ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের চিঠি
প্রিয় সম্পাদক,
প্ৰথম খবর এই যে ভালভাবে পৌঁছেছি। পথে যা যা ঘটবার যথারীতি ঘটেছে অর্থাৎ আকাশ মেঘলা থাকায়, পেশোয়ার থেকে প্লেন দেড় ঘণ্টা পরে ছেড়েছে। এখানকার এয়ারপোর্টে পাসপোর্ট চেক করে ফেরত দেওয়ার সময় আমারটা ভুল করে জনৈকা বেগম ফজল নাদিরাকে দিয়ে দেয়, আর তারটা আমাকে। পাসপোর্টে বেগমের ঠিকানা দেখে পালটাতে গিয়ে সে প্রায় জেল খাটার বন্দোবস্ত আর কী!
সে যা হোক, এসব কথা ফিরে গিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা যাবে। এখন ফেস্টিভ্যাল সম্বন্ধে কিছু খবর পাঠাই। কেন যে এই জুন মাসে মরুভূমির মধ্যে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয়েছে, আমার মোটেই মাথায় আসছে না। ব্যাপারটা হয়তো পুরোপুরিই রাজনৈতিক, তাতে অবশ্য কী আসে যায়, আমার তো বিনি ভাড়ায় প্লেন চড়া হয়ে গেল।
কিন্তু মশা? কী ভয়ংকর মশা আফ্রিকার এই শহরে! ছোটবেলায় ভূগোল বইতে আফ্রিকার জীবজন্তুর মধ্যে মশার নাম ছিল কিনা কিছুতেই মনে পড়ছে না। চিত্রতারকা বা যারা এসেছেন, বেশ বহাল তবিয়তেই আছেন। তাদের, মুখ চোখ সারা শরীর পেন্ট করা, মশার কামড়ে কিছু করতে পারছে না। কিন্তু আমরা, হতভাগ্য ফিল্ম সাংবাদিকরা দিনে গরম এবং রাত্রে মশা–অস্থির, একেবারে পাগলের মতো হয়ে উঠেছি। আমার ক্যামেরার কেসটা বোধ হয় কাঁচা চামড়ার ছিল, মশায় কামড়ে সেটাকেও ফুটো ফুটো করে দিয়েছে।
গতকাল থেকে ফেস্টিভ্যাল শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনটা ভাল পড়া নেই। এই ফিল্মগুলো সম্বন্ধে আলোচনা করতে ভরসা পাচ্ছি নে। যা হোক, সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলির নাম জানাব না।
প্রথম ফিল্মটি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে। ভাষা কিছু বোঝা গেল না। তবে দেশটি খুব পর্দানশিন। এই বইয়ে সমস্ত মহিলা চরিত্র বোরখা পরিহিতা। একটি সিন আছে, পাঁচটি মেয়ে বোরখা পরে নাচছে। ইংরেজিতে বইয়ের বিজ্ঞপ্তি বাইরে দেখলাম তাতে লেখা রয়েছে কুইন অফ ডেসার্ট এই বইয়ের নায়িকা। শতাধিক বোরখার অন্তরালে সত্যিই কোনটি কুইন, সে রহস্য রয়ে গেল অবশ্য। পরে শুনলাম বোরখাবিহীনা পাত্রী কিছু কিছু মূল বইয়ে ছিল, কিন্তু বাইরে দেখানোর আগে সে দেশের সেন্সারবোর্ড সেই জায়গাগুলো কেটে দিয়েছে। হয়তো আপত্তির কিছু নেই, বেআব্রু রমণীদের বাইরে না পাঠানোই ভাল।
কালকের দ্বিতীয় বই এক সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের। দুঃখের বিষয়, সেই রাষ্ট্রের জনৈক চিত্র সাংবাদিকের সঙ্গে এখানে আসার সময় আলাপ হয়েছিল। তার কাছেই প্রথমে তাদের দেশের বইয়ের সম্বন্ধে আলোচনা শুনি। শখের থিয়েটারে যেমন মধ্যে মধ্যে প্রম্পটারের গলা শোনা গেলে, আপত্তির কিছু নেই, এঁদের সিনেমাতেও কখনও কখনও ডিরেক্টরের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। সে এক বিষম অভিজ্ঞতা।
নির্জন সমুদ্রতীর। নারিকেল কুঞ্জে হাওয়া বইছে। অপরাহ্নের আলো ম্লান হয়ে আসছে। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘ। নায়ক নায়িকা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এবং সেই চিরদিনের ডায়ালগ।
নায়ক : এই সমুদ্রতীরে আজ এই বিকালের আলো, আমার কেমন যেন মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
এর প্রতিবাদে নায়িকার যথারীতি করুণ অনুনয় এবং অবশেষে সহমরণের বাসনা। এই রোমান্টিক সিচুয়েশানে সমুদ্রের উদ্দাম হাওয়ায় অসম্ভূতপদা নায়িকা; নায়কের উড়ু উড়ু চুল, সহসা একটি কাংস্য কণ্ঠ শোনা গেল, যেন নিয়তি, যেন বুভুক্ষু দর্শকের অন্তরাত্মা কথা বলে উঠল,–
বুক থেকে শাড়ির আঁচল আরেকটু ফেলে দিন, আরেকটু ঘেঁষে দাঁড়ান। পরিচালকের কণ্ঠস্বর, নায়িকার প্রতি নির্দেশ স্পষ্ট শোনা গেল।
নায়িকার বাবা এইমাত্র মারা গেছেন। ও গড বলে সিনেমার সেই প্রবীণ ডাক্তার মাথার টুপি খুলে ফেলেছেন (সিনেমার ডাক্তারদের মাথায় কেন যে টুপি থাকে!), ঘরে সবাই নিস্তব্ধ, এক। নায়িকার চাপা গোঙানি ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই, হঠাৎ শোনা গেল, সাবধান পা নাড়াবেন না, সাবধান। মনে রাখবেন এটা মৃত্যুর দৃশ্য। মৃতের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করছিলেন নিশ্চয়ই তার প্রতি এই নির্দেশ। কলকাতার স্টুডিওতে একবার এক ডিরেক্টর নাকি মৃতের ভূমিকার অভিনেতাকে বলেছিলেন, অমন কাঠ হয়ে পড়ে থাকবেন না, একটু লাইফ আনুন–এ অবশ্য তার চেয়েও মারাত্মক।
এ তবু একরকম। আজ দুপুরে যে সিনেমাটি দেখেছি, সেটা অসাধারণ ফিল্মের সিম্বল। কী অবস্থা যাচ্ছে বলতে গিয়ে সেদিন আপনি রসিকতা করেছিলেন যে–কে একজন আপনার পরিচিত ফিল্ম তুলছে, তার বইয়ে কোনও মৃত্যুর দৃশ্য নেই। দেখানো হল একজন লোক রাস্তা পার হচ্ছে উলটোদিক থেকে, বহুদূরে একটা গাড়ি আসছে, তারপরেই আদিগন্ত সবুজ, সতেজ ফলভারনমিত পটলক্ষেত, একজন পটল তুলছে অর্থাৎ পূর্ব দৃশ্যের পথচারীটি লরি চাপা পড়ে পটল তুলল।
এখানে অন্য একজন সাংবাদিক বললেন যে, কোনও একটা ফিল্মে নাকি দেখানো হয়েছে যে ভীষণ ভিড়ের ট্রেনে একটা লোক পকেটে অনেক টাকা নিয়ে যাচ্ছে। তার পরের দৃশ্যে একটা লোক। স্টেশনে একটা দোকান থেকে এক প্যাকেট কঁচি সিগারেট কিনল। সিজার্সের প্যাকেটটা একবার ক্লোজ আপে দেখানো হল। এর পরেই প্রথম লোকটি হায় হায় করছে, আর দ্বিতীয় লোকটি দ্রুত হাঁটছে। অর্থাৎ, প্রথম লোকটির পকেট কেটে দ্বিতীয় লোকটি পালাচ্ছে। কঁচি হল পকেট কাটার প্রতীক।
ভদ্রলোকের গল্প শুনে আমরা খুব হাসলাম। দুপুরের সিনেমা দেখে কিন্তু খুব ঘাবড়িয়ে গেলাম। জানি না, এটাও সিম্বল কিনা। দেবদারু আর পাইনের গাছ, আকাশে বিশাল পূর্ণিমার চাঁদ, নায়িকা ঘুরে ঘুরে গুনগুন করে গান গাইছেন–আশ্চর্য মোহময় পরিবেশ। এমন সময় কড় কড় কড়াৎ, বিনামেঘে বজ্রপাত। পূর্ণিমার চাঁদ আকাশ থেকে ছিটকে এসে নায়িকার মাথায় লাগল। তারপরে ডেড আউট। পরের দৃশ্যে নায়িকা হাসপাতালে, মাথায় ব্যান্ডেজ। একেই বোধ হয় বজ্রাহত বলে।
বিশ্বাস করুন, এরপরেও আরেকটা বই দেখেছি। এরকম বিশ্বস্ত সাংবাদিক আর জীবনে পাবেন। এ বইটি ক্রাইম ড্রামা। অনেকটা আমাদের বোম্বাইয়ের বইগুলোর মতো। বোম্বাইয়ের বই জানেন তো, অবশ্য আপনি খুব বেশি দেখেননি, সেই লাস্ট সিন নায়ক আর ভিলেন, জাহাজের মধ্যে রিভলভার হাতে মারামারি। দুজনের হাত থেকে রিভলভার খসে সমুদ্রে পড়ে গেল, এবার বেরুল। ছোরা। ছোরা হাতে দুই জনে জাপটাজাপটি করতে করতে ঢুকে পড়ল বয়লারের মধ্যে, সেখান থেকে মেশিনের মধ্যে দিয়ে জাহাজের চোঙার ভিতর দিয়ে আগুন আর ধোঁয়ার সঙ্গে দুজনে বেরিয়ে এল, উঠে গেল জাহাজের মাস্তুল বেয়ে। তারপর দুই জনেই পড়ল সমুদ্রের জলে। এর মধ্যে একবার সাগরের মধ্যে ক্লোজআপে একটা ক্ষুধার্ত হাঙর দেখানো হয়েছে। পড়া মাত্র হাঙর এসে ভিলেনকে ধরল, ধরেই তাকে গিলে ফেলল। ভাববেন না যেন, এইখানেই বই শেষ হল। এর পরেও আছে দশ মিনিট ধরে সাসপেন্স, নায়কের কী হল? সমুদ্রের তীর দেখানো হচ্ছে, দেখানো হচ্ছে কৃষ্ণশাড়ি পরিহিতা ব্যাকুলা নায়িকাকে দূরের জাহাজে করুণ উদাত্তস্বরে গান গাইতে, কিন্তু নায়কের কী হল? দর্শক সমাজ উৎকণ্ঠিত, ক্ষুধার্ত হাঙর নায়ককে কি ভিলেন ভেবে খেয়ে ফেলল। না তা হয় না কোনওদিন; দেখা গেল হাঙরের পিঠে নায়ক চেপে বসেছেন আর দুই হাত দিয়ে ধারালো দাঁত সমেত হাঙরের চোয়াল চিরে ফেলেছেন, হাতের মাসলগুলো ফুলে উঠেছে। দর্শক-সাধারণ হাততালি দিল, নায়িকা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। এখন সম্মুখে নিরুদ্বিগ্ন মধুর জীবন।
আমি একবার একজন পরিচালককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মশায়, ভিলেনকে হাঙর খেয়ে ফেলার পর ওই দশ মিনিট দর্শকদের ঝুলিয়ে রাখার মানে কী?
তিনি অবাক হয়েছিলেন, সে কী বুঝতে পারেননি?
আজ্ঞে না।
হাঙর আগে ভিলেনকে খেয়ে হজম করুক, তারপর নায়ক তাকে মারবে। না হলে আবার তো ভিলেন বেরিয়ে আসতে পারে, তার মানে আরও দেড় হাজার ফুট। আর বলবেন না মশায়, কাঁচা ফিল্মের যা বাজার হয়েছে।
আজ যে ক্রাইমড্রামা দেখলাম, সেটাও মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশের, তবে একটু আলট্রামডার্ন; আর সেখানে বোম্বে ফিল্মের খুব কদর। তাদেরও লাস্ট সিন ওই একই রকম, সেই জাহাজে মারামারি সেই নায়ক আর ভিলেন। কিন্তু একটু অন্যরকম। নীচে উত্তাল তরঙ্গসংকুল সমুদ্র, নায়ক আর ভিলেন ধস্তাধস্তি করতে করতে জাহাজ থেকে পড়ল, কিন্তু পরের দৃশ্যে দেখা গেল সমুদ্রের নাম গন্ধ নেই, তৃণাচ্ছাদিত বিশাল প্রান্তরে দুজনে কুস্তি হচ্ছে, একপাশে নায়িকা পঁড়িয়ে কখনও হাততালি দিচ্ছে, কখনও চোখ মুছছে।
আজ এই পর্যন্ত। ভয়ংকর দাঁতে ব্যথা করছে। ছোটবেলা থেকে লক্ষ করছি, কেন জানি না, একসঙ্গে অনেক মেয়ে দেখলে আমার দাঁতে কেন যেন খুব ব্যথা হয়। ছোটবেলায় বিয়েবাড়িতে গেলেই পরদিন দাঁতে ব্যথা হত। বড় হয়ে ব্যাপারটা ভেবে দেখেছি কিন্তু কিছু বুঝতে পারিনি। প্রথম যৌবনে আড়াই বছর মেয়েদের কলেজে মাস্টারি করেছিলাম, চারটে দাঁত তুলে ফেলতে হয়েছিল। এ বয়সে আর সহ্য হয় না। এত চিত্রতারকার ভিড়, কী ভীষণ ব্যথা করছে যে মাড়ির দাঁতগুলোয়!
সিঙ্গাপুরী নৃত্যপটিয়সী চিত্রতারকা লুনমুন কাল এক সান্ধ্যবাসরে আমাকে বলেছিলেন, বাঙালিদের ঠোঁটের গড়ন তার খুব পছন্দ। আজ এমন সময় তিনি কোথায় থাকতে পারেন তারও একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
কিন্তু দাঁতের ব্যথায় যে গেলাম, এখন এই মধ্য রাত্রির নিস্তব্ধ মরু নগরে বেরোতে হচ্ছে ডেন্টিস্টের সন্ধানে, ভালয় ভালয় ফিরলে কালকের ডাকে পরবর্তী খবর বিস্তারিত জানাব, শুভরাত্রি। ইতি—
পুঃ বাসায় বাজার খরচ দিয়ে আসিনি। দয়া করে আপনার বউদিকে গোটা পনেরো টাকা পাঠিয়ে দেবেন আর দাঁতের ব্যথার কথাটা জানাবেন না।