্তেজিতা। দু-হাতে সাহেবকে জড়িয়ে ধরতে গেলেন তিনি। সঙ্গে-সঙ্গে দু-পা ছিটকে সরে গিয়ে সাহেব বললেন, ননা ডার্লিং আগে স্নান করে নাও। ইউ আর অয়েলি। তা ছাড়া আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল অশ্বিনীর। তার দুটো হাত কুটকুট করছে এবং উঁচু-উঁচুব্রণর মতো কিছুতে ছেয়ে গেছে হাতের তালু দুটো। সকালে সেগুলো ঘা-এর চেহারা নিল। ডাক্তারবাবু অনেকক্ষণ পরীক্ষা করলেন। তারপর বললেন, বুঝতে পারছি না। ওষুধ দিচ্ছি, নিয়ে যা।
কারণ বুঝতে পারছিল না অশ্বিনী। এই দুটো হাতের ঘা না মারলে তো খদ্দের জুটবে না। মাথা খারাপ হয়ে গেল তার। ওষুধেও কমছে না ঘা। বরং রস গড়িয়ে যেন হাড় দেখা যাচ্ছে তার। ডাক্তার বললেন, এ রোগ জীবনে দেখিনি। খারাপ মেয়ের কাছে গিয়েছিলি?
না তো!
কলকাতায় যেতে হবে তোকে। বড় ডাক্তার দেখাতে হবে। নইলে খসে যাবে হাত।
এখন আঙুল মুড়তে পারছেনা। অশ্বিনী। কিছু ধরা অসম্ভব। শেষ সম্বল বিক্রি করে বউ তাকে কলকাতায় খরচ দিয়েছে। কাপড়ে মোড়া হাত দুটো নিয়ে বাসে উঠেছিল সে কলকাতার জন্যে। এই কদিন সে কেবলই ভেবেছে কি করে হল এমন। এমন কিছু সে ধরেনি যাতে হাতে এমন ঘা হয়। শেষবার ম্যাসেজ করেছে সে মেমসাহেবকে নিজের তৈরি তেল দিয়ে। ওই তেলে চিরকাল সে ম্যাসাজ করে এসেছে। এতদিন তো কিছু হয়নি আর তখনই তার খেয়াল হল শিশিটার কথা। সাহেব ওটা নিয়ে গেছে কলকাতায়। কেন? কেন সাহেব ওটাকে একদিন নিজের কাছে রেখে। দিয়েছিল? চটপট বাস থেকে নেমে এল সে।
চোরের মতো হোটেলের পেছন দরজা দিয়ে সে কটেজের কাছে চলে এল। এখনও এদিকে নতুন বোর্ডার আসেনি। বেয়ারারা তাই এপাশে নেই। কটেজের দরজা বন্ধ। ঠিক পাশেই ময়লা ফেলার ড্রামটা চোখে পড়ল। ঝুঁকে পড়ল তাতে অশ্বিনী। ছেঁড়া কাগজ, দামি তোয়ালে আর শিশিটা এখনও পড়ে আছে। সাহেব এটা কলকাতায় নিয়ে যায়নি তাহলে!
অনেক চেষ্টা করে শিশিটা ধরতে পারল সে। ওপরে তেল ভাসছে, তলায় ওটা কি? তার তেল তো কখনও কাটে না। এবং তখনই আঁতকে উঠল অশ্বিনী।
কলকাতার বাস-এ অশ্বিনী বসে ছিল চোখ বন্ধ করে। তার কাপড়ে জড়ানো হাতে তখন প্রচণ্ড যন্ত্রণা। কাঁধের ব্যাগে একটা দামি তোয়ালে আর সেই শিশি। হাত সারুক বা না সারুক ওই শিশি সে উপুড় করে দেবে একটা মানুষের ওপর। অমন মাখনের মতো স্বপ্নের শরীরে যে মানুষটা প্যাঁচ কষে রস গড়াননা ঘা করে দিয়েছে। সে তো ওই তেল সর্বাঙ্গে মাখিয়ে দিয়েছিল। একটা ফুলের বাগান নরককুণ্ডে পরিণত হয়ে গেছে এতক্ষণে। পাষণ্ডটির সন্ধান তাকে করতেই হবে।
কলকাতার হাঁ মুখ বড় বড়। তাই একমাস পরে একটা পুরো হাত তিনটে অন্য হাতের আঙুল খুইয়ে সুস্থ অশ্বিনী প্যাকাটির মতো দুর্বল শরীরে মনুমেন্টের নিচে সমুদ্র সৈকতের বাস ধরবে বলে এসে ব্যাগ থেকে শিশিটা বের করল। তারপর ওই দুটো আঙুলেই সে বিষাক্ত তেলটাকে উপুড় করে দিল কলকাতার ওপর।