ফুঃ
‘ফুঃ’।
ঘরের মধ্যে সোফায় বসে একবার ফুঃ করেছিলেন অমরজিৎ। তারপর চুপচাপ গম্ভীর মুখে রাস্তায় বেরিয়ে এসে সাদা মারুতি গাড়িটার পেছনের সিটে বসে আবার আরেকবার ফুঃ করলেন। অমরজিৎ চক্রবর্তী।
পাশাপাশি শুকনো মুখে হেঁটে আসছিলেন মিলনবাবু, মিলনলাল সেনগুপ্ত। তাঁর দালালগিরির সুদীর্ঘ জীবনে তিনি আর কখনও এতটা অসফল, এতটা হতাশ হননি। ব্যাপারটা কী যে হল, পরপর পাঁচবার ফুঃ, এরকম তো হওয়ার কথা নয়–কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না মিলনবাবুর।
ঘটনাটা বোধহয় আর বেশিক্ষণ হেঁয়ালির কুয়াশায় ঢেকে রাখা উচিত হবে না। এরপরে পাঠিকাসুন্দরী হয়তো নিজেই ঠোঁট উলটিয়ে ফুঃ বলে গল্পটা ছুঁড়ে ফেলে দেবেন।
সুতরাং।
সুতরাং গল্পটা বরং সংক্ষেপে আদ্যোপান্ত বলি। এবং একমাত্র বলি যে গল্পটা ঠিক গল্প নয়, একেবারে সাহেবরা যাকে বলে জীবন থেকে নেওয়া, ঠিক তাই। সুতরাং এই গল্পে যদি চরিত্রাবলির নামধাম ঠিকানা ঘটনা কোনও কারণে মিলে যায় তার জন্য সম্পূর্ণ দায়িত্ব এই গল্পকারের এবং তার অক্ষম কল্পনাশক্তির।
বিধান সরণিতে অর্থাৎ পুরনো কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে খুব নাম করা গয়নার দোকান চক্রবর্তী অ্যান্ড কোম্পানি, গোল্ড মার্চেন্টস অ্যান্ড জুয়েলার্স। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে রমরমা চলছে এই দোকান, বাঙালির যেকোনও ব্যবসার পক্ষেই সেটা গৌরবজনক। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়েছেন মূল প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গত বৈকুণ্ঠনাথ চক্রবর্তীর পৌত্র শ্রীযুক্ত অমরজিৎ চক্রবর্তী।
চক্রবর্তী ব্রাহ্মণের পক্ষে সোনার গয়নার ব্যবসা, স্যাকরার পেশা খুব স্বাভাবিক নয়। কিন্তু ঘটনাটা ঘটেছিল একটি সামান্য এবং পুরনো কারণে।
বৈকুণ্ঠনাথের পিতৃনিবাস ছিল উত্তরবঙ্গের কোনও এক জেলায়। চল্লিশ বছর বয়েসে পিতৃহীন হয়ে একটা সাবেকি বড় সংসারের পুরো দায়িত্ব তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। তখনও তার কনিষ্ঠতমা বোনের বিয়ে হয়নি। গৃহেনগদ অর্থ বিশেষ ছিল না কিন্তু স্থায়ী ধন ছিল মা ঠাকুমার স্বর্ণালংকার। কালাশৌচের বছর পার হতেই বোনের বিয়ে স্থির করে ফেললেন বৈকুণ্ঠনাথ। বোনের বিয়ের আগে নতুন গয়না করতে এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে কিছু পুরনো ভারী অলংকার নিয়ে বৈকুণ্ঠনাথ কলকাতায় আসেন। বড়বাজারে, বউবাজারে দু-চারটি গয়নার দোকানে ঘোরাঘুরি করার পর তরুণ বৈকুণ্ঠনাথ একটি তত্ত্ব অবহিত হন যে পুরনো গয়না ভেঙে নতুন গয়না করাতে গেলে পানমরা নামক একটি পদার্থ যায়। পুরনো গয়না বিক্রি করতে গেলেও ঠিক তাই। দশ ভরি ওজনের পুরনো সোনার গয়নার বদলে বড় জোর সাড়ে আট, নয় ভরি নতুন সোনার গয়না পাওয়া যাবে, বেচতে গেলে অনেক সময় তার চেয়েও কম।
বৈকুণ্ঠনাথের উপায় ছিল না, তিনি বাধ্য হয়ে পানমরা বাদ দিয়ে কিছু পুরনো গয়নার বদলে নতুন গয়না বানিয়ে এবং কিছু সোনা পানমরা বাদ দিয়ে বেচে অর্থসংগ্রহ করে বিয়ের আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরলেন।
কিন্তু এই পানমরা ব্যাপারটা তার মাথার মধ্যে প্রবেশ করে গিয়েছিল। নতুন গয়নায় পানমরা থাকে না অথচ সে গয়না পুরনো হলেই সেটার মধ্যে পানমরা প্রবেশ করে এবং সোনা কেনাবেচা করতে গেলে বা সোনার গয়না বানাতে গেলে অতি ধুরন্ধর এবং বিচক্ষণ ক্রেতাকেও যে পানমরা ব্যাপারটা মেনে নিতে হয়–এই ঘটনার তাৎপর্য বৈকুণ্ঠনাথের মনে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল।
সে যা হোক বোনের বিয়ে ভালভাবে মিটে গেল। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পুরোদমে চলছে। একদিন কলকাতায়ও বোমা পড়ল, কলকাতা থেকে দলে দলে লোক পালাতে লাগল, লোক পালানোর রীতিমতো হিড়িক পড়ে গেল। দোকানে দোকানে তালা ঝুলল, অবিশ্বাস্য সব কম দামে চালু ব্যবসা বিক্রি হয়ে যেতে লাগল। কলকাতায় বাড়ির দাম হু হু করে পড়ে যেতে লাগল, হাজার হাজার শূন্য বাড়ির দরজায় লাগানো হল টু-লেট বিজ্ঞাপন, মানে ভাড়া দেওয়া হবে।
এই সময়েই অসম সাহসী বৈকুণ্ঠনাথ গ্রামের জমিজমা সব বেচে দিয়ে কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে একটি জুয়েলারি দোকান এবং হাতিবাগানে একটা দোতলা বাড়ি কিনে কলকাতায় উঠে এলেন। কয়েকদিন আগেই কলকাতায় বোমা পড়েছে এই সময় গ্রাম থেকে কলকাতা চলে আসায়, যখন সবাই গ্রামে পালাচ্ছে, অনেকে বৈকুণ্ঠনাথকে উন্মাদ ভেবেছিলেন কিন্তু তা না হলে তো তিনি খাস কলকাতায় সাড়ে এগারো হাজার টাকায় দোতলা বাড়ি আর দুহাজার টাকায় আসবাব সমেত দোকান কোনওদিনই পেতেন না।
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে কথা এসব। গত অর্ধ শতাব্দীকাল ধরে চক্রবর্তীদের সোনার দোকান রমরমা চলেছে। বৈকুণ্ঠনাথও বহুদিন বিগত হয়েছেন।
আমাদের এই গল্প বৈকুণ্ঠবাবুর নাতি অমরজিৎকে নিয়ে। অমরজিৎ বছর খানেক আগে পিতৃহীন হয়েছে, সেই এখন দোকান ব্যবসার মালিক। তাঁর পিতামহ তার বাবাকে একুশ বছর বয়েসে এবং তাকে বাইশ বছর বয়েসে বিয়ে দিয়েছিলেন।
এখন অমরজিতের বয়েস পঁয়ত্রিশ, তার স্ত্রী শ্যামলীর বয়েস অমরজিতের ধারণা তার থেকে কিছু বেশিই হবে অন্তত ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ তো হবেই। তাদের পাঁচটি ছেলেমেয়ে, তার মধ্যে প্রথম তিনটি মেয়ে এবং তারপরে যমজ ছেলে।
এই বয়েসেই শ্যামলী কেমন যেন মোটা, থপথপে হয়ে গিয়েছে, রাত দিন পান দোক্তা চিবোচ্ছে, টানা রিকশায় চড়ে ঘুরে ঘুরে বাংলা সিনেমা দেখছে, না হয় বাড়িতে বসে টিভিতে বস্তাপচা সিরিয়ালে সময় নষ্ট করছে। লোডশেডিংয়ের সময় শ্যামলীর টিভি দেখতে যাতে বাধা না হয় সে জন্য অমরজিৎকে শক্তিশালী ইনভারটার কিনতে হয়েছে।
অমরজিৎ স্কটিশচার্চ কলেজ এবং যাদবপুরের ছাত্র। প্রজাপতির মতো রঙিন ও সুন্দরী সহপাঠিনী ও বান্ধবীদের সঙ্গে তার প্রথম যৌবনের দিনগুলি কেটেছে। তারপর কলেজ ছাড়তে না ছাড়তে বিয়ে। শ্যামলী। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা খারাপ লাগেনি। বরং একটু মাদকতাই ছিল তার মধ্যে। বাইশ-তেইশ বছরের শ্যামলী তখন সেও দেখতে ভালই ছিল, সেই যে মাইকেল লিখেছিলেন না, যৌবনে কুকুরীও ধন্যা, অনেকটা প্রায় সেইরকম। শ্যামলীর তখন গায়ের কালো রঙের একটু লালিত্য ছিল, মুখে চোখে তারুণ্যের আহ্লাদ ছিল।
এখনকার শ্যামলীকে দেখলে এই শ্যামলীর কথা মনে পড়া সম্ভব নয়। স্থলাঙ্গিনী, কৃষ্ণকায়, মাংসল মুখের মধ্যে থ্যাতা নাক, কুতকুঁতে চোখ।
অথচ এখনও রাস্তাঘাটে অমরজিতের যখন পুরনো বান্ধবী বা সহপাঠিনীদের সঙ্গে দেখা হয় তার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, এরা এখনও কেমন তরল, চঞ্চল, ফুটফুটে রয়েছে। তা ছাড়া অমরজিতের বন্ধুদের অনেকের এখনও বিয়ে হচ্ছে, সেসব বিয়েতে তাকে বরযাত্রীও যেতে হচ্ছে। সেসব বিবাহবাসরে গিয়ে সুসজ্জিতা নববধূ এবং তাদের সঙ্গিনীদের দেখে অমরজিৎ বিহ্বল বোধ করেন। নিজের ওপর রাগ হয়, কেন মরতে একুশ বছর বয়েসে বিয়ে করতে গিয়েছিলাম। তার ওপরে ওই কালো ধুমসিকে। পিতামহ বৈকুণ্ঠনাথের ওপর তাঁর আরও রাগ হয়, নাতবউয়ের মুখ দেখার জন্যে বুড়ো তাঁকে ডুবিয়ে গেছে, বুড়ো তো মাত্র তিন মাস শ্যামলীর মুখ দেখতে পেয়েছিল তারপরেই অক্কা পায় কিন্তু তাকে যে সারাজীবন ওই মুখ দেখতে হচ্ছে। অবশেষে এখন অমরজিৎ ওড়া শুরু করেছেন। স্বৰ্গত বৈকুণ্ঠনাথের ওপর যতই রাগ হোক তার, কিন্তু বৈকুণ্ঠনাথ প্রতিষ্ঠিত চক্রবর্তী অ্যান্ড কোম্পানি, গোল্ড মার্চেন্টস অ্যান্ড জুয়েলার্স পানমরার কল্যাণে তখনও রীতিমতো বহাল তবিয়তে আছে। অর্থাভাব নেই অমরজিতের।
গয়নার দোকান যথারীতি চলতে লাগল সেইসঙ্গে উদ্বৃত্ত অর্থের সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি।
প্রথমে ঠিক করলেন সিনেমা কোম্পানি করবেন। বাজারে এ খবর ছড়িয়ে পড়তে ঝাকে ঝাকে পরামর্শদাতা জুটে গেল। দুবার বম্বে এবং একবার মাদ্রাজ গেলেন অমরজিৎ। কিন্তু দশ-বিশ লাখ টাকা পুঁজির বাঙালি প্রযোজকের কোনও সুবিধা হল না। সেখানকার তরলা যৌবনবতীরা এক ঝলকের জন্যেও অমরজিতের সঙ্গে দেখা করলেন না। মধ্যে থেকে দালালে টাউটে হাজার পঞ্চাশ টাকা খরচ হয়ে গেল। পঞ্চাশ, একশো কোটি অন্তত মেরে কেটে দশ বিশ কোটি টাকা না হলে বম্বেতে পাত্তা পাওয়া অসম্ভব।
কলকাতায় ফিরে এসে এক অত্যাধুনিক প্রগতিশীল পরিচালকের পাল্লায় পড়লেন অমরজিৎ। সে ছোকরা বছর সাতেক ধরে এম. এ. পড়ার পরে কফিহাউস, কলেজ স্ট্রিটে প্রচুর ধোঁয়া উড়িয়ে গলা উঁচু খদ্দরের পাঞ্জাবি পরে সুকান্তের আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা আবৃত্তি শুরু করে, সেখান থেকে ওই যাকে বলে গ্রুপ থিয়েটার পরিচালনা ও অভিনয়, রাবণরাজারা তিন ভাই নাটকের বিখ্যাত বিভীষণ চরিত্রে, তারপর দেশাত্মবোধক টেলিফিল্ম হাতে হাত মেলাওঅবশেষে সিনেমায় এসেছে। কলকাতার রাস্তার কুকুরদের নিয়ে তার পনেরো মিনিটের তথ্যচিত্র কামস্কাটকা ফিল্ম উৎসবে অল্পের জন্য তাম্রগাভী পায়নি।
ছোকরার আগে কী নাম ছিল বলা কঠিন তবে এখন নাম বহ্নিবলয় চৌধুরী। সে এবার কলকাতার তিনশো বছর উপলক্ষে জব চার্নকের যৌবন ও বাল্যকালের ওপর একটা চিত্রনাট্য লিখেছে।
বহ্নিবলয় তালেবর যুবক, অমরজিৎ কী চায় সে বুঝতে পেরেছিল। চার্নকের বাল্য ও যৌবনকাল কেটেছে বিলেতে, সুতরাং শ্বেতাঙ্গিনী অন্তত অ্যাংলো প্রয়োজন নায়িকা ও অন্যান্য মহিলা চরিত্রে। মাসখানেক বহ্নিবলয় ও অমরজিৎ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে খালি কুঠি আর পার্ক স্ট্রিটে বারে হোটেলে ঘুরে শ্বেতাঙ্গিনী নায়িকার অনুসন্ধান করে বেড়াল।
এই সময়েই ডাকাবুকো মেয়ে (কলগার্ল) পামেলা বর্দের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে কেনা বিলিতি কেচ্ছা পত্রিকায় পামেলার নানা মনোহারিণী ভঙ্গিমার ছবি দেখছিল একদিন অমরজিৎ। তখন বহ্নিবলয় তাকে পরামর্শ দেয়, চলুন লন্ডনে গিয়ে পামেলাকে জোব চার্নকের যৌবনের প্রথম সঙ্গিনীর পার্টে আমাদের বইয়ের নায়িকার ভূমিকায় প্রপোজাল দিই। যদি রাজি হয় সারা পৃথিবীতে হইহই পড়ে যাবে।
মাস দেড়েক বাদে পাসপোর্ট ইত্যাদির ঝামেলা মিটিয়ে অমরজিৎ ও বহ্নিবলয় যখন লন্ডনে পৌঁছাল তখন পামেলা মেমসাহেব নাগালের বাইরে, তিনি তখন আজ এখানে কাল সেখানে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু লন্ডনে নিশ্চয় কোনও গর্হিত, অতি গর্হিত কাজ করেছিল বহ্নিবলয়। কারণ হঠাৎ একদিন দুম করে গজভুক্ত কপিথবৎ বহ্নিবলয়কে ফেলে অমরজিৎ কলকাতায় ফিরে আসেন। বহ্নিবলয়ের এরপরে আর কোনও খবর পাওয়া যায়নি, শোনা গেছে সোহো অঞ্চলে সে একটি নাইট ক্লাবে গেলাস ধোয়ার কাজ করছে।
এদিকে কলকাতায় ফিরে অমরজিৎ স্ত্রীর সঙ্গে এক ঘরে শোয়া বন্ধ করে দেন এবং কেউ কেউ বলে গোপনে এইডস রোগের কারণ, প্রতিকার ও চিকিৎসা বিষয়ে যথাসাধ্য খোঁজখবর করেন।
যতদূর মনে হয় অমরজিতের আশঙ্কাটা অমূলক ছিল। কারণ এখন আবার তিনি পুরোপুরি উড়তে শুরু করেছেন এবং শ্যামলীর শয়নকক্ষে আর ফিরে যাননি। এবার তার বাহন জুটেছে মিলনলাল সেনগুপ্ত। মিলনলাল যাত্রার লোক। সে অমরজিৎকে বার্তা পাঠিয়েছে যাত্রাপার্টি খুলুন, এ হল যাত্রার যুগ, যাত্রার মরশুমে গ্রামগঞ্জের বাতাসে লাখ লাখ টাকা হাওয়ায় ওড়ে। ঠিক মতো পালা আর খলবলে নায়িকা থাকলেই যাত্রার রমরমা।
কথাটা অমরজিৎ খেয়েছে। আগামী মরশুম থেকেই তার যাত্রাপার্টি চালু হবে। সে সাবেকি কায়দায় তার যাত্রাদলের নাম রাখতে চেয়েছিল চক্রবর্তী কোম্পানি কিন্তু মিলনলাল বলেছে, আজকাল ওসব চলবে না। লাগসই আধুনিক নাম চাই। অবশেষে অমরজিতের ভাবী যাত্রাদলের নাম হয়েছে। সখাসখী অপেরা।
সখাসখী অপেরার নামকরণ হওয়ার পর আজ মিলনলাল অমরজিতকে নিয়ে বেরিয়েছে হিরোইন নির্বাচন করতে। যাত্রার মরশুম এখনও বেশ দূরে, ধীরে সুস্থে হিরোইন নির্বাচন করলেই চলত। কিন্তু অমরজিৎ উতলা হয়ে পড়েছে অবিলম্বে হিরোইন সংগ্রহ করার জন্য।
কারণটা অবশ্য একটু অন্যরকম। গতকালই শ্যামলীর সঙ্গে তার একহাত হয়েছে। শ্যামলী তাকে ধরেছিল, তুমি আলাদা থাক কেন? বম্বে-মাদ্রাজে কী করেছিলে? ইত্যাদি বহুবিধ মর্মভেদী প্রশ্ন, সেই সঙ্গে লম্পট, হিজরে ইত্যাদি বিশেষণ প্রয়োগে তাকে জর্জরিত করেছিল শ্যামলী, কুৎসিত, মোটা, কালো, কোলা ব্যাঙের মতো থপথপে, মরা কাতলা মাছের মতো ঠান্ডা শ্যামলী।
নিতান্ত প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে আজ এই সাতসকালে মিলনলালকে সঙ্গে নিয়ে নায়িকা পছন্দ করতে বেরিয়েছেন অমরজিৎ। মিলনলাল সকাল সকালেই এসে গেছে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে অমরজিতের সাদা বিরাট গাড়িটায় বসে মিলনলাল প্রথমেই বলল, স্যার, তাহলে প্রথম হেমামালিনীর কাছেই যাই।
হেমামালিনীর নাম শুনে চমকিয়ে উঠলেন অমরজিৎ, বম্বেতে পঞ্চাশ হাজার টাকা গচ্চা যাওয়ার শোক এখনও তিনি ভুলতে পারেননি, ভাবলেন হেমামালিনী বোধহয় কলকাতায় এসেছে, মাঝে মাঝেই তো আসে, এ্যান্ডে বা এয়ারপোর্ট হোটেলে হয়তো উঠেছে। কিন্তু হেমা বাংলা যাত্রার হিরোইন হতে রাজি হবে কি, সময়ই বা পাবে কোথায়?
মিলনলাল বোঝাল, না, না। এ হেমামালিনী সে হেমামালিনী নয়। এ থাকে বরানগরে, আগের নাম ছিল কুঁচি পাল, ধর্মাধর্ম অপেরার ম্যানেজার গজানন মণ্ডল ও নাম চলবে না বলে হেমামালিনী করে দিয়েছে। আমরা এখন যাচ্ছি হেমাকে ধর্মাধর্ম অপেরা থেকে ভাঙিয়ে আনতে।
বরানগরের গলিতে দোতলার ওপরে দু কামরার ফ্ল্যাট, বাইরের ঘরে বেতের সোফা সেট, খুব দামি নয় কিন্তু ভালই। হেমা খুব সপ্রতিভ মেয়ে, স্নান করতে গিয়েছিল, স্নান সেরে ভেজা এলোচুলে এসে নমস্কার করল, পাতলা, ছিপছিপে, শ্যামাঙ্গিনী তরুণী। সামান্য কথাবার্তার পর হেমা বলল তার একটু তাড়াতাড়ি আছে, পুরুলিয়ায় যাত্রা আছে রাতে, একটু পরেই বেরোতে হবে। মিলনলাল বলল, ঠিক আছে, পরে একদিন এসে কথা বলা যাবে।
দুজনে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে অমরজিৎ একবার ফুঃ বললেন। তারপর আবার গাড়িতে বসে আরেকবার ফুঃ বললেন।
ফুঃ! এই উক্তি অমরজিতের ওষ্ঠে শুনে মিলনলাল চিন্তিত হল, কী রে বাবা হেমাকে পর্যন্ত পছন্দ হল না। তারপর একটু ভেবে ঠিক করল যাত্ৰাজগতের মক্ষিরানী অনন্ত যৌবনা অমলাবালার কাছে নিয়ে যাই, অমলাবালাকে পছন্দ হতেই হবে। যাত্রার এক নম্বরী মহিলা যাকে বলে তাই।
অমলাবালা প্রায় মধ্যবয়সিনী, গৌরতনু, সুডৌল এক রমণী। তাকে খুব মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন অমরজিৎ। কিঞ্চিৎ বাক্যালাপ ও চা পান ইত্যাদিও হল। কিন্তু অমলাবালার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইরের দরজার পাপোশে পা রেখেই অমরজিৎ আবার বললেন, ফুঃ! গাড়িতে উঠে সিটে বসে যথারীতি আরেকবার ফুঃ।রীতিমতো চিন্তায় পড়ল মিলনলাল। হেমাকেও ফুঃ, অমলাকে ফুঃ অমরজিতের রুচিটা তো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। যা হোক একবার রেহানা বেগমের কাছে নিয়ে গিয়ে শেষ চেষ্টা করল মিলনলাল।
রেহানা বেগম যাকে বলে একেবারে আগুন। যেমন তার গায়ের রং, তেমনি গড়ন, যেমন তার চোখ, তেমন তার চাউনি, চলাফেরা কিন্তু ওই রেহানা বেগমকে দেখে বেরিয়ে আবার অমরজিৎ ফুঃ বললেন। ঘরের মধ্যে সোফায় বসেও একবার অস্ফুটে ফুঃ বলেছিলেন, রেহানা যখন চা আনতে গেল তখন তার পিছন দিকে তাকিয়ে। আবার এবার গাড়ির মধ্যে ফিরে এসে আরেকবার ফুঃ।
রেহানার পর জবা, জবার পর মালতী। নায়িকা খুঁজতে খুঁজতে দুপুর গড়িয়ে গেল। কিন্তু সব জায়গাতেই ওই ফুঃ।
অবশেষে ক্লান্ত, পর্যদস্ত মিলনলাল সাহস করে অমরজিৎকে প্রশ্ন করল, সে কী স্যার এত ভাল ভাল রাজ্যের সব সেরা হিরোইন দেখালাম আপনার কাউকেই পছন্দ হল না?
অমরজিৎ বললেন, পছন্দ হবে না কেন? সবাইকে পছন্দ হয়েছে।
মিলনলাল বলল, তা হলে?
অমরজিৎ বললেন, তা হলে!
মিলনলাল বলল, ওই যে একেকজনকে দেখেই আপনি বললেন ফুঃআমি ভাবলাম বুঝি আপনার অপছন্দ হয়েছে।
অমরজিৎ বললেন, ধুৎ, তুমি যেমন গাধা। আমি কি আর ওদের ফুঃ বলেছি, আমি ফুঃ বলেছি আমার বউ শ্যামলীকে, কোথায় ওরা আর কোথায় শ্যামলী, তাই ফুঃ বলেছি।
আশ্বস্ত হল মিলনলাল, বলল, তাহলে কাকে নেবেন। অমরজিৎ বললেন, যে কয়জনকে পাওয়া যাবে সবাইকে নেব। সখাসখি অপেরা নয়, সখি অপেরা নাম হবে আমার কোম্পানির, নায়ক-টায়ক লাগবে না, সাতজন নায়িকা থাকবে।
এই বলে আবার একটা বিশাল ফুঃ করলেন অমরজিৎ, অবশ্যই সাতজন নায়িকা বনাম ধুমসী, থপথপে শ্যামলীর উদ্দেশে।