Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » প্রতি চুয়ান্ন মিনিটে || Mahasweta Devi » Page 4

প্রতি চুয়ান্ন মিনিটে || Mahasweta Devi

আন্দোলনটা হয়েছিল।

এ রাজ্যের বড় বড় দৈনিকে খবরটা খুব ফলাও করে কভার করে।

রাজনীতিক দলগুলিও মঞ্চে নামতে বাধ্য হয়। কলকাতা থেকে ছুটে আসেন নেতারা, জেলার মন্ত্রীরা। পুলিশ সকলের আক্রমণের টার্গেট হয়।

ফলে নির্মীয়মাণ হোটেলের সামনে বসে এক অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি।

সুজাতারা মেমোরেণ্ডাম ছাপান ও বিলি করেন। এ সীমান্ত জেলা থেকে কত মেয়ে তিন বছরে অপহৃত, কতজন ধর্ষিতা, কতজন ধর্ষণের পর নিহত। চিহ্নিত আসামীরা কিভাবে নিশ্চিন্তে ঘুরছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এস. পি. সবচেয়ে আক্রান্ত হন।

কারা এ কাজ করল? তারা কি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মস্তান?

সমুরা দাবি করে, ধর্ষণ যখন রাজ্যের বিরুদ্ধে অপরাধ, তখন পুলিশ কেন কেস করছে না?

ওরা কলকাতা ছুটে গিয়েছিল শ্রীমতী বর্ষা প্যাটেলের কাছে। বর্ষা প্যাটেল বম্বেতে কুলাম্বা নায়ারের কেস করেছিলেন, জিতেছিলেন, আসামী ধরা পড়েছিল। কিন্তু ওঁর কথাবার্তা আশাবাদী নয়, সিনিকাল।

—সে তো ১৯৮৩—র ঘটনা। রেপ কেস প্রমাণ করাই কঠিন, আর তার ম্যক্সিমাম সাজা যাবজ্জীবন। এতে জামিন মেলে না। লোকটা বেরিয়ে যাবে, সুপ্রীম কোর্টে আপীল করেছে।

—বেরিয়ে যাবে?

—মনে হয়। আপনাদের এটা তো গ্যাংরেপ।

—তাই মনে হয়।

—’মনে হয়’! বর্ষা প্যাটেল বিষণ্ণ হাসি হাসলেন। সমু, সুজাতা, গুলতি, পিপলি—সবাই কিছুটা আশাহত। বর্ষা প্যাটেল কৃতী আইনজীবী, মেয়েদের ধর্ষণের কত রকম কেস না করেছেন। কত লেখা বেরিয়েছে তাঁর বিষয়ে।

তারপর সেই বর্ষা প্যাটেল কলকাতায় আসছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে, এটা জানার পর নিশীথই যোগাযোগ করে দেয়। একটি ঘণ্টা সময় বের করা গেল তাঁর ব্যস্ত কর্মসূচীর মধ্য থেকে। বললেন, ‘মনে হয়’ শব্দের তো কোনো দাম নেই। রেপ কেসের নিয়মগুলো শুনলেই বুঝবেন। প্রথম রিপোর্ট কে করে, মেয়েটি?

—ও তো সেন্সলেস ছিল।

—’রেপ হয়েছে’ বলে কেউ রিপোর্ট লিখিয়েছে?

—না। ওকে নগ্ন ও ক্ষতবিক্ষত দেখে লোকাল থানা কিছুই লেখেনি। সদরে ফোন করে সদর থানা মারফৎ হাসপাতালে দিয়ে যায়।

—গ্যাংরেপ বলল কে?

—ডাক্তাররা, আমরাও বুঝেছিলাম।

—আপনাদের বোঝার তো কোনো দাম নেই। পুলিশে লেখায়নি কেউ?

—ওর বাবা।

—ডাক্তারী পরীক্ষাতেও তাই বলছে?

—ওখানে তো বলছিলেন, এমন জঘন্য গ্যাংরেপ কেস আগে পাননি।

—কারা রেপ করে, কোথায় রেপ হয়…

সুজাতা বললেন, বলতে পারত একমাত্র পুতলি। কিন্তু লোডশেডিং ছিল, ওকে বারবার ফ্লোরোফর্মও করা হয়। ও অ্যাট অল কিছু বলতে পারবে কিনা জানি না।

—আর নিয়ম হলো, ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট বা এফ আই আর—এ শুধু প্রাসঙ্গিক তথ্য থাকবে। এটা যে রেপ তা পরিষ্কার বলতে হবে। তার সঙ্গে অন্যান্য অপরাধ ঘটে থাকলে তাও বলতে হবে। এফ আই আর সই করতে হবে। মেয়েটির বাবা এ সব করেছিলেন?

—উনি খুব ভেঙে পড়েছিলেন।

—তারপর পুলিশ যাবে ক্রাইমের সীনে, ধর্ষিতার জবানবন্দী নেবে, ডাক্তারী পরীক্ষা করাবে, প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের জবানবন্দী নেবে, কাপড়চোপড় ইত্যাদি প্রমাণ সংগ্রহ করবে, রাসায়নিক পরীক্ষায় পাঠাবে।

সমু চেঁচিয়ে ওঠে, ওকে নগ্ন করে ফেলে দিয়ে যায়, নগ্ন করে…

সমু উঠে গিয়ে জানালায় দাঁড়ায়।

—তারপর আসছে আসামীকে/আসামীদের গ্রেপ্তার। তারপর ধর্ষিতা মেয়েটি তাকে/তাদের শনাক্ত করবে।

সুজাতা আস্তে ইংরেজিতে বলেন, ও আমার বাড়ি থেকে সন্ধ্যার মুখে বেরোয়, কিছুদূর যেতে লোডশেডিং এবং নিখোঁজ। চারদিন বাদে হাইওয়ের পাশে ওকে পাওয়া যায়। নগ্ন, বুকে আঁচড়, কামড়ের দাগ, লজ্জাস্থানে চাপ চাপ রক্ত, ও বেহুঁশ। হাসপাতালে এত চিকিৎসার পর এখনো ওর ট্রমা কাটেনি। তাকাচ্ছে, কাউকে দেখলে কুঁকড়ে যাচ্ছে, অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে।

—এ কেস তো দাঁড় করানোই কঠিন। আমি আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। পুলিশের যা অ্যাটিচুড…প্রপার মেডিক্যাল একজামিনেশান করবার ব্যবস্থা কোথায় জেলা হাসপাতালে? যথেষ্ট প্রমাণ পেলে তবে তা পুলিশ চার্জশীট দেয়। কি করে ধর্ষিতা মেয়েটি সুবিচার পাবে। পুলিশ কি কম মেয়ে ধর্ষণ করে?

—লীগ্যালি কিছু করা যাবে না তবে?

—খুব কঠিন। যদি মেয়েটি যথেষ্ট রিকভার করে, যদি আসামীদের চিনতে পেরে থাকে, ‘জার্নি টু জাসটিস’ বইটা দিয়ে গেলাম, এতে সবই লেখা আছে। কেস করবার যথেষ্ট গ্রাউণ্ড থাকলে জানাবেন। আমি সানন্দে আসব।

—এত সব জানিনা।

—জানুন, লীগ্যাল সেলস গড়ুন, আন্দোলন গড়ে তুলুন। হাজার হাজার মেয়ে ধর্ষিতা হয়, ক’জন ধর্ষণকারী কোথায় শাস্তি পায়? কি করে পাবে?

নিচু অথচ তীব্র গলায় বললেন, যে দেশে প্রতি চুয়ান্ন মিনিটে একটা করে নারী ধর্ষণ হয়, প্রতি দু’ঘণ্টায় পণের কারণে একটি করে বধূ হত্যা হয়, প্রতি তেতাল্লিশ মিনিটে একটি মেয়ে অপহৃতা হয়, নির‍্যাতিতা হয় প্রতি ছাব্বিশ মিনিটে, সে দেশে কোন মেয়ে এই মান্ধাতার আমলের পুরুষদের তৈরি বিচার—ব্যবস্থার কাছে সুবিচার পাবে? হিন্দী ছবিতে নারী ধর্ষণ দেখানো চলবে না বলে আমরা একটা সেমিনার করি। এক তরুণ অ্যাডভোকেট বললেন, যা ঘটছে, তাই দেখাচ্ছে। অবাস্তব কিছু দেখাচ্ছে?

ঘড়ি দেখে উঠে পড়লেন। করজোড়ে বললেন, আমি আপনাদের কোনো সাহায্যই করতে পারলাম না। কিন্তু রেপ প্রমাণ, ও রেপ কেস করতে করতে আমি তিক্তই হয়ে গেছি। আইনগুলো এত অমানবিক!

নিশীথ বলল, ছেড়ে তো দেননি।

—ছাড়ব কি করে? দরকার প্রতি রাজ্যে তেমন আশ্রয় কেন্দ্রের … যেখানে এ সব মেয়েরা প্রকৃত আশ্রয় পাবে, যা আপনাদের সরকারী লিলুয়া হোম নয়। মধ্যপ্রদেশে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ হয়, নিষ্ঠুরতায় নির‍্যাতনে পশ্চিমবঙ্গের স্থান দ্বিতীয়।

—এগুলো..?

বর্ষা সুন্দর হেসে বললেন, পুলিশের রিপোর্ট। অর্থাৎ পুলিশে ডায়েরি করা কেস থেকে গৃহীত পরিসংখ্যান। নিজেরাই ভাবুন, এক পার্সেন্ট কেসও কি থানায় যায়?

—কিসে যে ওকে সুস্থ করা যাবে!

—ভালবাসা আর ঘিরে থাকা। ওর যেন কখনো না মনে হয়, ও একা।

—আচ্ছ…চলি…

—আমার দিদির মেয়েই রেপ হয়, নিহতও হয়।

—ঈশশ।

—আমি আজও আসামীকে খুঁজছি। চেষ্টা হারাতে নেই। আচ্ছা!

ওঁরা বেরিয়ে আসেন। সমু বলে, আমরা ফিরেই যাই সুজাতাদি, ও তো কাউকে চিনতে পারছে না। আর, এখন ও যেমন আছে তেমন থাকাই ভালো।

সুজাতাদি, পিপলি আর নিশীথ একটা কফির দোকানে বসলেন।

পিপলি বলল, বাবা যা হোক, পুতলির জন্যে অনেকটা নর্মাল। খাবার নিয়ে যায়, বসে থাকে। বাবা কুমারের কাছে তো থাকল না।

—কিন্তু তোমার…?

—কি করব বলুন? পূর্বাশা বেচতে পারলে পুতলিকে নিয়ে বাবা একটা আলাদা ফ্ল্যাটে থাকলে…

—তোমার খুব স্ট্রেইন হচ্ছে।

—আমার…অমেয়র… ছেলেমেয়েকে বা কি বোঝাব? কুমার আর ঝুমাও কাজ করে। কে ওঁদের নিয়ে…একা বাবা কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু পুতলি…

—আমরা তো দেখতে যেতে পারি।

—নিশীথ তো ফোন করে, ওঁকে জানাব।

—তুমি রোজ যাও?

—সময় কোথায়? প্রতি বছরই এ সময়টা বড্ড কাজ থাকে। ছেলেমেয়ে অক্টোবরে বাড়ি আসে, আমরা একসঙ্গে দিন পনেরো কোথাও যাই। এ বছর…

—অসুবিধে?

—ওকে তো ছেড়েও দেবে। তখন আমার বাড়ি, কি কুমারের বাড়ি… ওর পক্ষে, আমাদের পক্ষেও একটা এমবারসিং পোজিশান। কি বলব সকলকে? কি হয়েছে ওর?

—বলবে… রেপ হয়েছে…

—সর্বনাশ হবে তাহলে। এত কথা হবে, এত লোক নাক গলাবে, এমন স্ক্যানডাল হবে!

—ওর এত বড় ট্রাজিডি… তোমরা না দেখলে…

—তেমন কোনো ইনস্টিটিউশনও নেই যে ওকে রাখা যায়। একটা রিয়াল প্রবলেম। ওই ছেলেটাকেই যদি বিয়ে করত…

নিশীথ বলে, ওই টাউনে সমু যদি ওকে বিয়ে করে সমাজকে তুড়ি মেরে থাকতে পারে, সমুর পায়ের ধুলো নেব।

পিপলি বলে, পারবে না। ধর্ষিতা মেয়ে নিয়ে? দুজনেই অসুখী হবে। অমেয় তো আমার পুরনো ছেলেবন্ধুদের দেখলেও রেগে যায়। এ তো রেপ হওয়া মেয়ে।

—তুমি সেটা মেনে নাও?

—নিশ্চয়। বিবাহিত জীবনে সুখী হওয়া মানে কিছু ছাড়ো, কিছু পাবে। আমরা তো সুখী হয়েছি।

—কুমার?

—পিপলি সগর্বে বলে, দুজনে দুজনের মত কথা বলে কয়ে নিয়েছে। ওরাও সুখী। পুতলি সবসময়ে অন্যরকম ছিল, আমাদের সঙ্গে মিলতই না। এমন গাঁইয়া, এমন গোঁয়ার, এমন সামান্যে তুষ্ট!

সুজাতা বললেন, তোমাদের বোন, তোমরা তো দেখবেই। যদি বিশ্বাস পাও, আমি ওকে নিয়ে কোথাও চলে যাব।

—কোথাও?

—ম্যাকলাসকিগঞ্জে নিশীথদের একটা বাড়ি আছে। খুব নির্জন, চেনাশোনা জগৎ নয়।

—দেখি, জানাব। আমার প্ল্যান, যত থাকে থাকবে। কুমার ওকে রাখুক কিছুকাল যতদিন না পূর্বাশা বেচা যায়।

—ওখানে বাড়ি রাখবে না?

—ওখানে কেমন করে ওর থাকা সম্ভব অথবা বাবার? ওখানে আমরা কেউ যাব না। এই স্ক্যানডালের পর? আচ্ছা আমি উঠি। বর্ষা প্যাটেল খুব ইমপ্রেসিভ, তাই না? দেখলে মনে হয়, তিরিশ, আমি জানি ওঁর বয়স বাহান্ন। নিশ্চয় ফেসিয়াল করায় বিদেশে গিয়ে।

—আমার তো মনে হলো না।

—আরে, এত বিদেশে যায়, ওর সুবিধে কত। থাকে তো এক বিপত্নীক অ্যাডভোকেটের সঙ্গে। সব জানি। চলি আজ।

নিশীথ মাথা নাড়ল।

—স্বার্থপর পরিবার। পুতলি তেমন মনের আশ্রয় পাবে না।

—সেটুকু দিতেই হবে। নইলে মেয়েটা কোনদিন কি করে বসবে।

—আত্মহত্যা?

—অবাক হবো না।

—না সুজাতাদি। আমার কেন যেন একটা নৈতিক দায়িত্ব এসে গেছে। আমি ওকে বাঁচাতেই চেষ্টা করব।

—হয়তো তোমার ওখানেই হাজির হবো দুজনে। নীহারবাবু নার্সিংহোমে বসে কি পড়ে বল তো?

—গীতা পড়ে, সেদিন হঠাৎ বলল, আমি আর পুতলি দুজনেই তো একটা ধর্মীয় আশ্রমে গিয়ে থাকতে পারি টাকা দিয়ে। ওর তো আর স্বাভাবিক জীবন হবে না।

—বুঝেছি, ওঠো। বাজার করে ফিরতে হবে। বাড়িতে সবজি নেই।

—সুজয় আর জয়া আসে।

—না। আমার সঙ্গে যোগ রাখার সাহস ওদের নেই। ওরা নিরাপত্তায় বিশ্বাসী। আমার একটা রাজনীতিক অতীত আছে না? কুড়ি বছর বয়সে উগ্রপন্থীদের সঙ্গে যুক্ত হবার অপরাধ আমাদের বাড়িতে অমার্জনীয়।

—তাই চা—বাগানের শেয়ার নাওনি?

—নিজেদের বাগানের শোষণের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করি না? সে বাগানের শেয়ার নেব? ছিঃ। ওঠো।

—পুতলির ট্রমা কাটবে কবে? ওরা আমার সঙ্গে ওকে যেতে দেয় তো…

—বয়সটা তো কম। তাড়াতাড়ি শরীর সেরে যাবে।

—মন?

—সময় লাগবে অনেক সময়, ওঠো এখন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *