Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আট

তিন বছর পর।

তিন বছর অনেক সময়, অনেক কিছু ঘটতে পারে এর মধ্যে, কিন্তু রুমীর খুব একটা পরিবর্তন হয় নি। স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে কিছুটা, তার ওপরে গোঁফ রেখেছে, তাই দেখতে একটু ভারিক্কি লাগে আজকাল। চিন্তাভাবনা অনেক স্পষ্ট হয়েছে, দেশ-বিদেশের সত্যি খবর রাখে তাই আপাতদৃষ্টিতে তাকে উচ্চাশাহীন সাদামাঠা ছেলে বলে ভুল হতে পারে। বই পড়ার অভ্যাস দিনে দিনে আরও বেড়েছে। চোখ খারাপ হয়ে থাকতে পারে, ক্লাসে পেছনে বসলে সে বোর্ডের লেখা ভালো দেখতে পায় না, তবুও কখনো চোখের ডাক্তারের কাছে যায় নি। ওর ভয় হয় ডাক্তার জোর করে ওকে চশমা দিয়ে দেবেন। চোখে চশমা ও দুচোখে দেখতে পারে না। আলগা বুদ্ধিজীবীর একটা ভাব ফুটে ওঠে যেটা ওর ভারি অপছন্দ।

তিন বছরে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার ঘটেছে রুমীর জীবনে। সে প্রেমে পড়েছিল আবার আঘাত পেয়ে ফিরেও এসেছে, এখনো সে ভুলতে পারে না, প্রায় প্রতিদিনই তার বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যায়। চমৎকার মেয়েটি ছিল, ওদের ক্লাসের অনেকেই ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়েছিল মেয়েটির জন্যে। সুন্দরী হিসেবে মেয়েটিকে ওরও ভালো লাগতো, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করতো কিন্তু কখনো সে চেষ্টা করে নি। ওর ধারণা ছিল যেচে কোনো মেয়ের সাথে গল্প করা হ্যাংলামোর পর্যায়ে পড়ে। ওদের একজন শিক্ষক তখন নতুন পিএইচডি করে এ দেশে ফিরে এসেছেন। সুদর্শন অল্পবয়সী ভদ্রলোক, করিডোরে দাঁড়িয়ে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সাথে গল্প করতে ভালোবাসেন। ফাজিল ছেলেরা বলে বিয়ে করেন নি তাই মেয়ে পছন্দ করার চেষ্টা করছেন। রুমীও দু-একদিন তার গল্প শুনেছে, এমনিতে মানুষটা খারাপ নন, নিজের বিষয়ে জানেন খুব ভালো, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে সাধারণ। রুমী বাজি রেখে বলতে পারে ভদ্রলোক রিডার্স ডাইজেস্ট পড়েন এবং বিশ্বাসও করেন। রুমীর এমনিতে কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু ভদ্রলোক যখন রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন সে চুপ থাকতে পারল না। তার প্রথম কথাটি শুনেই সে বলে উঠল, না, স্যার, আপনি ভুল বলছেন।

ভুল? ভদ্রলোকের ফর্সা চেহারা একটু লাল হয়ে ওঠে। এ সপ্তাহের নিজউ উইকে–না স্যার, ওটা ভুল। নিউজ উইকের খবরটা পড়তে পারেন কিন্তু তার অ্যানালিসিস পড়বেন না। ওটা ওয়েস্টার্ন দৃষ্টিভঙ্গি। আমি আপনাকে চারটি ভিন্ন ভিন্ন কাগজের নাম বলতে পারি যারা ওরকম করে দেখবে না। রুমী কাগজগুলির নাম বলল, কে কি লিখেছে তাও বলল। কিবরিয়া ভাইয়ের কাছে সে তর্ক করা শিখেছে, উদাহরণ না দিয়ে সে কখনো কথা বলে না।

তাই বলে তুমি নিউজ উইককে অবিশ্বাস করবে? জানো ওদের সার্কুলেশন কত?

রুমী সঠিক সংখ্যাটি বলতেই ভদ্রলোক একটু হকচকিয়ে গেলেন। রুমী ঠাণ্ডা গলায় ভদ্রলোককে বোঝাতে শুরু করে, নিউজ উইক টাইম ওরা তো কাগজের ব্যবসা করে। ওরা খবরগুলি এমনভাবে ছাপায় যেন মানুষের পড়তে ভালো লাগে, না হলে লোকে ওদের কাগজ কিনবে কেন। থার্ড ওয়ার্ল্ড সম্পর্কে ওরা কি ভাবে আপনি কখনো খেয়াল করে দেখেছেন?

ভদ্রলোককে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সে উদাহরণ দিতে শুরু করে কবে বাংলাদেশকে নিয়ে কি লিখেছে যা লেখার কোনো মানে হয় না, কবে কোন্ সত্যকে বিকৃত করেছে, কবে কোন্ সত্যকে গোপন করেছে, কবে কোন্ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকে অবহেলা করেছে। এটা রুমীর প্রিয় বিষয়, সে এত জানে এ সম্পর্কে যে আজকাল কিবরিয়া ভাইও তার সাথে সাবধানে কথা বলেন। ভদ্রলোক একেবারে চুপসে গেলেন। এরপর আর কোনো গল্পই জমল না, ভদ্রলোক একটা ক্লাসের অজুহাত দিয়ে চলে গেলেন। তিনি চোখের আড়াল হতেই সেই মেয়েটি খুব অবাক হয়ে বলল, তুমি তো খুব জোর দিয়ে কথা বলো, আমি সব সময়ে ভাবতাম তুমি বুঝি খুব চুপচাপ।

রুমী মেয়েটার চোখের দিকে তাকায়, সুন্দর বিস্ময়াভিভূত চোখ দুটি দেখে ওর ভেতরে কি যেন নড়েচড়ে যায়। একটু হাসার ভঙ্গি করে বলে, আমি এমনিতেই চুপচাপই। কেউ বিদেশিদের মতো কথা বললে কেন জানি চুপ করে থাকতে পারি না। মাথা চুলকে বলে, বেশি বলে ফেললাম কি-না কে জানে, স্যারের পরীক্ষা সামনে।

মেয়েটি খিলখিল্ করে হেসে ওঠে খুব মিষ্টি স্বরে। বলে, না-না খুব ভালো করেছ! এখন যদি স্যারের গল্প করা কিছুটা কমে।

ক্লাসের ফাজিল মেয়েটা বলল, কবে যে স্যারের বিয়ে হবে আর আমরা রেহাই পাব! সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। এ নিয়ে খানিকক্ষণ হাসাহাসি চলে, মেয়েটি একটু পরে আবার আগের ব্যাপার টেনে আনে, তুমি বুঝি এসব নিয়ে খুব ভাব?

রুমীর বুকের ভেতর কি যেন ঘটে যায়, কথা বলতে কষ্ট হয়। ওর। কোনোমতে বলে, বেশি আর কোথায়!

কিন্তু তুমি তো স্যারকে বলেছ খুব ভালো, এতগুলো রেফারেন্স দিয়েছ যে বেচারা স্যার কিছুই বলতে পারলেন না। আমেরিকা থেকে এসেছেন মোটে তিন মাস।

মেয়েটিকে রুমীর এত ভালো লেগে যায় যে বলার নয়। ইচ্ছে করে কাছে টেনে এনে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। নিজেকে ওর অনেক বড় মনে হয়, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস অনুভব করে নিজের ভেতর। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে, কি হলো মেয়েটির কে জানে, হঠাৎ লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।

ফাজিল মেয়েটি বলল, ওই যা!

এরপর রুমীকে প্রায়ই ওই মেয়েটির সাথে দেখা যেতে লাগল–করিডোরে কথা বলছে, কেন্টিনে চা খাচ্ছে, লনে বসে চীনাবাদাম চিবুচ্ছে। এক ছুটির দিনে দুজন লুকিয়ে সিনেমাও দেখতে গেল।

রুমীর জীবনে সবচেয়ে আনন্দের সময় ছিল সেই কটা মাস। মেয়েটির জন্যে কি করবে সে ভেবে পেত না। ইচ্ছে করতো মেয়েটিকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে, সমুদ্রের ধারে নারকেলগাছের ছায়ায়, নীল আকাশের নিচে নীল সমুদ্রের তীরে যেখানে তরঙ্গ পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে। রাতে পড়তে বসে আনমনা হয়ে যেতো সে।

ঠিক বুঝতে পারে নি রুমী মেয়েটি আস্তে আস্তে কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গুটিয়ে যেতে থাকে নিজের ভেতর। প্রায়ই মনে হতো মেয়েটি ওকে কি যেন বলতে চায় কিন্তু পারে না। কি বলতে চায় ও যখন বুঝল তখন মেয়েটির বিয়ের কার্ড ছাপা হয়ে গেছে। প্রচণ্ড একটা আঘাত পেল রুমী, কেউ যেন ধারালো একটা ছুরি দিয়ে নিপুণভাবে ওর ভেতরটা চিরে দিয়ে গেছে। জীবন অর্থহীন হয়ে ওঠে ওর কাছে, প্রচণ্ড শূন্যতা নিয়ে দিনের পর দিন কাটে, কি করবে সে বুঝতে পারে না। আস্তে আস্তে সামলে নিয়েছে নিজেকে, শুধু বুকের ভেতর কোথায় জানি খানিকটা শূন্যতা রয়ে গেছে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালে এখনো মেয়েটির কথা মনে হয় ওর। কোথায় আছে সে?

বিয়ের পর পরই মেয়েটি তার স্বামীর সাথে আমেরিকা চলে গিয়েছিল। অনেক চিন্তা করে সে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে যদি না চাইতো ওখানে বিয়ে হতো না। ইচ্ছে করলে সে রুমীকে বিয়ে করতে পারতো। কিন্তু সে অনেক ভেবে দেখেছে রুমীর সাথে তার খাপ খাবে না। খুব ভালো লাগত ওর রুমীকে, ইচ্ছে করত রুমীর মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে রাখে, কিন্তু ও জানে বিয়ে হলে সব অন্যরকম হয়ে যাবে। ওর নিজের বোনকে দেখে শিখেছে, কত ভালোবাসা ছিল ওর বোনের। বিয়ের এক বছরের ভেতর দুজন দুরকম হয়ে গেল, ছোটখাটো জিনিস নিয়ে কি ভয়ানক ঝগড়া করে দুজন। ওর নিজের অনেক শখ, বিদেশে যাবে, চমৎকার একটা বাসা হবে দেশে ফিরে এলে, ওর ফুটফুটে ছেলেমেয়েরা বাসার লনে গুটি গুটি হেঁটে বেড়াবে। লাল একটা গাড়ি হবে ওদের, ছুটিতে ওরা ব্যাংকক বেড়াতে যাবে। কিন্তু রুমী অন্যরকম। ভবিষ্যতের কথা বললেই ওর চোখ স্বপ্নালু হয়ে যায়, টিনের ছাদে ঝমঝম্ করে বৃষ্টি পড়ছে, পালতোলা নৌকায় বসে হাওরের কালো পানির দিকে তাকিয়ে আছে, এর বেশি সে কল্পনা করতে পারে না। ওরা দুজন দুরকম, ওদের বিয়ে হলে সবকিছু গোলমাল হয়ে যাবে। অনেক ভেবেছে সে, অনেক ভেবে সে এখানে বিয়ে করেছে। রুমীর কথা মনে হয় এখনো, বড় ভালো ছেলে, তাকে নিশ্চই খুব ভুল বুঝেছে, কিন্তু কি করবে সে? রুমীর জন্যে সে তো ঠিক মেয়ে নয়, জীবন অনেক দীর্ঘ সময়, সেটা তো নষ্ট করতে পারে না, তার নিজেরটাও নয়, রুমীরটাও নয়।

ভদ্রলোকের নাম ড. আজহার আলী, বাঙালি, কিন্তু বিদেশেই থাকেন। দেশে এসেছিলেন, বেশিদিন থাকতে পারেননি, মোহভঙ্গ হয়ে ফিরে গেছেন। প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী দূর গ্যালাক্সির আলো বিশ্লেষণ করে কীভাবে জানি মুক্ত কোয়ার্কের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। সারা পৃথিবীতে খুব এ নিয়ে, রুমী নিজে নিউজ উইকে ভদ্রলোকের ছবি দেখেছে। কদিন আগে দেশে এসেছিলেন, সেমিনারে লোক আর ধরে না। হলের কমন রুমের টেলিভিশনে দেখেছে রুমী, বেশি বয়স না, ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে হয়তো। বাংলা বলেন একটু অদ্ভুতভাবে, দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে বোধ করি এমন হয়েছে।

আদিল রহমান, মধ্যবয়স্ক কিন্তু এখনো প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর। প্রযোজকরা কেউ তাকে ছবি তৈরি করার টাকা দিতে চায় না। নিজের সবকিছু বিক্রি করে ধারদেনা করে ছবি তৈরি করলেন, ‘ হাতছানি’। কোনো সিনেমা হল প্রথমে দেখাতে রাজি হলো না। একটিতে কোনোরকমে এক সপ্তাহ টিকে থাকল, লোকজন দেখতে পর্যন্ত গেল না। কাগজে কিন্তু খুব ভালো সমালোচনা বের হলো, বিজ্ঞ লোকেরা যথেষ্ট প্রশংসা করলেন, তবু সেই ছবি বাজার পেল লোকজন ভুলেই গিয়েছিল ‘হাতছানির’ কথা, বার্লিনের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেটা সর্বশ্রেষ্ঠ ছায়াছবি হিসেবে সে-বছর প্রথম পুরস্কার পেয়ে গেল। শুধু তাই নয়, এ ছবিরই পরিচালক ও চরিত্রাভিনেতা শ্রেষ্ঠ হিসেবে সম্মান পেলেন। দেশে হৈচৈ পড়ে গেল, সব জায়গায় শুধু হাতছান’র গল্প। লোক ভেঙে পড়ল ছবি দেখতে। আদিল রহমান মাথা উঁচু করে দেশে ফিরে এলেন। তাঁকে নিয়ে কি মাতামাতি।

হৈচৈ কমে এলে আবার ছবি করতে চাইলেন ভদ্রলোক, প্রচণ্ড বাধা পেলেন আবার। স্টুডিওর লোকেরা সহযোগিতা করল না, নায়ককে গুম করে ফেলার ভয় দেখানো হলো। ভদ্রলোকের বাড়িতে গ্রেনেড ফাটল একদিন। আদিল রহমান সেই সপ্তাহেই স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে ইতালি চলে গেলেন। আর ফিরে আসেন নি। সেখানকার কি একটা ফিল্মের স্কুলে নাকি পড়ান এখন।

শাজাহান সুজা, বয়স মাত্র ত্রিশ, তার আঁকা তেল রঙের ছবি ‘প্রিন্স’ ওয়াশিংটন ডিসির মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস এক মিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে নিয়েছে। টাকাটা অবিশ্যি শাজাহান সুজা পান নি, পেয়েছে অন্য লোক যার কাছে ছবিটা বিক্রি করেছিলেন তিনি, খুব প্রিয় ছবি ছিল তার, নেহাত বিদেশে অর্থকষ্টে পড়েছিলেন বলে বিক্রি করেছিলেন ওটা। টাকা না পেলেও সম্মান ঠিকই পেয়েছিলেন। পৃথিবীর সব বড় বড় শিল্প সমালোচক প্রিন্সকে অসাধারণ কালজয়ী ছবি হিসেবে প্রশংসা করেছে। প্রিন্স ছবিটি কিন্তু খুব সাধারণ, কোনো নতুন টেকনিক বা স্টাইল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই। বিমূর্ত ছবি নয়, ছবিতে সত্যি সত্যি প্রিন্স বা রাজপুত্রকে চেনা যাচ্ছে, ক্ষুধার্ত উলঙ্গ একটি শিশু উবু হয়ে বসে তাকিয়ে আছে, জ্বলজ্বলে চোখে। অতি সাধারণ ছবি ভালো একটা ক্যামেরা দিয়ে অনায়াসে এরকম একটা ছবি তোলা যায় এ দেশের পথেঘাটে। কিন্তু তবু ছবিটিতে কি যেন একটা রয়েছে, অত্যন্ত স্পষ্ট, অত্যন্ত নির্মম, অত্যন্ত নিষ্করুণু, যা শুধু একজন শিল্পীই সৃষ্টি করতে পারে, ক্যামেরা পারে না। তাই সাধারণ ছবি হয়েও প্রিন্স অসাধারণ ছবি। যে-ই দেখেছে সে-ই স্বীকার করেছে এটা শুধু ছবি নয়, এটা গোটা পৃথিবীর দুঃখ-কষ্টের। ইতিহাস।

শাজাহান সুজা তার সম্মান নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। রুমী অপেক্ষা করছিল কবে নাগাদ চলে যান দেখার জন্যে। এ দেশে কেউ থাকে না, কোনো কিছুতে একটু ভালো হলেই লোকজন এ দেশ ছেড়ে চলে যায়। শাজাহান সুজা বড় শিল্পী, তাঁর থাকার তো কোনো কারণই নেই। তবু তিনি থেকে গেলেন। চুপচাপ লোক, এখনো বিয়ে করেন নি। অনেক মেয়ের গোপন দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর করে শাজাহান সুজা ক্যামেরা নিয়ে তার লাল রঙের গাড়ি করে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ান। রুমী খুব পছন্দ করে তাকে, সুযোগ পেলে একবার কথা বলে দেখবে, এত বিখ্যাত লোক সুযোগ পাবে কি না সেটাই সন্দেহ। দেশের জন্যে রুমীর খুব মমতা, দেশের বড় বড় লোকজন যদি ফিরে আসে তাহলে দেশের লোককে আশা দেওয়া যায়। না হলে তারা কাকে দেখে মুগ্ধ হবে, আশা পাবে? যোগ্য মানুষ এ দেশে অনেক আছে, কিন্তু তারা স্বীকৃতি পায় না যতদিন না পাশ্চাত্য দেশ তাদের স্বীকৃতি দেয়। এ নিয়ে রুমীর দুঃখটা আন্তরিক।

জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্যাপারটা অনেকের চোখে পড়ল। গত কয়েক মাসে অন্তত চারটি শিশু অস্বাভাবিকভাবে মারা গেছে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল বুঝি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কিন্তু তিন মাসের মাথায় দেখা গেল এগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ব্যাপারটা বুঝতে তিন মাস সময় লাগার আরও একটা কারণ আছে। যে সমস্ত শিশু এ সময়ে মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে তারা সবাই গরিবের সন্তান, রাস্তাঘাট… বড়জোর বস্তিতে থাকে। তাদের বেঁচে থাকাটাই বিস্ময়, তাই হঠাৎ করে মারা গেলে কেউ অবাক হয় না, মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ সভ্য লোকজনের কান পর্যন্ত পৌঁছোয় কিন্তু ঢাকা শহরে তিন মাসে অন্তত চারটি শিশুর অস্বাভাবিক মৃত্যু, দুজন নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ একটু বাড়াবাড়ি, তা সে যত গরিবের সন্তানই হোক। প্রথম প্রথম শিশুগুলির মৃতদেহ পোস্টমর্টেম পর্যন্ত করা হয় নি। তৃতীয় শিশুটির বেলায় একটু হৈচৈ হলে তাকে পোস্টমর্টেম করে দেখা গেল তাকে বিষ প্রয়োগে মারা হয়েছে। চতুর্থ শিশুটিকে মারা হয়েছে গলা টিপে। শহরে এবার কিছুটা হৈচৈ পড়ে গেল, খবরের কাগজে লেখালেখি হলো, সমাজব্যবস্থাকে একচোখা বলে গালি দেওয়া হলো, কিন্তু সুরাহা হলো না ব্যাপারটার। নওয়াবপুর রোডে আধপাগল গোছের একজন লোক একটা বাচ্চাকে আদর করতে গিয়ে খামোখা প্রচণ্ড মার খেলো একদিন। শহরের মা-বাবারা সতর্ক হয়ে গেলেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে আর চোখের আড়াল করতে চান না। কিন্তু যে ধরনের ছেলেমেয়েরা মারা যাচ্ছিল সেই সব পথের শিশু ঠিকই পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগল। তাদের বেঁচে থাকতে হলে ঘুরে বেড়াতে হয়, এখানে-সেখানে ছোটখাটো কাজ, ভিক্ষা ও চুরিচামারি করে বেঁচে থাকার রসদ জোগাতে হয়। তাদের ঘর নেই, বন্ধ হয়ে থাকবেই বা কোথায়?

ব্যাপারটা নিয়ে হৈচৈ হওয়ার পর প্রায় মাসখানেক কিছু ঘটল না। একজন-দুজন নিখোঁজ হয়েছে হয়তো, কিন্তু পথের ছেলেমেয়েরা কখন সত্যিই নিখোঁজ হয়েছে, আর কখন নিজেই কোথায় চলে গিয়েছে ঠিক করে বলা মুশকিল।

ফেব্রুয়ারি মাসে আবার সবার টনক নড়ল, চার বছরের একটা শিশুকে প্রকাশ্য রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেল। নির্মমভাবে তাকে ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করে মারা হয়েছে। যখন তাকে পাওয়া গেছে তখনো তার মৃতদেহ শীতল হয়ে যায় নি। মুখের যন্ত্রণার অভিব্যক্তি থেকে যেটা বড় সেটা হচ্ছে ভীতি। কি ভয়ানক ভীতি, মৃত্যুর মুখোমুখি হলেই বুঝি এরকম ভীতি সম্ভব।

সারা শহরে এবার হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। অনেকে এবার সত্যিসত্যি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাজনৈতিক দলগুলি মাইক নিয়ে বস্তিতে বস্তিতে সবাইকে সচেতন করার জন্যে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াল। ছোট ছোট ছেলেমেকে শিখিয়ে দেওয়া হলো কখনো যেন তারা অপরিচিত কারো কাছে না যায়, অপরিচিত লোকদের দেওয়া কিছু না খায়, কখনো যেন একা হাঁটাহাঁটি না করে, রাতে কখনো পথেঘাটে ঘোরাঘুরি না করে, সন্দেহজনক কিছু দেখলেই যেন বয়স্ক কাউকে বা পুলিশকে জানায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বয়স্কাউট আর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীরা তাদের অফিস খুলে রাতে পাহারা দেওয়া শুরু করল।

কিন্তু তবু ব্যাপারটি বন্ধ হলো না, প্রায় নিয়মিতভাবে দুই থেকে তিন সপ্তাহের ভেতর একটা করে শিশু নিখোঁজ হতে লাগল। সব সময়েই যে শিশুগুলির মৃতদেহ পাওয়া যেতো তা নয়, কিন্তু যে একবার নিখোঁজ হয়েছে সে আর কখনো ঘুরে আসততা না, তা থেকে সবাই প্রায় নিঃসন্দেহ হতো যে তাদেরও মেরে ফেলা হয়েছে। আরও নিঃসন্দেহ হওয়া গেল কারণ কদিন পরেই সাভারের কাছে একটা ডোবায় একজন চারটে মৃতদেহ আবিষ্কার করল। সবই বাচ্চাদের দেহ, দীর্ঘদিনে সেগুলি বিকৃত হয়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে কাউকে চেনার উপায় নেই। পুলিশ অনেকদিন খবরটা চেপে রেখে সেখানে চব্বিশ ঘণ্টা গোপন পাহারার ব্যবস্থা করেছিল, কিন্তু কোন লাভ হয় নি, হত্যাকারী সেখানে আর কখনো ফিরে আসে নি।

চেষ্টার অবিশ্যি কোনো ত্রুটি ছিল না। দিনরাত অসংখ্য পুলিশ সাদা পোশাকে সারা শহরে ছড়িয়ে থাকতো। শিশুর মৃতদেহে হাতের ছাপ বা অন্যান্য চিহ্ন খুঁজে বের করার জন্যে মূল্যবান যন্ত্রপাতি কিনে আনা হলো। ফরেনসিক এক্সপার্ট একজনের ট্রেনিং বাতিল করিয়ে দিয়ে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হলো। একদিন কারফিউ দিয়ে মিলিটারি আর পুলিশ সারা শহর তন্নতন্ন করে খোঁজাখুঁজি করল। কেউ হত্যাকারী সম্পর্কে কোনো খোঁজ দিতে পারলে তাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হলো। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সে-টাকা কদিনের ভেতর বাড়িয়ে এক লাখ করে দিল, কিন্তু তবু কোনো লাভ হলো না। টাকার লোভে আজকাল লোকজন অনেক ঘন ঘন খবর নিয়ে আসে, কিন্তু সব খবরই ভিত্তিহীন। দেখতে দেখতে পাঁচ মাস হয়ে গেল, তবু ঘটনার কোনো কিনারা হলো না।

দুস্থ শিশুদের পথেঘাটে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করার জন্যে অনেক বড় বড় পরিকল্পনা নেওয়া হলো। শহরের বড় বড় বস্তিতে ছোট শিশুদের জন্যে লঙ্গরখানা খোলার ব্যবস্থা করা হলো। প্রচুর টাকার প্রয়োজন, সবাই নিজেদের সাধ্যমতো চেষ্টা করল। সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীরা তাদের একদিনের বেতন দান করল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে লোকজনের কাছ থেকে টাকা তুলতে লাগল। বড় শিল্পীরা গানের আসর করলেন, অনেক মোটা টাকায় টিকিট বিক্রি করে পুরো টাকাটা শিশুদের জন্যে দান করা হলো। শাজাহান সুজা তার ছবির প্রদর্শনী করলেন, প্রদর্শনী শেষে ছবিগুলো নিলামে বিক্রি করা হলো। স্থানীয় বিদেশিরা অবিশ্বাস্য দাম দিয়ে ছবিগুলি কিনে নিল, শাজাহান সুজার ছবি কিনলে নাকি টাকা খরচ করা হয় না, টাকা খাটানো হয়, কদিন পরে ছবিগুলি হয়তো লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হবে। ছবি প্রদর্শনী থেকে অনেক টাকা উঠল, পুরো টাকাটাই শাজাহান সুজা শিশুদের জন্যে দিয়ে দিলেন।

দরজায় টোকা শুনে উঠে দরজা খুলে দেয় রুমী, বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ ওর ভেতরটা চমকে ওঠে। হলে আশেপাশের দরজা থেকে অনেক ছেলে উঁকি দিয়ে দেখছে, পুলিশ এ সমাজে খুব ভয়াবহ জীব। পুলিশ অফিসার হাত বাড়ালেন, চিনতে পারছেন?

চিনতে পারল রুমী, এক রাত হাজতবাসের সময় এই পুলিশ অফিসার তাকে জেরা করেছিলেন, তাকে অবিশ্বাস করে হাজতে পুরেছিলেন আবার তার কথা সত্যি হওয়ার পর নিজে গিয়ে লকআপ খুলে বের করে এনেছিলেন। রুমী হাত বাড়িয়ে বলল, চিনতে পারব না! এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাব! আমার জীবনের প্রথম হাজতবাস!

ভদ্রলোক জোরে জোরে হাসলেন, তাই শুনে আশেপাশের সবাই বুঝল ভয়ের কিছু নেই, যে যার নিজের কাজে ফিরে গেল। ভদ্রলোক রুমীর সাথে তার ঘরে ঢুকে এদিক-সেদিক তাকালেন। চমৎকার ঘর, চমৎকার দৃশ্য ইত্যাদি বলে রুমীকে একটা সিগারেট দিয়ে নিজে আরেকটা ধরিয়ে কাজের কথায় চলে এলেন। রুমী বুঝতে পেরেছে কি জন্যে এসেছেন, তবু নিজের কানে শোনার জন্যে অপেক্ষা করে রইল।

মনে আছে আপনি হাজতে বসে আশফাক হাসানের কেসটা কীভাবে বলে দিয়েছিলেন?

মাথা নাড়ে রুমী।

আমি নিজে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। অবিশ্বাস্য!

চুপ করে থাকে রুমী। ভদ্রলোক একটু নিচু গলায় বললেন, আপনাকে আবার সাহায্য করতে হবে।

রুমী নড়েচড়ে বসে বলে, কি সাহায্য?

পুলিশ ডিপার্টমেন্ট কিছুতেই বাচ্চাদের মার্ডারকে ধরতে পারছে না। কোনোদিকে এতটুকু চিহ্ন নেই। এত চেষ্টা করা হচ্ছে আপনি কল্পনা করতে পারবেন না, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। আপনি যদি আগের মতো বলে দেওয়ার চেষ্টা করেন, জাস্ট একটু ধরিয়ে দেবেন, কোনো ধরনের ব্লু, জাস্ট ছোট একটা ক্ল…

রুমী আস্তে আস্তে বলে, আমি পারলে সত্যি বলতাম। আপনি না এলেও আমি চেষ্টা করতাম। ঠাট্টা করে বলে, অন্তত টাকাটার লোভে চেষ্টা করতাম! কিন্তু বিশ্বাস করুন, আজ তিন বছর ধরে

আমি আর পারি না। একেবারেই পারি না।

ভদ্রলোকের খুব আশাভঙ্গ হলো। মরিয়া হয়ে লুকিয়ে রুমীর কাছে এসেছিলেন তিনি। শিশু হত্যাকারীকে ধরার জন্যে সম্ভাব্য সবকিছু চেষ্টা করা হচ্ছে। পুলিশের ডিআইজি নিজে নাকি সব কজন পীরের কাছে গিয়ে ধর্না দিয়েছেন, কোনো লাভ হয় নি।

ভদ্রলোক যাবার সময় রুমীকে নিজের নাম আর ফোন নম্বর দিয়ে গেলেন। যদি কোনোভাবে কোনোরকম হদিস পায় তাকে জানাতে যেন দ্বিধা না করে।

রুমী সে রাতে অনেকক্ষণ ভাবল ব্যাপারটা। তার যে কথাটা আগে মনে হয় নি তা নয়, এমনকি কিবরিয়া ভাইও একবার তাকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। পুরস্কারের টাকাটা এক লাখ হয়ে যাবার পর তার নিজেরও প্রচণ্ড লোভ হয়েছিল। তবু কিছুতেই সেই অন্ধকার জগতে ফিরে যেতে চায় না রুমী। যাদের অভিজ্ঞতা হয় নি তারা কোনোদিন ওর ব্যাপারটা বুঝতে পারবে না। এটা অনেকটা চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো, ড্রাইভার ট্রেনের ব্রেক কষে থামাতে পারবে কি না জানা নেই। যতবার ওই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে, ততবারই সে তার ভেতর থেকে ফিরে আসতে পারবে বলে ভাবতে পারে নি। ব্যাপারটা এখন অতীত, তবু ওর বুকের ভেতর ভয়টুকু রয়ে গেছে, প্রচণ্ড অশরীরী ভয়, সে ভয়ের রাজ্যে আর ফিরে যেতে চায় না রুমী।

ঘুরেফিরে একসময়ের সর্বনাশা ক্ষমতার কথা মনে হতে থাকে ওর। শিশু হত্যাকারীদের ওপর সবার মতো সে নিজেও এমন বিরক্ত হয়ে উঠেছে যে বলার নয়, আরও কিছুদিন এরকম চললে ও সত্যিই চেষ্টা করে দেখবে হত্যাকারীর মনের ভেতর প্রবেশ করা যায় কি না। এখন সে তা পারে না, ক্ষমতাটা শেষ হয়ে গেছে, তবু চেষ্টা করাটা ওর কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে জানে হয়তো তার ভেতরে কোথাও এখনো ক্ষমতাটা লুকিয়ে আছে, চেষ্টা করলেই বের হয়ে আসবে। তাই যদি হয়, তবে শিশুগুলির মৃত্যুর জন্যে সে-ও খানিকটা দায়ী হবে।

চিৎকার করে উঠে বসে রুমী। স্বপ্নে দেখেছে ছোট একটা শিশু প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আর্তনাদ করছে। যন্ত্রণায় ওর সারা মুখ বিকৃত হয়ে উঠেছে, চোখ দুটি যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দেখতে দেখতে ছোপ ছোপ রক্তে ওর মুখ ভরে উঠছে। শিশুটি তখনো চিৎকার করে যাচ্ছে, অসহায় ব্যাকুল চিৎকার, দেখে বুক ফেটে যেতে চায়।

ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসে রুমী, দরদর করে ঘামছে সে, বুকের ভেতর ধক ধক করছে। কি ভয়ানক! ইশ! কি ভয়ানক স্বপ্ন!

রুমীর বুকের ভেতর বহু পুরোনো চাপা একটা ভয় বাসা বাঁধতে থাকে, ও জানে এটা শুধু স্বপ্ন নয়-স্বপ্নের থেকে অনেক বেশি।

পরদিন ভোরে খবরের কাগজে বড় বড় করে লেখা হলো, আরও একটি হতভাগ্য শিশু। পাশেই শিশুটির রক্তাক্ত ছবি। রুমী চিনতে পারল একেই সে দেখেছে গতরাতে।

নয়

সারাদিন ধরে প্রস্তুতি নিল রুমী, আজ রাতে সে শিশু হত্যাকারীকে খোঁজার চেষ্টা করবে। আগে কখনো এ ধরনের চেষ্টা করে নি ও, পারবে কি না তাও জানে না, কিন্তু আগের রাতে সেই হতভাগ্য শিশুটিকে দেখার পর ওর মনে হয় ব্যাপারটা সম্ভব হতেও। পারে। ওর প্রস্তুতির বেশির ভাগই মানসিক। শানুকে একটা লম্বা চিঠি লিখল, অনেকদিন দেখা হয় না, সময় পেলেই বেড়াতে যাবে, ভাগনেরা সব কেমন আছে–এ ধরনের কথাবার্তা। দুপুরে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে পরিষ্কার কাপড় পরল সে। খাওয়ার পর ভালো এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আনল দোকান থেকে। লাইব্রেরির কটা বই ছিল তার কাছে, সব সময় পাওয়া যায় না। অনেক কষ্টে পেয়েছে সে, তবু সেগুলি কি ভেবে ফেরত দিয়ে এলো। একটা ছেলের কাছ থেকে দশ টাকা ধার করেছিল সেদিন, টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে এলো। পুলিশ অফিসারকে জানাবে কি না ভেবে না পেয়ে, না জানানোই ঠিক করল। রাতে যদি ওর কিছু একটা হয়ে যায় সেটা ওর পাশের রুমের ছেলেটি জানতে পারবে। আজকাল ভোরে নাস্তা করতে যাওয়ার সময় রোজ তাকে ডেকে নিয়ে যায়। সন্ধ্যে হয়ে এলে বুকের ভেতর যেন কেমন করতে থাকে। রুমীর। কে জানে শেষ পর্যন্ত কিছু হবে কি না! সে একটু পর পর নিজের মনের ভেতর খুঁজে দেখে অশুভ কোনো অনুভূতি জেগে উঠছে কি না। আজ সারাদিনই ওর বুকে একটা চাপা ভয়, সবকিছুকেই ওর অশুভ মনে হয়।

একটু সকাল সকাল খেয়ে নেয় রুমী। কারো সাথে কথা না বলে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। বাতি নেভানোর আগে একটা সিগারেট ধরায়, অন্ধকারে সিগারেট খেয়ে সে মজা পায় না। কোনোরকমে সিগারেট শেষ করে বাতি নিভিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বিছানায় বসে। বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে শিশুগুলির কথা ভাবতে থাকে সে। যে মানুষ এরকম অবোধ শিশুদের মারতে পারে সে না জানি কি রকম! কে জানে হয়তো এটাও কোনো ধরনের প্রেত-সাধনা–রুমীর বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে। সাথে সাথেই তার টুপি মাথায় সেই বৃদ্ধিটির কথা মনে। পড়ে, সে তাকে বুঝিয়েছিল মানুষের ভেতর কত ক্ষমতা আছে তা সে জানে না, জানলে প্রথিবী অন্যরকম হয়ে যেতো। সে নিজেকে সাহস দেয় অতীতে যা ঘটেছে তা অতীতেই থাকবে, ভবিষ্যতে আর ঘটতে দেবে না।

…লুসি ইন দা স্কাই…ডায়ম…হঠাৎ করে রুমীর ভেতরে একটা ইংরেজি গানের সুর ভেসে ওঠে। মুহূর্তে সোজা হয়ে বসে রুমী। কেউ একজন গান গাইছে! কে লোকটা? হঠাৎ গান বন্ধ হয়ে তীব্র গালাগালি শুরু হয়ে যায়, সে ভাষা বুঝতে পারে না রুমী কিন্তু অনুভূতিটা বুঝতে পারে। প্রচণ্ড ঘৃণা কারো ওপর, প্রচণ্ড ঘৃণা! চোখ বন্ধ করে দেখার চেষ্টা করে রুমী, কিচ্ছু দেখতে পায় না। সমস্ত মনপ্রাণ একত্র করে সে চেষ্টা করতে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ একটা দুটো ছবি ভেসে ওঠে, কিন্তু তেমন পরিষ্কার হয় না। মনে হচ্ছে সে দ্রুত ভেসে যাচ্ছে, যেন হাওয়ায় ভর করে-একটা দোকান, একটা লাইট পোস্ট, ঠেলাগাড়িতে শুয়ে আছে একজন…আবার অন্ধকার।

আর একটা হলেই হয়। শালারা এত সাবধান হয়ে গেছে! আবার অশ্রাব্য গালি, এবারে বাংলায়। রুমী বুঝতে পারে লোকটা ছোট বাচ্চার কথা বলছে। সে ঠিক লোকটাকেই পেয়েছে। এতক্ষণ ভাবছিল বিদেশি, কিন্তু না বিদেশি নয়। সারা মনপ্রাণ একত্র করে মানুষটার ভেতরে মিশে যাবার চেষ্টা করে রুমী, পারে না, বারবার লোকটা ওর কাছ থেকে যেন ফস্কে বেরিয়ে যায়। কিন্তু সে হাল ছাড়ে না, প্রচণ্ড একাগ্রতা নিয়ে পেছনে লেগে থাকে।

আস্তে আস্তে লোকটাকে অনুভব করতে পারে সে, দেখতে পায় লোকটার চোখ দিয়ে, ভাবনাগুলি জানতে পারে। গাড়ি চালাচ্ছে রুমী, চোখ দুটি ঘুরছে রাস্তার দুপাশে, ছোট শিশু খুঁজছে সে। আপন মনে গান গাইছে, লুসি ইন দ্য স্কাই উইথ ডায়মন্ড, ঘুরেফিরে একটা লাইনই গাইছে সে অনেকক্ষণ ধরে। কি গান এটা? লোকটাকে দেখতে পায় না ও, তার চোখ দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখে, কিন্তু তাতে লাভ কি? লোকটাকে ওর দেখা দরকার।

পারল না রুমী, হঠাৎ করে সে লোকটার অনুভূতি হারিয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ লাগল ওর বুঝতে ও কোথায় আছে। নিজের বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। ভীষণ ক্লান্তি অনুভব করে, আগে কখনো সে এত ক্লান্তি অনুভব করেনি। কে জানে, জোর করে চেষ্টা করছে বলেই হয়তো এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তবু ওর বুকের ভেতরটা হালকা হয়ে যায়। লোকটাকে পেয়েছে সে, এবারে তার পরিচয় বের করতে হবে। লোকটার গাড়ি আছে, অন্ধকারে বোঝা যায় না কি রং। বিদেশি ভাষায় কথা বলতে পারে সে, ইংরেজি গান গায় লুসি ইন দ্য স্কাইন না কি যেন। কি গান এটা? বেশিক্ষণ ভাবতে পারে না রুমী, মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়ে সে।

পরদিন ফোন করে পুলিশ অফিসারকে পেল না রুমী, কি কাজে জানি রাজশাহী গেছেন, দুদিন পর ফিরে আসবেন। একটু আশাভঙ্গ হলো তার, ভদ্রলোক শুনলে খুশি হতেন। অবিশ্যি এখন পর্যন্ত সে বিশেষ কিছু জানতে পারে নি, লোকটা কোথায় থাকে বের করতে হবে, কি রকম চেহারা, কি নাম সব জানতে হবে।

রাত গম্ভীর হয়েছে। লোকটা আবার গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। লাল রঙের গাড়ি, রুমী দেখতে পেয়েছে আজ। লোকটা গাড়ি চালায় খুব বেপরোয়াভাবে। প্রতিবার একটা রিকশা পার হয় আর কুৎসিত গালি দেয় রিকশাওয়ালাকে। লোকটা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে একটা বাচ্চার জন্যে, অপেক্ষা করতে পারছে না আর। গান গাইতেও মনে নেই, চোখ দুটো শুধু নড়ছে দুই পাশে।

কি একটা কাজ আটকে আছে ওর, রুমী অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারল না। একটা বাচ্চা না পেলে সে কাজটা শেষ করতে পারছে না। অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিচ্ছে বাচ্চাদের, মানুষ বলেই ভাবে না, কুকুর-বেড়ালের মতো দেখে সে ওদের। জীবন সার্থক করে দিচ্ছে সে শিশুগুলির, সেজন্যে ওদের খুশি হওয়া উচিত। মরে তো এমনিতেই শেষ হবে, একটা কাজে লাগলে ক্ষতি কি?

তৃতীয় রাত। ঘরের বাইরে গেল না রুমী, অন্ধকার ঘরে বসে মদ খেলো সারাক্ষণ। মন-মেজাজ খুব খারাপ, মদ খেয়ে আরও খারাপ হয়ে গেল। বসার ঘরে টেলিফোন বেজেই চলল, সে গিয়ে ধরল না পর্যন্ত।

চতুর্থ রাত। কি আনন্দ! কি আনন্দ! বাচ্চা পেয়েছে সে একটা, ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে এখন। কাল ভোর থেকেই কাজ শুরু করে দেবে। অনেক দূর যেতে হয়েছে আজ, শহরের সবাই এত সাবধান হয়ে গেছে যে বলার নয়। তার এতগুলি কায়দা ছিল বাচ্চা ধরে আনার তবু কোনোটাই কাজে লাগছে না আজকাল। দূরে গ্রামের দিকে শিশুগুলি এখনো সাবধান হয় নি, সেখান থেকেই ধরে এনেছে সে। সবার এটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার দরকার কি সে বুঝতে পারে না। সে তো খারাপ কিছু করছে।, বাচ্চাগুলি তো এমনিতেই মরে ভূত হয়ে যেতো, এখন তবু একটা কাজে লাগছে। লোকটা হালকা সুরে গান গাইতে গাইতে ঘুরে বেড়াতে থাকে। বাথরুমে গেল, রুমী প্রস্তুত হয়ে নিল সাথে সাথে, বাথরুমে আয়নায় চেহারা ভালো করে দেখে নিয়ে মনে রাখতে হবে। চেহারার থেকে বেশি দরকার লোকটার পরিচয়, বাসার ঠিকানা।

বাথরুমে বাতি জ্বালিয়ে লোকটা আয়নার দিকে তাকাল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজেকে দেখছে।

লোকটাকে আগে দেখেছে রুমী, কিন্তু মনে করতে পারছে না কোথায় দেখেছে। কে? কে লোকটা? কে?

হঠাৎ চিনতে পারে রুমী, হতবাক হয়ে যায়, শাজাহান সুজা!

পুলিশ অফিসার গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লেন, আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে এখন।

রুমী জোর দিয়ে বলল, আমি স্পষ্ট দেখেছি শাজাহান সুজাকে। আমি ওকে ভালো করে চিনি, ওর একটা লাল গাড়িও আছে।

কিন্তু ওর বাসায় আমি কিছু পাই নি, বললেন পুলিশ অফিসার। সবকিছু তন্নতন্ন করে দেখেছি। ভীষণ খেপেছে শাজাহান সুজা, ডিআইজিকে ফোন করেছে, এখন আমার চাকরি যাবার দশা।

রুমী মাথা নেড়ে বলল, আমি স্পষ্ট দেখেছি, বিশ্বাস করুন আমাকে।

কিন্তু কি করবে ও বাচ্চাকে মেরে?

জানি না। কি একটা খুব নাকি জরুরি দরকার। কি কাজ কিছুতেই বুঝতে পারলাম না।

পুলিশ অফিসার মুখ গম্ভীর করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। একটু পড়ে বললেন, হয়তো এতদিন পরে আপনার ক্ষমতাটা কমে আসছে, ঠিক করে বলতে পারছেন না আজকাল…

উত্তেজিত হয়ে বাধা দেয় রুমী, কক্ষণো না। আমি ঠিক বুঝতে পারি কখন কি হচ্ছে।

কিন্তু আমাদের হাত-পা বাঁধা। শাজাহান সুজাকে হাতেনাতে ধরতে না পারলে কিছুতেই প্রমাণ করা যাবে না। আপনার কথার ওপর ভরসা করে ওকে তো অ্যারেস্ট করতে পারি না।

রুমী এবারে রেগে ওঠে। চেষ্টা করে রাগটা চেপে রাখতে, তবু ওর গলার স্বরে সেটা প্রকাশ হয়ে যায়, আপনিই নিজে গিয়ে আমাকে অনুরোধ করলেন একটা কিছু আভাস দিতে। এখন আমি বলে দিচ্ছি লোকটা কে তবু আমার কথা বিশ্বাস করছেন না।

বিশ্বাস করছি না কে বলল? ভদ্রলোক বাধা দিলেন, আপনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে শাজাহান সুজাকে চোখে চোখে রাখলেই সে ধরা পড়বে।

কতদিন চোখে চোখে রাখবেন?

যতদিন সে আবার একটা কিছু না করছে।

মানে? আর সে যে আরেকটা বাচ্চা ধরে এনেছে। তাকে যদি…

আমি ওর বাসা দেখেছি, কোনো বাচ্চা নেই।

আমি বলছি আছে, আমাকে নিয়ে চলুন।

তা হয় না। ভদ্রলোক নরম গলায় বললেন, শাজাহান সুজা খুব ক্ষমতাশালী লোক। আপনি বুঝবেন না, ওকে হাতেনাতে ধরলেও ওর নামে কেস করা খুব মুশকিল হবে।

আস্তে আস্তে বলল রুমী, তার মানে আপনি ওই বাচ্চাটাকে শাজাহান সুজার হাতে মরতে দেবেন?

ভদ্রলোক দুর্বল গলায় বললেন, ওর বাসায় কোনো বাচ্চা নেই।

রুমী টেবিলে কিল মেরে বলল, একশোবার আছে। কাল-পরশু যখন বাচ্চাটাকে রাস্তায় মরে পড়ে থাকতে দেখবেন তখন বিশ্বাস করবেন।

আমাদের ওই একটা চান্স! আপনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে শাজাহান সুজাকে কোথাও না কোথাও মৃতদেহটা ফেলতে হবে। তখন হাতেনাতে ধরে…

রুমী লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়, চিৎকার করে বলে, তার মানে ওই ছেলেটাকে জান দিতে হবে ওকে ধরার জন্যে, আপনারা জেনেশুনে শিশুটিকে মরতে দিচ্ছেন?

ব্যস্ত হবেন না, আমার কথা শুনুন। ভদ্রলোক রুমীকে হাত ধরে বসিয়ে দিলেন।

ব্যাপারটা এইভাবে দেখুন, ছেলেটা হয়তো মারা যাবে, তবু আমরা ওকে ধরতে পারব, এ ছাড়া তাকে ধরার আর কোনো উপায় নেই। আপনার কথা শুধু আমিই বিশ্বাস করছি, অন্য কেউ বিশ্বাস করবে না। শুধু তাই নয়, আপনি যদি অন্য কাউকে এটা বলতে যান, আপনি নিজে সমস্যায় পড়ে যাবেন। শাজাহান সুজা ছলিমদ্দি, কলিমদ্দি না, শাজাহান সুজা হচ্ছে শাজাহান সুজা, দেশের সম্পদ। ওই বাচ্চাটা মারা গিয়ে হয়তো আরও দশটা বাচ্চার জান বাঁচাবে।

মাথা নাড়ে রুমী, আমি কিছুতেই আপনার কথা মানতে পারব না। এক হাজার পুলিশ দিয়ে ওর বাড়ি ঘেরাও করুন, হারামজাদাকে ধরে গরুর মতো পিটিয়ে ওর মুখ থেকে কথা বের করুন…

আপনি এখনো অনেক ছেলেমানুষ। দুনিয়া বড় কঠিন। জায়গা। পকেটমারকে ধরে পেটানো যায়, যদিও সে পকেট মারছে ছেলেমেয়েদের খাওয়ানোর জন্যে। শাজাহান সুজারাও ছাড়া পেয়ে যায়, যদিও খুন করছে নিছক আনন্দের জন্যে।

ঠিক তক্ষুনি একটা টেলিফোন এলো। রুমী পুলিশ অফিসারের কথা শুনে বুঝতে পারে শাজাহান সুজার বাসায় গিয়েছিলেন বলে কৈফিয়ত তলব করা হচ্ছে। খবরের কাগজে খবর চলে গিয়েছে, কাল ভোরে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। ভদ্রলোক মুখ কালো করে শুনে গেলেন। কোন খবরের ওপর ভরসা করে শাজাহান সুজার বাসায় গিয়েছিলেন বলার উপায় নেই। আমতা আমতা করে বললেন, সাভারের রাস্তায় একটা লাল গাড়ি দেখা গিয়েছিল, শাজাহান সুজার গাড়িও লাল…।

ফোনের অন্য পাশ থেকে একটা অট্টহাসির মতো শব্দ ভেসে এলো। রুমী প্রায় দুহাত দূরে বসে স্পষ্ট শুনল ওপাশ থেকে বলছে, তাহলে ফায়ার ব্রিগেডের লোকজনকে অ্যারেস্ট করো না কেন? ওদের গাড়িও তো লাল!

ভদ্রলোক ফোন রেখে বললেন, আজকালের ভেতর এটার কোনো কিনারা না হলে আমার গারো পাহাড়ে পোস্টিং হয়ে যাবে!

ক্ষুব্ধ হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াল রুমী, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে সেও খানিকটা বুঝতে পেরেছে কেন এখন শাজাহান সুজাকে ধরার উপায় নেই। ওর মনে পড়ে প্রেত উপাসকের দল হাতেনাতে ধরা পড়েও শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল। তবুও চুপচাপ একটা শিশুকে মরতে দিতে কিছুতেই ওর মন সায় দিচ্ছে না।

রুমী খেয়াল করে নি কখন সে হাঁটতে হাঁটতে শাজাহান সুজার বাড়ির কাছে চলে এসেছে। সম্ভ্রান্ত এলাকা, ঝকঝকে বাসাগুলি আশ্চর্য রকম চুপচাপ। প্রায় বাসাতেই বড় বড় কুকুর, ঘেউ ঘেউ করে ঐশ্বর্যের কথা জানিয়ে দেয়।

শাজাহান সুজার বাড়িটি একতলা, ছিমছাম। বাইরে বড় লোহার গেট, সেখানে মস্ত তালা ঝুলছে। এক মুহূর্তের জন্যে দাঁড়াল রুমী। কে জানে হয়তো এর ভেতর এখন শাজাহান সুজা বাচ্চাটিকে হত্যা করছে। ভাবতে ভাবতে একটা শিশুর তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পেল রুমী। চমকে ঘুরে তাকায় সে, কেউ নেই। চিৎকারটি সে শুনতে পায়নি, অনুভব করেছে। কিন্তু এত স্পষ্ট আর

জীবন্ত অনুভূতি এর আগে কখনো হয় নি।

চলে যাচ্ছিল রুমী, হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। শাজাহান সুজার গলা শুনতে পেল সে, দেখি কত সহ্য করতে পারিস হারামজাদা। রুমীর মনে হলো ওর কানের কাছে চিৎকার করে বলছে শাজাহান সুজা। এত জীবন্ত গলার স্বর যে রুমীর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

আবার শাজাহান সুজার হিংস্র চিৎকার শুনতে পেল রুমী, আর সাথে সাথে একটা শিশুর প্রাণফাটা আর্তনাদ। রুমীর চোখের সামনে একটা শিশুর রক্তমাখা মুখ এক মুহূর্তের জন্যে ভেসে ওঠে। ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রায় ছুটতে থাকে সে, আর সহ্য করতে পারে না। কিন্তু ছুটে গিয়েও রেহাই পায় না সে, শিশুটার প্রাণফাটা আর্তনাদ তাকে তাড়া করতে থাকে।

পাগলের মতো ছুটতে থাকে রুমী, আর কি ভাগ্য তখনি খালি রিকশা পেয়ে যায়। কোনোমতে উঠে বলে, তাড়াতাড়ি চলো।

কোথায়?

যেখানে খুশি। রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে প্রাণপণে রিকশা ছুটিয়ে চলে।

অনেকক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরে পায় রুমী। অনেক ঘুরেফিরে সে হলের কাছে এসে পৌঁছেছে। বাচ্চাটার আর্তনাদ আর সে শুনতে পাচ্ছে না কিন্তু তাতে লাভ কি? সে ভুলবে কি করে?

দশ

সারা বিকেল সে চুপচাপ বসে ভেবেছে। ঘুরেফিরে বারবার ওর তিন বছর আগের সেই টুপি মাথায় শান্ত মতন বুড়ো লোকটার কথা মনে পড়েছে। তাকে বলেছিল, বাবা, তোমার সাহস থাকলে বলতাম তুমি ওই লোকদের শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দাও। তখন তার সাহস ছিল না, যে কোনোভাবে এই যন্ত্রণাদায়ক ক্ষমতার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এখন অন্য ব্যাপার, সে নিজেই এখন তার ভেতর সেই পুরোনো ক্ষমতা জাগিয়ে তুলেছে। এবারে সে চেষ্টা করে দেখতে পারে না? শাজাহান সুজাকে একটা শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দিতে পারে না? এতে শিশুদের আত্মা যদি একটু শান্তি পায়, সেটুকুই লাভ।

কথাটা যতই ভাবে ততই তার স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে উঠতে থাকে। আস্তে আস্তে নিজের ভেতরে একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসের অস্তিত্ব অনুভব করে সে। সন্ধ্যায় খেতে বসে থেকে থেকে তার মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে কেমন একটা কঠোর ভাব ফুটে ওঠে। সামনের চেয়ারে পরিচিত ছেলেটি রুমীকে দেখে অবাক হয়ে বলল, কি রে রুমী, কি হয়েছে তোর?

মুহূর্তে মুখের মাংসপেশি শিথিল করে হেসে বলল, না কিছু না।

মুখ এমন করে রেখেছিস যেন কাউকে মারবি!

একটু হাসল রুমী, কাকে মারবে? ও কি জানে মারলে তার কি শাস্তি হবে?

শান্ত হয়ে নিজের ঘরে বিছানায় বসে আছে রুমী। ঘরের বাতি বন্ধ, খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো বিছানার ওপর এসে পড়েছে। আজকাল তার আর ভয় হয় না, নিজের ক্ষমতার ওপর একটা বিশ্বাস জন্মে গেছে। অবিশ্যি আজ দুপুরে সে যখন শাজাহান সুজার বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল তখন তার নিজের ইচ্ছার ওপর কোনো হাত ছিল না। সে শাজাহান সুজার হিংস্র চিৎকার আর বাচ্চাটির আর্তনাদ কিছুই শুনতে চাচ্ছিল না। তবু তাকে শুনতে হয়েছে। পুরো অনুভূতিটা এত তীব্র আর এত জীবন্ত ছিল যে তার সহ্য করা পর্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছিল। কে জানে খুব কাছাকাছি থাকলে হয়তো এরকম তীব্র অনুভূতিই হয়।

চোখ বন্ধ করে, মনপ্রাণ অনুভূতি একত্র করে শাজাহান সুজার ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে রুমী।

শাজাহান সুজা ছবি আঁকছে–যন্ত্রণাকাতর ভীত একটা শিশু হাত-পা শক্ত করে চেয়ারের সাথে বাঁধা। একটু পর পরই সে একটা বড় ধারালো ছুরি দিয়ে ভয় দেখিয়ে শিশুটার এখানে-সেখানে খোঁচা মারছে। প্রাণপণে আর্তনাদ করে ওঠে শিশুটা, তীক্ষ্ণ চোখে সে তখন শিশুটাকে লক্ষ করে। তারপর তুলিতে রং লাগিয়ে ছবিতে মন দেয়। ছবিতে শিশুটির চেহারা এই শিশুটির মতো নয়। সে ইচ্ছা করেই কোনো নির্দিষ্ট শিশুর চেহারা নেয় নি, শুধু তাদের যন্ত্রণার অভিব্যক্তিটি ধরার চেষ্টা করেছে। আশ্চর্য রকম জীবন্ত এ ছবিটি, হঠাৎ দেখলে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন মুহূর্তের জন্যে থেমে যেতে চায়। শাজাহান সুজার ছবি আঁকা শেষ হয়ে গেছে। এখন সে খুব সূক্ষ্ম কটি জিনিস দেখে নিতে চায়। বাড়তি আলো লাগিয়েছে আজ, একটা ক্যামেরা রেখেছে বাচ্চাটির যন্ত্রণাকাতর মুখের ছবি তুলতে। যে অভিব্যক্তি তার আঁকা ছবিতে ফোঁটানোর চেষ্টা করেছে ক্যামেরার ফিল্মে তা ধরা পড়ে না, তবু শিশুগুলির ছবি তুলছে সে, কে বলতে পারে হয়তো পরে কাজে লাগবে।

ছবিটির এখানে-সেখানে তুলির একটি দুটি পোচ দিয়ে মাথা সরিয়ে দেখে শাজাহান সুজা। মুখে ওর পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু থেকে থেকে তার ভেতরে একটা দুশ্চিন্তা এসে উঁকি দিচ্ছে। পুলিশ অফিসার কি করে তাকে সন্দেহ করল? ভাগ্যিস জানালা দিয়ে সে পুলিশের জিপটা দেখেছিল, বাচ্চাটির মুখ শক্ত করে বেঁধে আলমারির পেছনে গোপন জায়গাটাতে লুকিয়ে রাখার মতো সময় পেয়েছিল সে! কিন্তু পুলিশ অফিসার বুঝল কি করে? সবচেয়ে অবাক লাগে যখন হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় কেউ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে হঠাৎ অন্য কেউ যেন কথা বলে ওঠে। কে জানে ওইসব মৃত শিশুর আত্মা মিছিল করে তাকে মারতে আসে কি না।

এসব ভেবে শাজাহান সুজার হাসি পেয়ে যায়, কিন্তু ছবিটির দিকে তাকিয়ে আবার সে গম্ভীর হয়ে পড়ে। ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবি। এটা শেষ করে মারা গেলেও তার দুঃখ নেই। কি আনন্দ! নিখুঁত একটা ছবি এঁকে এত আনন্দ সে জানতো না। নিখুঁত ছবি কটি আছে পৃথিবীতে? একেই বোধ হয় সৃষ্টি বলে সৃষ্টি! বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করে ঈশ্বর বুঝি এরকম আনন্দ পেয়েছিলেন। সে যেটা করেছে সেটাই তো সৃষ্টি অসাধারণ সৃষ্টি। যুগ যুগ ধরে মানুষ জানবে যন্ত্রণা কাকে বলে, মৃত্যুভয় কাকে বলে। যারা যন্ত্রণাকে কোনোদিন অনুভব করেনি। তারা যন্ত্রণাকে অনুভব করবে। জীবন্ত মানুষ মৃত্যুর আগেই পারবে মৃত্যুকে অনুভব করতে।

শাজাহান সুজার চোখে পানি এসে যায়। এরকম মহান একটা সৃষ্টির জন্যে না হয় কটা প্রাণ গেলই। আর সে তো খুঁজে গরিব, দুঃখী, ভাগ্যহীন শিশুদেরই বেছে নিয়েছে। এরা বড় হলে তো অনুভূতিহীন নির্বোধ মানুষ হয়েই বড় হতো, ক্ষুধার অনুভূতি ছাড়া আর কি অনুভূতি আছে এদের? সুন্দর কিছু দেখার, অনুভব করার ক্ষমতা এদের কখনো হতো না। পৃথিবীটা তো এদের জন্যে তৈরি হয় নি, এরা কীটপতঙ্গের মতো জন্মায়, কীটপতঙ্গের মতো মারা যায়। অল্প কজন মানুষ শুধু প্রতিভা নিয়ে জন্মায়, ওদের দেখার চোখ থাকে, বোঝার ক্ষমতা থাকে, অনুভব করার শক্তি থাকে, পৃথিবীটা তো তাদের জন্যেই। অন্যেরা শুধু পেটের ক্ষুধা, বড়জোর দেহের ক্ষুধা নিয়ে বেঁচে থাকে। ওদের বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার মাঝে পার্থক্য কি?

অপলক দৃষ্টিতে ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে শাজাহান সুজা, ওর মুখ কোমল হয়ে আসে। চোখ থেকে মমতা যেন বৃষ্টির ফোঁটার মতো গড়িয়ে পড়ে। এরকম পরিতৃপ্তি ওর জীবনে আর কখনো আসে নি। ছবিটির দিকে তাকালে মনে হয় যন্ত্রণাকাতর একটি শিশুর মুখ, ভালো করে দেখলে চোখে পড়ে শুধু যন্ত্রণা নয় আরও কিছু আছে এতে। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে ছোট একটা শিশু যখন তার যন্ত্রণাকে ভুলে গিয়ে ভাগ্যের কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত হয় তখন তার চোখে মুহূর্তের জন্যে যে বিচিত্র দৃষ্টি ফুটে ওঠে, এটি সেই মুহূর্তের ছবি। যন্ত্রণা যখন ভীতির রূপ নেয়, আশা যখন ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে, সুখ-দুঃখ যখন অর্থহীন হয়ে যায় এটি ঠিক সেই পরিবর্তনের মুহূর্ত।

ছবি আঁকা শেষ হয়েছে। তুলিটা রেখে দিয়ে সে একটু পিছিয়ে এসে দাঁড়ায়। আহা! কি ছবি! ঘরের আলোগুলি একটু সরিয়ে দেয়, অন্যদিক থেকে আলো এসে পড়ায় ছবিটা একটু অন্যরকম লাগতে থাকে। জিব দিয়ে একটা আনন্দের শব্দ করল শাজাহান সুজা।

অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিল বাচ্চাটা, এবারে হঠাৎ যন্ত্রণার অস্ফুট একটা শব্দ করল। শাজাহান সুজা ভুরু কুঁচকে বাচ্চাটার দিকে তাকায়। সে ভুলেই গিয়েছিল বাচ্চাটার কথা। এর প্রয়োজন শেষ, পারলে সে ছেড়েই দিত বাচ্চাটাকে। তেলাপোকা মারতেও তো খারাপ লাগে, আর এ তো মানুষের বাচ্চা! কিন্তু ছাড়তে পারবে না সে, জানাজানি হয়ে যাবে তাহলে। মরার আগে একেকটার গায়ে কি ভয়ানক শক্তি এসে যায়, শাজাহান সুজার মনের আনন্দটা বিরক্তিতে ম্লান হয়ে আসে। কম ঝামেলায় কীভাবে বাচ্চাটাকে মারা যায় ভাবতে বসল সে। মারার পর এটাকে আবার বাইরে নিয়ে ফেলে আসতে হবে, কে জানে ওই মাথা খারাপ পুলিশ অফিসার আবার তার ওপর পাহারা বসিয়ে রেখেছে কি না। তাহলে সে এটাকে এখন বাইরে নিয়ে ফেলতেও পারবে না। হয়তো কেটে টুকরো টুকরো করে ছোট ছোট প্যাকেটে ভরে..ভাবতেই শাজাহান সুজার মন বিরক্তিতে বিষিয়ে ওঠে।

মনের এত পরিতৃপ্তির ভাবটা এই বাচ্চাটার জন্যে নষ্ট হয়ে গেল। শাজাহান সুজা এগিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড একটা লাথি মারে বাচ্চাটাকে। এক লাথিতে মরে গেলেও চুকে যেতো, মরেও না শালার বাচ্চা! বাচ্চাটা প্রচণ্ড লাথি খেয়েও কেন জানি এবারে ডুকরে কেঁদে উঠল না, হয়তো বুঝতে পেরেছে এখন ওকে কি করা হবে। অদ্ভুত বোবা একটা দৃষ্টিতে শাজাহান সুজার দিকে তাকিয়ে রইল সে, দেখে আরও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার।

ফ্রিজ খুলে একটা বিয়ারের বোতল বের করে আনতে হলো তাকে। সোফায় বসে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে সে ভাবতে থাকে কি করা যায়।

এদিকে মনপ্রাণ এক করে শাজাহান সুজার ওপর নিজের প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছে রুমী, ও জানে না কি করতে হয়, কি করবে কোনো ধারণা নেই। প্রথমে চেষ্টা করছে শাজাহান সুজার অস্তিত্ব থেকে নিজের অস্তিত্ব আলাদা করে রাখতে। প্রথম প্রথম পারছিল না, বারবার মনে হচ্ছিল সে নিজেই শাজাহান সুজা। আস্তে আস্তে সেটা সম্ভব হয়েছে, এখন শাজাহান সুজার অস্তিত্বের মাঝে থেকেও সে আলাদা হয়ে আছে। শাজাহান সুজার অস্তিত্বে বসে থেকে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে সে। কোনো লাভ হচ্ছে না, শাজাহান একমনে বিয়ার খেয়েই চলছে। সমস্ত শক্তি একত্র করে সে ডাকার চেষ্টা করল শাজাহান সুজাকে, কোনো লাভ হলো না। রুমী জানে একবার যদি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে তবে নিজের ওপর বিশ্বাস বেড়ে যাবে হাজার গুণ, সঙ্গে সঙ্গে শক্তিও বেড়ে যাবে অনেকখানি। তাই সে হাল ছাড়ল না, আবার ডাকল শাজাহান সুজাকে আবার ডাকল-কিন্তু কোনো লাভ হলো শাজাহান সুজা সোফায় বসে চুক চুক করে বিয়ার খেয়েই চলেছে।

খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বিশ্বাস সঞ্চয় করার চেষ্টা করে রুমী। নিশ্চয়ই পারবে সে, নিশ্চয়ই পারবে। তাকে পারতেই হবে, ছোট একটা শিশুর জীবন নির্ভর করছে তার ওপর। আর কোনো বিকল্প নেই, তাকে পারতেই হবে-পারতেই হবে। রুমী মনপ্রাণ একত্র করে ডাকে শাজাহান সুজাকে, আর কি আশ্চর্য শাজাহান সুজা চমকে পেছনে তাকায়। কেউ নেই কোথাও অথচ কি আশ্চর্য। ও স্পষ্ট শুনল কে যেন ওকে ডাকল।

আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস আস্তে আস্তে বের করে দেয় রুমী। পেরেছে সে, শাজাহান সুজার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। এবার সে তাকে শিক্ষা দেবে, এমন শিক্ষা দেবে যে, তার আত্মা নরকে গিয়েও ভুলতে পারবে না।

শাজাহান সুজা!

শাজাহান সুজা আবার চমকে পেছনে তাকাল, আবার সে শুনেছে কেউ যেন তাকে ডাকল। কি আশ্চর্য, আধ বোতল বিয়ার খেয়েই তার নেশা হয়ে গেল নাকি? শাজাহান সুজা বিয়ারের বোতলটা রেখে দেয়। এখনো অনেক কাজ বাকি, নেশা করার সময় হয় নি। কিন্তু ভেতরটা জানি কেমন করতে থাকে। অনেকদিন পর ভয় পেয়েছে সে।

শাজাহান সুজা, ডান দিকে তাকাও!

শক খাওয়া লোকের মতো চমকে ডান দিকে তাকাল শাজাহান সুজা। কেউ নেই। বাম দিকে তাকাও শাজাহান সুজা!

টেবিল ধরে কোনোমতে বাম দিকে তাকায় শাজাহান সুজা। জানে কেউ নেই, তবু তাকিয়ে দেখল। কি হয়েছে ওর? বাথরুমে গেল মাথায় পানি দিতে।

রুমী আস্তে আস্তে বলল, রেজরটা দেখো শাজাহান সুজা!

শাজাহান সুজা ভয়ে ভয়ে রেজরটার দিকে তাকায়।

হাত বাড়িয়ে তুলে নাও দেখি!

নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শাজাহান সুজা হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় ওটা।

এবারে গলায় একটা পোচ লাগাও দেখি চাঁদ!

শাজাহান সুজা চিৎকার করে হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল রেজরটা। পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে।

দাঁতে দাঁত ঘষে রুমী, কোথায় যাবে তুমি বাছাধন?

শাজাহান সুজা ফ্রিজ খুলে ব্র্যান্ডির একটা বোতল বের করে ঢক ঢক্‌ করে দুই টোক খেয়ে নিল। মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেছে। বাচ্চাটাকে শেষ করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। অনেক ধকল গিয়েছে শরীরের ওপর দিয়ে। রান্নাঘর থেকে একটা বড় ছুরি নিয়ে স্টুডিওতে চলে এলো সে।

একটু চমকে ওঠে রুমী, শাজাহান সুজাকে থামাতে হবে। মনপ্রাণ একত্র করে সে ওকে আদেশ দিতে থাকে, এক এগোবে

তুমি, দাঁড়াও যেখানে আছ। ( হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে শাজাহান সুজা। দরদর করে ঘামছে সে। সারা মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ভয়ে।

তোমার আর কোনো শক্তি নেই, শাজাহান সুজা! প্রথমবার কথাটা এমনি বলল রুমী, দ্বিতীয়বার বলল অনেক জোর দিয়ে, তৃতীয়বার শুধু জোর দিয়ে নয়, বিশ্বাস নিয়ে।

শাজাহান সুজার মনে হলো সত্যিই তার কোনো শক্তি নেই। হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবার মতো অবস্থা এখন ওর। কোনোমতে পা টেনে টেনে টলতে টলতে সোফায় এসে বসে পড়ল। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। ভয় পেয়েছে সে, প্রচণ্ড ভয়।

বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে রুমীও, প্রচণ্ড পরিশ্রম হচ্ছে ওর। একটি করে আদেশ দেয় শাজাহান সুজাকে আর সেটি কাজে খাটাতে গিয়ে সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায় তার। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে ওর, কিন্তু উঠে পানির গ্লাসটা আনতেও ভয় পাচ্ছে সে যদি সেই সময়টাতে কিছু একটা করে ফেলে বাচ্চাটাকে, চোখ বন্ধ করে সে দেখে শাজাহান সুজাকে, মড়ার মতো পড়ে আছে সোফায়। হয়তো ওর শাজাহান সুজার বাসার কাছে চলে যাওয়া উচিত, ত হলে ওর এত পরিশ্রম হবে না। কাছাকাছি থাকলে অনুভূতিটা অনেক তীব্র হয় আজ বিকেলেই সে দেখেছে। কাছে থাকলে আরও শক্ত করে শাজাহান সুজাকে ধরতে পারবে, আরও ভালো করে শিক্ষা দিতে পারবে।

উঠে দাঁড়ায় রুমী, ঢক ঢক্‌ করে গ্লাসের পানিটা শেষ করে পায়ে জুতো পরে নেয়। এত রাতে রিকশা না পেলে তাকে হয়তো হেঁটেই যেতে হবে। জুতো পায়ে অনেক তাড়াতাড়ি হাঁটা যায়। শাজাহান সুজা এখন মড়ার মতো পড়ে আছে, কতক্ষণ পড়ে থাকবে কে জানে, এর মাঝে রুমীকে যতটুকু সম্ভব ওর কাছাকাছি চলে যেতে হবে। দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে প্রায় ছুটতে থাকে সে।

অন্ধকার রাত। ঢাকা শহরেই রাতে এত অন্ধকার নামতে পারে, গ্রামেগঞ্জে বনেবাদাড়ে না জানি এখন কত অন্ধকার! শহরে কেউ কখনো আকাশের দিকে তাকায় না। আকাশে চাঁদ ওঠে, আবার চাঁদ ডুবে যায়, কেউ খেয়াল পর্যন্ত করে না। রুমীর মনে আছে রাতে পড়াশোনা করে ঘুমানোর সময় একদিন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে কত বড় একটা চাঁদ। দেখে সে কি অবাক, কতদিন পরে চাঁদ দেখল। সেই ছেলেবেলায়

মায়ের কোলে বসে চাঁদ দেখতো, ওর মা গুনগুন করে কি যেন গান গেয়ে ওকে আদর করতেন। তারপর কদিন হয়ে গেছে আর সে আকাশের দিকে তাকায় নি। আজ মাঝরাতে রিকশায় বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ওর মায়ের কথা মনে পড়ল, কোথায় আছেন ওর মা? ওর ভেতরে কেমন একটা দুঃখ বোধ জেগে ওঠে, কি মানে আছে এই জীবনের? সে কি করেছে এখন? কি প্রয়োজন তার এইসব করার?

ঠিক রাস্তার মোড়ে একজন লোক লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে-যে কেউ দেখে বলে দিতে পারবে এ পুলিশের লোক। পুলিশের সাদা পোশাকের লোকগুলিকে দেখতে সব সময় এরকম দেখায় কেন কে জানে। বোধহয় তারা একই ধরনের কাপড় পরে, একই ধরনের কাজকর্ম করে-হয়তো যেখানে তাদের কাজ শেখানো হয় সেখানে সবাইকে একই জিনিস শেখানো হয়। লোকটি সিগারেট টানতে টানতে খুব নিস্পৃহভাবে রুমীর দিকে তাকাল যেন রুমী কে তাতে তার কিছুই এসে যায় না।

কি ভেবে সেখানেই নেমে পড়ল রুমী, পুলিশের লোকটাকে কিছু একটা বলে গেলে হতো। রুমী একটু দ্বিধা করে, কে জানে হয়তো এ পুলিশের লোক নয়। রুমী চেষ্টা করল লোকটি কি ভাবছে বুঝতে, কিন্তু পারল না। আগেও দেখেছে স্বাভাবিক চিন্তাভাবনাগুলো সে বুঝতে পারে না, শুধু খারাপ, অশুভ কথাগুলিই শুনতে পায়।

একটু দ্বিধা করে জিজ্ঞেস করল রুমী, আপনি কি পুলিশের লোক?

লোকটা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, আপনি… আপনি কীভাবে জানলেন?

জানি না বলেই তো জিজ্ঞেস করলাম। আমি আন্দাজ করেছিলাম আপনারা কেউ কাছাকাছি থাকবেন। লোকটিকে আরও ঘাবড়ে না দিয়ে ব্যাপারটা খুলে বলল সে। পুলিশ অফিসারের নাম করে বলল, সে তাকে খুব ভালো করে চেনে এবং তার খবরের ওপর ভিত্তি করেই শাজাহান সুজার বাসার ওপর পাহারা বসানো হয়েছে। শুনে লোকটি একটু সহজ হলে রুমী বলল, আপনাকে আমার একটা উপকার করতে হবে।

কি উপকার?

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু পুলিশ নিয়ে আসতে হবে। আপনাদের অফিসারকে আমার নাম বলে ফোন করলেই হবে।

লোকটি চোখ কপালে তুলে বলল, পুলিশ? সর্বনাশ! এটা খুব গোপন ব্যাপার, আমি এখানে আছি সেটা পর্যন্ত ডিপার্টমেন্ট জানে না।

জানি। রুমী ঠাণ্ডা গলায় বলল, গোপন ব্যাপার আর গোপন নেই। আমি শাজাহান সুজার বাসায় ঢুকছি ওকে হাতেনাতে ধরার জন্যে।

লোকটি অবাক হয়ে রুমীর দিকে তাকাল, এর মাথা খারাপ না আর কিছু! কি একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ সে রুমীকে ভীষণ চমকে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেলতে দেখল। তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার শুনেছে রুমী-চোখ বন্ধ করে দেখতে পায় শাজাহান সুজা ছুরি হাতে বাচ্চাটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বেঁচে থাকার আদিম প্রবৃত্তির বশে বাচ্চাটা প্রাণপণে চেষ্টা করে চেয়ারসহ মাটিতে পড়ে গেছে। ছুরি তার হাতের খানিকটা কেটে ফেলেছে কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেছে সে। প্রচণ্ড রেগে গেছে শাজাহান, সুজা, মুখ বিকৃত করে আবার এগিয়ে আসছে সে। না! প্রাণপণ চিৎকার করে ওঠে রুমী, থাম-থাম শুয়োরের বাচ্চা! শক খাওয়া লোকের মতো ঘুরে দাঁড়ায় শাজাহান সুজা। এক পা নড়েছিস কি তোর জান শেষ করে দেব-দাঁতে দাঁতে ঘষে রুমী বলতে থাকে, আর একটু নড়েছিস কি তোর জিব টেনে বের করে ফেলব। পুলিশের লোকটি বিস্ফারিত চোখে রুমীর দিকে তাকিয়ে থাকে, এক মুহূর্তের জন্যে সে ভেবেছিল রুমী বুঝি তাকে কিছু বলছে। কিন্তু রুমীর দৃষ্টি অন্য কোথাও, কথা বলছে অনেকটা নিজের মনে। দেখে ভয় হয়, মনে হয় সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। কি ভয়ানক চেহারা হয়ে গেছে এক মুহূর্তে, দাঁত বেরিয়ে পড়েছে, শক্ত চোয়াল, চোখ টকটকে লাল, কিন্তু পাতা নড়ছে না, মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বলল রুমী, আমি আসছি। তোকে আজ দেখে নেব, শয়তানের বাচ্চা! পুলিশের লোকটা অবাক হয়ে দেখল, অদ্ভুত একটা ভঙ্গিতে শাজাহান সুজার বাসার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রুমী, কেন জানি ভয়ে ওর সারা শরীর কাটা দিয়ে ওঠে। আরও আধঘণ্টা পরে অন্য আরেকজন এসে তাকে ছুটি দেওয়ার কথা কিন্তু এতক্ষণ অপেক্ষা করার সাহস নেই। তার, তক্ষুনি সে ছুটল কাছাকাছি পুলিশ ফাড়ি থেকে ফোন করার জন্যে।

লোহার গেট বাসার সামনে, মস্ত তালা ঝুলছে। রুমী এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে গেট টপকে ভেতর ঢুকে পড়ে। ওপরে কাঁটাতার দেওয়া, ওর হাত ছড়ে গেছে কিন্তু এখন সে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। কঁকর বিছানো পথ, দুধারে ফুলের গাছ, অযত্নে অবহেলায় একটা বুনো রূপ নিয়েছে। ঝিঁঝি ডাকছে কোথায়, মুহূর্তের জন্যে থামতেই বোঝা গেল চারদিক কি ভয়ানক নীরব হয়ে আছে।

দরজা খোলো!

না।

দরজা খোলো শাজাহন সুজা!

না-না…

প্রচণ্ড জোরে ধমকে ওঠে রুমী, দরজা খোল্ শুয়োরের বাচ্চা!

শাজাহান সুজা তবু দাঁড়িয়ে থাকে। রুমী বাইরে দাঁড়িয়ে শাজাহান সুজাকে দরজার কাছে টেনে আনে খুব সহজে। ওকে বাধ্য করে দরজা খুলতে। শাজাহান সুজা ছিটকিনি খুলে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে, লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলল রুমী। ভয়ে ছিটকে সরে গেল শাজাহান সুজা-ড্রয়ার হাতড়াচ্ছে প্রাণপণে, পিস্তলটা খুঁজছে ওর। ততক্ষণে রুমী ঢুকে গেছে ভেতরে।

কি, কি চান আপনি?

রুমী হাসল। বিকারগ্রস্ত লোকের হাসি। কি চাই? দেখবে, এক্ষনি দেখবে।

শাজাহান সুজা তখনো ড্রয়ার হাতড়ে যাচ্ছে, রুমী জানে ও পিস্তলটা খুঁজছে কিন্তু বাধা দিল না সে। কি করবে ও পিস্তল দিয়ে? তাকে গুলি করবে। রুমী জানে সে ইচ্ছা করলে এখন শাজাহান সুজা একটা আঙুল পর্যন্ত নাড়াতে পারবে না। কি প্রচণ্ড শক্তি ওর ভেতরে! ইচ্ছা করলে শাজাহান সুজার জিব টেনে বের করতে পারে সে, হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে ফেলতে পারে! ও ইচ্ছা করলে খুলি ফেটে তার মস্তিষ্ক বের হয়ে যাবে এখন পিস্তল দিয়ে কি করবে?

খুঁজে পেয়েছে সে পিস্তলটা-তুলে ধরল রুমীর দিকে।

রুমী আবার হাসার ভঙ্গি করে, গুলি করতে চাও? তাহলে ঘুরিয়ে নিজের মাথার দিকে নাও।

শাজাহান সুজার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে ওর, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হাত উঠে যাচ্ছে তার মাথার দিকে।

কি, গুলি করবে?

প্রাণপণ চেষ্টায় মাথা নাড়ল, না-না…

পিস্তলটা আমার দিকে ছুঁড়ে দাও! শাজাহান সুজা পিস্তলটা ছুঁড়ে দেয়। রুমী জীবনে পিস্তল ভালো করে দেখে নি পর্যন্ত, দেখার ইচ্ছাও নেই। লাথি মেরে পিস্তলটা সরিয়ে দিল দূরে।

কি, কি চান আপনি? শাজাহান সুজার কণ্ঠস্বর শুষ্ক, ভয়ে কাঁপছে।

অনেক কিছু চাই আমি। তোমাকে এমন শিক্ষা দিতে চাই…

কেন? কি করেছি আমি?

প্রচণ্ড রাগে রুমীর মুখ ভয়াবহ হয়ে ওঠে, কি করেছ তুমি? চিৎকার করে ওঠে রুমী, তুমি জানো না? রুমীর অদম্য ক্রোধ প্রচণ্ড একটা শক্তির মতো শাজাহান সুজাকে আঘাত করে, ছিটকে গিয়ে সে পড়ে এক কোনায়, প্রচণ্ড জোরে ওর মাথা ঠুকে যায় দেয়ালে। রুমীর রাগের দমকে দমকে ওর সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে, মুখে ফেনা এসে যায় যন্ত্রণায়।

অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে রুমী, আস্তে আস্তে শাজাহান সুজার কাঁপুনিও থেমে যায়। কোনোমতে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়, প্রচণ্ড ভয়ে ওর মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে।

তুমি কি করেছ তুমি জানো না?

শাজাহান সুজা মাথা নিচু করে থাকে। আস্তে আস্তে মাথা তুলে কাতর ভঙ্গিতে বলে, কিন্তু আমি তো শুধু শুধু করি নি। এই দেখুন, এই ছবিটা আমি এঁকেছি, পৃথিবীর লোক এই ছবিটা পেতো না আমি যদি কিছু না করতাম…

কি ছবি এটা?

শাজাহান সুজা একটু আশায় ভর করে এগিয়ে আসে, ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, আপনিও বুঝতে পারবেন।

তাকিয়ে দেখল রুমী।

শাজাহান সুজা দুর্বলভাবে একটু হাসল, আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ এটা

প্রিন্সে’র থেকে হাজার গুণ ভালো। এরকম আর হবে না কখনো হবে না। রঙের কাজ আর টেকনিক ছেড়ে দিয়ে শুধু অভিব্যক্তিটা দেখুন।

খুব যত্নের ছবি তোমার?

হ্যাঁ। এটা শেষ করে আমার মরতেও দ্বিধা নেই। একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে শাজাহান সুজা আস্তে আস্তে বলে, মরতেও দ্বিধা নেই!

সিগারেট খাও তুমি?

হ্যাঁ, খুব ব্যস্ত হয়ে শাজাহান সুজা পকেট হাতড়াতে থাকে। সিগারেট বের করে এগিয়ে দেয় রুমীর দিকে।

ম্যাচটা বের করো।

শাজাহান সুজা একটা দামি সিগারেট লাইটার বের করে।

সাবধানে ছবিটার নিচে লাইটারটা জ্বালিয়ে ধরো।

প্রচণ্ডভাবে চমকে উঠল শাজাহান সুজা, কি বলছে সে? এক মুহূর্তের জন্যে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না ও।

নিচে লাইটারটা জ্বালিয়ে ধরো!

হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল শাজাহান সুজা, আপনি বুঝতে পারছেন না এই ছবির মূল্য।

আমাকে মেরে ফেলুন, যা খুশি করুন, কিন্তু এই ছবিটাকে বেঁচে থাকতে দিন।

ছবির নিচে লাইটারটা জ্বালিয়ে ধরো!

কাতর অনুনয়ে শাজাহান সুজার গলার স্বর ভেঙে পড়ে, আপনি একটু বুঝতে চেষ্টা করুন। তাজমহলকে কেউ যদি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় আপনার কেমন লাগবে? দা ভিঞ্চির মোনালিসাকে কেউ যদি পুড়িয়ে দেয় আপনার কেমন লাগবে? মাইকেল এঞ্জেলোর পিয়েতাকে কেউ যদি ভেঙে ফেলে কেমন লাগবে আপনার? আপনি বিশ্বাস করুন এটা ঠিক সেরকম একটা সৃষ্টি। এটা নষ্ট করার অধিকার কারো নেই। আমি অপরাধ করেছি, আমাকে যা ইচ্ছা শাস্তি দিন, আমার ছবির ওপর প্রতিশোধ নেবেন না।

একটিবার পৃথিবীর লোককে এই ছবি দেখতে দিন।

লাইটারটা জ্বালিয়ে ছবির নিচে ধরো।

দোহাই আপনার-এটা আমার সন্তানের মতো। আমার যদি একটা সন্তান থাকতো তাকে কি আপনি মারতেন? আমি যত দোষই করি আমার সন্তানের তো কোনো দোষ নেই। তাকে আপনি বাঁচতে দিন…

হঠাৎ প্রচণ্ড রাগে ফুঁসে ওঠে রুমী, তোমার সন্তানের মতো! যাদের তুমি মেরেছ তারা কারো সন্তান ছিল না?

রুমীর কথা শেষ হবার আগেই প্রচণ্ড একটা আঘাতে শাজাহান সুজা ছিটকে মাটিতে পড়ে। রুমীর রাগ কমে না আসা পর্যন্ত সে যন্ত্রণায় কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে থাকে। তারপর আস্তে আপ্তে আবার উঠে দাঁড়ায়। কপালের কাছে কেটে গেছে ওর, ফুলে উঠছে ধীরে ধীরে। একটা চোখ প্রায় বুজে গেছে। কাতর অনুনয়ের দৃষ্টিতে শাজাহান সুজা রুমীর দিকে তাকিয়ে থাকে।

রুমী ওকে আবার আদেশ দেয় ছবিটাতে আগুন ধরানোর জন্যে। শাজাহান সুজা দুই হাত জোর করে ক্ষমা ভিক্ষা চায়। রুমী পাথরের মতো নিজের শক্তি ব্যবহার করে। শাজাহান সুজা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাঁপা কাঁপা হাতে লাইটারটা জ্বালিয়ে, আস্তে আস্তে আগুনটা ছবির নিচে ধরে। ওর মুখ প্রচণ্ড হতাশায় বিকৃত হয়ে আছে, চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসছে। আস্তে আগুন ধরে গেল একপাশে। শাজাহান সুজা প্রাণপণ চেষ্টা করল হাত দিয়ে আগুন নিভিয়ে দিতে, কিন্তু ওর কোনো ক্ষমতা নেই। রুমীর ইচ্ছার দাস হয়ে ও দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। আস্তে আস্তে আগুনটা ছড়িয়ে পড়ছে, দ্রুত এগিয়ে এসে গ্রাস করে নিচ্ছে ছবিটাকে।

আর্তনাদ করে উঠল শাজাহান সুজা, দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মাটিতে মাথা কুটতে থাকে প্রচণ্ড দুঃখে। ওর সারাজীবনের স্বপ্ন ওর চোখের সামনে শেষ হয়ে যাচ্ছে, ও একটা ফটো পর্যন্ত তুলে রাখে নি ওটার। আর দেখতে পারল না, চোখ বন্ধ করে ফেলল, শাজাহান সুজা!

চোখ খোলো শাজাহান সুজা!

শাজাহান সুজার চোখ খুলে গেল ইচ্ছার বিরুদ্ধে। ওর চোখের সামনে পুরো ছবিটা ঢেকে গেল জ্বলন্ত আগুনের শিখায়। অনেক ওপরে উঠে গেল আগুনের শিখা, ধোঁয়ায় ভরে গেছে সারা ঘর, খক্‌ খক্ করে কাশতে থাকে রুমী।

শাজাহান সুজাকে ডাকল রুমী। তার উত্তর দেয়ার ক্ষমতা নেই, অর্থহীন বোবা দৃষ্টিতে রুমীর দিকে তাকিয়ে থাকে সে।

খুব একটা সৃষ্টি করেছিলে, বাচ্চাদের খুন করে সৃষ্টি কর তুমি। বাচ্চারা সৃষ্টি না, সৃষ্টি তোমার ওই আর্ট। প্রচণ্ড ঘৃণায় রুমীর মুখ বিকৃত হয়ে উঠতেই আবার শাজাহান সুজা ছিটকে পড়ে মাটিতে। রুমীর তীব্র দৃষ্টিতে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকে যন্ত্রণায়। ভীষণ দুর্বল লাগতে থাকে রুমীর। ও আস্তে আস্তে সোফায় গিয়ে বসে, পুলিশ এসে যাবে যে কোনো মুহূর্তে, তখন ওর কাজ শেষ। হঠাৎ ওর চোখ পড়ে বাচ্চাটার ওপর, রুমী ওর কথা ভুলেই গিয়েছিল। শক্ত করে বাঁধা চেয়ারে, রক্তাক্ত শরীর, বাম হাত থেকে তখনো রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। রুমী চোখের দৃষ্টি কোমল করে ওর দিকে এগিয়ে যায়, বাচ্চাটা ভীত চোখে ওকে লক্ষ করে, ওর ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। ভয় কি তোমার? ভয় নেই, তোমাকে আর কেউ কিছু করতে পারবে না। রুমী ওর দড়ির বাঁধন খুলে দিতে লাগল।

বিড়বিড় করে কথা বলছে শাজাহান সুজা। কান পেতে শোনার চেষ্টা করে রুমী, প্রথমে মনে হচ্ছিল অসংলগ্ন কথা, কিন্তু আসলে তা নয়। প্রচণ্ড দুঃখে ওর বুক ভেঙে গেছে তাই নিজেকে সান্তনা দিচ্ছে নিজেই। বলছে, এটা পুড়ে গিয়েছে তো কি হয়েছে।

আবার আঁকব আমি, আবার আঁকব। আরও ভালো করে আঁকব আমি, আরও অনেক যত্ন করে। আমি শিল্পী, আমার চোখ আছে, আমার দেখার ক্ষমতা আছে, আমার সৃষ্টির ক্ষমতা আছে! কজনের আছে আমার মতো ক্ষমতা? আমি আবার সৃষ্টি করব। দরকার হলে আবার ধরে আনব নোংরা জানোয়ারগুলোকে, গলা টিপে মেরে…

প্রচণ্ড রাগ রুমীর শিরদাঁড়া বেয়ে উঠতে থাকে-প্রচণ্ড রাগ! দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, আবার ছবি আঁকবে তুমি? আবার সৃষ্টি করবে? তোমার ওই চোখ দিয়ে তুমি দেখবে আর সৃষ্টি করবে?

রুমী ওর দিকে এগিয়ে যায়, তোমার চোখ আমি ছিঁড়ে নেব, ছিঁড়ে উপড়ে নেব। চোখ উপড়ে নেবার ভঙ্গি করে রুমী, আর হঠাৎ ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে এলো শাজাহান সুজার চোখ থেকে। প্রচণ্ড আর্তনাদ করে দুই চোখ ঢেকে ফেলল শাজাহান সুজা, হাতের ফাঁক দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হতে থাকে।

রুমীর মনে হয় তার মাথাটা হালকা হয়ে গেছে। সমস্ত ঘরটা যেন ওর চোখের সামনে ঘুরে ওঠে। সাবধানে সে সোফার হাতল ধরে বসার চেষ্টা করল, ঘরটা আরও জোরে ঘুরছে, আলোগুলি যেন দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে, ও তাকিয়ে থেকেও আর দেখতে পাচ্ছে কোলাহলের মতো শব্দ ভেসে আসতে থাকে, ঢেউয়ের মতো সে শব্দ এগিয়ে আসছে, আস্তে আস্তে তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। রুমী সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে খুব ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাল।

বাইরে তখন পুলিশের জিপ এসে থেমেছে।

পরিশিষ্ট

এগারো

শাজাহান সুজাকে অন্ধ অবস্থায় তার বাসায় গ্রেফতার করা হয়। কি এক অজ্ঞাত কারণে তার দুই চোখেরই নার্ভ ছিঁড়ে গিয়ে সে অন্ধ হয়ে গেছে। বহুদিন চিকিৎসাধীন থাকল সে। প্রচণ্ড শকে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে বলে তার বিচার অনেক দিন বন্ধ রাখা হয়েছিল। বিচারের বিশেষ কিছু ছিলও না, নিজেই সব কটি শিশুহত্যার অপরাধ স্বীকার করেছে। এ নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার কোনো অনুতাপ ছিল না। বিচারে ওর মৃত্যুদণ্ডই হতো কিন্তু রায় বের হওয়ার আগেই সে জেলখানায় মারা গেল। অনেকে বলে আত্মহত্যা করেছে, অনেকে বলে জেলখানায় অন্যরা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। কোনটি সত্যি এখনো সেটা ভালো করে জানা যায় নি। কীভাবে মারা গেছে সেটা নিয়ে বিশেষ কারো মাথাব্যথা নেই, শাজাহান সুজা যে মারা গেছে সেটাই অনেকের কাছে একমাত্র স্বস্তির কথা।

যে রাতে শাজাহান সুজাকে গ্রেফতার করা হয়, সে রাতে রুমীকেও তার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়। রুমীর বাইশ বছরের জীবনে মস্তিষ্কে দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচার করে তাকে বাঁচাতে হয়েছে। তার মস্তিষ্কের বড় একটা অংশ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, ডাক্তাররা সন্দেহ করেছিলেন সে হয়তো জ্ঞান বুদ্ধিহীন অথর্ব একটা মানুষে পরিণত হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল রুমী খুব ভালোভাবেই সামলে উঠেছে। তার দৈহিক কোনো সমস্যাই হয় নি, বুদ্ধিমত্তাও পুরোপুরি স্বাভাবিক রয়েছে, কিন্তু স্মৃতি একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সে তার অতীতের একটি কথাও মনে করতে পারে ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করলেন। শাজাহান সুজাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে সে এক লাখ টাকা পুরোটাই পেয়েছিল। তার থেকে অনেকখানি ওর চিকিৎসার জন্যে ব্যয় করা হলো, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। অন্যরা যদিও রুমীর স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়াটা খুব গুরুত্ব নিয়ে দেখছিল তবু সে নিজে এ ব্যাপারে বেশি বিচলিত হয় নি। তার স্মৃতির কিছুই অবশিষ্ট নেই, তাই সে জানতোও না কি নিয়ে তার বিচলিত হওয়া উচিত।

রুমী একটু সুস্থ হওয়ার পর ওর বোন শানু ওকে নিজের কাছে নিয়ে গেল। প্রথম প্রথম সে শানুকে দেখে একটু লজ্জা পেতো, এই সুন্দরী মেয়েটি তার বোন তার বিশ্বাস হতে চাইতো না। বোনের ছোট ছেলেটির সাথে তার ঘনিষ্ঠতা হলো খুব সহজে, বড়দের সাথেই তার কথাবার্তা বলতে অসুবিধে অসুবিধে হতো। কখন কীভাবে কি বলতে হয় সে তখনো শিখে উঠতে পারে নি। তার নাকি এমএসসি. পরীক্ষা দেবার কথা ছিল, কিন্তু এ বছরটা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই, যদিও সবাই চায় যে সে আবার ঢাকা গিয়ে পড়াশোনা শুরু করুক, কিন্তু তার নিজের সেরকম কোনো ইচ্ছা নেই। সে কেন গ্রামে থাকতে পারে না, এই সহজ ব্যাপারটা এখনো কেউ তাকে বুঝিয়ে দিতে পারে নি। সে তার বোনের স্বামীর মতো দোকান দেবে বলায় একদিন সবাই এমনভাবে তার মুখের ওপর হেসে উঠেছিল যেন সে ভারি মজার কথা বলেছে। রুমী আজকাল তাই কাউকে কিছু বলে না, সে কি করবে সেটা সে নিজেই ঠিক করবে। তার নাকি অনেক টাকা জমা আছে ব্যাংকে, সেটা কীভাবে তুলতে পারবে এখনো জানে না। জেনে। নিতে পারবে সে কদিনের ভেতরেই। তখন টাকাটা তুলে এনে কংশ নদীর চরটা কিনে নেবে ও, ওখানে নাকি খুব ভালো ধান হয়। কিছু টাকা দিয়ে সে গ্রামের স্কুলটা ঠিক করিয়ে দেবে। হেডমাস্টারের সাথে কথা বলেছে গোপনে, সে চাইলেই তিনি তাকে একটা মাস্টারি দিয়ে দেবেন। স্কুলে অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়ানোর কেউ নেই, সে বিএসসিতে অনার্স, তবুও একটু ভয়ে ভয়ে ছিল হয়তো অঙ্ক, বিজ্ঞান সব ভুলে গেছে এই ভেবে, কিন্তু স্কুলের অঙ্ক বই খুলে দেখেছে খুব সহজ। কিছুই ভুলে যায় নি।

কদিন আগে ঢাকা থেকে কিবরিয়া চৌধুরী নামে একজন তার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, একসময়ে নাকি তার সাথে খুব বন্ধুত্ব ছিল। কেমন রাগী রাগী আর অসুখী মানুষের মতো চেহারা। তাকে অনেক বুঝিয়ে গেছেন যেন সে ঢাকা চলে আসে, যাওয়ার আগে তাকে চিঠি লিখলেই তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন। ঠিকানা রেখে গেছেন তার কাছে। তাকে সে কিছু বলে নি, বললে ভদ্রলোক হয়তো রেগে যেতেন। কেউ গ্রামে থাকতে পারে সেটা তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। রুমী কিন্তু গ্রামেই থাকবে, যে যাই বলুক তাকে।

অনেক ঘুরে দেখেছে সে। সড়ক ধরে অনেক দূর হেঁটে গেছে, কি সুন্দর ধানের ক্ষেত দুপাশে, বাতাস যেন ঢেউ খেলে যাচ্ছে। আকাশে সাদা মেঘ এপাশ থেকে ওপাশে ভেসে ভেসে যায়। একদিন কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেল, রুমীর দেখে আশা মেটে না, বিজলি চমকাতে থাকে, তারপর কি গুড়গুড় মেঘের ডাক! রাখাল ছেলেরা গরু ছুটিয়ে নিয়ে আসছে গোয়ালে, উঠনে শুকাতে দেওয়া ধান হৈচৈ করে তুলে নিচ্ছে মেয়েরা, মোরগগুলি কঁক্ কঁক করে ঘরে ঢুকছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে ভেবে। দেখতে দেখতে ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে এলো, ভেসে গেল যেন পৃথিবী। ভেজা শাড়ি পরে মেয়েরা ছুটোছুটি করতে থাকে, সংসারের খুঁটিনাটি জিনিস তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিতে চায়। এসব দেখে আনমান হয়ে যায় রুমী।

নৌকা করে গিয়েছিল একবার, নদীর দুতীরে তাকিয়ে সে স্তব্ধ হয়ে যায়, দূরে কাশবন, ঝোঁপঝাড়, বনজঙ্গল। আকাশে মেঘ, তার মাঝে সারি সারি বক উড়ে যায় দক্ষিণে। নদীর কালো পানি দেখে অবাক হয়ে যায় রুমী, কে জানে কত রহস্য লুকানো আছে ওখানে। জেলেরা মাছ ধরছে তার মাঝে হঠাৎ একটা শুশুক লাফিয়ে উঠে আবার ডুবে যায় পানিতে। সন্ধ্যার পড়ন্ত আলোতে নিচু গলায় কথা বলে মাঝিরা, নৌকোর গলুইয়ে চুলো জ্বালিয়ে রান্না চাপায়। রাতে কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে খেতে বসে সবাই। লাল চালের ভাত, মুগের ডাল আর মাগুর মাছের ঝোল, খেতে অমৃতের মতো লাগে ওর।

ভোরে কুয়াশায় মাঠ ঢেকে থাকে, হুঁকো খেতে খেতে গল্প করে চাষিরা, তামাকের মিষ্টি গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আসে। লাঙল-গরু নিয়ে মাঠে চলে যায় সবাই ভোরের আলো ফোঁটার আগে। রুমী চুপচাপ ওদের দেখে মনে হতে থাকে সে ওদেরই একজন। শহরে ও যাবে না, এখানেই থাকবে, এদের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে থাকবে, যে যাই বলুক না কেন।

একটা মোটে জীবন, সেটা সে নষ্ট করবে না এবার।

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *