প্রজাপতির নির্বন্ধ-8
অষ্টম পরিচ্ছেদ
নৃপবালা। আজকাল তুই মাঝে মাঝে কেন অমন গম্ভীর হচ্ছিস বল্ তো নীরু।
নীরবালা। আমাদের বাড়ির যত কিছু গাম্ভীর্য সব বুঝি তোর একলার? আমার খুশি আমি গম্ভীর হব।
নৃপবালা। তুই কী ভাবছিস আমি বেশ জানি।
নীরবালা। তোর অত আন্দাজ করবার দরকার কী ভাই? এখন তোর নিজের ভাবনা ভাববার সময় হয়েছে।
নৃপ নীরুর গলা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “তুই ভাবছিস, মা গো মা, আমরা কী জঞ্জাল। আমাদের বিদায় করে দিতেও এত ভাবনা, এত ঝঞ্ঝাট।”
নীরবালা। তা, আমরা তো ভাই ফেলে দেবার জিনিস নয় যে অমনি ছেড়ে দিলেই হল। আমাদের জন্যে যে এতটা হাঙ্গাম হচ্ছে সে তো গৌরবের কথা। কুমারসম্ভবে তো পড়েছিস গৌরীর বিয়ের জন্য একটি আস্ত দেবতা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। যদি কোনো কবির কানে উঠে তা হলে আমাদের বিবাহেরও একটা বর্ণনা বেরিয়ে যাবে।
নৃপবালা। না ভাই, আমার ভারি লজ্জা করছে।
নীরবালা। আর, আমার বুঝি লজ্জা করছে না? আমি বুঝি বেহায়া? কিন্তু কী করবি বল্? ইস্কুলে যেদিন প্রাইজ নিতে গিয়েছিলুম লজ্জা করেছিল, আবার তার পর বছরেও প্রাইজ নেবার জন্যে রাত জেগে পড়া মুখস্থ করেছিলেম। লজ্জাও করে প্রাইজও ছাড়ি নে, আমার এই স্বভাব।
নৃপবালা। আচ্ছা নীরু, এবারে যে প্রাইজটার কথা চলছে সেটার জন্য তুই কি খুব ব্যস্ত হয়েছিস?
নীরবালা। কোন্টা বল্ দেখি। চিরকুমার-সভার দুটো সভ্য?
নৃপবালা। যেই হোক-না কেন, তুই তো বুঝতে পারছিস।
নীরবালা। তা ভাই, সত্যি কথা বলব? (নৃপর গলা জড়াইয়া কানে কানে) শুনেছি কুমারসভার দুটি সভ্যের মধ্যে খুব ভাব, আমরা যদি দুজনে দুই বন্ধুর হাতে পড়ি তা হলে বিয়ে হয়েও আমাদের ছাড়াছাড়ি হবে না– নইলে আমরা কে কোথায় চলে যাব তার ঠিক নেই। তাই তো সেই যুগল দেবতার জন্যে এত পুজোর আয়োজন করেছি ভাই! জোড়হস্তে মনে মনে বলছি, হে কুমারসভার অশ্বিনীকুমারযুগল, আমাদের দুটি বোনকে এক বোঁটার দুটি ফুলের মতো তোমরা একসঙ্গে গ্রহণ করো।
বিরহসম্ভাবনার উল্লেখমাত্রে দুটি ভগিনী পরস্পরকে জড়াইয়া ধরিল এবং নৃপ কোনোমতে চোখের জল সামলাইতে পারিল না।
নৃপবালা। আচ্ছা নীরু, মেজদিদিকে কেমন করে ছেড়ে যাবি বল্ দেখি। আমরা দুজনে গেলে ওঁর আর কে থাকবে?
নীরবালা। সে কথা অনেক ভেবেছি। থাকতে যদি দেন তা হলে কি ছেড়ে যাই? ভাই, ওঁর তো স্বামী নেই, আমাদেরও নাহয় স্বামী না রইল। মেজদিদির চেয়ে বেশি সুখে আমাদের দরকার কী?
পুরুষবেশধারিণী শৈলবালার প্রবেশ
নীরু টেবিলের উপরিস্থিত থালা হইতে একটি ফুলের মালা তুলিয়া লইল। শৈলবালার গলায় পরাইয়া কহিল, “আমরা দুই স্বয়ম্বরা তোমাকে আমাদের পতিরূপে বরণ করলুম।”
এই বলিয়া শৈলবালাকে প্রণাম করিল।
শৈল। ও আবার কী?
নীরবালা। ভয় নেই ভাই, আমরা দুই সতীনে তোমাকে নিয়ে ঝগড়া করব না। যদি করি, সেজদিদি আমার সঙ্গে পারবে না– আমি একলাই মিটিয়ে নিতে পারব, তোমাকে কষ্ট পেতে হবে না। না, সত্যি বলছি মেজদিদি, তোমার কাছে আমরা যেমন আদরে আছি এমন আদর কি কোথাও পাব? কেন তবে আমাদের পরের গলায় দিতে চাস?
পুনর্বার নৃপর দুই চক্ষু বাহিয়া ঝর্ ঝর্ করিয়া জল পড়িতে লাগিল। “ও কী ও নৃপ, ছি” বলিয়া শৈল তাহার চোখ মুছিয়া দিল; কহিল, “তোদের কিসে সুখ তা কি তোরা জানিস? আমাকে নিয়ে যদি তোদের জীবন সার্থক হত তা হলে কি আমি আর কারো হাতে তোদের দিতে পারতুম?”
তিনজনে মিলিয়া একটা অশ্রুবর্ষণকাণ্ড ঘটিবার উপক্রম করিতেছিল এমন সময়ে রসিকদাদা প্রবেশ করিয়া কাতরস্বরে কহিলেন, “ভাই, আমার মতো অসভ্যটাকে তোরা সভ্য করলি– আজ তো সভা এখানে বসবে, কিরকম ভাবে চলব শিখিয়ে দে!”
নীর কহিল, “ফের পুরোনো ঠাট্টা?– তোমার ঐ সভ্য-অসভ্যর কথাটা এই পরশু থেকে বলছ।”
রসিক। যাকে জন্ম দেওয়া যায় তার প্রতি মমতা হয় না? ঠাট্টা একবার মুখ থেকে বের হলেই কি রাজপুতের কন্যার মতো তাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে হবে? হয়েছে কী– যতদিন চিরকুমার-সভা টিকে থাকবে এই ঠাট্টা তোদের দু-বেলা শুনতে হবে।
নীরবালা। তবে ওটাকে তো একটু সকাল সকাল সেরে ফেলতে হচ্ছে। মেজদিদি ভাই, আর দয়ামায়া নয়– রসিকদাদার রসিকতাকে পুরোনো হতে দেব না, চিরকুমার-সভার চিরত্ব আমরা অচিরে ঘুচিয়ে দেব তবেই তো আমাদের বিশ্ববিজয়িনী নারী নাম সার্থক হবে। কিরকম করে আক্রমণ করতে হবে একটা কিছু প্ল্যান ঠাউরেছিস?
শৈল। কিছুই না। ক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে যখন যেরকম মাথায় আসে।
নীরবালা। আমাকে যখন দরকার হবে রণভেরী ধ্বনিত করলেই আমি হাজির হব। “আমি কি ডরাই সখী কুমারসভারে? নাহি কি বল এ ভুজমৃণালে?’
অক্ষয় ঘরে প্রবেশ করিয়া কহিলেন, “অদ্যকার সভায় বিদুষীমণ্ডলীকে একটি ঐতিহাসিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করি।”
শৈল। প্রস্তুত আছি।
অক্ষয়। বলো দেখি যে-দুটি ডালে দাঁড়িয়েছিলেন সেই দুটি ডাল কাটতে চেয়েছিলেন কে?
নৃপ তাড়াতাড়ি উত্তর করিল, “আমি জানি মুখুজ্যেমশায়, কালিদাস।”
অক্ষয়। না, আরো একজন বড়ো লোক। শ্রীঅক্ষয়কুমার মুখোপাধ্যায়।
নীরবালা। ডাল দুটি কে?
অক্ষয় বামে নীরুকে টানিয়া বলিলেন “এই একটি” এবং দক্ষিণে নৃপকে টানিয়া আনিয়া কহিলেন “এই আর-একটি।”
নীরবালা। আর কুড়ুল বুঝি আজ আসছে?
অক্ষয়। আসছে কেন, এসেছে বললেও অত্যুক্তি হয় না। ঐ-যে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
শুনিয়া দৌড়, দৌড়। শৈল পালাইবার সময় রসিকদাদাকে টানিয়া লইয়া গেল। চুড়ি-বালার ঝংকার এবং ত্রস্ত পদপল্লব কয়েকটির দ্রুতপতনশব্দ সম্পূর্ণ না মিলাইতেই শ্রীশ ও বিপিনের প্রবেশ। ঝম্ ঝম্ ঝম্ ঝম্ দূর হইতে দূরে বাজিতে লাগিল। এবং ঘরের আলোড়িত বাতাসে এসেন্স্ ও গন্ধতৈলের মিশ্রিত মৃদু পরিমল যেন পরিত্যক্ত আসবাবগুলির মধ্যে আপনার পুরাতন আশ্রয়গুলিকে খুঁজিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া বেড়াইতে লাগিল।
বিজ্ঞানশাস্ত্রে বলে শক্তির অপচয় নাই, রূপান্তর আছে। স্বর হইতে হঠাৎ তিন ভগিনীর পলায়নের বাতাসে যে একটি সুগন্ধ আন্দোলন উঠিয়াছিল সেটা কি প্রথমে কুমারযুগলের বিচিত্র স্নায়ুমণ্ডলীর মধ্যে একটি নিগূঢ় স্পন্দন ও অব্যবহিত পরেই তাঁহাদের অন্তঃকরণের দিক্প্রান্তে ক্ষণকালের জন্য একটি অনির্বচনীয় পুলকে পরিণত হয় নাই? কিন্তু সংসারের যেখান হইতে ইতিহাস শুরু হয় তাহার অনেক পরের অধ্যায় হইতে লিখিত হইয়া থাকে– প্রথম স্পর্শ স্পন্দন আন্দোলন ও বিদ্যুৎচমকগুলি প্রকাশের অতীত।
পরস্পর নমস্কারের পর অক্ষয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “পূর্ণবাবু এলেন না যে?”
শ্রীশ। চন্দ্রবাবুর বাসায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ তাঁর শরীরটা খারাপ হয়েছে বলে আজ আর আসতে পারলেন না।
অক্ষয়। (পথের দিকে চাহিয়া) একটু বসুন– আমি চন্দ্রবাবুর অপেক্ষায় দ্বারের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। তিনি অন্ধ মানুষ, কোথায় যেতে কোথায় গিয়ে পড়বেন তার ঠিক নেই– কাছাকাছি এমন স্থানও আছে যেখানে কুমারসভার অধিবেশন কোনোমতেই প্রার্থনীয় নয়। বলিয়া অক্ষয় নামিয়া গেলেন।
আজ চন্দ্রবাবুর বাসায় হঠাৎ নির্মলা আবির্ভূত হইয়া চিরকুমারদলের শান্ত মনের মধ্যে যে একটা মন্থন উৎপন্ন করিয়া দিয়াছিল তাহার অভিঘাত বোধ করি এখনো শ্রীশের মাথায় চলিতেছিল। দৃশ্যটি অপূর্ব, ব্যাপারটি অভাবনীয়, এবং নির্মলার কমনীয় মুখে যে-একটি দীপ্তি ও তাহার কথাগুলির মধ্যে যে-একটি আন্তরিক আবেগ ছিল তাহাতে তাহাকে বিস্মিত ও তাহার চিন্তার স্বাভাবিক গতিকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দিয়াছে। সে লেশমাত্র প্রস্তুত ছিল না বলিয়া এই আকস্মিক আঘাতেই বিপর্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে। তর্কের মাঝখানে হঠাৎ এমন জায়গা হইতে এমন করিয়া এমন একটা উত্তর আসিয়া উপস্থিত হইবে স্বপ্নেও মনে করে নাই বলিয়াই উত্তরটা তাহার কাছে এমন প্রবল হইয়া উঠিল। উত্তরের প্রত্যুত্তর থাকিতে পারে, কিন্তু সেই আবেগকম্পিত ললিতকণ্ঠে– সেই গূঢ়-অশ্রু-করুণ বিশাল কৃষ্ণচক্ষুর দীপ্তিচ্ছটার প্রত্যুত্তর কোথায়? পুরুষের মাথায় ভালো ভালো যুক্তি থাকিতে পারে, কিন্তু যে আরক্ত অধর কথা বলিতে গিয়া স্ফুরিত হইতে থাকে, যে কোমল কপোল দুটি দেখিতে দেখিতে ভাবের আভাসে করুণাভ হইয়া উঠে, তাহার বিরুদ্ধে দাঁড় করাইতে পারে পুরুষের হাতে এমন কী আছে?
পথে আসিতে আসিতে দুই বন্ধুর মধ্যে কোনো কথাই হয় নাই। এখানে আসিয়া ঘরে প্রবেশ না করিতেই যে শব্দগুলি শোনা গেল, অন্য কোনো দিন হইলে শ্রীশ তাহা লক্ষ্য করিত কি না সন্দেহ– আজ তাহার কাছে কিছুই এড়াইল না। অনতিপূর্বেই ঘরের মধ্যে রমণীদল যে ছিল, ঘরে প্রবেশ করিয়াই সে তাহা বুঝিতে পারিল।
অক্ষয় চলিয়া গেলে ঘরটি শ্রীশ ভালো করিয়া দেখিয়া লইল। টেবিলের মাঝখানে ফুলদানিতে ফুল সাজানো। সেটা চকিতে তাহাকে একটু যেন বিচলিত করিল। তাহার একটা কারণ শ্রীশ অত্যন্ত ফুল ভালোবাসে, তাহার আর-একটা কারণ শ্রীশ কল্পনাচক্ষে দেখিতে পাইল– অনতিকাল পূর্বেই যাহাদের সুনিপুণ দক্ষিণ হস্ত এই ফুলগুলি সাজাইয়াছে তাহারাই এখনই ত্রস্তপদে ঘর হইতে পলাইয়া গেল।
বিপিন ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “যা বল ভাই, এ ঘরটি চিরকুমার-সভার উপযুক্ত নয়।”
হঠাৎ মৌনভঙ্গে শ্রীশ চকিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “কেন নয়?”
বিপিন কহিল, “ঘরের সজ্জাগুলি তোমার নবীন সন্ন্যাসীদের পক্ষেও যেন বেশি বোধ হচ্ছে।”
শ্রীশ। আমার সন্ন্যাসধর্মের পক্ষে বেশি কিছুই হতে পারে না।
বিপিন। কেবল নারী ছাড়া!
শ্রীশ কহিল, “হাঁ, ঐ একটি মাত্র!”– লেখকের অনুমানমাত্র হইতে পারে, কিন্তু অন্যদিনের মতো কথাটায় তেমন জোর পৌঁছিল না।
বিপিন কহিল, “দেয়ালের ছবি এবং অন্যান্য পাঁচরকমে এ ঘরটিতে সেই নারীজাতির অনেকগুলি পরিচয় পাওয়া যায় যেন।”
শ্রীশ। সংসারে নারীজাতির পরিচয় তো সর্বত্রই আছে।
বিপিন। তা তো বটেই। কবিদের কথা যদি বিশ্বাস করা যায় তা হলে চাঁদে ফুলে লতায় পাতায় কোনোখানেই নারীজাতির পরিচয় থেকে হতভাগ্য পুরুষমানুষের নিষ্কৃতি পাবার জো নেই।
শ্রীশ হাসিয়া কহিল, “কেবল ভেবেছিলুম, চন্দ্রবাবুর বাসার সেই একতলার ঘরটিতে রমণীর কোনো সংস্রব ছিল না। আজ সে ভ্রমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। নাঃ, ওরা পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে।”
বিপিন। বেচারা চিরকুমার কটির জন্যে একটা কোণও ফাঁকা রাখে নি। সভা করবার জায়গা পাওয়াই দায়।
শ্রীশ “এই দেখো-না” বলিয়া কোণের একটা টিপাই হইতে গোটাদুয়েক চুলের কাঁটা তুলিয়া দেখাইল।
বিপিন কাঁটা দুটি লইয়া পর্যবেক্ষণ করিয়া কহিল, “ওহে ভাই, এ স্থানটা তো কুমারদের পক্ষে নিষ্কণ্টক নয়।”
শ্রীশ। ফুলও আছে, কাঁটাও আছে।
বিপিন। সেইটেই তো বিপদ। কেবল কাঁটা থাকলে এড়িয়ে চলা যায়।
শ্রীশ অপর কোণের ছোটো বইয়ের শেল্ফ হইতে বইগুলি তুলিয়া দেখিতে লাগিল। কতকগুলি নভেল, কতকগুলি ইংরাজি কাব্যসংগ্রহ। প্যাল্গ্রেভের গীতিকাব্যের স্বর্ণভাণ্ডার খুলিয়া দেখিল, মার্জিনে মেয়েলি অক্ষরে নোট লেখা– তখন গোড়ার পাতাটা উল্টাইয়া দেখিল। দেখিয়া একটু নাড়িয়া চাড়িয়া বিপিনের সম্মুখে ধরিল।
বিপিন পড়িয়া কহিল, “নৃপবালা! আমার বিশ্বাস নামটি পুরুষমানুষের নয়। কী বোধ কর।”
শ্রীশ। আমারও সেই বিশ্বাস। এ নামটিও অন্যজাতীয়ের বলে ঠেকছে হে!
বলিয়া আর-একটা বই দেখাইল।
বিপিন কহিল, “নীরবালা! এ নামটি কাব্যগ্রন্থে চলে কিন্তু কুমারসভায়–”
শ্রীশ। কুমারসভাতেও এই নামধারিণীরা যদি চলে আসেন তা হলে দ্বাররোধ করতে পারি এত বড়ো বলবান তো আমাদের মধ্যে কাউকে দেখি নে।
বিপিন। পূর্ণ তো একটি আঘাতেই আহত হয়ে পড়ল– রক্ষা পায় কি না সন্দেহ।
শ্রীশ। কিরকম?
বিপিন। লক্ষ্য করে দেখ নি বুঝি?
প্রশান্তস্বভাব বিপিনকে দেখিলে মনে হয় না যে, সে কিছু দেখে; কিন্তু তাহার চোখে কিছুই এড়ায় না। পরম দুর্বল অবস্থায় পূর্ণকে সে দেখিয়া লইয়াছে।
শ্রীশ। না না, ও তোমার অনুমান।
বিপিন। হৃদয়টা তো অনুমানেরই জিনিস– না যায় দেখা, না যায় ধরা।
শ্রীশ থমকিয়া দাঁড়াইয়া ভাবিতে লাগিল; কহিল, “পূর্ণর অসুখটাও তা হলে বৈদ্যশাস্ত্রের অন্তর্গত নয়?”
বিপিন। না, এ-সকল ব্যাধি সম্বন্ধে মেডিকাল কলেজে কোনো লেক্চার চলে না।
শ্রীশ উচ্চস্বরে হাসিতে লাগিল, গম্ভীর বিপিন স্মিতমুখে চুপ করিয়া রহিল।
চন্দ্রবাবু প্রবেশ করিয়া কহিলেন, “আজকের তর্কবিতর্কের উত্তেজনায় পূর্ণবাবুর হঠাৎ শরীর খারাপ হল দেখে আমি তাঁকে তাঁর বাড়ি পৌঁছে দেওয়া উচিত বোধ করলুম।”
শ্রীশ বিপিনের মুখের দিকে চাহিয়া ঈষৎ একটু হাসিল; বিপিন গম্ভীরমুখে কহিল, “পূর্ণবাবুর যেরকম দুর্বল অবস্থা দেখছি পূর্ব হতেই তাঁর বিশেষ সাবধান হওয়া উচিত ছিল।”
চন্দ্রমাধব সরলভাবে উত্তর করিলেন, “পূর্ণবাবুকে তো বিশেষ অসাবধান বলে বোধ হয় না।”
চন্দ্রমাধববাবু সভাপতির আসন গ্রহণ করিবার পূর্বেই অক্ষয় রসিকদাদাকে সঙ্গে লইয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। কহিলেন, “মাপ করবেন, এই নবীন সভ্যটিকে আপনাদের হাতে সমর্পণ করে দিয়েই আমি চলে যাচ্ছি।”
রসিক হাসিয়া কহিলেন, “আমার নবীনতা বাইরে থেকে বিশেষ প্রত্যক্ষগোচর নয়–”
অক্ষয়। অত্যন্ত বিনয়বশত সেটা বাহ্য প্রাচীনতা দিয়ে ঢেকে রেখেছেন, ক্রমশ পরিচয় পাবেন। ইনি হচ্ছেন সার্থকনামা শ্রীরসিক চক্রবর্তী।
শুনিয়া শ্রীশ ও বিপিন সহাস্যে রসিকের মুখের দিকে চাহিল; রসিকদাদা কহিলেন, “পিতা আমার রসবোধ সম্বন্ধে পরিচয় পাবার পূর্বেই রসিক নাম রেখেছিলেন, এখন পিতৃসত্য পালনের জন্য আমাকে রসিকতার চেষ্টা করতে হয়, তার পরে “যত্নে কৃতে যদি ন সিধ্যতি কোহত্র দোষঃ’।”
অক্ষয় প্রস্থান করিলেন। ঘরে দুটি কেরোসিনের দীপ জ্বলিতেছে; সেই দুটিকে বেষ্টন করিয়া ফিরোজ রঙের রেশমের অবগুণ্ঠন। সেই আবরণ ভেদ করিয়া ঘরের আলোটি মৃদু এবং রঙিন হইয়া উঠিয়াছে।
পুরুষবেশী শৈল আসিয়া সকলকে নমস্কার করিল। ক্ষীণদৃষ্টি চন্দ্রমাধববাবু ঝাপসাভাবে তাহাকে দেখিলেন– বিপিন ও শ্রীশ তাহার দিকে চাহিয়া রহিল।
শৈলের পশ্চাতে দুইজন ভৃত্য কয়েকটি ভোজনপাত্র হাতে করিয়া উপস্থিত হইল। শৈল ছোটো ছোটো রুপার থালাগুলি লইয়া সাদা পাথরের টেবিলের উপর সাজাইতে লাগিল। প্রথম পরিচয়ের দুর্নিবার লজ্জাটুকু সে এইরূপ আতিথ্যব্যাপারের মধ্যে ঢাকিয়া লইবার চেষ্টা করিল।
রসিক কহিলেন, “ইনি আপনাদের সভার আর একটি নবীন সভ্য। এঁর নবীনতা সম্বন্ধে কোনো তর্ক নেই। ঠিক আমার বিপরীত। ইনি বুদ্ধির প্রবীণতা বাহ্য নবীনতা দিয়ে গোপন করে রেখেছেন। আপনারা কিছু বিস্মিত হয়েছেন দেখছি– হবার কথা। এঁকে দেখে মনে হয় বালক, কিন্তু আমি আপনাদের কাছে জামিন রইলুম– ইনি বালক নন।”
চন্দ্র। এঁর নাম?
রসিক। শ্রীঅবলাকান্ত চট্টোপাধ্যায়।
শ্রীশ বলিয়া উঠিল, “অবলাকান্ত?”
রসিক। নামটি আমাদের সভার উপযোগী নয় স্বীকার করি। নামটির প্রতি আমারও বিশেষ মমত্ব নেই– যদি পরিবর্তন করে বিক্রমসিংহ বা ভীমসেন বা অন্য কোনো উপযুক্ত নাম রাখেন তাতে উনি আপত্তি করবেন না। যদিচ শাস্ত্রে আছে বটে “স্বনামা পুরুষো ধন্যঃ’, কিন্তু উনি অবলাকান্ত নামটির দ্বারাই জগতে পৌরুষ অর্জন করতে ব্যাকুল নন।
শ্রীশ কহিল, “বলেন কী মশায়! নাম তো আর গায়ের বস্ত্র নয়, যে বদল করলেই হল।”
রসিক। ওটা আপনাদের একেলে সংস্কার শ্রীশবাবু। নামটাকে প্রাচীনেরা পোশাকের মধ্যেই গণ্য করতেন। দেখুন-না কেন, অর্জুনের পিতৃদত্ত নাম কী ঠিক করে বলা শক্ত– পার্থ, ধনঞ্জয়, সব্যসাচী, লোকের যখন যা মুখে আসত তাই বলেই ডাকত। দেখুন নামটাকে আপনারা বেশি সত্য মনে করবেন না; ওঁকে যদি ভুলে আপনি অবলাকান্ত না’ও বলেন উনি লাইবেলের মোকদ্দমা আনবেন না।
শ্রীশ হাসিয়া কহিল, “আপনি যখন এতটা অভয় দিচ্ছেন তখন অত্যন্ত নিশ্চিন্ত হলুম, কিন্তু ওঁর ক্ষমাগুণের পরিচয় নেবার দরকার হবে না– নাম ভুল করব না মশায়।”
রসিক। আপনি না করতে পারেন, কিন্তু আমি করি মশায়। উনি আমার সম্পর্কে নাতি হন– সেইজন্যে ওঁর সম্বন্ধে আমার রসনা কিছু শিথিল, যদি কখনো এক বলতে আর বলি সেটা মাপ করবেন।
শ্রীশ উঠিয়া কহিল, “অবলাকান্তবাবু, আপনি এ-সমস্ত কী আয়োজন করেছেন? আমাদের সভার কার্যাবলীর মধ্যে মিষ্টান্নটা ছিল না।”
রসিক। (উঠিয়া) সেই ত্রুটি যিনি সংশোধন করছেন তাঁকে সভার হয়ে ধন্যবাদ দিই।
শ্রীশের মুখের দিকে না চাহিয়া থালা সাজাইতে সাজাইতে শৈল কহিল, “শ্রীশবাবু, আহারটাও কী আপনাদের নিয়মবিরুদ্ধ?”
শ্রীশ দেখিল কণ্ঠস্বরটিও অবলা নামের উপযুক্ত। কহিল, “এই সভ্যটির আকৃতি নিরীক্ষণ করে দেখলেই ও সম্বন্ধে কোনো সংশয় থাকবে না।”
বলিয়া বিপুলায়তন বিপিনকে টানিয়া আনিল।
বিপিন কহিল, “নিয়মের কথা যদি বলেন অবলাকান্তবাবু, সংসারের শ্রেষ্ঠ জিনিসমাত্রই নিজের নিয়ম নিজে সৃষ্টি করে। ক্ষমতাশালী লেখক নিজের নিয়মে চলে, শ্রেষ্ঠ কাব্য সমালোচকের নিয়ম মানে না। যে মিষ্টান্নগুলি সংগ্রহ করেছেন এর সম্বন্ধেও কোনো সভার নিয়ম খাটতে পারে না– এর একমাত্র নিয়ম, বসে যাওয়া এবং নিঃশেষ করা। ইনি যতক্ষণ আছেন ততক্ষণ জগতের অন্য সমস্ত নিয়মকে দ্বারের কাছে অপেক্ষা করতে হবে।”
শ্রীশ কহিল, “তোমার হল কী বিপিন? তোমাকে খেতে দেখেছি বটে, কিন্তু এক নিশ্বাসে এত কথা কইতে শুনি নি তো।”
বিপিন। রসনা উত্তেজিত হয়েছে, এখন সরল বাক্য বলা আমার পক্ষে অত্যন্ত সহজ হয়েছে। যিনি আমার জীবনবৃত্তান্ত লিখবেন, হায়, এ সময়ে তিনি কোথায়?
রসিক টাকে হাত বুলাইতে বুলাইতে কহিলেন, “আমার দ্বারা সে কাজটা প্রত্যাশা করবেন না, আমি অত দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে পারব না।”
নূতন ঘরের বিলাসসজ্জার মধ্যে আসিয়া চন্দ্রমাধববাবুর মনটা বিক্ষিপ্ত হইয়া গিয়াছিল। তাঁহার উৎসাহস্রোত যথাপথে প্রবাহিত হইতেছিল না। তিনি ক্ষণে ক্ষণে কার্যবিবরণের খাতা, ক্ষণে ক্ষণে নিজের করকোষ্ঠী অকারণে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতেছিলেন। শৈল তাঁহার সম্মুখে গিয়া সবিনয়ে নিবেদন করিল, “সভার কার্যের যদি কিছু ব্যাঘাত করে থাকি তো মাপ করবেন, চন্দ্রবাবু, কিছু জলযোগ–”
চন্দ্রবাবু শৈলকে নিকটে পাইয়া তাহার মুখ নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, “এ-সমস্ত সামাজিকতায় সভার কার্যের ব্যাঘাত করে, তাতে সন্দেহ নেই।”
রসিক কহিলেন, “আচ্ছা, পরীক্ষা করে দেখুন মিষ্টান্নে যদি সভার কার্য রোধ হয় তা হলে–”
বিপিন মৃদুস্বরে কহিল, “তা হলে ভবিষ্যতে না হয় সভাটা বন্ধ রেখে মিষ্টান্নটা চালালেই হবে।”
চন্দ্রবাবু নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে দেখিতে শৈলের সুন্দর সুকুমার চেহারাটি কিয়ৎপরিমাণে আয়ত্ত করিয়া লইলেন। তখন শৈলকে ক্ষুণ্ন করিতে তাঁহার আর প্রবৃত্তি হইল না।
বলা আবশ্যক, অচিরকাল পূর্বেই বিপিন জলযোগ করিয়াই বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছিল। তাহার ভোজনের ইচ্ছামাত্র ছিল না, কিন্তু এই প্রিয়দর্শন কুমারটিকে দেখিয়া, বিশেষত তাহার মুখের অত্যন্ত কোমল একটি স্মিতহাস্যে, বিপুলবলশালী বিপিনের চিত্ত হঠাৎ এমনি স্নেহাকৃষ্ট হইয়া পড়িল যে, অস্বাভাবিক মুখরতার সহিত মিষ্টান্নের প্রতি সে অতিরিক্ত লোলুপতা প্রকাশ করিল। রোগভীরু শ্রীশের অসময়ে খাইবার সাহস ছিল না, তাহারও মনে হইল, না খাইতে বসিলে এই তরুণ কুমারটির প্রতি কঠিন রূঢ়তা করা হইবে।
শ্রীশ কহিল, “আসুন রসিকবাবু, আপনি উঠছেন না যে।”
রসিক। রোজ রোজ যেচে এবং মাঝে মাঝে কেড়ে খেয়ে থাকি, আজ চিরকুমার-সভার সভ্যরূপে আপনাদের সংসর্গগৌরবে কিঞ্চিৎ উপরোধের প্রত্যাশায় ছিলুম, কিন্তু–
শৈল। কিন্তু আবার কী রসিকদাদা? তুমি যে রবিবার করে থাক, আজ তুমি কিছু খাবে নাকি?
রসিক। দেখেছেন মশায়! নিয়ম আর কারো বেলায় না, কেবল রসিকদাদার বেলায়! নাঃ– বলং বলং বাহুবলম্! উপরোধ-অনুরোধের অপেক্ষা করা নয়।
বিপিন। (চারটিমাত্র ভোজনপাত্র দেখিয়া) আপনি আমাদের সঙ্গে বসবেন না!
শৈল। না, আমি আপনাদের পরিবেশন করব।
শ্রীশ উঠিয়া কহিল, “সে কি হয়!”
শৈল কহিল, “আমার জন্যে আপনারা অনেক অনিয়ম সহ্য করেছেন, এখন আমার আর একটিমাত্র ইচ্ছা পূর্ণ করুন। আমাকে পরিবেশন করতে দিন, খাওয়ার চেয়ে তাতে আমি ঢের বেশি খুশি হব।”
শ্রীশ। রসিকবাবু, এটা কি ঠিক হচ্ছে?
রসিক। ভিন্নরুচির্হি লোকঃ। উনি পরিবেশন করতে ভালোবাসেন, আমরা আহার করতে ভালোবাসি। এরকম রুচিভেদে বোধ হয় পরস্পরের কিছু সুবিধা আছে।
আহার আরম্ভ হইল।
শৈল। চন্দ্রবাবু, ওটা মিষ্টি, ওটা আগে খাবেন না, এই দিকে তরকারি আছে। জলের গ্লাস খুঁজছেন? এই-যে গ্লাস।– বলিয়া গ্লাস অগ্রসর করিয়া দিল।
চন্দ্রবাবুর নির্মলাকে মনে পড়িল। মনে হইল এই বালকটি যেন নির্মলার ভাই। আত্মসেবায় অনিপুণ চন্দ্রবাবুর প্রতি শৈলের একটু বিশেষ স্নেহোদ্রেক হইল। চন্দ্রবাবুর পাতে আম ছিল, তিনি সেটাকে ভালোরূপ আয়ত্ত করিতে পারিতেছিলেন না– অনুতপ্ত শৈল তাড়াতাড়ি তাহা কাটিয়া সহজসাধ্য করিয়া দিল। যে সময়ে যেটি আবশ্যক সেটি আস্তে আস্তে হাতের কাছে জোগাইয়া দিয়া তাঁহার ভোজন-ব্যাপারটি নির্বিঘ্ন করিতে লাগিল।
চন্দ্র। শ্রীশবাবু, স্ত্রী-সভ্য নেওয়া সম্বন্ধে আপনি কিছু বিবেচনা করেছেন?
শ্রীশ। ভেবে দেখতে গেলে ওতে আপত্তির কারণ বিশেষ নেই, কেবল সমাজের আপত্তির কথাটা আমি ভাবি।
বিপিনের তর্কপ্রবৃত্তি চড়িয়া উঠিল। কহিল, “সমাজকে অনেক সময় শিশুর মতো গণ্য করা উচিত। শিশুর সমস্ত আপত্তি মেনে চললে শিশুর উন্নতি হয় না, সমাজ সম্বন্ধেও ঠিক সেই কথা খাটে।”
আজ শ্রীশ উপস্থিত প্রস্তাবটা সম্বন্ধে অনেকটা নরমভাবে ছিল, নতুবা উত্তাপ হইতে বাষ্প ও বাষ্প হইতে বৃষ্টির মতো এই তর্ক হইতে কলহ ও কলহ হইতে পুনর্বার সদ্ভাবের সৃষ্টি হইত।
এমন-কি, শ্রীশ কথঞ্চিৎ উৎসাহের সহিত বলিল, “আমার বোধ হয় আমাদের দেশে যে এত সভাসমিতি আয়োজন-অনুষ্ঠান অকালে ব্যর্থ হয় তার প্রধান কারণ, সে-সকল কার্যে স্ত্রীলোকদের যোগ নেই। রসিকবাবু কী বলেন?”
রসিক। অবস্থাগতিকে যদিও স্ত্রীজাতির সঙ্গে আমার বিশেষ সম্বন্ধ নেই তবু এটুকু জেনেছি, স্ত্রীজাতি হয় যোগ দেন নয় বাধা দেন, হয় সৃষ্টি নয় প্রলয়। অতএব ওঁদের দলে টেনে অন্য সুবিধা যদি-বা নাও হয় তবু বাধার হাত এড়ানো যায়। বিবেচনা করে দেখুন, চিরকুমার-সভার মধ্যে যদি স্ত্রীজাতিকে আপনারা গ্রহণ করতেন তা হলে গোপনে এই সভাটিকে নষ্ট করবার জন্যে ওঁদের উৎসাহ থাকত না, কিন্তু বর্তমান অবস্থায়–
শৈল। কুমারসভার উপর স্ত্রীজাতির আক্রোশের খবর রসিকদাদা কোথায় পেলে?
রসিক। বিপদের খবর না পেলে কি আর সাবধান করতে নেই? একচক্ষু হরিণ যে দিকে কানা ছিল সেই দিক থেকেই তো তীর খেয়েছিল। কুমারসভা যদি স্ত্রীজাতির প্রতিই কানা হন তা হলে সে দিক থেকেই হঠাৎ ঘা খাবেন।
শ্রীশ। (বিপিনের প্রতি মৃদুস্বরে) একচক্ষু হরিণ তো আজ একটা তীর খেয়েছেন, একটি সভ্য ধূলিশায়ী।
চন্দ্র। কেবল পুরুষ নিয়ে যারা সমাজের ভালো করতে চায় তারা এক পায়ে চলতে চায়। সেইজন্যেই খানিক দূর গিয়েই তাদের বসে পড়তে হয়। সমস্ত মহৎ চেষ্টা থেকে মেয়েদের দূরে রেখেছি বলেই আমাদের দেশের কাজে প্রাণসঞ্চার হচ্ছে না। আমাদের হৃদয়, আমাদের কাজ, আমাদের আশা বাইরে ও অন্তঃপুরে খণ্ডিত। সেইজন্যে আমরা বাইরে গিয়ে বক্তৃতা দিই, ঘরে এসে ভুলি। দেখো অবলাকান্তবাবু, এখনো তোমার বয়স অল্প আছে, এই কথাটি ভালো করে মনে রেখো– স্ত্রীজাতিকে অবহেলা কোরো না। স্ত্রীজাতিকে যদি আমরা নিচু করে রাখি তা হলে তাঁরাও আমাদের নীচের দিকেই আকর্ষণ করেন; তা হলে তাঁদের ভারে আমাদের উন্নতির পথে চলা অসাধ্য হয়, দু পা চলেই আবার ঘরের কোণে এসেই আবদ্ধ হয়ে পড়ি। তাঁদের যদি আমরা উচ্চে রাখি তা হলে ঘরের মধ্যে এসে নিজের আদর্শকে খর্ব করতে লজ্জা বোধ হয়। আমাদের দেশে বাইরে লজ্জা আছে, কিন্তু ঘরের মধ্যে সেই লজ্জাটি নেই, সেইজন্যেই আমাদের সমস্ত উন্নতি কেবল বাহ্যাড়ম্বরে পরিণত হয়।
শৈল চন্দ্রবাবুর এই কথাগুলি আনতমস্তকে শুনিল; কহিল, “আশীর্বাদ করুন আপনার উপদেশ যেন ব্যর্থ না হয়, নিজেকে যেন আপনার আদর্শের উপযুক্ত করতে পারি।”
একান্ত নিষ্ঠার সহিত উচ্চারিত এই কথাগুলি শুনিয়া চন্দ্রবাবু কিছু বিস্মিত হইলেন। তাঁহার সকল উপদেশের প্রতি নির্মলার তর্কবিহীন বিনম্র শ্রদ্ধার কথা মনে পড়িল। স্নেহার্দ্র মনে আবার ভাবিলেন, এ যেন নির্মলারই ভাই।
চন্দ্র। আমার ভাগ্নী নির্মলাকে কুমারসভার সভ্যশ্রেণীতে ভুক্ত করতে আপনাদের কোনো আপত্তি নেই?
রসিক। আর কোনো আপত্তি নেই, কেবল একটু ব্যাকরণের আপত্তি। কুমারসভায় কেউ যদি কুমারীবেশে আসেন তা হলে বোপদেবের অভিশাপ।
শৈল। বোপদেবের অভিশাপ একালে খাটে না।
রসিক। আচ্ছা, অন্তত লোহারামকে তো বাঁচিয়ে চলতে হবে। আমি তো বোধ করি, স্ত্রীসভ্যরা যদি পুরুষসভ্যদের অজ্ঞাতসারে বেশ ও নাম পরিবর্তন করে আসেন তা হলে সহজে নিষ্পত্তি হয়।
শ্রীশ। তা হলে একটা কৌতুক এই হয় যে, কে স্ত্রী কে পুরুষ নিজেদের এই সন্দেহটা থেকে যায়–
বিপিন। আমি বোধ হয় সন্দেহ থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারি।
রসিক। আমাকেও বোধ হয় আমার নাতনী বলে কারো হঠাৎ আশঙ্কা না হতে পারে।
শ্রীশ। কিন্তু অবলাকান্তবাবু সম্বন্ধে একটা সন্দেহ থেকে যায়।
তখন শৈল অদূরবর্তী টিপাই হইতে মিষ্টান্নের থালা আনিতে প্রস্থান করিল।
চন্দ্র। দেখুন রসিকবাবু, ভাষাতত্ত্বে দেখা যায়, ব্যবহার করতে করতে একটা শব্দের মূল অর্থ লোপ পেয়ে বিপরীত অর্থ ঘটে থাকে। স্ত্রীসভ্য গ্রহণ করলে চিরকুমার-সভার অর্থের যদি পরিবর্তন ঘটে তাতে ক্ষতি কী?
রসিক। কিছু না। আমি পরিবর্তনের বিরোধী নই– তা নাম-পরিবর্তন বা বেশ-পরিবর্তন বা অর্থ-পরিবর্তন যাই হোক-না কেন, যখন যা ঘটে আমি বিনা বিরোধে গ্রহণ করি বলেই আমার প্রাণটা নবীন আছে।
মিষ্টান্ন শেষ হইল এবং স্ত্রীসভ্য লওয়া সম্বন্ধে কাহারো আপত্তি হইল না।
আহার-অবসানে রসিক কহিল, “আশা করি সভার কাজের কোনো ব্যাঘাত হয় নি।”
শ্রীশ কহিল, “কিছু না– অন্যদিন কেবল মুখেরই কাজ চলত, আজ দক্ষিণ হস্তও যোগ দিয়েছে।”
বিপিন। তাতে আভ্যন্তরিক তৃপ্তিটা কিছু বেশি হয়েছে।
শুনিয়া শৈল খুশি হইয়া তাহার স্বাভাবিক স্নিগ্ধকোমল হাস্যে সকলকে পুরস্কৃত করিল।