চেসোয়াভ মিউশের সাক্ষাৎকার
(চেসোয়াভ মিউশের এ-সাক্ষাৎকার নেন রবার্ট ফাগেন। এটি দ্য প্যারিস রিভিয়্যুর আর্ট অ্যান্ড পোয়েট্রির ৭০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।)
সাক্ষাৎকারটি প্রাথমিকভাবে বার্কলিতে মিউশের বাড়িতে গ্রহণ করা হয়, যেখানে তিনি স্ত্রী ক্যারোল এবং টিনি নামে একটি বিড়ালসহ বাস করতেন। বাকি অংশগুলো নিউইয়র্কের ৯২ স্ট্রিট YMHA-র উন্টারবার্গ কবিতা কেন্দ্রে সরাসরি অনুষ্ঠানের আগে রেকর্ড করা হয়। বার্কলির প্রথম কথোপকথনটি বিরতিহীনভাবে চার ঘণ্টা ধরে অনুষ্ঠিত হয়, যতক্ষণ না কবি তাঁর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু দরদী স্বরে তাঁর নিঃশেষিত সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর উদ্দেশে বলে উঠলেন, ‘এখন ছয়টা বাজে, একটু ভোদকা খাওয়া যায়?’
প্রশ্ন : সম্প্রতি, বায়ান্ন বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো লিথুয়ানিয়ায় গেলেন। কেমন ছিল এই ভ্রমণ?
মিউশ : এটা ছিল এক ভ্রাম্যমাণ অভিজ্ঞতা। দেশের সন্তান হিসেবে সেখানে আমাকে আন্তরিকভাবে বরণ করা হয়েছিল। কাউনাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে সাম্মানিক ডিগ্রি প্রদান করা হয়। তারপর আমি আমার কাউন্টি এলাকা পরিদর্শন করি। সেখানে আমাকে কৃষকদের পোশাকে সীমান্ত প্রতিনিধিদল থেকে অভ্যর্থনা দেওয়া হয়, যা ছিল ওই অঞ্চলের এক বিশাল ঘটনা। আমাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয় এবং যেখানে একদা আমার ব্যাপ্টাইজম হয়েছিল সেই কাঠের গির্জায় এক জনসমাবেশে আমি অংশগ্রহণ করি। কিন্তু অনেক গ্রাম হারিয়ে গেছে। মনে হয় এলাকার অসংখ্য অধিবাসী সাইবেরিয়ায় নিয়োজিত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও সেখানে লাল ইটের ছোট ছোট পরিচ্ছন্ন শহর রয়েছে। যেখানে আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম, সেখানেও আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে আর কোনো ঘরবাড়ি অবশিষ্ট নেই এখন, শুধু বিগত দিনের সৌন্দর্যকে নিয়ে একটি পার্ক রয়েছে, আর নদীটি একেবারেই দূষিত।
প্রশ্ন : লিথুয়ানিয়ায় বেড়ে ওঠার সময় কী ধরণের সাহিত্য আপনার কল্পনাশক্তিকে রূপায়িত করেছিল?
মিউশ : কল্পনা করুন এমন এক জগৎ যেখানে ছিল না কোনো রেডিও, টেলিভিশন বা ফিল্ম। এটাই ছিল ইউরোপের একটি প্রাদেশিক অংশে আমার শৈশব। সে-সময়ে এখনকার তুলনায় বইয়ের প্রভাব ছিল অনেক বেশি, আর আমি আমার ঠাকুরদার পাঠাগার থেকে উপকৃতও হয়েছিলাম খুব, যা ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর নানা বইয়ে ভর্তি।
অ্যাটলাসটি এমনই পুরনো ছিল যে, আফ্রিকার ঠিক মাঝখানটাতে এক বিশাল সাদা দাগ পড়ে গিয়েছিল। সময়ের রহস্য মার্সেল প্রুস্তের হাত ধরে নয়, বরং জেমস ফেনিমোর কুপারের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল আমার কাছে। সে-সময়ে ফেনিমোর কুপারের মতো লেখকেরা সংক্ষেপিত এবং কখনোবা ঈষৎ পরিবর্তিত শিশুতোষ সংস্করণের জন্য খুব জনপ্রিয় ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হরিণহত্যাকারী নামক মহাকাব্যের সব খন্ডই একটি খন্ডে কমিয়ে আনা হয়েছিল। এখনো এ-বই আমাকে আশ্চর্যজনকভাবে বিমোহিত করে, কারণ এটা সত্যি সত্যিই এক তরুণ হরিণ শিকারির কাহিনি, যে ধীরে ধীরে নিজেকে পরিবর্তিত করে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠেছিল, আর তারপর আস্তে-ধীরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে সরে গিয়ে বুড়ো হয়ে গিয়েছিল। তার ট্র্যাজেডি ছিল যে, সে নির্বাসিত ছিল কিন্তু সভ্যতাকে রক্ষা করতে পারেনি। আমি টমাস মেনক রাইডের মতো লেখকদের লেখাও পড়েছি, যাঁদের নাম আমেরিকায় শোনা যেত না। তিনি ছিলেন একজন আইরিশ, যিনি আমেরিকায় একজন শিকারি ও শিক্ষক হিসেবে কিছুকাল বাস করেছিলেন, আর তারপর লন্ডনে বাস করার সময় তিনি শিশুদের লেখক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বইগুলো সকল প্রকার লতাগুল্ম, প্রাণী আর পাখিদের বর্ণনায় ভর্তি, এবং প্রতিটিরই নিজ নিজ লাতিন নামে পরিচয় দেওয়া থাকত। সে-সময়টা ছিল আমার জন্য খুবই সংকটময়, কারণ আমি চেয়েছিলাম একজন পক্ষীবিশারদ হতে। আমি লাতিন নামসহ পাখিদের নাম জানতাম। আমি কার্ল মে-র লেখাও পড়েছি, যিনি সারা ইউরোপে ছোটো বালকদের খুব প্রিয় ছিলেন, এবং ইউরোপের সব ভাষায় তিনি অনূদিত হয়েছিলেন, কিন্তু আমেরিকায় তিনি ছিলেন অজানা। তিনি ছিলেন একজন জার্মান, যিনি দেনাদারের কারাগারে বসে অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস লিখতেন।
পরবর্তীকালে ভিলনিয়াসে বাস করার সময় আমি চলচ্চিত্র দেখেছি। এ বিষয়ে আমার শিক্ষা ছিল সমসাময়িক শিশুদের মতো। ম্যারি পিকফোর্ড, লিলিয়ান গিশ, বাসটার কিটন, চার্লি চ্যাপলিন এবং পরে গ্রেটা গার্বো, সবাই আমাকে মুগ্ধ করত। শৈশবের পাঠ আর অধিক পরিণতির পাঠ শুরু করার মধ্যে পার্থক্য করা আমার জন্য খুবই কঠিন। কিন্তু আমার গ্রামীণ এবং প্রাদেশিক শৈশবকালের জন্য এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর পাঠাগারের ওই ধরণের বইগুলোর জন্য, আমি সে-বইগুলোর মাধ্যমে প্রকৃতির জগতে ঢুকতে পেরেছিলাম, বিশেষত, অডুবোন, আলেকজান্ডার উইলসন প্রমুখের অঙ্কন এবং রঙিন উডকাটের জন্য। এই বইগুলোই প্রকৃতিবিষয়ক আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে গড়ে দিয়েছিল।
প্রশ্ন : প্রকৃতি কীভাবে আপনাকে আকৃষ্ট করল?
মিউশ : আচ্ছা, আমার মহান নায়ক ছিলেন লিনেয়াস; তিনি প্রাণীর নামকরণের একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন এবং এভাবে তিনি প্রকৃতিকে অধিকার করেছিলেন, এ-ধরণের চিন্তা আমার ভালো লেগেছিল। প্রকৃতির প্রতি আমার যে-বিস্ময় তা সৃষ্টি হয়েছিল বৃহদার্থে নাম ও নামকরণের প্রতি আমার আগ্রহের কারণে। কিন্তু আমি একজন শিকারিও ছিলাম। পাখি এবং প্রাণী হত্যার জন্য এক্ষণে আমি গভীরভাবে লজ্জিত। এখন আর আমি এই কাজ কখনোই করব না, কিন্তু সে-সময়ে আমি তা উপভোগ করতাম। এমনকি আমি একজন ট্যাকসিডারমিস্টও ছিলাম। উচ্চ বিদ্যালয়ে, যখন আমার বয়স ধরতে গেলে তেরো কি চোদ্দো বছর, আমি প্রাকৃতিক নির্বাচন-সংক্রান্ত ডারউইনের তত্ত্বগুলো আবিষ্কার করলাম। আমাদের প্রকৃতিবিদদের ক্লাবে ঢোকার আমার সুযোগ হলো এবং আমি সেখানে ডারউইনের ওপর বক্তৃতাও করলাম। কিন্তু সে-সময়ে, যদিও আমাদের ইশকুলটি ছিল একটি রাষ্ট্রীয় ইশকুল, তবু পাদ্রীরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সুতরাং একদিকে আমি ধর্ম, গীর্জার ইতিহাস, হঠবাদ আর দোষস্বীকৃতি শিখছিলাম; আর অন্যদিকে বিজ্ঞানও শিখছিলাম যা মূলত ধর্মকে দুর্বল করত। ইত্যবসরে আমি ডারউইনবাদ থেকে সরে এলাম কারণ তা ছিল নিষ্ঠুর, যদিও প্রথমে তাকে আমি গ্রহণ করেছিলাম। আমার মতে, প্রকৃতি চিত্রকলায় অনেক-অনেক সুন্দর।
প্রশ্ন : প্রকৃতি বিষয়ে একজন প্রকৃতিবিদ আর কবির উপলব্ধির মধ্যে কোনো সংযোগ কি করা যায়?
মিউশ : ডেভিড ওয়াগোনার ‘আমেরিকান পক্ষীবিজ্ঞানের লেখক এক পাখির ছবি আঁকেন যা এখন বিলুপ্ত’ নামে একটি কবিতা লিখেছেন। এটি আমেরিকার একজন প্রধান পক্ষীতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার উইলসনকে নিয়ে লেখা একটি কবিতা, যিনি একটি কাঠঠুকরাকে গুলি করে আহত করেন এবং তাকে রেখে দেন ছবি আঁকার জন্য, কারণ এটা ছিল তাঁর কাছে এক নতুন নমুনা। পাখিটি তাঁর বাড়িতে ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছিল। উইলসন ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, তাঁকে পাখি মারতে হয় যেন তারা বইয়ের পৃষ্ঠায় বেঁচে থাকতে পারে। এটি একটি নাটকীয় কবিতা। সুতরাং বিজ্ঞান ও প্রকৃতির সম্পর্ক, এবং আমি মনেও করি শিল্প ও প্রকৃতির সম্পর্ক হলো বিজ্ঞানী এবং শিল্পী – দুইয়ের একধরণের মনের সহমিলন এইভাবে যে, তাঁদের উভয়েরই জগৎকে অধিকার করার আবেগ-উদ্দীপনা থাকতে হবে। ধর্মীয় কল্পনাশক্তির ক্ষয় দেখে আমি খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, কারণ বিজ্ঞানের অভিঘাত। এটা আমাদের সময়ের দরকারি এক সমস্যার গভীর শিকড়ে যায়, তাহলো, ধর্মীয় সম্পর্ক বিষয়ে সমসাময়িক মানুষের অসামর্থ্য। আমি টমাস মারটনের দ্বারা প্রভাবিতও হয়েছি, যার সঙ্গে অনেক বছর ধরে আমার পত্র-যোগাযোগ হয়েছিল। আমরা প্রায়শই ধর্ম এবং প্রকৃতি নিয়ে আলাপ করতাম। প্রকৃতি-বিষয়ে আশাবাদী একজন হিসেবে এবং মোটাদাগে আমেরিকান দৃষ্টিভঙ্গির জন্য আমি তাঁকে ভৎর্সনা করতাম।
প্রশ্ন : সুতরাং ক্যাথেলিক বিশ্বাস, যাতে আপনি বড়ো হয়েছেন, তা বিজ্ঞানের অভিঘাতকে বাতিল করে?
মিউশ : হ্যাঁ। কিন্তু সমস্যা হলো, বিংশ শতাব্দীতে ধর্মীয় কবিতা লেখা খুবই কঠিন। আমরা বৃহত্তরভাবে এক উত্তর-ধার্মিকতার জগতে বসবাস করছি। বর্তমান পোপের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল, তিনি আমার কিছু কাজের, বিশেষত, ‘পদ্যে ছয়টি ভাষণে’র ওপর মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আপনি এক কদম সামনে যান তো আর এক কদম পেছনে। আমি বলেছিলাম, পবিত্র পিতা, বিংশ শতাব্দীতে একজন আলাদাভাবে কীভাবে ধর্মীয় কবিতা লিখতে পারে?
প্রশ্ন : আর তা শুনে পোপ কী করলেন?
মিউশ : তিনি হাসলেন।
প্রশ্ন : আপনার দ্য ল্যান্ড অব উলরোতে আপনি এ সমস্ত সমস্যা আর আপনার ওপর আপনার বড়ো কাকাতো ভাই অস্কার মিউশের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। আপনার কাজে তাঁর প্রভাব কতটুকু ছিল?
মিউশ : স্টাইলের বিবেচনায় আমি সাবধান ছিলাম যে তাঁর প্রভাব মারাত্মক। তাঁর শৈলী ছিল উত্তর-প্রতীকীবাদী, যার কিছু কিছু আমি মনে করতাম সে-সময় অনুকরণ করা অনুচিত। কিন্তু তাঁর মরমি লেখাগুলো – ‘দ্য এপিস্টল টু স্টোরজ’ এবং ‘দ্য আর্স মাগনা’, যেখানে তিনি বলেছেন, জগৎ অজড় এবং জড় আলোর রূপান্তরণে সৃষ্ট – আমার কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আইনস্টাইনেরও আগে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধারণা করেছিলেন এক আপেক্ষিকতার বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্বে – এক মুহূর্ত যখন কোনো স্থান নেই, বস্তু নেই, কাল নেই; তাঁর কল্পনায় এই তিনটি একই আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ।
প্রশ্ন : আপনি একসময় আইনস্টাইনকে উৎসর্গ করে একটি কবিতা লিখেছিলেন।
মিউশ : আইনস্টাইনের সঙ্গে আমার জানাশোনা ছিল। প্রকৃতপক্ষে বলা যায়, আমি তাঁকে পূজা করতাম। আমার কাকাতো ভাই অস্কার মিউশ বিশ্বাস করতেন যে, আপেক্ষিকতা তত্ত্ব মানুষের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে – বিজ্ঞান, ধর্ম এবং শিল্পের মধ্যে ঐকতান, পুনরায় সম্পর্ক স্থাপনের দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আইনস্টাইনের আবিষ্কারের সদর্থক ফলাফল ছিল নিউটনীয় স্থানকাল অসীম-সংক্রান্ত ধারণাকে বাতিলকরণ এবং স্থান ও কালের আপেক্ষিকতার অবতারণা, যা মহাবিশ্বতত্ত্ব এবং বিগ ব্যাং ধারণার ভিত্তিস্বরূপ। আমি আইনস্টাইনকে গভীর শ্রদ্ধা করতাম। আর এ-কারণেই তাঁকে নিয়ে একটি কবিতা লিখি। ওই সময়ে তিনিও একমত হয়েছিলেন যে, পারমাণবিক বোমার কারণে বিশ্ব ধ্বংস হওয়ার পথেই অগ্রসর হচ্ছে, আর এর একমাত্র সমাধান হলো অস্ত্রশস্ত্রকে নিয়ন্ত্রণের জন্য এক বিশ্ব সংগঠন করা। ১৯৪৮ সালে তিনি এই ব্যাপারে তাড়িত হয়ে একটি লেখা লেখেন এবং তা পোল্যান্ডের রোক্লাউয়ে বুদ্ধিজীবীদের বিশ্ব কংগ্রেসে পাঠিয়ে দেন। কংগ্রেস ছিল স্টালিনের সামরিকীকরণের ঠিক একটা ফ্রন্ট, আর রাশিয়া তা পাঠ করতে আপত্তি জানাল। ঠিক এই সময়ের দিকে আমি আইনস্টাইনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পোল্যান্ডে ফিরে যাব, নাকি বিদেশে থেকে যাব। তিনি মনে করতেন, আমার দেশে ফিরে যাওয়া উচিত, আর এ-ব্যাপারে তিনি খুব অকপট ছিলেন।
প্রশ্ন : তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার ঘটনাটা কেমন ছিল?
মিউশ : ওয়াশিংটনে পোলিশ দূতাবাসে অ্যাটাশে হিসেবে আমি তখন কাজ করছিলাম। পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখব, নাকি ছিন্ন করব – এ-ব্যাপারে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য সে-সময়টা আমার জন্য ছিল এক কঠিন সময়। আইনস্টাইনও আমেরিকায় নির্বাসনে ছিলেন, আর একজন বিশারদ-ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর সঙ্গ আমি কামনা করেছিলাম। একদিন নিউইয়র্ক থেকে সরাসরি ওয়াশিংটন না গিয়ে আমি গাড়ি ঘুরিয়ে প্রিন্সটন চলে এলাম। অবশ্যই আমি জানতাম যে, আইনস্টাইন সেখানে বসবাস করছেন। আমার চরিত্রের ব্যঙ্গাত্মকময়তা সত্ত্বেও আমার প্রকৃতি কাউকে গভীর শ্রদ্ধা এবং ভক্তি করতে চাইত। আইনস্টাইনের সাদা চুল, তাঁর ঝরণা কলম-আটকানো ধূসর সুয়েট শার্ট, তাঁর নরম হাত এবং কণ্ঠস্বর – পিতৃসুলভ ও দিশারীময় এক ব্যক্তিত্বের প্রতি এই সবকিছু আমাকে আকর্ষণ করল। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন মনোমুগ্ধকর ও উষ্ণ হৃদয়ের মানুষ। তিনি আমার অভিবাসী হওয়ার ব্যাপারটিতে আপত্তি জানালেন। আবেগী পর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন, তুমি তোমার দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করো না; একজন কবির তাঁর দেশের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা উচিত। আমি জানি এটা কঠিন, তবু এগুলোকে বদলানো দরকার। এভাবে তারা বেশিদিন চলতে পারবে না। তিনি আশাবাদী ছিলেন যে, এ-শাসনের অবসান হবে। একজন মানবতাবাদী হিসেবে তিনি মনে করতেন যে, মানুষ যুক্তিশীল প্রাণী, যদিও আমার প্রজন্মে দেখা গেছে, মানুষ আসুরিক খেলায় অতিমত্ত। তারপর আমি তাঁর মার্সার স্ট্রিটের বাসা থেকে বের হয়ে কিছুটা অসারভাবে গাড়ি চালিয়ে কোথাও চলে গেলাম। সর্বোত্তম প্রজ্ঞার জন্য আমরা আকুল ছিলাম যারপরনাই, কিন্তু অবশেষে আমরা নিজেদের ওপর আস্থা রাখলাম।
(#)
প্রশ্ন : কখন প্রথম ভাবলেন যে লেখক হবেন?
মিউশ : আমি যখন উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি তখন থেকে আমি লেখা শুরু করি, যদিও তাতে ছিল না নিজেকে প্রকাশ করার কোনো প্রচেষ্টা। তা ছিল ফর্মের অনুশীলন, আর আমার ধারণা এই যে, আমি ষোড়শ শতাব্দীর ফরাসি লা প্লেইয়াদ ঘরানার কবিগোষ্ঠী যথা জোয়াশিম দু বেল্লা, রেমি বেলিউ, পিয়ারে দ রসাঁ প্রমুখের দ্বারা প্রভাবিত ছিলাম, যাঁদের কবিতা আমি পড়েছিলাম ফরাসি টেক্সট বইয়ে। বলা যথার্থ হবে না যে, আমি কবি হতে চেয়েছিলাম। আমি আসলে আমার পরিপার্শেবর সঙ্গে দ্বন্দ্বে মেতে উঠতে চেয়েছিলাম। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, ফ্লবের যাকে বলেছেন বুর্জোয়াদের প্রতি ঘৃণা, আমি একটি স্বতন্ত্র শৈলী চেয়েছিলাম, চেয়েছিলাম ভিন্ন জীবনযাপনের পথ।
প্রশ্ন : ভিলনিয়াস ছিল আপনার যৌবনের শহর, যা বারংবার আপনার লেখায় ফিরে আসে।
মিউশ : এর ছিল এক দীর্ঘস্থায়ী ফলাফল। একটি প্রাদেশিক শহরে বেড়ে ওঠার অনেক সুবিধা আমি দেখি। এটা একধরণের ভিন্ন, সম্ভবত ভালো পরিপ্রেক্ষিত দেয়। যখন আমি বাইরে থাকি, তখন ভিলনিয়াস এবং লিথুয়ানিয়াকে পশ্চিমা পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়, যা কঠিন কাজ, কারণ শহরটি এই শতাব্দীতে তেরোবার হাতবদল হয়েছে। তার নানা জাতীয়তা, গোষ্ঠী, ভাষা নিয়ে তা সারজেভোর মতো। বসনিয়ায় যা ঘটছে তাতে আমি গভীরভাবে তাড়িত হচ্ছি, কারণ আমি এতসব জাতিগত সংঘর্ষ বুঝতে পারি।
প্রশ্ন : সাম্প্রতিক বছরগুলোয় লেখা কবিতায় ইতিহাস-বিষয়ে আপনার অতি কম আগ্রহ দেখা যায়।
মিউশ : হ্যাঁ, নিশ্চয়। পোল্যান্ডের ঐক্যের সময়টাতে, যখন সামরিক আইন ঘোষণা করা হলো, তখন আমি একটি প্রবন্ধ লিখি ‘নোবল মাইন্ডেডনেস, অ্যালাস’ নামে, যাতে আমি সাবধান করেছিলাম যে, মার্শাল ল’র বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ কিছু নিশ্চিত বাগাড়ম্বরের সৃষ্টি করেছে, শিল্প-সাহিত্যে আদর্শমনা নৈতিকতা মারাত্মক, কারণ এটা মানবিক সম্পর্কগুলোকে পাশে রেখে আন্দোলন ও সংগ্রামের দিকে ঘনীভূত হয়। সে-সময়ে বুদ্ধিজীবী এবং চার্চের মধ্যে একধরণের সমঝোতা ছিল, যা অনেক সাহিত্য ও শিল্পসংস্থাকে আশ্রয় দিয়েছিল। আমার প্রবন্ধটি ছিল অনেকটা ভবিষ্যদ্বাণী গোছের, কারণ গত কয়েক বছরে জাতীয় ঐক্য আলাদা হয়ে যাচ্ছিল। তরুণ প্রজন্ম উচ্চ নৈতিক আদর্শের প্রতি কোনো অবস্থান জাগাতে পারল না। আদর্শবাদীদের প্রতি আমার সহানুভূতি ছিল, আর আমি ক্যাথেলিক হিসেবে আমার ধর্মীয় অবস্থান ব্যক্ত করলাম। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চার্চের প্রতি আমার ভালোবাসা কম ছিল।
প্রশ্ন : প্রথমদিকে, জাগারি নামের একটি সাহিত্যিক দলে আপনি ছিলেন, যার বিশ্ববীক্ষা ও কাব্যিক চর্চাকে বলা হতো ‘বিপর্যয়বাদ’।
মিউশ : আমি ছিলাম এই গ্রুপের সহ-স্থপতি। আমরা নিজেদের বিপর্যয়বাদী হিসেবে ভাবতাম না। পরে সাহিত্যের সমালোচকেরা এই নামকরণ করে। ১৯৩১-৩৩ – এ-সময়টা ছিল হতাশার বছর। আমি এখন আশ্চর্য হই যে, নৈরাশ্যবাদের প্রতি কোনো ব্যক্তিগত ঝোঁকেরই কি ফল ছিল ইতিহাসের এক অন্ধকার রূপকল্প, নাকি একজনের নৈরাশ্যবাদই ঐতিহাসিক সময়ের পরিমন্ডলকে প্রতিফলিত করেছিল। যাই হোক না কেন, এটা ইউরোপের জন্য এক ভয়াবহ সময়। হবাইমার জার্মানির সাহিত্য ছিল নাস্তিবাদী, বিদ্রূপাত্মক, ঘৃণায় পূর্ণ। সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ চালুর আগের ১৯২০-এর দিকের সোভিয়েত সাহিত্যও ছিল পুরোপুরি নিষ্ঠুর আর নঞর্থক। তখন সেখানে সেইফুলিনা এবং ইলিয়া এহরেনবার্গের মতো লেখকেরা ছিলেন, যাঁরা সে-সময় পারীতে বসবাস করতেন। এহরেনবার্গের নাস্তিবাদী উপন্যাসগুলো তখন খুব তাড়াতাড়ি পোলিশ ভাষায় অনূদিত হয়ে যেত। সুতরাং সাহিত্যের বিভাবটি ছিল নৈরাশ্যবাদী ও অতি নঞদর্থক। একই সময় রাজনৈতিক খবরগুলো ছিল ভীতিজনক – রাশিয়ায় স্টালিনবাদ চলছে আর জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় এসে গেছে। অবশ্যই এই সবকিছু আমাদের দলকে প্রভাবিত করেছিল। একইভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর মারিয়ান জিকহওস্কি, যিনি ছিলেন একজন বয়স্ক অধ্যাপক আর একজন পাঁড় নৈরাশ্যবাদী। তিনি ফেসিং দ্য এন্ড নামে একটি বই লিখলেন, যেখানে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, ইউরোপ অচিরেই জাতীয়তাবাদ এবং সাম্যবাদ – এই দুই শক্তিতে ধ্বংস হয়ে যাবে। সৌভাগ্যবশত ১৯৩৯ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে তিনি মারা গেলেন। সেখানে নৈরাশ্যবাদী পোলিশ লেখকেরাও ছিলেন, বিশেষত ছিলেন স্তানিয়াভ ইগনাসি ভিৎকিভিজ, যিনি ছিলেন সম্ভাব্য একজন বিপর্যয়কারী। সুতরাং আমাদের কবিতা একধরণের অমঙ্গলের আশঙ্কাকে প্রকাশ করত, যা ছিল ভয়ের একধরণের পরাবাস্তব ভবিষ্যদ্বাণী। এটা ছিল অনেকটা কাসান্ড্রার স্বরের মতো। পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পরিবর্তে আমরা এক মহাজাগতিক বিপর্যয় অনুধাবন করেছিলাম। পরে, ওয়ারশতে নাৎসি দখলদারিত্বের সময়, সেখানে অতি তরুণ কবিদের একটি দল ছিল যাদের কাছে চরমাবস্থা, রহস্যোদ্ঘাটন ছিল নাৎসি দখলদারিত্ব। আমাদের কাছে তা ছিল না; এটা ছিল শুধু এক বিশাল আলেখ্যের অংশবিশেষ।
প্রশ্ন : আপনি ছিলেন ওয়ারশ প্রতিরোধের একজন। নাৎসিবিরোধী একটি গোপন কবিতা সংকলন তখন আপনি প্রকাশ করেন। যুদ্ধের বছরগুলো আপনার কবিতায় কী প্রভাব বিস্তার করেছিল?
মিউশ : কবি হিসেবে আমি তখন বিচলিত ছিলাম, কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, পৃথিবী যেমন ছিল কবিতা তাকে সেভাবে অঙ্কিত করতে পারেনি – আগের ধারণা ছিল ভুল। সুতরাং আমি ভিন্ন কিছুকে খোঁজ করছিলাম। কিন্তু একই সময়ে ছোটো ছোটো কবিতা দিয়ে আমি একটি দীর্ঘ কাজ করি, যার নাম দিই ‘জগৎ (একটি সরল কবিতা),’ এক সিরিজ কবিতা – যদিও সে-সময়ে আমি তা নিয়ে সচেতন ছিলাম না – ব্লেকের ‘সংস অব ইনোসেন্সে’র মতো। পৃথিবীকে আমি এমন ভয়ংকর ভাবতে লাগলাম যে, এই শিশুতোষ কবিতাগুলো ছিল – পৃথিবী যেরকম তা না হয়ে কেমন হওয়া উচিত তার উত্তর। যা ঘটছিল তাকে মাথায় রেখে লেখা ‘জগতে’র কবিতাগুলো ছিল গভীরভাবে শ্লেষাত্মক।
প্রশ্ন : এটাই কি ছিল ‘একটি সরল কবিতা’ উপ-শিরোনামের কারণ?
মিউশ : শিশুদের টেডি বিয়ার গল্পের মতোই কবিতাটি ছিল অতিকাল্পনিক গোছের একটি বই। কিন্তু আমার জন্য অস্বস্তিকর হয়ে গেল যখন সমালোচকেরা এবং পাঠকেরা এগুলোকে প্রেম, বিশ্বাস, আশা-সংক্রান্ত তথাকথিত কবিতা হিসেবে গ্রহণ করে বসল, এবং পোল্যান্ডের ইস্কুলগামী শিশুদের তা পড়ার জন্য ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বসল। যারা ইস্কুলে এই কবিতাগুলো মনেপ্রাণে শিখেছে সেইসব শিশুর কাছ থেকে আমি চিঠি পাই, যে-কবিতাগুলো মজা করে লেখা হয়েছিল।
প্রশ্ন : ‘জগৎ’ নামের সিরিজ কবিতার একটি কবিতায় আপনি লিখেছেন,
‘আমরা আর ফুলেরা পৃথিবীর ওপর ছুড়ে দিই ছায়া
যার ছায়া নেই তার বেঁচে থাকার শক্তিও নেই।’
মিউশ : এই পংক্তিগুলোর পেছনে রয়েছেন টমাস অ্যাকুইনাস। বস্ত্তর নৈর্ব্যক্তিক অস্তিত্বে বিশ্বাসের ওপর তিনি জোর দিয়েছিলেন। এটা একধরণের সরল কবিতা – একটি ফুলের, একটি নদীর, একটি বাগানের বাস্তবতার ওপর বিশ্বাস। ওই সময়ের আমার কবিতাগুলোয় দু’ধরণের অনুসন্ধান রয়েছে : অপাপবিদ্ধ মাধুর্যের অন্বেষণ – সরল কবিতাগুলো – অন্যদিকে, ‘অকিঞ্চিৎকর মানুষের স্বরে’র চক্র, নাৎসি দখলদারির সাথে কীভাবে সরাসরি মোকাবিলা করা যায় তার উপায় অন্বেষণ। তখন আমি বিশুদ্ধ মেজাজের জন্য চীনা কবিতা পড়ছিলাম, এই কবিতায় তার প্রভাবও ছিল।
প্রশ্ন : চীনা কবিতা পাঠে তখন কী ঘটল?
উত্তর : ওয়ারশতে দ্য চায়নিজ ফ্লুট নামে আমি একটি কবিতার সংকলন কিনেছিলাম, যা আদতে চীনা থেকে নয়, বরং ফরাসি ভাষা থেকে করা অনুবাদ ছিল। এসব কবিতায় ছিল খোলামেলা চিত্রকল্প আর বিশেষত ছিল শক্তিশালী রঙ, যা আমি নাৎসি দখলদারিত্বের কালো, লাল এবং অন্ধকার জগতের মধ্যে ঢোকাতে পারতাম। সে-থেকেই কালো ও লাল – এই দুই রঙের সমন্বয় আমার কাছে ভীতিজনক হয়ে রয়েছে।
প্রশ্ন : এশীয় কোন কোন কবি আপনাকে আকর্ষণ করেছে?
মিউশ : সে-সময়ে আলাদা আলাদা করে কবিদের আমি বেশি চিনতাম না। পরে আমেরিকান কবিতায় আমার আগ্রহের কারণে আমি তা জেনে নিই। আপনি জানেন যে, পুরনো চীনা ও জাপানী কবিতার অনুবাদ আমেরিকান কবিতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এক্ষেত্রে এজরা পাউন্ড একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ইমেজিস্টরা এশীয় কবিতা দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিল। সুতরাং, এটা ছিল এক ধীর প্রভাব, আর আমার কিছু কাজের দার্শনিক মুখবন্ধের কারণে তা বিকাশ লাভ করেছিল।
প্রশ্ন : যেমন?
মিউশ : নিছক অতি তত্ত্বসর্বস্বতা আমার পছন্দ নয়, কিন্তু পুরোপুরি আত্মমগ্নতার বিষয়ে আধুনিক কবিতার কিছু নিশ্চিত প্রবণতার প্রতি আমি আমার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছিলাম। এশীয় কবিতায় আত্ম ও পরের মাঝে একটা-কিছু নিশ্চিত বোঝাপড়া পরিলক্ষিত হয়, যা পশ্চিমে খুবই কম দেখা যায়। আমি এমন এক কাব্যিক ঐতিহ্য থেকে আসি যেখানে ইতিহাসের এক বড় ভূমিকা রয়েছে। আমার কবিতা ইতিহাসের ট্র্যাজেডি, নিশ্চিত কিছু প্রধান ঘটনার পরিবর্তনকে অতি মাত্রায় ধরে আছে। মধ্য ইউরোপের ঐতিহ্য হলো, ব্যক্তি এখানে দুর্বল, যা পশ্চিম থেকে আলাদা, যেখানে ব্যক্তির ক্ষমতার ওপর জোর দেওয়া হয়। যখন আমি বিংশ শতাব্দীর বড়ো ট্র্যাজেডিগুলোকে নিয়ে লেখা থেকে সরে গেলাম, তখন আমি চেয়েছিলাম ভারসাম্য পেতে। বিশুদ্ধ ব্যক্তিগত বোধ থেকে আমি লিখতে চাইনি, যা অতিমাত্র আজকালকার কবিতার ধাঁচের – অতি ব্যক্তিগত পরিপ্রেক্ষিত থেকে অবলোকন করা, আর সে-কারণে প্রায়শই তা হয়ে ওঠে অর্থোদ্ধারে কঠিন। আমি বুঝলাম, ব্যক্তির দুর্বলতা কবিতার জন্য শুভ নয়, আর অতি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য কবিতার জন্য বিপদ হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন : অপ্রাপনীয়ের জগতে হুইটম্যানের অনেক কবিতার অনুবাদ অন্তর্ভুক্ত করে তাঁর মতো এক অহংবাদী কবির প্রতি আপনি মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। আপনি তাঁর অস্মিতার প্রকাশকে কীভাবে বিবেচনা করেন?
মিউশ : হুইটম্যান এক অদ্ভুত ব্যাপার, কারণ তিনি এক পার্সোনা বা ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। এই পার্সোনা কথা বলে, যদিও হুইটম্যান এবং এই জটিল পার্সোনার মধ্যে এক সুনির্দিষ্ট পার্থক্য রয়েছে, যাকে তিনি তাঁর কবিতায় মূর্ত করেন, যা একজন কবি, যিনি সরলভাবে বিশ্বাস করেন যে, সবকিছুই যা তিনি একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে অনুভব ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করেন তা পাঠককে আগ্রহী করে তোলে, তা থেকে আলাদা। অবশ্যই হুইটম্যান একজন অতি জটিল কবি, ভালো আর মন্দকে একসাথে মেশান, যাকে আমার কাকাতভাই অস্কার মিউশ বলতেন, মহৎ কবিতার এক প্রেসক্রিপশন।
প্রশ্ন : হুইটম্যানের একজন আধুনিক উত্তরাধিকারী অ্যালেন গিন্সবার্গের প্রতি আপনার শ্রদ্ধা রয়েছে।
মিউশ : আমার ‘অ্যালেন গীন্সবার্গের প্রতি’ কবিতাটি অতি গোলমেলে। কবিতা পাঠের পর তিনি আমার কাছে এসে বললেন, আমার মনে হয় নিজেকে তুমি যেমন করে তুলে ধরো, তেমন সৎ তুমি নও। গীন্সবার্গ সম্পর্কে আমার ধারণা স্ববিরোধী। তাঁর ‘কাদিশ’ এক অর্থে এক ভয়ংকর লেখা, কিন্তু খুবই দুঃসাহসিক। মায়ের পাগলামোর কথা বলা, তার বিভিন্ন অবস্থাকে তুলে ধরা… তা এককথায় অবিশ্বাস্য। আমি সবসময়েই এই ধরণের ব্যক্তিগত হঠকারিতাকে ভৎর্সনা করি। সুতরাং গীন্সবার্গের এই দুঃসাহসে আমি খুবই মর্মাহত এবং কতকটা ঈর্ষাকাতরও বটে। আর তাঁকে নিয়ে লেখা কবিতায় আমি তা-ই প্রকাশ করেছি।
প্রশ্ন : আমি বুঝতে পারছি, আপনি হুইটম্যানের ‘চাকার ফুলকি’ কবিতাটি আপনার অপ্রাপনীয়ের জগতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ-কবিতায় হুইটম্যান অনাদৃত সত্তার অবস্থা কিন্তু একইসঙ্গে একজনের মনোযোগের বিচ্ছিন্ন অবস্থাকে বোঝানোর জন্য ‘আনমাইন্ডেড’ নামের একটি অপূর্ব শব্দ ব্যবহার করেছেন। এ-ধরণের এমন-কিছু-একটা আপনিও আপনার কবিতায় করে থাকেন।
মিউশ : হ্যাঁ। একধরণের ব্যাজোক্তি। আমরা একে বলতে পারি রোমান্টিক ব্যাজোক্তি। একই সময়ে একজন অংশগ্রহণ করে এবং পর্যবেক্ষণও করে : যেন সিঁড়ি থেকে পড়ার সময় একজন এ-অবস্থাকে মজা হিসেবে দেখে। আমি মনে করি, যখন একটি কবিতা খুব সাধারণ মানের হয়, আর তা একপ্রকার আবেগী স্বীকারোক্তির দিকে যায়, তখন আমি কিছু বাড়তি ভাষ্য তাতে যোগ করি, তা কোনো প্রথাগত কায়দাকানুন নয়, বরং এক সততার অন্বেষণ। এ-ধরণের ব্যাজোক্তি আমার লেখায় এমনই প্রয়োজনীয় যে, আমি প্রক্রিয়া থেকে তাকে আলাদা করতে পারি না।
(#)
প্রশ্ন : আপনি আপনার কবিতা ‘কাব্যতত্ত্বে’ বলেছেন, কবিতার উদ্দেশ্যই হলো আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া যে, শুধু একজন অখন্ড মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা কী যে কঠিন।
মিউশ : আমার কবিতাকে বলা হয় বহু-স্বরিক। তার মানে হলো কথনস্বরে আমি পরিপূর্ণ থাকি; একভাবে আমি নিজেকে মাধ্যম বা সরঞ্জাম ভাবি। আমার বন্ধু জীন হার্শ, যে আমাকে কার্ল ইয়াসপার্সের অস্তিত্ববাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, বলে যে, ‘এমন ইনস্ট্রুমেন্টাল ব্যক্তি আমি আর দেখিনি,’ তার মানে হলো, স্বর আমার মধ্যে যাওয়া-আসা করে। এখানে পার্থিব-বহির্ভূত কোনোকিছু নেই, বরং আমার নিজের সাথে কিছু-একটা রয়েছে। এখানে কি আমি একা? আমি তা ভাবি না। নীটশে ও দস্তয়েভস্কিই প্রথম লেখক যাঁরা আধুনিক সভ্যতার সংকটকে চিহ্নিত করেছিলেন এই বলে যে, আমরা প্রত্যেকেই পরস্পরবিরোধী স্বর এবং জড়-তাড়না দ্বারা তাড়িত হই। যখন এসব অতিথি যাওয়া-আসা করে আর তাদের যন্ত্র হিসেবে আমাদের নেয়, তখন একই ব্যক্তি হিসেবে যথাযথ থাকার সমস্যা নিয়ে আমি লিখেছি। কিন্তু খারাপ সত্তা নয়, ভালো সত্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়ার আশা আমাদের থাকতে হবে।
প্রশ্ন : আপনি নিজেকে বলেছেন এক মাধ্যম, কিন্তু সন্দেহপ্রবণ একজন। এর দ্বারা আপনি কী বুঝিয়েছেন? কী অর্থে আপনি এক মাধ্যম?
মিউশ : পেছনে ফিরে তাকালে আমার মনে হয়, সবকিছুই যেন আমাকে লিখতে হুকুম করছিল, আর আমি যেন ছিলাম এক সরঞ্জাম। কিসের সরঞ্জাম আমি জানি না। আমি বিশ্বাস করি, আমি ঈশ্বরের এক যন্ত্র, কিন্তু এটা দুঃসাহসিক একটা ব্যাপার। আর আমি যা-ই হোক না কেন একেই বলতে চাই আমার daimonion। আমি একটি নতুন কবিতা লিখেছি যেখানে আমার এই সম্পর্কটিকে বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রশ্ন : আমরা আবার ফিরে যাই আপনার আগের বছরগুলোর কাছে। ওয়ারশ অভ্যুত্থান এবং নিধনযজ্ঞের আপনি ছিলেন একজন চাক্ষুষ সাক্ষী, কিন্তু এ নিয়ে আপনার লেখা অপেক্ষাকৃত কম।
মিউশ : বিভিন্ন সময়ে আমাকে অনুরোধ জানানো হয় ‘campo dei Fiofi’ কবিতাটি পাঠ করতে, যা লেখা হয়েছিল ওই সময়ের ভোগান্তি নিয়ে। সম্প্রতি ওই সময়ের ঘটনাকে নিয়ে লেখা আমার কবিতাগুলোর পুনর্মুদ্রণের এক অনুরোধ আমি নাকচ করে দিই। আমি চাই না, নিজেকে একজন পেশাগত শোককারী হিসেবে পরিচিত করতে।
প্রশ্ন : আপনি একজন অভিবাসী হিসেবে পারিতে থেকেছেন। ‘Bypassing Rue Descartes’ নামীয় কবিতায় আপনি পারিকে এমন শহর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যেখানে দেখা মেলে অনেক নীতি, যাকে আপনি বলেছেন ‘সুন্দর চিন্তা’, যা একাধারে সরল ও নিষ্ঠুর।
মিউশ : পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা মানুষের জন্য পারি কোনো নিশ্চিত জায়গা ছিল না। দুই পর্যায়ে আমি পারিতে ছিলাম। ১৯৫০ সালে আমি পোলিশ দূতাবাসের একজন অ্যাটাশে ছিলাম আর সে-সময়ে পাবলো নেরুদা এবং পল এলুয়ারের সঙ্গে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। পরের বছর পোল্যান্ডে কমিউনিস্ট শাসনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভেঙে গেলে আমি একজন রিফিউজি হিসেবে সেখানে আবার বাস করতে আসি। সে-সময়ে ফরাসি বুদ্ধিজীবীরা আবার সাম্যবাদ এবং স্টালিনের প্রেমে একবারে মশগুল থাকত। আমার মতো যে-কেউ অসন্তুষ্ট হয়ে পূর্ব ইউরোপ থেকে এখানে এলে তাকে ভাবা হতো পাগল বা আমেরিকার দালাল। ফরাসিরা ভাবত, তাদের তথাকথিত Idées générales সমগ্র বিশ্বের জন্যই বোধহয় প্রযোজ্য। এগুলো ছিল সুন্দর ধ্যানধারণা; কিন্তু একেবারেই অবাস্তব। একই সময়ে ইউরোপের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল হতাশাজনক এবং অস্বস্তিকর; লাখ লাখ মানুষ তখন গুলোকে; তাদের কষ্ট ইউরোপের বাতাস এবং বাতাবরণকে দূষিত করে ফেলেছিল। আমি জানতাম কী ঘটতে যাচ্ছিল। পশ্চিমকে তখনো সলজেনেৎসিনের লেখা গুলাক দ্বীপমালা থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
প্রশ্ন : আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি আপনাকে সমস্যায় ফেলেছিল?
মিউশ : এটা কোনো গোপন কিছু নয়। যখন আমি ওয়ারশতে ফিরলাম, সরকার তখন আমার পাসপোর্ট কেড়ে নিল। কূটনৈতিক চাকরি নিয়ে পারিতে ফিরে যাওয়া তারা চাইল না। শেষ পর্যন্ত তা আমাকে পুরনো অবস্থায় নিয়ে এলো। কিন্তু তখনই আমি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলাম এবং নির্বাসনে চলে এলাম। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজনের অতি আগ্রহী সাম্যবাদী রুশ পত্নী আমাকে বলল, আমার মতে, একজন লেখকের দেশত্যাগ করা উচিত নয়, কিন্তু যেহেতু আপনি অন্যরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন তখন মনে রাখবেন যে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া আপনার দায়িত্ব রয়েছে। কার বিরুদ্ধে? স্টালিন, তিনি বললেন; রাশিয়ার জল্লাদ। এরকম বলা তখন ছিল এক বিপজ্জনক ব্যাপার। কিন্তু আমিও বলার এক বাধকতাকে অনুভব করলাম। আলব্যের কাম্যুর সঙ্গে তখন আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, সে-সময় জাঁ পল সার্ত্র ও তাঁর লোকজন তাঁকে তাড়াচ্ছিল, তাঁকে ধ্বংস করতে চাইছিল কারণ তিনি তাঁর রেবেল গ্রন্থে, অন্য অনেককিছুর সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ছিল বলে উল্লেখ করেছিলেন। কারণ আমার মতে, যারা আমাকে অনুবাদ করতে পারত তারা তা করতে অস্বীকার করল। তারা বলল যে, যদি তারা তা করত তবে তারা একঘরে হয়ে পড়বে। সুতরাং সে-সময় আমি খুব কঠিন অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলাম।
প্রশ্ন : কবিতা কি দর্শনের জন্য যথাযথ ক্ষেত্র?
মিউশ : এটা নির্ভর করে কী ধরণের দর্শন তার ওপর।
প্রশ্ন : আপনার নিজের কবিতার জন্য আপনি কী ধরণের দর্শন পেয়েছেন?
মিউশ : আমার কবিতায় সে-ধরণের দর্শন রয়েছে যা আমাকে রাতে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় আলোতে খরগোশের লাফ দিয়ে পড়ার মতো একটি অবস্থা মনে করিয়ে দেয়। খরগোশ জানে না, কীভাবে আলোকরশ্মি থেকে বের হয়ে যেতে হয়। তাই সে সোজাসুজি সামনের দিকে দৌড়ায়। আমি সে-ধরণের দর্শনে আগ্রহী যা সে-অবস্থায় খরগোশের উপকারে আসবে।
প্রশ্ন : খরগোশের জন্য কোনো আশাই আর নেই। আপনি যখন ছাত্র ছিলেন, সবসময় আপনি আপনার ঝোলায় গির্জার ইতিহাস রেখে দিতেন, আর আপনি মানিকিইজমের মতো বিরুদ্ধ মতেও সুনির্দিষ্টভাবে আগ্রহী ছিলেন।
মিউশ : সাধু, কিন্তু বলা দরকার মানিকিইজম কোনো বিরুদ্ধ মত ছিল না, দীর্ঘকাল ধরে তা একটি প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ছিল। মূলত তা অশুভের এক উল্লেখযোগ্য ক্ষমতাকে স্বীকার করে, আর অশুভ হলো শুভের অভাব – এই ধ্রুপদী ও ধর্মগত ব্যাখ্যাকে প্রতিরোধ করে। সে-সময়ে অশুভের ক্ষমতাকে মানবসমাজের যৌথ সৃষ্টি এবং মানবাত্মার স্বতন্ত্র উপাদান হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকার করা হতো। সমসাময়িক নাস্তিকদের যে যুক্তি – যে এক কল্যাণময় ঈশ্বর এ জগৎ যেমনটি সেভাবে তা সৃষ্টি করতে পারেন না – তা প্রকৃতপক্ষে নব্য-মানিকীয়। যদিও তা একবারেই আমার মতো নয়, তবু আমি স্বীকার করি যে, এটি একটি জোরালো যুক্তি; আমার কবিতাতেও আমি অশুভের অস্তিত্বকে ভালোভাবে সম্পর্কায়িত করেছি। সাইমোন ওয়েল, যিনি একজন অতি পরিণামবাদী, তিনি অশুভের ক্ষমতাকেও স্বীকার করেছেন, যা তাঁর চিন্তার প্রতি আমার আকর্ষণের প্রধান কারণ ছিল। তিনি বলে বসতেন যে, মানুষের মধ্যে কেবল সরষের দানার পরিমাণ শোভনতা আছে।
প্রশ্ন : আপনার ‘গান’ কবিতায় নারীটি আকাঙ্ক্ষা করে ‘অক্ষত একটি বীজ’। আপনি এবং ওয়েল উভয়েই দেখা যাচ্ছে উল্লেখ করছেন মার্কলিখিত সুসমাচারের সেই সরষের বীজকে।
মিউশ : হ্যাঁ, এই ছোট সরষের বীজ হলো ঈশ্বরের রাজ্য, শোভনতা আর শুভত্ব – পৃথিবীর অমঙ্গলের সাথে তুলনা করলে বলতেই হয় ছোট। এটাই ছিল সিমোন ওয়েলের বিশ্বাস। সে-সময়ে আরেকজন লেখক আমাকে আকর্ষণ করেছিলেন, তিনি হলেন লেফ শেস্তোফ, যিনি দেখেছিলেন যে, সমগ্র জগৎ বিশ্ববিধির দ্বারা পরিচালিত। তিনি স্টোয়িকবাদের বিরোধিতা করেন। একজন স্টোয়িক, তিনি প্রাচীন কিংবা আধুনিক যা-ই হোন না কেন, বলবেন হাসিমুখে দুঃখ সয়ে যাও। কিন্তু কেন আমরা তা সইব? শেস্তোভের তত্ত্ব ছিল, আমাদের দ্রোহ করা উচিত, আর্তনাদ নয়! তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ এথেন্স অ্যান্ড জেরুজালেমে গ্রিক স্টোয়িকবাদের বিপরীতে আর্তনাদরত যবকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন।
প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন ঘূর্ণিঝড় থেকে যবকে দেওয়া ঈশ্বরের উত্তর যথেষ্ট ছিল?
মিউশ : না, তা যথেষ্ট ছিল না, যথেষ্ট ছিল না।
প্রশ্ন : যবের ঈশ্বর আর ওল্ড টেস্টামেন্টের ঈশ্বরকে কি আপনি আলাদা ঈশ্বর বলে বিবেচনা করেন?
মিউশ : আমি জানি না। অনুমান করি, আমরা এমন এক রাজ্যে প্রবেশ করেছি যেখানে এসবের কোনো উত্তর নেই।
প্রশ্ন : আদি খ্রীষ্টানত্বের জটিলতা থেকে নস্টিকবাদের জন্ম হয়েছিল, যা বিশ্বাসকে বাদ দিয়ে জ্ঞানের মাধ্যমে পরিত্রাণ পাওয়ার ওপর জোর দিয়েছিল। নস্টিকবাদে আপনার আগ্রহ আপনার কবিতার সঙ্গে কতটুকু সম্পর্কিত?
মিউশ : খ্রীষ্টানত্বের প্রথম শতাব্দীতে নতুন ধর্ম নানাভাবেই শিক্ষিত মানুষের জন্য অসম্পূর্ণ মর্মে প্রতিভাত হচ্ছিল, আর এ-সুযোগেই নস্টিকবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল। নস্টিকবাদ তখন তা-ই করেছিল এখন কবিতা শিক্ষিত লোকের জন্য যা করে। কিন্তু কবিতাকে শুধু নন্দনতত্ত্বে নামিয়ে আনলে হবে না। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই কবিতা হলো নিখিলবিশ্বে মানুষের অবস্থানের অন্বেষণ। মানুষের স্বর্গ থেকে পতনের পর থেকেই মঙ্গল আর অমঙ্গল মানুষের মধ্যে আরোপিত। প্রধান প্রশ্ন হলো : এই মুহূর্তটির আগে আদম এবং ইভ কী অবস্থায় বেঁচে ছিল? দর্শনের মস্ত এবং চরম দুঃসাধ্য এক সমস্যা হলো আদিপাপ। লেভ শেস্তোভ বলেছেন, আর আমিও একমত যে, এটা উল্লেখযোগ্য বস্ত্ততঃ অনেকটাই অনুনমেয় যে, আদিম ধর্মযাজকেরা এমন এক রহস্যময় পুরাণে উপনীত হলো যে, যে-প্রজন্ম আজ পর্যন্ত এর জন্য মেহনত করেছে, তাদের কাছে বিষয়টা অবোধ্যই রয়ে গেল।
প্রশ্ন : কীভাবে এক মঙ্গলের ঈশ্বর পৃথিবীতে অমঙ্গল হতে দেন, এই প্রশ্নটা আপনার কবিতায় একবারেই জড়িয়ে আছে। আমরা কি ঈশ্বরকে যুক্তির ভেতর দিয়ে, কবিতার ভেতর দিয়ে সত্যি বলে প্রমাণ করতে পারি?
মিউশ : শেস্তোভ বলেছেন, পৃথিবীতে এমন প্রশ্ন আছে যেগুলো জিজ্ঞেস করা ঠিক না, কেননা এগুলোর কোনো উত্তর হয় না। সাইমোন ওয়েল এই অসংগতিকে সমর্থন করতে চেয়েছেন এই বলে যে, তা অনধিগম্যতার নৈতিক জোর। আমার সবকিছুই অসংগতিময়, আমি দ্বন্দ্বেই যেন গঠিত, আর এ-কারণেই দর্শন অপেক্ষা কবিতা আমার কাছে লেখালেখির জন্য উৎকৃষ্ট ফর্ম।
প্রশ্ন : ওয়েল ধর্মের এই সাবলীল স্বস্তির বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
মিউশ : তিনি ছিলেন মানবিক দুর্বলতায় সামান্য সহ্যশক্তিসম্পন্ন একজন আপসহীন ব্যক্তিত্ব, অন্ততঃ নিজের সঙ্গে। এক অর্থে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত তপস্বী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অন্তিম দশায় উপনীত রোগী, যে ভাবে যে, সে ভালো হয়ে যাচ্ছে, এইরূপ কাল্পনিক মতিভ্রমতার আসুরিক কাজকে তিনি বাতিল করে দেন। তবে আশ্চর্যজনকভাবে উপশম ঘটবে, এ-ধরণের আশা থাকা অত্যন্ত মানবিক এক ব্যাপার বলা যায়। কেন তাদের বাতিল করা? মানবিক সবকিছুতেই আমাদের এ-ধরণের স্বস্তিকে অনুমোদন করা উচিত।
প্রশ্ন : আপনার বন্ধু উইটোল্ড গোমব্রোভিচ একবার তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘মিউশ দ্বন্দ্ব, যন্ত্রণা, আর সংশয়কে অভিজ্ঞতায় এনেছেন যা আগের লেখকদের কাছে একেবারেই অজানা ছিল।’ আপনি কি এতে একমত?
মিউশ : হ্যাঁ, আমি একমত। তিনি বিশেষভাবে তা উল্লেখ করেছেন আমার দ্য ক্যাপটিভ মাইন্ড বইটি মনে রেখে, আর এ-শতাব্দীর শয়তানের সঙ্গে আমার সংগ্রামকে মনে রেখে – হেগেলীয় ঐতিহাসিক বিশ্ববিধি বিশ্বাস যে, ইতিহাস পূর্বনির্ধারিত রেখা ধরে এগিয়ে যায়। আমি দ্য ক্যাপটিভ মাইন্ড লিখেছিলাম নিজেকে মুক্ত করতে, এ-দর্শনের বিরুদ্ধে যুক্তি খুঁজে পেতে। এজন্যই সম্ভবত তিনি বলেছেন যে, আমার সংগ্রাম আগের লেখকদের কাছে অজানা ছিল।
প্রশ্ন : এই মুক্তিতে কে সহায়তা করেছিল বলে আপনি মনে করেন?
মিউশ : আমার উপন্যাস ইসা ভ্যালিতে রাজনৈতিক কিছুই নেই। ঘটনাটি ঘটে ১৯২২ সালের দিকে লিথুয়ানিয়ার গ্রামে। এক যাজকের এক রক্ষিতা ছিল আর সে একদিন আত্মহত্যা করল, তারপর গির্জাপল্লীতে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সম্প্রতি পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পর প্রথমবারের মতো লিথুয়ানিয়ায় গিয়ে আমি সেই গীর্জা-এলাকা পরিদর্শন করি। আমার যেখানে ব্যাপ্টাইজম হয়েছিল এবং আমার উপন্যাসের অনেক ঘটনা যেখানে ঘটেছিল যা আমি বর্ণনা করেছিলাম উপন্যাসে, সেই একই গীর্জার কাছেই স্থানীয় গোরস্তানে ছিল মেয়েটির কবর। কিন্তু উপন্যাসটি শুধু শৈশবের স্মৃতিরোমন্থন নয়, বরং শয়তান এবং ঐতিহাসিক বিশ্ববিধি ও প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা থেকে নিজেকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষাসংক্রান্ত এক দার্শনিক উপন্যাস।
প্রশ্ন : তখন থেকেই আপনি উপন্যাস লেখাতে অনাগ্রহী হয়ে পড়লেন। দেখা গেল সাহিত্যের এই রীতির সঙ্গে আপনার ঝগড়া লেগে গেল। কেন?
মিউশ : এটি একটি অবিশুদ্ধ ফর্ম। বার্কলিতে আমি বিশ বছর দস্তয়েভস্কি পড়িয়েছি। তিনি একজন জাত ঔপন্যাসিক, সবকিছুই তিনি ত্যাগ করেছেন; সম্মানের কোনো ধার ধারতেন না। উপন্যাসে তিনি সবকিছুই ঠেসে দিতেন। জেনারেল ইভোলগিন নামে একটি চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইডিয়ট উপন্যাসে, যে একজন মিথ্যাবাদী আর গল্প বলে বেড়ায় – কীভাবে সে যুদ্ধে তার পা হারায়, কীভাবে সে তার সেই পাকে কবর দেয়, আর তারপর সে সমাধিফলকে কী লিপি উৎকীর্ণ করে। উৎকীর্ণলিপিটি নেওয়া হয়েছিল দস্তয়েভস্কির মায়ের সমাধি থেকে। এখানে আপনি পাবেন সত্যিকারের একজন ঔপন্যাসিককে। আমি তা করতে পারিনি।
প্রশ্ন : যদিও উপন্যাস নামের রীতিটি আপনার সঙ্গে খাপ খেল না, তবু টমাস মানের ভক্ত ছিলেন আপনি, এমনকি ‘ম্যাজিক মাউন্টেন’ নামে একটি কবিতাও লিখেছেন।
মিউশ : ছাত্রাবস্থায় দ্য ম্যাজিক মাউন্টেন আমাকে মুগ্ধ করেছিল। সেখানে নাফটা নামে একটি চরিত্র আছে যে-একজন জেসুইট যাজক, আলোকপ্রাপ্তির বিরুদ্ধে অবস্থানকারী একজন একচ্ছত্রবাদী। আমি এই চরিত্রে আবিষ্ট ছিলাম। আমার নিজের ছিল বামপন্থী সর্বগ্রাসী প্রবণতা আর সেজন্যই আলোকপ্রাপ্তির বিষয়ে নাফটার সন্দেহের বিষয়টাতে আটকে গিয়েছিলাম আমি। এখন যদিও উপন্যাসে নাফটার প্রতিদ্বন্দ্বী আলোকপ্রাপ্তির চৈতন্যের প্রতিনিধিত্বকারী সেটেমব্রিনির দিকেই আমার পক্ষপাত। কিন্তু মানবতা বিষয়ে আমার অন্তর্দৃষ্টি সেটেমব্রিনির থেকেও অধিক অন্ধকারময়।
প্রশ্ন : অবরোধের সময় আপনি ইংরেজি থেকে পোলিশ ভাষায় এলিয়ট অনুবাদ করেছিলেন। এ-কাজে কেন আপনি আগ্রহী হলেন?
মিউশ : পোড়ো জমির পুরোটাই বিপর্যয়ের উপাদানে ভরা। সে-সময়ে, অধিকৃত ওয়ারশতে, ধসেপড়া শহরের চিত্রকল্পে এর ছিল কিছু সুনিশ্চিত ক্ষমতা। পুড়ে যাওয়া গেটোর আগুনের বিচ্ছুরণ যখন দিকচক্রবালে ছড়িয়ে পড়ত, তখন তা অতিপ্রাকৃত পাঠের সৃষ্টি করত। এটা গভীরভাবে এক শ্লেষাত্মক কবিতা, বা এমনকি বিদ্রূপাত্মকও। এটি আমার চিন্তার সঙ্গে খাপ খায় না। কিন্তু চৌতালে আমরা এমন বিরল ও ব্যতিক্রম একজনকে পাই, যিনি অনেক সংগ্রামের পর শিল্পের মাধ্যমে তাঁর নিজ বিশ্বাসে ফিরে আসতে সমর্থ হন। এলিয়টের সঙ্গে লন্ডনে আমার দেখা হয়, আর তিনি আমাকে উষ্ণ অভিবাদনও জানান। পরে তাঁকে আমি আমেরিকাতে দেখি এবং পোলিশ ভাষায় তাঁর আরো কবিতা অনুবাদ করি।
প্রশ্ন : এলিয়টের মতো আপনিও কি মনে করেন, কবিতা ব্যক্তিত্ব থেকে পলায়ন?
মিউশ : সর্বদাই এটা আমার জন্য এক সমস্যা। সাহিত্য এমন-এক আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নেয় যা সত্যনিষ্ঠ হতে চায় – কোনোকিছুকে লুকাতে চায় না, আর একজনকে অবিকল উপস্থাপন করতে চায় না। তবু যখন আপনি লেখেন তখন কিছু নির্দিষ্ট বাধকতা থাকে, যাকে আমি বলি ফর্মের নিয়মনীতি। আপনি সবকিছু বলতে পারেন না। অবশ্যই এটা ঠিক যে, মানুষ কোনোরকম সংযম ছাড়াই অনেককিছু বলে। কিন্তু কবিতা কিছু সংযম আরোপ করে। তথাপি এমনই মনে হয় যে, আপনি নিজেকে বিস্তৃতভাবে প্রকাশ করতে পারেননি। বই লেখা হয়, তা প্রকাশিত হয় আর ভাবি, ঠিক আছে পরবর্তী সময়ে আমি নিজেকে উন্মুক্ত করব। আর যখন পরের বইটি বের হলো, একই অনুভূতি আমার হয়। আর তারপর জীবন শেষ হয়ে যায়, আর এ-ই ঘটে।
প্রশ্ন : আপনার অনেক কবিতায় স্বীকারোক্তি দৃষ্টিগোচর হয়। আপনি কি মনে করেন এই স্বীকারোক্তি কোনো কিছুকে নির্দেশ করে?
মিউশ : আমি জানি না। আমি কখনো মনোবিকলিত হইনি। মনোরোগচিকিৎসার ব্যাপারে আমি খুব সন্দেহপরায়ণ। আমার স্বপ্ন হলো, ভাষায় সবকিছু প্রকাশ করা আর সবকিছু বলা। কিন্তু সম্ভবত আমি পেরে উঠব না, আর উপরন্তু, কোনোকিছুই তা নির্দেশ করবে না।
প্রশ্ন : আপনার লেখার পদ্ধতিটি কেমন?
মিউশ : আমি প্রতিদিন সকালে লিখি। এক পংক্তি বা দু পঙ্ক্তি যা-ই হোক না কেন, কিন্তু তা সকালে। আমি নোটবুকে লিখি আর তারপর কম্পিউটারে খসড়া করি। লেখার সময় আমি কফি বা অন্য কোনো উত্তেজক কিছু কখনোই নিই না। আমি পরিমিতভাবে পান করি, কিন্তু তা কাজ শেষ হওয়ার পর। সম্ভবত এ-কারণেই নিউরোটিক আধুনিক লেখকদের ইমেজের সঙ্গে আমি খাপ খাই না, কিন্তু কে জানে?
প্রশ্ন : আপনি কি লেখা খুব বেশি মাত্রায় সংশোধন করেন?
মিউশ : এমন কোনো নিয়ম নেই। কখনো পাঁচ মিনিটে একটি কবিতা লেখা হয়, কখনো বা একমাসও লেগে যায়। কোনো নিয়মনীতি নেই।
প্রশ্ন : আপনি কি প্রথমে পোলিশ ভাষাতেই লেখেন, তারপর ইংরেজিতে অনুবাদ করেন?
মিউশ : আমি কেবল পোলিশ ভাষাতেই লিখি। আমি সবসময় কেবল পোলিশ ভাষাতেই লিখেছি, কারণ আমি মনে করি, যখন আমি আমার শৈশবের ভাষাকে ব্যবহার করি, তখনই কেবল আমি আমার ভাষার সেরা কেরামতিটি দেখাতে পারি।
প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন আপনার কবিতা ভালোভাবে অনুবাদিত হতে পারে?
মিউশ : আমি নিজেই আমার কবিতা অনুবাদ করি, তারপর আমার বন্ধুরা, অধিকাংশ সময়েই রবার্ট হাস বা লেনার্ড নাথান, এগুলো সংশোধন করেন। কিন্তু মৌল ছন্দটা আমিই ঠিক করে দিই, কারণ তাঁরা পোলিশ ভাষাটা জানে না। আমি বিশ্বাস করতাম না যে, আমার কবিতা অনুবাদিত হতে পারে। আমি খুবই ভাগ্যবান যে, আমেরিকান পাঠকদের সঙ্গে আমি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি। এসব পাঠকের অর্ধেকই প্রায় হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় উদ্গ্রীব কবি। তারা কবি হিসেবে আমাকে খুবই তারিফ করে। যেমন পোলসের কাছে আমি যে-কোনো কিছুর চেয়ে বেশি এক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব।
প্রশ্ন : আপনি নিজেকে একজন গুহ্য অপ্রচারযোগ্য কবি বলেছেন। আপনি কি পাঠককে চিন্তা করেন না?
মিউশ : আমি সে-ধরণের আদর্শ ব্যক্তিদের জন্যই লিখি যারা ঠিক আমার অন্তরঙ্গ ধরণের। অতিমাত্রায় সহজগম্য হওয়া নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমি দেখি আমার কবিতা কতটুকু যথার্থ, কতটুকু অপরিহার্য। আমি ছন্দোস্পন্দ আর ক্রমকে অনুসরণ করি। আর আমার সংগ্রাম হলো বিশৃঙ্খলা ও শূন্যতার বিরুদ্ধে, যেন আমি যতটা সম্ভব বাস্তবতার নানা ধরণকে ফর্মে নিয়ে আসতে পারি।
প্রশ্ন : সাম্প্রতিক একটি কবিতা ‘মাকড়সা’য়, আপনি কবিতাকে রূপকার্থে বলেছেন, ‘ …সময়ের সীমান্তরেখার ওপারে দাঁড় টানার জন্য/ এক ছোট্ট নৌকা বানানো।’ এভাবেই কি আপনি নিজের কাজকে দেখেন?
মিউশ : আমি খোলস ছাড়ার রূপক ব্যবহার করতে পছন্দ করি, যার অর্থ পুরনো ফর্ম এবং ধারণা বাতিল করা। আমি মনে করি, এটাই লেখাকে উদ্দীপক করে তোলে। আমার কবিতা সবসময়ই ফর্মের এক অধিকতর পরিসরকে অন্বেষণ করে। যে-সমস্ত কবিতার তত্ত্ব নান্দনিক বস্তুকে ঘিরে আবর্তিত, তার সঙ্গে আমার সার্বক্ষণিক দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। যদিও কোনো না কোনোভাবে আমি খুশিই যে, আমার কিছু পুরনো কবিতা লেখার ধরণ আমার থেকে আলাদা হয়েও তাদের নিজের ধাঁচে ভালোভাবেই এখনও অস্তিত্বশীল।
প্রশ্ন : তাহলে যখন একজন কবি বা শিল্পী প্রশংসিত হন এবং উচ্চ ধারণায় অবস্থান করেন, তখন কেন আপনি প্রায়শই সে-বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন?
মিউশ : সমস্যা হলো, জনসাধারণ সাধারণত কোনোরকম দ্বন্দ্ব-সংঘাতহীন এবং জীবন যা দেয় তার চেয়েও অধিকতর বিশাল এক সুন্দর-অঙ্কিত প্রতিকৃতি প্রত্যাশা করে। এই ধরণের প্রতিকৃতি আর বাস্তবতার মধ্যে বৈষম্য থাকে, যা হতে পারে হতাশাজনক। একজন কবি যদি খুব সীমাবদ্ধ বৃত্তে খ্যাতি পান, তাহলে এটারই সম্ভাবনা থাকে যে, তাঁর ভাবমূর্তি বিকৃত হবে না। বৃহত্তর ক্ষেত্রে বিকৃত হওয়ার বেশি ঝুঁকি থাকে।
প্রশ্ন : আপনার নিজের কী ধরণের বিকৃতিকে ব্যাপক সমস্যা বলে মনে হয়?
মিউশ : আমার নীতিবাগীশ ভাবমূর্তি। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর পোল্যান্ডে যখন আমার কবিতার ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল, অনেকের কাছেই আমি হয়ে উঠলাম সেন্সরশিপ থেকে বেরিয়ে আসা এক মূর্ত স্বাধীনতার প্রতীক, আর এজন্যই হয়ে গেলাম এক নৈতিক ব্যক্তিত্ব। আমি জানি না আমি এই ভাবমূর্তিকে ধরে রেখেছি কি না, এটা সম্ভবত আগের তুলনায় একটু হলেও খেলো হয়ে গেছে। এই যে দেখুন (মিউশ তাঁর পকেটে কী-একটা হাতড়ালেন আর একটি পদক পেলেন), এটা পোল্যান্ডের মনুমেন্টের একটি রেপ্লিকা। এর চারটি প্রতীক আছে : পোপ দ্বিতীয় জন পলের সম্মানচিহ্ন, পোলিশ আর্চবিশপের মুকুট, লেস ওয়ালেসার যন্ত্র আর একটি বই, যা আমার প্রতিনিধিত্ব করে।
প্রশ্ন : আপনি তো ভালো সাহচর্যেই আছেন।
মিউশ : বিংশ শতাব্দীর একজন কবির জন্য ভাগ্য খারাপ নয়, বিশেষত মানবসমাজে কবিতার স্থান নিয়ে যেসব খেদ বিদ্যমান তার আলোকে। কিন্তু আমি তা নিয়ে একটু সন্দেহগ্রস্তই। পোলিশ ইতিহাসের বিশাল নৈতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমি চিন্তিত হতে চাই না। একটি নৈতিক জীবনযাপনের সমস্যা হিসেবে শিল্প পর্যাপ্তভাবে প্রতিস্থাপনীয় নয়। আমি আমার চেয়েও বড় কোনো ঘড়ি পরতে ভয় পাই।
প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন, অজানা ও অখ্যাতভাবে কাজ করাই একজন কবির জন্য ভালো?
মিউশ : বহু বছর আমি অজ্ঞাতভাবে কাজ করেছি। বার্কলিতে আমার বছর ও সময়গুলো এমন ছিল যে, এখানে প্রকৃতপক্ষে আমার কোনো পাঠক ছিল না, আর আমেরিকায় এমন মানুষ সত্যিই কম ছিল যাদের বিচারবোধের ওপর আমি ভরসা করতে পারতাম। পারি এবং পোল্যান্ডে আমার কয়েকজন বন্ধু ছিল, সুতরাং পত্র-যোগাযোগ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল : কয়েকজন বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া চিঠিগুলোই ছিল আমার বাঁচার শক্তি। পোলিশ ভাষায় আমার কবিতার বইগুলো বের হচ্ছিল। সেগুলো পোল্যান্ডে বেআইনিভাবে বিক্রি হচ্ছিল, সুতরাং পোল্যান্ডের পাঠকদের প্রতিক্রিয়া জানারও সুযোগ ছিল না আমার তখন।
আমি জানতাম আমি কী, আর আমার মূল্য সম্বন্ধেও আমি ওয়াকিবহাল ছিলাম, কিন্তু বার্কলিতে, অবশ্যই এক্ষেত্রে স্লাভিক ভাষার অধ্যাপকেরা ছাড়া, আমার প্রায় সকল সহকর্মীর কাছেই আমি ছিলাম অজ্ঞাত। এক অখ্যাত বিভাগের এক অখ্যাত অধ্যাপক ছিলাম আমি। যখন আমি দস্তয়েভস্কি পড়াতে শুরু করলাম, তখনই আমি ছাত্রদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠলাম। এ-সময়টাকে বোঝার জন্য একটি গল্প রয়েছে। জার্সি কোজিনস্কির সঙ্গে স্ট্যানফোর্ডে এক সাহিত্যিক নৈশভোজে আমি ছিলাম, আর অবশ্যই তিনি তখন বিখ্যাত একজন। সেখানে কোজিনস্কির ভক্ত একজন ভদ্রমহিলা ছিলেন যিনি টেবিলে আমার কাছেই বসেছিলেন। তিনি ভদ্রভাবে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কী করি। আমি বললাম, আমি কবিতা লিখি। তিনি তখন কর্কশভাবে বলে উঠলেন, সবাই কবিতা লেখে। আমি বেশি কিছু মনে করলাম না, কিন্তু ঘটনাটি এখনো আমাকে কষ্ট দেয়। তখনকার বছরগুলোতে আমার অবস্থা, আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার দুঃখকষ্টের ব্যাপারটা এ-ঘটনায় ধরা পড়ে।
প্রশ্ন : তুলনামূলকভাবে আপনার অধিকসংখ্যক পাঠককে আপনি কীভাবে বিবেচনা করেন?
মিউশ : অনেক বছর আগে একসময় ছিল যখন মানুষকে আনন্দ দিত, এমন ধরণের লেখার জন্য আমি স্বীকৃতি পেয়েছিলাম। কিন্তু সে-সময় অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। যখন আপনি রাজনৈতিক কবিতা লিখবেন, যেমনটা আমি যুদ্ধের সময় লিখেছিলাম, তখন সবসময় আপনার কবিতার খদ্দের থাকবে। যে-স্বীকৃতি আমি পাই, তার জন্য আজকাল আমি আশ্চর্য হই এবং অস্বস্তিতেও ভুগি। কারণ আমি জানি যে, এই সাড়া খুব খাঁটি, আর এজন্য নয় যে, আমি নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত। অপরদিকে, আমি মনে করি না যে, নোবেল পুরস্কার আমাকে বা আমার কাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
প্রশ্ন : ওয়ালেস স্টিভেনসের ধারণা অনুযায়ী, আধুনিক কবিতা হলো ‘প্রয়োজনকে খোঁজার লক্ষ্যে মনের ক্রিয়ার কবিতা’, কীভাবে আপনি একে দেখেন?
মিউশ : সাহিত্য ও কবিতা এখন বৈজ্ঞানিক চিন্তাপ্রণালী এবং অভিজ্ঞতালব্ধ চিন্তাপ্রণালীর মারাত্মক চাপের সম্মুখীন। স্টিভেনসের মর্মভেদী এবং ব্যবচ্ছেদী যে-মন, আমি মনে করি তা কবিতায় প্রয়োগ করা ভুল। আমরা যদি স্টিভেনসের ‘স্টাডি অফ টু পিয়ার্স’ কবিতাটিকে নিই তাহলে দেখব, অন্য, এক গ্রহ থেকে এক প্রাণী নাশপাতিকে যেন বা মঙ্গল গ্রহের মতো মনে করে বর্ণনা করার চেষ্টা করছে। এই হলো ব্যবচ্ছেদ। আমি মনে করি, পৃথিবীর বস্তুরাশিকে ব্যবচ্ছেদ না করে বরং গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। বস্তুুর প্রতি এ-ধরণের নিস্পৃহ মনোভাব যে-কেউ ওলন্দাজ স্টিল লাইফ চিত্রকলায় খুঁজে পাবেন। শোফেনহাউয়ার একেই শিল্পের সর্বোচ্চ রূপ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এ-ধরণের গভীর চিন্তা জাপানি হাইকু কবিতাতেও দেখা যায়। বাশো বলেছেন, পাইন গাছ নিয়ে লিখতে গেলে তোমাকে পাইন থেকেই শিখতে হবে। জগৎকে ব্যবচ্ছেদ করার চেয়ে তা এক সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। আমি মনে করি, শোফেনহাউয়ার প্রকৃতপক্ষে কবিদের, শিল্পীদের দার্শনিক।
প্রশ্ন : কেন?
মিউশ : কারণ তিনি দূরত্বের প্রয়োজনের ওপর জোর দিয়েছেন। জগতে কাজ করতে গিয়ে আমরা জঘন্য আবেগের চক্রে পতিত হই – আপ্রাণ চেষ্টা আর সংগ্রাম করি উদ্ধারের জন্য। ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রের দ্বারা শোফেনহাউয়ার প্রভাবিত হয়েছিলেন; তাঁর কাছে স্বাধীনতা মানে হলো শাশ্বত জন্ম-মৃত্যুর চক্রের বাইরে দাঁড়ানো। শিল্পও হলো এই ঘুরন্ত চাকার বাইরে দাঁড়ানো যেন আবেগ ও অভিপ্সামুক্ত হয়ে আর নিশ্চিত নিরাসক্তি নিয়ে কোনো বস্তুর দিকে আমরা অগ্রসর হতে পারি। নিস্পৃহ গভীর চিন্তনের দ্বারাই জীবনের সংরাগকে দূর করা যায়, যা শিল্পের এক ভালো সংজ্ঞার্থ : ‘নিরাসক্ত গভীর চিন্তন’। এ কারণেই শিল্পসংক্রান্ত শোফেনহাউয়ারের নির্যাস হলো স্টিল লাইফ। ডাচ স্টিল লাইফ।
প্রশ্ন : দুটো কবিতায়, একটি হলো ‘রাজা রাওকে’, যা ছিল এক কথোপকথনের জবাব, আর একটি সাম্প্রতিক কবিতা যার নাম ‘ক্যাপরি’, আপনি প্রকৃত বর্তমানের জন্য, ইন্দ্রিয়ের দেবত্বরহস্যের জন্য অপেক্ষার উল্লেখ করেছেন। এটা কি এ-ধারণাই দেয় যে, কবিতা হলো এমন এক সংস্কারাত্মক কাজ যার মাধ্যমে আমরা এই বর্তমানকে আহ্বান করতে পারি?
মিউশ : হ্যাঁ, ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, যে-জগৎকে আমরা জানি তা এক গভীর বাস্তবতার বল্কল, আর এই বাস্তবতাই এখানে বিরাজমান। শুধু শব্দে একে সীমাবদ্ধ করা যায় না, আর এ-জায়গাতেই এ-শতাব্দীর কিছু লেখকের সঙ্গে আমার অমিল। এটা এমন এক ধরণের পার্থক্যের মতো, যখন একজন ভাষাকে, অন্তর্গত জীবনকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে, আর অন্য একজন যে আমার মতো শিকারি, মনস্তাপিত হয় এ-কারণে যে, বাস্তবতাকে ঠিক পাকড়ানো যায় না।
প্রশ্ন : লারকিনের ‘প্রভাতসংগীত’ কবিতাটি আপনার কেমন লাগে যেখানে তিনি মতামত উপস্থাপন করেন যে, ধর্ম হলো এক ধরনের চাতুরী আর তাকে বলেছেন,
‘এটি বিশাল এক শুঁয়াপোকা খাওয়া সাংগীতিক কিংখাব
এই ছলনায় সৃষ্ট যে আমরা কখনো মরব না?’
মিউশ : আমি লারকিনের ‘প্রভাতসংগীত’ কবিতাটি পড়েছি, এটি আমার কাছে মনে হয়েছে একটি জঘন্য কবিতা। আমি লারকিনকে পছন্দ করি না। তিনি ছিলেন একজন দারুণ কারিগর বা ক্রাফ্টসম্যান, বস্ত্ততই এক্ষেত্রে অতি ভালো একজন। রচনাশৈলীর অধিকারী হিসেবে আমি তাঁকে অতিউচ্চাসন দিই, কারণ তিনি আমার এ-ধারণাকে যথাযথভাবে প্রত্যয়িত করেন – ঠিক শুধু ভাবগত সংবেদনকে বিবেচনা না করে পরিষ্কার অর্থময়তাসহ স্পষ্টভাবে কবিতা লিখতে; কিন্তু আমি তাঁর কবিতা পছন্দ করি না, তিনি পছন্দের জন্য অতি লক্ষণাত্মক।
প্রশ্ন : লক্ষণাত্মক কার প্রতি?
মিউশ : বর্তমান, মারাত্মক বিশ্বদর্শন, বা weltanschauung(জীবনবেদ)-এর লক্ষণযুক্ত। আমার মনে হয় তাঁর কবিতায় কোনো প্রকাশ নেই। এমনকি তাঁর চিঠিগুলোও তাঁর বন্ধুদের হতাশ করে কারণ এগুলো বিদ্বেষময়, বিশেষত কালো, ভারতীয়, পাকিস্তানী এবং অন্যদের প্রতি জাতিবিদ্বেষাত্মক। তিনি ছিলেন অতি হতাশ এবং অতি অসুখী বেপরোয়া একজন মানুষ। শূন্যতার প্রতি একধরণের আকাঙ্ক্ষার অভিপ্রায় তাঁর ছিল যা ছিল জীবনবিরোধী, যা তাঁকে বেশি কিছু দেয়নি। আমি শঙ্কিত যে, শিল্পে নৈতিক মানদন্ড প্রয়োগের রেওয়াজকে আমরা একেবারেই হারিয়েছি। কারণ যখন কেউ আমাকে বলে যে লারকিন বড়ো কবি, আর তা যদি তখন মানবিক মূল্যবোধকে বাদ দিয়ে ভালো কবিতা লেখার জন্য ঢের হয়ে যায়, তখন আমি সন্দেহবাদী হয়ে উঠি। বোধহয় এ-ই আমার শিক্ষা ও প্রবৃত্তির ভাষ্য। আমার মন্ত্র হলো ইসসার এই হাইকুটির মতো –
‘নরকের ছাদে আমরা হাঁটি
পুষ্পের দিকে তাকিয়ে।’
শ্লেষে বা ব্যাজোক্তিতে পড়ার জন্য তা অতি খেলো। এই শূন্যতা ও হিংস্রতা, যা লারকিনের weltanschauung(জীবনবেদ)-এর ভিত্তি, তা গ্রহণীয় হবে তার ওপর ভিত্তি করে যদি আপনার কাজ কিছুমাত্রায় আলোমুখী হয়।
প্রশ্ন : আচ্ছা, ভাষা কতটা নিবিড়ভাবে জগৎকে অধিকার করতে পারে?
মিউশ : ভাষা সবকিছুকে অধিকার করতে পারে না, বা তা আবার বিশুদ্ধ খেয়াল-মাফিকও নয়। কিছু নির্দিষ্ট শব্দের, শুদ্ধ প্রথাগত ব্যবহার অপেক্ষা, গভীর অর্থময়তা থাকে। সুতরাং তাকে লেখার জন্য, ভাষা খেয়াল-মাফিক – এ-ধারণাকে আমি বাতিল করি। আমি ভাষার ভেতরে বা তার বিষয়ে লিখতে গিয়ে তাকে écriture-এ নামিয়ে আনতে পারব না।
প্রশ্ন : প্রভিন্সেস কাব্যগ্রন্থের একটি গদ্যকবিতা ‘আ ফিলোসোফারস হোমে’ আপনি ঈশ্বরের প্রতি আরোপ করেছেন ‘একজন ফোটো-সাংবাদিকের আবেগোদ্দীপ্ত উদ্দীপনা।’ এটা কি প্রমাণ হিসেবে ঈশ্বরের আদর্শকে বর্ণনা করে, আর এটা কি সে-আদর্শ যা একজন কবি করতে চায়?
মিউশ : হ্যাঁ। তথাপি আমার বলা উচিত যে, একজন কবি হলেন পনিরের মাঝে এক ইঁদুরের মতো, যে খাওয়ার জন্য কতটুকু পনির আছে এই ভেবে উত্তেজিত। আমি বলেছি যে, হুইটম্যান এমন একজন কবি, আমার ওপর যার খুব শক্তিশালী প্রভাব ছিল। হুইটম্যান সবকিছুকেই কাজে লাগাতে চাইতেন, সবকিছুকেই তাঁর কবিতায় ধরতে চাইতেন, আর আমরা তাঁর অন্তহীন শব্দপ্রবাহকে ক্ষমা করতে পারি, কারণ তিনি যতটা সম্ভব ব্যাপক বাস্তবতাকে কাজে লাগানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। অনুমান করি, এটা কোনো না কোনোভাবে আমার মৃত্যুর পর জীবনের প্রতিচ্ছায়ার সঙ্গে সম্পর্কিত, যা ব্লেকের ভাষায় – ‘অন্তহীন শিকার।’
প্রশ্ন : কবিতা আপনার কাছে ‘বাস্তবের সংরাগময় পশ্চাদ্ধাবন’? আপনি কখনো কি আপনার কাজের মাধ্যমে এ-‘বাস্তব’কে অর্জন করতে পেরেছেন?
মিউশ : বাস্তব যার দ্বারা আমি বুঝিয়েছি ঈশ্বর, তা সবসময় অতলস্পর্শী।
——————————————-
[ সংগৃহীত ও সম্পাদিত।
কৃতজ্ঞতা ও ঋণস্বীকার –
১).কুমার চক্রবর্তী।
২). (মতিন বৈরাগী -১৬ই সেপ্টেম্বর ২০১২.)
arts.bdnews24.com
৩). অংকুর সাহা। ]