প্রেমশশী
বিয়ের পর পনেরোটা দিনও কাটেনি প্রেমকিশোর বন্ধুদের কাছে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ভাই, তোরা আমায় ত্রিশূল পর্বতের একটা টিকিট কেটে দে, আমি পাহাড়ে চলে যাব।
ত্রিশূল পর্বতটা কোথায় বন্ধুদের কারও জানা ছিল না। গুহ জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় কাজ করে, ভারতবর্ষের মানচিত্রটা তার মোটামুটি জানা—সেই গুহও বলল, একজ্যাক্ট লোকেশানটা কোথায় ত্রিশূলের?
প্রেমকিশোর বিরক্তির চোখে গুহর দিকে তাকাল।
সুবীর হাজরা আর মন্মথ প্রেমকিশোরকে ভাল করে নজর করতে লাগল। পনেরো দিনেই প্রেমকিশোর রং-ওঠা জামার মতন মেড়মেড়ে মেরে গেছে, তার মুখে জেল্লা নেই, মাথার চুলে হেয়ার-ক্রিমের পালিশ নেই, গাল-টাল শুকনো, চোখ গর্তে ঢুকেছে। দেখলে মনে হচ্ছে, ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রি থেকে সদ্য উঠে এসেছে।
সুবীর হাজরা জীবনের নানা ব্যাপারে অভিজ্ঞ। প্রেমকিশোরের প্রায়-বিধ্বস্ত চেহারা খুঁটিয়ে নজর করতে করতে বলল, “বুঝেছি দি সেম প্রবলেম। আমাদের বঙ্কিমের মতন। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলি বুঝি?” বলে সুবীর একটু টেরচা চোখে হাসল।
মন্মথ বলল, “আমরা তো জানতাম তুই বউ নিয়ে হনিমুন করে বেড়াচ্ছিস। পুরী যাবি বলেছিলি না?”
প্রেমকিশোর বুক ভাঙা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হনিমুন কোথায় ভাই, আমার হনি গন, —আর মুন ভ্যানিশ হয়ে গেছে।”
গুহ ভড়কে গিয়ে বলল, “হনি গন মানে কি রে? বউ পালিয়ে গেছে নাকি?” প্রেমকিশোর বলল, “না, বউ পালায়নি। আমি পালাব। ।’’
সুবীর বলল, “কি আজেবাজে কথা বলছিস! তুই পালাবি কেন? কী হয়েছে তোর! বিয়ের পর প্রথম প্রথম ছেলেদের ও-রকম একটু হয়। ওটা নার্ভাসনেসের ব্যাপার। মালটি-ভিটামিন খা, আর দুটো আসন কর, ঠিক হয়ে যাবে।”
প্রেমকিশোর প্রবলভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল; “না না, তা নয় ; বঙ্কিমের কেস না। সে-কেস অনেক ভাল ছিল। আমার কেস কোয়াইট ডিফারেন্ট। আমি আর বাঁচব না।”
মন্মথ বন্ধুর অবস্থা দেখে বলল, “তুই অত কাহিল হয়ে পড়ছিস কেন। ব্যাপারটা কী খুলে বলবি তো! আমরা এতগুলো ম্যারেড লোক রয়েছি; সিজন্ড, তোর প্রবলেম সল্ভ করতে পারব না? আলবাত পারব। কী হয়েছে বল?”
গুহ বলল, “তুই একটু জল খেয়ে নে প্রেম, সুস্থ হয়ে নে। শুধু জল খাবি, না জলবৎ ব্র্যান্ডি খাবি? দুই তোকে খাওয়াতে পারি।” বলে গুহ হাসল।
প্রেমকিশোর অভিমান করে বলল, “আমায় কিছু খাওয়াতে হবে না ভাই, নিমতলায় যাবার পর দু ফোঁটা গঙ্গার জল দিস, তা হলেই হবে।”
মন্মথ জিভ কেটে বলল, “ছি ছি, বলছিস কি! এখন তুই ম্যারেড, সবেই লাইফ শুরু করেছিস,…কত সুখ আহ্লাদ পড়ে আছে জীবনে।”
বুকে হাত রেখে প্রেমকিশোর বলল, “আমার জীবনে আর কিছু নেই। এখন একটা খাঁচায় পোরা বাঁদর বনে গিয়েছি।”
সুবীর বলল, “বাজে বকিস না। তোর মাথায় শর্ট সার্কিট হয়ে গেছে। সব ঠিক করে দেব। এই গুহ, চা বলে আয় ভেতরে।”
গুহ বাড়ির মধ্যে চায়ের কথা বলতে গেল।
প্রেমকিশোরের বিয়ের একটা ইতিহাস আছে। তার বন্ধু—বান্ধবরা আটাশ ত্রিশ বড় জোর বত্রিশের মধ্যে বিয়ে করে ফেললেও প্রেমকিশোর সাঁইত্রিশ বছর বয়েস পর্যন্ত অনড় অটল থেকে গেল। তার কারণ প্রেমকিশোরের বাল্যকাল থেকেই কেমন একটা প্রেম-প্রেম বাতিক হয়েছিল। তার বাল্যসঙ্গিনী ছিল পাশের বাড়ির লাবণ্য—ডাক নাম লাবু। প্রেমকিশোর সেভেন ক্লাসে পড়ার সময় সাপ-লুডো খেলতে খেলতে একদিন লাবুকে মনোচোর বলেছিল ; তার ফলে লাবু প্রেমকিশোরের হাতে এমন কামড় কামড়েছিল যে বেচারি প্রেমকিশোরকে এ টি এস নিতে হয়েছিল। ‘মনোচোর’ শব্দটা প্রেমকিশোর নজরুলের গানে শুনেছিল। মানেটা বোঝেনি। যাই হোক, বাল্যপ্রেমে এই ভাবে বিচ্ছেদ ঘটে। কৈশোরে প্রেমকিশোর তার এক পিসির ভাশুরঝির প্রেমে পড়ে। সেই মেয়েটির নাম ছিল হাসি। হাসি যত না হাসত তার চেয়ে বেশি কাঁদত। একবার শিয়ালদায় রথের মেলায় প্রেমকিশোর হাসিকে নিয়ে রথ দেখতে গিয়েছিল। রথ দেখতে গিয়ে সে তার কিশোরী প্রেমিকা হাসিকে এত বেশি তেলেভাজা খাইয়েছিল যে হাসি পেটের ব্যথায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডাক ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে। তার কান্না শুনে লোকজন ভিড় করতে থাকল, শেষে পুলিশ এসে দাঁড়াল। হাসি রাস্তায় উবু হয়ে বসে বমি করে অনবরত, আর আঙুল দিয়ে প্রেমকিশোরকে দেখায়, বলে, ওই ছেলেটা—ওই ছেলেটা—। যাই হোক, প্রেমকিশোর খুব বেঁচে গিয়েছিল। কলেরা হতে হতে হাসিও বেঁচে গেল। কিশোর প্রেমটাও রথের মেলায় ভেঙে গেল প্রেমকিশোরের। তারপর যৌবনে প্রেমকিশোর বার তিনেক নিজেকে লটকে ফেলার চেষ্টা করেছে, একবার বেণুর সঙ্গে ; পরের বার সুরূপার সঙ্গে ; আর শেষ বার আইভির সঙ্গে। বেণুর বাবা প্রেমকিশোরের পিছনে তাঁদের বিশাল অ্যালসেশিয়ানকে লাগিয়ে দিয়েছিলেন, ফলে প্রেমকিশোর বেণুদের বাড়িতে ঢুকতেই পারল না। সুরূপার বেলায় প্রেমকিশোর একদিন ট্যাক্সি করে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিল সুরূপাকে নিয়ে। সন্ধেবেলায় রেড রোডে গাড়ি গেল খারাপ হয়ে, অ্যাক্সেল গেল ভেঙে। ড্রাইভার বলল, বাবু তোমরা একটু গাড়িটা দেখো। আমি মিস্ত্রি ডেকে আনছি। ডাইভার গেল তো গেল, আর আসে না। প্রথম প্রথম প্রেমকিশোরের ভালই লাগছিল—এমন নির্জনে নিরিবিলিতে সুরূপাকে পাওয়া ভাগ্যের কথা। একটু চঞ্চল হয়ে সুরূপাকে প্রেম-ট্রেমের কথা বলতে গিয়েই ধাক্কা খেল প্রেমকিশোর। সুরূপা বলল, এ সমস্ত তোমার চালাকি! তুমি ড্রাইভারের সঙ্গে সাঁট করেছ। ছোটলোক, অসভ্য, ইতর। দাঁড়াও না, পুলিশের গাড়ি এবার এলেই আমি হাত দেখাব। তোমায় আমি দেখাচ্ছি।…
সুরূপার হাতে পায়ে ধরে প্রেমকিশোর বাঁচল। একটা প্রাইভেট গাড়ি থামিয়ে চলে গেল সুরূপা; আর প্রেমকিশোর ট্যাক্সির মধ্যে ভূতের মতন বসে থাকল। ঘণ্টা দুই পরে ট্যাক্সিঅলা ফিরল, বলল, আমার সর্বনাশ হল বাবু, আপকো তো মজা হল, থোড়া জাদা টাকা ছাড়ন, পঁচাশ…। প্রেমকিশোর নাক কান মলে পালাল। শেষে এল আইভি। নাচ জানত। প্রেমকিশোরকে মাস কয়েক বেশ নাচাল, তারপর একদিন প্রেমকিশোরকে দিয়েই বম্বের একটা ফার্স্ট ক্লাস টিকিট কাটিয়ে বম্বে চলে গেল ফিল্মে চান্স খুঁজতে।
প্রথম থেকে পর পর এতগুলো ধাক্কা খাবার পর প্রেমকিশোর নারী—বিদ্বেষী হয়ে উঠল। প্রতিজ্ঞা করল, বিয়ে করবে না। মা যতদিন বেঁচে ছিল বিয়ে বিয়ে করত, মা মারা যাবার পর সেদিক থেকেও নিশ্চিন্ত। বাবা আগেই গিয়েছেন। নিজের বলতে আর কেউ নেই। ছোট বোন বিয়ের পর মাদ্রাজে থাকে। আসেও না। নির্ঝঞ্ঝাটে ছিল প্রেমকিশোর; বাপের আমলের ছোট্ট বাড়ি, আর বেসরকারি অফিসে চাকরি—চমৎকার ছিল।
বন্ধুবান্ধবদের বিয়ে হয়ে যেতে লাগল, বিয়ের পর বাচ্চাকাচ্চা; তাদের নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখত প্রেমকিশোর আর হাসত, বলত, নে এবার ঠেলা বোঝ ; আমি আমার লর্ড হয়ে আছি। বন্ধুরা প্রেমকিশোরকে বিয়ের উপকারিতা সম্বন্ধে বোঝাত, জ্ঞান দিত, ফুঁসলাবার চেষ্টা করত। প্রেমকিশোর বলত, তোমরা লেজ কেটেছ, বেশ করেছ, আমি লেজ কাটছি না, ভাই।
গত বছর প্রেমকিশোর হুট করে এক বড় অসুখে পড়ল। ভুগল মাসখানেক। বন্ধুবান্ধব তাদের স্ত্রীরা প্রেমকিশোরের দেখাশোনা করল। বাড়ির চাকরটা কত আর পারবে। অসুখ থেকে উঠে প্রেমকিশোরের মনোভাব খানিকটা পালটে গেল। বছর সাঁইত্রিশ বয়েস হয়ে গেল, দেখতে দেখতে চল্লিশ হবে, তারপর চল্লিশের ওপারে হেলে পড়বে। আফটার ফরটি মানেই দাঁত আলগা হওয়া, চুল উঠে যাওয়া, চোখে দোতলা চশমা পরা, ব্লাড সুগার আর প্রেশারের জন্যে উৎকণ্ঠা, মানে ‘শেষের সে-দিনের জন্যে’ ঘন ঘন তাকানো।
অসুখের পর প্রেমকিশোর মনে মনে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুদের স্ত্রীর খোঁজ-খবর নেওয়া, সেবাযত্ন করা, পাশে বসে গল্প করা, এই সব দেখে শুনে তার মনে হল, বিয়ের একটা প্রয়োজন আছে। হাজার হোক, বউ থাকা মানে একজন কেউ থাকা, সে অন্তত প্রেমকিশোরকে দেখাশোনা করতে পারবে, অসুখ-বিসুখে মাথার কাছে বসে থাকবে, আর প্রেমকিশোর মারা যাবার পর অন্তত এই বাড়িটার মালিক হবে।
প্রেমকিশোর বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। বন্ধুদের বলল, বেশ, বিয়ে আমি করব। কিন্তু মেয়ে নয়—মহিলা। বয়েস মিনিমাম পঁয়ত্রিশ হতে হবে। মোটামুটি দেখতে হলেও চলে যাবে, তবে মোটা চলবে না। জাতের ব্যাপারে আমার কোন প্রেজুডিস নেই। মহিলাকে শিক্ষিতা হতে হবে। আর আমার অন্য শর্ত, বাপের বাড়ির গুষ্টি আমি অ্যালাও করব না।
বন্ধুরা বলল, ঠিক আছে; একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে দি—দেখা যাক।
তিন মাসে তিন রবিবার বাংলা কাগজে প্রেমকিশোরের বিয়ের পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন বেরুল। চিঠি এল শ’ দেড়েক। বন্ধুরা সর্ট করল, চিঠি পড়ল, আলোচনা করল, কোন মেয়েকেই পছন্দ হল না প্রেমকিশোরের।
দেখতে দেখতে আরও মাস দুই কাটল। এমন সময় আচমকা প্রেমকিশোরই ইংরেজি কাগজ থেকে এক বিজ্ঞাপন এনে হাজির করল। এমন বিজ্ঞাপন সচরাচর চোখে পড়ে না, আদপেই পড়ে কি না কে জানে, মেয়েপক্ষ নিজেই নিজের বিজ্ঞাপন দিয়েছে।
ব্যাপারটা প্রেমকিশোরকে খুবই রোমাঞ্চিত করেছিল। এই তো হওয়া উচিত। কোন ন্যাকামি নেই, একেবারে সোজাসুজি ব্যাপার। মেয়ে লিখেছে: ‘আমার বয়েস ছত্রিশ, ডক্টরেট করার পর আমি আরও রিসার্চ করছি, আমার গায়ের রং এবং চেহারা সাধারণ। যে কোন ভদ্রলোক, বয়েসে অন্তত আমার সমবয়স্ক হবেন, এক আধ বছরের ছোটতেও আপত্তি নেই। অবশ্যই তিনি শিক্ষিত ও উপার্জনসক্ষম হবেন, বিবাহের ব্যাপারে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। পছন্দ হলে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে আলাপ-পরিচয় করব।’
বন্ধুরা বিজ্ঞাপন দেখে রীতিমত ভড়কে গিয়েছিল। বলেছিল, এ তো মাইরি ডেঞ্জারাস মহিলা।
প্রেমকিশোর বলেছিল, এমন মেয়েই আমি সারা জীবন ধরে খুঁজছি। স্ট্রেট, ডিরেক্ট, প্রোগ্রেসিভ।…তোদের ন্যাকামি নেই, লজ্জা নেই, বাজে টলানি নেই। একেই শালা মডার্ন ক্যারেকটার বলে। রিয়েল লিব মুভমেন্ট।
বন্ধুরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বলল, তা হলে লেগে পড়।
প্রেমকিশোর লেগে পড়ল। চিঠি লিখল পোস্ট বক্স-এর নম্বরে। দিন কুড়ি বাইশ পরে জবাব পেল। নাচতে নাচতে বন্ধুদের এসে বলল, ইন্টারভিউতে ডেকেছে রে। পার্ক স্ট্রিটে চিনে দোকানে ইন্টারভিউ হবে।
গুহ বলল, “জেনারেল নলেজের বইটা পড়ে যাস।”
প্রেমকিশোর বলল, “হ্যাত, আমি তার চেয়েও একটা টেরিফিক বই পড়ছি, আমেরিকান বই। কী নাম জানিস? হাউ টু উইন এ উইমেন ইন বেড অ্যান্ড আউট অফ বেড?”
গুহ বলল, “বেডটাও কি সাজিয়ে ফেলেছিস?”
প্রেমকিশোর বলল, “ডোন্ট বি ভালগার। সি ইজ এ লেডি…মাইন্ড দ্যাট।”
এরপর মাস দেড়েকের মধ্যে প্রেমকিশোর রেজেস্ট্রি করে বিয়ে করে ফেলল। বন্ধু আর বন্ধুর স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের ভূরিভোজ দিল। বাড়িতেই। তার স্ত্রীকে দেখলেই সমীহ করতে ইচ্ছে করে। মোটামুটি লম্বা চেহারা, ছিপছিপে গড়ন, চোখে মোটা চশমা, ভীষণ সিরিয়াস মুখ, ধারালো চোখ, নাকটা লম্বা, মাথার চুল বব করা। কথার মধ্যে দু-চারটে হিন্দি চলে আসে। শাড়ির চেয়ে ঢিলে প্যান্ট আর মেয়ে-শার্ট পরতে পছন্দ করে বেশি। নাম, শশিকলা।
শশিকলা নামটা বন্ধুদের পছন্দ হয়নি। এ আবার কি নাম? পুরানো।
প্রেমকিশোর বলল, “শুধু শশী বলবি। কী সুন্দর। ও আবার হিন্দি দেশেই মানুষ কি না—ওই রকমই নাম—ওরা বলে শাশি…”
মন্মথ বলল, “ভালই হয়েছে। প্রেম-শশী। তোরা মিলে যা ভাই, আমরা চক্ষু সার্থক করি।”
সেই ঘটনার পর আজকের এই ঘটনা। প্রেমকিশোর বিয়ের দশ বারো দিনের মাথায় রক্ত-আমাশায় ভোগা রোগীর মতন চিঁ চিঁ করতে করতে ছুটে এসেছে বন্ধুদের কাছে। এই কদিন যে বন্ধুরা খোঁজখবর নেয়নি, তার কারণ, প্রেমকিশোর বলে রেখেছিল সে নতুন বউ নিয়ে হনিমুন করতে পুরী ওয়ালটেয়ার যাবে। বন্ধুরা ভেবেছিল, প্রেমকিশোর কলকাতায় নেই, প্রেম-মিলন করে বেড়াচ্ছে সমুদ্রের ধারে ধারে।
দুই
বাড়ির ভেতর থেকে চা এসে গিয়েছিল।
চা আর সিগারেট খেতে খেতে সুবীর বলল, “এবার ব্যাপারটা বল?”
প্রেমকিশোর আস্তে আস্তে চা খাচ্ছিল। সিগারেট ধরিয়ে নিল একটা। তারপর বলল, “সব কথা বলতে হলে মহাভারত হয়ে যাবে। অত কথা বলতে পারব না, সময় নেই। ঘণ্টা দুয়েকের ছুটি নিয়ে পালিয়ে এসেছি।”
‘ছুটি নিয়ে পালিয়ে এসেছি মানে?” মন্মথ জিজ্ঞেস করল।
“আর বলিস না ভাই, আমি এখন হিউম্যান গিনিপিগ। চব্বিশ ঘণ্টা ওই মেয়েছেলের অবজারভেশানে আছি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। একেবারে চোখে চোখে রেখেছে।”
বন্ধুরা হাঁ হয়ে গেল। পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। এ রকম হবার কথা নয়। তবে কি শশিকলা তার ছত্রিশ বছরের জমানো প্রেম দিয়ে প্রেমকিশোরকে জমিয়ে ফেলতে চাইছে? এ তো ভাবাই যায় না আজকালকার দিনে। এক মুহূর্তও চোখের আড়াল হতে দেবে না, হলেই অচেতন হবে—এসব বৈষ্ণব কাব্যে হত! দারুণ ব্যাপার তো!
সুবীর বলল, “তুই বলছিস কি, প্রেম? এ তো তোর ভাগ্য! ছত্রিশ বছর বয়েসের মহিলা, তুই তার ফার্স্ট হাজবেন্ড অ্যান্ড লাভার! ভেবে দেখ, যৌবন যায়-যায় বলে কেমন সলিড প্রেমে তোকে ধরে রাখতে চাইছে শশী।’’
প্রেমকিশোর ক্ষুন্ন হয়ে বলল, “যথেষ্ট হয়েছে ভাই, কাটা ঘায়ে আর নুনের ছিটে কেন?”
মন্মথ হাত তুলে বন্ধুদের বলল, “দাঁড়া, তোরা চুপ কর। আমি ব্যাপারটাকে বুঝি।’’বলে সে প্রেমকিশোরের দিকে তাকাল, বলল, “শশী তোকে চব্বিশ ঘণ্টা চোখে চোখে রাখছে এইটেই তোর মেইন কমপ্লেন?”
“হ্যাঁ, আমার আরও হাজারটা কমপ্লেন আছে।’’
“একটা একটা করে বল। নয়ত গুলিয়ে ফেলব।…তোর অফিস কবে?”
“এক মাস ছুটি নিয়েছিলাম। মাত্র পনেরো দিন হয়েছে। আরও পনেরো দিন-মর্নিং টু নাইট ওর কাছে থাকতে হবে। বাবা গো, আমি মরে যাব।”
গুহ বলল, “গোড়া থেকে শোনাই ভাল, মন্মথ। আমার মনে হচ্ছে, প্রেম নিজের মতন করে বলুক। তার যেখান থেকে ইচ্ছে।”
সুবীর বলল, “সেই ভাল। …প্রেম, তুই প্রথম থেকে—তোর যা বলতে ইচ্ছে করে। বল। আমরা শুনছি।”
প্রেমকিশোর চা শেষ করল। একটা সিগারেট শেষ করে আরও একটা ধরিয়ে নিল। তারপর করুণ মুখ করে বলল, “ভাই, প্রথম দিন, দি ভেরি ফার্স্ট নাইট আমরা তো তোদের মতন ফুলশয্যা করিনি। তবু কিছু ফুল-টুল ছিল, নতুন চাদর, নতুন বালিশ, সেন্ট-টেন্ট একটু ছড়িয়ে দিয়েছিলাম বিছানায়। তোরা সব খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চলে এলি, আমরা সাড়ে এগারোটা নাগাদ বিছানায় এলাম। আমার বুকের মধ্যে একটা টেনিস বল যেন লাফাচ্ছিল ভাই। রিয়েলি, কেমন যেন আবেশও লাগছিল, আবার নার্ভসও লাগছিল। সেই যে বইটা পড়েছিলাম, হাউ টু উইন এ উইমেন ;সেই টেকনিকে প্রথমেই খুব স্মার্ট ভাবে শশীকে বললাম, তোমার জন্যে দুটো জিনিস কিনে রেখেছি—বলে দামি পোখরাজ বসানো একটা আংটি, আর সাদা পাথর বসানো কানের গয়না ওর হাতে তুলে দিলাম। আংটিটা পরিয়ে দিলাম। কানের গয়নাটা শশী রেখে দিল। শুরুটা ভালই হল। দুজনে বিছানায় বসলাম। দু-পাঁচটা কথা হল। আমি বেশ হেসে হেসে কথা বলছিলাম। হঠাৎ ভাই শশী আমায় কি বলল জানিস?”
“কী?’’
“বলল, মানে আমায় জিজ্ঞেস করল, তোমার অত চোখ পিটপিট করে কেন? মিনিটে তিরিশ বার?”
সুবীর বলল, “সে কি রে?”
প্রেমকিশোর বলল, “হ্যাঁ ভাই, ফর গডস সেক, ওই কথা বলল। বলার পর আমার চোখ পিটপিট বেড়ে গেল; মিনিটে থার্টি থেকে বাড়তে বাড়তে ফর্টি ফিফটি হয়ে গেল।”
“তারপর?”
“তারপর আরও একটা ব্লো মারল।”
“ব্লো? মানে ঘুঁষি।”
“ঘুঁষি নয়, দাবড়ানি। বলল, কথা বলার সময় তোমার খানিকটা তোতলামি আছে, তুমি প্রপার ওআর্ড মনে করতে পারো না, ইউ মিস ইট। হোয়াই?”
মন্মথ বলল, “যাঃ বাব্বা। ফুলশয্যা করতে বসে এই ডায়লগ?”
প্রেমকিশোর পরম দুঃখীর মতন বলল, “হ্যাঁ, ভাই, এই ডায়লগ। রাত দেড়টা পর্যন্ত আমার ডিফেক্ট সম্পর্কে কত রকম কি শুনতে হল। তারপর বাতি নিভিয়ে শুলাম।”
গুহ এবার একটু গলা ঝাড়ল।
প্রেমকিশোর মাথা নেড়ে বলল, “গলা ঝাড়ার দরকার নেই। যা ভাবছ তা নয়। আমি তখন এত নার্ভাস হয়ে গিয়েছি একটার পর একটা অ্যাটাকে যে আমার কোলাপ্স করার অবস্থা। একেবারে শালা ডেড হয়ে শুয়ে থাকলাম। আর শশী একেবারে চাঁদের মতন ঢলে পড়ল। ও দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ল। আমি সারারাত জেগে থাকলুম।”
গুহ বলল, “টাচ লাইনের বাইরে বেরুতে পারলি না?”
“টাচই হল না তো বাইরে!”
কেসটা যে রীতিমত গোলমেলে সুবীর হাজরা যেন তা বুঝতে পারল। বুঝে চুপ করে থাকল।
প্রেমকিশোর তার মাথার রুক্ষ চুলে আঙুল চালাল। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলল। বুকে হাত বোলাল।
মন্মথ বলল, “পরের দিন কী হল?”
“পরের দিন সকাল থেকেই আমার ওপর অবজারভেশান শুরু হয়েছে।’’
“মানে?”
“মানে আমার হাঁটা, চলা, কথা বলা, দাঁত মাজা, খাওয়া, শোওয়া, জামাকাপড় পরা, তাকানো সব এখন শশিকলার অবজারভেশানে রয়েছে।”
“কেন?”
“শশী সাইকোলজি নিয়ে ডক্টরেট করেছে।”
“কোন ইউনিভার্সিটি?”
“বিদর্ভ গন্ধর্ব কোন একটা জায়গা থেকে হবে। বছর কয়েক ওদিকেই কোথাও সাইকো-অ্যাট্রিস্ট হিসেবে কাজ করেছে। তারপর কলকাতায় এসেছে। এখন ওর হায়ার রিসার্চ চলছে।”
“হায়ার রিসার্চ?”
“তাই তো বলে ভাই, বিয়ের পর পাঁচ বাক্স বই, দু বাক্স কাগজপত্র, এক বাক্স নানা ধরনের খেলনা টাইপের জিনিস আর সব কি কি এনেছে।”
“এখন কী তোকে নিয়ে রিসার্চ করছে?”
“হ্যাঁ ভাই। আমি এখন শশিকলার হিউম্যান গিনিপিগ। চব্বিশ ঘণ্টা পিছনে লেগে আছে।”
সুবীর কপালে করাঘাত করে বলল, “সর্বনাশ!”
প্রেমকিশোর বলল, “শুধু সর্বনাশ নয়, আমার জীবননাশ হতে বসেছে।”
গুহ মাথা চুলকে বলল, “তোকে নিয়ে কী রিসার্চ করছে, প্রেম? রিসার্চের সাবজেক্টটা কী?”
প্রেমকিশোর বলল, “ভাই, আমি সাইকোলজির কিছু বুঝি না। তবে কথাবার্তা শুনে যা মনে হয় মানুষের ডেন্টাল ফরমেশান তার হিউম্যান নেচারকে ইনফ্লুয়েন্স করছে—সেই নিয়ে এক গবেষণা।”
কথাটা শোনামাত্র তিন বন্ধু এক সঙ্গে আঁতকে উঠল। আঁতকে উঠে তিনজনেই তাদের দাঁত উন্মুক্ত করে বসে থাকল।
প্রেমকিশোর বলল, “ব্যাপারটা আমিও বুঝি না। তবে শশীর কথা থেকে মনে হয়, মানুষের দাঁতটাই আসল; দাঁত দেখে তার স্বভাব প্রকৃতি—ফিজিক্যাল অ্যান্ড মেন্টাল, দুইই বলে দেওয়া যায়।”
সুবীর বলল, “বলিস কী! দাঁত দেখে শুনেছি ঘোড়ার বয়েস আন্দাজ করা যায়। আমরা কী ঘোড়া?”
প্রেমকিশোর সদুঃখে বলল, “ঘোড়াও ভাল; আমরা ঘোড়ারও অধম; গাধা।”
গুহ আর মন্মথ দাঁতে দাঁত বাজাল। দেখল, দাঁতগুলো শক্ত না নরম।
মন্মথ বলল, “তোকে কী করতে হয়? বউয়ের কাছে দাঁত বের করে বসে থাকতে হয়
মাথা হেলিয়ে প্রেমকিশোর বলল, “একজ্যাক্টলি। সকালে ঘণ্টা দেড়েক; দুপুরে ঘণ্টাখানেক। আর রাত্রে কম করেও দু’ ঘণ্টা।”
সুবীর উৎকট এক শব্দ করল। মনে হল, যেন বাব্বা বলল। তারপর ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে থাকিস একটু দেখা তো।”
প্রেমকিশোর বলল, “কী ভাবে আর থাকব! শশী চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে থাকে, টেবিলে দিস্তে দিস্তে কাগজ, হাতে কলম। আমি হাত তিনেক দূরে একটা টুলের ওপর দাঁত বের করে বসে থাকি। কখনো তার দিকে তাকাই, অবশ্য তাকাতে বললে, আর না হয় জানলার দিকে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে।…শশী দেখে আর কাগজে কি লেখে। দেখে আবার লেখে। মাঝে মাঝে এসে ফরসেপ দিয়ে মাড়ি উঠিয়ে ভেতর দিকের দাঁত দেখে যায়।”
বন্ধুরা থ মেরে গেল। এমন ঘটনা তারা জীবনে শোনেনি। মাথায় কিছু আসছিল না।প্রেমকিশোরের দুঃখে তারাও বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল।
প্রেমকিশোর বলল, “এখন বল, আমি কী করি! আমার ত্রিশূল পর্বতে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।…সাধে কি ব্যাচেলার ছিলাম।”
কথাটা ঠিকই। প্রেমকিশোর যতদিন অবিবাহিত ছিল, বেশ ছিল, বিয়ে করেই ডুবল। শুধু ডুবল নয়। পনেরো দিনেই যে হাল তাতে এই অবস্থা চলতে থাকলে মাসখানেকের মধ্যেই ওকে নিমতলায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে।
তিন বন্ধুই গুম। মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। প্রেমকিশোরের এই বিপদে কি করবে, বুঝে উঠতে পারছে না।
শেষে মন্মথ প্রেমকিশোরের ওপরই চটে গেল। বলল, “তখনই তোকে বলেছিলাম, এইসব বিয়ে করিস না। মেয়েছেলে নিজের বিয়ের বিজ্ঞাপন নিজে দিচ্ছে, ব্যাপারটা গোলমেলে। তুই বেটা এমন উজবুক, আমাদের কথা শুনলি না, দারুণ দারুণ বলে নাচতে লাগলি। এখন বোঝ, সামলা তোর শশিকলাকে। দন্ত শোভা প্রদর্শন করে বসে থাক।” রাগের মাথায় মন্মথ ভাল ভাল বাংলা বলে ফেলল। এক কালে কাব্যচর্চা করতে বলেই বোধহয়।
প্রেমকিশোর অপরাধীর মতন বলল, “ভাই, যা করেছি ভুল করেছি। গাধার মতন কাজ করেছি। আর করব না। কিন্তু এখন আমার কী হবে? হয় ত্রিশূল, না হয় সুইসাইড। সুইসাইড করতে আমার ইচ্ছে নেই। বড় পেইনফুল। মারা যাবার পরও কাটাকাটি করবে। শরীরটাকে আমি মুদ্দাফরাসের হাতে দিতে চাই না।”
সুবীর বলল, “শোন, তোর প্রবলেমটা ভেরি ডিফিকাল্ট। ঝট করে ভেবে কিছু বলা যাবে না। লেট আস থিংক ওভার দি ম্যাটার। আমরা ভাবি। আলোচনা করি। পরে তোকে একটা কিছু বলব। কী বল, গুহ?”
গুহ বলল, “হ্যাঁ, ব্যাপারটা কঠিন। ভাবতে হবে।”
“তোরা আমায় ধাপ্পা দিচ্ছিস?” প্রেমকিশোর সন্দেহ প্রকাশ করল।
“না, না, ধাপ্পা দেব কেন! তুই আমাদের পুরনো বন্ধু। তোর লাইফ মিজারেবল করে একটা মেয়ে পার পেয়ে যাবে—তা হয় না। এটা চ্যালেঞ্জ। আমরা পুরুষ হয়ে একটা মেয়ের বাঁদরামির কাছে হেরে যাব?”
“বাঁদরামি বলিস না ভাই”, প্রেমকিশোর বাধা দিয়ে বলল, “হাজার হোক লিগাল ওয়াইফ।’’
“যা যা বাজে বকিস না; ওয়াইফের নিকুচি করেছে। তুই শনিবার আয়।” “কেমন করে আসব?”
“ধাপ্পা মেরে আসবি শালা। আমরা থাকব। তখন তোকে বলব কী করা যায়। বুঝলি ?…আর দেরি করিস না, পালা। তোর শশিকলা নাইট সিটিংয়ের জন্যে বসে আছে।”
প্রেমকিশোর উঠে পড়ল। দু’ ঘণ্টার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। ঘড়ি দেখল। তারপর বলির পাঁঠার মতন কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল, “ভাই, তোরাই আমার শেষ ভরসা। যা হয় করিস। হয় বাঁচাস, না হয় মেরে ফেলিস। আচ্ছা যাই।”
প্রেমকিশোর চলে যাবার পর তিন বন্ধু পরস্পরের দিকে তাকাল। তিনজন তিনজনকে দাঁত দেখাল। তারপর গালে হাত দিয়ে বসে থাকল।
তিন
প্রেমকিশোর যা বলেছিল সেটা যে মিথ্যে নয়, পরের দিনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে সেটা বোঝা যাবে।
পরের দিন সকালে প্রেমকিশোর ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গেল। ফিরে এসে চা খেতে বসল বারান্দায়।
টেবিলে চা সাজিয়ে শশিকলা বসে ছিল। বারান্দায় যথেষ্ট আলো রয়েছে; রোদও এসেছে। ছোট টেবিল। আলো আর রোদ যেদিকে বেশি প্রেমকিশোরের বসার চেয়ার সেদিকেই। উল্টো দিকে শশিকলা বসে আছে। তার একপাশে টেবিলের ওপর কিছু সাদা কাগজ ক্লিপ দিয়ে আঁটা। পাশে একটা ফাউন্টেন পেন। টেবিলে চায়ের পট, দুধ, চিনি ; আর তিন চার রকম খাবার। একেবারে কড়কড়ে টোস্ট ; এক প্লেট শক্ত মটর, গোটা চারেক কলা। সকালে কি কি খাবে প্রেমকিশোর শশিকলা ঠিক করে রাখে আগে থেকেই।
প্রেমকিশোর চেয়ারে বসে গোবেচারার মতন মুখ করে হাসল একটু। তারপর দু’ পাটি দাঁত বের করে বসে থাকল।
শশিকলা ডাক্তারের মতন তীক্ষ্ণ চোখ করে দাঁত দেখল। তারপর বলল, “ক’ দাফে করেছ? টু অর থ্রি?”
প্রেমকিশোর আঙুল তুলে দুই দেখাল।
“আই টোল্ড ইউ টু মেক থ্রি। মনে থাকে না?”
প্রেমকিশোর বলল, “নতুন পেস্ট; মাড়ি জ্বলে যাচ্ছিল।”
“জ্বলে যাচ্ছিল! বাচ্চে কি মাফিক বাত মাত্ বোলো জি।”
শশিকলা কলম তুলে নিয়ে কাগজে কি যেন লিখল। শশিকলার মুখের চেয়ে চশমা যেন বড়, মোটা মোটা কাচ, চৌকোনো ফ্রেম, কাচের মধ্যে আবার গোল গোছের অস্পষ্ট দাগ। নাক প্রচণ্ড লম্বা। বব করা চুল। পাঁশুটে রং চুলের। গায়ে হালকা নীল শাড়ি, আঁটসাঁট করে পরা, গায়ের ব্লাউজ ধবধবে সাদা। চোখে-মুখে অবাঙালিয়ানার ছাপ আছে। মুখ দেখতে মন্দ নয়, কিন্তু সারা মুখে কেমন রুক্ষতা রয়েছে। চোখ দুটো ভীষণ তীব্র লাগে।
শশিকলা চা ঢালবার আগে হাত দিয়ে কলার প্লেটটা দেখাল। বলল, “কেলা খাও পহেলে।’’
প্রেমকিশোর বলল, “তুমি আমার কাছে হিন্দি বোলো না। আমি বুঝতে পারি না। আইদার ইউ ম্পিক ইন ইংলিশ অর ইন বেঙ্গলি।’’
শশিকলা স্বামীর দিকে তাকাল। “অল রাইট। কোলা খাও।”
প্রেমকিশোর চটে গেল। বাংলা নিয়ে ঠাট্টা। তুমি কোন মহারানি গো যোধপুরের? কলার প্লেট টেনে নিয়ে বলল, “কোলা নয় কলা। শশিকোলা কিংবা শশিকেলা বললে তোমার শুনতে ভাল লাগবে?”
শশিকলা চোখের চাউনিতে যেন বিস্ময় ফোটাল। বলল, “আচ্ছা! ইউ আর শোয়িং সাম ক্যারেজ।”
প্রেমকিশোর কলার খোসা ছাড়িয়ে মুখে দিল।
শশিকলা চা ঢালতে লাগল। হঠাৎ শশিকলা বলল, “স্টপ।”
প্রেমকিশোর ঠোঁট বন্ধ করল, মুখের মধ্যে কলা।
শশিকলা বলল, “দাঁত দেখাও।”
প্রেমকিশোর দাঁত বের করল। মুখের কলা গলায় আটকে যায় আর কি!
শশিকলা দেখল। তারপর আবার কলম তুলে কি লিখল। লেখা শেষ হয়ে গেল। “ফ্রম সফট টু হার্ড। আজ তুমি প্রেম, নার্ম চিজ খাবে ফাস্ট, উসকি বাদ হার্ড, হার্ডর। আমি তোমায় অবজার্ভ করব। সমজ মে আয়া?”
প্রেমকিশোর মাথা নাড়ল। —না।
“কাহে?”
“হিন্দি আমি বুঝি না। বাংলায় বললা।”
শশিকলা দু মুহূর্ত যেন কি ভাবল, তারপর বলল, “সরি।” বলে বাংলায় বলল “পহেলে কলা খাবে নার্ম চিজ; নেক্সট খাবে টোস্ট, বাদ মে মটর।”
কাল বন্ধুদের কাছ থেকে ঘুরে আসার পর প্রেমকিশোরের মনে খানিকটা সাহস এসেছিল। তা ছাড়া কাল রাত্রে সে স্বপ্ন দেখেছে, প্রেমকিশোর ঝোলাঝুলি কাঁধে করে লাঠি হাতে গেরুয়াশোভিত মুণ্ডিতমস্তক হয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে হিমালয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। খুব সম্ভব ত্রিশূল পর্বতেই ডেরা বাঁধতে যাচ্ছে। স্বপ্নটা তাকে তাড়া দিচ্ছিল, চাগিয়ে দিচ্ছিল। সংসার যদি ছাড়তেই হয় সে বীরের মতন ছাড়বে, ভীরুর মতন নয়। ভেতরের এই বিদ্রোহ প্রেমকিশোরকে সামান্য সাহসী করে তুলছিল।
কলা খেয়ে আরও কলার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে প্রেমকিশোর বলল, “তোমার মুখে বাংলা শুনতে আমার খুব ভাল লাগে, শশী। প্লিজ বাংলাতেই কথা বলো।”
শশিকলা প্রেমকিশোরের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিল।
মাখন লাগানো বিস্কিট নিল শশিকলা, মুখে দিল, দিয়ে দাঁতের ডগায় ভাঙল। চমৎকার দাঁত শশিকলার, ঝকঝকে, সুবিন্যস্ত, সাজানো। শশিকলা ধীরে ধীরে খায়, ঠোঁট সামান্য ফাঁক করে।
প্রেমকিশোর সাহস করে বলল, “তুমি আমায় একটু বুঝিয়ে দেবে।”
“কী?”
“এই দাঁতের সাইকোলজিটা?” বলে প্রেমকিশোর স্ত্রীকে সর্বোৎকৃষ্ট তেল দিচ্ছে এ রকম একটা ভাব করে বলল, “তুমি দারুণ লার্নেড, অর্ডিনারি মেয়েদের মতন নও, তোমার সাংঘাতিক অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার, রিসার্চের সাবজেক্টটাও ভেরি ডিফিকাল্ট। আমার দারুণ ইন্টারেস্ট লাগছে।”
শশিকলা কথাটা কানে তুলল না। বলল, “নার্ম জিনিস যখন খাও তখন তোমার দাঁতের ফিলিং কেমন হয়?”
প্রেমকিশোর চুপ। জিভটা দাঁতের ওপর বুলিয়ে নিল। তারপর বলল, “নরম জিনিস মানে ডাল ভাত পেঁপে কলার কথা বলছ?”
“জরুর।”
“নাথিং স্পেশ্যাল। কিছুই ফিল করি না। আরও নরম কিছু খেতে পারলে ডিফারেন্সটা বুঝতে পারতাম।”
“আরও নার্ম?”
প্রেমকিশোরের ইচ্ছে হল রহস্যময় দৃষ্টিতে একবার শশিকলার দিকে তাকিয়ে চোখ টেপে। সাহস হল না। সাহসের বাড়াবাড়ি ভাল নয়। প্রেমকিশোর বলল, “আরও নরম কিছু থাকতে পারে।”
“এনি ফুট?”
“ফল!…হ্যাঁ তা ফলও বলা যায়।”
“তো বোলো— ’’
মাথা চুলকে প্রেমকিশোর বলল, “বিম্বোধর!”
“কেয়া?”
“দ্যাটস এ ফুট। ক্ল্যাসিকাল ফুট। ওরই বড়সড় ফল হল পয়োধর।”
“আমার মালুম নেই!”
“যেমন ধর খরমুজ আর তরমুজ। দে আর মোর অর লেস এ সেম কাইন্ড অফ ফ্রুট। বাট দে ডিফার ইন সাইজ অ্যান্ড টেস্ট।”
“তুমি কী নাম বললে জি?”
“বিম্বোধর আর পরোধর।”
“আই হ্যাভ নেভার হার্ড অফ ইট? কলকাত্তায় পাওয়া যায়?”
প্রেমকিশোরের ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। হাসি চাপতে না পেরে সে পটাস করে একবার চোখ টিপে দিল। মনে মনে বলল, শশী, কলকাতায় কেন এই বাড়িতেই পাওয়া যায়। তুমি মাইরি কী ক্রুয়েল।
শশিকলা ঝপ করে কলম তুলে নিল! বলল, “নার্ম ফুড খাবার পর তোমার আঁখ নাচে। দ্যাটস ভেরি ফানি। আই মাস্ট মেক এ নোট অফ দিস পারটিকুলার এফেক্ট…” বললে বলতে শশিকলা খসখস করে নোট লিখতে লাগল।
প্রেমকিশোর বিপদ বুঝে আবার চোখ পিটপিট শুরু করল।
টোস্টে হাত দিল প্রেমকিশোর। কড়কড়ে টোস্ট। মাখন দেওয়া হয়নি। মাখনে নরম হয়ে যেতে পারে বলেই বোধহয়।
প্রেমকিশোরের দাঁত অত মজবুত নয়। রীতিমত কষ্ট করে খেতে হচ্ছিল। এরপর শক্ত মটরদানা খেতে হবে। চোখে জল চলে আসছিল প্রেমকিশোরের। শশিকলা প্রথম কাপ চা শেষ করে আরও এক কাপ চা ঢেলে নিল। নিয়ে হাফ—বয়েল ডিমের প্লেটটা টেনে নিল।
প্রেমকিশোর মনে মনে গালাগাল দিয়ে বলল, শালা, আমার বেলায় সব শক্ত, আর তোমার বেলায় নরম! ঠিক আছে, দু’ দিন সুখ করে নাও, তারপর দেখবে প্রেম কোথায় যায়, সোজা ত্রিশূল পর্বতে চলে যাবে।
হাফ—বয়েল খেতে খেতে শশিকলা বলল, “তুমি আমার থিয়োরির কুছ জানতে চাইছিলে?” প্রেমকিশোর মাথা নাড়ল। তার দাঁত ব্যথা করছে। টোস্ট এত কড়কড়ে হয়? এ একেবারে লোহা!
শশিকলা তার দাঁতের থিয়োরি বোঝাতে লাগল। মানুষের দাঁতই তার চরিত্র, দাঁতই তার ইমোশানকে বুঝিয়ে দেয়। যেমন, যাকে আমরা সুন্দর বলি—ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক—সাধারণত তাদের দাঁত সুন্দর, ঝকঝকে, সুবিন্যস্ত। যাদের আমরা দেখতে খারাপ বলি তাদের দাঁত বেশির ভাগ সময়েই বিশ্রী। যথার্থ সুন্দরী কোন মেয়ের দাঁত খারাপ হতে পারে না, যেমন হেলেনের দাঁত ছিল সোনার মতন ঝকঝকে, ক্লিয়োপেট্রার দাঁত ছিল মুক্তোর মতন, কিন্তু দাঁতের ডগা ছিল ধারালো ; যিশুর ছবিতে তাঁর দাঁতের যে আকার তাতে বোঝা যায় এমন মহাপুরুষ বিরল। শ্রীরামকৃষ্ণের হাসির সময় তাঁর যে ক’টি দাঁত ছবিতে দেখা যায়—তাতে বোঝা যায়, এমন আত্মভোলা সরল সাধক মানুষ আর দ্বিতীয়টি হয় না।
শশিকলা দাঁতের সাইকোলজি বোঝাতে বোঝাতে বলল, “আদমি শয়তান হলে দাঁত বড়া হয়, এজ শারপ হয়, ফরমেশান খারাপ হয়। ইসলোক ক্রিমিন্যাল। বাচ্চারা ইনোসেন্ট, তারা হাসলে দাঁত দেখো, সো বিউটিফুল। ইউ নো প্রেম, অল দি হিউম্যান ইমোশান্স অফ পেইন অ্যান্ড প্লেজার—দাঁতকে রিঅ্যাক্ট করায়। আগর তুমি গোসা করো—দাঁতে দাঁত ঘষবে, তুমি মজা পাও, তুমি হাসো, অ্যান্ড সো অন…হাজারো একজাম্পল আছে জি।”
প্রেমকিশোর মটরদানা চিবোচ্ছিল; একটা শক্ত মটর খটাস করে দাঁতে লাগল। দাঁতের একটা পাশ ভেঙে গেল। ব্যথায় লাফিয়ে উঠল প্রেমকিশোর।
শশিকলা বলল, “কেয়া হুয়া?”
প্রেমকিশোর বলল, “মর গিয়া।”
চার
শনিবার দিন প্রেমকিশোর যথাসময়ে বন্ধুদের কাছে হাজির হল। তার ডানদিকের গাল সামান্য ফোলা, রুমাল চাপা দিয়ে রেখেছিল।
বন্ধুরা প্রেমকিশোরের জন্যেই অপেক্ষা করছিল; সে আসতেই সুবীর অভ্যর্থনা করে বলল, “আয় আয়, তোর জন্যেই ভাবছিলাম।”
প্রেমকিশোর গালের পাশ থেকে রুমাল সরাল।
মন্মথ বলল, “কী হয়েছে রে? ফোলা ফোলা দেখছি!”
প্রেমকিশোর বলল, “তোদের কাজ দেখে যাবার, তোরা শুধু দেখে যা; আর আমি তোদের চোখের সামনে তিলে তিলে মরি।”
গুহ বলল, “হয়েছে কী বলবি তো?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রেমকিশোর গাল ফোলার বিবরণ দিল। বলল যে, শশিকলার হুকুমে সে শক্ত মটরদানা চিবিয়ে খাচ্ছিল। শক্ত জিনিস খাবার সময় তার দাঁত কেমন ব্যবহার করছে শশিকলা সেটা দেখছিল। হঠাৎ একটা মটরদানা এমন বেকায়দায় কষদাঁতের একটাতে লেগে যায় যে, নীচের দাঁতের একটা চাকলা ওপর থেকে উঠে বেরিয়ে গেল। মনে হল, ব্রহ্মতালু পর্যন্ত নড়ে গেল।
প্রেমকিশোর বলল, “সে কী যন্ত্রণা ভাই, ছুরির মতন ধারালো একটা পাশ গালে লেগে ঘা হয়ে গেল দুপুরের মধ্যেই। বিকেলে ডেন্টিস্টের কাছে গিয়ে ঘষিয়ে এলাম। ভাঙা জায়গাটায় এনামেল নেই, কিছু লাগলেই কনকন করছে, জল পর্যন্ত খেতে কষ্ট হয়। ওষুধ চালাচ্ছি। ফোলা আগের চেয়ে অনেকটা কমেছে।”
সুবীর বলল, “তোর বউকে এখনও দাঁত দেখাচ্ছিস?
“মাঝে মাঝে দেখাতে হয়, সিটিং বন্ধ আছে। এখন নরম নরম জিনিস খাইয়ে মাঝে মাঝে দেখছে।’’
“কী খাওয়াচ্ছে?”
“ঢেঁড়স সেদ্ধ, পেঁপে সেদ্ধ, কলা সেদ্ধ,…এইসব।”
“তোর দাঁত ঠিক হয়ে গেলে আবার ধরবে?”
“ধরবে মানে, গলা টিপে ধরবে। এই দু-তিন দিন ঠিক মতন সিটিং হচ্ছে না বলে বেশ রেগে আছে।’’
গুহ চায়ের জন্যে হাঁক ছাড়ল।
মন্মথ বলল, “তুই কিছুই করতে পারছিস না, প্রেম?”
“নাথিং।” মাথা নাড়ল প্রেমকিশোর বিরস মুখে, “তোদের এখান থেকে ফিরে গিয়ে পরের দিন একটু গরম নিচ্ছিলাম, শালা দাঁত ভেঙে গেল।’’
সুবীর মাথা নেড়ে বলল, “ব্যাপারটা আমি বুঝতেই পারছি না। বউকে বললাম, হ্যাঁ গো, তুমি তো আমার মুখ দেখেই জীবন কাটাবে বলেছিলে, কিন্তু প্রেমের বউ বলেছে, সে প্রেমের দাঁত দেখেই জীবন কাটাবে। কোন ভালবাসাটা বেশি গভীর বলতে পারো?…তা মাইরি বউ যা একটা কথা বলল, সে আর পাবলিকলি বলতে পারব না। আজকালকার বউগুলো ব্যালেস্টিক মিসাইলের মতন দূর থেকে একেবারে জায়গা মতন হিট করে।”
মন্মথ হেসে উঠল। গুহও।
গুহ বলল, “সত্যি প্রেম, তুই বাঘের খাঁচায় পড়েছিস! তোর জন্যে বড় দুঃখ হয়।”
প্রেমকিশোর বলল, “বাঘের খাঁচা, কুমিরের মুখ, নদীর দ—যা খুশি বল, তবে এ-জীবনে এমন প্যাঁচে আমি পড়িনি। লাইফ সম্পর্কে আমার ধারণাই পাল্টে যাচ্ছে। জীবন, জগৎ, প্রেম, স্ত্রীলোক, সবই অলীক। বেঁচে থাকা অনর্থক।”.
মন্মথ বলল, “তুই শালা ফিলজফার হয়ে যাচ্ছিস নাকি! হয়ে যা, যে রকম কেস তাতে ত্যাগী, যোগী এসব না হলে আর বাঁচবি না।”
কিছুক্ষণ এইসব চলল। চা এল তারপর।
চা খেতে খেতে প্রেমকিশোর বলল, “তোরা কিছু ভাবতে পারলি?”
বন্ধুরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। সিগারেট ফুঁকল।
শেষে গুহ বলল, “আমরা অনেক প্ল্যান করেছি; ভেবেছি; তার মধ্যে তিনটে প্ল্যান স্ট্যান্ড করছে। এর মধ্যে তোকে একটা বেছে নিতে হবে।”
প্রেমকিশোর বলল, “প্ল্যান তিনটে কী শুনি?’’
মন্মথ বলল, “প্রথম প্ল্যানটা তোর ত্রিশূল পর্বতে পালিয়ে যাবার মতন।”
“মানে?”
“মানে, তুই একদিন বাড়ি থেকে কেটে পড়। কোন খোঁজখবর বাড়িতে দিবি না। ইচ্ছে করলে কলকাতার বাইরে পালাতে পারিস ; কলকাতার বাইরে যেতে না চাস, কোনো হোটেলে কিংবা আমাদের কারও বাড়িতে থাকতে পারিস। আমাদের কারও বাড়িতে থাকলে আমাদের বউরা সন্দেহ করবে। কাজেই হোটেল ভাল।”
“তাতে কী হবে?”
“তোর শশিকলা ঘাবড়ে যাবে। সে একা বাড়িতে দুদিন থাকলেই বুঝতে পারবে, শশী ইজ দেয়ার, বাট কলা ইজ নট দেয়ার ; কলাহীন শশী মানে নো শশী। সপ্তাহখানেক তুই ডুব মেরে থাক শশীর বারোটা বেজে যাবে। তারপর আমরা কেউ তোর বউয়ের সঙ্গে দেখা করব ; বলব, প্রেম ত্রিশূল পর্বত থেকে লিখেছে, সে আর সংসার করবে না। এই টরচার সে সহ্য করতে রাজি নয়। আপনি যদি মশাই, চুক্তিপত্র লিখে দেন, প্রেমকে আর টরচার করবেন না, তাকে চব্বিশ ঘণ্টা আপনার সামনে দাঁত বের করে বসে থাকতে হবে না, স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনযাপন করবেন, তা হলে প্রেম ফিরতে পারে। নয়ত নয়।”
প্রেমকিশোর মন দিয়ে পরিকল্পনাটা শুনল। তারপর বলল, “এটা হবে না; শশী অত কাঁচা নয়। নেক্সট টাইম যখন বাড়ি ঢুকব, আমায় ফায়ার করে দেবে।…সেকেন্ড প্ল্যানটা বল, শুনি।”
গুহ বলল, “সেকেন্ড প্ল্যানটা আমার। আমি অত ন্যাকামি বুঝি না। আমার কথা হল স্ট্রেট ডিল, প্রত্যেক হাজবেন্ডের রাইট আছে স্ত্রীর সঙ্গে নর্মাল লাইফ এনজয় করা। তোকে প্রেম কড়া হতে হবে, সাহসী হতে হবে। তোর বউ যেই দাঁত বের করতে বলবে সঙ্গে সঙ্গে তুই টারজানের মতন লাফ মেরে বউয়ের ঘাড়ে গিয়ে পড়বি। পড়ে বউকে নিয়ে বিছানায় ধরাশায়ী হয়ে যাবি। যেখানে সেখানে বার কয়েক কামড়ে দিবি, জোরে কামড়াবি না বেটা প্রথমে, ধীরে কামড়াবি, তাতেও বাগ না মানলে আরও জোরে কামড়াবি। মানে বউকে তুই ফিজিক্যাল অ্যান্ড মেন্টাল স্ট্রেংথ দিয়ে জিতে নিবি। পুরুষমানুষের মতন চেঁচাবি শালা, চেঁচাবি, লাফাবি, জিনিসপত্র দু-চারটে ভাঙবি, একটু মাল টেনে নিবি, দেখবি তোর বউ কেঁচো হয়ে গেছে। নিজের বউয়ের উপর যে স্বামী তার রাইট এস্টাব্লিশ করতে পারে না—তার মরে যাওয়া ভাল। বুঝলি?”
প্রেমকিশোর গুহর কথা শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে উঠছিল, কিন্তু যখন তার মনে হল শশিকলার সঙ্গে তাকে টারজানের খেল খেলতে হবে—তখন সে ভয় পেয়ে গেল। করুণ কণ্ঠে বলল, “না ভাই, ও আমি পারব না। আমি রোগাসোগা লোক, টারজান হতে গিয়ে বুকের হাড় ভাঙবে, পিঠের মাসল-এ খিচ লেগে যাবে, না হয় হাতের হাড় সরে যাবে, তারপর শালা বিছানায় শুয়ে ককিয়ে মরি আর শশিকলা আমায় অনবরত খোঁচাক। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। না ভাই, আমি পারব না।”
প্রেমকিশোর সামনের সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট টেনে নিয়ে ধরাল। জিজ্ঞেস করল, “থার্ড প্ল্যানটা কী?”
এই প্ল্যানটা সুবীরের। কাজেই সুবীরকে বলতে হল।
সুবীর বলল, “তুই আগের দুটোতেই রাজি হচ্ছিস না, শেষেরটা কি পারবি?”
“শুনি।”
সুবীর বলল, “আমি অনেক ভেবে দেখলাম তোকে দাঁত তুলে ফেলতে হবে।”
প্রেমকিশোর হেঁচকি তোলার মতন শুরু করল, আসলে শব্দটা ভয়ের, শব্দ করে নিজের গালে হাত দিল। বলল, “দাঁত তুলে ফেলতে হবে, মানে?”
“মানে তোর নিজের কোন দাঁত থাকবে না। যদি তোর নিজের দাঁত না থাকে তবে আর তোকে নিয়ে কিসের রিসার্চ করবে? ফলস দাঁত তো আসল দাঁত নয় যে তার নিজের কিছু থাকবে। ঠিক কী না বল? ফলস চোখে দেখা যায় না, ফলস হাতে ধরা যায় না। মেয়েদের বাচ্চা হবার সময় ফলস পেইনে বাচ্চা হয় না। তোর দাঁত ফলস হলে শশিকলাও রিসার্চ ছেড়ে দেবে।”
প্রেমকিশোর খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনতে লাগল এবং ভাবতে লাগল।
সুবীর বলল, “আমার এক বড় শালা ডেন্টিস্ট। ধর্মতলায় বসে। তার সঙ্গে কথা বলতে পারি। তবে বত্রিশটা দাঁত তো একদিনেই ভোলা যাবে না। মাস দুই অন্তত সময় লাগবে। তারপর বাঁধানো দাঁত করতে আরও হপ্তা তিন। এই তিন মাস তোকে কষ্ট সহ্য করতে হবে।”
প্রেমকিশোর গালে হাত রেখে বলল, “তোর কী মাথা খারাপ! তিন মাস আমি বাড়িতে সামাল দেব কী করে? তা ছাড়া আমার এই শক্ত শক্ত দাঁতগুলো চড়চড় করে টেনে তুলবে, উরে বাব্বা মরেই যাব! গলগল করে রক্ত বেরুবে, ব্যথায় প্রাণ যাবে, গাল ফুলে থাকবে। আমি এসবের মধ্যে নেই।”
সুবীর বলল, “তোর দাঁত কিন্তু যা বাঁধিয়ে দেব দেখবি।”
“নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ! সরি, আমি নাক কাটতে পারব না।”
সুবীর বলল, “ভালো করে ভেবে দেখ। যদি রাজি থাকিস, তোর ওই ভাঙা দাঁত দিয়েই নেক্সট উইক থেকে শুরু হতে পারে।”
প্রেমকিশোর জোরে জোরে মাথা নাড়ল।
গুহ বলল, “ব্যাপারটা পেইনফুল ; কিন্তু সুবীরের থিয়োরিটা কারেক্ট। ফলস দাঁত থাকলে শশিকলা তোর দাঁত দেখে একটি বর্ণও তোর রিঅ্যাকশন বুঝবে না। ঠাণ্ডা মেরে যাবে। আমার বউয়ের একবার ফলস হয়ে হয়েছিল।…”
হঠাৎ প্রেমকিশোর লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই খেপার মতন বলল, “হয়েছে, হয়েছে! শালা হয়েছে! ইউরেকা! ইউরেকা!” বলে প্রেমকিশোর ঘরের মধ্যে চরকিপাক খেয়ে মাথার ওপর হাত তুলে নাচতে লাগল।
বন্ধুরা থ’ মেরে বসে রইল। হাঁ করে, অবাক হয়ে।
নাচতে নাচতে প্রেমকিশোর হাসতে লাগল, হাসতে হাসতে সুবীরের গলা জড়িয়ে পটাস করে দুটো চুমু খেয়ে ফেলল। বলল, “মার দিয়া! সাবাস সুবীর। শালা তুই গুরু লোক। আয়, তোকে একটা প্রণাম করি।”
প্রেমকিশোর আর দাঁড়াল না। হাত তুলে বন্ধুদের বলল, “চলি ভাই, কর্ম ফতে করে তবে ফিরব।”
“তোর হল কী? হঠাৎ খেপে গেলি কেন?”
“সে পরে শুনবি। আমি চললাম।”
“ব্যাপারটা বলে যা—।”
“এখন নয়। পরে। বাই বাই। “ নাচতে নাচতে প্রেমকিশোর চলে গেল। বন্ধুরা বোবা হয়ে বসে থাকল।
গুহ বলল, “বেটা কী দাঁত তোলাতে গেল নাকি?”
“মনে তো হয় না।”
“তবে?”
সুবীর, মন্মথ, গুহ কেউ কোন কিছু বুঝল না। অনুমান করতেও পারল না। চুপ করে বসে থাকল।
পাঁচ
বাড়িতে ঢোকার আগে প্রেমকিশোর কাছাকাছি বার-এ গিয়ে অল্প হুইস্কি খেয়ে নিল। তার সঙ্গে স্যারিডন। হুইস্কি তাকে মেজাজ দেবে ; আর স্যারিডন দাঁতের ব্যথা মারবে।
অন্যদিন প্রেমকিশোর চোরের মতন বাড়ি ঢোকে ; আজ বড় বড় পা ফেলে শব্দ করতে করতে ঘরে ঢুকল। শশিকলা ঘরে বসে বই পড়ছিল, প্রেমকিশোরকে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকতে দেখে চোখ তুলে অবাক হয়ে তাকাল। তার পরনে মেয়ে প্যান্ট, গায়ে কামিজ।
প্রেমকিশোর বউয়ের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসল।
শশিকলা বলল, “কী হয়েছে? উতনা হাসছ কেন?”
প্রেমকিশোর বলল, “রাস্তায় একটা লোক বাংলা খেয়ে খেমটা নাচছে।”
“খেমটা কী?”
প্রেমকিশোর অক্লেশে কোমরে হাত দিয়ে খেমটা নাচ দেখাল।
শশিকলা নাক মুখ কুঁচকে ধমক দিয়ে বলল, “স্টপ। ইয়ে ভালগার হ্যায়।”
প্রেমকিশোর কোমর থেকে হাত নামিয়ে বলল, “তোমাদের ইয়ে ঘুরিয়ে নাচ আরও ভালগার।”
“কোথায় গিয়েছিলে জি?”
“ডেন্টিস্টের কাছে।”
“কাল ভি গিয়েছিলে!”
“আজও গিয়েছিলাম। দাঁত ব্যথা করছিল। ওষুধ খেয়েছি।” প্রেমকিশোর হুইস্কি খাওয়াটা মেরে রাখল।
শশিকলা হাতের বই নামিয়ে রাখল। —“খানা খাবে?”
“খাব! রুটি, তরকারি, মাছ—সব খাব।”
“মাগর তোমার দাঁতে পেইন আছে।”
“গোলি মারো।”
শশিকলা ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। সন্দেহের চোখে স্বামীকে দেখল।
প্রেমকিশোর গ্রাহ্য করল না। আপন মনে প্যান্ট জামা খুলতে খুলতে হঠাৎ গান গাইতে লাগল : আমি ভয় করব না।
শশিকলা চমকে গিয়ে বলল, “সিঙ্গিং?”
“ও ইয়েস।”
“কেয়া হুয়া তোমারা জি?”
“ফিলিং ফাইন আফটার দি মেডিসিন।”
শশিকলা তাকিয়ে থাকল। প্রেমকিশোর গান গাইতে গাইতে বীরবিক্রমে বাথরুমে চলে গেল।
খেতে খেতে প্রেমকিশোর বলল, “দাঁত দেখাব?”
“নট নাউ।”
“ও-কে।…দাও রুটি দাও ; তরকারি দাও। কি মাছ, চিংড়ি? লাগাও, শালা সব খাব আজ।”
শশিকলা এবার ভয়ে ভয়ে প্রেমকিশোরকে দেখল। —“তোমার দেমাক খারাপ হয়ে গেছে জি।”
‘কুছ পরোয়া নেই। তুমি যখন আছ মাথা নিয়ে ভাবি না, ঠিক করে দেবে। সাইকোলজিস্ট বউ, হোয়াই শুড আই ফিয়ার!”
শশিকলার জন্যে অপেক্ষা করল না প্রেমকিশোরকে, নিজেই টেনে টেনে খাবার নিতে লাগল। শশিকলা বলল, “ডক্টর তোমায় কী ওষুধ দিয়েছে?”
“জানি না। ব্রান্ডি টাইপের গন্ধ ছিল।”
“হোয়াই ব্রান্ডি?”
“ডাক্তার জানে। আমি ডাক্তার নই।”
“ওহি বাস্তে তোমারা এতনা ফুর্তি…।”
“তোমায় বড় ভাল লাগছে। এই ড্রেসটা পরে থাকবে না ছাড়বে?”
“তুমি লুজ টক করছ।”
“তোমাকে লুজ করব।”
শশিকলা রেগে মেগে আর কথা বলল না।
শুতে এসে প্রেমকিশোর বেশ মেজাজের মাথায় সিগারেট খাচ্ছিল।
শশিকলা এল বেশ কিছুটা পরে। শাড়ি পরে শুতে পারে না শশিকলা। সিলোনিজ সায়ার মতন একটা বড়-সড় মাপের পেটিকোট পরে, সেটা অনেকটা ঘাঘরার মতন। গায়ে ঢিলেঢালা ব্লাউজ।
বিছানায় শুয়ে শশিকলা বলল, “বাত্তি বুজাও।”
প্রেমকিশোর বলল, “তুমি হিন্দি ছাড়বে না ছাড়বে না? বাঙালি মেয়ে তুমি। হিন্দি যতই বল, ভাল লাগে না।”
শশিকলা বলল, “বেশ।”
“বেশ মানে?”
“বেশ মানে বেশ, হিন্দি বলব না।”
“খুশি হলাম।”
শশিকলা গা-হাত ঝেড়ে গুছিয়ে শুল।
প্রেমকিশোর শশীর দিকে ফিরল। বলল, “তুমি চুলে কি মাখো?”
“কুছ না।”
“ফাইন গন্ধ দিচ্ছে।”
“শ্যাম্পুর গন্ধ।”
“বিউটিফুল। তোমার বডি পাউডারটা মার্ভেলাস।”
“তোমার আজ কী হয়েছে কী? এতনা বকবক করছ? কিতনা ব্র্যান্ডি খেয়েছ?” মনে মনে প্রেমকিশোর হাসল। শালা এক পেগ বড় হুইস্কিতেই এই কর্ম।
বলল, “বেশি নয়।”
“বাত্তি নেভাও।”
“বাত্তি নয়, বাতি—” বলে প্রেমকিশোর সোজা তার ডান হাত বউয়ের গায়ে চাপিয়ে দিল। ফুলশয্যার দিন হাত বাড়ানোর চেষ্টাও করতে পারেনি, ধমক খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল।
শশিকলা চমকে উঠে হাত সরিয়ে দেবার চেষ্টা করল। —“ই কেয়া?”
প্রেমকিশোর বলল, “বাংলায় একে আলিঙ্গন বলে ভাই, আলিঙ্গন জানো না?”
“হাত উঠাও।”
“নেভার।”
“ইউ মাস্ট।”
“নেভার, নেভার, নেভার…” বলতে বলতে প্রেমকিশোর হাত নামিয়ে শশিকলার পেটের কাছে সুড়সুড়ি দিল।
শশিকলা ছিটকে যাবার চেষ্টা করল, পারল না। প্রেমকিশোরের হাত উঠিয়ে দেবার জন্যে ধাক্কা মারল, পারল না।
প্রেমকিশোর এবার দু’হাত দিয়ে সুড়সুড়ি দিতে লাগল কোমরে আর পেটে।
শশিকলা শরীর ভেঙে দুমড়ে বেঁকে ক্ষণে ক্ষণে বিচিত্র আকার ধরতে লাগল। এবং সে হাসতে লাগল।
প্রেমকিশোর বিছানার ওপর উঠে বসে কীচক বধের ভঙ্গি করে শশিকলার সর্বাঙ্গে সুড়সুড়ি দিতে লাগল।
শেষ পর্যন্ত শশিকলা বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে মাটিতে নামল। প্রেমকিশোরও লাফ মারল। ঘরের মধ্যে ছুটোছুটি। শশিকলার ঘাঘা পেখম মেলে নাচছে, হাত কখনো বুকের কাছে, কখনো মুখের কাছে। আর প্রেমকিশোর শশিকলার সামনে কোমর ভেঙে ফ্রি স্টাইল কুস্তির ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে রয়েছে সুড়িসুড়ি দেবার জন্যে। “প্লিজ প্রেম”—
“নেভার।”
“আমি বেশি হাসতে পারি না।”
“কেন পারো না। হাসি ভাল। হাসলে আয়ু বাড়ে, চর্বি ঝরে যায়।”
“আমার চর্বি নেই প্রেম।”
“ভয়ঙ্কর চর্বি তোমার। মেন্টাল চর্বি।” বলতে বলতে প্রেমকিশোর আবার ধরে ফেলল শশিকলাকে। শশিকলার গলার স্বর মোটা হয়ে গিয়েছে, মোটা গলায় হাসতে লাগল, যেন জলভরা বোতল থেকে জল পড়ছে।
তারপর সারা ঘর লণ্ডভণ্ড। শশিকলা লাফ মেরে বিছানায় উঠল। প্রেমকিশোর লাফ মারল। শশিকলা মাথার দিকে পালাল বিছানার—প্রেমকিশোর পাশ থেকে গিয়ে জাপটে ধরল।
হাসতে হাসতে বসে পড়ল শশিকলা। প্রেমকিশোর দাঁড়িয়ে থাকল। শশিকলা এবার পালাবার চেষ্টা করল। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে ছুটল।
দরজার ছিটকিনিতে হাত দিতেই পারেনি শশিকলা—প্রেমকিশোর এসে জাপটে ধরল।
কোমরের দু’পাশে হাত রেখে জোর কাতুকুতু দিতেই শশিকলা এত জোরে হেসে উঠল যে কি যেন তার মুখ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে দরজায় খট করে লাগল। লেগে মাটিতে পড়ল। শশিকলা একেবারে থ।
প্রেমকিশোর দেখল, দাঁতের বাঁধানো পাটি, পুরো পাটি।
শশিকলা তাকাল প্রেমকিশোরের দিকে। চোখে মুখে ধিক্কার, দুঃখ, বেদনা, ধরা পড়ে যাবার ভয়, লজ্জা।
প্রেমকিশোর মাটি থেকে দাঁতের পাটিটা কুড়িয়ে নিল। নিয়ে ডান হাত পাতল।
শশিকলার চোখে জল এল। মুখ থেকে অন্য দাঁতের পার্টিটা বের করে প্রেমকিশোরের হাতে দিল।
ছত্রিশ বছরের শশিকলার ভরন্ত মুখ চুপসে গেল। যেন কেউ পিন ফুটিয়ে বেলুন চুপসে দিয়েছে। হঠাৎ শশিকলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
প্রেমকিশোর দাঁতের পাটি দুটো বিছানার দিকে ছুড়ে দিল। বলল, “কেঁদো না। প্লিজ।”
শশিকলা আরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
প্রেমকিশোর শশিকলার হাত ধরে টানতে টানতে বিছানায় এনে বসাল। বলল, “তুমি রোজ রাত্রে, আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর দাঁতের পাটি দুটো বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখতে?”
মাথা নাড়ল শশিকলা। হ্যাঁ, রাখত।
প্রেমকিশোর বলল, “আবার ভোরে উঠে পরে নিয়ে বাথরুমে যেতে?”
এবারও স্বীকার করল শশিকলা।
“আমায় বরাবর ফলস দিচ্ছিলে?”
শশিকলা চুপ।
“তোমার দাঁত ফলস বলে তার কোনো ফিলিং ছিল না।”
শশিকলা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
প্রেমকিশোর একটু হাসল। হাত দিয়ে শশিকলার চোখের জল মুছিয়ে দিতে গিয়ে সারা গাল লেপটে দিল। তারপর বলল, “তোমাকে এখন আরও বিউটিফুল দেখাচ্ছে। আই ডোন্ট কেয়ার ফর দোজ ফলস…। এসো, শুয়ে পড়ো।”
প্রেমকিশোর শশিকলাকে শুইয়ে দিয়ে নিজে পাশে শুয়ে পড়ল।
বেড সুইচ টিপে বাতি নেভাল। তারপর শশিকলার দিকে ফিরে তাকে জাপটে নিয়ে বলল, “ডার্লিং, তুমি মন খারাপ করো না। তোমার নিজের দাঁত না থাক—আমার আছে। আমি, তোমার কাজ চালিয়ে দেব। কই, মুখটা দেখি…। তোমার মুখে মার্ভেলাস গন্ধ।…শশী, এসো ভাই লক্ষ্মীটি…” বলতে বলতে প্রেমকিশোর এমন জোর একটা চুমু খেল বউকে—মনে হল নতুন টিউবওয়েলে জল তুলছে।