ফুটেছে কুসুমকলি…
ফাল্গুনের মাঝামাঝি পলাশবনে আগুন ধরে গেল। ডাইনে খোয়াই, বাঁয়ে মউরি মাঠ। দুইয়ের মাঝখান ধরে খানিকটা এগুলেই পলাশবন। মউরি মাঠকে কেউ কেউ বলে আকাশি মাঠ। যত না মাঠ তার চেয়ে বেশি ছোট ছোট বালিয়াড়ির ঢেউ। মাঠ-শেষের আগেই আকাশ এসে মাটি ছুঁয়েছে। তারই গায়ে উড়নি নদী। কবে নাকি কোন অপ্সরার গায়ের উড়নি খুলে গিয়ে বাতাসে উড়তে উড়তে এসে পড়েছিল এখানে—সেই থেকে উড়নি নদী। শীর্ণ স্বচ্ছ আকাবাঁকা জলস্রোত। বর্ষায় জল থাকে, বাকি সময়টায় ঝকঝকে বালি।
এই বছরটি যেন কেমন। সবই আগে আগে। বৈশাখ পড়ল কি আকাশ জুড়ে চিতা জ্বলে উঠেছিল। সেই দাউ দাউ জ্বলনে গাছপালা পুড়ল, লতাপতা শুকিয়ে ঝরে গেল, পশুপাখিও ঝলসে যাচ্ছিল। বর্ষাও এল ঝমঝমিয়ে। আষাঢ়েই ভরা শ্রাবণ। শরৎকালটি অবশ্য সময়মতন দেখা দিয়েছিল। তবে এবার শিউলিগাছের ডালে যেন পাতা ছিল না। পাতা ডুবিয়ে ফুল ফুটেছিল। আর রূপমণি গাছের মাথা নুইয়ে দিল পুঁতির মতন ছোট সাদাসাদা জংলি ফুল। সকাল বিকেল, শুধু ফুল ঝরে। তারপর হেমন্ত আর শীত। এল গায়ে গায়ে। মাঘের গোড়াতেই শীত মোলায়েম হল। তখন থেকেই বাতাস এলোমেলো। হাওয়া দিল বসন্তের।
মাঘের শেষে পলাশবনে রঙ ধরেছিল। ফাল্গুনের মাঝামাঝি আগুন ধরে গেল।
এবারে দোল পড়েছে পয়লা চৈত্র। নীলমণির বড় আফসোস, আহা অমন ফুলগুলি সব দোলোৎসবের আগেই শুকিয়ে ঝরে যাবে!
মাধব হল নীলমণির বড় চেলা। ভাবসাব যথেষ্ট। নীলমণির আফসোস দেখে মাধব বলত, পলাশবন রাঙা থাকল কি থাকল-না তাতে কী আসে যায় ঠাকুর! আপনার এই আখড়াটিতে তো তখন রঙ ধরে যাবে।
নীলমণির এই আস্তানাটিকে মাধব বলে, আখড়া। নীলু ঠাকুরের আখড়া। তার দেখাদেখি আরও পাঁচজন আখড়া বলতে শুরু করেছে।
নীলমণি শোনে, আর হাসাহাসি মুখ করে। এটি তার আখড়া নয়, আশ্রমও নয়, সে বলে, গৃহবাস। জায়গাটি দেখলে অবশ্য ছোটখাটো আশ্রম বলে মনে হয়।
বছর তিনেক আগে নীলমণি এই জায়গাটিতে এসে উঠেছিল। কবে কোন কালে এখানে একটি গড় ছিল। রাশ রাশ পাথরের স্তূপ আর বড় বড় গাছের জঙ্গল ছাড়া সেই গড়ের আর কিছু নেই। তবু নামটি থেকে গিয়েছে বাসুদেবগড়। বাসুদেব ছিল রাজা।
নীলমণির মনে ধরে গেল বাসুদেবগড়। বিঘে দেড়েক জায়গা নিল। দাম বলতে প্রায় কিছুই নয়। জংলি জায়গা—কোন কাজেই বা লাগে! নীলমণি ধীরেসুস্থে জায়গাটিকে ঘিরে নিল। নিজের মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করল।
আজ অবশ্য নীলমণির গৃহবাসটিকে আশ্রম বলেই মনে হয়। কাঠকুটো, জঙ্গলা লতাপাতা, কাঁটাগাছের বেড়া দেওয়া রয়েছে চারপাশে। কাঠের তক্তা দেওয়া দুটি সরু সরু ফটক। সামনেরটি পুবমুখো। পুবের দিকেই নীলমণির বাস।
নিজের আশ্রয়টি নীলমণি ছোটখাটো করেই গড়ে নিয়েছে। সূর্যমার্কা সস্তা পাতলা টালির ছাদ, ইটের দেওয়াল। মেঝে সিমেন্ট-বাঁধানো। গুটি তিনেক ছোট ছোট ঘর, বারান্দা। দেখতে কোঠা বাড়ির মতনই লাগে।
পশ্চিমের দিকে খড়ের ছাউনি-দেওয়া লম্বাটে এক একচালা। গাঁথনি অবশ্য ইটের। মেঝে কাঁচাপাকা, কোথাও সিমেন্ট কোথাও খোয়া-পেটানো। এই একচালার মধ্যে দশ পনেরো জন অনায়াসেই মাথা গুঁজে থাকতে পারে। দু’চারটি জংলা কাঠের তক্তপোশ পাতা থাকে। দড়ির খাটিয়াও দাঁড় করানো আছে দু’তিনটি একাপাশে।
কুয়াতলার কাছ বরাবর থাকে বংশী। বংশী আর তার বউ সুবলা। একটা কচি ছেলেও আছে ওদের, ঝুমরু। বংশীদের বাড়িটি হল টিনের চালা দেওয়া।
নীলমণির এই জায়গাটিতে গাছপালাও মন্দ নয়। দু’ তিনটি বড় বড় গাছ : নিম আর দেবদারু। ফলের গাছ বলতে পেয়ারা, কুল। আতাঝোপ। বংশীর হাতের গুণে শাকসবজি আনাজও ফলেঃঃ লাউ কুমড়ো, ঝিঙে, লেবু লংকা—এরকম সব। দু’পাঁচটি মামুলি ফুলগাছের ফুলও ফোটে বারো মাস।
নীলমণি একা থাকে না। সঙ্গে থাকে কনকবালা। সম্পর্কে নীলমণির বোন। নিজের নয়, সৎমায়ের মেয়ে। বোনের বাপটিও অন্য। নীলমণির থেকে বছর ছয়েকের ছোট কনক। বয়েসে যুবতী, দেখতে সুন্দরী। নীলমণি বলে, কাঞ্চনকান্তি।
পেশা বলতে নীলমণির বড় কিছু নেই। দু’ চারটি ওষুধবিষুধ সে তৈরি করে, গাছগাছড়ার; সোহাগা কর্পূর লবঙ্গফুল চন্দনগুঁড়োর মলম। আরও কত কিসের মিশেল থাকে। লোকজন আসে মাঝে মাঝে, নিয়ে যায়। আশপাশের হাটেবাজারেও নীলমণির তৈরি ওষুধের শিশি, মলমের কৌটো পাওয়া যায়। মাধবই এই ব্যবস্থাটি করেছে।
নীলমণির হাতে তৈরি দুটি ওষুধের খুব সুনাম। আগুনে-পোড়া ঘায়ের জ্বালা-যন্ত্রণা কমাতে রয়েছে একটি মলম। অন্য ওষুধটি শ্লেষ্মা-রোগের। আরও একটি ওষুধ নীলমণি জানে। উন্মাদ রোগের ছোটখাটো উপসর্গ দেখা দিলে তার সাময়িক উপশম সে করতে পারে। তবে এই ওষুধটি আর কতই বা কাজে লাগে!
মাধব ঠাট্টা করে নীলমণিকে বলে, ”আপনি ঠাকুর বৈদ্যবংশে না জন্মালেও সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। আমি বলি কী—এই আখড়াটিকে কবিরাজী ওষুধের কারখানা করে ফেলুন। আগুনে পোড়া আর কফ পিত্ত দিয়ে তো শুধু হবে না, দু’ পাঁচটি মেয়েলি ওষুধ বার করুন। হাটে-মাঠে বিক্রি হবে। আর একটা মাথার তেল—বলবেন—সুনিদ্রাবিলাস। মাথায় মাখলেই সুনিদ্রা। ….এই ক’টি বার করুন তো, দেখতে দেখতে লাখোপতি হয়ে যাবেন।”
নীলমণি হেসে বলে, ”আমি ধন্বন্তরি হব কেন, মাধব। দু-একটি ওষুধ যা জানি—সেগুলি আমার বাপ-ঠাকুরদার কাছে শিখেছি। টোটকা-টুটকি বলতে পার। দেহাতি ওষুধ।”
নীলমণি ঠিকই বলে। তার ঠাকরদা আগে ছিলেন জরিপদার। জঙ্গলে মাঠেঘাটে জরিপের কাজ করতেন। পরে কাঠের কারবার শুরু করেন। পাহাড় জঙ্গলে ঘোরার সময় এক সাধু তাঁকে আগুনে পোড়ার ওষুধটি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। ঠাকুরদা সেটি পারিবারিকভাবে ব্যবহার করতেন। পাড়াপড়শিদের দিতেন।
নীলমণির বাবা কালীগঙ্গার অক্ষয়কবিরাজ মশাইয়ের কবিরাজী ওষুধের কারবারের অংশীদের ছিলেন। পয়সাও যোগাতেন। বাবাও যেন কেমন করে দু’ একটি ওষুধ শিখে ফেলেছিলেন। শ্লেষ্মা আর শ্বেতী রোগের ওষুধ দুটি মোটামুটি কাজে লাগত। তা বাবা একসময় অক্ষয়কবিরাজ মশাইকে ছেড়ে আসেন। বনিবনা হচ্ছিল না।
বাবা মারা যান পঞ্চান্ন বছর বয়েসের এ-পারে। দ্বিতীয় স্ত্রীটি বেঁচে ছিল তারপর আরও বছর তিন। তার নামটি ছিল ইন্দুমতী।
নীলমণিদের সমাজটি একটু অন্যরকম। এমনটি এখন আর দেখাই যাবে না। বিশ তিরিশটি ঘর হয়ত ছিটিয়ে-ছড়িয়ে রয়েছে। কে কোথায় আছে খোঁজ পাওয়া যায় না। হিন্দু সমাজেরই মানুষ, তবু আচার আচরণে পুরোপুরি হিন্দু নয়। শোনা যায়, আদিতে এরা ক্ষত্রিয় ছিল। বাংলাদেশের বাইরের মানুষ। অচ্ছুতের অন্ন গ্রহণ করার জন্যে জাতিচ্যুত হয়। ছুট সমাজের মানুষ হিসেবে কে কবে কোন আলাদা ধর্ম ও মত অবলম্বন করেছিল—তারও কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না।
নীলমণির বাবা যখন ইন্দুমতীকে নিজের সংসারে নিয়ে আসেন, তখন ইন্দুমতী বিধবা, সঙ্গে রয়েছে কনক। কিশোরী মেয়ে। ইন্দুমতী বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী হল। বিয়ের আচার কিছুই ছিল না। একটি কাগজে লেখালেখি হল। সই-সাবুদ থাকল। বাবা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর গলায় সোনার হার পরিয়ে দিলেন, আর ইন্দুমতী বাবার হাতে একটি আঙটি।
ইন্দুমতী সেদিন থেকে বাবার স্ত্রী। বাবার ঘর, বাবার বিছানা ইন্দুমতীর নিজের হয়ে গেল। সংসারটিও।
নীলমণির মা মারা গিয়েছিল তার বাল্যকালে। ইন্দুমতী যখন এল নীলমণি তখন কৈশোর পেরিয়েছে। কনক বছর দশেকের মেয়ে। বাবার নতুন স্ত্রীকে পছন্দ করেনি সে। কনককেও নয়। তবে নীলমণি বরাবরই শান্ত নরম ধরনের বলে নিজের বিরূপতা জানাবার চেষ্টাও করেনি। সে ছাড়া-ছাড়া ভাবে থাকত, তফাতে তফাতে। কিন্তু বাবার তরফ থেকে ছেলের প্রতি কোনো অনাদর ঘটছে না দেখে, আর ইন্দুমতীও তাকে স্নেহযত্ন থেকে বঞ্চিত করছে না বুঝতে পেরে নীলমণির মন খানিকটা ঘুরল। ইন্দুমতীর গুণ ছিল, মায়া-মমতা ছিল। আকর্ষণও ছিল। নীলমণিকে ধীরে ধীরে আপন করে ফেলতে লাগল। ‘মণি’ বলে ডাকত তাকে। নীলমণি কিন্তু ইন্দুমতীকে মা বলতে পারত না, বলত ‘ইন্দুমাসি’। বাইরের লোকের কাছে অবশ্য কখনও কখনও ‘ইন্দুমা’ বলত।
বাবা যখন মারা গেল নীলমণির বয়েস পঁচিশ ছাব্বিশ। ইন্দুমাসির সঙ্গে তার সম্পর্ক খুবই ভাল। চমৎকার বনিবনা। মাসির হ্যাঁ, নীলমণিরও হ্যাঁ। সেই মাসিই হঠাৎ কেমন খাপছাড়া হয়ে উঠল। কখনো অন্যমনস্ক, কখনও বিরক্ত। রাগারাগি করতে লাগল অকারণে। মাঝে মাঝে গুম হয়ে থাকত। দেখতে দেখতে মাসির হাবভাব পালটে যেতে লাগল। স্বামীর অবর্তমানে এরকম হয়েছে, নাকি মাসি নিজেকে নিরাশ্রয় বিপন্ন ভাবছে—বুঝতে পারত না নীলমণি। বাবা তাদের নিঃস্ব নিঃসম্বল করে রেখে যাননি। মাথা গোঁজার জায়গা, সামান্য জমিজায়গা, ওষুধের দোকানটা রেখে গিয়েছিলেন। নীলমণি সেসব দেখত। তাহলে মাসির এই ভয়, দুশ্চিন্তা, বিরক্তি, বিষণ্ণতা কেন! কী হয়েছে মাসির?
নীলমণির যখন সন্দেহ হতে শুরু করেছে, ভাবছে—ইন্দুমাসির কি মাথার গোলমাল দেখা দিল তখন দুটো বিশ্রী ঘটনা ঘটল। ছোটখাটো দৃষ্টিকটু ঘটনা তো প্রায়ই ঘটত, সেসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি নীলমণি। কিন্তু পরে এমন দুটি ঘটনা ঘটল যে, নীলমণি আর অগ্রাহ্য বা উপেক্ষা করতে পারল না।
একদিন ইন্দুমাসি কনকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখন সন্ধেরাত। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে, মেঘের ডাক আর বিদ্যুতের চমকে কান চোখ খোলা রাখা যায় না। কনকের ঘর থেকে তাকে টেনে নিয়ে এসেছে মাসি। এনে ঢাকা বারান্দায় দাঁড় করিয়ে আঁচড়াচ্ছে, মারছে, গলা টিপে ধরছে, শাড়ি জামা টেনে খুলে ছিঁড়ে-খুঁড়ে দিচ্ছে। বৃষ্টির জলে, ঝাপটায় দু’জনেই ভিজে গিয়েছে। দুটি নারীই যেন নির্বাস, পরস্পর পরস্পরকে বারান্দা দিয়ে সিঁড়ির মুখে ঠেলে ফেলে দেবার চেষ্টা করছিল।
নীলমণি কনককে বাঁচাল। কিন্তু বুঝল না, ইন্দুমাসির হঠাৎ এমন উন্মাদের মতন ব্যবহার কেন? মেয়েকে তো কম ভালবাসে না মাসি! শুধু যে ভালবাসে তা নয়—নিজের আঁচলে বেঁধে রেখেছে বরাবর। সেই মেয়েকে এমন করে নৃশংসের মতন কেন মারছিল মাসি? কী দোষ কনকের?
নীলমণি যখন কথাটা তুলব তুলব করছে, আর ইন্দুমাসির মাথার গোলমাল সম্পর্কে প্রায় নিঃসন্দেহ, তখনই একদিন মাসি তার ঘরে এসে হাজির। রাত হয়েছে এসেছে, বৃষ্টি নেই, বাদলা বাতাস দিচ্ছিল।
ইন্দুমাসি কোনো ভূমিকা করল না। বলল, ”আমি দু’চার দিনের মধ্যে পুরী চলে যাব।”
”পুরী! কেন?”
”সেখানে থাকব।”
”কে আছে সেখানে?”
”কেউ নেই। থাকলেও তোমাদের কেউ নয়। …আমায় তুমি টাকা দেবে।”
”টাকার কথা পরে। আগে বলো, তুমি হঠাৎ পুরী চলে যাবে কেন? কী হয়েছে তোমার? কেন তুমি এমন হয়ে যাচ্ছ? সেদিন কনককে…”
নীলমণির কথা শেষ করতে না দিয়ে ইন্দুমাসি আচমকা বলল, ”ওই মেয়ের সঙ্গে তোমার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। ওর বাবা তোমার বাবা নয়, আমিও তোমার মা নই। কনককে নিয়ে তুমি এখানে থাকতে পার। বিয়ে করতে পার।”
নীলমণি চমকে উঠল। মাসির মুখ দেখল। আগুনের শিখা দপ করে জ্বলে উঠলে যেমন তার ভয়ংকরতা থাকে—ইন্দুমতীর সারা মুখে চোখে সেই রকম এক ভয়ংকর ভাব। নিষ্ঠুর, হিংস্র দেখাচ্ছিল তাকে।
নীলমণি কথা বলতে পারছিল না। শেষে বলল, ”তুমি পাগলের মতন কী বলছ?”
ইন্দুমতী বলল, ”আমি পাগল হয়েছি। আরও বেশি পাগল হবার আগে এখান থেকে চলে যেতে চাই। কনককে তুমি কী বুঝবে! আমি বুঝি। …ওকে তুমি কাছে রেখে দিও। অন্য কোথাও দিয়ো না। ও মরবে। তুমিও মরবে।”
নীলমণি বলল, ”ঠিক আছে। এখন তুমি যাও।”
”আমি তো যাবই। কিন্তু তোমায় আমি বলে যাচ্ছি মণি, ভালবাসার তিনটি ঘর আছে। প্রথমটি চোখে ধরা পড়ে, অন্য দুটি দেখা যায় না। বড় অন্ধকার। যার ঘর সেও সেখানে হাতড়ে বেড়ায়। …তুমি আমায় পাগল ভাব, আর যাই ভাব, আমি তোমায় আমার কথাটি বলে গেলাম। একদিন তুমি নিজেই বুঝবে।”
ইন্দুমাসি সত্যিসত্যি পুরী চলে গেল। স্বর্গদ্বারের দিকে থাকত। মাস ছয়েক পরে খবর এল, সমুদ্র মাসিকে টেনে নিয়েছে।
নীলমণি বড় দুঃখ পেয়েছিল। যে-মানুষটিকে সে বারো তেরো বছর ধরে নিত্যদিন দেখল, যাকে কখনোই খামখেয়ালি, খাপছাড়া, বোকা, স্বার্থপর, কাণ্ডজ্ঞানহীন বলে মনে হয়নি, সেই মানুষই শেষপর্যন্ত কেন এমন হয়ে গেল—সে বুঝতে পারেনি। মাসি তার মেয়েকে ভালবাসত। জন্মাবধি এই মেয়েকে নিজের বুকের তলায় রেখে মানুষ করেছে। কনক বড় হবার পর মাসি তাকে নিজের আঁচলে গিঁট বেঁধে রেখে দিয়েছিল। তবু শেষ বেলায় এমন হল কেন?
ইন্দুমাসির স্বভাবের সঙ্গে সবই কেমন বেমানান। বাবাকে মাসি যত ভালবাসত ততই মান্য করত। বাবার কোনো কষ্ট মাসি সহ্য করতে পারত না। স্বামীর সুখদুঃখের সঙ্গে নিজেকে এমন করে জড়িয়ে ফেলেছিল যে, নীলমণির মনেই হত না, এই স্বামী কপালগুণে নতুন করে কুড়িয়ে পাওয়া।
নীলমণিকেও কি কম ভালবাসত মাসি! বাবা মারা যাবার পর তাকে যেন আগলে রাখতে চাইত ইন্দুমাসি। কিন্তু নীলমণি তো তখন পূর্ণ যুবক।
হয়ত মানুষের জীবন এই রকমই। যে-আকাশ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রোদে রোদে ভরা থাকে, দুপুর থেকে বিকেল গড়িয়ে যাবার পরও যার দশপ্রান্তে নীল ছড়িয়ে থাকল—কত পাখি সাঁতার কাটল শূন্যে, বাতাসে ডানা মেলে উড়ে বেড়াল—হঠাৎ সেই শান্ত স্বাভাবিক আকাশ সন্ধের মুখে অন্যরকম হয়ে গেল। মেঘ এল, ঝড় এল, আকাশ কালো হয়ে দেখা দিল দুর্যোগ। মানুষের জীবনেও এ-রকম হয়। মাসির বেলায় হল।
মাসি মারা যাবার পর নীলমণি দেড় দু’বছর কোথাও নড়েনি। নিজের জায়গায় বসে থাকল। তার মন কিন্তু ছাড়া-ছাড়া হয়ে গেল। ভাল লাগছিল না আর। বাবার দোকান টিমটিম করে চলছিল।
কনকের বিয়ের চেষ্টা করল। মাসি থাকতেই সে-চেষ্টা হয়েছিল। কনককে রাজি করানো যায়নি। মেয়ের বয়েসও তো দেখতে দেখতে চব্বিশ পঁচিশ ছাড়িয়ে যাচ্ছিল।
নীলমণি নতুন করে চেষ্টা করল। পারল না। কনক যে কোন জেদ দরে বসে থাকল কে জানে।
এরপর একসময় নীলমণি ঘোরফেরা করতে বেরিয়ে এই বাসুদেবগড়ে। জায়গাটা তার ভাল লেগে গেল।
নিজেদের ঘরবাড়ি, দোকান, জমিজায়গা যা ছিল বেচে দিয়ে একদিন নীলমণি চলে এল এখানে। তারপর তিনটি বছর কেটে গেল।
দুই
সে-দিন মাধব এল বিকেলের গোড়ায়। সাইকেল থেকে নামতে নামতে বলল, ”ঠাকুর, রেল স্টেশনের মাস্টারবাবু এটি গছিয়ে দিলেন। বললেন, ও মাধব—এটি নিয়ে যাও, তোমাদের নীলমণিবাবুর জিনিস।” বলতে বলতে মাধব একটা ক্যাম্বিসের মাঝারি ব্যাগ সাইকেলের হ্যান্ডেলের কাছ থেকে নামিয়ে নিচে রেখে দিল।
গরম পড়ে আসছে। সকালের দিকটায় মরা শীতের ভাব থাকে, কুয়াশাও জড়ানো থাকে মাঠেঘাটে, কোনোদিন পাতলা কোনোদিন ঘন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতের সিরসির ভাবটা কেটে যায়। বেশি বেলায়, গরম লাগতে শুরু করে, তারপর দুপুর নাগাদ মনে হয়—মউরি মাঠ আর পলাশবনের দিক থেকে এলোমেলো দমকা বাতাসের সঙ্গে বুঝি চৈত্রমাসটাও এসে পড়ল। তখন বেশ গরম। আকাশও ঝকঝক করছে, সূর্য জ্বলছে। ফাল্গুন মাস শেষ হতে চলল। দুপুরের দিকটা এই রকমই হবে। সন্ধেবেলায় আবার সব বদলে যেতে শুরু করে। রাত্রে শীত আছে এখনও। বনজঙ্গলের জায়গা, ফাঁকা, শীত ফুরোতে সেই চৈত্র।
মাধব ঘেমে গিয়েছিল। স্টেশনে এখান থেকে মাইল দুই। বোধহয় সরাসরি সেখান থেকেই আসছে সাইকেল চালিয়ে পড়ন্ত রোদের মধ্যে।
নীলমণি ব্যাগটা দেখল। হাত দেড়েক লম্বা। পেট মোটা। একরঙা নয়, নীল-কালোর চৌকো-কাটা। ছোট্ট এক টিপ-তালা লাগানো মাঝ-মধ্যে।
নীলমণি বলল, ”কার বাগ?”
”তা জানি না।” মাধব এবার ঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকল, ”ও দিদি, বাইরে জল দিন, গলা শুকিয়ে মরছি।”
নীলমণি একটা কাঠের নিচু চৌকির ওপর বসে ছিল। ছোট ছোট কাঠের চৌকি দু’তিনটে পাতা থাকে বারান্দায়। বেঞ্চিও আছে একটা। বারান্দায় রোদ নেই এখন। ছায়াও অনেক ঘন। রোদ এখন পশ্চিমে।
ব্যাগটা দেখতে দেখতে নীলমণি বলল, ”মাস্টারবাবু ব্যাগটা দিলেন, কিছু বললেন না? কার ব্যাগ, কে রেখে গেল?”
মাথা নাড়ল মাধব। পকেটের ময়লা রুমাল দিয়ে তখনও মুখ গলা ঘাড় মুছে নিচ্ছিল। বলল, ”মাস্টারবাবু বললেন, তিনি কি আর লোকটিকে দেখেছেন! গাড়ি তখন ছেড়ে দিয়েছে—একটি প্যাসেঞ্জার হঠাৎ ব্যাগটি প্ল্যাটফর্মে ছুঁড়ে দিয়ে রেলের কুলিকে বলল—এখানে দিতে। পরে মানুষটি আসছে।”
নীলমণি অবাক হল। প্ল্যাটফর্মে ব্যাগ ফেলে দিয়ে বলে গেল তাদের কাছে পৌঁছে দিতে। অদ্ভুত লোক তো! সে যাচ্ছিল কোথায়? কেনই বা নীলমণিদের কাছে ব্যাগটি পৌঁছে দিতে বলল! নীলমণি বলল, ”স্টেশনের মুটেও তাকে দেখেনি?”
”নজর করে দেখতে পারেনি।”
নীলমণির এখানে খানিকটা খ্যাতি রয়েছে। ফাঁকায়, একপাশে বনজঙ্গলে যেভাবে সে পড়ে থাকে—যেমন করে তার গৃহবাসটিকে গড়ে তুলেছে সে, টোটকাটুটকি ওষুধপত্র দেয়—তাতে অনেকেই মনে করে মানুষটি আশ্রমবাসী। সাধুসন্ন্যাসীর আশ্রম নয় ঠিক, তবে আশ্রমই। নীলু ঠাকুরের আখড়া। এই খ্যাতির জন্যই বোধহয় প্ল্যাটফর্মে ফেলে দেওয়া ব্যাগটা স্টেশনের মাস্টারবাবুর কাছে গচ্ছিত করে দিয়েছে কুলিটি।
কনক এল। হাতে জলের মগ আর গ্লাস। জল দিল মাধবকে।
নীলমণি তখনও ব্যাগ থেকে পুরোপুরি চোখ সরাতে পারেনি। কনককে বলল, ”ওই ব্যাগটি দেখেছ! স্টেশনে কে যেন ফেলে গিয়েছে। বলেছে এখানে পৌঁছে দিতে।”
কনক ব্যাগটি দেখতে দেখতে বলল, ”কার ব্যাগ? কখন ফেলে গিয়েছে?”
মাধব বলল, ”মাস্টারবাবু বললেন, কাল সন্ধের গাড়িতে। এক প্যাসেঞ্জারবাবু ব্যাগটা প্লাটফর্মে ফেলে দিয়ে খালাসিকে বললেন, নীলু ঠাকুরের আস্তানায় পৌঁছে দিতে। পরে তিনি আসছেন।”
কনক বলল, ”কেমন বাবু? খালাসি দেখেনি?”
”খেয়াল করেনি। সন্ধেবেলা। এখানের প্ল্যাটফর্মে আলোও দু’তিনটি।”
নীলমণি কনককে বলল, ”কে হতে পারে? কার বাগ? আগে এ-বাগ দেখেছ?”
মাথা নাড়ল কনক। সে জানে না।
নীলমণি কী ভেবে বলল, ”ভেতবে নিয়ে গিয়ে রেখে দাও, পরে দেখা যাবে। …আর যারই ব্যাগ হোক সে তো আসছেই আজকালের মধ্যে।”
কনক আরও খানিকটা জল দিল মাধবের গ্লাসে। তারপর ব্যাগটা তুলে নিল। নিয়েই বলল, ”মুখের তালাটা তো খোলা!”
নীলমণি অতটা লক্ষ করেনি আগে। মাধবও নয়। ছোট সস্তা টিপ-তালা—চট করে চোখেও পড়ে না খোলা না বন্ধ!
মাধব বলল, ”তাহলে প্ল্যাটফর্মে ফেলে দেবার সময় খুলে গেছে। চলন্ত গাড়ি থেকে ছুঁড়ে জিনিস ফেললে কি ওই তালা ঠিক থাকে! কতটুকু জান ওর!”
ঠিক কথা। নীলমণি যেন মাথা নাড়ল।
কনক চলে গেল ব্যাগটা নিয়ে।
জল খেয়ে জিরিয়ে মাধব এতক্ষণে আরাম পেল।
নীলমণি এবার বলল, ”তোমার লোকদুটি কবে আসবে মাধব?”
”কাল থেকেই আসার কথা। নয়ত পরশু থেকেই আসবে। …হাতে এখনও সময় আছে, ঠাকুর। দোল পড়তে এখনও সাতদিন।”
নীলমণি বলল, ”দু’একদিনের কাজ। মাঠটুকু সাফসুফ করে দেবে। আর ওই চালাটি সামান্য মেরামত করে দেবে। বংশীও হাত লাগাবে ওদের সঙ্গে।”
মাধব সবই জানে। প্রতি বছরই যেমন হয় এবারও তাই। দোলের দু’একদিন আগে থেকেই নীলমণি ঠাকুরের দু’ দশজন চেলাচেলি আসে। এরা সব নীলু ঠাকুরের চেনাজানা, অনুগত, বন্ধুটন্ধু। কেউ একা আসে, কেউ আসে জোড় বেঁধে। আসে বেড়াতে, দোলের সময় হইচই করতে, ফাগ ওড়ায়, ঘোরেফেরে, গান গল্পগুজব করে দু’চারটি দিন এই আখড়া জমিয়ে রেখে আবার ফিরে যায়। মাধবও ওদের মধ্যে অনেককে চেনে; বলরামবাবু, সুখময়বাবু, কেদার, রায়বাবু—অনেককেই। মেয়েদের মধ্যেও চেনে লীলাদিদিকে, বেণুদিদিকে, হাসি আর মাধুরীদিদিকে। চেনার সঙ্গে অচেনাও দু’একজন এসে যায়। আবার এ-বছর যারা এসেছে, তারা সবাই পরের বছর যে আসতে পারে, তাও নয়। গত দুটি বছর এরকমই দেখছে মাধব।
নীলমণি বলল, ”তুমি আজ কিছু টাকা নিয়ে যাও না কেন, মাধব। কনকের সঙ্গে বসে কথা বলে নাও। চালটি ডালটি তেল মশলা রাখতে হয় এবার।”
মাধব বলল, ”আমার খেয়াল আছে। গড়াই মশাইকে বলে রেখেছি। অসুবিধে হবে না। তবে একটা কথা ঠাকুর?”
নীলমণি তাকাল।
মাধব বলল, ”খরচটি তো আপনার মন্দ হয় না। দশ পনেরোটি লোক খায়দায়, তাদের চা পান এটি ওটিও রয়েছে। গড়ে একশো শোয়াশো টাকা। পাঁচ সাত দিনে পাঁচ সাত শো টাকা। আপনি এতগুলো টাকা খরচ করেন। তা করুন, আপনার লোকজন, অতিথি, কটি দিন আনন্দ করতে আসেন সবাই। আপনারাও এক পড়ে থাকেন। …কিন্তু ঠাকুর, খরচাটি তো তুলতে হবে। একটি দুটি ওষুধ আরও বাড়ান। দাশরথিবাবু বলছিলেন, কুষ্ঠ রোগটি এদিকে বেশি। লোকে ভয়ও পায়। হাসপাতাল সেই তিরিশ চল্লিশ মাইল তফাতে। মণ্ডল পাদ্রিবাবার কুঠো আশ্রমটিও কম দূর নয়। সেখানে আসল কুঠোরা থাকে। তাও দশ পনেরোটি। একটি ওষুধ যদি বার করেন—বিক্রি হবে।”
নীলমণি সব শুনল। বলল ”আমার যে জানা নেই মাধব। …কাজে লাগবে না, মিথ্যে একটি ওষুধ বিক্রি করে কী লাভ! সাতশো হাজারটি টাকা যদি আমার খরচা হয় এ-সময়ে হোক। বাপের কৃপায় এখনও সামান্য কিছু আছে আমার। চলে যাবে। তুমি ভেব না।”
মাধব চুপ করে বসে থাকল। তারপর হেসে বলল, ”ঠাকুর, আপনার লাখোপতি হওয়া হল না।”
তিন
নীলমণির ঘরে ব্যাগটি রেখে দিয়েছিল কনক।
সন্ধেবেলায় নীলমণি কোনো কোনো দিন বইপত্র পড়ে : রামায়ণ মহাভারত চরিতামৃত; কোনোদিন কবিরাজী চিকিৎসার বই, কোনোদিন বা এস্রাজ বাজায়। নীলমণি গাইতেও পারে। তবে তার গলার স্বর নরম, উঁচুতে চড়তে পারে না, চেষ্টা করলে কাশি এসে যায় বলে গান সে বড় একটা গায় না।
নীলমণি একটা বই নিয়েই বসবে ভাবছিল। লণ্ঠনটা সরাতে গিয়ে ব্যাগটা চোখে পড়ল।
কনক কী কাজে ঘরে এসেছিল, কাছেই ছিল। নীলমণি ব্যাগটা দেখতে দেখতে বলল, ”এ তো বড় অবাক কাণ্ড দেখছি, কনক।”
”কী?”
”লোকটা কে? গাড়ি থেকে ব্যাগ ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল! এখানেই যদি আসছিল তবে আবার গেল কোথায়? কী আছে ব্যাগে?”
কনক বলল, ”জামাকাপড় আছে হয়ত। হালকা।”
”এখানেই আসছিল শুনলাম। কে আসছিল? আর যদি আসছিল তো নেমে গেলেই তো পারত। জিনিস রেখে চলে গেল!” বলেই নীলমণি থেমে গেল। তারপর হঠাৎ তার কী মনে পড়ে গেল। অবাক গলায় বলল, ”শিতিকণ্ঠ নয় তো?”
কনকও যেন শিতিকণ্ঠর নাম শুনে অবাক হল। নীলমণিকে দেখল কয়েক পলক, তারপর ক্যাম্বিসের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে থাকল। ”ওর কি আসার কথা ছিল?”
”জহরকে নাকি বলেছিল দোলের সময় আসবে। জহর চিঠিতে লিখেছিল।”
কনক কথাটা জানত না। জহরদাদার চিঠির কথা সে শুনেছে। এক ক’দিন মাত্র আগে চিঠি এসেছে জহরদাদার। দোলের সময় আসছে না এবার। গতবারও আসতে পারেনি।
”নিশ্চয় শিতিকণ্ঠ”, নীলমণি বলল, ”ও ছাড়া এমন সব কাণ্ড আর কে করবে!”
কনক বলল, ”আমায় তো তুমি বলোনি। কেমন করে জানব!”
”ভুলে গিয়েছি। তা ছাড়া জহরের চিঠি। শিতিকণ্ঠ নিজে লেখেনি। ও কী বলেছে জহরকে, শিতির কথার কি ঠিক আছে! দেখা হয়েছে, বলেছে, ফুরিয়ে গেছে। আমি নিজেই বিশ্বাস করিনি।”
কনক কিছু বলল না।
নীলমণির কৌতূহল যেন বেড়ে গেল। বলল, ”ব্যাগটার তালা খোলা?”
কনক মাথা হেলিয়ে বলল, ”হ্যাঁ।”
কী খেয়াল হল নীলমণির, কৌতূহল যেন ক্রমশই বাড়ছিল। মজাও লাগছিল। বলল, ”দেখি কী আছে? শিতি আমার সঙ্গে চালাকি করতে চাইছে! আমায় বোকা বানাবে!”
কনক ইতস্তত করল। ”খুলে ফেলব?”
”খুলে ফেলো।”
”আজই যদি এসে পড়ে! বা কাল?”
”আজ আর কখন আসবে! সন্ধে তো হয়েই গেছে। কাল আসতে পারে। আসুক। …ও আমার সঙ্গে মজা করবে, ধোঁকা দেবে—আমি ওর সঙ্গে মজা করতে পারব না!” নীলমণি ছেলেমানুষি গলায় বলল, হাসতে হাসতে।
কনক ব্যাগের মুখে লাগানো আলগা তালাটা খুলে ফেলল। স্ট্র্যাপ ছিল দু পাশে দুটো। খুলে নিল।
নীলমণি হাসিমুখে তাকিয়ে থাকল।
কনক ব্যাগ খুলে হাত ঢোকালো ভেতরে। যা ভেবেছিল সে, ঠিক তাই। জামাকাপড়ই রয়েছে ব্যাগের মধ্যে।
প্রথমেই কনক একটা চাদর বার করল। গরম চাদর। ঘন খয়েরি রঙের। সামান্য কাজ আছে পাড়ের দিকে। দেখাল নীলমণিকে।
হাত বাড়াল নীলমণি। ”দেখি।”
হাতে নিয়ে দেখল নীলমণি। মাথা নাড়ল।
কনকও বুঝতে পারল না। শিতিকণ্ঠকেই কতকাল দেখেনি।
চাদরের পর একে একে অনেক কিছুই বেরুলো ব্যাগের মধ্যে থেকে। জামা দু’তিনটি, ধুতি একজোড়া, গেঞ্জি, দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম, আয়না, চিরুনি, মায় কাগজে মোড়া চামড়ার চটি।
নীলমণি বড় অবাক হয়ে যাচ্ছিল। একটি জিনিসও সে চিনতে পারছিল না। না-চেনা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। আজ চার বছরের মধ্যে শিতিকণ্ঠকে মাত্র একবার সে দেখেছে। এখানে নয়, পুরনো বাড়িতে।
কনক তখনও ব্যাগের মধ্যে হাত ডুবিয়ে হাতড়াচ্ছিল। এবার একটা চশমার খাপ বার করল। করে খাপটা খুলল। স্টিল ফ্রেমের চশমা। গোল কাচ।
নীলমণি বলল, ”শিতি নয়। শিতি চশমা পরে না।”
কনকও জানে শিতিকণ্ঠ চশমা পরে না। তবে হালে যদি নিয়ে থাকে চশমা—কে বলতে পারে! চশমার খাপ রেখে দিয়ে কনক ব্যাগটা এবার উলটে দিল। যদি কিছু থেকে থাকে ভেতরে!
ব্যাগ ওলটানোর পর মামুলি একটা খাম পাওয়া গেল। সাদা খাম। ভাঁজ করা। খামের মধ্যে আধ-ছেঁড়া তুলসীর মালা। দেখে তেমনই মনে হল।
নীলমণি যেন খুবই হতাশ হয়ে পড়েছে। গাল চুলকে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ”কনক, হেরে গেলাম। শিতি নয়।”
কনক বলল, ”কে তবে?”
”বুঝতে পারছি না। শিতি ছাড়া এরকম কাজ তো অন্য কেউ করবে না। শিতি বরাবরই রগুড়ে! ওর মাথায় খেলেও নানারকম। কাণ্ডজ্ঞান নেই।”
কনক জিনিসগুলো গুছিয়ে ব্যাগে ভরতে লাগল।
নীলমণি কনককে দেখছিল। শিতিকণ্ঠ এলে কনক কি খুশি হত? এক সময় কনকের সঙ্গে শিতির সম্পর্ক ভালই ছিল। শিতি কনককে পছন্দ করত। কনকের জন্যে তার দুশ্চিন্তাও দেখেছে নীলমণি। ইন্দুমাসির ইচ্ছেও ছিল, কনকের সঙ্গে শিতির বিয়ে হয়ে যায়। শিতি ভাল ছেলে, দেখতেও সুপুরুষ। ঝকঝকে চেহারা। স্বভাবও ভাল। খুবই জীবন্ত ধরনের। এক সময় চাকরিবাকরি করত, পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নেমেছিল। ফলপাকড়ের মোরব্বা, আচার, সস—এটাসেটা করত। খারাপ চলত না তার ব্যবসা।
নীলমণি নিজেও শিতিকণ্ঠকে বলেছিল কনককে বিয়ে করার জন্য।
শিতিকণ্ঠ হাসত। বলত, ‘গাছের ফল না পাকলে হয়? ফল পাকতে দাও।’
নীলমণি পালটা জবাব দিত হেসে, ‘পাকার ভরসায় বসে থাকলে যে কোনদিন ঝড়ে ফল এমনিতেই পড়ে যাবে হে!’ ইন্দুমাসির সঙ্গে তার মেয়ের তখনকার সম্পর্কের কথা ভেবেই বলত সে কথাটা।
শিতিকণ্ঠ কোনো জবাব দিত না।
নীলমণির কেমন দ্বিধা হত। বলত, ‘আমাদের কোনো সমাজ নেই, ছুট সমাজী, এতেই কি তুমি…!’
‘রাম রাম! ও আবার কী বলছ নীলু! ওসব সমাজফমাজে আমার কাঁচকলাটি হবে। না হে, কথা তা নয়। আসলটি হল কনক। সে যখন রাজি হবে, আমি হাজির হব।’
কনকই রাজি হচ্ছিল না। ইন্দুমাসির চেষ্টার শেষ ছিল না। মেয়েকে কত কী বোঝাত! মেয়ে অবুঝ।
এরপর থেকেই ধীরে ধীরে ইন্দুমাসির মন পালটাতে লাগল। স্বভাব রুক্ষ হয়ে উঠল। কেমন এক সন্দেহ আর রাগ তাকে খেপিয়ে তুলতে লাগল।
শিতিকণ্ঠ কেন, কনক যদি অন্য কাউকে বিয়ে করত—তাতেও মাসি আপত্তি করত না। কিন্তু কনককে কিছুতেই নোয়ানো গেল না।
নীলমণি নিজে কনকের সঙ্গে কথা বলেছে।
কনক তার জেদ ভাঙেনি। কথার জবাবও দিত না ভাল করে। রূঢ়ভাবে কিছু বলতে গেলে বলত, ‘তোমার বাড়িতে যদি রাখতে ইচ্ছে না থাকে বলে দাও, আমি চলে যাব।’
‘কোথায় যাবে?’
‘রাস্তায় বেরিয়ে ঠিক করব।’
‘মেয়েরা রাস্তায় বেরিয়ে কোথায় যায়?’
কনক ঘুরিয়ে জবাব দিত। ‘এ বাড়ি আমার বাবার নয়, এখানে আমি নিজের জোরে থাকতে পারি না। পেতেও পারি না। মা আমায় নিয়ে এসেছিল। মা বলতে পারে, এ তার দ্বিতীয় স্বামীর বাড়ি। আমি কিছু বলতে পারি না। তোমার বাবা আমার বাবা নয়, তোমার বাড়িঘর আর মায়ের বাড়িঘর থেকে আমায় তাড়িয়ে দিলে আমি চলে যাব। তারপর কী হবে—সে জেনে তোমাদের কী দরকার!’
ইন্দুমাসি ভেতরে ভেতরে রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে জ্বলছিল বোধহয়। জ্বলতে জ্বলতে তার মাথার গোলমাল শুরু হল। শেষ পর্যন্ত মাসি একদিন মেয়েকে যেন আর সহ্য করতে পারল না। তাকে টেনে নিয়ে এল বারান্দায়। মেয়েকে অনাবৃত করে দেখতে চাইল সে কত কী লুকিয়ে রেখেছে ভেতরে। হয়ত আক্রোশ আর ঘৃণার বশে ইন্দুমাসি মেয়ের গলা টিপে ধরত। বা তাকে বাড়ি থেকে বার করে দিত।
নীলমণি শেষটুকু আর গড়াতে দেয়নি।
এরপরই মাসি তার যা বলার নীলমণিকে বলে পুরী চলে গেল। সেখানে মাসি কেমন ছিল বলা মুশকিল। খোঁজখবর করেও নীলমণি সব জানতে পারত না। সে আজও জানে না ইন্দুমাসি সমুদ্রের ভেসে গিয়েছিল নাকি আত্মহত্যা করেছিল!
কিন্তু নীলমণি তার আগে থেকেই কনককে আর জোর করে কিছু বলেনি। তার ভয় ধরে গিয়েছিল। ভয়, ভাবনা, দ্বিধা।
তার চেয়ে এই ভাল। কনক থাক। নিজের মতনই থাক। সে একেবারে মূর্খ নয়, লেখাপড়া শিখেছে খানিক, বোধবুদ্ধি আছে; স্বভাবটিও হালকা নয়। নিজের চারপাশে যে বেড়াটি বেঁধে রেখেছে তা ডিঙিয়ে যাওয়া কঠিন। অথচ কনক সকলের সঙ্গেই মেলামেশা করতে পারে, স্বাভাবিক ভাবেই। তার গাম্ভীর্য অন্য ধরনের। নীলমণি নিজেই ঠাট্টা করে বলে, মুখটিতে তোমার মেঘ জমে থাকে না—এটাই ভাল কনক; রোদটি আকাশে লেগে থাকলে তবেই না ভাল লাগে। তা কনকের মুখে সেই স্নিগ্ধ সৌন্দর্যটি রয়েছে। সে চঞ্চল নয়, চপল নয়, কিন্তু লাবণ্যময়।
নীলমণি আরও একটি জিনিস লক্ষ করেছে। ইন্দুমাসির সঙ্গে শেষের দিকে তার মেয়ের যা সম্পর্ক দাঁড়িয়েছিল তাতে কনক দিন দিন কঠিন, অত্যন্ত গম্ভীর, একা একা হয়ে উঠেছিল। মাসি মারা যাবার পর কনকের সেই অবস্থাটি পালটাতে শুরু করে। এখানে আসার পর কনক যেন কত পালটে গিয়েছে। তার ক্ষোভ নেই, বিরক্তি নেই, উদ্বেগ নেই। সে সহজ স্বাভাবিক। পরিশ্রমই কম করে না এখানে। নিত্যদিনের কাজকর্ম তো আছেই—তার ওপর রয়েছে নীলমণির কাজে হাত লাগানো, গাছগাছড়া শেকড়বাকড় এটিসেটি নিয়ে যারা আসে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা, দামদস্তুর করে টাকাপয়সা মেটানো। মাধবের সঙ্গে কনকের একটা গোপন শলাপরামর্শও হয়—ওষুধপত্রের বেচাকেনার দাম নিয়ে—নীলমণি সেটা বুঝতে পারে। কিন্তু কনক বা মাধব তাকে এই পরামর্শের মধ্যে ডাকতে চায় না। বংশী আর তার বউও কনকের কথাতেই চলে; এই যে নীলু ঠাকুরের আখড়াটি এমন পরিচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে—তার যেটুকু শ্রী—সবই কনক আর বংশীর দৌলতে।
নীলমণি কনককে নিয়ে আর ভাবে না। নিজের মতনই থাকুক কনক, স্বস্তিতে থাকুক—নীলমণি তাকে আর উত্যক্ত করবে না। বয়েসও তো কম হল না কনকের। তিরিশ ছাড়িয়ে গেল।
ব্যাগ গোছানো হয়ে গিয়েছিল কনকের।
নীলমণি বলল, ”আমাদের সঙ্গে এ-খেলাটি কে খেলল বলো তো?” বলে হাসল।
কনক বলল, ”আমারও মাথায় আসছে না।”
”তা যেই খেলুক, সে গেল কোথায়? আসবে কবে?”
কনক জায়গামতন ব্যাগটি রেখে দিল। দিয়ে বলল, ”আসবে কাল পরশুর মধ্যেই। জিনিস ফেলে গেল, না এসে যাবে কোথায়?”
নীলমণি মাথা নাড়ল।
কনক আর দাঁড়াল না, চলে গেল।
কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থাকার পর নীলমণি যেন সামান্য পায়চারি করল। তারপর এগিয়ে গিয়ে কাঠের তাক থেকে একটি বই টেনে নিল। পড়বে কিছুক্ষণ।
চার
তখন ভাল করে রোদ ওঠেনি, ‘কুসুম-ভোর’। আকাশ যেন সদ্য ঘুমভাঙা চোখ মেলছে। চারপাশ কুয়াশা জড়ানো; ঘাস লতাপাতা হিমে ভিজে রয়েছে, কার গলা বুঝি নীলমণির ঘুম ভাঙিয়ে দিল।
ঘুমভাঙা আলস্যের মধ্যেই নীলমণি শুনল কে যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গাইছে—’ফুটেছে কমলকলি, আপনি এসে জুটলো অলি। সে কেন শুনবে মানা, মিছে তাকে বলাবলি। ফুটেছে কলমকলি….’
নীলমণির ঘোর ভেঙে গেল। কার গলা! কে গাইছে? ইন্দ্রদা না? ইন্দ্রদা!
স্বপ্ন দেখছে না তো নীলমণি!
বিছানায় উঠে বসল সে। গান আরও স্পষ্ট, আরও জোর; ‘ফুটেছে কমলকলি, আপনি এসে জুটলো অলি…’
ইন্দরদা! এ-গান সে-ই শুধু গায়।
নীলমণি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে জানলার কাছে গেল। দুটি জানলার কোনোটাই এখনও পুরোপুরি খুলে রাখা যায় না। মাঝরাতে জঙ্গলের শীত আর হাওয়া এসে শরীর কনকনিয়ে দেয়। একটা জানলার সামান্য খোলা থাকে।
গায়ে চাদর জড়াতে জড়াতে নীলমণি জানলার পাট খুলে দিল। ওই তো ইন্দ্রদা। বারান্দায় উঠে পড়েছে। গান গাইছে চেঁচিয়ে : ‘যারে যে ভালবাসে সে যায় তার পাশে। জেনো লো প্রেম যেখানে, সেখানে ঢলাঢলি। …ফুটেছে কমলকলি…।’
ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল নীলমণি। ”ইন্দরদা!”
ইন্দ্র তখনও গান থামায়নি। বরং আরও জোরে গাইতে লাগল : ‘যারে যে ভালবাসে সে যায় তার পাশে। জেনো লো প্রেম যেখানে, সেখানে ঢলাঢলি…’
নীলমণি হাসতে লাগল। বিচিত্র বেশ ইন্দ্রর। পরনে এক মোটা পাজামা, গায়ে খদ্দরের পুরু পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির ওপর করকরে এক জহরকোট, মাথায় টুপি, গলায় মাফলার, একটা বেয়াড়া রঙের গরম চাদরে গা-কোমর জড়ানো। পায়ে মোজা আর কাপড়ের মোটা জুতো। কাঁধে মোটাসোটা ঝোলা। বগলে এক কম্বল। বান্ডিল করা।
নীলমণি এগিয়ে এসে হাসতে হাসতে বলল, ”গান থামাও তো! সাতসকালে হচ্ছেটা কী?”
ততক্ষণে কনকও তার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। বাসী কাপড়, সামান্য এলোমেলো, গায়ে চাদর। চাদরে মাথার খানিকটা ঢাকা। কপালে গালে চুলের গুচ্ছ।
ইন্দ্র দু’পলক দেখল কনককে। তারপর হেসে কিছুটা পিঠ নুইয়ে মাথা নিচু করে যেন যাত্রার কায়দায় কুর্নিশ জানাল। গান গেয়ে গেয়ে বলল, ”ফুটলো কমলকলি, আপনি এসে জুটলো অলি। আহা এই ভোরে কনকবালার মুখটি দেখে প্রাণটি ভরে গেল।”
কনক হেসে ফেলল।
নীলমণি বলল, ”মজাটি তবে তুমিই করেছিলে?”
”আমি তো মজারই লোক। নিজে মজি অপরকে মজাই। তুমি কোন মজাটির কথা বলছ নীলুবাবু?”
”ব্যাগটি স্টেশনে ফেলে দিয়ে গেলে?”
ইন্দ্র তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল নীলমণিকে। ”ব্যাগ! কই না! আমি তো ফেলে যাইনি কিছু।”
নীলমণিও অবাক। ”তুমি ফেলে যাওনি?”
মাথা নাড়ল ইন্দ্র।
”তোমার জিনিসপত্র কই?”
কাঁধের ঝোলাটি দেখাল ইন্দ্র, আর বগলের কম্বলটি। কম্বলটি গুটিয়ে পাট করা, দড়ি দিয়ে বাঁধা।
নীলমণি বলল, ”তুমি নও! তা হলে…? আশ্চর্য!” বলে কনকের দিকে তাকাল।
ইন্দ্র বলল, ”হয়েছেটা কী?”
নীলমণি বলল, ”কে একজন স্টেশনে তার ব্যাগ রেখে দিয়ে গিয়েছে। বলেছে এখানে পৌঁছে দিতে। স্টেশনের মাস্টারবাবু কাল ব্যাগটা পাঠিয়ে দিয়েছেন। ….কার ব্যাগ বুঝতে পারছি না। হুট করে তুমি এসে হাজির হলে ভাবলাম তোমারই ব্যাগ। আমাদের সঙ্গে বুঝি মজা করছিলে!”
ইন্দ্র কনকের দিকে তাকাল। বলল, ”ছোট জিনিস ফেলে যাবার পাত্তর আমি নই গো নীলুবাবু! ফেলেই যদি যাব, বড় জিনিস রেখে যাব, না কি গো কনকবালা!”
কনক হাসল। বলল, ”তা হঠাৎ বুঝি আমাদের মনে পড়ল?”
”কথাটি তুমি বললে ঠিকই, তবে আমার একটি জবাব আছে। এই যে আকাশটি দেখছ, এর মধ্যেও একটি হঠাৎ থাকে। হঠাৎ মেঘ হয়, মেঘ ডাকে, বৃষ্টি নামে; আমার হঠাৎটিও তেমন, ছিল সবই, হুট করে চলে এলুম।”
নীলমণি হাসতে হাসতে বলল, ”তা তোমার ঝোলাটি, বগলের কম্বলটি নামাবে, না, দাঁড়িয়ে থাকবে ঠায়?”
ইন্দ্র বগল থেকে কম্বলের বান্ডিলটি নামাল। নীলমণি হাত বাড়িয়ে নিল সেটি।
”ইন্দরদা, তুমি কি পথ ভুলে চলে এলে?”
ইন্দ্র তার কাঁধ থেকে ঝোলাটি নামাচ্ছিল। এটিও ব্যাগের মতন দেখতে। মোটা কাপড়ের। মোটামুটি ভারী। ঝোলা নামাতে নামাতে ইন্দ্র বলল, ”পথ ভুলে নয় নীলুবাবু, পথ খুঁজে। কদিন আগে ব্যান্ডেল স্টেশনে সুখময়বাবুর সঙ্গে দেখা। গাড়ি আর আসে না। দুজনে ছিলাম অনেকক্ষণ। তিনি বললেন, তুমি এখন দিব্যি এক আশ্রম বানিয়েছ! মনোহর আশ্রম। গাছ লতাপাতা ফুল পাখি, বনজঙ্গল নদী…, জায়গাটিতে এলে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। …তারপর শুনলাম তোমার এই আশ্রমটিতে দোলের সময় উৎসব হয়। রাধাকৃষ্ণর মন্দির বানিয়েছ নাকি নীলুবাবু?” হাসতে হাসতে মজার গলায় বলছিল ইন্দ্র।
নীলমণি হেসে বলল, ”না, মন্দির নেই। এখন পর্যন্ত শখ হয়নি বানাবার। এই সময়ে এখানে এসে থিতু হলাম। জায়গাটি বড় ভাল। বসন্তকালে চারদিকে রঙ ধরে যায়। দু’একজনকে হাতেপায়ে ধরে ডাকলাম। তারা এল। তারপর ওই—দু’চারটি দিন বন্ধুবান্ধবে মিশে হইরই হয়। ভাল লাগে।”
ইন্দ্র বলল, ”তা ভাল। বেশ করেছ!…আমি কিন্তু উৎসব করতে আসিনি। এসেছি আমার কমলকলিটিকে দেখতে।” বলে কনকের দিকে তাকিয়ে হাসল। ”ফুটলো কমলকলি, আপনি এসে জুটল অলি। …সুখময় বললেন, কলিটি এখন পুরোপুরি ফুটে গিয়েছে…”
কথা থামিয়ে কনক রগড় করে বলল, ”গন্ধ পেয়েছে নাকি?”
”গন্ধে কি যায় আসে! যারে যে ভালবাসে সে যায় তার পাশে। জেনো লো প্রেম যেখানে সেখানে ঢলাঢলি।”
নীলমণি হেসে উঠল জোরে। কনকও।
ইন্দ্র কনককে বলল, ”দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ ভালবাসার কথা বলব, কনক। রাতের গাড়ি, মাঝরাতে স্টেশনে নেমেছি। কুকুরকুণ্ডলী পাকিয়ে বসেছিলাম স্টেশনে। কী শীত! ভোর ফুটতেই হাঁটা শুরু করলাম। তা নীলমণিবাবুর নামডাক ভালই হয়েছে। স্টেশনের খালাসি আর চা-অলা বলে দিল ঠাকুরের আখড়াটি কোথায়! আমার কোনো অসুবিধে হয়নি। হাঁটাপথে সোজা নীলুঠাকুরের আখড়ায়। …এখন যে আর শরীর বইছে না। হাত-মুখটি ধুই। একটু চা-মুড়ি খাওয়াও কনকসখি!”
কনক আর দাঁড়াল না। রোদ উঠে আসছে। বংশীর বউ সুবলা কুয়াতলায় এসেছে জল তুলতে। সুবলাকেই বলবে কনক উনুনটা ধরিয়ে দিতে। উনুন ধরতে ধরতে কনকের বাসী কাপড়চোপড় ছাড়া হয়ে যাবে।
নীলমণি বলল, ”এসো ইন্দরদা। ঘরে চলো।”
”ঘরে নয় হে। একটু রোদে দাঁড়াই। বেশ লাগছে। গায়ের শীতটুকু রোদে শুকিয়ে নিই।”
নীলমণি বলল, ”তা দাঁড়াও। তোমার জিনিসগুলো ঘরে রেখে দিই।”
ইন্দ্রর ঝোলা আর কম্বলের পুঁটলি নিয়ে নীলমণি ঘরে গেল জিনিসগুলো রাখতে। ইন্দ্র মাঠে নেমে গেল। রোদের মধ্যে পায়চারি করতে করতে সে যেন জায়গাটা ভাল করে দেখছিল। মাঠ ঘাস, লতাপাতা, ফুলের গাছ, সবজিবাগান, লম্বামতন একচালা, বংশীর ঘর। দেখতে দেখতে পেয়ারাগাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আকাশ ততক্ষণে রোদে ভরে এল, সূর্যটি নরম অথচ উজ্জ্বল। পাখি উড়ে যাচ্ছে, চড়ুইয়ের দল গাঁদাফুলের ঝোপের পাশে ঝাঁক বেঁধে নামল, আবার উড়ে গেল। প্রজাপতি উড়ছে ফুলের বাগানে। পাখি ডাকছিল।
ইন্দ্র অন্যমনস্কভাবে পেয়ারাগাছের নিচু ডাল দুলিয়ে যেন একটু খেলা করল। তারপর নিমগাছের দিকে তাকল। নিমগাছটি কচি। দাঁতনের কাঠি নেবার জন্য গাছের দিকে এগিয়ে গেল।
বেলার দিকে বারান্দায় বসে নীলমণি আর ইন্দ্র কথা বলছিল। মাধবের লোক দুটি এসে গিয়েছে। মাঠ পরিষ্কার করছিল। শীতের সময় মরা ঘাস কোথাও কোথাও শুকিয়ে মাটি যেন। সামান্য পরিষ্কার না করে দিলে সবুজ ঘাস গজাতে দেরি হবে। রুক্ষ জমি-মাটি শক্ত। শুকনো পাতা জড়ো করছিল বংশী। সকালের দিকটা তার বাগান নিয়ে কেটে যায়। বিকেলে সুবলাকে নিয়ে জল দেয় বাগানে। বংশীর ছেলেটা খেলা করছে মাঠে।
ইন্দ্র নিজেই বলল, তার সামান্য কাজও ছিল এদিকে। জ্ঞাতিগোষ্ঠীদের শরিকী মামলা মোকদ্দমা। ইন্দ্রর সইসাবুদের দরকার ছিল। ঝঞ্ঝাট মিটিয়ে হাত ধুয়ে সে চলে এসেছে। আসার ইচ্ছে অনেকদিন ধরেই, মাঝে মাঝে এর ওর মুখে ভাসাভাসা খবর পায় নীলমণিদের। কিন্তু সঠিকভাবে কিছু জানত না। সুখময়ের সঙ্গে দেখা হবার পর সব জানতে পারল। তখন থেকেই ইন্দ্র ঠিক করে নিয়েছিল—সে এখানে আসবে।
নীলমণি বলল, ”কত দিন পরে দেখা হল, ইন্দরদা?”
”বছর তিনেক পর। তোমরা এখানে আসার আগে দেখা হয়েছিল। কথাও হয়েছিল।”
”তুমি বারণ করেছিল আসতে। বলেছিলে, জায়গা পালটালেই কি ভাল লাগবে! নতুন জায়গাতে মানাতে পারব কী? ….আমি কিন্তু ভাল আছি ইন্দরদা।”
”দেখছি তাই।” …ক মুহূর্ত থেমে বলল, ”কনক?”
নীলমণি তাকাল। বলল, ”খারাপ দেখলে?”
ইন্দ্র সিগারেট খায়। সিগারেট বিড়ি যা জোটে। পকেটে সিগারেট ছিল। সস্তা সিগারেট। ধীরেসুস্থে সিগারেট ধরিয়ে ইন্দ্র বলল, ”দেখা আর হল কই! দুটো দিন দেখি।”
”তুমি থাকবে তো। দোল পর্যন্ত?”
”মন বসলে থাকব, না বসলে চলে যাব। ধরে নাও থাকব।” ইন্দ্র বলল।
”তুমি থেকে যাও। আমাদের খুব ভাল লাগবে।”
পাঁচ
দুটি দিন থাকা হয়ে গেল ইন্দ্রর। মানুষটি সত্যিই মজার। নীলমণি আর কনকের দিন কাটত নিজেদের মতন করে। নিরিবিলিতে। শান্ত, সরলভাবে। ইন্দ্র আসার পর কেমন এক সাড়া জাগল। ইন্দ্র হাসছে হো হো করে, হাসছে তো হাসছেই, ওর হাসি যেন থামতে চায় না। গল্পও জানে বটে মানুষটা—কতরকম গল্প, বলতেও পারে রসিয়ে। ছোট কথাই কেমন বড় হয়ে যায়। আর গান! ইন্দ্রর যে কত গান জানা আছে কে জানে! কেমন করে এসব গান জানল সে বোঝাই যায় না। এটা অবশ্য ইন্দ্রর বরাবরের গুণ।
দু দিনেই মাধব ভক্ত হয়ে উঠল ইন্দ্রর। এখন সে নিত্য আসছে। চালা মেরামতের লোক আনল এবেলা তো অন্য বেলায় চাল ডালের বস্তা আনল গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে। সে গাড়িও সেরকম, ককিয়ে ককিয়ে চলে, গোরু দুটো পাঁজরা-সার। আর মাত্র দিন পাঁচেক পরে পূর্ণিমা। ব্যবস্থা না সেরে রাখলে হয়!
মাধব আসত আর ইন্দ্রর সঙ্গে মজে যেত। ইন্দ্রকে ‘মহারাজ’ বলে ডাকতে শুরু করে দিল।
ছেলেমানুষিও আছে ইন্দ্রর। মাধবকে বলল, ও মাধবচন্দর—দুটি লাল নীল সবুজ কাগজ আনতে পার না! পতাকা হবে, শিকলি হবে, তোমার নীলুঠাকুরের আখড়াটি সাজানো হবে হে!
মাধব বলল, এ এমন কী কথা! কালই আনব! বলেন যদি হ্যাজাক মেজাকও আনতে পারি। রাত্তিরে জ্বলবে দু’চার ঘণ্টা।
ইন্দ্র মাথা নাড়ল। বলল, এবারটায় থাক। আসছে বছর দেখা যাবে। এবারে পতাকা আর শিকলি হোক।
নীলমণি খুশি হল। ইন্দ্রদা তা হলে থেকে যাচ্ছে দোল পর্যন্ত। ও যা মানুষ, এই আছে, তার পরই নেই।
ইন্দ্র আছে বলেই নীলমণির এই জায়গাটি আরও সাফসুফ, ঝকমকে হয়ে উঠতে লাগল। যতক্ষণ মাধব আছে হাত গুটিয়ে বসে থাকে না ইন্দ্র। এটা সেটা করে।
কনক হেসে বলল, ”তুমিও কি আখড়ার মানুষ হলে?”
ইন্দ্র বলল, ”মানুষ হলাম না চোর হলাম কে বলতে পারে?”
”মানেটি বুঝলাম না।”
”নামটি আমার ইন্দ্র। গৌতমমুনির আশ্রমে গিয়ে যে-কাজটি সে করেছিল—তুমি তো জান গো কনকবালা!”
কনক হেসে বলল, ”সে কাজটি তুমি পারবে না। তোমায় যে গৌতমের বেশ ধরতে হবে। সে মন্ত্রটি তোমার জানা নেই।”
ইন্দ্র যেন সায় দিয়ে মাথা নাড়তে লাগল। বলল, ”ঠিক কথা। যথার্থ কথা। দেবতাদের ভেলকি কি মানুষ জানে! তবে আমি বলি কী কনকসখি, বেশ ধরার কথাটি হেঁয়ালি। গৌতমমুনির বউটি মুনিবাবাজীর তপস্যা আর দাড়িগোঁফ জটা দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল। দেবরাজ ইন্দ্রমশাই যখন সামনে এসে দাঁড়ালেন, বেচারি অহল্যার ভেতরটি ছটফট করে উঠল। তা মুনির বউ বলে কথা, স্বর্গের অপ্সরা তো নয় যে দেবরাজকে এসো প্রাণেশ্বর বলে দু হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকবে। ডাকটি ঠিকই ছিল। রামায়ণটি পড়ে দেখো। গৌতমবেশধারী ইন্দ্রকে চিনতে পেরেও অহল্যা তাকে বাধা দেয়নি। নিজের সম্মতি জানিয়েছিল। তারপর মনপ্রাণ দেহটি জুড়িয়ে গেলে শশব্যস্ত হয়ে বলেছিল, আমি কৃতার্থ হয়েছি সুরশ্রেষ্ঠ। ‘কৃতার্থাস্মি সুরশ্রেষ্ঠ গচ্ছ শীঘ্রমিতঃ প্রভো’—মানে, এবার আপনি পালিয়ে যান মশাই, নিজেকে এবং আমাকে গৌতমের ক্রোধ থেকে রক্ষা করুন।”
কনক শুধু হাসে।
ইন্দ্র বলল, ”অহল্যা কথাটির মানে জান? জান না? যার কোনো পাপ নেই সে হল অ-হল্যা। তা যার অমন পাপটি থাকল সে অহল্যা হল কেমন করে? পাপটি তার ছিল। মানুষের দেহটির তলায় পাপ না থাকলে সেটি জীবন হয় না। শিশু বয়সের দেহে আর মৃত মানুষের দেহটিতেই শুধু পাপ থাকে না, কেননা তাতে তার নিজের জীবনটি নেই। ভগবানের এইটেই লীলা।
ইন্দ্র হাসতে থাকে। কনক কিছু বলে না। এত তত্বকথায় তার কী দরকার।
মাধব কাগজ আনল রঙিন। লাল নীল সবুজ হলুদ।
ইন্দ্র যেন ছেলেমানুষ। মাধবেরও শখ কম নয়। রঙিন কাগজের পতাকা হচ্ছে, শিকলি হচ্ছে। বংশীর ছেলেটা ঠায় বসে থাকে, কখনো বা রঙিন কাগজের টুকরো নিয়ে ছোটাছুটি করে মাঠে বাগানে। কনককেও মাঝে মাঝে এসে বসতে হয় ইন্দ্রর হাঁকডাকে, কাগজ কাটতে হয় কাঁচি দিয়ে, লেই তৈরি করে দিতে হয়।
এমন সময় এক সন্ধেবেলায় আরও একজনের আবির্ভাব ঘটল।
নীলমণি বুঝি আশাই করেনি, স্বপ্নেও নয়, তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে হাত ধরল, ”তিলক। তিলক—তুই?”
ইন্দ্র কাছেই ছিল। মাধবও। মাধব আজকাল সন্ধে উতরে না যাওয়া পর্যন্ত নড়ে না। তার সাইকেলে আলো লাগিয়ে নিয়েছে। চেনা রাস্তা ধরে চলে যেতে অসুবিধে হয় না তার। নীলুঠাকুরের চেয়েও এখন তার বড় আকর্ষণ ইন্দ্র। ইন্দ্রর গল্প আর গান শুনতে শুনতে মাধব যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়।
ইন্দ্র আর মাধব দু’জনেই তিলকের দিকে তাকাল।
নীলমণি তিলকের হাত ধরে টানছে। ”আয়—আয়—”, দরজার কাছ থেকে টানতে টানতে ভেতরে আনল তিলককে। ”তুই কেমন করে এলি? কে তোকে আমার কথা বলল! আমাকে তুই অবাক করলি! স্বপ্নেও ভাবিনি…আশ্চর্য!”
ঘরের মধ্যে লণ্ঠন জ্বলছিল।
তিলক কিছুক্ষণ যেন নীলমণিকেই দেখল। তারপর ইন্দ্র আর মাধবকে। একটু হাসল।
নীলমণি ইন্দ্রকে বলল, ”ইন্দরদা, আমার বন্ধু তিলক। আমরা বলতাম রাজতিলক। ওর কপালে দাগটা দেখছ না!” বলে হাসতে লাগল। আবার বলল, ”আমার স্কুলের বন্ধু। পরেও বন্ধুত্ব ছিল। বাড়িতে আসত যেত। তারপর বেপাত্তা!” বলে তিলকের দিকে তাকাল। ”ইন্দরদা। আর ও হল মাধব।
ইন্দ্র বলল, ”নামটি যেন শুনেছি নীলুবাবুর মুখে। তা ভালই হল।”
নীলমণি তিলককে বলল, ”তুই এলি কেমন করে? কে তোকে আমার কথা বলল?”
তিলক বলল, ”বেণুবউদি। বেণুবউদি এখানে আসে…..।”
নীলমণি মাথা নাড়ল। বেণুদিদি রায়দার স্ত্রী। পর পর দু বছরই এসেছে দোলের সময়। এবারও আসার কথা। রায়দা আর বেণুদিদি যেন টাকার এ-পিঠ ও-পিঠ। নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ দু’জন। বাচ্চাকাচ্চা নেই। ভেতরে ক্ষোভ থাকলে বাইরে তা চোখে পড়ে না। দু’জনেই চাকরি করে। আর ছুটিছাটায় ঘুরে বেড়ায়। ওদের চিঠিপত্রও কখনো কখনো পায় নীলমণি। বেণুদিদি কনককেও এক আধটা চিঠি লেখে দু’চার মাস অন্তর।
কনককে ডাকতে হবে। নীলমণি কনককে ডাকতেই বাইরে যাচ্ছিল, থেমে গিয়ে তিলককে বলল, ”তুই নিজে নিজেই চিনতে পারলি?”
”চিনব না কেন? সহজ ব্যাপার। …এই লাইন দিয়ে আমিও আগে গিয়েছি কতবার!”
”ও! তা হলে তুই?”
”আমি? কী আমি!” তিলক তাকাল। বুঝতে পারছিল না।
নীলমণি হাসতে হাসতে বলল, ”তা হলে তুই-ই ব্যাগটা ফেলে গিয়েছিস! মজা করছিলি আমাদের সঙ্গে।” বলতে বলতে সে তিলকের চশমার দিকে তাকাল।
তিলক বেশ অবাক হল। ”ব্যাগ? কিসের ব্যাগ?”
নীলমণিও ধোঁকা খেয়ে গেল। ”তুমি সেদিন একটা ব্যাগ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ফেলে দিয়ে যাসনি! বলেছিলি—এখানে পৌঁছে দিতে, তুই ঘুরে আসছিস?”
তিলক যেন ধরতেই পারছিল না নীলমণি কী বলছে! বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক পলক। ”বুঝতে পারলাম না কী বলছিস?”
নীলমণিও হতবুদ্ধি। মাধবের দিকে তাকাল। মাধবই স্টেশন থেকে বয়ে এনেছিল ব্যাগটা। ”মাধব, কী ব্যাপার বলো দেখি! তিলকও বলছে ব্যাগ সে ফেলে যায়নি। তবে কি মাস্টারবাবু ভুল বললেন?”
মাধব জোরে জোরে মাথা নাড়ল। বল, ”না। মাস্টারবাবুকে স্টেশনের কুলি যা বলেছে—তিনি তাই বলেছেন। মাস্টারবাবুর কাছে আমি খোঁজ নিয়েছি, ঠাকুর।”
তিলক বলল, ”হয়েছে কী!”
নীলমণিই বলল যা ঘটেছে। তারপর বলল, ”আশ্চর্য ব্যাপার তো! ব্যাগটা ইন্দরদার নয়, তোরও নয়। তবে কার?”
তিলক হাসতে হাসতে বলল, ”আমার মোট আমি একটা লোককে দিয়ে বইয়ে এনেছি। এখনও সে দাঁড়িয়ে আছে। পয়সা মেটানো হয়নি। দাঁড়া পয়সা মিটিয়ে দিয়ে আসি।” বলে তিলক ঘরের বাইরে গেল।
নীলমণি বলল, ”ইন্দরদা, এ কেমন ভূতুড়ে ব্যাপার হল?”
ইন্দ্র হেসে বলল, ”তোমার অতিথিরা সবাই তো আসেনি এখনও। দেখোই না শেষ পর্যন্ত যার জিনিস সে নিজেই খোঁজ নিতে আসবে!”
নীলমণি কী বলতে যাচ্ছিল, ইন্দ্র বাধা দিল। বলল, ”আমরা তো উটকো লোক। যারা আসে বরাবর তারা আসুক। তারপর বোঝা যাবে।”
নীলমণি আর দাঁড়াল না, কনককে ডাকতে গেল।
ইন্দ্র একটা সিগারেট ধরাল ধীরেসুস্থে। বারান্দায় তিলকের গলা। ইন্দ্র বলল, ”মাধবচন্দর, তুমি বাপু জিনিসটি খাওয়ালে না! কতরকম জল আছে জান? বৃষ্টির জল, নদীর জল, ডাবের জল আর গঙ্গাজল!”
”আজ্ঞে, গঙ্গাও তো নদী! সে জল এখানে পাই কোথায়?”
”গঙ্গার আরেক নাম সুরধুনী। ধুনীটি আমার দরকার নেই হে। শুধু সুরা একটু হোক। আজ বাদে কাল ভদ্দরলোকেরা চলে আসবেন। মেয়েরা আসবেন। তার আগে বাপু দিশিগঙ্গা নিয়ে এসো এক আধ বোতল। দুই ভাইয়ে মিলে জুত করে খাই। তবে তোমার নীলুঠাকুরের আখড়ার বাইরে গিয়ে। কেমন?”
মাধব হাসতে লাগল।
ইন্দ্র বলল, ”আর একটি জলের কথা বলতে ভুলে গেছি। সেটি অশ্রু-জল। কে জানে—সেটিও দেখব কি না!”
ছয়
সামান্য রাত হয়ে এসেছিল।
ইন্দ্র এসে ডাকল, ”কনক?”
ঘরেই ছিল কনক। নীলমণির ঘরের গায়ে ছোটমতন এক বাড়তি ঘর। তার পরেই কনকের ঘর। টানা বারান্দার ওপাশে রান্না-ভাঁড়ার।
ঘর থেকে বেরিয়ে এল কনক।
”কী করছিলে?” ইন্দ্র বলল।
”এমনি একটু শুয়েছিলাম!”
”তোমার খাটুনি বেড়ে যাচ্ছে….”
”না। এ আর কী!… সবাই এসে পড়লে খাটুনি বাড়ে। তেমন আবার লোকও থাকে—লীলাদিরা…।”
”তা হলে এসো বাইরে পায়চারি করি খানিক।”
বাইরে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে রয়েছে। আজ দ্বাদশী তিথি। দু’দিন পরেই পূর্ণিমা। আকাশ পরিষ্কার। চাঁদের আলোয় ধোয়া। সামনের মাঠে বাগানে ঈষৎ কুয়াশা জড়ানো কিরণ ঝরে পড়ছে যেন আকাশ থেকে।
কনক বলল, ”তুমি উঠে এলে?”
”ওরা ওদের গল্প করছে। মাধব চলে গেছে অনেকক্ষণ। নীলুদের কথার মধ্যে বসে থেকে কী করব! চলে এলাম।”
কনক বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, ”এখনও ঠাণ্ডা আছে অল্প। তুমি আবার ঠাণ্ডা লাগিয়ে বসবে বাইরে ঘুরলে!”
মাথা নাড়ল ইন্দ্র। হেসে বলল, ”না গো কনকবালা, এ হল কুলিমজুরের শরীর, গরিব মানুষের। তোমাদের মতন আরামের দেহ নয়।”
কনকও পালটা জবাব দিল, ”আমরা বনজঙ্গলে থাকি, দেহাতি মানুষ; আমাদের সবই সয়। তোমরা হলে শহুরে লোক। আসতে না আসতেই কাশি বাঁধিয়েছ।”
ইন্দ্র বলল, ”হাঁচি কাশি থাকবে না শরীরে, তবে আর মানুষের দেহ হল কেন গো কনকবালা!” বলে কনককে ডাকল, ”এসো।” বারান্দার সিঁড়ি পর্যন্ত এগুতে এগুতে আবার বলল, ”কাশির দোষ কী! তোমাদের ওই ধর্মশালাটির দুটি জানলা ভালমতন বন্ধ হল না। খুলে রেখে দিলাম। মাঝ আর শেষরাতের কনকনে হাওয়া লেগে গলাটি খসখস করতে লাগল। ও কিছু নয়। আজ ঠিক হয়ে গেছি।”
মাঠে নেমে কনক বলল, ”বর্ষার পর প্রত্যেকবার জানলাগুলো ওইরকম হয়। কাঁচা কাঠ, বুনো, এখনও ঠিক হল না। …তা এখন তো ঠিক করে দিয়েছে।”
মাথা হেলালো ইন্দ্র; দিয়েছে। লম্বামতন ঘরটিই এখানকার অতিথিশালা। ইন্দ্র ঠাট্টা করে বলে ধর্মশালা। ওই চালার তলাতেই থাকছে ইন্দ্র। অসুবিধা কিছু নেই। সরু তক্তাপোশের ওপর বিছানা। দড়ি-টাঙানো হয়েছে জামাকাপড় রাখার জন্যে।
ইন্দ্র বলল, ”আজ একজন সঙ্গী পাওয়া গেল! রাতটি কাটবে ভাল।”
”কে?” কনক বলল, অন্যমনস্কভাবেই।
”কে! সে কী! তোমাদের তিলকবাবু!”
”ও!…হ্যাঁ।”
ইন্দ্র ঠাট্টা করে বলল, ”একেই বলে কপাল, বুঝলে কনকসখি! প্রাণটি চেয়েছিল তোমাকে, সঙ্গিনীটিকে; এসে জুটল এক সঙ্গী। মনটি আমার হায় হায় করছে গো!”
কনক হেসে ফেলল।
মাঠ দিয়ে জ্যোৎস্নার মধ্যে হেঁটে যেতে যেতে ইন্দ্র গান করে বলল, ”অনুগত জনে কেন তুমি এত করো প্রবঞ্চনা/আমায় মারিলে মারিতে পার/রাখিলে কে করে মানা।”
কনক আর জোরে হাসছিল না। মুখে হাসি লেগেছিল।
হাঁটতে হাঁটতে কাঠের ছোট ফটক পর্যন্ত গেল ইন্দ্র। তারপর ওপাশ দিয়ে গাছতলার দিকে।
মরা শীতের বাতাস নয় বসন্তের বাতাসই আসছিল। তবু বাতাসের মধ্যে মৃদু শীতলতা রয়েছে।
কনক আবার চুপচাপ।
ইন্দ্র মাঝে মাঝে কনককে দেখছিল। তার মুখ। কনক চুপচাপ, অন্যমনস্ক।
”কনক?”
”উঁ?”
”এ-বেলায় তোমায় যেন কেমনটি দেখছি।”
কনক তাকাল। তার পরই মুখ ফিরিয়ে নিল। ”কেন?”
”সে-কথাটি তুমিই বলবে!”
”কই, আমি এ-বেলায় কেমনটি হলাম কখন?”
ইন্দ্র হালকা গলায় বলল, ”আমার প্রাণটিকে তুমি ফাঁকি দিতে পার, চোখ দুটিকে পার না।”
কনক চুপ করে থাকল। তার গায়ে হালকা রঙের শাড়ি জ্যোৎস্নায় প্রায় সাদাটে দেখাচ্ছে। মাথার খোঁপাটি ভেঙে পড়েছে ঘাড়ের কাছে। কনকের কাঁধ সামান্য চওড়া, ভরা।
ইন্দ্র যেন গল্পই করছে, সহজভাবে বলল, ”ওই তোমাদের রাজতিলকটি এসে পড়ে তোমায় মুশকিলে ফেলে দিয়েছে নাকি?”
তাকাল কনক। ”আমায়? কেন?”
”এমনি বলছি। মনে হল, তুমি ওকে দেখে আহ্লাদে গলে গেলে না!”
”বাঃ, আহ্লাদে গলবো কেন!”
”আমার বেলায় গলেছিলে—” ইন্দ্র কৌতুক করে বলল, ”আমায় দেখে তোমার কী মুখের চেহারা, যেন কমলকলিটি ভোরের রোদে হেসে উঠেছিল!”
কনক একটু হেসে বলল, ”তুমি যে কীসব বলো, ইন্দ্রদা!”
”যথার্থ কথাটি বলি। …তুমি আমার চোখ দুটিকে ঠকাতে চাইছ! …ওই রাজতিলককে দেখে তুমি খুশি হওনি।”
কনক কথা বলল না।
ইন্দ্র বলল, ”এতক্ষণ বসে বসে ওদের কথা শুনছিলাম। পুরনো গল্প করছে। ওরা কম বয়েসের বন্ধু, স্কুলটুল থেকে পড়ার সময় থেকে। তাই না?”
”হ্যাঁ।”
”একই জায়গায় থাকত। তিলকের বাবার নাকি পয়সাকড়িও ছিল যথেষ্ট।”
”ছিল। দুর্নামও ছিল।”
”কিসের দুর্নাম?”
”সব দিকের দুর্নাম ছিল। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বনিবনা হত না।”
”স্ত্রী?”
”মারা গিয়েছিল।”
”তুমি ওকে প্রথম থেকেই দেখেছ?”
”হ্যাঁ। মায়ের সঙ্গে ও-বাড়িতে আসার কিছুদিন পর থেকেই দেখেছি।”
ইন্দ্র হাঁটছিল। নিমগাছের ছায়া মাড়িয়ে গিয়ে দাঁড়াল এবার। বলল, ”ও নাকি হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে যায়?”
কনক সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। পরে বলল, ”সে ওদের বাড়ি আর পরিবার নিয়ে নানা গণ্ডগোল হচ্ছিল। মামলা মোকদ্দমা, থানা, বড় ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল, জেল হল তার, মেজ বোন বাপের বাড়িতে এসে আত্মহত্যা করল,…অনেক কাণ্ড! সেই সময় ও বাড়ি থেকে চলে যায়। বেপাত্তা কি না জানি না। চাকরি-বাকরি নিয়ে বাইরে চলে গেছে শুনেছিলাম। কেউ বলত চা-বাগানে, কেউ বলত আন্দামানে। …আমি জানি না।”
”শুনলাম আন্দামানে বেশ ক’ বছর ছিল।”
”তা হবে।”
”চেহারাটি এখনও ভাল আছে। ভালই দেখতে।”
কনক হঠাৎ বলল, ”তুমি কী জানতে চাইছ ইন্দ্রদা?”
ইন্দ্র হেসে ফেলল। তারপর কনকের কাঁধে হাত দিয়ে কাছে টেনে নিল একটু। বলল, ”হিংসে আমার হবে গো কনকবালা! তবু আসল কথাটি বলো তো? তিলক কি তোমায় তার প্রেম নিবেদন করত?”
কনক কথা বলল না। ইন্দ্রর হাতও সরিয়ে দিল না কাঁধ থেকে। দশ বিশ পা হেঁটে এসে বলল, ”পুরনো কথা জেনে কী লাভ তোমার!”
”তবু শুনি!”
খানিকটা ইতস্তত করে কনক বলল, ”করতে চাইত অনেক কিছুই। মায়ের কাছে নানা কথা বলত। দু’বার আমায় বড় অপ্রস্তুতে ফেলেছিল। একদিন আমি ওকে মায়ের কাছে ধরে নিয়ে গিয়ে বলেছিলাম—ওর পকেটে হাত দিয়ে দেখতে। …এসব কথা আমার ভাল লাগছে না ইন্দ্রদা। শুধু একটা কথা তোমায় বলি।”
”বলো?”
”ও একদিন আমায় একটা সোনার হার দিতে এসেছিল। আমি নিইনি। …তখন ও আমায় টিটকিরি দিয়ে বলল, সময় থাকতে নিয়ে নাও, এরপর আর সোনা জুটবে না, পরে যে আসবে সে হয়ত রুপো দেবে। তোমার এই রূপ কদিন। মেয়েদের বয়েস বাড়লে দাম কমে যায়। শরীরে ভাটা নামলে আর তোমাদের জোয়ার আসে না। তোমারও আসবে না। …তা ছাড়া তোমার কোনো পরিচয় নেই। তুমি ভদ্রসমাজে জায়গা পাবে না।”
ইন্দ্র বলল, ”বুঝেছি। …তা তিলকবাবুটি কি এরপর বাড়ি ছাড়া?”
”তখনই নয়, পরে চলে গেল। ওদের বাড়িতে হাজার গণ্ডগোল। ভাইয়ে ভাইয়ে লাঠালাঠি, মেজো ভাই নেশাভাঙ করে বেড়াত। গাড়ি চাপা পড়ল। বেঁচে গেল প্রাণে, একটা পা বাদ দিতে হল।”
ইন্দ্র এবার কনককে নিয়ে ফিরতে লাগল। ফিরে আসতে আসতে বলল, ”তুমি কি ভাবছ, ওই তিলক নতুন করে তোমায় জ্বালাতে এসেছে?”
”আমার খারাপ লাগছে!”
”ক্ষমাঘেন্না করে দাও। দুটি তো দিন। তারপর ও চলে যাবে।”
কনক চুপ করেই থাকল।
গোটা মাঠ ঘুরে বাগান ঘুরে আবার কনকের ঘরের কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। বারান্দার তলায় দাঁড়িয়ে ইন্দ্র নীলমণির ঘরের দিকে তাকাল। আলো জ্বলছে ঘরে। দু বন্ধু গল্প করছে এখনও।
ইন্দ্র হঠাৎ বলল, ”কাল আবার কারা আসবে?”
”কাল! কাল হয়ত লীলাদিরা চলে আসবে।”
”কাল আর পরশু! তার পরই চাঁদের হাট বসে যাচ্ছে এখানে—” বলে হাসতে লাগল ইন্দ্র।
কনকও মাথা নাড়ল। কাল যারা আসতে না পারল পরশু সকালের গাড়িতে নিশ্চয় চলে আসছে।
”ইন্দ্রদা! তুমি কদিন থেকে যাও না।”
”থাকছি তো!”
”আমি বলছি, ভিড় ফাঁকা হয়ে যাবার পরও দু’চারদিন থেকে যাও। তোমার এমন কী কাজ!”
ইন্দ্র বলল, ”দু’চার দিনের কথা কেন বলছ! তুমি রাখলে বরাবরই থাকতে পারি। রাখিলে রাখিতে পার…” বলেই ইন্দ্র গান ধরল উঁচু গলায় : ”আমায় মারিলে মারিতে পার/রাখিলে কে করে মানা/অনুগতজনে কেন তুমি এত কর প্রবঞ্চনা/বিনা অপরাধে বধ, এ কি রে তোর বিবেচনা….”
গান গাইতে গাইতে বারান্দায় উঠল ইন্দ্র। কনকও।
নীলমণির ঘর থেকে বেরিয়ে এল দুই বন্ধু।
তিলক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল ইন্দ্র আর কনককে।
নীলমণি হাসতে হাসতে বলল, ”ইন্দরদা, কে তোমায় প্রবঞ্চনা করছে?”
হাসতে হাসতেই ইন্দ্র বলল, ”আমার ভাগ্য। আর ভালবাসার মানুষটি গো!”
কনক নিজের ঘরে চলে গেল।
কাছাকাছি এগিয়ে এসেছিল নীলমণি। বলল, ”তোমার এই গানটি কি ভালবাসার? না, দেহতত্বের?”
”এক ঢিলে দুই পাখি। যে যেমন ভাবে নেয়। তবে কি জান নীলুবাবু, ভালবাসার তত্বটি দেহ থেকেই আসে। মুশকিলটা কোথায় হয় জান? ভালবাসাটি যখন দেহ ভিন্ন আর কিছু দেখে না—তখন সেটি কাঁচা ভালবাসা। যেমন সোনাটি। ওটি তুমি দেহে রাখো, দেখাবে ভাল। কনককে তাই বলছিলাম—সোনাটি রূপোটি দেহের বাইরে থাকে। এটি শোভা। অন্তরে প্রাণে কি সেকরার সোনা রাখা যায় গো! সেখানে অন্য সোনা।”
ইন্দ্র হাসছিল মাথা দুলিয়ে।
তিলক দেখছিল ইন্দ্রকে।
সাত
দোলের আগের দিনই নীলমণির অতিথিশালাটি ভরে গেল। বলরামবাবু যেন শোভাযাত্রা করে হাজির হলেন সকালের গাড়িতে, তিনি আর তাঁর গৃহিণী লীলাদির সঙ্গে দুটি নতুন মানুষ—লীলাদির ভাইবোন। মতিলাল বলে এক বন্ধুও। দুদিনের জন্যে আসা—তবু জিনিসপত্রের পাহাড় বয়ে এনেছেন যেন। নিজেদের মোটঘাট তো আছেই তার সঙ্গে বাড়তি কিছু, নীলমণিদের জন্যে। লীলাদি যখনই আসেন কনকের জন্য এটিসেটি নিয়ে আসেন। কোনোটা কনকের ব্যক্তিগত, কোনোটা বা তার সংসারে কাজে লাগবে বলে।
সন্ধের গাড়িতে এল রায়বাবুরা। কর্তা গিন্নি। এল শিতিকণ্ঠ। মাধুরী এবার এসেছে তার এক ভাইকে সঙ্গে করে, আবিরলাল। কম বয়েসী ছেলে, দেখতে সুন্দর, মেয়েদের মতন এক মাথা চুল, গলায় হার। ডান হাতে লোহার বালা। ছেলেটা কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে এসেছে। ছবি তোলার শখ।
শিতিকণ্ঠ কল্পনাও করেনি এখানে এসে সে ইন্দ্রকে দেখতে পারে। অবাক হয়ে গেল। ”আরে ইন্দ্রদা, তুমি? তুমিও এসেছ!” ইন্দ্র বলল, ”এসে পড়লাম। দেখতে এলাম নীলুবাবু কেমন আখড়া বানিয়েছে। যা দিনকাল—শেষ পর্যন্ত এখানে এসেই না মালা জপতে হয়।”
শিতিকণ্ঠ বলল, ”সত্যি ইন্দ্রদা, নীলু তো জায়গাটি দিব্যি করে ফেলেছে।”
নীলমণির জায়গাটি বেশ দেখাচ্ছিল। মাধব আর ইন্দ্র মিলে রঙিন কাগজের পতাকা টাঙিয়েছে দিনের বেলায়। কাগজ টাঙিয়েও যেন শখ মেটেনি মাধবের, দেবদারু গাছের পাতাও টাঙিয়েছে দড়ি বেঁধে, কিছু ফুল। রঙিন কাগজগুলো আজ হয়ত সারা রাতের হিমে ভিজবে। ভিজুক। কাল শুকিয়ে যাবে চড়া রোদে।
বলরামবাবুও খুশি। ইন্দ্রর সঙ্গে পরিচয় ছিল না। পরিচয় হল।
লীলাদিদি এসে পর্যন্ত কোমরে আঁচল জড়িয়ে বসে পড়েছেন কাজে। হাত-মুখে জল দিয়ে ট্রেনের কাপড়চোপড় বদলে সেই যে বসেছেন—আর ওঠবার নাম নেই।
নীলমণিও তার অতিথিদের নিয়ে ব্যস্ত। কনক বসেছে লীলাদিদির সঙ্গে—রান্নাবান্না নিয়ে, মাধুরীও হাত লাগিয়েছে। বেণুবউদি অতিথিশালা নিয়ে ব্যস্ত।
শিতিকণ্ঠ আসতেই নীলমণি তাকে ধরেছিল। ব্যাগের কথা জিজ্ঞেস করল।
শিতিকণ্ঠ অবাক হয়ে বলল, ”তোমার মাথা খারাপ! আমি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ব্যাগ ফেলে রেখে চলে যাব! সে-মানুষ আমি নই। এ-রকম মজা আমি করি না।”
”আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তুমি?”
মাথা নাড়ল শিতিকণ্ঠ। ”না ভাই, আমি নই। সংসারী মানুষ এখন, চালাক চতুর হতে হয়েছে। ….দেখো—অন্য কার; আমার নয়—এটুকু বলতে পারি।”
শিতিকণ্ঠর নয়, ইন্দ্রর নয়, তিলকেরও নয়। তবে কার? আর কার হতে পারে?
বলরামবাবু বললেন, ”আমার মনে হচ্ছে, ব্যাগটা ভুল করে এখানে এসে পড়েছে। হয় তোমাদের স্টেশনের খালাসি ভুল শুনেছে, না হয় মাস্টারবাবু!”
নীলমণি বলল, ”মাধব মাস্টারবাবুকে ভাল করে জিজ্ঞেস করেছিল—উনি বললেন আমাদের….”
রায়বাবু বললেন, ”জিনিসগুলো একবার তবে দেখা যাক নীলুবাবু! যদি হদিশ করা যায়!”
নীলমণির ঘরেই ছিল ব্যাগটা। ব্যাগ দেখা হল, ব্যাগের মধ্যে জিনিসপত্র—কেউ কোনো হদিশ করতে পারল না।
বলরামবাবু বললেন, ”গোটা ব্যাপারটাই ভুল। খালাসি বেটা কানে কম শোনে নিশ্চয়। সে ভুল শুনেছে। মাস্টারবাবুর আর দোষ কী!….তা ও নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। আমরা তো সবাই এসে গিয়েছি। আমরা যখন বলছি আমাদের নয়—তখন ও-জিনিস আমাদের কারও নয়। মাস্টারবাবুকে ওটা ফেরত পাঠিয়ে দিয়ো নীলুবাবু। কাল তো আর হবে না। পরশু-তরশু দিয়ো।”
কথাটি ঠিকই। রায়বাবুরও সেই মত। যেখান থেকে এসেছে সেখানেই ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া ভাল।
পরের দিনটি দোলোৎসব।
নীলমণির আখড়াটি সামান্য বেলা থেকেই জেগে উঠল। সারাটি বছর যে-জায়গাটি শান্ত, প্রায়-নির্জন, কোলাহলহীন হয়ে পড়ে থাকে—সেই জায়গাটি কোলাহলে ভরে গেল। লীলাদিদিরা দোল শুরু করার আগেই তাঁর ভাইবোন আর আবিরলাল নেমে পড়ল মাঠে। বংশীর ছেলে রঙ মাখতে লাগল সকাল থেকেই। মাধব এসে পড়ল সময়মতন। তারপর বেলা খানিকটা গড়াতে না গড়াতে রঙে আবিরে ছোটাছুটি কলরবে নীলমণির আখড়াটি উৎসব আর আনন্দে মুখর হয়ে উঠল।
রঙ খেলা শেষ হতে হতে বেলা বাড়ল। লীলাদিদির শখ চাপল—উড়নি নদীতে স্নান করতে যাবেন।
নদীতে এখন জল নেই লীলাদিদি!
জল ছাড়া নদী হয় নাকি! যা আছে তাতেই হবে।
বয়সে কেউ বুড়ো হয়নি যে হুজুগে মাতবে না। সাবান গামছা শাড়ি জামাকাপড় নিয়ে পুরুষ মেয়েরা চলল উড়নি নদীতে স্নান করতে। কনকও গেল। থাকল নীলমণি আর মাধুরীদি। মাধুরীদির পা মচকেছে রঙ নিয়ে ছোটাছুটি করতে করতে। থাকল বংশী আর তার বউ। ছেলেটাও।
আবিরলাল যেন শতখানেক ছবি তুলে নিয়ে যাবে এখান থেকে এমনই তার উৎসাহ।
দুপুরের রোদে রঙমাখা শাড়ি জামা, ধুতি পাজামা পাঞ্জাবি উড়তে লাগল নীলমণির আখড়ায়।
সন্ধেবেলায় গান-বাজনা।
ফাঁকা মাঠে, জ্যোৎস্না ধারার তলায়, মাদুর আর সতরঞ্চি পেতে বসে গান। বেণুবউদি গাইতে পারে। আবিরলালও কম যায় না। বলরামবাবু সব গানেতেই গলা মেশাতে যান। তারপর নিজেই বলেন, ‘একি তোমাদের সিনেমার গান হচ্ছে যে লোকে হাউসে বসে শুনবে। এ হল আমাদের মনের খুশির গান। আহলাদ করে গাইবে সব। কাম অন লেডিস অ্যান্ড বয়েজ, লেট আস সিং…সং অফ আওয়ার হ্যাপি মোমেন্টস…।’ নীলমণিকে সব গানের সঙ্গেই তার এস্রাজের ছড়ি টানতে হয়।
ইন্দ্রই আসর মাতালো। হেসে বলল, ”রাধাকেষ্টর গান গাই তবে…” বলে গান ধরল, ”কী করি সহচরি, মরি লো মরি মরি…!”
কনক শুনছিল আর ঠোঁট টিপে হাসছিল।
গান থামলে লীলাদিদি বলল, ”ও মশাই মরিটরি নয়, আরও একটা শোনান।”
ইন্দ্র বলল, ”তবে, ভজন গাই।” বলে সে এক ভজন গাইতে লাগল।
তিলক উঠে গিয়েছিল আগেই। গানে তার মন ছিল না। এই উৎসবে তার কোনো গা নেই। আনন্দ নেই। বরং সে কোথাও যেন ঘা খেয়ে বিরক্ত তিক্ত হয়ে উঠেছে।
শিতিকণ্ঠ বসে ছিল নীলমণির পাশে। হাসিখুশি মুখ। মাঝে মাঝেই মাথা দুলিয়ে তারিফ করছিল। ‘ইন্দ্রদা—দারুণ!’
মাধব গ্লাস দুই সিদ্ধি খেয়েছে নিজে। বলরামবাবুকেও খাইয়েছে। রায়দা সাবধানী লোক। এক গ্লাস খেয়েছে। তিনজনে গায়ে গায়ে বসে সিদ্ধির নেশায় দুলছিল আর তাল দিচ্ছিল গানের সঙ্গে।
হঠাৎ হাসি শুরু হল। বলরামবাবুদের হাসি।
লীলাদিদি বললেন, ”নাও এবার ওঠো, সিদ্ধিখোররা হাসতে শুরু করেছে। এখন তবে হাসিই চলুক।”
গানের আসর ভাঙল।
শিতিকণ্ঠ বলল, ”ইন্দ্রদা, তুমি এখনও তাজা আছ! আমরা বুড়ো হয়ে গেলাম।”
ইন্দ্র বলল, ”আমি মন্ত্র জানি যে। তোমরা জান না।”
আট
উৎসব ফুরলো। দু’তিনটি দিন। পলাশবন আর মউরি মাঠের দিক থেকে মাঝ বসন্তের যে-বাতাস এতদিন ছুটে আসছিল সেই বাতাসে এখন চৈত্রের রুক্ষতা অনুভব করা যাচ্ছিল। নীলমণির গৃহবাসটি আবার কলরবহীন। শান্ত। নিরিবিলি। মাধবদের টাঙানো রঙিন পতাকাগুলি হিমে রোদে বাতাসে রঙ জ্বলে গিয়ে সাদাটে হয়ে এসেছে, ছিঁড়ে ফেটে গিয়েছে শিউলি, দেবদারুর পাতা আর ফুল শুকিয়ে উড়ে গিয়েছে বাতাসে। দড়িগুলো ছেঁড়া। বড় শূন্য দেখাচ্ছিল যেন।
ইন্দ্র বলল, ”নীলু, এবার আমি যাই।”
নীলমণি বলল, ”ওরা যেতে না যেতেই তুমি যাবে! থাকো না আরও দু’চারদিন।”
ইন্দ্র হাতের আঙুল দেখিয়ে দেখিয়ে হিসেব করে বলল, ”আমি এসেছি সবার আগে, তোমরা না ডাকতেই। তোমার অতিথিরা দিন দুই হল বিদায় নিয়েছে। আমি এখনও আছি। আর তো থাকা যায় না। কাল আমায় যেতে হবে।”
নীলমণি বলল, ”কনককে বলেছ?”
”পাকা করে বলিনি। বলব আজ।”
”কখন যাবে কাল?”
”মাধব বলছিল সকালের গাড়িটাই ভাল।”
”তা বেশ। যাবে যখন দেও। …আমাদের বড় খারাপ লাগবে ইন্দরদা!”
”লাগবে না। আজ সন্ধেবেলায় অনেক গল্পগুজব করা যাবে”, ইন্দ্র হাসতে হাসতে বলল।
সন্ধেবেলায় নীলমণির ঘরে বসে গল্প-গুজব হচ্ছিল। মাধবও ছিল। এবার উঠল। বলল, ”আজ একটু তাড়া আছে ঠাকুর। আমি উঠলাম।”
নীলমণি বলল, ”এসো।” বলে মুখ ফেরাতে গিয়ে ঘরের একপাশে রাখা ব্যাগটা চোখে পড়ল। জলচৌকির ওপর রাখা আছে। পাশে কাঠের আলনা; নীলমণির জামা-কাপড় চাদর ঝুলছে, আলনার গায়ে গায়ে এক টেবিল। টেবিল ছুঁয়ে জানলা।
নীলমণি মাধবকে বলল, ”ভাল কথা, ব্যাগটি তুমি নিয়ে গেলে না, মাধব। মাস্টারবাবুকে ফেরত দিয়ে দিতে। বলতে আমাদের জিনিস নয়। ভুল করে এখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
মাধব বলল, ”পরে নিয়ে যাব।” বলে ও দরজার দিকে এগুতে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ইন্দ্রর দিকে তাকাল। ”কাল সকালে আমি আসছি মহারাজ। আপনি বেরিয়ে পড়বেন না। আমি আপনাকে পৌঁছে দেব। চলি।”
মাধব চলে যাচ্ছিল, ঘরের চৌকাটের কাছে কনক। কনককে পথ দিয়ে বাইরে চলে গেল সে। সামান্য পরেই সাইকেলের ঘণ্টি শোনা গেল।
কনক ঘরে এসে দাঁড়িয়ে থাকল একপাশে।
নীলমণি তখনও অন্যমনস্কভাবে ব্যাগটা দেখছিল। হঠাৎ বলল, ”এ বড় অবাক কাণ্ড, ইন্দরদা! কার জিনিস, কে ফেলে গেল, কেনই বা ফেলে গেল, বলে গেল আসব—অথচ এল না! আশ্চর্য! এখন তো মনে হচ্ছে ভুল করেই জিনিসটা এখানে চলে এসেছিল!”
ইন্দ্র নীলমণির দিকে তাকিয়ে থাকল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মুখে কেমন এক হাসি ফুটলো। কৌতুকের। একটু যেন রহস্যও রয়েছে।
নীলমণি বলল, ”তুমি হাসছ?”
কনককে ইশারায় কাছে ডাকল ইন্দ্র। পাশে এসে বসতে বলল। হাসিটি কিন্তু আরও স্পষ্ট, চোখ দুটি যেন কৌতুকে মাখামাখি হয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। লণ্ঠনের আলোয় ইন্দ্রর মুখটিও সহাস্য দেখাচ্ছিল।
ইন্দ্র বলল, ”গল্পটি তবে তুমি জান না?”
”কিসের গল্প?”
কনক এগিয়ে এসে ইন্দ্রর পাশে বসেছে ততক্ষণে।
ইন্দ্র বলল, ”পুরাকালে বারাণসী থেকে অনেকটা দূরে এক মুনিঋষির চমৎকার একটি তপোবন ছিল। মুনির কয়েকজন শিষ্যও থাকত সেই তপোবনে। গুরুগৃহে থাকা আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞান অর্জন করাই ছিল তখনকার রেওয়াজ। …তা একদিন এক ছোকরা শিষ্য, যুবক তপস্বীই বলতে পার, বা কাঁচা সন্ন্যাসী—গুরুর আশ্রম থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি গঙ্গাতীরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ দেখে একঝাঁক রাজহংসের মধ্যে একটি সোনালী হাঁস ঠোঁটের ডগায় এক ফুলের মালা নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। শিষ্যটি তো অবাক। ফুলের মালা ঠোঁটে করে সোনালী হাঁস উড়ে যায় এমন দৃশ্য তো সে আগে দেখেনি। এ বড় অলৌকিক দৃশ্য। বড়ই কৌতূহল হল শিষ্যটির। সে তখন হাঁসের ঝাঁকটির পিছু পিছু ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে পথ ফেলল হারিয়ে, সন্ধে হয়ে গেল, রাত হল—গভীর এক জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়ল শিষ্যটি। ফেরার আর পথ নেই। রাত্তিরটি বনের মধ্যেই কাটল। পরের দিন সে পথভোলা হয়ে ঘুরতে ঘুরতে—ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত হয়ে মাঝদুপুরে এক ছায়ায় গিয়ে বসে পড়ল। দেখে, গাছতলায় কে যেন কাঠকুটো, মাটির পাত্র, চাল ডাল আলু ফল সাজিয়ে রেখেছে। পূর্ণ জলপাত্র রয়েছে পাশে। আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থাও। শিষ্যটি চারপাশে তাকাল। কাউকে দেখতে পেল না। অপেক্ষা করল। কেউ এল না। এদিকে খিদে তেষ্টায় সে বেচারি তো মরে যাচ্ছে। নিজের পেট ভরাবার আয়োজন রয়েছে সামনে অথচ অন্যে যে-অন্নজলের ব্যবস্থা করে গেছে, তার খাদ্য সে খায় কেমন করে! সে না সন্ন্যাসী, তপস্বী! অধর্মাচরণ যে বড় পাপ! …তা শেষ পর্যন্ত শিষ্যটি আর ক্ষুধা তৃষ্ণা সহ্য করতে পারল না। ধর্মচ্যুত হতে হয় এই ভয়ে সে হেঁকে ডেকে বলল, ‘এই অন্ন, ফল, জল, অগ্নি কার? আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আমি ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, ক্লান্ত। যিনিই এই অন্নজলের অগ্নির আয়োজন করে থাকুন—তিনি আমার কথার উত্তর দিন। অনুমতি দিন অন্নজল গ্রহণ করতে’।” ইন্দ্র হঠাৎ চুপ করে গিয়ে সকৌতুক মুখে হাসতে লাগল।
নীলমণি বলল, ”তারপর?”
ইন্দ্র বলল, ”তারপর সেই নির্জনে হঠাৎ কার যেন গলা শোনা গেল। অদৃশ্য মানুষটি বলল, হে নবীন সন্ন্যাসী, আমি অগ্নি। আমি সর্বজনের। তুমি আমার দাক্ষিণ্য গ্রহণ করতে পার। …শিষ্যটি চমকে গেল। কিন্তু শুধু অগ্নি নয়, অগ্নির পর গলা শোনা গেল অন্নদেবতার। দেবতা বলল, আমিও সকলের, ক্ষুধার্ত জনের। তুমি আমায় ভোজ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পার। …বনদেবতা বলল, আমার রাজত্বে গাছে গাছে কত ফল ধরে, পশুপাখি মানুষ সেই ফল খায়। তুমি আমার গাছের ফলগুলি খেতে পার। …আর জলের দেবতা বললে, সৃষ্টির আদি থেকে আমি জীবজগতের। জলের কি অধিকার-বিশেষ আছে সন্ন্যাসী! তুমি ওই জল পান করতে পার।”
”বাঃ! তারপর?”
”শিষ্যটি আগুন জ্বালাল, মাটির হাঁড়িতে ভাত ফুটিয়ে নিল, ফলপাকড় যা ছিল খেয়ে নিয়ে জলপান করে গাছতলায় শুয়ে পড়ল। দিব্যি একটা ঘুম মেরে সে আবার তার গুরুর আশ্রমের পথ ধরল।”
”আর সেই সোনালী হাঁস? মালা?”
ইন্দ্র হেসে উঠল। ”আর কি সে সোনালী হাঁসের পেছনে ছোটে! মালাটি তো তাকে কম ভোগ ভোগালো না। কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এল! ….কী পেল সে?” বলে ইন্দ্র কনককে দেখল একবার, তারপর নীলমণির দিকে তাকিয়ে বলল, ”তোমায় কয়েকটি কথা বলি, নীলু! তুমি যদি ওই হাঁসের মালাটির জন্যে বসে থাকো—তুমি ঠকবে। ওটি ভ্রম। মোহ। ছলনা। জানি না তুমি ও মালাটির জন্যে এতকাল এত কিছুর পর শেষ পর্যন্ত এখানে এসে বসে আছ কিনা! যদি থেকে থাকো, তুমি কিন্তু ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত হয়েছ…!”
ইন্দ্রর কথার মাঝখানে কনক উঠে দাঁড়াল। কিছু বলল না। চলে গেল।
নীলমণি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল। ইন্দ্রকে দেখছিল।
ইন্দ্রও কথা বলছিল না।
নিস্তব্ধ ঘর। লণ্ঠনটি জ্বলছে একপাশে। ছায়া জমে আছে দেওয়ালের এখানে ওখানে। মাঠ থেকে মৃদু এক শব্দ ভেসে আসছিল, হয়ত চৈত্ররাতের বাতাসে গাছের পাতায় শব্দ হচ্ছিল।
নীলমণি হঠাৎ বলল, ”ইন্দরদা, আমি তো মালার জন্যে বসে নেই।”
”তা হলে কিসের জন্যে বসে আছ? তোমার চারপাশে কোনো আয়োজনেরই তো অভাব রাখেনি কনক। অগ্নি, অন্ন, ফলমূল, জল—সবই তো সে সাজিয়ে রেখেছে। তার দেহ, তার ভালবাসা, তার মায়া, মমতা তার নিবেদন—কোনটি সে তোমার জন্যে রাখেনি! অন্য আর কারও জন্য কনক তার আয়োজন সাজিয়ে রাখেনি। তুমি সবই জান, তবু…”
”জানি। কিন্তু আমার ভয় হয়, দ্বিধা হয়….। ইন্দুমাসিও আমাকে বলেছিল—কনককে যেন বরাবর কাছে রাখি। বলেছিল, ভালবাসার তিনটি ঘর। একটি দেখা যায়—অন্য দুটি চোখে পড়ে না। সেখানে নাকি বড় অন্ধকার। …কনক যদি কখনো তার…”
বাধা দিয়ে ইন্দ্র বলল, ”নীলু, তোমার মাসি তোমায় কী বলেছিল জানি না। আমি বলি, দেহ আর রূপ যদি ভালবাসার প্রথম ঘরটি হয় তবে তার অন্য দুটি ঘর হল—মন আর হৃদয়। প্রথমটি দৃশ্য, অন্য দুটি দেখা যায় না। সেখানেই তো তোমার প্রাণটিকে পাবে।”
নীলমণি কোনো কথা বলল না। ইন্দ্রকে দেখছিল।
ইন্দ্র এবার উঠে দাঁড়াল। বলল, ”একটু বাইরে যাই।…” বলে ইশারায় জলচৌকির ওপর রাখা ব্যাগটি দেখাল। বলল, ”ওটি ভুল করে এখানে আসেনি, নীলু। আমি ফেলে দিয়ে গিয়েছিলাম। ওর মধ্যের জিনিসগুলি তুমি ভাল করে দেখোনি। ও-সবই তোমার।”
”আমার?”
”চার বছর আগেকার নীলুর মাপজোক, চোখের হিসেবে সামান্য ছোটবড় হতে পারে। ধুতি চাদরে হবে না। হয়ত জামায় হবে। তবু সুখময়বাবুর কাছে আমি একটা আন্দাজ নিয়ে নিয়েছিলাম…..তোমাদের সমস্ত কিছুর। মনটি বড় উতলা হয়েছিল তখন থেকে। তাই তো এলাম।”
নীলমণির গলায় যেন স্বর ফুটছিল না। কোনো রকমে বলল, ”কিন্তু চশমা? চশমা তো আমি পরি না ইন্দরদা!”
”ওটি ঘষা কাচের চশমা। দেখা যায় না। তোমার চোখ দুটি তো ওই রকমই ছিল। অন্ধ তুমি। কাছের জিনিসও দেখার চোখ তোমার ছিল না।”
ইন্দ্র আর দাঁড়াল না, ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বাইরে চলে গেল।
কনককে দেখা গেল বাইরে। মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। একা।
তৃতীয়া তিথির চাঁদ উঠেছিল আকাশে। জ্যোৎস্না ফুটেছে। চৈত্রের এলোমেলো বাতাস দিচ্ছিল।
ইন্দ্র মাঠে নামল। ধীরে ধীরে কনকের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
কনক মুখ ফেরাল না। দাঁড়িয়ে থাকল আগের মতনই।
ইন্দ্র কনকের কাঁধে হাত দিল। গাঢ় গলায় বলল, ”কনকসখি, ভালবাসা জিনিসটি এই রকমই। দেবতারা সমুদ্রমন্থন করে অমৃত তুলেছিলেন। ভালবাসাটিও যে মন্থন করে তুলতে হয় গো! তার অনেক দুঃখযন্ত্রণা মনোকষ্ট। কত হতাশার পর হয়ত সে তোমার কাছে ধরা দেয়, আবার দেয়ও না। ভগবান যখন আমাদের হৃদয়টি দিলেন শেষ পর্যন্ত, তখন বলে দিয়েছিলেন দেহের কোথাও তোমার স্থান নেই গো, তুমি শূন্য। তবু তুমিই হলে দেহ আর আত্মার মধ্যে একমাত্র পূর্ণ।”
কনক মুখ ঘুরিয়ে তাকাল।
ইন্দ্র কনকের ভিজে গাল নিজের হাতে মুছিয়ে দিতে দিতে গাইল : ”অনুগত জনে কেন করো তবে এত প্রবঞ্চনা….”
কনককে নিয়ে বারান্দার দিকে আসার সময় ইন্দ্রর চোখে পড়ল—নীলমণি তার ঘ;েরর দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছে।