প্রাণের ঠাকুর
25 শে বৈশাখের সকাল! মনামী ঘুম থেকে উঠেই বাগানে চলে এসেছে! ফুলে ভরা চাঁপা গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে দূরে বাগানে প্রান্তের কৃষ্ণচূড়া গাছটা রক্তিম উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে আছে— দু চোখের নোনা জলে বুকের আঁচল ভিজে যাচ্ছে— কি যেন ফিসফিস করে বলছে—” মাম মাম গন্ধ ফুল।” তার “তাতা”! আজ যে তাতার ও জন্মদিন। রাস্তা দিয়ে প্রভাতফেরি চলেছে—- হে নূতন দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ!
তার তাতা আর প্রাণের ঠাকুর যে একই দিনে জন্মেছেন! ছেলের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মনামী এই মানুষটার সাথে আরো আরো বেশি সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। তারপর তার ছোট্ট তাতা থেকে উজান হতে হতে আরো কেটে গেছে দশটা বছর। পুরো সময়টাই রবি ময়।উজান রবি ঠাকুরের ভক্ত নিজেও গান গায় আবৃত্তি করে। শান্তিনিকেতনে পড়বে এই লক্ষ্যেই সে এগিয়েছিল।ও যেন ঠিক রবি ঠাকুরের বলাই। গাছপালা ওর প্রাণ। ওদের সাথেই গল্পগাছা ওদের সাথে আরি ভাব। এই চাঁপা ও কৃষ্ণচূড়া গাছটা ওর লাগানো । শান্তিনিকেতনে পড়বে এটাই লক্ষ্য ছিল তাই হায়ার সেকেন্ডারিতে আর্টস নিয়েছিল। মনামী স্বামী সাগ্নিক একটু গাইগুই করেছিল ঠিকই কিন্তু ছেলের উৎসাহে আর বাধা দেয়নি। ফলে হায়ার সেকেন্ডারি রেজাল্ট দারুণ হয়েছিল— জেলায় প্রথম আর রাজ্যে কুড়ি জনের মধ্যে একজন! শান্তিনিকেতন এর ভর্তির জন্য যাচ্ছিল ওরা তিনজন! আনন্দের আবহে গাড়িতে একের পর এক গান গাইছিল উজান—– এলেম নতুন দেশে
আমি পথ ভোলা এক পথিক এসেছি
আমরা নতুন যৌবনের দূত——
হঠাৎ যমদূতের মত উল্টো দিক থেকে আসা এক লরির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ—– আর কিছু মনে নেই মনামীর। যখন জ্ঞান ফিরল তখন ওর সাজানো সংসার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। একইসাথে স্বামীও ছেলেকে হারিয়ে ওপ্রায় বোবা হয়ে গিয়েছিল। কাউন্সেলিং মিউজিক থেরাপি ওকে আবার জীবনমুখী করে। রবি ঠাকুর প্রাণের ঠাকুর ওকে আবার জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনে। তখনই জন্ম হয় সপ্তসুরের। এই সংস্থা অনাথ ও দুঃস্থ বাচ্চাদের আশ্রয় হয়ে উঠেছে। দশজন বাচ্চা নিয়ে সূত্রপাত আজ 150 জন বাচ্চার বড়মা মনামী।
প্রভাতফেরির দলটা সপ্তসুরের আঙিনায় এসে দাঁড়ায়। মনামী আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে। রবি ঠাকুরের ফুলে সাজানো ছবি টার পেছনে ওকে দাঁড়িয়ে—— হাসিমুখের উজান যেন ওদের সবার সাথে গলা মিলিয়ে গাইছে—-
তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি
বুঝতে নারি কখন তুমি দাও যে ফাঁকি——!
চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে মনামী গলা মেলায়—-!