ফসল
“যদি নাইবা পেলাম তারে
তবে জীবন বৃথা!
পিতা মাতার কথাটা তো
ভাবতে হবে পৃথা”।
পৃথা দুঃখের পাহাড়ের চূড়ায় বসে ভাবছে সৌগতকে ছাড়া এক পল ভাবতে পারে না।কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল! হাতের আংটির দিকে তাকিয়ে পৃথা কেঁদে ওঠে। অন্তরের বিবেক কবিতার সুরে বলছে পৃথা তুমি যেটা ভাবছ সেটা করো না। তোমার মা-বাবার কথাটাতো ভাববে! তুমি চলে গেলে ওনারা কি নিয়ে বাঁচবেন!
আমি অভাগী পৃথা । আপনমনে বিড়বিড় করে বলি তাইতো যেতে পারছিনা।ওই দেখো সৌগত আমাকে ডাকছে। “পাগলী একা একা কি করছিস”!আয় এখানে বিবাহ বাসর সাজায়। সংসারের মায়া ত্যাগ করে চলে আয়।
সৌগত জানিস তোর মা বলেছেন আমি অপয়া। কেননা আমাদের আশীর্বাদের পর তাঁদের ছেলে চলে গেছে। তোকে বারবার করে বারণ করেছিলাম আর পাহাড়ে ট্রেকিং করতে যাস না।দেখলিতো আর ফিরলি না! দুমাস বাদেই ছিল আমাদের বিয়ে। জানিস আমাদের কার্ড ছাপতে দেওয়া হয়ে গেছে। তুই বলে দে সৌগত তোর পৃথাএখন কি করবে! তোর ছন্নছাড়া পৃথা আপনমনে রেললাইন ধরে এগিয়ে চলেছে।
হঠাৎ দুটো বলিষ্ঠ হাত,ছিঃ মা তুমি রেললাইনে মরতে এসেছ!! আমি বাঁচতে চাই না কাকু।তবে আমি মরবার পথ ও খুঁজে পাচ্ছি না। আমার দুমাস বাদে প্রেমের বিয়ে।এই দেখুন সৌগত আংটি পরিয়ে দিয়েছে। আমাদের ছয় বছরের প্রেম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছিল। জানেন আশীর্বাদের পর দুই বাড়ির সবাই দার্জিলিং বেড়াতে গেছিলাম।একান্তে কথা হয়েছিল হানিমুনে দার্জিলিঙে আসব। সৌগত এখন আর নেই কাকু! কাকু অবাক হয়ে আমায় জিজ্ঞেস করেন মা তোমার বাড়ি কোথায়? উত্তর দেবার আগেই আমি কাকুর গায়ে এলিয়ে পড়ি ।
চোখ মেলতেই দেখি মা -বাবা দাঁড়িয়ে আছেন।দুদিন নাকি অজ্ঞান ছিলাম কাকুর বাড়িতে। আমার হাতব্যাগে আইকার্ড দেখে বাড়িতে ফোন গেছিল। সৌগতের মা , বাবা দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি কাকুর দিকে তাকিয়ে বলি আমি অপয়া ওনার ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী। সৌগতের মা বলেন তোকে বাঁচতে হবে রে মা! বাচ্চাটা হয়ে গেলে তোকে আবার বিয়ে দেবো! আমার ছোট্ট সৌগতকে ফিরিয়ে দে মা! উদ্ধারকর্তা কাকুর মুখে শুনলাম উনি ডাক্তার। আর আমি নাকি প্রেগন্যান্ট! অবলীলাক্রমে আমার মা বললেন ভ্রূণটা নষ্ট করতে ।বিয়ে হয়নি সমাজ কি বলবে!! ডাক্তার কাকু বললেন পৃথা মা তুমি এখানেই থাকো। সব হয়ে গেলে যে বাড়িতে ইচ্ছে ফিরে যেও। দুই মায়ের মধ্যে মৌখিক যুদ্ধ চলছিল। শেষে ডাক্তার কাকু আমায় জিজ্ঞেস করলেন পৃথা তোমার ইচ্ছে কি? আমি কাঁদতে কাঁদতে বলি আমাদের মনের বিয়ে হয়েছিল। যদি নাইবা পেলাম তারে, তার উপহার সযত্নে বড়ো করতে চাই। বাবা – মা আমাকে ক্ষমা করো। কাকু ও কাকিমার যত্নে দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হতে লাগলো।এক সময় মনে হতো ভগবান আমার পৃথিবীটা কেড়ে নিয়েছে।তবে ভালোবাসার ফুল দিয়েছে।যা ফুটতে সাহায্য করছে এই কাকু ও কাকিমা।সত্যি কি দরকার ছিল ওনাদের আমার জন্য করা। আমি মৃত্যু পথযাত্রী কুড়িয়ে পাওয়া দশমাসের মেয়ে। তারপর সব মিটে গেলে চলে যেতে হবে বিনা সিঁথিতে শ্বশুর-বাড়িতে। আমার যথাসময়ে ফুটফুটে পুত্রের জন্ম হলো। আমি নিঃসন্তান কাকু-কাকিমার বাড়িতে আরেক বছরের জন্য থেকে গেলাম। অবশ্য এরকম বাড়িতে সারা জীবন থাকা যায়।
নাতি দেখতে দাদুরা ঠাম,দিদুন রোজ আসেন। ছেলে যেদিন উল্টাতে শিখল কাকু কাকিমা , দাদু,দিদা ঠামের কি যে আনন্দ। একটা বাচ্চা কত যে আনন্দ দিতে পারে কুমারী মা হয়ে বুঝতে পেরেছিলাম। ছেলের চুপিচুপি এই তিন পরিবার নিয়ে মুখেভাত হলো।মাঝে মাঝে নিজের খারাপ লাগে এইটুকু শিশুর বাবা নেই। সৌগতর মার মুখের হাসি টা ঈশ্বর প্রদত্ত লাগে।ওই উনি আমাকে অপয়া বলেছিলেন। অবশ্য একমাত্র সন্তান অকালে চলে গেলে কারর মাথার ঠিক থাকে না। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দেখি কাকু ও কাকিমার মুখে হাসি। আমি জিজ্ঞেস করি কি ব্যাপার আজ তোমাদের বিয়ের দিন নাকি! কাকিমা বলে এটা চৈত্র মাস বিয়ের মাস হয় নাকি! কাকিমা কাকু কে বলছেন এই বলি পৃথাকে, কাকু বলছেন একদম না। আমি বোকার মতো হেসে বলি কি ব্যাপার আজ তোমাদের প্রেম দিবস নাকি! কাকিমা বলে না সোনা আমরা আগের দিনের লোক ,মা বাবা যা দেখে দেবেন,তাকেই বিয়ে করতে হবে! আমি বলি কাকিমা সেটাই ভালো ছিল গো। দেখছো তো আমার কপাল! কাকিমা বলেন তোর কপাল খুব ভালো মা। আমি বলি তা তো দেখতেই পাচ্ছো।তবে তোমাদের মতো কাকু ও কাকিমা পেলাম। ইচ্ছে করে তোমাদের ও মা -বাবা বলি। কাকিমা কেঁদে বলেন বলবি রে আমায় মা! কোনো দিন এই ডাকটা শুনিনি রে! আবেগ মুহূর্তে হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে। কাকিমা বলেন যা যা খোল দরজা।তোর চমক দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলতেই দেখি দাঁড়িয়ে আছে একজন সুপুরুষ। আমি হাউমাউ করে চিৎকার করে বলি ৬ সৌগত তুমি বেঁচে আছো! পিছনে হৈ হৈ করছে দুই বাড়ির বাবা’রা ও মা ‘রা। সত্যি আমি ভাগ্যবতী তিনটি করে বাবা ও মা পেলাম। সৌগত ট্রেকিং এ গিয়ে দুর্ঘটনা হয়েছিল । তবে কোমা থেকে জ্ঞান ফেরে একবছর পর। অতীত ভুলে গেছিল। তিনদিন আগে চোখের সামনে দুর্ঘটনা দেখে পুরনো স্মৃতি ফিরে আসে। হঠাৎ ঘরে কান্নার আওয়াজ। সবাই ঘরে ছুটে যায়। গিয়ে দেখি বাবা ও ছেলে কেঁদে কেঁদে কত কথা চলছে। বিয়ের পর পাড়াপড়শির নানা কথার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কাকু ও কাকিমার বাড়িতে থেকে যায়। ছেলেটার মুখ চেয়ে এইটা করবার সিদ্ধান্ত আমরা স্বামী ও স্ত্রী মিলে নিই।দিব্যি সৌগত ও আমার মতো কাকু ও কাকিমাকে বাবা ও মা বলছে। এমনি করে দিন যাক না!!