Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » প্রাকৃতিক || Samaresh Majumdar

প্রাকৃতিক || Samaresh Majumdar

পঁচাত্তরে পড়তে আর তিনমাস; কিন্তু স্বপ্নেন্দুর মাথার একটি চুলও সাদা হয়নি। দাড়ি কামাবার সময় আয়নার সামনে বসে নিজেকে লক্ষ্য করেন তিনি। দুদিন দাড়ি না কামালে (সেটা খুব কম হয়) গালে সাদা ছোপ লাগে। কিন্তু না জুলপি, না কানের ওপাশে একটি রুপোলি চুল দেখতে পান না। একদা বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে ঠেস দেওয়া প্রশ্ন শোনেন, ‘কি হে, এই বয়সেও চুলে ব্রাশ করছ? তা করো, কিন্তু একটু-আধটু সাদা রাখলে ভালো করতে।’

স্বপ্নেন্দু বোঝাবার চেষ্টা করেছেন তিনি চুলে কালো রং ব্যবহার করেন না। যাঁদের বলেছেন তাঁরা অবিশ্বাসী চোখ নিয়ে শুনেছেন। স্বপ্নেন্দু এও বলেছেন, তাঁর মা গত হয়েছিলেন সাতাশি বছর বয়সে এবং মৃত্যুকালে মায়ের চুল সম্পূর্ণ কালো ছিল।

আজকাল আর এসব বলতে ইচ্ছে করে না। তাঁর সমসাময়িক তো বটেই, দশ-বারো বছরের যারা ছোট তাঁদের চুল সাদা হয়ে গেছে, কেউ রং দিয়ে দিয়ে আর না পেরে হাল ছেড়ে দেওয়ায় চুলের শরীর শেয়ালের লোম হয়ে গিয়েছে। কিন্তু স্বপ্নেন্দুর চুল এখনো নিবিড় কালো, সামান্য পাতলা হলেও টাক পড়েনি। শ্যাম্পু করলে বেশ ফুলে-ফেঁপে থাকে, পঁয়তাল্লিশ বছর আগে যেমন থাকত। ইদানীং চোখের নিচে একটু ভাঁজ পড়ব পড়ব করছে। মেয়ে সজনী একটা ক্রিম এনে দিয়েছে যা ঘষলে ভাঁজটা অনেকক্ষণ উধাও হয়ে যায়। কিন্তু গলার চামড়া এখনো টানটান কিন্তু বুকের লোমে পাক ধরেছে। কিন্তু গেঞ্জি এবং শার্টের আড়াল থাকায় তা জনসাধারণের জানার কথা নয়। স্বপ্নেন্দু প্রতি ছয়মাস অন্তর রক্ত পরীক্ষা করান। প্রতিবারেই দেখা যায় তাঁর সবকিছু স্বাভাবিক। এমনকি ইসিজি রিপোর্টেও বিপদের আভাস নেই।

সজনী তার শ্বশুরবাড়ির সামনে প্রতি রবিবার দুপুরবেলা আসে, বিকেলে ওর স্বামী এসে ওকে নিয়ে বেড়াতে যায়। কিছুদিন আগে সজনী এসে বলল, ‘আজ সন্ধ্যে সন্ধ্যে খেয়ে শুয়ে পড়বে। কাল সকালে তোমার রক্ত নিতে আসবে নতুন জায়গা থেকে।’

‘কেন? এই তো মাসখানেক আগে সব করালাম – ।’ স্বপ্নেন্দু অবাক।

‘না। মা বলল, তুমি নিশ্চয়ই তোমার রিপোর্ট ঘুষ দিয়ে তৈরি করাও। তাই তোমার জানাশোনা নেই এমন জায়গায় পরীক্ষা করাতে বলল।’ সজনী বলে গেল।

এই হলো সরমা। পঁচিশ বছরে বিয়ে হয়েছিল, বিয়ের পর পঁয়তাল্লিশ বছর কেটে গেছে, কিন্তু সন্দেহ করার স্বভাব মরে যায়নি। প্রতিবাদ না করে সহযোগিতা করলেন স্বপ্নেন্দু। পরের দিন রিপোর্ট দেখে চমকে গেলেন। ফাস্টিং ব্লাড সুগার নববুই, খুব ভালো। কিন্তু ভরপেট খাওয়ার দুঘণ্টা পরে যে-রক্ত নেওয়া হয়েছিল তাতে সুগারের পরিমাণ চুরাশি? হয় নাকি? এক ডাক্তার বন্ধুকে ফোন করে জানলেন, কখনো কখনো ওটা হয়।

মেয়েকে ফোন করে রিপোর্টটা পড়ে শোনালেন। মেয়ে খুব খুশি হলো। বলল, ‘মাকে বলেছ?’ স্বপ্নেন্দু বললেন, ‘না। তিনি তোমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তোমার কর্তব্য তাঁকে রিপোর্ট করা।’

স্বপ্নেন্দুর জীবন এইরকম। ভোর সাড়ে পাঁচটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঠিক এক মাইল হেঁটে পার্কে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখে আবার ওই পথে ফিরে এসে বাজারে ঢোকা। বাজার থেকে নির্বাচিত মাছ-সবজি কিনে রিকশায় চেপে বাড়ি ফেরা। তারপর চা খেয়ে তিনটি খবরের কাগজে ডুবে যাওয়া। সকাল সোয়া ছটায় খানিকটা ফল আর একটা ডিমের পোচ খেয়ে লিখতে বসা। ঠিক দুপুর দুটোয় গাড়ি নিয়ে বের হয়ে দুটো আড্ডা ঘুরে সন্ধ্যের মুখে ফান ক্লাবে ঢুকে দুই পেগ হুইস্কি পান করে নটায় বাড়ি ফিরে ডিনার শেষ করে শুতে যাওয়া। এর মধ্যে তিনি তিনবার সরমার ঘরে যান। প্রথমবার বাজার সেরে। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেন সরমা হাতজোড় করে বসে আছেন তাঁর পুজোর বেদির সামনে। এখন কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না জেনেও বলেন, ‘বাজার নিয়ে এলাম।’ সরমা কোনো চোখ খোলেন না। দ্বিতীয়বার, দুপুরে বেরোবার আগে স্ত্রীর দরজায় পৌঁছে বলেন, ‘যাচ্ছি। কোনো দরকার আছে?’

সরমা তখন বিছানায় শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। কাগজের আড়ালে মুখ। কথা ভেসে আসে, ‘থাকলে জানাতাম।’

সরমা এখন কেমন আছেন? মাথার নববুই ভাগ চুল এখন ক্যাটকেটে সাদা। বয়সের ছাপ মুখে, গলায়। হাঁটেন খুব ধীরে। পঁয়তাল্লিশ বছর আগের সরমা যেরকম তরতাজা ছিলেন, এখন তার কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না। সজনী অনেক চেষ্টা করেছে তাঁকে পার্লারে নিয়ে গিয়ে ফেসিয়াল, ডাই ইত্যাদি করাতে। সরমা বলেছেন, ‘তোমার ইচ্ছেটা আমার ওপর চাপিয়ে দিও না। আমি যেমন আছি তেমনই থাকতে চাই। রং মেখে বয়স কমানো পছন্দ করি না।’ তবু মেয়ে জেদাজেদি করছে দেখে শেষ কথা বলেন, ‘আচ্ছা, ওসব করে আবার কী লাভ হবে? দেখলে মনে হবে বয়স কম? কিন্তু আবার মনের বয়স কি তাতে কমবে? মন যে মানতে চাইবে না।’

মেয়ে বলেছিল, ‘কিন্তু তোমার এই চেহারা বাবার পাশে মানাচ্ছে না।’ হেসেছিলেন সরমা, ‘ও। ওঁর পাশে মানায় এমন কাউকে জানা থাকলে যোগাযোগ করো, আমার একটুও আপত্তি নেই।’

না। কোনো ঝগড়াঝাঁটি নয়, তৃতীয় পক্ষের কারণেও দূরত্ব তৈরি হয়। একসঙ্গে থাকতে থাকতে হয়তো সরমার মনে হয়েছিল, অনেক তো হলো, এবার নিজের মতো ভাবা যাক। তিনি সময় কাটাতে দীক্ষা নিলেন। ঈশ্বর এমন একটা অনুভব যার মধ্যে ডুবে গেলে অদ্ভুত স্বস্তি পাওয়া যায়। যাকে সময় এবং ভক্তি ছাড়া কিছুই দিতে হয় না। এবং যাঁর কাছ থেকে কোনো জাগতিক বস্ত্ত পাওয়ার সম্ভাবনাই নেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হলেই একটা এক্সপেক্টেশন তৈরি হয়। আমি যেমন দেব তেমনি তার কাছ থেকেও আমি পাব। এটার ব্যতিক্রম ঘটলে সম্পর্ক ভাঙে, দুঃখ উথলে ওঠে। ঈশ্বরের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনাই নেই। সরমা কখন ধীরে ধীরে সেই জগতে ঢুকে গেল তা স্বপ্নেন্দু চোখের ওপর দেখলেন। পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলে মেয়েদের অন্তত বেশিরভাগ মেয়েদের মন থেকে প্রেম, যৌনআকর্ষণ, বাইশের উন্মাদনা দুপ করে নিভে যায়। স্বামীকে ওই ভূমিকা নিতে দেখলে তারা বিরক্ত হন। মন এবং শরীরের সমর্থন পান না। এই সময় যদি কেউ ঈশ্বরচিন্তায় মুক্তির পথ পেয়ে যান, বাড়িতে থেকেও তাতেই ডুবে থাকতে খুশি হন তাহলে তাঁর প্রতিবন্ধক হওয়া উচিত নয়। স্বপ্নেন্দু সরমাকে তাঁর আপত্তির কথা জানাননি।

রবিবারের দুপুরে বাড়িতে খাবেন না, কাজের মেয়েকে জানিয়ে দিয়েছিলেন স্বপ্নেন্দু। তাঁর পরিচিত এক ব্যবসায়ী কলকাতা রেসকোর্সের স্টুয়ার্ট হয়েছেন। তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আজ। খুব বড় বাজি ছাড়াও মোট আটটি রেসে ঘোড়ারা দৌড়াবে। ভারতবর্ষের সেরা জকিরা আসছে অংশ নিতে। ব্রিটিশ আমলে রেসকোর্সের স্টুয়ার্ট সাদা চামড়ার লোকই হতেন। তবে ভারতীয় রাজা-মহারাজাদেরও এই সম্মান দেওয়া হতো। এখন ব্রিটিশরা নেই, রাজা-মহারাজাদেরও দিন শেষ, কিন্তু সেই সময়ের তৈরি আইন, প্রোটোকল ঠিকঠাক চালু আছে। তাই স্বপ্নেন্দুকে স্যুট-টাই পরতে হয়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলেন তিনি। এখনো বয়স থাবা বসানো দূরের কথা, অাঁচড় কাটতে পারেনি। চল্লিশেও যেমন ছিলেন এখনো তেমন। হাসলেন তিনি। পার্সে টাকা ভরতে ভরতে মনে পড়ল আমন্ত্রণ জানানোর সময় মিস্টার গোয়েঙ্কা বলেছিলেন, ‘মিসেসকে নিয়ে আসবেন, প্লিজ। কারণ ওখানে মিস্টার-মিসেসরাই আসছেন।’ তখন কিছু বলেননি, কিন্তু আজ সকালে গোয়েঙ্কাকে ফোন করেছিলেন তিনি, ‘সরি মিস্টার গোয়েঙ্কা। আমি যেতে পারছি না।’

‘সে কি! কেন?’

‘ব্যাড লাক। আমার স্ত্রী বাথরুমে পা স্লিপ করে -, তেমন উদ্বেগের কিছু নয়, কিন্তু ডাক্তার ওঁকে আজ হাঁটতে নিষেধ করেছেন।’ মিথ্যে বললেন স্বপ্নেন্দু।

‘ওহো! এখন কেমন আছেন?’

‘ভালো। আজ শুয়ে-বসে থাকতে হবে আর কি!’

‘তাহলে আপনার আসতে কি অসুবিধা হবে?’

‘না। কিন্তু আপনি যে বলেছিলেন সবাই মিসেসকে নিয়ে যাচ্ছেন -?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু যাঁর মিসেস নেই তিনিও তো আসছেন। আপনি আসুন, প্লিজ।’

অতএব স্বপ্নেন্দু যাচ্ছেন। কিন্তু কথাটা কানে বাজল। যিনি বিয়ে করেননি অথবা যাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছেন, সরমা সঙ্গে না থাকলে তাঁকে ওই দলে ফেলবে সবাই। কিন্তু সরমাকে লক্ষ টাকা দিলেও রেসকোর্সে নিয়ে যাওয়া যাবে না। রেসকোর্স দূরের কথা, সজনী তার মাকে সিনেমা হলে নিয়ে যেতে পারে না। হঠাৎ সজনীর গলা পেলেন স্বপ্নেন্দু। বাড়িতে ঢুকে প্রথমে সে মায়ের ঘরে যায়। কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে। তার বিষয়ও স্বপ্নেন্দুর জানা। ‘এই রংচটা শাড়িটা তুমি আবার পরেছ? গলা খালি কেন? মা, তুমি পাহাড়ের গুহায় বসে সাধনা করছ না, বাড়িতে আছ। ওঠ, এখনই শাড়ি পাল্টাও।’ সরমার প্রতিবাদ শোনা গেল। মেয়েকে ধমকাচ্ছেন তিনি। তাঁর ওপর গলা উঠল সজনীর। ‘কোনো কথা শুনবো না, তুমি শাড়ি না পাল্টানো পর্যন্ত আমি এখান থেকে নড়ব না।’

মিনিট চারেক বাদে মেয়ের এই ঘরে প্রবেশ। তারপরেই তাঁর বিস্ময়, ‘উরে ববাবা। তোমাকে ফাটাফাটি দেখাচ্ছে। কী সেজেছ তুমি?’

‘কী এমন সাজলাম। একটা স্যুট পরেছি মাত্র।’ একটু লজ্জা পেলেন স্বপ্নেন্দু।

‘তাতেই উত্তমকুমারের মতো দেখাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছ গো?’

‘আর বলিস না – !’ স্বপ্নেন্দু মিস্টার গোয়েঙ্কার আমন্ত্রণের কথা বললেন।

সজনীর চোখ বড় হলো, ‘তুমি ডার্বি দেখতে যাচ্ছ?’

‘ডার্বি?’

‘আঃ, জানো না যেন। আজ রেসকোর্সে ডার্বি দেখতে সবাই যাবে। তোমার জামাই তার বন্ধুদের সঙ্গে একটু আগে চলে গেল। আমাকে যেতে বলেছিল কিন্তু আমি গেলাম না।’

‘কেন?’

‘দূর! হাজার হাজার লোকের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বসার জায়গা পাওয়া যায় না। সাধারণ টিকিটে ঢুকলে তো ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পাওয়া যায় না।’

‘তা অবশ্য। আমাকে স্টুয়ার্ট লাউঞ্জে যেতে হবে। সেখানেই লাঞ্চ।’ হঠাৎ কী মনে হলো স্বপ্নেন্দুর, ছোট্ট শব্দে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘যাবি?’

সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল সজনী, ‘হ্যাঁ! পাঁচ মিনিট সময় দাও, আমি তৈরি হয়ে নিই।’

পাঁচ নয়, দশ মিনিট পরে সজনী যখন সামনে এলো তখন স্বপ্নেন্দুর মনে হলো তাঁর মেয়ে সত্যি সুন্দরী। সরমার ঘরের দরজায় গিয়ে বললেন তিনি, ‘যাচ্ছি, কোনো দরকার আছে?’

উত্তর এলো পেছন থেকে। সজনী বলল, ‘মা পুজো করছে।’

ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিল। সজনী বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই অনেকবার রেসে গিয়েছ, নেট রেজাল্ট কি? হার না জিত?’

‘হিসেব করিনি। ওখানে গিয়ে এক পয়সাও খেলে না এমন অনেক মানুষ আছে।’

‘তাই? তাহলে আমিও খেলব না। তাছাড়া আমি তো জানতাম না রেসকোর্সে যাব, তাই তৈরি হয়ে আসিনি। খেলতে চাইলে তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে হবে।’

‘তাহলে না খেলাই ভালো। রেস খেলার একটা নিয়ম আছে। হিসেব আছে। কোন ঘোড়া জিততে পারে তা অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে। সেসব না জেনে বাজি ধরা নিছক বোকামি ছাড়া কিছু নয়। তারচেয়ে যে-ক্রাউডটা ওখানে জমায়েত হবে তাদের লক্ষ্য কর। অনেক ইন্টারেস্টিং ব্যাপার দেখবে যা বাইরে দেখতে পাবে না।’ স্বপ্নেন্দু বললেন।

স্টুয়ার্টস এক্সক্লোজারের গেটে ভিড় নেই। পাঁচ পাবলিককে ওদিকে ঘেঁষতে দেওয়া হয় না। তাঁরা ভিড় জমিয়েছেন গ্র্যান্ড এবং মেম্বার্স এক্সক্লোজারে। গেটের প্রহরী হাত বাড়িয়ে কার্ড পরীক্ষা করে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ যেতে পারেন। তাদের পেছনে আর একটি দল গাড়ি থেকে নেমে এলো। কিন্তু প্রহরী তাদের মধ্যে বারমুডা পরা লোকটিকে আটকে দিলো। মেয়েদের ক্ষেত্রে বাধা না হলেও ছেলেদের বারমুডা পরে ঢোকা চলবে না। সজনী হাসল, ‘ঠিক হয়েছে।’

এই সময় সামনের জটলা থেকে মিস্টার গোয়েঙ্কা হাসিমুখে এগিয়ে এলেন, ‘ওয়েলকাম। আপনারা শেষ পর্যন্ত এসেছেন দেখে খুব খুশি হলাম। চলুন, আপনাদের দোতলায় বক্সে বসিয়ে আসি।’

‘রেস আরম্ভ হয়নি তো?’

‘জাস্ট দশ মিনিট বাকি। ওপরে উঠলেই দেখতে পাবেন হাজার হাজার মানুষ এদিকে এসে গেছে।’ তারপর গলা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন মিস্টার গোয়েঙ্কা, ‘ম্যাডামের পা তো নর্মাল। ইনি নিশ্চয়ই আপনার মিসেস নন?’

‘ওহো। সজনী, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছি। ইনি মিস্টার গোয়েঙ্কা, আজ আমরা ওঁর গেস্ট। আর মিস্টার গোয়েঙ্কা, এর নাম সজনী, আমার একমাত্র মেয়ে।’

সজনী মিস্টার গোয়েঙ্কার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি হাসল।

দোতলার বক্সটি চারজনের। সেখানে ওঁদের বসিয়ে গোয়েঙ্কা বললেন, ‘আমি একটা পনেরোতে আপনাদের ডেকে নিয়ে যাব লাঞ্চের জন্যে।’

স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়লে ভদ্রলোক চলে গেলেন। দোতলার গ্যালারি যেন রঙিন সাজের মানুষদের জন্যে রঙিন হয়ে গেছে। সজনী অবাক হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছিল। কত ফিল্মস্টার চারপাশে ছড়িয়ে আছেন। বাকিদের দেখলেই বোঝা যাচ্ছে তাঁরা অতি উচ্চবিত্ত সমাজের মানুষ। পুরুষরা দামি পোশাক পরেছেন, মহিলাদের সাজ দুচোখ ভরে দেখার মতো। স্বপ্নেন্দু মেয়েকে বলল, ‘সামনে তাকা, কী সবুজ মাঠ। এতবড় রেসকোর্স ভারতবর্ষে নেই। বিভিন্ন দূরত্বে আধঘণ্টা পরপর নতুন নতুন ঘোড়া দৌড়াবে। দৌড় শেষ হবে ঠিক আমাদের সামনে।’

স্বপ্নেন্দুর কথা শেষ হওয়ামাত্র রেস শুরু হয়ে গেল। ভিক্টোরিয়ার দিক থেকে দশ-বারোটা ঘোড়া ছুটে আসছে। মাইকে রিলে হচ্ছে তার। সঙ্গে সঙ্গে জনতা চিৎকার শুরু করল পছন্দের ঘোড়ার নাম ধরে। সজনী মুগ্ধ হয়ে দেখল একটা ঘোড়া সবাইকে ছাড়িয়ে জিতে গেল রেসটা। এই সময় গোয়েঙ্কা এসে একটা বই তুলে দিলেন স্বপ্নেন্দুর হাতে, ‘পরের রেসগুলো দেখে ইচ্ছে হলে খেলুন।’ চিৎকার করে জনতার আওয়াজ ছাপিয়ে কথাগুলো বলে ভদ্রলোক ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলেন।

‘দেখি, দেখি আমাকে দাও।’ প্রায় ছোঁ মেরে বইটা নিয়ে পাতা উল্টাল সজনী। তারপর উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘এই তো সেকেন্ড রেস।’

একজন কর্তাব্যক্তি দুজন মেমসুন্দরীকে এনে স্বপ্নেন্দু যে-বক্সে বসেছিলেন তার সামনের দুটি আসনে বসিয়ে গেলেন। দুজনেই চল্লিশের আশেপাশে। দুজনের মাথার ওপর কায়দা করে অনেকটা উঁচু খোঁপায় সুবিন্যস্ত। খোঁপার গায়ে রুপোলি চেন জড়ানো। কিন্তু স্বপ্নেন্দুর সামনে যিনি বসে আছেন তাঁর পিঠ সম্পূর্ণ নিরাবরণ। টানটান সুডৌল পিঠে মাখনের স্নিগ্ধতা। চোখ সরিয়ে নিতে নিতে আবার তাকালেন স্বপ্নেন্দু। এই মহিলা অন্তর্বাস ছাড়া কীভাবে জামা পরেছেন।

‘বাবা!’ সজনীর চাপা গলা কানে আসতেই মেয়ের দিকে তাকালেন স্বপ্নেন্দু।

‘ওদিকে তাকিও না।’

‘না-না!’ লজ্জা এবং অস্বস্তিতে মাথা নাড়লেন স্বপ্নেন্দু।

কিন্তু কতক্ষণ দূরের মাঠের দিকে তাকাবেন তিনি।

‘বাবা! কত টাকা খেলতে হয়? মিনিমাম?’ বইয়ে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করল সজনী। স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়লেন, ‘আমি এখানে কখনো খেলিনি।’

এবার পিঠখোলা সুন্দরীর পাশে যিনি বসেছিলেন তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন, ‘ডু ইউ ওয়ান্ট টু বেট?’

‘ইয়েস।’ সজনী মাথা নাড়ল।

‘মিনিমাম বেট ইজ টেন রুপিস। আই অ্যাম গোয়িং টু কাউন্টার। ইউ ক্যান কাম উইদ মি।’ মহিলা উঠে দাঁড়ালেন।

পার্স খুলে একশ টাকার নোট বের করে মেয়ের হাতে দিলেন স্বপ্নেন্দু।

‘থ্যাংকু।’ উঠে দাঁড়াল সজনী। তারপর স্বপ্নেন্দুর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় নিচু গলায় বলল, ‘আমি না ফেরা পর্যন্ত চোখ বন্ধ করে থাকো।’

ওরা চলে যাওয়ার পরই গোয়েঙ্কা এসে হাজির, ‘মেয়ে কোথায়?’

‘টিকিট কাটতে গিয়েছে।’

‘আহা। তিন নম্বর ঘোড়া জিততে পারে, ওকে বলা হলো না।’

‘ঠিক আছে। মজা করতে এসেছে, জেতা-হারা কোনো ব্যাপার নয়।’

এবার গোয়েঙ্কার নজর পড়ল পিঠখোলা সুন্দরীর দিকে, ‘হ্যালো!’

‘হাই।’ মহিলা হাসলেন।

‘ভালো আছেন তো?’ গোয়েঙ্কা গদগদ।

উত্তর না দিয়ে কাঁধ নাচালেন মহিলা।

‘ওহো! আপনাদের আলাপ নেই, না? ইনি ইলিনা গুপ্তা। আর ইনি স্বপ্নেন্দু সেন।’ ভদ্রতার কারণে স্বপ্নেন্দু বললেন, ‘গ্ল্যাড টু মিট ইউ।’

ইলিনা হাসলেন, ‘আপনি বেট করছেন না?’

‘না।’

‘শি ইজ – !’

‘হ্যাঁ, আমার মেয়ে। ও বেট করতে গেছে।’

‘মাই গড! শি ইজ ইওর ডটার। আই কান্ট বিলিভ!’

গোয়েঙ্কা হাসলেন শব্দ করে, ‘আমি তো স্ত্রী বলে ভেবেছিলাম।’

ইলিনা হেসে বললেন, ‘ক্রেডিট গোস টু ইউ।’

‘আচ্ছা – !’ গোয়েঙ্কা চলে গেলেন।

উসখুস করে স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি কলকাতায় থাকেন?’

‘ওঃ, নো। আই অ্যাম ফ্রম মুম্বাই।’

‘ও।’

সোজা হয়ে বসলেন স্বপ্নেন্দু। এই সময় ওরা ফিরে এলো। সজনী বলল, ‘বাবা, ইনি ফ্যাশন ডিজাইনার। শোভা গুপ্তা।’

স্বপ্নেন্দু কিছু বলার আগে শোভা বললেন, ‘আপনি যে সজনীর বাবা তা ভাবাই যাচ্ছে না। আমার বর তো পঞ্চাশেই বুড়ো হয়ে গিয়েছে।’

উত্তর না দিয়ে স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কত নাম্বার খেললেন?’

শোভা বললেন, ‘আমি এক নাম্বার। সজনী তিন।’

‘তোর তিন নাম্বার খেলার কারণ কী?’

‘কোনো কারণ নেই। তিন আমার পছন্দের নাম্বার।’

রেস শুরু হয়ে গেল। জিতলো দুই নম্বর ঘোড়া। দর্শকরা চেঁচাচ্ছে। ওটাই বেশিরভাগ মানুষের পছন্দের ঘোড়া ছিল।

একটু পরে একজন যুবকের সঙ্গে যে বয়স্ক মহিলা পাশের বক্সে এসে বললেন, তাঁর বয়স অবশ্যই সত্তর পেরিয়েছে। সাদা সিল্কের শাড়ি, সাদা জামা, মাথায় সাদা চুল পরিপাটি করে বাঁধা। চশমায় বিশেষত্ব আছে যা তাঁর বয়সের সঙ্গে চমৎকার মানানসই। গম্ভীর মুখে ভদ্রমহিলা মাঠের দিকে তাকিয়ে আছেন।

সজনী চাপা গলায় বলল, ‘কী দারুণ দেখতে, না বাবা?’

এবার ভদ্রমহিলা বাঁ দিকে তাকালেন। ভাবলেশহীন মুখ। মুখে বলিরেখা জানান দিলেও তা সৌন্দর্যকে ম্লান করতে পারেনি। সজনী তাঁর দিকে তাকিয়েছিল। মহিলার মুখ একটু নরম হলো। বললেন, ‘এক্সকিউজ মি! কিছু বলবে?’

‘না, না। এমনি দেখছিলাম।’

‘নাম কী?’

‘সজনী।’

‘তোমার বাবার নাম স্বপ্নেন্দু?’

‘এ্যাঁ!’ চমকে উঠল সজনী, ‘আপনি জানলেন কী করে?’

‘কারণ আমরা একসঙ্গে পড়তাম। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। ও আমাকে চিনতে পারছে না। এখনই ওকে কিছু বলো না।’

‘আপনার নাম জানতে পারি?’

‘স্বচ্ছন্দে। মালবিকা। বিয়ের আগে মিত্র ছিলাম। বিয়ের পর দত্ত। যার জন্যে দত্ত হয়েছিলাম তিনি আজ নেই। আর এ হচ্ছে আমার নাতি, শৌভিক।’

পরের রেস শুরু হওয়ার তোড়জোড় চলছিল। গোয়েঙ্কা চলে এলেন, ‘চলুন লাঞ্চ করবেন। ম্যাডাম, আপনারা কি লাঞ্চে আসবেন?’

দুই মহিলা পরস্পরের মধ্যে দৃষ্টি-বিনিময় করলেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। সজনী মালবিকাকে বলল, ‘আমি আপনাকে কি বলে ডাকব জানি না। আন্টি বলতে ভালো লাগছে না। কিন্তু আপনি কি লাঞ্চে আমার সঙ্গে যাবেন?’

‘না মা। আমি খেয়ে এসেছি।’ বৃদ্ধা সুন্দর হাসলেন, ‘যাও খেয়ে এসো।’

লাঞ্চ যে-ঘরে পরিবেশন করা হচ্ছে সেখানে বেশ ভিড়। সজনী একটু খোঁজার পর ওদের দেখতে পেল। পিঠখোলা মহিলা স্বপ্নেন্দুর সঙ্গে হেসে এমনভাবে চোখ ঘুরিয়ে কথা বললেন যে সজনীর গলা থেকে একটু জোরেই শব্দটা ছিটকে বের হলো, ‘বাবা!’

স্বপ্নেন্দু তাকালেন, ‘হ্যাঁ। আয়। তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’

খাবার প্লেটে নিয়ে দাঁড়িয়েই খাচ্ছিল সবাই। পিঠখোলা মহিলা বললেন, ‘এখানে আসার ইচ্ছে ছিল না। না এলে আপনার সঙ্গে আলাপ হতো না।’

স্বপ্নেন্দু মাথাটা সামনে ঈষৎ ঝুঁকিয়ে বললেন, ‘ধন্যবাদ।’

দ্বিতীয় মহিলা সজনীর দিকে তাকালেন, ‘আজ রাত্রে কী করছ? বাবাকে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে এসো। নটার মধ্যে। আমরা একটা এক্সক্লুসিভ পার্টি করব।’

‘খুব ভালো লাগত যেতে পারলে। কিন্তু আমার মা অসুস্থ। আজ ওঁর সঙ্গে থাকব।’ সজনী হেসে বলল।

দ্বিতীয়া অবাক হলেন, ‘কী হয়েছে ওঁর?’

‘খুব মারাত্মক অসুখ। মানুষ যখন নিজেকে একা মনে করে তখন অসুখটা হয়।’

‘আচ্ছা।’ মহিলা মাথা নাড়লেন, ‘আই অ্যাম সো সরি!’

এরপর কথা এগোচ্ছিল না। ভিড়ের মধ্যে সবাই যেটুকু পারে খেয়ে প্লেট রেখে দিলো। স্বপ্নেন্দু একটা বেয়ারাকে বলে জল আনিয়ে নিলেন।

দ্বিতীয়া ‘এক্সকিউজ আস’ বলে পিঠখোলাকে নিয়ে মেয়েদের টয়লেটের দিকে চলে গেলে স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করল, ‘হঠাৎ মাকে অসুস্থ করলে কেন?’

‘অসুস্থ না হলে কোনো মানুষ নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখে?’

তুমি জানো ওটা উনি করেন ইচ্ছে করেই। ঈশ্বরকে আঁকড়ে ধরতে চেয়ে নিজের প্রতি নজর দেননি। কেউ ওঁকে বলেছিল আমার পাশে থাকলে ওঁকে মাসি বলে মনে হয়। তারপর থেকেই উনি দূরত্ব রেখে চলেছেন। তাই ওঁর অসুস্থতা মনের।’ স্বপ্নেন্দু বললেন।

সজনী বলল, ‘তুমি কি ওঁদের জন্যে অপেক্ষা করছ?’

‘না। তোর সঙ্গে কথা বলছি।’

‘তাহলে বক্সে চলো।’

নিজের চেয়ারে বসে সজনী মালবিকার দিকে তাকিয়ে হাসল। মালবিকা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিছু খেললে নাকি?’

‘না। আপনি?’

‘দূর! দেখতেই মজা।’

সজনী স্বপ্নেন্দুর দিকে তাকাল, ‘বাবা, ওঁর সঙ্গে আলাপ হলো। কী সুন্দর দেখতে। তাই না?

স্বপ্নেন্দু মালবিকাকে দেখলেন। বললেন, ‘নমস্কার।’

মালবিকা হাত জোড় করলেন। তারপর হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চিনতে পারছ?’

ধন্দে পড়লেন স্বপ্নেন্দু। বললেন, ‘ঠিক প্লেস করতে পারছি না।’

‘সেটাই স্বাভাবিক। তুমি তো এখনো যুবক।’

‘আপনি আমাকে চেনেন?’

‘নইলে তুমি বলছি কী করে?’

সজনী কথা বলল, ‘উনি মালবিকা দত্ত। বিয়ের আগে মিত্র ছিলেন। তোমরা সহপাঠী ছিলেন। মনে পড়ছে?’

বিদ্যুৎ চলকে গেল মাথায়। স্বপ্নেন্দু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘মালবিকা! তুমি?’

‘আমি।’

‘উঃ। কতদিন পরে দেখলাম। পঞ্চাশ বছর পরে তোমাকে দেখছি।’

‘হ্যাঁ। পঞ্চাশ বছর পরে যা হওয়া স্বাভাবিক আমি তাই হয়েছি। কিন্তু তুমি একটু বড়সড় হওয়া ছাড়া আগের মতো আছ। অসুবিধে হয় না?’

‘অসুবিধে? অবাক হলো স্বপ্নেন্দু।

‘এই স্রোতের উল্টোদিকে চলতে।’

ঠিক তখনই হইহই শব্দ হলো। খাঁচায় ঢুকিয়ে দৌড় শুরু করার জন্য ঘোড়াগুলোকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল সহিসরা। হঠাৎ একটা ঘোড়া তীব্র আপত্তি করে লাফিয়ে উঠতেই সহিসের হাত থেকে লাগাম বেরিয়ে গেল। মুক্ত ঘোড়াটা অন্য ঘোড়াদের দিকে দৌড়ে গেলে তারাও বিদ্রোহী হলো। তারাও লাফাতে লাগল। সহিসরা ভয় পেয়ে দূরে সরে যেতেই বারোটা ঘোড়া ধাক্কা দিয়ে খাঁচা ভেঙে ফেলল। তারপর একসঙ্গে দৌড়ে চলে এলো গ্যালারির সামনে। ভয়ঙ্কর বেগে তারা রেসকোর্সের রেলিং ভেঙে ফেলল। সামনে যা পাচ্ছে তাই ওরা উড়িয়ে দিচ্ছে। পুরো রেসকোর্সের মাঠে বিশৃঙ্খল অবস্থা।

দর্শকরা ভয় পেয়ে গেল। রেসকোর্সের ঘোড়াদের তিনমাস বয়স থেকে প্রতিদিন যা শেখানো হয় তার অন্যতম হলো ডিসিপ্লিন। একইভাবে তারা মাঠে আসে, খাঁচায় ঢোকে, দৌড়ায়। এই নিয়মের ব্যতিক্রম কখনোই হয় না। আজ হলো? কর্তারা ভেবেই পাচ্ছেন না, কেন হলো?

সজনী বলল, ‘বাবা, চলো।’

সবাই উঠে দাঁড়িয়েছিল। কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘ঘোড়াগুলো পার্কিং প্লেসে ঢুকে একটার পর একটা গাড়ি ভাঙছে। ওদের থামাতে গুলি করে মারা উচিত।’ কিন্তু গুলি করা আইনে নিষিদ্ধ।

সজনী দেখল এই গোলমাল শুরু হওয়ামাত্র পিঠখোলা এবং তাঁর সঙ্গিনী উধাও হয়ে গিয়েছেন। মালবিকা বললেন, ‘তাহলে স্বপ্নেন্দু। নিরীহ ঘোড়াগুলোও আচমকা বিদ্রোহ করতে পারে।’

স্বপ্নেন্দু কথা বললেন না।

মালবিকা তাঁর নাতিকে বলতেই সে সজনীকে একটা কার্ড এগিয়ে দিলো।

সজনী হাসল, ‘আপনাকে ফোন করব।’

প্রায় আধঘণ্টা পরে গাড়িতে চুপচাপ বসেছিল স্বপ্নেন্দু, পাশে সজনী। তাঁদের গাড়ি বেঁচে গেছে।

দুদিন বাদে মায়ের ফোন পেল সজনী। ‘কী ব্যাপার বল তো।’

‘কেন? কী হয়েছে?’

‘তোর বাবা চায়ে চিনি খাচ্ছে, ব্রেকফাস্ট শুধু গমের বদলে লুচি তরকারি, লাঞ্চে ভাত আলুসেদ্ধ, তরকারি মাছ বা মাংস খাচ্ছে। এসব তো কখনো খেত না।’

‘তাই?’

‘হ্যাঁ রে। তার ওপর শুনলাম, এই দুদিন দাড়ি কামায়নি। গালে গলায় সাদা কদম ফুটে উঠেছে। ভাবতেই পারছি না।

‘কাজের লোকের মুখে না শুনে নিজেই যাও না দেখতে।’

‘আমার বয়ে গেছে। দরকার হলে সে নিজেই আসবে।’

ফোন রেখে আবার ডায়াল করল সজনী, ‘বাবা, কনগ্র্যাচুলেশন!’

স্বপ্নেন্দু হাসলেন, ‘ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress