প্রলয়ের গল্প, জীবনের গান
পাহাড়ে ওঠা – জীবনের খোঁজে এক ভ্রমণ
ডঃ অরিন্দম মিত্র, কলকাতার একজন বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, জীবনের ব্যস্ততায় পরিবারকে সময় দেওয়া প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। স্ত্রী রঞ্জনা এবং আট বছরের মেয়ে তানিয়া মাঝে মাঝেই তাকে ভ্রমণে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করত। কিন্তু তার কাজের চাপ কখনোই সেই সুযোগ দেয়নি। একদিন, পুরনো বন্ধু রঘুবীর, একজন পরিবেশবিদ, অরিন্দমকে কেদারনাথ যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। সে বলে, “একবার প্রকৃতির মাঝে চলে আয়। নিজের কাজের বাইরেও কিছু রয়েছে, তা অনুভব করবি।”
অবশেষে, রঞ্জনার পীড়াপীড়িতে অরিন্দম রাজি হন। তাদের সবার মনে ছিল কেদারনাথের সৌন্দর্য আর পবিত্রতা নিয়ে এক অন্যরকম উত্তেজনা। কিন্তু তারা জানত না, সেই ভ্রমণ তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা হয়ে উঠবে।
কেদারনাথ পৌঁছে অরিন্দম প্রথম থেকেই কিছু অদ্ভুত অনুভব করছিলেন। মন্দাকিনীর তীরে হাঁটার সময় এক স্থানীয় বৃদ্ধ তাকে বলেছিলেন, “এই নদী কখনো স্থির থাকে না। সে তার ক্রোধ দেখাবে।” রঞ্জনা এসব শুনে হেসে বলেছিল, “আপনি অতীতের পুরাণকথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। এখনকার নদী এত ভয়ঙ্কর হতে পারে না।”
অরিন্দম যদিও বুঝতে পারছিলেন, প্রকৃতি কিছু বলতে চাইছে। রঘুবীর তাকে জানায়, “আমাদের এখানে ভূমিকম্পের ছোট ছোট কম্পন ধরা পড়ছে। নদীর জলও স্বাভাবিকের তুলনায় অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে।”
১৭ জুনের সেই কালো সকাল। মন্দাকিনীর জল হঠাৎ করেই ভয়ঙ্কর ভাবে বেড়ে যায়। অরিন্দম, রঞ্জনা আর তানিয়া তখন পাহাড়ের একটি ছোট্ট আশ্রমে ছিল। নদীর গর্জন এবং ঢেউয়ের শব্দ তাদের সবাইকে আতঙ্কিত করে তোলে।
“তুমি তানিয়াকে নিয়ে দৌড়াও!”—রঞ্জনা চিৎকার করে বলল। কিন্তু পরিস্থিতি এত দ্রুত বদলে গেল যে তারা কিছু করার সুযোগই পেল না। অরিন্দম তার মেয়েকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু এক বিশাল ঢেউ এসে তাকে মাটি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তানিয়া তার হাত ফসকে নদীর স্রোতে হারিয়ে গেল।
রঞ্জনা অরিন্দমকে ধরার চেষ্টা করছিল, কিন্তু নিজেও জলের প্রবল স্রোতে ভেসে গেল। অরিন্দম একটি বড় পাথরের আড়ালে আটকে যায়, পা ভেঙে যায়। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই তার চেতনায় ভেসে উঠল তানিয়া ও রঞ্জনার মুখ। “আমি মরতে পারি না। ওদের জন্য আমাকে বাঁচতেই হবে,” মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি।
অরিন্দম ধীরে ধীরে নিজেকে টেনে একটি গুহার ভিতর নিয়ে গেলেন। সেখানে আরও কয়েকজন আহত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন পূর্ণিমা, অন্তঃসত্ত্বা এক মহিলা। তার চোখে ছিল জীবনের প্রতি গভীর হতাশা।
অরিন্দম পূর্ণিমাকে সাহস দিয়ে বললেন, “তুমি যদি হার মানো, তাহলে তোমার ভেতরে যে নতুন জীবন আছে, সেও শেষ হয়ে যাবে। আমরা সবাই বাঁচব। তুমি দেখবে, এই ধ্বংসের মধ্যেও আলো আছে।”
গুহায় থাকা একটি কিশোরী পূজা, তার পরিবারকে হারিয়েছে। সে অরিন্দমকে তার বাবা মনে করে আঁকড়ে ধরে। অরিন্দম বুঝতে পারলেন, তিনি শুধু নিজের জন্যই নয়, এই মানুষগুলোর জন্যও দায়ী।
রঘুবীর, যিনি স্থানীয় ভূমিধস এবং পরিবেশগত ভারসাম্য নিয়ে গবেষণা করছিলেন, শেষ পর্যন্ত একটি গুহায় তার সাথে দেখা করেন। তিনি জানান, কেদারনাথের কাছেই একটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করা হয়েছিল, যা নির্মাণ কাজের সময় পাহাড়ের ভারসাম্য নষ্ট করেছিল।
“মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। পাহাড় এভাবে ধ্বংস হবে না,” রঘুবীর বললেন। “এটা আমাদেরই দোষ। আমরা প্রকৃতিকে অপমান করেছি, আর সে তার প্রতিশোধ নিচ্ছে।”
অরিন্দম এবং তার সঙ্গীরা ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই নিজেদের শক্তি জোগাড় করার চেষ্টা করে। পূর্ণিমার প্রসব যন্ত্রণার সময় আসে। অরিন্দম প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান দিয়ে তার সন্তান প্রসব করান। নবজাতকের কান্না যেন ধ্বংসের মধ্যেও জীবনের নতুন আশার বার্তা নিয়ে আসে।
তবে তাদের খাবার প্রায় ফুরিয়ে গিয়েছিল। গুহার বাইরে বেরিয়ে আশ্রয় খোঁজার সময় একটি ভূমিধসে রঘুবীর প্রাণ হারায়। কিন্তু যাওয়ার আগে সে তার সব নথি অরিন্দমকে দিয়ে যায়।
ধ্বংসস্তূপ থেকে বাঁচার চেষ্টায় তারা শেষমেশ উদ্ধারকারী দলের কাছে পৌঁছায়। কিন্তু অরিন্দমের মনে তখনও তানিয়া আর রঞ্জনার হারানোর যন্ত্রণা। পূজা তার হাত ধরে বলে, “তুমি তো আমাদের বাঁচালে। তানিয়া আর রঞ্জনা আপনা থেকেই খুশি হবে। তুমি তো একজন সুপারহিরো!”
অরিন্দম শহরে ফিরে এসে একটি বই লেখেন, ‘প্রলয়ের পরে আলো, যেখানে তিনি তার অভিজ্ঞতা আর প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়িত্বের কথা উল্লেখ করেন। বইটি অসংখ্য মানুষকে নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়।