ফুলমণি উপাখ্যান
পরদিন সকাল এগারোটার মধ্যেও কোনো খবর পাওয়া গেল না। হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নেওয়া হয়েছে, এমনকি এক পুলিশ বন্ধুকে ধরে মর্গেও ঘুরে এসেছে লালুদা। ফুলমণি যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে।
সিরাজুল সাহেবের বাড়িতে যাওয়া হলো।
অনিন্দ্য দাসের সঙ্গে আমার ঝগড়ার ঘটনাটা এর মধ্যেই তাঁর কানে এসেছে। দু’জন তরুণ শিল্পী বসে আছে তাঁর ঘরে। আমার কাছে সব বিবরণ শুনে তাঁর মুখে দুঃখের ছায়া পড়ল, কিন্তু কোনো মন্তব্য করলেন না।
একটু পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন ওকে নিয়ে এলাম ওর গ্রাম থেকে। ওখানেই বেশ ছিল। শহরে কত খারাপ লোক আছে।
একজন শিল্পী বলল, শুনেছি কিছু লোক কলকাতা থেকে মেয়ে ধরে ধরে বম্বেতে বিক্রি করে দিয়ে আসে। আরব দেশগুলোতে অনেক মেয়ে চালান হয়।
সিরাজুল সাহেব বললেন, ওর কাছে কি টাকাপয়সা কিছু ছিল? এমনকি হতে পারে যে, আমাদের শিল্পী বন্ধুটির কথাবার্তায় ও অপমানিত বোধ করেছে তাই তক্ষুনি হাওড়ায় গিয়ে ট্রেনে চেপে তাতে ছোটপাহাড়ীতে ফিরে গেছে?
ফুলমণিকে আমি একশো টাকা দিয়েছিলুম। কিন্তু ও কি নিজে নিজে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে?
সিরাজুল সাহেব বললেন, রাস্তার লোককে জিজ্ঞেস করে করে হাওড়া পৌঁছে যাওয়া খুবই সম্ভব। ফুলমণি কথা কম বলে বটে, কিন্তু বোকা তো সে নয়। বোকা মানুষেরা শিল্পী হতে পারে না।
একজন শিল্পী বলল, যাই বলুন স্যার, আঙুল দিয়ে ছবি আঁকাটা ঠিক প্রপার আর্ট ফর্ম নয়। ওকে তুলি ধরতে শেখাতে হবে।
সিরাজুল সাহেব বললেন, ওসব কথা এখন থাক। আগে মেয়েটির নিরাপত্তা…আচ্ছা, ছোটপাহাড়ীতে টেলিফোন করে জানা যায় না?
আমি বললুম, ওখানে এখনো টেলিফোন যায়নি। আমি ভাবছি, আজই আমি একবার চলে যাব।
সিরাজুল সাহেব বললেন, কাল আমার একটা খুব জরুরি মিটিং আছে বটে, তবু আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারি। থাক কাজ। হ্যাঁ, চলুন আমি যাব।
একজন শিল্পী বলল, সে কী স্যার? আজ বিকেলে আপনার …
সিরাজুল সাহেব বললেন, তাতে কী হয়েছে। তোমরা ম্যানেজ করবে। আমি যাব—কটায় ট্রেন আছে, নীলুবাবু?
তরুণ শিল্পীটি বলল, আজ সিরাজুল সাহেবের জন্মদিন। সন্ধেবেলা একটা অনুষ্ঠান আছে, অনেকে আসবে এ বাড়িতে।
সিরাজুল সাহেব তবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে বাধা দিয়ে আমি বললুম, আপনার যাওয়ার কী দরকার? আমি গিয়ে খবর নিয়ে আসছি। ফুলমণিকে ওখানে পাওয়া গেলে আপনাকে জানাব, আমি ফিরেই দেখা করব।
অন্য শিল্পীটি বলল, সব দোষ অনিন্দ্য দাসের। উনি যা খুশি করবেন। কিন্তু ওর মুখের ওপর কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।
সিরাজুল সাহেব মিনতির সুরে বললেন, আমার বাড়িতে ওসব কথা আলোচনা করো না, প্লিজ!
অর্থাৎ সিরাজুল সাহেব নিজে তো নিন্দে করবেনই না, অন্য কারুর মুখে নিন্দে শুনতেও চান না।
এত কাণ্ডের মধ্যেও আমার এই একটি পরম লাভ হলো, সিরাজুল সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হলো।
বড় মাপের মানুষ না হলে কি বড় শিল্পী হওয়া যায়? এই প্রশ্নটা অনেকদিন ধরে আমার মাথায় ঘুরছিল।
দরজা পর্যন্ত আমাকে পৌঁছে দিতে এসে সিরাজুল সাহেব মৃদু গলায় বললেন, আপনি একলা একলা যাবেন, যদি আপনার কিছু রাহা খরচ…
আমি বললুম, আমি তো ওখানে চাকরি করি। আমাকে তো এমনিই যেতে হতো। চন্দনদাকে খবরটা জানান দরকার।
সিরাজুল সাহেব বললেন, তাড়াতাড়ি ঘুরে আসুন। ভালো খবর নিয়ে আসুন। উনি আমার হাত ধরলেন। আমি বললুম, দোয়া করবেন!
এখানকার খবরাখবরের ভার রইল লালুদার ওপর। লালুদা বলল, কোনো চিন্তা করো না। ফুলমণির খোঁজ পেলেই আমি তোমাকে কুরিয়ার সার্ভিসে জানিয়ে দেব। এমনকি নিজেও চলে যেতে পারি।
নীপা বউদি বললেন, নীলু, তুমি তোমার চন্দনদাকে বিশেষ ব্যস্ত হতে বারণ করো। ফুলমণি যদি ছোটপাহাড়ীতে না গিয়ে থাকে, এখানে তার সন্ধান পাওয়া যাবেই। মেয়েটা তো আর উধাও হয়ে যেতে পারে না।
লালুদা বলল, না, না, চন্দনের এখন কলকাতায় আসার দরকার নেই। সে কত কাজে ব্যস্ত। আমরা এদিকটা ঠিক ম্যানেজ করে নেব। সন্ধেবেলা অ্যাকাডেমিতে আর্ট এক্জবিশনেও আমি বসে থাকব।
যে-যার তালে আছে। চন্দনদা কলকাতায় না থাকলে লালুদার পক্ষে ও বাড়িতে আড্ডা জমানোর বেশি সুবিধে হয়।
হাওড়ার বাসে চাপবার সময় আমার মনে হলো, অনিন্দ্য দাসের বাড়ি দমদম উনি বিয়ে-টিয়ে করেননি। একা থাকেন। ছোটপাহাড়ী যাবার আগে ওঁর নাকে একটা ঘুষি মেরে যাওয়া উচিত নয় কি! যত নষ্টের গোড়া!
কিন্তু দমদম একেবারে উল্টো দিকে। সেখান থেকে ঘুরে হাওড়ায় যেতে হলে আর ছোটপাহাডীর ট্রেন পাব না। সেই জন্যই অনিন্দ্য দাস আমার হাতের ঘুষি থেকে বেঁচে গেলেন। কিংবা আমি ওর লাঠির আঘাত থেকে বেঁচে গেলুম বোধহয়।
হাওড়া স্টেশনে শান্তনু চৌধুরীর সঙ্গে দেখা। উনি ললিতকলা অ্যাকাডেমির কোনো মিটিং-এ যোগ দিতে মাদ্রাজ যাচ্ছেন। চন্দনদার পেছনে এক তল্পিবাহক হিসেবে উনি আমাকে একবার মাত্র দেখেছেন, আমাকে ওঁর চেনার কথা নয়। তবু উনি চিনতে পারলেন। ট্রেনটা এখনো আসনি, আমরা অপেক্ষা করছি, উনি হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকলেন কাছে।
ছাই রঙের স্যুট ও টাই পরা, নিখুঁত পোশাক। মসৃণ মুখ। পাট করা চুল। উচ্চ মধ্যবিত্তের পরিচয় ওঁর সর্ব অঙ্গে লেখা, কেউ আর্টিস্ট হিসেবে ভুল করবে না। অথচ ভালো ছবি আঁকেন।
শান্তনু চৌধুরী খানিকটা ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে বললেন, শুনুন, সেদিন আপনার নামটা জিজ্ঞেস করা হয়নি। আপনি চন্দনের ভাই, তাই না?
কথা না বাড়িয়ে আমি মাথা নেড়ে দিলুম।
শান্তনু চৌধুরী বললেন, অনিন্দ্য নাকি এক কাণ্ড করেছে? আপনাকে আর ঐ মেয়েটিকে নিয়ে…ঠিক কী হয়েছিল। বলুন তো?
মানুষের চরিত্রে যতগুলো খারাপ দিক থাকে, তার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হলো অসাক্ষাতে কোনো বন্ধুর নিন্দে উপভোগ করা। শান্তনু চৌধুরীকে সবাই অনিন্দ্য দাসের খুব বন্ধু বলে জানে।
এ ব্যাপারটাতে আমি প্রশ্রয় দেব কেন? আমি উল্টে বললুম, আপনি কী শুনেছেন?
শান্তনু চৌধুরী একঝলক হেসে বললেন, অনিন্দ্য নাকি ঐ সাঁওতাল মেয়েটার কাপড় ধরে টেনেছে সবার সামনে?
এবার বোঝা গেল যে, শান্তনু চৌধুরী নিখুঁত ভদ্রতার প্রতিমূর্তি হলেও ওঁর ঝোঁক আদিরসের দিকে।
মাথা নেড়ে বললুম, হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন।
শান্তনু চৌধুরী বললেন, আর একবার কী হয়েছিল জানেন? একটা পার্টিতে অনিন্দ্য এমন বেসামাল হয়ে গেল, ক্যালকাটা ক্লাবের মেম্বার মিস্টার নানপুরিয়ার বউকে, সে মেয়েটি একবার মিস ইন্ডিয়া হয়েছিল, সবার সামনে অনিন্দ্য তাকে বলল, তোমার ঐ ইয়েদুটো, বুঝলেন না, ইয়ে ঐ দুটো কি ফল্স? লজ্জায় আমরা মুখ তুলতে পারি না। তারপর থেকে মিসেস নানপুরিয়ার দিকে তাকালেই আমার ওর ইয়েদুটোর দিকে, ফল্স না আসল..
ট্রেন ঢুকতেই একটা শোরগোল পড়ে গেল।
শান্তনু চৌধুরী এ. সি ফার্স্ট ক্লাসে যাবেন, তাঁকে আর দেখা গেল না।
আমার শরীর মন কেমন যেন অসাড় হয়ে গেছে, ট্রেন চলতে শুরু করার পরেই আমি ঘুমে ঢুলতে লাগলাম।
এই দূরপাল্লায় ট্রেনটা বালুঘাই স্টেশনে এক মিনিটের জন্য থামে। কেন অত ছোট স্টেশনে থামে তা কে জানে! আমার পক্ষে সুবিধেজনক।
একটাই মুশকিল, রেলস্টেশন থেকে ছোটপাহাড়ী যেতে বাস ছাড়া উপায় নেই। রাত আটটায় শেষ বাস ছেড়ে যায়। এই ট্রেনটা লেট করলেই চিত্তির!
ঠিক লেট হলো দেড় ঘণ্টা।
আজকাল যেহেতু ছোটপাহাড়ীতে নানা রকম কনস্ট্রাকশন চলছে, তাই মালপত্র নিয়ে অনেক ট্রাক যায়। ট্রাকগুলোর দিন-রাত্রি জ্ঞান নেই। চন্দনদা প্রথম দিনই আমাকে বলে দিয়েছিল, যদি কোনোদিন বালুঘাই স্টেশনে পৌঁছে বাস মিস্ করিস, তা হলে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে হাত দেখাবি, কোনো না কোনো ট্রাক তোকে পৌঁছে দেবে।
এত ছোট স্টেশনে দশ-পনেরো জনের বেশি যাত্রী ওঠানামা করে না। অনেক আগেই আমার ঘুম ভেঙে গেছে, তবু ঘুম ঘুম চোখে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে স্টেশনের বাইরে এসে আমি বড়রাস্তার দিকে এগোতে যাচ্ছি, এমন সময় কে যেন ডাকল, মিঃ নীললোহিত!
দৈববাণী নাকি? কিন্তু ঠাকুরদেবতারা কি আমাকে মিস্টার বলবে? কে জানে, আজকাল হয়তো ঠাকুরদেবতারা খুব হিন্দি ফিল্ম দেখে।
প্রায় যেন মাটি ফুঁড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন মহিম সরকার। আমার হাত ধরে বললেন, আরে মশাই, আপনাকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছেন না? চলুন, আমার জিপ আছে। ঐ যে ডানদিকে।
আমি বললুম, আপনি এখানে কেন?
আসলে আমার মাথা থেকে ঘুম কাটেনি। মহিম সরকারকে দেখে তো আমার খুশি হবারই কথা।
উনি ওঁর কোনো আত্মীয়কে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছেন। বেশ সহজে আমি লিফ্ট পেয়ে গেলুম। তবু যেন আমার মনে হচ্ছে, হাইওয়েতে গিয়ে আমাকে হাত দেখিয়ে কোনো ট্রাক থামাতে হবে।
আমাকে টেনে তুলে মহিম সরকার ড্রাইভারের পাশের সিটে বসিয়ে দিলেন। জিপ চালাচ্ছেন উনি নিজে।
গাড়ি স্টার্ট দেবার পর মহিম সরকার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কী খবর বলুন। কলকাতায় সব ঠিকঠাক হলো?
আমি বললুম, হ্যাঁ, খবর খুব ভালো, খুব ভালো। যে-জন্য গিয়েছিলুম, অত্যন্ত সাকসেসফুল। ছোটপাহাড়ীর খবর কী?
—ছোটপাহাড়ীর খবর ঠিকই আছে। আপনার ওখানকার তেতলায় কনস্ট্রাকশন অনেকটা হয়ে গেছে। মিঃ নীললোহিত, ছাদ ঢালাইয়ের সময় কিন্তু আপনাকে উপস্থিত থাকতে হবে। জানেন তো, ঢালাই একবার থেমে গেলে কত ক্ষতি হয়?
—থাকব। নিশ্চয়ই থাকব। ফুলমণি আবার কাজ করবে?
–ফুলমণি?
—আপনি এত চমকে যাচ্ছেন কেন? ফুলমণি, যে ভালো ছবি আঁকে। সে ফিরেছে নিশ্চয়ই?
—তাকে তো আপনি সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন কলকাতায়।
—হ্যাঁ, কিন্তু সেকি একলা ফিরতে পারে না?
—তা তো আমি জানি না। কিন্তু নীললোহিত, আমি যতদূর জানি, সে ফেরেনি। সবাই জানে,আপনি তাকে কলকাতায় নিয়ে গেছেন। আপনিও আর ফিরবেন না, সে-ও ফিরবে না।
—আরে মোলো যা! আমার ফেরার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক? ফুলমণি আমার কে?
হঠাৎ যেন একটা ঝাঁকুনি খেয়ে আমি সজাগ হলুম। এসব আমি কী বলছি? লালুদা আর নীপা বউদি পইপই করে বলে দিয়েছিল, ফুলমণির হারিয়ে যাবার খবরটা যেন চন্দনদার আগে অন্য কারুকে জানানো না হয়। ঘুমের ঘোরে আমার গুলিয়ে গেছে সব কিছু।
মহিমবাবু আমার দিকে ত্যারছা চোখে তাকিয়ে আছেন।
কথা ঘোরাবার জন্য আমি বললুম, আমাকে মিস্টার মিস্টার বলেন কেন, মহিমবাবু? আমি ক্লাস থ্রি স্টাফ, আপনার মতন তো অফিসার নই। আপনার থেকে আমি বয়েসেও অনেক ছোট। আমাকে শুধু নাম ধরে ডাকবেন।
–ও, এ-কথাটা প্রথম দিন বললেই পারতেন। আমি ভেবেছিলাম বড় সাহেবের ভাই।
—সিগারেট খাবেন? এখানে বৃষ্টি হয়নি? কাল কলকাতায় কী তুমুল বৃষ্টি
—ফুলমণিকে কোথায় রেখে এলেন?
এ যে ভবী ভোলবার নয়। ঘুরে ফিরে আবার সেই ফুলমণির কথা। কেন যে মহিমবাবুর জিপে উঠলুম!
–ও তো কলকাতাতেই রয়ে গেছে। ওর একজিবিশান যতদিন চলবে…ওর ছবির খুব নাম হয়েছে, বুঝলেন।
—তবে কেন জিজ্ঞেস করলেন ফুলমণি ফিরেছে কি না?
—ওটা এমনই আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলুম।
—হু।
আমি বুঝব কী করে মহিমবাবু এর মধ্যে তাঁর শালা কিংবা ভাইপোর চাকরি মনে মনে পাকা করে ফেলেছেন। বাকি রাস্তা তিনি আমার সঙ্গে কোনো কথা বললেন না। আমি গল্প জমাবার চেষ্টা করলেও হুঁ-হাঁ করে সারলেন।
জঙ্গলটা পেরিয়ে ছোটপাহাড়ীতে পৌঁছে বাজারে কাছটায় এসে মহিমবাবু বললেন, একটা মুশকিল হয়েছে, আমার জিপে ডিজেল খুব কম, আপনার গেস্ট হাউসে পৌঁছোতে গেলে…আমার গাড়ি সম্পূর্ণ উল্টো দিকে…যদি ডিজেল একেবারে ফুরিয়ে যায়? আপনি এইটুকু হেঁটে যেতে পারবেন?•
লোকটা মহা কিপ্যুস তো। দেড় ঘণ্টা জিপ চালিয়ে এল, আর দশ মিনিট চালালেই ডিজেল ফুরিয়ে যাবে? আসলে আমাকে অবজ্ঞা দেখাতে চায়।
তবু ওঁকে খাতির করে বললাম, না, না, আমার বাড়ি বাঁ দিকে, আপনি এখান থেকে ঘুরে চলে যান। আমি এইটুকু রাস্তা স্বচ্ছন্দে হেঁটে যেতে পারব। মালপত্র কিছু নেই, আপনি যে এতটা পৌঁছে দিলেন, তাতেই কত উপকার হলো। ট্রাক ধরে এলে পয়সা লাগত!
গাড়ি থেকে নেমে বললুম, আচ্ছা। কাল দেখা হবে।
মহিমবাবু বললেন, নিশ্চয়ই
ছোট্ট বাজার, অনেক আগেই আলো-টালো নিবিয়ে ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে। বাজারের পেছনে একটা নতুন কুলি বস্তি, ক্ষীণ গান-বাজনার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে সেখানে।
আমার রাস্তা ডান দিকে, সম্পূর্ণ অন্ধকার।
এরকম অন্ধকার, এরকম নিস্তব্ধতা কলকাতায় দেখা যায় না। গাড়ি-টাড়ি তো দূরের কথা, একটাও মানুষ নেই পথে। দু’ পাশে এখনো প্রচুর ফাঁকা মাঠ, দূরে দূরে বাড়ি, সেসব বাড়ির লোকেরা ঘুমিয়ে পড়ে নটা-সাড়ে নটার মধ্যে। টি ভি নেই তো ভদ্রলোকেরা জেগে থাকবে কী করে?
গেস্ট হাউসে নয়, আগে যেতে হবে চন্দনদার বাড়িতে।
চন্দনদা কোনো কোনোদিন দেড়টা-দুটো পর্যন্ত জেগে পড়াশুনো করে, আবার কখনো ঘুমিয়ে পড়ে রাত দশটার মধ্যে—কোনো ঠিক নেই। আজ ঘুমিয়ে পড়লেও জাগাতেই হবে। ফুলমণির দায়িত্বটা আমি এবার চন্দনদার ওপর দিয়ে দিতে চাই, আমি আর পারছি না।
কাছেই পাহাড় ও জঙ্গল আছে বটে কিন্তু নির্জন রাস্তায় হঠাৎ হিংস্র জন্তু—জানোয়ারের ভয় নেই। তবে সাপ বেরোয় প্রায়ই। বিশেষত বৃষ্টির দিনে। সাপ তাড়াবার শ্রেষ্ঠ উপায় মাটিতে জোরে জোরে শব্দ করা। আমি চটি দিয়ে ধপাস ধপাস করে এগোতে লাগলুন।
নিজের পায়ে আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শুনতে পাওয়ার কথা নয়। হঠাৎ যেন আরও কয়েকটা পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল।
পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, অন্ধকারের মধ্যেই চলন্ত অন্ধকার হয়ে গোটা কয়েক লোক ছুটে আসছে। ওরা কারা কে জানে, আমি সরে দাঁড়ালুম এক পাশে
লোকগুলো কিন্তু আমারই কাছে এসে থেমে গেল এবং ঘিরে ফেলল। মিস্তিরি—কুলি শ্রেণীর মানুষ, কয়েকজনের হাতে লাঠি।
একজন জিজ্ঞেস করল, এ বাবু, ফুলমণি কোথায়?
লোকগুলোকে ঠিক চিনতে পারছি না। ওরকম রুক্ষ স্বরের প্রশ্ন আমার পছন্দ হলো না। ফুলমণি, সে কৈফিয়ৎ যদি দিতে হয় তার শ্বশুরকে দেব, এরা কারা!
জিজ্ঞেস করলুম, তোমরা কে?
সেই লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, ফুলমণি কোথায়?
-সে কলকাতায় আছে।
—তাকে আনলি না কেন?
—তার কাজ এখনো শেষ হয়নি।
–তুই নিয়ে গেছিস, তুই আনবি না?
–সে এখন…
আমার কথাটা শেষ করতে দিল না, একজন আমার মাথায় চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। আর একজন পিঠে মারল লাঠির বাড়ি।
আমি লাফিয়ে সরে যাবার চেষ্টা করে বললুম, আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, আমার কোনো দোষ নেই, ফুলমণি…।
ওরা আমাকে কোনো কথা বলতে দিতে চায় না। সবাই চালালো কিল-চড়—ঘুষি। এবার পালানো ছাড়া উপায় নেই। দৌড় মারবার চেষ্টা করতেই একজন আমার পায়ে খুব জোরে একটা লাঠির ঘা কষালো। আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলুম, পাথুরে রাস্তায় কপালটা ঠুকে গেল, ছেঁচে গেল নাক।
এবার একজন আমার মাথা ঘেঁষে কাঁধে যে জিনিসটা দিয়ে মারল সেটা লাঠি না লোহার রড? যা-ই হোক, তাতে কিছু আসে যায় না, মোট কথা আমার মাথা ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে বুঝতে পারছি। আরও মারছে, আর কত মারবে!
সেই অবস্থায় আমার মনে পড়ল, ভাগ্যিস সিরাজুল তারিক সহেব আমার সঙ্গে আসেননি। যদি তাঁকেও এরা…
আমি গড়াবার চেষ্টা করেও পারছিলুম না। আর কিছু চিন্তাও করতে পারছি না কেন? চোখের মধ্যে যেন অনবরত বিদ্যুতের ঝিলিক দিচ্ছে। আমি কি অজ্ঞান হচ্ছি, না মরে যাচ্ছি? মৃত্যুর সময় বুঝি চোখে এরকম ঝিলিক খেলে। এরা আমাকে শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলল? ছি ছি ছি ছি।
একেবারে শেষ মুহূর্তে আমি টের পেলাম বৃষ্টি নেমেছে।
আমার শেষ চিন্তাটা এই যে, ছোটপাহাড়ীতে আমার চাকরির এই শেষ। এক মাসের মাইনেটাও পেলুম না? এরা আমাকে পুরো একটা মাসও চাকরি করতে দিল না। আজ মাসের ঊনতিরিশ তারিখ। মায়ের হাতে তুলে দিতে পারলুম না একটা টাকাও। আমি একটা অপদার্থ!