পোড়ামাটির স্বপ্নকাব্য
” রানিসায়র”—– মাকরা পাথরের চ্যাট্টানের মাঝে টলমলে স্ফটিকের মতো জলভর্তি এক টুকরো স্বপ্ন। রুক্ষতার এর মাঝে এক টুকরো সবুজ। স্থানীয় লোকের কথায়” বাঁধ”! পাডে বেশ কটা তালগাছ। আড বাঁশির মন কেমনিয়া সুরের জাদুতে সারা বাঁধ পাড যেন কাঁদছে। হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পডে রঘু সদ্দার। সূত্রধর পাড়ার মোড়ল ই নয় ও এ তল্লাটের নামকরা মন্দির কারিগর— সবার কথায় উস্তাদ শিল্পী ভাস্কর! যার খোঁজে এই বাঁধ পাডে এসেছে সে ওর মা বাপমরা একমাত্র নাতি —শ্যাম! সত্যিই যেনো কষ্টি পাথরের মূর্তির মতো চেহারা আর বাঁশিও বাজায় কৃষ্ণের মতোই মনমুগ্ধকর। রঘুর সবকিছুর উত্তরাধিকারী ও। স্থাবর সম্পত্তিও শিল্পের অমোঘ উত্তরাধিকার —-দুটোতেই! সকাল থেকেই ছেলেটা ঘরছাড়া !আজ বিষ্ণুপুর থেকে এক জোতদারের ঘরে আমন্ত্রণ এসেছে নতুন দেব দেউল নির্মাণের —শ্যামরায় মন্দির! বুড়ো রঘুর খুব ইচ্ছে এই মন্দিরের অলংকরণ শ্যামের হাতেই হোক। এটা ঠিকঠাক করলে ওকে দলের সাথে বিষ্ণুপুররাজের মন্দির গড়ার কাজে পাঠিয়ে দেবে। রঘু “বিষ্ণুপুর থাকে” র শিল্পী! রাঢ়বঙ্গের মন্দির শিল্পীদের মধ্যে এই থাকের খুব খ্যাতি। ফৌজদার উপাধিধারী শিল্পীরা শুধু মাটি নয় চতুর্বিধ বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। মাটি কাঠ পাথর ও চিত্র রচনা তাদের অধিগত ছিল। সোনামুখী বহুলাড়া বালসী লোকপুর বৈতাল এদের কেন্দ্র। রঘুর শিষ্যদের মধ্যে শ্যামের মতই আরও 5 জন আছে তারা এইসব অঞ্চলের বাসিন্দা খালি একজন হুগলির আরামবাগের মানুষ। আরামবাগ ও মন্দির শিল্পীদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
রঘু সরদারের চমক ভাঙ্গে একটা মিঠেল স্বরে— ও দাদা তুই এখানে ক্যেনে গো? কার খুঁজে এস্যেছ? রঘু মুখ ফিরিয়ে দেখে—” গিরি”—ফৌজদার দের বিটি। কোমরে কলসি কাঁধে গামছা রানিসায়ের এসেছে স্নানে। পিছনে ওর সহচরীরা আসছে কল কল করতে করতে। বড় চটুল মেয়েটা। যৌবনের গরবে টলমল করছে— বড় মুখরা! রঘু কোন কথা না বলে এগিয়ে যায় মেঠো পথ ধরে। একটু এগোতেই দেখে শ্যাম তাল গাছের গুড়িতে পিঠে রেখে একমনে সুর সেধে যাচ্ছে। ওর পায়ের শব্দে চোখ খোলে দাদাকে দেখে একমুখ হাসিতে ঝলমল করে উঠেছে ছেলেটা। বলে –দাদা তুই কেন এলি এখানে? পিছন থেকে গিরির চটুল গলা ভেসে আসে— তোর লাতি রাধিকার জন্য বসে আছ্যে গ্য। শুনছনি বাঁশি কি বলতিছে! রঘু বলে—- বিষ্ণুপুর থেকে ডাক এসেছে শ্যামরায় মন্দির গড়ার— সিংহ দের বাড়িতে! কোন কথা না বলে দাদার সাথে চুপ করে ফিরে চলে শ্যাম—-রঘুর স্বপ্নের কারিগর।
কদিন পরের কথা। রঘু ও ওদের থাকের কজন বয়স্ক শিল্পী বিষ্ণুপুর লাগোয়া “বাঁধ পাড়া “গ্রামের জমিদার বীর বিক্রম সিংহের ভদ্রাসনে হাজির হয়। কায়স্থ জমিদার। উনার মা শ্যামানন্দ প্রভুর কাছে মন্ত্র দীক্ষা নিয়েছেন। বৃন্দাবন থেকে কষ্টিপাথরের শ্যামরায় কে রাধাসহ নিয়ে এসেছেন। তাঁরই মন্দির স্থাপন করবেন। বড সাধ মনের মতো করে সাজাবেন মন্দিরটিকে তাই রঘুকে ডাকা। জমিদারের একমাত্র সন্তান এক কন্যা সবাই বলে রাইমনি। রাধারানীর মতোই গৌরী ,পান পাতার মত মুখ ,একঢাল কালো রেশমী চুল !বড় নরম মনের মানুষ। এত দূর থেকে শিল্পীরা এসেছে পথশ্রমে ক্লান্ত তাই “রাইমনি “এদের খাবার বন্দোবস্ত করে। শ্যাম অবাক চোখে চেয়ে থাকে জমিদারকন্যার দিকে। দাদুর ডাকে সম্বিত ফিরে ওর ।দাদা বলে—- এভাবে দেখতে নাই !ওযে” রাইমনি” ভাই ! শ্যাম লজ্জা পায়।
মাকডা বা ঝামা পাথরের ছোট এক রত্ন মন্দির। মন্দির স্থপতিরা কাঠামো গড়ে চলে গেছে এবার অলংকরন এর কাজ করবে রঘুও শ্যামরা। পঙ্খ ও টালি দিয়ে দুভাবেই অলংকরণ করবে ভাবে শ্যাম। দাদা পুরো স্বাধীনতা দিয়েছে তাকে এই মন্দিরের ব্যাপারে।
রাত গভীর—— বাহির মহলের দালানে একা একা বসে বাঁশিতে ফুঁ দেয় শ্যাম! বুক মুচড়ে ওঠে বাঁশির করুণ আর্তিতে। অন্দরমহলের দোতালার ঝরোখায় এক ছায়ামূর্তি কে দেখা যায়। বাঁশির সুর যেন অজগরের নাগপাশ এর মত তাকে টেনে এনেছে। দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। একদিন দুপুরে ঠাকুর দালানের উঠোনে মাটি ছানছে শ্যাম ।দাসী এসে খবর দেয় “বড়মা” এসেছেন শিল্পীর সাথে কথা বলবেন !শ্যাম তটস্হ হয়ে ওঠে। ওর সামনে এসে দাঁড়ান বীরবিক্রমের মা “জগদম্বা দেবী।” তসরের থান পরিহিত এক উজ্জ্বল মাতৃমূর্তি! মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে শ্যাম! বড়মা বলেন —বসো।তুমি আমার নাতির বয়সী হবে তাই ভাই বলছি। এই মন্দির আমার রাইয়ের শ্যামরায়ের। তাই এর সাজ রাইয়ের মনের মত হওয়া চাই। বৃন্দাবনে রাস মণ্ডল এর মত এখানেও যেন রাস মণ্ডল এর চিত্র থাকে। মাথা নাড়ে শ্যাম ।উজ্জ্বল হাসিতে মুখ ভরে ওঠে—- বড় মা যে ওর মনের কথাই বলেছেন— “রাই য়ের শ্যামরায়”! ওর কল্পনার মন্দির চোখের সামনে ভেসে ওঠে! বড় মার স্বরে ও বাস্তবে ফেরে—– রাইয়ের বিয়ে সামনে সনে !এ বছরের মধ্যেই শ্যামরায় মন্দির যেন সম্পূর্ণ হয় ভাই!
শুরু হয় এক স্বপ্ন রচনার। তরুণ শিল্পীর প্রথম মনের মাধুরী মেশানো শিল্পকর্ম। এক একদিন গভীর রাতে যখন সে বাঁশিতে সুর তোলে বেশ বুঝতে পারে কেউ একজন তাকে লক্ষ্য করছে অন্তরাল থেকে। মনে মনে হাসে শ্যাম ।আপন মনের মাধুরী দিয়ে সে বানিয়ে চলে রাস মণ্ডল এর, নৌকা বিলাস ,দশাবতারের টালি। এবার চুন-সুরকির গাঁথনি দিয়ে মন্দিরের গায়ে বসিয়ে দিতে হবে তা।কাজ প্রায় 90% হয়ে গেছে। শেষ দফার কাজ চলেছে এখন। সবশেষে একটা “রাধাকৃষ্ণ” টালি তৈরি করে শ্যাম। চোখের সামনে যে জীবন্ত রাইকিশোরী কে সে দেখেছিলো তারই প্রতিচ্ছবি এই টালি গুলিতে তুলে এনেছে সে।
ধীরে ধীরে রাত শেষ হয়। পূব দিগন্ত রাঙ্গা হয়ে দিনমণির উদয় হচ্ছে। বৃদ্ধ শিল্পী রঘু আসে তার শিষ্যের কাজের পরিদর্শনে। শ্যাম দাদার হাত ধরে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় মন্দিরের সামনে— দেউল প্রাচীরের রাস মণ্ডল রাধাকৃষ্ণের মোটিফের টালি জ্বলজ্বল করছে। মুগ্ধ গুরু দুহাত বাড়িয়ে শিষ্যকে বুকে টেনে নেয়। দাদার বুকে মুখ লুকিয়ে শ্যাম বলে—- দেখো দাদা “রাইয়ের শ্যামরায় ” ঠিক সাজিয়েছি তো? গুরুর চোখের জলে অভিষিক্ত হয় শিষ্যের মাথা! অস্ফুটে উচ্চারণ করে “জয় শ্যামরায়”! সমাপ্তি ঘটে এক পোড়ামাটির কাব্যগাথার।