Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » প্রজাপতি || Samaresh Basu » Page 3

প্রজাপতি || Samaresh Basu

প্রজাপতি – ০৩

এই প্রজাপতিটাকে দেখে, সেই কথাই আমার মনে পড়েছে। চাইলাম ধরতে, তা একবার ছটফটানিটা দেখ। নিজের ইচ্ছায় মার খাওয়া না এ সব! ধরে তো খেয়ে ফেলতাম না। প্রজাপতিটা কখন ঘরে এসেছিল, আর আমার কাছেপিঠেই উড়ে বেড়াচ্ছিল। শিখা চোখ বড় বড় করে বলেছিল, কী সুন্দর প্রজাপতিটা। তখনো আমার তেমন কিছু মনে হয়নি। তারপরে প্রজাপতিটা প্রায় একবার আমার কাঁধের কাছে এসে বসেছিল। শিখা চোখ ঘুরিয়ে হেসে বলেছিল, ‘সুখেনদা, প্রজাপতিটা তোমার গায়ে বসেছে, তোমার এবার বিয়ে লাগবে। আহ্ কী সুন্দর!’

তখনই আমি হাত বাড়িয়ে, রঙচঙে পোকাটাকে ধরতে চাইছিলাম। প্রজাপতি হলেও পোকাই তো ওটা। শিখার কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল, প্রজাপতিটা ওর গায়ে বসলেই ভাল হত। আমার যে আবার কী রকম বিয়ে হবে, তা কি ও জানতো না। মেয়ে আমি অনেক দেখেছি, ঘেঁটেছি যাকে বলে, হাড়ে মাংসে দেখা আছে। বিয়ের কথা কোন দিন চিন্তা করিনি। তবে হ্যাঁ, যদি কোন দিন কিছু করতেই হয়, বিয়েটিয়ের মত, তা হলে শিখাকে আমি ছাড়ব না। তা ওকে যত লোকই চাক, আর যতই ওর পেছনে পেছনে ঘুরুক, ওকে আমি ছাড়ব না। জানি সবই, কে কে ওকে চায়। আমার দুই দাদাও ওকে চায়। বড়দা আর মেজদা। আরও অনেকের টাক আছে, তাল মারবার লোকের অভাব নেই। আরও মেয়েমানুষ যাকে বলে, বাব্বা, যত দেখবে সবাই তাকে তালতোল্লাই দিচ্ছে, ততই রঙে রঙে উঠবে। তার ওপরে যদি সেই মেয়ের আবার একটু খেলুডি মেজাজ হয়, তা হলে তো কথাই নেই। খেলোয়াড়ির সঙ্গে যদি আবার একটু অভাব অনটন, আর যদি জানতে পারে, একটু খেললে পরে, সে-সব মিটবে, উহ্রে ফাদার, তাকে আর দেখতে হবে না। আমার তো মনে হয়, তারা বেশ্যাদের থেকেও মারাত্মক। আর এই রকম মেয়ে আজকাল এত হয়েছে-না, যেখানেই যাবে, গাদা গাদা। বেশ্যাদের বুঝি বাপু, ঘাটে কড়ি দাও, খেয়া মেরে চলে যাও। বুঝেছি বাওয়া, এ নদী এখন তোমাকে পার হতেই হবে। ব্যস, সাফ সুরত ব্যাপার, ধোলাইয়ের নাম পেটে খাওয়া।

কিন্তু এই মেয়েগুলো কী। তারা সব রকম করবে, অথচ, বেশ্যা না। শিখাও অনেকটা সেই জাতের। বাপটি স্‌সাহ্‌ ফেরেববাজ, কলোনী ঘেষে এই আট কাঠা জমিটা কীভাবে বাগিয়েছে, কেউ বলতে পারে না। তার সঙ্গে এই পুরনো একতলা বাড়িটাও। বাড়িটা এককালে এক মুসলমানের ছিল। শুনেছি, পঞ্চাশ সনের দাঙ্গার সময়, শিখার বাবা এই বাড়িটা দখল করেছিল। তারপরে, কীভাবে কীভাবে একেবারে মৌরসী দলিল করে নিয়েছে। খচ্চর-রাজ লোক একেবারে। দলিলে কাউকে সই করাতে ভোলেনি। মুসলমানের সম্পত্তি তো, ভাগীদার অনেক। বলে, টাকাও নাকি দিয়েছিল তাদের। কোথেকে বাবা! টাকা বানাবার কল ছিল তোমার ঘরে! রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল লিখে তো খেতে, আর একটি ক্ষমতা ছিল, এনতার ছেলেমেয়ে করেছ। তাও পাঁচটার বেশী বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। মানুষ যা করেছে, সে তো দেখাই যাচ্ছে। বড় বড় ছেলে দুটো ঘস্টে ঘস্টে কোনরকমে ইস্কুল ফাইনাল পাশ করেছিল। তাও কত বছরে কে জানে বলে, কেরানীর চাকরি করে, আমার স্সাহ তাও বিশ্বাস হয় না, দেখ গিয়ে হয়তো বেয়ারা পিওনের কাজ করে। তবে নেহাত ভদ্রলোকের পরিচয়টা দিত হবে তো, তাই বোধহয় বলতে হয়। বড় মেয়েটার-শিখার দিদি বেলার কোথায় একটা বিয়ে দিয়েছিল! জানি না কার দোষ, সেও ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। বেলা তো এখন বাড়িতেই বেশ আসর জমিয়ে তুলেছে, তবে ওর ব্যাপারটা একটু আলাদা। আমাদের আবার বেলাদিদি তো, ওর ওখানে একটু বড় বড় দাদাদেরই আসর জমে। ডাক্তার, ব্যবসাদার, ইস্তক ভূড়োদাস প্রিয়চরণ মোক্তারও বেলা বেলা করে নালানি-ঝোলানি করে। বেলা বিশেষ বাইরেটাইরে যায় না। আসর যা কিছু বাড়িতেই। তবে আমার মনে হয়, ডাক্তার হরনাথ চক্রবর্তীই ওকে ঠিক জায়গায় কোপ বসিয়েছে। কেননা, ডাক্তার রোজ আসে—তায় আবার ডাক্তার তো—সব সময়ে হাতে থাকা ভাল। কিন্তু এই মাঝবয়সী বুড়ো খচ্চরগুলো কেউই বেলাদিকে বিয়ে করবে না, আমি জানি। ওদিকে তো সব ধাড়িগুলোরই ঘরে একটি করে ইন্ত্রি আর এক পাল বাচ্চা রয়েছে।

বেলাদি মাঝে মাঝে আমাদের দিকেও নেক নজর হানে। আমরা, যারা শিখার পিছনে ঘুরঘুর করি। হানবেই তো, গতরে বিষ, মনেও কোন আশা নেই। মাঝে মাঝে, তা-ই বোধহয় মনে করে, ছোঁড়াগুলোকেই একটু চানকে দেখি। আ–র বেলাদি, ছোঁড়ারা কি আর সেই ছোঁড়া আছে যে তোমার বশার খোঁচায় বিধবে। আজকালকার ছোঁড়ারা সব পাঁকাল মাছ, গায়ে একটু ঝাপটা মারবে, তার পরেই পিছলে কেতরে বেরিয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, বুড়োদের পোটকা মাছের মত ঝাপটা না, সেটা একটু জোরেই লাগবে। তোমাকে জড়িয়ে নিয়ে কেউ যাবে না। তোমার তিরিশ বছরকে জড়াবার জন্যে ওদের পাখনা খেলবে না! তবে হ্যাঁ, জড়বার হিম্মত যদি কারুর থাকতো, তবে ছোঁড়াদেরই। এরকম এক-আধটা কেস এখনো আমাদের এই শহরে ঘটে না, তা বলব না। লাখে এক। বুড়ো বাঁদরগুলোর তো কেবল মিঠে মিঠে বুলি, তার সঙ্গে আবার একটু তত্ত্বকথা। আসলে স্বাদ বদলাবার তাল। কিন্তু বেশ্যা বাড়ি যাবে না। তা-ই কি যেতে পারে, আমন সব খাসা ভদ্দরলোক, আমন ঝকঝকে গতর। লোকে চরিত্রের দোষ দেবে না? রোগের ভয় নেই? তার চেয়ে বল, ওই বুড়োদেরই এক ব্যাটাকে একদিন ধরি, পাড়ার ছেলে-ছোঁড়াদের জড় করি, একটা হৈ-হুল্লোড় পাকিয়ে, তোমার সঙ্গে সাঙা লাগিয়ে দিই! আমার নাম সুখেন—সুখেন গুণ্ডা।

কিন্তু তা হবার নয়। বেলাদির জীবনটা এভাবেই কেটে যাবে মনে হচ্ছে। বেচারি! মাইরি বলছি, আমার খুব খারাপ লাগে, কষ্টও হয়। যে কারণে একবার নির্মল—আমাদেরই বন্ধু, বুক বাজিয়ে বেলাদির নামে খিস্তি করে বলেছিল, কবে ও বেলাদির সঙ্গে কী করেছে, শুনে গদাম করে মেরেছিলাম পাছায় লাথি। ব্যাপারটা অনেক দূর গড়াতো। নির্মল আমাকে মারবার জন্য পকেট থেকে ছুরি বের করেছিল! উহ্ রে স্‌সাহ্‌, কালকা যোগী, মাস্তানি দেখাতে এসেছ আমাকে। স্রেফ লিভারের উপর ঝেড়ে আর একটা লাথি কষিয়েছিলাম। আমার মেজাজ চড়ে গেলে, ক্ষমা নেই। সঙ্গে আরো দু-একজন বন্ধু ছিল। সবাই থামিয়ে দিয়েছিল। নির্মলের হাতের ছুরিটা ছিটকে পড়েছিল দূরে। সেটা তুলে নিয়ে, মুখ বন্ধ করে, আবার ওকেই ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।

তারপরে অবিশ্যি আমার মনে হয়েছিল, কেন মিছিমিছি ওকে মারতে গেলাম। আমরা সবাই-ই তো আমাদের কীর্তিকাহিনী নিজেদের মধ্যে বলাবলি করি, হাসাহসি করি। ওর কী দোষ। বেলাদিরই বা এত চুলবুলোনি কেন যে, আমাদের সঙ্গেও তাল দিতে হবে। তা ভাবলে কী হবে, তখন কী রকম মেজাজ চড়ে গিয়েছিল। নাঃ, সব ভাবলে পরে ঘেন্না ধরে যায়।

শিখার আবার এসব নেই। ওর ভাবভঙ্গি একটু আলাদা, অন্য রকম। ও তো আবার বছর দুয়েক কলেজেও পড়েছিল। অন্য রকমের ফষ্টিনষ্টি আছে, তবে সেসব আমার খুব খারাপ লাগে না। তা বলে সকলের সঙ্গেই করবে নাকি। কিন্তু দেখ গিয়ে, ওর ভাব সকলের সঙ্গে। আরে, র‍্যাশন ইনস্পেকটরটাও ওকে দেখলে কুকুরের মত গলে পড়ে, যেন ল্যাজ নাড়াতে আরম্ভ করে। স্‌লার আগমন কী কারণে? না, দাদাদের সঙ্গে খাতির। শহরে আর লোক পাওনি খাতির জমাবার, যত খাতিরের লোক হল শিখার দাদারা। ক’খানা কার্ড বাড়তি রাখতে দিয়েছ দাদা! হস্তায় হস্তায় ক’ কে জি চাল র‍্যাশন দরে শিখারা পায়! দাদাদের সঙ্গে খাতির দেখাচ্ছে। দাদারাও তো তা-ই বলবে। চার বেলা করে, এই বাজারে ভাত মারতে পারলে, বোনের ওপর দিয়ে যদি কেউ কিছু উশুল করে যায়, যাক। এদিক নেই, ওদিক আছে, দু ভাই আবার রাজনীতিও করে। তাও কি, দু’জনে একদলের না! এ একদল, ও আর-একদল। আমাদের বাড়ির মতই। আমার দুই দাদাও তো তাই-ই। দু’জনে দুই দল করে।

আমার দাদাদের কথা না হয় আলাদা, ওরা তো আর বোন দেখিয়ে চার বেলা ভাত মারে না। এদেরই বোধ হয়, সেই মেটে রঙ, দু-মুখো ঢামনা সাপ বলে। দেখেছি সাপগুলোকে, এত কুচ্ছিত দেখতে বোধ হয় কোন জীব হয় না। একে তো পচা ঘায়ের মত রঙ। লম্বায় বড় হয় না, বেঁটে আর মোটা। সামনে পেছনে বলে কিছু নেই। দুমুখ দিয়েই চলে। আর দুটো মুখই একরকম। কোনটা মুখ আর কোনটা পাছা, কী করে বুঝবে।

শিখার দাদারা হল সেই রকম। ওর দুই দাদা, আমার দুই দাদারই সাকরেদ। আমার দুই দাদা এই শহরের দুই দলের নেতা, আর আমি গুণ্ডা। সাববাস! কিন্তু আমি ভাবি, দাদারা যা-ই হোক, শিখাও কেন ওরকম হবে। সেও নিশ্চয় জেনেশুনেই র‍্যাশন ইনস্পেকটরটাকে চা দেয়, হেসে ঢঙে কথা বলে। সকলের সঙ্গেই তো, যে একটু তাল দিচ্ছে, আমনি নাচছে—নাচছে মানে চোখ নাচাচ্ছে, ভুরু নাচাচ্ছে, শরীর নাচাচ্ছে। মেয়ে বড় ভাল, সকলের সঙ্গেই ভাব খাতির, সবাই বড্ড ভালবাসে, একেবারে উমচ্রু উমচ্রু! সবাই ভালবেসে যা দেয়, তা-ই নেয়, আহ্ কী ভালবাসা গো, একেবারে গড়িয়ে যায়। এদিকে শহরে তো কানপাতা দায়। আজ এর সঙ্গে, কাল ওর সঙ্গে, গল্প লেগেই আছে। সেরকম কাণ্ড কিছু আমার চোখে পড়েনি কোনদিন, যত রকম শোনা যায়। পড়লে কী হবে বলা যায় না। মেজাজ চড়ে গেলে, ভুকিয়ে ছেড়ে দেব, সে আমার নিজের দাদা হলেও খাতির নেই।

তবে এই মেয়েটার একটা কী আছে, অনেক ছেলেই ওর পেছনে লেগে আছে। আমার কথা বাদ, আমি তো একটা গুণ্ডা। আমার দাদাদের তো এই শহরে খুব নাম-ডাক আছে, বলতে গেলে শহরটা দু’ভাগে ওদের দু’জনেরই। অধিকাংশ লোকই দু দলে ভাগাভাগি। ওরা পর্যন্ত শিখার দিকে নজর রেখেছে। কেন, তা-ই আমার জানতে ইচ্ছা করে, শিখার কী আছে। একটা কী যেন আছে ওর। আমি তো বলছি, যারা বেশ্যাদের থেকেও খারাপ, ওকে আমার সেই জাতেরই মনে হয়, তবু কী যেন একটা আছে, যেটা আমি বুঝতে পারি না। এই যেমন, আমি-আমি তো গুণ্ডা সবাই জানে, তবু ও আমার সঙ্গে কথা বলে, মেশে। তার চেয়েও সাফ কথা, আমার সঙ্গে ওর আছে, মানে বেশ ভালই আছে। একটা ছেলেতে আর মেয়েতে যা থাকবার, সেই রকমই প্রায় সব আছে। সেটা আমি গুণ্ডা বলে ভয়ে কি না, জানি না। কিন্তু ভয়ে ভয়ে কিছু হলে সেটা বোঝা যায়। মানে, ইচ্ছে নেই, জোর করে কাউকে যদি চুমো-টুমো খেতে হয়, তার যে কী রকম কাঠ কাঠ ভাব, তা আমার জানা আছে। সে রকম কখনো দেখিনি। শুধু তা-ই না, আমি এলে যে শিখা রাগ করে, অসন্তুষ্ট হয়, সে রকম ভাবও বেশী দেখিনি। একেবারে হয় না, তা বলব না, তবে খুব কম। আমি এলেই তো, বাকী খচ্চরদের কাটবার পালা, এমন কি আমার দাদাদেরও। তখনো কিন্তু ও আমাকে চলে যেতে বলে না, রাগ করে উঠে চলে যায় না, মুখ গোমড়া করেও বসে থাকে না। তা-ই বা কেন, ইচ্ছে করলে গা ছেড়ে দেওয়া ভাবে আলগা আলগা কথাও বলতে পারে, কাটিয়ে দেবার তাল থাকলে অনেকে যেরকম করে। কিন্তু তা-ও করে না।

না না, এ আবার একটু বেশী ভাবছি আমি। করে, দু-এক মিনিট একটু কেমন যেন হয়ে যায়, একটু হাসি-হাসি ঠাট্টা-ঠাট্টা, তার মধ্যে একটু জ্বালাও। হয়তো ঠাট্টার মত করে বলে, ‘বলুন সুখেন্দুবাৰু, আপনার জন্যে কী করতে পারি। ওরকম কথা শুনলে আমার রাগই হয়, যেন ও সকলের জন্যে কিছু করতেই আছে। এতক্ষণ করছিল অন্যের জন্যে, এবার আমার জন্য করবে। খুব মেজাজ খারাপ থাকলে, আমি এক-আধটা খারাপ কথা বলি, খারাপ খিস্তি আর কি! হয় তো বলি, দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে, আমার সঙ্গে শুয়ে পড়তে পার, আর কী পার? এরকম কিছু বললেই কিন্তু শিখা রেগে যায় না। এমন একরকম করে হাসে, যে হাসিতে যেন খানিকটা রাগ বা বিরক্ত ভাব থাকে, সেইভাবে হেসে বলে, ‘বড়িতে গঙ্গাজল আছে, এনে দিচ্ছি, মুখটা একটু ধুয়ে নিন।’

ওরকম কবে কথা বললে, আমি আবার বিশেষ কিছু বলতে পারি না, আর ৩খন ও সপাসল কথার ছপাট চালিয়ে যেতে থাকে, ‘সব সময় সব জায়গায় একই কথা বলে বেড়াচ্ছ, না? মুখটা একটু ভাল করতে পার না, সব সময়ে নোঙরা নোঙরা কথাগুলো বলবার জন্যে যেন মুখিয়ে আছ।’

কিন্তু যে শুয়োরগুলো তার আগে বসেছিল, সে সময়ে ওদের শুয়োর ছাড়া আমার আর কিছু মনে হয় না—আমাকেও নিশ্চয় ওদের ওরকমই একটা কিছু মনে হয়–খচ্চর কুকুর যা হোক একটা, গুণ্ডা তো বটেই, ওদের কথা মনে করে তখনো আমার রাগটা মনের মধ্যে জমেই থাকে, তাই আমি চুপ করেই থাকি। কোনদিন এদের কোন-কোনটাকে আমি হাড় ভেঙে দিতাম। শিখার জন্যেই পারি না, কী জানি কেন। ও ভাল না, আমি জানি, কথা তো সেইখানেই, তবু ওর মধ্যে কী একটা আছে। সে কথা হয়তো কেবল আমারই মনে হয়, একটি বোকচন্দরের মত ওসব ভেবে মরছি, বাকীরা তাওয়ায় রুটি যা সেঁকে নিয়ে যাচ্ছে, তাওয়ার মধ্যে কী আছে, তা ভাবতে তাদের বয়েই গেছে।

তা হতে পারে, আমার যা মনে হয়, আমি তা-ই বলছি, বোকচন্দর হই, আর যা-ই হই, ওর মধ্যে কী একটা যেন আছে, চোখের মধ্যে, কথার মধ্যে বুঝতে পারি না। অনেক সময় মনে হয়, সেইরকম নাকি, সেই বাবা বাইরে স্যাণ্ডেল ফটর ফটর করছে, আর মা আমাদের কাছে বসে আছে, তখন মাকে যেরকম লাগতো। ধূ-র, নাহ! মায়ের সঙ্গে ওর কী। হয়তো বেশ্যাদের চাল এরকম হয়—উহু, না না, ওদের আমার দেখা আছে। ওরা শিখা না। আসলে, এরকম অবস্থায়, শিখার যেরকম হওয়া উচিত ছিল রপুটে মেয়ে—শহরে আরো যে রকম আছে, সে তুলনায় শিখা কেমন যেন অদ্ভুত সহজ। এমন সহজ যে, ওর যেন তা হওয়াই চলে না। গলার স্বর বদলে, ভুরু তুলে, চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, পাছা নাচিয়ে নাচিয়ে চলা এক ধরনের ছুঁড়ি আছে না, রাস্তায় কলেজে সবখানে যাদের দেখতে পাওয়া যায়, বুলির ধরন-ধারণ সবই একটু অন্য রকম, সেরকম একেবারেই না। কে জানে, সেসব আবার ছেলেমানুষি কি না, নাকি সেটাই ছেনালি, জানি না। কিন্তু ওসব মেকীপনার থেকে ওর সোজাসুজি ভাবের টানটা যেন বেশী। আরো কী মনে হয়, ও যেন একটা পাখী, ওর নিজের মনেই আছে। লাফাচ্ছে, পাখা ঝাপটা দিচ্ছে, উড়ছে, খুটে খুঁটে খাচ্ছে, মরদ এসে ঠকছে, ঘাড়ে উঠছে, আবার ভয় পেয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, কোন বাচ্চা ছেলের গুলতির গুলিটা যেন ঠাস করে গায়ের কাছে পড়তেই সী করে উড়ে যাচ্ছে, আর যে-ই না বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, তখন কেমন একটা মন-মরা, যেন সেটাও এক ধরনের ভয় পাওয়া, কী যেন বিপদ চারদিকে.উরে স্‌সাহ্‌, লে লে সুখেন, অনেক ভেবেছিস। যা বোঝা যায না, তা নিয়ে এত ভাবার কোন মানে হয় না। মোটের ওপর, যা-ই থাক, ওর মধ্যে কী রকম একটা মায়া মমতার ভাব আছে। মায়া মমতা, সেটা যে ঠিক কী রকম, তাও ঠিক বলতে পারি না, ওই কথাটাই মনে এল, আর মায়া মমতা থাকলেই, কেমন যেন মনে হয় না, তার একটা কি দুঃখও বুঝি আছে।

দুঃখ! তাও আবার শিখার। ওর আবার দুঃখ কিসের। ওকে তো শহরের গণ্ডা গণ্ডা লোক—যাক্‌গে, আমার ওইরকম মনে হয়। আর তা-ই ও যখন বলেছিল, ‘প্রজাপতিটা তোমার গায়ে বসেছে, তোমার বিয়ে লাগবে’, সেটা যেন কেমন একরকম লেগেছিল। ঠাট্টা করেই থাকুক, আর যাই করুক, প্রজাপতিটা আমি ওকে ধরে দিতে চেয়েছিলাম। ওর গায়ে

দু’জনেরই গায়ে লেগেছে, দু’জনের এক সঙ্গেই হবে। মানে, ওর সঙ্গে আমার হবে। খচ্চর প্রজাপতিটা—না খচ্চরটা, কিছুতেই ধরা দিল না। এখন আমি জানি শিখা কী বলবে। ওর যে রকম কথা, ঠিক বলবে, ‘তোমার একটা ডানা যদি কেউ ভেঙে ফেলে, তা হলে কেমন হয়।’…

কিন্তু শিখা যে ফিরেই তাকাচ্ছে না। পিছন ফিরে কী করছে এতক্ষণ ধরে। দেখতে হয়। আমি দেওয়ালের দিকে ওর কাছে গেলাম। ওর ঘাড়ের পাশ দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, গায়ের সঙ্গে লাগানো আস্তে ডানাটা ধরে, শিখা ছেঁড়া ডানাটা যেন জোড়া লাগাবার চেষ্টায় আছে। আর প্রজাপতিটা এখনো ঝাপটাঝাপটি করছে, এক ডানাতেই ফরফর করছে। আর শিখাটা কী ভেবেছে, ও কি সত্যি ছেঁড়া ডানাটাকে জোড়া লাগাতে চায় নাকি। এসব দেখলে, ওকে কী রকম ছেলেমানুষ লাগে। একটা লেখাপড়া জানা মেয়ে যদি এরকম করে, আর এসব দেখলে, ওর যা নামডাক এই শহরে, মানে রেপুটেশন, স্‌সিখা মজুমদার, তাকে যেন ঠিক চেনা যায় না।

তবে প্রজাপতিটা, সত্যি সুন্দর, বিউটিফুল। শিখার আঙুলে প্রজাপতিটার পাখার কালো আর রুপোলি রঙ লেগে গেছে দেখতে পাচ্ছি। কেন এরকম হয়, কে জানে, প্রজাপতির গায়ের রঙটা যেন আলগা, এইমাত্র কেউ লাগিয়ে দিয়েছে, কাঁচা রঙ, তাই হাতে লেগে যায়। এর আগে, আমিও যতবার প্রজাপতির গায়ে হাত দিয়েছি, ঠিক রঙ লেগে গেছে। তা লাগুক গিয়ে; আমার নাকটা প্রায় শিখার এলিয়ে পড়া চুলের কাছেই। গন্ধ একখানি যা লাগছে না, মিষ্টি মিষ্টি, মনে হচ্ছে, নাক ডুবিয়ে গন্ধটা নিয়ে ‘কপ করে খেয়ে ফেলি, মাইরি গন্ধ খাওয়া যায় না জানি, তবু মনে হয়, গপ করে গিলে ফেলি। বললাম, ওটা জোড়া লাগাচ্ছ নাকি।

শিখা নড়ল না চড়ল না, জবাব দিল না, একইভাবে তলতলে নরম গায়ের সঙ্গে, ছেঁড়া পাখনাটা ঠেকিয়ে রাখল, আর প্রজাপতিটা ঠিক ছটফট করেই চলেছে, সামনের শুড় দুটো কাঁপিয়ে যাচ্ছে। আমি আর একটু ঝুঁকে উঁকি দিতে চেষ্টা করলাম। শিখার মুখটা প্রায় দেওয়ালের কাছে কি না। আমার মুখ বাড়িয়ে এতটা দেখবার উপায় নেই। কিন্তু যা দেখলাম না, তাতেই মেজাজটা একদম বেকায়দা হয়ে গেল। যা ভেবেছিলাম, ঠিক তা-ই, শিখা ব্লাউজের ভিতরে কিছু পরেনি। আর সামনের দিকে ঝুঁকে আছে বলে, ডোরা-কাটা-কাটা শিকের গরাদ জামাটা বেশ খানিকটা ফাঁক হয়ে পড়েছে। আর তার ভিতর দিয়ে, উহ্রে বাবা, হাতে একেবারে বিদ্যুৎ খেলে গেল। বলেছিলাম, সকালবেলার শিশির শুকিয়ে যাবার পরেই, নধর কপিপাতার মতন—ঠিক সেইরকম দেখাচ্ছে। তাতে আবার যেমন, কেমন একটা পাউডার লাগানো ভাব থাকে না, ঠিক যেন সেইবকম, একটা বেশ চোখ-জুড়ানো শ্যামলা শ্যামলা চিকচিকনো রঙ। মাঝখানের ফাঁক, আর দু’ পাশে গোল হয়ে ওঠা ওটা—ওটাকে সত্যি আমার মাংসপিণ্ড বলতে ইচ্ছে করে না। মাংস ভাবলেই যেন এ জিনিস সে জিনিস থাকে না, সত্যি। মাংস বলে আমার মনেই হয় না, যেন অন্য কিছু, আর কিছু। ওই যে বইয়ে লেখে না, স্তন—আরো যেন কী সব বলে না—কী—-কী যেন—গুলি মারো, শিখার ওই বুক দুটোকে আমার স্তন বলতে ইচ্ছা করে। হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়ছে, পীনপয়োধরা—নাহ, হাতটাকে এবার কামড়ে দেব, নয়তো ক্যাত করে একটা লাথি মারব।

আচ্ছা, ওরকম গোল হয়ে বেড়ে উঠেছে বলেই, ওখানকার চামডাটা কি ওরকম দেখায়, যেন খুব ছোট ছোট বিন্দু বুকে ছড়ানো। যেমন হয় না, গায়ে অনেক সময় কাঁটা দিয়ে উঠলে, গায়ে কী রকম কুঁড়ি কুঁড়ি ফুটে ওঠে, সেই রকম দেখাচ্ছে। আর ওখানটা—বুকের মাঝখানটা আর গোল বুক দুটো হাতমুখের রঙ থেকে বেশী ফরসা। এমন কি বাঁ দিকের জামায় এতটা ঢল খেয়েছে, বা দিকের সবটুকু প্রায় পুরোই দেখা যাচ্ছে। যেখানটা ইঞ্চিখানেক জায়গা যেন গোল করে খয়েরি রঙ লাগানো, ওখানটা যে কেমন, সবই আমার জানা। ওর গাটা তো আমার চেনা, সবরকম স্বাদই নেওয়া আছে, তবু একটা ভিখিরির মত হ্যাঙলাপনা, কিছুতেই আমার যেতে চায় না। কেন, আমি তাই ভাবি। ব্যাপারটা তো সেই একই। যতবারই কিছু করতে যাব, ঘুরে ফিরে সেই একরকমই লাগবে। অথচ মনে হয়, প্রত্যেকবারই যেন নতুন লাগবে। এই যেমন, এসব ভাবতেই মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে থাকতে পারছি না, ফুরিয়ে যাচ্ছে, এখনি হাতটা বাড়িয়ে দিই।

শিখার গায়ের ছোঁয়া প্রথম যেদিন পাই, সেই দিনটার কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। তখন আমার অনশন ধর্মঘট চলছে—উ রে স্‌সাহ্‌, মনে করে এখন আমার চিত হয়ে শুয়ে, ওপরে পা তুলে ভ্যাক ভ্যাক করে হাসতে ইচ্ছে করছে। আমি আবার অনশন ধর্মঘটও করেছি! কলেজে সেটাই আমার লাস্ট ইয়ার। বুঝেছিলাম, ডিগ্রি কোর্স-এর ডিগ্রি ডিঙনো আমার দ্বারা আর কোনদিনই হবে না। পড়ে-টড়ে পাশ করা, ওতে অরুচি। পড়লে কী হবে, মনেই থাকতো না। আর মনে না থাকার দোষ কী। কলেজে তো ধূমধাড়াক্কা রোজই লেগে ছিল। আজ এই কাল সেই, আর আমি তো দলের পাণ্ডা। এই যে আমি, এখনকার আমি, যাকে সবাই সুখেন গুণ্ডা বলে, তার হাতেখড়ি কলেজেই। দলাদলি আর মারামারি, তখন থেকেই, তা বলে, সবাই কি আর আমার মত গুণ্ডা হয়েছে। আমিই হয়েছি। আমার তখন সেটাই নেশা, কলেজের মাস্তান। আমার দলের বন্ধুরা আমার মাস্তানি খুব ভালবাসতো, আমি তাদের হিরো—স্‌সাহ্‌ হিরো ছিলাম! চা সিগারেটের ভাবনা ছিল না, যখন যার কাছে চাইতাম, সে-ই খাওয়াতো! চাইবারও দরকার ছিল না, নিজে থেকেই খাওয়াতো অনেকে।

ও সবে আরো নেশা ধরে গিয়েছিল, স্যারদের জন্যে। বাইরে থেকে টের পাওয়া যেত না, কিন্তু ওহরে বাবা, আমাদের দলাদলির মধ্যে ওরা ছিল সর্ষের মধ্যে ভূতের মতন। অথচ সামনাসামনি স্যারেরা এমন থাকতো, হেসে গলে, ‘এই যে কেমন আছেন ভাই যশোদাবাবু ‘—আর যশোদাবাবু অমনি, আর বলেন কেন বেণীবাবু, শরীরটা কিছুতেই…. এই রকম সব কথা বলতো, কিন্তু ভিতরে খোঁজ নিয়ে দেখ, একেবারে হিন্দুস্থান পাকিস্তান। দিনরাত্রিই হুঙ্কার দিয়ে আছে। লড়তাম তো আমরা। যশোদাবাবু আমাদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে কথা বলতেন, চা খাওয়াতেন, স্‌লা পরামর্শ দিতেন, চান্স পেলে কলেজেই দু-এক কথা ফিসফিসিয়ে বলে দিতেন। আর রেগে গিয়ে কখনো বলতেন, ‘ওদের মেরে ঠাণ্ডা করে দাও তো।’

আবার কী চাই। স্‌সাহ্‌ যশোদাবাবু বলেছেন। তা ছাড়া, লম্বরটা মারতে হইবে তো যশোদাবাবুর সাবজেকটে কোনদিন ফেল করিনি। আর কপালে থাকলে ফাইনালের সময়, যশোদাবাবুকে যে ক’দিন ইনভিজিলেন্সে পাওয়া যেত, সে ক’দিন মার কাটারি। ঝেড়ে যাও বাওয়া, এমন দিন কি হবে মা তারা! তেমনি আবার বুনো ওলের বাঘা তেঁতুল, যদি বেণীবাবু খচ্চরটা পড়ে যেত, সবাই তো যে-যার কোল সামলাচ্ছে। আমাদের যেমন যশোদাবাবু, অন্যদের তেমনি বেণীবাবু। এই দু’জন না খালি, দলাদলিতে অনেক স্যারেরাই ছিল। দল ছাড়া, স্যারদেরও উপায় নেই। সব স্যারেরাই দল করে। পিছনে স্যারেরা আছে, স্যারেরা খাতির করছে, ওটা অনেকটা খুঁটির জোরের মতন। লেগে যাও বাবা। আমার তো আবার একটু বেশী খাতির ছিল, কেননা, ঝাঁপিয়ে পড়লে, আমার আবার মিনমিনানি ভাল লাগে না। এসপার নয় ওসপার। সেইজন্যেই বন্ধুদের কাছে বল, আর স্যারদের কাছে বল, আমার খাতিরটা একটু ‘ইসপেশাল’।

পালটা গ্রুপের মধ্যেও দাঙ্গাবাজ ছোঁড়া ছিল। তার মধ্যে তো এখন একটা আমারই সাকরেদ হয়ে গেছে, শুটকা যার নাম। স্‌লার নাম দেখ দেখি, ডাকনাম আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ছেলেবেলাতে নাকি খুব শুটকো ছিল। আর এখনই বা কী হয়েছে, নধর গোপাল? না, ওকে গাল দেব না, আমার দলের লোক, আমাকে গুরু বলে ডাকে পালটা গুপ দু’বার আমার মাথা ফাটিয়েছিল, দু’বারই সেলাই দিতে হয়েছিল। কিন্তু ওদের সাতটার মাথা ফাটিয়েছি। ঝাঁপিয়ে পড়লে আমার পেছন টান ছিল না। অথচ আমি যে আগের থেকেই হাতা গুটিয়ে থাকতাম, তা না। কী যে স্‌সাহ্‌ আমার ভাল লাগতো, তা জানতাম নাকি। জানতাম, পড়তে হবে, পাশ করতেই হবে, তারপরে তুমি চুল ছাঁটো গিয়ে বা ঘাস কাটো গিয়ে। মাইরি, আমি সত্যি কিছু বুঝতেই পারতাম না, কেন পড়ছি, কেন পাশ করতেই হবে, আর আমি কী হব! তা-ই কলেজের রঙবাজী বেশ লাগতো। ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং, নানান কথা শুনতাম। বুঝতে পারতাম, ওসব আমার দ্বারা হবে না।

বড়দা কেন ব্যবসায়ী হয়েছিল, মেজদা কেন চাকরী করতে গিয়েছিল, তাও যেমন বুঝতাম না, নিজেরটাও তেমনি বুঝতাম না। বাড়িতে আসছি, খাচ্ছি-দচ্ছি—মা তো ছিলই না, বাবা তখনো রিটায়ার করেনি, বরং একটা নেশা মরে গিয়ে, মায়ের কথা বলছি, বাবা কেমন একটু নেতিয়ে পড়েছিল। তবে সেটা টের পাওয়া যেত না তখন, ঘুষ ত্যালানি সমানই চলছিল, কাজ নিয়ে আরো ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তখন অবিশ্যি আমাকে একটু কাছে টানবার চেষ্টা করেছিল। কাঁচকলা! আমার ওসব ভাল লাগলে তো। মা মরে যাবার পরে, তবু যা হোক, কিছুদিন ডাকলে কাছেপিঠে যেতাম। একটু বড় হয়েই ওসব আর ভালো লাগতো না। তুমি থাকো গিয়ে তোমাকে নিয়ে, আমি আছি আমাকে নিয়ে। কী দরকার বাবা জ্বালাতন করবার। বড়দাটা একটু অন্যরকম ছিল, বাবার সঙ্গে কেমন যেন ওর একটু পোট খেত। মেজদার আবার অত না। অথচ একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, বড়দা যে বাবার কাছে গিয়ে বসতো, কথা বলতো, যেন ও কতই হোমরা-চোমরা দিগগজ হয়ে উঠেছে, সত্যি বড়দাটা বরাবরই কীরকম, সাধু চোর হলে যেমন হয়, সেরকম মনে হত, কিন্তু বাবা ওকে সেরকম ঠিক আমল দিতে চাইতো না। ও ভারী ভারী গলায় পাকা কথা বলে যেত, আর বাবা, যেন শুনছেই না, ঠিক যেন বাবার কোন একটা ফ্যালসা সাবরডিনেট, স্যার স্যার করেই যাচ্ছে, আর বাবা নিজের মনে অন্যদিকে চেয়ে হুম হাম দিয়েই যাচ্ছে। যেন বাবা ভাবছে, ‘আরে সে তো অনেক শুনেছি, কিছু আমদানি-টামদানি ঘটছে? অনেক সময় যেমন শুনতে পেতাম, সেই যে ওভারসিয়ার না কী, বোস না ঘোষ, শেয়ালের মতন চেহারা, স্‌সাহ্‌ কথাও বলতো যেন হুঙ্কাহুয়া করে, স্যার ওরা বলছিল, ব্যবস্থার কিছু এদিক ওদিক হবে না, বরাবর যা হয়ে এসেছে, সে তো হবেই, কিছু না হয় বেশীই ব্যস, ফাদারের অমনি ভুরু টান হল, কোঁচকালো, তারপরে মুখ তোলা হল, ‘অ, তাই নাকি।’

ওসব রমজানি অনেক দেখেছি, কারণ বাড়িটা তো ছোটোখাটো একটা অফিসই ছিল। বাবা থাকলে লোকজন সব সময়েই থাকতো। তবে সেসব হত কোন কারণে অফিসে না যেতে পারলে বা শরীর খারাপ হলে। মা মরে যাবার পর অফিসের কাজকর্ম বাড়িতে আর বিশেষ হত না। তা-ই বলছি, বাড়িতে আসছি যাচ্ছি খাচ্ছি-দাচ্ছি, আবার বেরুচ্ছি। তখন দলের বন্ধুবান্ধব নিয়ে থাকা ছাড়া করবারই বা কী ছিল। বড়দা মেজদা বাড়িতে থাকলে, ওরা নিজেদের ঘরে নিজেদের বন্ধুদের নিয়ে থাকতো। নয়তো একলা একলা। কাছাকাছি হলে দু’জনে তর্ক আর ঝগড়া। দলের ঝগড়া, এ বলে ওকে দালাল, ও বলে একে দালাল। আমাকে আবার দু’জনেই দু’জনের দলে টানবার চেষ্টা করতো, করছে এখনো, করেও যাবে। বড়দা যে ব্যবসা করে, আর মেজদা যে চাকরি করে, যেন সেসব আসলে কিছুই না। রাজনীতিটাই ওদের আসল কাজ! কলেজেও তো ওদের দল ছিল। ওরা সেই কলেজেরই ছাত্র ছিল, আর কলেজ থেকেই ওরা প্রথম ঝগড়া করতে আরম্ভ করেছিল। আর এখন তো এই শহরে, ওরা দু’জনে দুই দলের নেতা। ওরা যখন কথা কাটাকাটি করে, আমি তখন ওদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলি, “নারদ নারদ, লেগে যা, লেগে যা।’

অমনি ওরা আমার ওপর চটে ওঠে, দু’জনেই চীৎকার করে গালাগাল দেয়। একজন বলে, ‘তুই তো একটা মূর্খ। আর একজন বলে, ‘একটা গুণ্ডা।’ ‘একটা লম্পট।’ ‘একটা মাতাল।’ আমি বলি, ‘আর তোরা কী?’ আসলে বয়স তো আমার থেকে কারুরই খুব বেশী না। বড়দা আমার থেকে সাড়ে তিন বছরের বড় ও বলে চার বছরের। মেজদা বছর দুয়েকের। তা, আমার কলেজে পড়ার সময়, বাড়িতে প্রায় কেউই থাকতো না। আমার বাড়িতে ঢুকতেই ইচ্ছা করতো না। যতক্ষণ বাড়িতে থাকতাম, লেখাপড়া-টড়া করার জন্যে, বা যে কোন কারণেই হোক, আমার যেন সবই কেমন আলাদা আলাদা ছাড়া ছাড়া লাগতো। কথা নেই, যাঃ স্‌সাহ্‌, অসময়ে ঘুমোতে আরম্ভ করে দিলাম, নয় তো, রান্না হতেই খাবারের জন্য চীৎকার চেঁচামেচি, না পেলে ঠাকুরের পেছনে লাগা, ঝিকে গালাগাল দেওয়া। কী যে করব ঠিক ভেবেই পেতাম না। অনেকদিন এমনও মনে হয়েছে, ঘরদোরগুলো সব অগোছালো করে তছনছ করে দিই, বাবার টেবিলটা এলোমেলো করে রাখি, নয় তো ঘরের মধ্যে প্রস্রাব করে দিই। এসব যে একেবারে করিনি, তা না। বাবার সেক্রেটারিয়েট টেবিলের তলায় একদিন দিয়েছিলাম ছরছরিয়ে। ওহ, সে কী দুর্গন্ধ মাইরি। বাবা তো নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। আর কী চীৎকার, বাড়িটা ফাটিয়ে ফেলে আর কী। কিন্তু সব ভ্যাবাচক ভ্যাবাগঙ্গারাম হয়ে গিয়েছিল। কারণ এসব তো ভাবাই যায় না, কেউ এমন কাজ করতে পারে। আমি নিজেই তো অনেকবার ভেবেছি, “আচ্ছা, এই কাণ্ডটা করলাম কী করে। অবিশ্যি বাড়ির সকলের অবস্থা দেখে, বাথরুমে গিয়ে খুব হেসেছিলাম, উহ্রে সাবাস, কী হাসি আমার। তবু বাবার টেবিলের তলায় কী করে ওরকম একটা বিদঘুটে কাণ্ড করা যায়, আজও তা বুঝতে পারি না। অথচ ভাবলে, এখনো খুব হাসি পায়।

কিন্তু ওরকম, কোন কিছুর ঠিক নেই, সিনেমা দেখছি, চা-সিগারেট খাচ্চি, আড্ডা মারছি, কলেজে যাচ্ছি, দলাদলি মারামারি করছি, মেয়েদের পেছনে লাগছি—কলেজটা কো-এডুকেশন তো। যেসব মেয়েরা আমাদের দলে ছিল, তাদের সঙ্গেও আড্ডা দিচ্ছি, দু তিনটে স্পট ছিল, যেখানে গিয়ে একটু দিলালি করছি—প্রেম ঠিক বলা যাবে না, তখন আবার ওসব তেমন মনের মধ্যে জমে ওঠেনি। ওই আর কি, একটু সুহাগ যাকে বলে। তবে তার মধ্যে কয়েকজন ছিল, তারা রীতিমত হাত্তা চালাতো। দুটো জায়গা ছিল, সামনে চা আর খাবারের দোকান, ভিতরে অন্য ব্যবস্থা। ওখানে আবার দল বেঁধে নয়। পেয়ার পেয়ার। দোকানদারকে তার জন্যে কিছু মালকড়ি দিতে হত, ঘণ্টা কাবারি হিসাব। সেসব সকলের জানাজানি ছিল না। জানাজানি ছিল কেবল নিজেদের গুপের মধ্যে। সেসব জায়গা ছিল প্রেম করবার। তা ছাড়া দু’জনে দু’জনে সিনেমা দেখতে যাওয়া ছিল। সেটা একটু অসুবিধার ব্যাপার ছিল, শহরের মেলাই লোক, আর অনেকেই জানাশোনা। একবার তো, আমাদের গুপের একটা ছেলে আর মেয়ে সিনেমা হলে ধরাই পড়ে গেল। দু’জনে খুব মুচু মুচু চালিয়েছিল, আর দুটোকেই ধরে একেবারে প্রিন্সিপালের সামনে। স্‌সাহ্‌ রগড় কাকে বলে। ওরকম ব্যাপার ভাবতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে, এত ব্যাপার ঘটেছে। আর সিনেমায় না গেলে, গ্রামের দিকে মাঠে ময়দানে।

আমারও যে ওরকম দু’ একটা জুটি জোটেনি, তা না। এখন ভাবলে তো আমার খুব অবাক লাগে, একটু-আধটু চুমো-টুমো খাওয়া ছাড়া কিছু করিনি। আসলে তখন আমার ঠিক সেরকম কিছু ইচ্ছা হত না। বোধ হয় যৌবনের ফুল ফোটেনি। সসত্যি? বল, ফোড় ওঠেনি। কিন্তু যা-ই হোক, মোটের ওপর তখন এরকম মাংস-খেকো বাঘ হইনি, এই কয়েক বছরের মধ্যেই যেরকম হয়ে উঠেছি। একবার খালি, অমিতা বলে একটা মেয়ে, স্‌সাহ্‌ আমন লিকলিকে কালকুটি মেয়েটার নাম কোন বেয়াদপ যে অমিতা রেখেছিল, জানি না। যেমন তার খটং খটং চলা, তেমনি তার চিমসে পিছনের নাচানি। আমি নিজের কানে শুনেছি, শহরের রিকসাওয়ালাগুলো পর্যন্ত ধর ধর করে উঠতো। তার সঙ্গে একবার আমাকে দোকানের পিছনের ঘরে যেতে হয়েছিল। আহ্ একেবারে লিজ-এর মতন আমার মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। সুখেন ছাড়া সে কিছু জানে না, সুখেন ছাড়া বাঁচবে না। গৌর বিনা প্রাণ বাঁচে না, কী যন্ত্রণা….সেইরকম আর কী। ওর ওটা কী ভাই, বুক না তক্তা। অন্য জায়গার কথা আর নাই বা বললাম।

যাক্‌গে, তা-ই বলছি, এইসব করছি, বাড়ি আসছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি, তার মধ্যে দেড়শো টাকার মাস্টার মশাই ঠিক ছিল, ফাদারের সেদিকে নজর ছিল ঠিক, টাকা যতই লাগুক, খরচ করে ছেলেকে মানুষ করতেই হবে। একজন না, আবার দু’জন মাস্টার। কোথা থেকে টাকা আসছে, সে খোঁজে যেও না। মাস্টাররা ভাবছিল, চলুক চলুক, এমন দুধেল গাইয়ের মত ছেলে না থাকলে, চলে কেমন করে। বুঝতে পারছ তো? ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? জবাব একেবারে রেকর্ড করা, “হ্যাঁ স্যার। ওদিকেও জবাব রেডি করা, ‘ভেরি গুড? একেই বোধ হয় সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি বলে। আর ভাবতাম, বাবার টাকা আছে, আশা আছে, ছেলে ন্যাকাপড়া শিখবে, চালিয়ে যাও পানসি। এইসব মিলিয়ে আমার এক এক সময় কী রকম মনে হত, আমি যেন সেনস্-এ নেই। কীরকম একটা আলগা আলগা ভাব, গা ছাড়া, যেন হাওয়ার ওপরে চলছি। সত্যি, আমার সেরকমই মনে হত, কী করছি, কী করছি না, কিছুরই যেন ঠিক পাওয়া যাচ্ছে না। সেরকম অবস্থায় বাবার টেবিলের তলা যে নোঙর করে দেব, এ আর আশ্চর্য কী। আমার তো আরো অনেক কিছুই মনে হত। মনে হত, গোটা বাড়িটা চারিদিকে নোঙরা করে দিই। বাবার টেবিলের কাগজপত্রে এমনভাবে আগুন লাগিয়ে দিই, যাতে কিছুতেই ধরতে না পারে, কী করে ওরকম কাণ্ড ঘটলো। না হয় মেজদার ঘরের বই-পত্র, বড়দার ঘরের দামী দামী জিনিসগুলো সব নষ্ট করে দিই। আমার তখন নিজেকে অনেকটা ভূতে পাওয়ার মতন মনে হত। সব সময়ে না, এক এক সময়। ওদের ওপর আমার কেমন একটা ঘেন্না ছিল, যেন ওরা যে যার নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত, দেশটা মাথায় করে চলেছে। হয় পড়ার কথা জিজ্ঞেস করবে, না হয় দু’জনে দু’জনের দলে টানবার চেষ্টা করবে। বড়দা চাইতো, কলেজে ওদের দলের ছাত্র গুপের সঙ্গে যেন আমি থাকি। মেজদাও তাই চাইতো। আমার অবিশ্যি কোন দলের ওপরেই কোন টান ছিল না। যেখানে আমার পোট খাবে, মাস্তানি চলবে, আমি সেই দলেই যাব।

আমাদের কলেজে একটা সুবিধা ছিল। বড়দা মেজদাদের দল শহরের বেশ জোরদার হলেও কলেজে অন্য একটা দলের বেশ দখল ছিল। যশোদাবাবু আবার সেই দলের নেতা ছিলেন। কলেজে না, বাইরে। শুনেছি, সেই দলের তিনি বেশ হোমরাচোমরা, বাইরে সভা হলে বক্তৃতা করতেও দেখেছি। তবে যশোদাবাবুটিকে আমার কেমন একটু বেঁটে-সেটে মোটা মেটেরঙ দুমুখে ঢামনা সাপের মতন মনে হত। বয়স কত, পঞ্চাশ না ষাট, বুঝতে পারা যায় না। দাঁতগুলো সব নকল ঝকঝকে শাদা! কালো মুখটা ছিল আবার পাউরুটির মত ফুলো ফুলো। দেখলেই মনে হত, লোকটার রোগের শেষ নেই, আমাশা ডায়াবেটিস, তার ওপরে সব থেকে বেশী ছিল রগচটা গোছের। কিন্তু সেসব আমাদের সঙ্গে, যেন সব সময়ে একটা খেচোরাম ভাব। আমার মনে হত, ওসব লোকটার চালাকি, আমাদের কাছে খুব বড় কিছু একটা সাজবার চেষ্টা। সেই সেই যে বলে না—ধুত্তেরি, কথাটা যে কী—হ্যাঁ, যেন একটা জীনিয়স। আঙুল তুলে তুলে, ধবধবে শাদা কৃমি কৃমি রঙ চোখ পাকিয়ে গলার শির ফুলিয়ে খালি লেকচার মারতো। কিন্তু এমনভাবে আমাদের বুদ্ধি দিত, যেন আমরা কলেজে দুটো দলকেই এলিমিনেট করে দিতে পারি। তিসরি দল যাকে বলে, আমি ছিলাম সেই দলের, আর কলেজের দলাদলিতে, আমাদের দলটাই ছিল ভারী। আমি হয়তো অন্য দলেও যেতে পারতাম, দু একবার যে বদলাবদলিও করিনি তা নয়, তবে বড়দা মেজদার দলে আমার কিছুতেই যেতে ইচ্ছা করতো না।

আমি ওসব দল-টল জানি না, ওদের দু’জনের চরিত্তির তো আমার জামা ছিল। তা ছাড়া, সত্যি বলতে কি, ওরা আমার ওপর খবরদারি করবে, নেতাগিরি ফলাবে, এ আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারতাম না। দিনরাত্রি লঙ্কা ভাগাভাগি, আর স্‌সাহ্‌, গায়ে ল্যাংটা—মানে ওরা আসলে মানুষ যে রকম, চিনি তো, অথচ যেন কী একেবারে হ্যাট-কোট গায়ে দিয়ে চলেছে, সেরকম একটা ভাব, আমার দুচক্ষের বিষ। আমি বুঝতেই পারি না, কেন ওরা দল করে, আর ওসব বলে। দল যাই হোক, তোরা নিজেরা কী, তাই দ্যখি। কিন্তু কে বলবে, ল্যাংটা হয়েও যে বলবে আমি বেশ পোশাক-আশাক পরে সভ্য ভব্য আছি, তাদের কিছু বলবার নেই। ওদের আমার সেইরকম মনে হয়।

যশোদাবাবুটিও তাই। তবে তিনি তো আমার দাদা নন, তাই মাস্তানি করতে হল, সে দলে থাকাই আমার ভাল। কিন্তু ও লোকটারও একটা ব্যাপার আশ্চর্য, একেবারে গালাগাল দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, খচ্চরটার নটা ছেলেমেয়ে, মাইরি। স্‌সাহ্‌, রাগের চোটেই করেছে, নাকি সেই প্যানতাখ্যাচা বউটাকে লেকচার দিতে দিতেই এই কাণ্ড করেছে, কে জানে। ন’টা ছেলেমেয়ে! সেই পাউরুটি মাক ফুলো ফুলো মুখে, বাঁধানো দাঁতে, কৃমির মতন শাদা রক্তশূন্য চোখে দলাদলির প্যাঁচ-পয়জার কষে, আর কী করে সম্ভব! এখন তো বুঝতে পারি, মাস্তানি যে আমি ভালই পারি, তাই জেনে আমাকে সবসময় তোয়াজ করতো। বড়দা, মেজদার রোয়াবির থেকে, যশোদাবাবুর ত্যালানিই আমার ভাল লাগতো। সেজন্যেই বাড়িতে দাদাদের সঙ্গে আমার কোনরকম মিল ছিল না। আমাদের কারুর সঙ্গেই কারুর মিল ছিল না, আমরা সব টুকরো টুকরো, ছেঁড়া ছেঁড়া, অথচ আমরা এক মায়ের পেটেই জন্মেছিলাম। ওই পেটে জন্মানো পর্যন্তই, কেউ কারু না। বাবাও তাই ছিল। বাবা একটা লোক, বড়দা একটা লোক, মেজদা একটা লোক, আমি একটা লোক। সব যে-যার আলাদা, যে-যার নিজেকে নিজেকে নিয়ে আছে। স্‌সাহ্‌, আমার এইটা বয়ে গেছে, ঠিক এরকম আমার মনে হত। সুখেন তোদের মুখে ইয়ে করে দেয়, এরকম মনে হত। কেউ ঘুষ ত্যালানিতে মজে আছে, কেউ দল আর রাজনীতি করছে, আর আমি যা ইচ্ছা তাই করছি। তারপরেও যে আমি সকলের ঘর নোঙরা করিনি, জিনিসপত্র নষ্ট করিনি, সেটাই তো যথেষ্ট।

এক একদিন, আমার মাইরি, কী রকম ভয় করতো। এখন ভাবলে খুব হাসি পায়। হয়তো দুপুরবেলা একলা ঘরে বসে আছি, হঠাৎ আমার গায়ের মধ্যে কীরকম করে উঠতো। বুকের ভিতরটা গুরগুর করে উঠতো, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতো। যেখানে বসে থাকতাম, সেখান থেকে উঠতে পারতাম না। মনে হত, উঠলেই কেউ আমাকে ঘাড় মুচড়ে দেবে, চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। কেন এরকম মনে হত, আমি জানি না। হাতে পায়ে কোন জোর থাকতো না, আর বুকের কাছে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে উঠতো, চোখ থেকে যেন জল এসে পড়তো, অনেকটা কান্নার মতন। অথচ আমি সবই দেখতে পেতাম, শুনতে পেতাম, বাড়ির বাইরে লোকজন চলাচ. করছে, পিছনের একটা আমবাগানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করছে, মেজদা হয়তো একটা ঘরে আমাদের ঝিয়ের ষোল-সতর বছরের মেয়েটাকে সেইসব করছে—আমি কয়েকদিন দেখেছিলাম কিনা, ফ্রক পরা ধুমসো বেঁটে ভোঁদকা, জন্তুর মতন চোখ, আর পায়ে মেলাই কালো কালো লোম মেয়েটাকে মেজদা গায়ের এখানে ওখানে খামচে খামচে আদর করছে, আর মেয়েটা তাড়কা রাস্ফুসীর মত হাসছে, অথচ লজ্জা লজ্জা ভাব। ওদিকে ঝি চাকর ঠাকুরদের কথাবাত কাজকর্ম, সবই দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি, বুঝতে পারছি। অথচ আমার হঠাৎ কেমন একটা ভয় করে উঠতো, আর গায়ের মধ্যে থরথর করতো, মনে হত, সেই একটা লোককে দেখেছি, যে মুচ্ছে না মিরগি রুগী বলে হঠাৎ পড়ে গিয়ে, অজ্ঞান হয়ে যায়, মাটি খামচে ধরে, মুখ দিয়ে গাঁজলা উঠতে থাকে, আমার যেন সেইরকম হবে।

তখনই আমি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াতাম। জোরে হাত পা ছুড়ে ঘরের মধ্যে দৌড়ে লাফিয়ে এমন জোর চীৎকার করে উঠতাম, গোটা বাড়িটা হকচকিয়ে উঠতো। ছুটে ঘরের বাইরে গিয়ে, একেবারে আমাদের বাগানের মধ্যে চলে যেতাম। তখনো যদি মনে হত, ভিতরে সেই ভয়ের ভাবটা আছে, তা হলে এদিকে ওদিকে ইট ছুড়ে, গাছপালা মুচড়ে, একটা যা-তা কাণ্ড করতাম। ততক্ষণে ঠাকুর চাকর ঝি, সবাই ছুটে আসতো। কেউ বারান্দায় দাঁড়াতো, কেউ বাগানের কাছে। চেঁচিয়ে বলতো, কী হচ্ছে কি, অ্যাঁ? ছোট খোকা, তুমি চন্দরমল্লিকের গাছটা ছিঁড়ে ফেলবে, বাবু কী রকম রাগ করবেন জান?’

আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়তাম। পিটপিট করে সকলের দিকে তাকাতাম। আমার ভিতরের ব্যাপারটা ততক্ষণে কেটে গেছে। কিন্তু ওদের কাউকে সে কথা বলতে পারতাম না। ওদের বলব কী, আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারতাম না, সত্যি সেরকম কিছু হয়েছে, তাই খুব জোরে হো হো করে হেসে উঠতাম। আর ওরা সব নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচায়ি করতো। বুঝতে পারতাম, চোখে চোখে চেয়ে, ওরা নিজেদের মধ্যে মনে মনে বলাবলি করছে, ‘দেখছো, কী রকম বদ ছেলে। কথা নেই, বাত নেই, কী রকম বদমাইশি জুড়েছে। আমি কিন্তু খুব জোরে হাসতেই থাকতাম, চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওদের দিকে চেয়ে কাঁচকলা দেখাতাম। ঝি হয়তো বলতো, ‘ছি ছি ছোট খোকা, কী করলে বল তো?’

আমি ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলতাম, ‘বেশ করেছি! আরো করব।’

সে কথা শুনে ওরা যেন অবাক হয়ে যেত। ঝি বলতো, ‘তুমি এত বড় হয়েছ, তোমার কি এসব ভাল দেখায়। বাবু কী বলবেন বল তো’

আবার কাঁচকলা দেখাতাম, বাবু আমার এই করবে! কিন্তু তখন আমি কিছুতেই ঘরের দিকে যেতাম না। পুরনো চাকর শুলা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। ওকে আমি আমার জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি। ও প্রায় বাবার সমবয়সী, আমরা শুলাদা বলে ডাকি। এই রকম নামের মানে কী, তা জানি না বাবা। শুটকার তবু একটা মানে বুঝি, কিন্তু শুলা যে কারুর নাম হতে পারে, এ আমার মাথায় কিছুতেই আসে না। যতদিন জিজ্ঞেস করেছি, “আচ্ছা শুলাদা, তোমার নাম শুলা কেন, কোনদিনই সে ঠিক জবাব দিতে পারেনি। খালি বলে, ‘নামে কি এসে যায় গো। ওইসব ওগো হাঁগো নাগো খুব বলে সে। আমি বলতাম, ‘নামে যদি কিছু না আসে যায়, তবে তোমার নামের আগে একটা আর বসিয়ে দাও শুলাদা। শুলাদার সেদিকে খুব বুদ্ধি, বলতো, আরশুলা বলছ? তাও হতে পারে। লোকের নাম মাছি হয়, তাও শুনেছি গো। কেন, ব্যাঙ নাম শোন নাই, পাশের বাড়ির চাকরটার নাম তো ব্যাঙ? তখন আমার আবার অবাক লাগতো, সত্যি এরকম অদ্ভুত নাম মানুষের হয় কী করে। জিজ্ঞেস করতাম, ‘আচ্ছা এরকম নাম কেন রাখে?’

শুলাদা বলতো, ‘কেন আবার, ছেলেপিলে বেশী হলে, তখন বিরক্ত হয়ে লোকে ওরকম নাম রাখে। মাছি যেমন ঝাঁক বেঁধে জন্মায়, ব্যাঙ যেমন গাদা গাদা জন্মায়, সেইরকম। ভাবে, ওরকম একটা নাম রাখলে, আর ছেলেপিলে জন্মাবে না। আবার দেখতে খুব ছোটখাটোটি হলেও মাছি নাম রাখতে পারে, ব্যাঙ ব্যাঙ দেখতে হলেও ব্যাঙ নাম রাখতে পারে।’

এই রকম সব জবাব দিত। পরে আমি যখন বড় হলাম, তখন শুলাদাকে বলতাম, ‘তোমার নামের শু-এর উ-কারটা কেটে দিয়ে একটা আ-কার করে দিলে বেশ হয়। শুলাদা একটু-আধটু লেখাপড়াও জানতো। প্রথম দ্বিতীয় ভাগ পড়া ছিল, তাই মনে মনে একটু ভেবে, হেসে বলতো, ‘শালা বলছ? তারপরে আবার হাসতো, হি হি করে হেসে বলতো, ‘লেখাপড়া শিখে খুব পাজী হয়েছ। তা বলে আমি কোনদিন শুলাদাকে শালা বলে ডাকিনি, ফাজলামি করার জন্যেই বলতাম। ওর মোটা কালো গলায় কণ্ঠী আছে, তুলসী না কাঠের মালা বলে, সেই জিনিস, আর ওর চোখগুলো ঠিক গরুর মতন। গরুর মতন বড় বড়, চাউনিটাও যেন সেইরকম। অথচ গরুর চাউনি দেখলে যেমন গায়ে লাগে না, ও তো দুটো গরুর চোখ, কিছুই বুঝতে পারছে না, শুলাদার ঠিক সেরকম না। সে আমার দিকে চেয়ে থাকলেই মনে হত, সে যেন আমার ব্যাপারটা ধরে ফেলবে। তাই আমি তার দিকে বেশী তাকাতাম না। তা ছাড়া ছেলেবেলা থেকে ও আমাকে এত বেশী কোলে পিঠে করেছে, মনে হয়, আমার নাড়িনক্ষত্র জানে। আমার দিকে চেয়ে থেকে সে বলতো, ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি গো ছোট খোকা, অ্যাঁ, বল তো। আমি বলতাম ‘তোমার মুণ্ডু হয়েছে।’ তারপরে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথাও চলে যেতাম! আমি জানি, ওরা ভাবতো, আমি ভীষণ পাজী নচ্ছার আর একগুয়ে হয়ে উঠেছি। সবাইকে খালি জ্বালাতন করতে চাই। তেএঁটে বদমাইস হলে যা হয়, সেরকম আর কী। অথচ ব্যাপারটা কাউকে বলতে পারতাম না, বোঝাতেও পারতাম না, আর আমি এমনিতেও ছটফটে দুরন্ত ধরনের ছিলাম তো, একটু হাত পা ছোঁড়া মেজাজী, ঠিক কিছুই যেন মনের মতন হত না, সকলের ওপরেই কী রকম একটা রাগ রাগ ভাব। তাই সবাই ভাবতো, আমি খালি বদমাইসি করছি।

কিন্তু মেজদা বা বড়দা—বড়দা তো তখন বেশ তুখোড় খচ্চর হয়েছে। মেজদাটা ভিন্ন জাতের, হ্যাংলা কুকুরের মতন, যা পায় তাই খায়। না হলে ঝিয়ের সেই মেয়েটাকে কেউ খামচে আদর করে! বড়দার আবার অন্যরকম, তখন ও মাঝে মধ্যে ধুতি পাঞ্জাবী পরে, আর চেহারাটা তো খানিকটা মেয়েমানুষ মার্কা, আর মেয়ে বন্ধু ওর বিস্তর। কী জানি মেয়েলি ধরনের চেহারা ফরসা সুন্দর,নরমনরম মিষ্টি হাসি, ছাল ছাড়ানো আলুসেদ্ধ মতন পুরুষ দেখলে মেয়েদের এত খাই-খাই ভাব হয় কেন। ওকে দেখলেই মেয়েরা কাত। আমার তো ধারণা, বড়দার মতন ছেলেকে নিয়ে মাখামাখি করবে কাবুলের মতন পুরুষেরা। জানি না, ছেলেবেলায় সেরকম কোন পুরুষের পাল্লায় কোনদিন পড়েছে কিনা—পড়েনি কী আর! শহরে ওরকম অনেক ছেলেকেই আমি জানি। আমার তো ভাবলে কেমন গা ঘিনঘিন করে, কিসের সঙ্গে কী। তা বড়দাকে দেখেছি, শুধু মেয়েরা না, অনেক বউ, যুবতী বিবাহিতারাও ওর কাছে আসে, আড্ডা দেয়। এত মেয়ের ধকল ও সামলায় কী করে, কে জানে। এদিকে তো ছোটখাটো নরম নরম মানুষটি দেখলে মনে হয়, ভাজার মাছটি উলটে খেতে জানে না। জানে না আবার! আমি নিজের চোখে দেখেছি নন্দ ডাক্তারের মেয়ে কৃষ্ণাকে ওর ঘরের মধ্যে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে চুমো খাচ্ছে। কেন, শুধু তাই কেন, কলেজের লেকচারার রামকেষ্টবাবুর নতুন বিয়ে করা বউকে—বেশ সুন্দর বউটা, লেখাপড়াও ভালই শিখেছে, তার ওপরে জ্বলজ্বলে সিঁদুরের দাগ, সিঁথেয় আর কপালে, তাকে নিয়ে বেলেল্লাপনার আর বাকি রেখেছে কি! বড়দার সবই বড় বড়, ওসব বাজে মেয়েটেয়ের ব্যাপারে নেই। শহরের বেশ ভাল ভাল ঘরের মেয়েদের সঙ্গেই ওর আশনাই, সেখানেই ওর যাতায়াত। সে সবই ওর রাজনীতির দলের ব্যাপার, সবাই ওদের দলে আছে।

তবু যে কেন বড়দা বল, মেজদা বল, শিখার পেছন ওরা ছাড়ছে না, বুঝতে পারি না। যাই হোক, বড়দা বা মেজদা, যে-ই বাড়িতে থাকুক, আর তখন যদি সেই ভুতুড়ে ধরনের ভয়ে আমি ওরকম করে উঠতাম, তা হলে ওরা কী মনে করত, তাও আমি জানি। ওরা ভাবতো, খচ্চরটা আমাদের পেছনে লাগবার জন্যেই এরকম করেছে। সেটা বুঝতে পারতাম, পরে ওদের ব্যবহারে। পারে তো আমাকে ছিঁড়েই ফেলে বড়দা অবিশ্যি কথা বলতো না, ভাবটা করতো যেন কিছুই হয়নি, যে ভাব দেখলেই মনে হত, ও যেন ঠিক মায়ের মতন করছে, মা যেমন বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে সেরকম চাল চালতো বা মাকে দেখে যাদের নালানি-ঝোলানি গড়াতো, সেই শুয়োরের বাচ্চাগুলোর সামনে মা যেমন ‘গায়ে লাগছে না’ ভাব করে থাকতো, এইরকম আর কী। তবে বড়দা কথা বলতো না। ঘুঘু, যেন আমাকে দেখতেই পাচ্ছে না, এমনি ভাব। তার মানেই হল, ‘শয়তান, পেছনে লাগবার জন্যেই ওরকম করছিলি তা জানি। মেজদার ব্যাপার আলাদা। মেজদা রেগে তাকাতো। যেন দাঁতে দাঁত পিষতো, আর তাই দেখে আমার হাসি পেত, আমি মিটিমিটি হাসতাম! হাসতে দেখলেই ও একেবারে খ্যাঁক করে উঠতো, মারব মুখে লাথি, হাসছিস কেন?’

আমারও ভিতরে ভিতরে রাগ হত, বলতাম, ‘তুই রেগে রেগে তাকাচ্ছিস কেন?’

‘তুই তখন ওরকম চেঁচিয়ে ছুটে বাড়ি মাথায় করলি কেন?’

‘আমার ইচ্ছা?’

ও অমনি ঘুষি পাকিয়ে উঠতো, ‘তোর দাঁত ভেঙে ফেলবো, লোফার কোথাকার। রাসকেল|’

ইচ্ছা করতো, আসল কথাটা বলে ফেলি। কিন্তু চোখে না দেখতে পেলে তো হবে না, প্রমাণ দিতে পারব না। অথচ গালাগাল শুনে সহ্য করতে পারতাম না। অনেক ছেলেবেলায় ওকে ভয়টয় পেতাম। বডড মারতো। কিন্তু ক্লাস নাইন টেন-এ উঠে অতটা আর ভয় পেতাম না। আর ওসব ঘটনাগুলো তখনই ঘটতো বেশী। আমিও মুখে মুখে বলে উঠতাম, ‘ভাঙ তো দাঁত, তোরও চোখ গেলে দেব। তুই তো একটা লোচ্চা। বেশী বলবি তো সবাইকে চেঁচিয়ে যা-তা বলে দেব।’

বুঝতে পারতাম, গায়ে হাত তোলবার সাহস তখন আর ওর হত না। তবে একেবারেই যে মারামারি করিনি, তা না, আগে আগে হেরেই যেতাম। ওর সঙ্গে আমার শেষবার হাতাহাতি মারামারি হয়, কলেজের ব্যাপারে। ওদের দলের একটা ছেলেকে আমি মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। মেজদা বাড়ি এসে আমাকে খুব তড়পেছিল, বলেছিল, রাস্তায় বেরুলে ওরা আমার মাথা ফাটিয়ে ছাড়বে। আমি তখনই ওর সঙ্গে রাস্তায় যেতে চেয়েছিলাম। আমারও রাগ চড়ে গিয়েছিল। ও আমাকে যা-তা গালাগাল দিয়েছিল, তারপরে তর্ক করতে করতে দুম করে এক ঘুষি বসিয়ে দিয়েছিল আমার থুতনির কাছে। মারতেই আমি ওর ওপরে এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, এখন বুঝতে পারি, আমি যে এতটা ক্ষেপে যেতে পারি ও ভাবতেই পারেনি। একটার বদলে আমি অন্ততঃ গোটা আটেক ঝেড়েছিলাম ওকে। তাতে ওর চোখ ফুলে গিয়েছিল, ঠোঁটের কষে রক্ত বেরিয়ে পড়েছিল, ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে একটা টেবিল উলটে পড়ে গিয়েছিল মেঝেতে। খেয়ালই ছিল না, বাবা বাড়িতে আছে। তখন বাবার রিটায়ার করবার আর মাসখানেক বাকী, তাও চার বছর একসটেনসনের পরে।

হয়তো লড়াইটা আরো হত, বাবা এসে চীৎকার করে দাঁড়াতেই আমরা দুজনে দু দিকে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। দুজনেই হাঁপাচ্ছিলাম, আর মেজদার চোখের কাছে ভুরু ফুলে উঠেছিল, ঠোঁটের কষে রক্ত দেখা যাচ্ছিল, চোখ জ্বলছিল ধ্বকধবক করে। একবার আমার দিকে, আর একবার বাবার দিকে দেখছিল। আমি শুধু বাবাকেই দেখছিলাম, আর এক-আধবার মেজদাকে। বাবা চীৎকার করছিল, ‘কী, হচ্ছে কি বাড়ির মধ্যে, অ্যাঁ? এসব কী ব্যাপার। তোরা মারামারি করছিস, এটা কি ভদ্রলোকের বাড়ি না?’

আমারও নিশ্চয় চোখ জ্বলছিল, আর মনে মনে বলছিলাম, ‘আহ্‌, ভদ্দর লোকের বাড়ি!’ মেজদা বলে উঠেছিল, ‘আপনি জিজ্ঞেস করুন ওকে, কলেজে কী করে এসেছে। একটা ছেলেকে মাথা ফাটিয়ে এসেছে। আমি সে কথা বলেছি বলে, আমাকেও মারছে।’

মেজদার দিকে চেয়ে, ওর অবস্থা দেখে বাবা আমার ওপর ক্ষেপে উঠেছিল ৷ বলেছিল, ‘ইয়েস, আমি শুনেছি, এটা একটা গুণ্ডা হয়ে উঠছে, তোকে ও মেরেছে নাকি এভাবে?

মেজদা তখন অনেকটা কাঁদো কাঁদো, কষের রক্ত মুছতে মুছতে বলেছিল, ‘হ্যাঁ।

বাবা তৎক্ষণাৎ চীৎকার করে উঠেছিল, ‘দাদাকে এভাবে মারা? বেরোও, বেরিয়ে যাও তুমি বাড়ি থেকে। এ বাড়িতে থেকে ওসব গুণ্ডামি চলবে না। এত বড় সাহস, বাড়ির মধ্যে মারামারি!’

আমি বলেছিলাম, ‘ওকে তো আমি আগে কিছুই বলিনি। ও-ই তো আমাকে আগে মেরেছে।

‘আমি কোন কথা শুনতে চাই না, তুমি চলে যাও আমার চোখের সামনে থেকে। ‘

মস্ত বড় অফিসারটি গর্জন করে উঠেছিল, ‘তারপরে দেখছি আমি, তোকে কী করে শায়েস্তা করা যায় ওসব আমি কিছু সহ্য করব না! বাড়িটাকে এরা একেবারে নরক করে তুলেছে। আমি প্রত্যেককে দেখব, আর প্রত্যেককে শাস্তি দেব!’

অথচ আমি ভেবেছিলাম বাবা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। অনেকবার আমার দিকে তাকিয়ে চীৎকার করেও এগিয়ে এসে গায়ে হাত দেয়নি। তাতে আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। বাবা মারবে বলে আমি তো গা হাত পা শক্ত করে দাঁড়িয়েছিলাম। তবে তা দাঁড়ালেও আমার রাগ কমেনি। ভিতরটা আমার জ্বলছিল, ফুসছিল। বাবা গায়ে হাত দিলে অবিশ্যি আমি কিছু বলতাম না, কিন্তু আমার ইচ্ছে করছিল, মেরে ধরে ছিঁড়ে কুটে একটা তুলকালাম কাণ্ড লাগিয়ে দিই!

সেই সময়ে বড়দা এসে দাঁড়িয়েছিল, আর ও খুব ভালো মানুষের মত, বেশ ভারিক্কি চালে বলেছিল, ‘এভাবে মারামারি করার কোন মানে হয়। ইস, নিকুর তো ঠোঁট কেটে রক্ত বেরুচ্ছে দেখছি।’

আমাদের তিনজনের তিনটি ডাকনামও ছিল। পিকু নিকু টুকু ৷ জানি না, সেসব নামের উদয় হয়েছিল কেমন করে, কারণ শুলাদাকে কোনদিন জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে ওই শুলাদার কথাই ঠিক, নামে কী আসে যায়। বড়দার কথা শুনে, মেজদা আর একবার ঠোঁট মুছেছিল। কিন্তু ফিরে তাকায়নি। বাবাও যেন ফিরে যাবে বলে শরীরটাকে দোলাচ্ছিল, আসলে উত্তেজনায় সেরকম করছিল, আর বলেছিল, ‘আমি আমার বাড়িতে এসব কিছুই সহ্য করব না। যার যা খুশি তা-ই করবে, আর এসব ছোটোলোকোমি, কিছুতেই টলারেট করব না। ইউ অল মাস্ট মেনটেইন দ্য ডিসিপ্লিন!’

বড়দা আবার সেই ভাবেই বলেছিল, ‘কিন্তু বাইরের ব্যাপার এভাবে বাড়িতে টেনে আনা উচিত না। কলেজে যা ঘটেছে, ঘটেছে, সে সব নিয়ে বাড়িতে কথা বলার দরকার কী?’

তৎক্ষণাৎ মেজদা বলে উঠেছিল, ‘হ্যাঁ, তুই তো সেকথা বলবিই। এখন তোদের দলের ছাত্ররা তো ওদের সঙ্গে কলেজে আমাদের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়েছে। আমাদের কোণঠাসা করবার মতলব। তা-ই বড় গায়ে লেগেছে, কলেজের ব্যাপার বাড়িতে এসেছে বলে, খুব ইয়ে দেখাচ্ছিস্‌।’

বড়দা বলেছিল, ‘তা কেন—।’

বাবা চীৎকার করে উঠেছিল, ‘শটি আপ্‌, চুপ কর সব। আমি কারুর কোন কথা শুনতে চাই না। ঘরে বাইরে বলে কিছু জানি না আমি। এ সবের মধ্যে কারুরই থাকা চলবে না, আই ডোন্ট লাইক অল দিজ ব্লাডি ফুলিসনেস্‌।’

কথাবার্তা সেই ঠিক অফিসের বড়কতার মতই, কিন্তু ফাদারকে সেই সময় আমার একটু অন্যরকম লেগেছিল, যে রকমটা ঠিক আগে আর দেখিনি। আগে ছিল, রাগ তো রাগই, তার মধ্যে আর কিছু নেই, বাঘটা গর্জন করছে আর ফুসছে! কিন্তু সেই ঝগড়ার দিনে একটু অন্যরকম, যেন রাগ তর্জন-গর্জন সবই ছিল, অথচ বাঘটা যেন দূরে কিসের শব্দ শুনছিল। এক এক সময় হয়-না, হাঁক-ডাক চলছে একদিকে, অথচ মন পড়ে আছে অন্যদিকে। কী বলে তাকে যে, ওই সেই, মানে আনমাইল্ডফুল। না কি, গজরাচ্ছে, অথচ গায়ের কোথায়, গলায় না পায়ে, কোথায় একটা কাঁটা ফুটে আছে, আর সেটা বারে বারেই খচ্‌খচ্‌ করছে, কে জানে স্‌সাহ্‌, কী ভাব বলে ওকে। মোটের ওপরে, ফাদারের রাগ ছাড়াও একটা অন্যরকম ভাব ছিল, যেন বড় অশান্তি লাগছিল। সেই পর্যন্ত বলেই চলে গিয়েছিল। আমিও তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।

তবে, মেজদা বড়দাকে যা বলেছিল, সে কথাগুলো কিন্তু ঠিকই বলেছিল। ওদের দলটা তখন এমন একটা ভাব দেখাচ্ছিল, অনেকটা নিমরাজী ছুঁড়ির মতন। মুখে কিছু বলছি না, তবে যদি কিছু করতে চাও, চালিয়ে যেতে পার। মেজদাদের দলটার সঙ্গে যখন আমাদের বেশ গরমাগরমি ভাব, ওরা যেন ভর-হওয়া ঠাকুরের মতন হয়ে গিয়েছিল। কী জানি বাবা, তোমাদের যা করবার কর, আমরা ওসবের মধ্যে নেই। এর নাম ছেনলি। তার মানেই, বলতে চাইছিল, ‘ওদের মেরে স্‌লা উড়কু উঠিয়ে দাও। আমরা নাক গলাবো না। এর নাম ওদের রাজনীতি আর দলাদলি। খচ্চর! তা না হলে, বড়দা যা রাম ঘুঘু, মুখ ফুটে একটি কথাও বলতো না। কেননা, উলটো ঘটনাও তো ঘটেছে। তখন আবার বড়দা গোঁসা করেছে। তবে ও তো মেজদার মতন ছিল না, বরাবরই একটু অমায়িকভাবের তাঁদড়। এখন অবিশ্যি ওদের দুজনেরই অনেক অদলবদল হয়েছে। দুজনের ব্যবসা চাকরি আর রাজনীতি, সব মিলিয়ে ওরা আগের থেকে এখন অনেক চালাক হয়েছে। তার মানে, দুজনেই অনেক ঘুঘু হয়েছে এখন। অথচ, লড়াই ওদের ভিতরে ভিতরে বেড়েছে, আর আমাকে নিয়ে টানাটানিও বেড়েছে। এখন আমার সঙ্গে দুজনেরই নরম গরমে চলে। বুঝতে পারি, ওরা দুজনেই চায়, আমি ওদের দলে ভিড়ে পড়ি। কখনো দুজনেই আমাকে ত্যালায়, রেগুলার কমপিটিশন লেগে যায় ওদের; আমি মনে মনে বলি, স্‌সাহু মালপাড়ার গোঁসাই তোমরা, দেশটা তোমাদের মালপাড়া, আর আমাকেও তাই ভেবেছ? যখন দেখে যে, কিছু হবে না, তখন গুণ্ডা বলে। অথচ গুণ্ডা বলেই আমাকে চায়। আমার তো আর কোন দল নেই। যশোদাবাবুদের দলটা তো এখন নিখাগীর মা হয়েছে। কোনরকমে নাম বজায় আছে, কয়েকজনের দল হয়েছে, বাততি সব নিভু-নিভু! জোরদার থাকলেও আমি আর থাকতাম না! কলেজ যখন ছেড়েছি, ওদের সঙ্গে সম্পর্ক কী!

যাই হোক গে, মোটের উপর মেজদা জীবনে সেই আমার গায়ে শেষবার হাত তুলতে এসেছিল। বুঝতে পেরেছিল, আমার সঙ্গে লাগতে এলে খুব সুবিধা হবে না। আর সেই একটা ধারণা ছিল ওদের, আমি ওদের পেছনে লাগি। সেই ভয় পেয়ে যখন ওরকম করে উঠতাম, আর তারপরে চেঁচিয়ে ছুটে দাপিয়ে একটা কাণ্ড বাধিয়ে তুলতাম। শুধু ওরা কেন, বাড়ির ঝি ঠাকুর সবাই তাই মনে করতো। কেবল, কেন আমি জানি না, শুলাদাটা যেন একটু অন্য রকম ছিল। গাছ ফুল ফল ছিঁড়ে ফেললে, সে নিজের হাতে সব ঠিকঠাক করে রাখতো, যাতে ফাদারের চোখে কিছু না পড়ে। আর এও জানতাম, সে-ই সবাইকে সামলে রাখতো, যাতে আমার সেই সব বদমাইসির কথা বাবার কানে না যায়। সে আমাকে থেকে থেকে প্রায়ই বলতো, “তোমার কী হয় ছোট খোকা, তোমার কি মাথা খারাপ?

তা বলে, আমি কোনদিনই শুলাদাকে সে কথা বলিনি। আমি বুঝতে পারতাম, শুলাদা একটু অবাক হয়ে ভাবতো, ছোট খোকা বড় হচ্ছে, লেখাপড়া শিখছে, অথচ তার এরকম হচ্ছে কেন। ব্যাপারটার মধ্যে যে একটা অদ্ভুত কিছু আছে, সে খানিকটা আন্দাজ করতে পারতো। বুঝতে পারতো না কিছুই।

এ কথাও ঠিক, সেই এক রকমের ভয় পাওয়া, আর বুক গুরগুরিয়েওঠা, বুকের মধ্যে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া এক ধরনের যন্ত্রণা, চোখে জল এসে গড়ার ব্যাপারটা যে আমার খুব ছেলেমানুষি বয়সের তা না। তখন ক্লাস নাইন-টেনে উঠেছি, এমন কি যখন কলেজে প্রথম ঢুকেছিলাম, তখনো কয়েকবার সেইরকম হয়েছে, কথাটা ভেবে আমার সত্যি কান্না পেয়ে গেছে। বাথরুমে ঢুকে কেঁদেও ফেলেছি। আরো এইজন্যে যে, কাউকে বলতে পারছিলাম না, কেউ বুঝতেও পারছিল না, আর বললে বোধহয় বিশ্বাসও করতো না। তারপরেই অবিশ্যি রাগের চোটে আমার গা জ্বলে যেত। আমি নিজে নিজেই বলে উঠতাম, বিয়ে গেছে আমার। কাউকে বলতে চাই না। আমার কাউকে চাই না, কারুক্কে আমার দরকার নেই। বাবা না, দাদাদের না, কারুক্কে না। সবাইকে আমি ইয়ে করে দিই ‘ কেউ কাছে থাকলে কখনো সেরকম ঘটতো না। যখনই হয়েছে, আমার একলা অবস্থায়। আমার মনে আছে, কীরকম অবস্থায় সেটা হত। হয়তো হঠাৎ বাইরের থেকে বাড়িতে এসেছি, ঘরে ঢুকেই মনে হল, আচ্ছা ইকনমিকস-এর নোটটা একটু পড়ে রাখি। বইটা খুলতে গেলাম, ভাল লাগলো না, দুম করে বাবার ঘরে চলে গেলাম। টেবিলের ওপরে একটা অফিসের কাগজ ফ্যাস করে খানিকটা ছিঁড়ে ফেললাম, বাবার মুখটা মনে পড়ে গেল, হাসি পেল, একটু ভয়ও হল; বেরিয়ে এসে বড়দার ঘরে গেলাম, ওর দলের নেতাদের ছবিগুলো দেখলাম দেওয়ালে, ভেংচে কাঁচকলা দেখিয়ে দিলাম; মেজদার ঘরে গিয়ে প্যাঁচ করে একটু থুথু দিয়ে দিলাম, অবিশ্যি যদি ওরা বাড়িতে না থাকে। তারপরেই মনে হল, আচ্ছা কিছু খাই, ভাবতে ভাবতে বাথরুমে গেলাম, প্রায় কুঁথিয়ে কুঁথিয়ে একটু প্রস্রাব করলাম, কারণ, পায়নি তো। তখন মনে হল, বাইরে রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিছু খেলে কেমন হয়, আর ঠিক তখনই হয়তো সেই খারাপ একটা ব্যাপার করতে ইচ্ছা হল, বন্ধুদের কাছে শেখা, যেটা নিজে নিজেই করা যায়। ওটা তখন প্রায়ই ইচ্ছা হত, একলা থাকলেই কুকুরের নতুন গু খেতে শেখার মত। ব্যাপারটা সেরে হয়তো ছাদে গেলাম। আর তখনই জল তেষ্টা পেল, জল খেলাম। আর সেই সময়েই হয়তো একেবারে মোমেন্টে যাকে বলে, হঠাৎ একটা কীরকম ভয় করে উঠলো, আর বুক গুরগুরিয়ে….কোথা থেকে যে কী হয়ে যেত।

এখনো যে সে ভয়ের ভাবটা আমার একেবারে কেটে গিয়েছে, তা কিন্তু না। এখনো সেই গুরগুরোনিটা আমি মাঝে মাঝে টের পাই, তবে খুবই কম। কলেজের হৈ চৈ মারামারি উত্তেজনা মাথা ফাটাফাটি দলাদলি ওসব নিয়ে যতই মেতেছিলাম, ততই ব্যাপারটা কেটে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস স্‌সাহ্‌ গুণ্ডা হয়েছিলাম, তা না হলে হয়তো সেটা কৃমির মতন লেগেই থাকতো। যেন ও ব্যাপারটাকে কাটিয়ে ওঠবার জন্যেই আমার একটা হুড়যুদ্ধ দরকার। যে কোন রকমেরই ৷ এখনো মাঝে মাঝে যখন টের পাই, তখনই লক্ষ্য করে দেখেছি, হয়তো কোন কারণে মেজাজটা খারাপ, শরীরটা খারাপ, কিছু ভাল লাগছে না, কেমন যেন একটা ঝিম-ধরা ভাব, কিছুই করছি না, শিখার কাছেও যাচ্ছি না, ওকে গালাগাল দিচ্ছি মনে মনে, আর একলা একলা থেকেছি, তখনই হঠাৎ চমকে উঠলাম। মনে হয়, যেখানেই থাকি, ঘরে বাইরে দোকানে, সবখানেই, কী যেন একটা এসে হাজির হয়েছে। আমনি লাফ দিয়ে উঠে হেঁকে উঠলাম, ‘পেলে লেগে যা! এই সসিবে, সসুটকা!’

অমনি ওরা এসে হাজির হয়। যেখানেই হোক কাছাকাছিই তো থাকে। বাড়িতে থাকলে, ঝি চাকরকেই চেচিয়ে গালাগাল দিয়ে উঠি, দৌড়ে বাড়ির বাইরে যাই। মিছিমিছি চেঁচাতে চেঁচাতে যাই, “তোমাদের ডেকে পাওয়া যায় না, কোথায় থাক সব? তখন মনে হয়, যেন সত্যি সত্যি বলছি, সত্যি সত্যি ওদের কাউকে ডেকেছিলাম, কেউ শুনতে পায়নি। বাইরে থাকলে, অন্যরকম। ওইরকম চীৎকার করে ওদের ডাকি—ওরা এসে হাজির হলেই বলি, ‘চল তো একটু মাল খেয়ে আসি।’

ওরা অবাক হয়ে বলে, ‘সে কি রে স্‌লা, বেলা এগারটাতে মাল খাবি কী।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এখনই টানা যাক একটু, চল-না।’

ওরা হাসে, মজার মজার খিস্তি করে। একটু খেতে পাবার খুশিতেই যে আরো ওরকম করে, বুঝতে পারি, সময়ের জ্ঞান তো কত। কাকে গু খাবার আগে, ভোরবেলা পেলেই খেতে পারে, তারা আবার বেলা এগারটা দেখায় আমাকে। তবে ব্যাপারটা এমন আচমকা ঘটে, বলে, ‘গুরুর যে কখন কি মতিগতি হয়, মাইরি বুঝতে পারি না। ‘ বলেই না শুধু, আমাকে নিয়ে ওরা একটু অবাক। আসল ব্যাপার তো বুঝতে পারে না, ভাবে, আসল গুণ্ডার ভাবভঙ্গি বোধ হয় সকলের থেকে একটু আলাদাই হয়!

এইভাবে মদ খাবার জন্যে ছুটতে গিয়ে হয়তো, হঠাৎ চোখে পড়ে যায়, কোন মেয়েকে দেখে, কোন রিকশাওয়ালা খারাপ কথা বলে ফুট কাটছে, অমনি ঠাস করে মারি গালে এক চড়, তারপরেই আর একটা ঘুষি চোয়ালে। খিস্তি করে বলি, ‘সসাল্লা, ভদ্রলোকের মেয়েদের টিটকারি। সশহরে তোমার গাড়ি চালানোর বারোটা বাজিয়ে দেব আমি। খবরদার, আমার চোখে যেন কোনদিন আর না পড়ে।’

তার মধ্যে সাকরেদরাও হয়তো দু’চার ফাইট হাঁকিয়ে দেয়। লোকজন ট্রাফিক পুলিশ, যারা সবাই আমাকে চেনে, শহরের থানারই পুলিশ তো, আর রিকশাওয়ালারা এসে থামিয়ে দেয়। এক কাজে, দু কাজ হয়ে যায়। তখন কী যে করি বা করব, তা কোন শিবের বাবাও বলতে পারে না। ওরকম একটা কিছু করা তখন যেন আমার দরকার হয়ে পড়ে, মাইরি। আর সবাই অবাক হয়ে ভাবে, এরকম একটা কারণে আমি এত রেগে উঠতে পারি। শুধু অবাক কেন, রীতিমত প্রশংসা, যাকে বলে হিরোর দিকে চেয়ে দেখার মতন। অথচ জানে সবাই, আমার মত হাড়ে-হারামজাদা গুণ্ডা শহরে দ্বিতীয় নেই। সে কি না, কোন একটা মেয়েকে দেখে রিকশাওয়ালা কী বলেছে, তার জন্যে একেবারে লাল! আমি বলি, লে হালুয়া। লোকে বলে, অদ্ভুত তো!

লোকজনেরা সবাই রিকশাওয়ালাকে ধমকায়। এমন কি রিকশাওয়ালারা পর্যন্ত মার-খাওয়া লোকটাকে বলে, ‘তোর স্‌সালা আঁখ নেই রে, স্‌সুখেনদার সামনে মজাকি মারতে গেছিস।’ আমি তো আবার সকলেরই স্‌সুখেনদা। ভদ্র, অভদ্র, ছোট বড় অনেকেরই। আমি গা ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে আসি। কেবল সেপাইটাই একটু অন্যরকম করে তাকিয়ে থাকে। ঠিক কিছু বলতেও পারে না, অথচ আমার মাস্তানিটা সহ্যও হয় না। ওর তো ধারণা, মাথায় পাগড়ি আর গায়ে খাকি কুতা থাকতে, আর কেউ মাস্তানি করবে কেন। শহরে মাস্তান তো ওরাই। খালি পয়সায় রিকশা চাপছে, তা না হলেই পেটি কেসে ধরে নিয়ে গিয়ে ঠুকে দিচ্ছে, আশেপাশের দোকান থেকে যখন যা দরকার, ধারের নাম করে নিয়ে যাচ্ছে, আর কোনদিন দেবার নাম নেই ; বাজারেও তাই—অবিশ্যি দোকানদার রিকশাওয়ালাদেরও দোষ আছে, তা হলেও মনে করে, ওসব ওদেরই একচেটিয়া। বাবা, কেলাস বোঝ না, তোমাকে আমাকে ফারাক করলে হয়। জানবে, আসল মাস্তান আমিই! যদি না জান, তবে আরো অন্য জায়গায় গিয়ে জিজ্ঞেস কর।

কিন্তু রিকশাওয়ালারা ওরকম কত করে, আমার বাপ-মা-মরা দায় কেঁদে গেছে কিছু বলতে। আমি কিছু ওসব চেয়ে দেখি না, বলিও না। কত বেচালবাজ ছুঁড়ি আছে, তাদের পোশাক-আশাক ভাবভঙ্গি চলাফেরা দেখলে, আমিই কি কিছু বলতে ছেড়ে দিই নাকি! রিকশাওয়ালাদের মতন বলি না, গলাটা একটু নামিয়ে হয়তো বলি, ‘স্‌সটকা, ছুঁড়ির লেবেল খুলেছে মনে হয়।’

শুটকা তারও বাড়া, হয়তো জবাব দেয়, ‘লেবেল মানে, সাফ হয়ে গেছে সব মাল |’

আমরা এরকমভাবে বলি, ওদের বলাটা অন্যরকম। সে সব কথা শুনলে, কানে তালা লেগে যায়, মাইরি! এমনই মোক্ষম বলে, তারপরে আর কথা চলে না। তা ছাড়া রিকশাওয়ালারা আমার আপন লোক, বিনা পয়সায় আমাকে চাপায়, পয়সা কড়ি না থাকলে অনেক সময় কিছু দেয়ও। থানার বড়বাবুকে বলে অনেক সময় ছাড়িয়েও এনেছি। আমার যেমন বড়বাবুকে নিয়ে মাথাব্যথা, বড়বাবুরও তো তেমনি আমাকে নিয়ে মাথাব্যথা। কেউ কাউকে ডিসটাব করি না, খাঁটি ভদরলোকের চুক্তি …তাই বলছি, সেই ভয়ের ভাবটা আমার এখনো যায়নি। তবে অনেক কম, আর কালেভদ্রে টের পাওয়া যায়। গেলেই ওইরকম কিছু করি। ওটা যে কী ব্যাপার, আমি কোনদিন তা জানতে পারিনি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress