পূর্বপার্বতী (Purbaparvati) : 04
ছিলামুক্ত তীরের মতো ছুটে চলেছে লিজোমু। পায়ের তলা দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে চড়াই উতরাই। সরে যাচ্ছে উপত্যকা আর মালভূমি। এক টিলা থেকে আর এক টিলার ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে সে। পায়ের নিচে ছিটকে যাচ্ছে পাথর, এবড়োখেবড়ো রুক্ষ মাটি, আর অস্ফুট চেতনার ওপর সাঁ সাঁ করে ছুটে ছুটে যাচ্ছে কতকগুলো মুখ, কতকগুলো ভাবনার রেখা। সেঙাই! খোকে! মেহেলী!
খোনকেকে সর্দার ফেলে দিয়েছিল গভীর খাদের ভেতর। খোনকের সঙ্গে সঙ্গে লিজোমুর জীবন থেকে পাহাড়ী পুরুষের প্রেম কি একেবারেই মুছে গিয়েছে? না, না। টিজু নদীর এপার থেকে সে অনেকবার দেখেছে সালুয়ালা গ্রামের যৌবনকে। সেঙাইকে। এক বিচিত্র নেশায় তার আধফোঁটা মনটা সেঙাইর রূপে আবিষ্ট হয়ে ছিল। তা ছাড়া, মেহেলীর কাছে সেঙাই-এর কথা অনেক শুনেছে। তার পাহাড়ী মন বার বার দোল খেয়েছে। কিন্তু সেদিন তার জীবনে ছিল খোকে। লিজোমুর সেঙাইমুখী দেহমন খোকের পিরিতে সোহাগে একটু একটু করে নিভে গিয়েছে। তার অস্ফুট বন্য মনটা আর দু’টি পিঙ্গল চোখ ভরে খোনকে কাল পর্যন্ত বেঁচে ছিল। কিন্তু আজ আর নেই খোকে। খোনকে যদি নাই রইল পৃথিবীতে, তবে কি তার উদ্দাম যৌবন ব্যর্থ হয়ে যাবে? পাহাড়ী কুমারীরা পিরিত করবে, মনের মানুষের সঙ্গে ঘর বাঁধবে, সমাজকে ভোজ খাওয়াবে। আর সে-ই শুধু পুরুষহীন জীবন নিয়ে জ্বলে পুড়ে খাক হবে? না, না। খোকের দাম সে আদায় করবে সেঙাই-এর কাছ থেকে।
সেও পাহাড়ী মেয়ে। প্রয়োজন হলে পুরুষের যৌবনকে অন্যের কামনা থেকে ছিনিয়ে আনতে পারে। তা ছাড়া, সে পুরুষ যদি সেঙাই হয়। মেহেলী তার চোখের সামনে কেলুরি গ্রামের যৌবনকে ভোগ করবে, তা হয় না। তা হতে পারে না। অন্তত খোনকেহীন এই জীবনে লিজোমু তা সহ্য করবে না। খোনকে যদি নাই রইল, পাহাড়ী যৌবনের দাবি কি তবে চরিতার্থ হবে না? খোনকে নেই, কিন্তু তার কামনার আগুন অন্য পুরুষের দেহেও রয়েছে। খানকে নেই, কিন্তু তার ব্যগ্র আলিঙ্গন অন্য কারো দু’টি বাহুর মধ্যে থাকতে পারে। আর সে দেহ, সে বাহু যদি সেঙাই-এর হয়। সালুয়ালা গ্রামের শত্রুপক্ষ সেই পুরুষকে তার চাই।
কখন যে বিশাল খাসেম গাছটার তলায় এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল লিজোমু, খেয়াল ছিল না। চারিদিকে একবার চনমনে চোখে তাকাল। অনেক চড়াই উতরাই, অনেক টিলা উপত্যকা ডিঙিয়ে এসেছে। ঘন ঘন নিশ্বাসে বুকখানা উঠছে, নামছে।
চারপাশে বেলাশেষের রং নিভে আসতে শুরু করেছে। রোদ সরে গিয়েছে দূরের পাহাড়চূড়ায়।
আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না লিজোমু, তরতর করে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে ওপরের ঘরে চলে এল।
পাটাতনের ওপর উবু হয়ে বসে ছিল সেঙাই। চমকে উঠল, কে? কে রে, মেহেলী এসেছিস নাকি?
ময়াল সাপিনীর মতো লিজোমু হিসহিস করে উঠল, কেন? মেহেলী ছাড়া আর কোনো জোয়ান মাগী নেই সালুয়ালাঙ বস্তিতে?
কে তুই?
আমি লিজোমু। কেন তুই আমার পিরীতের মরদটাকে মেরেছিস সেঙাই?
ঘরের মধ্যে আবছা অন্ধকার। আতামারী পাতার চালের ফাঁক দিয়ে বেলাশেষের খানিকটা ঝাপসা রং এসে পড়েছে। কেমন যেন রহস্যময় হয়ে উঠেছে পরিবেশটা।
গলাটা এবার কেঁপে উঠল সেঙাই-এর, কে তোর পিরিতের মরদ?
খোনকে।
খোকে! সেঙাই চেঁচিয়ে উঠল।
হু-হু, খোকে। তুই খোকেকে মেরেছিস। আমার জোয়ান নাগরটা মরেছে, তার দাম দিতে হবে। আবছা অন্ধকারেও লিজোমুর চোখদুটো যেন জ্বলছে।
কী দাম দেব? শিউরে উঠল সেঙাই, আমাকে মারিস না। কাল রাত্তিরে আমি খাদে পড়ে গিয়েছিলাম। খুব লেগেছে। সারা গা কেটেকুটে ফালাফালা হয়ে গেছে।
না, তোকে মারতে আসিনি সেঙাই। খোনকের জানের দাম তুই নিজে। তুই আমার লগোয়া পন্য (প্রেমিক) হ। তোকে আমি চাই। সেঙাই-এর পাশে অন্তরঙ্গ হয়ে বসল লিজোমু।
তোকে আমি চাই না। মেহেলী কোথায়? তামুনুর (চিকিৎসক) কাছ থেকে আমাকে ওষুধ এনে দেবে বলেছিল, এখনও এল না তো? ছিটকে পাটাতনের আর এক পাশে সরে গেল সেঙাই। তরপর ক্রুদ্ধ গলায় বলল, তোকে আমি চাই না। তুই ভাগ।
আমাকে চাস না! বেশ, তা হলে খোকেকে ফেরত দে। আমার তো আর পিরিত করার মরদ নেই। সাপের মাথার মণির মতো লিজোমুর চোখ দুটো দপদপ জ্বলছে, তুই আমার হ। আমাকে তোর সঙ্গে নিয়ে যা তোদের বস্তিতে।
আমি পারব না।
পারবি না? মেহেলীর সঙ্গে পিরিত করতে পারবি, আর আমার সঙ্গে পারবি না! তোকে পারতেই হবে। বলতে বলতে সেঙাই-এর আরো কাছে সরে এল লিজোমু। গাঢ় গলায় বলল,
তুই আমাকে পিরিত করবি কিনা বল?
না।
তবে খোনকেকে মারলি কেন?
আমার ঠাকুরদাকে তোরা অনেক কাল আগে মেরেছিস। তার শোধ তুললাম। তবু আপশোশ রইল। খোনকের মাথাটা আমাদের মোরাঙে নিয়ে যেতে পারলাম না। শেষ দিকে কেমন যেন বিমর্ষ শোনালো সেঙাইর গলাটা।
বেশ, শোধবোধ হল। এবার আমাকে তোর লগোয় লেন (প্রেমিকা) করে নে।
না।
না! আমার সঙ্গে পিরিত করবি না! তা হলে মনে রাখিস সেঙাই শয়তান, আমার চোখের সামনে মেহেলীর সঙ্গে তোর পিরীত জমতে দেব না। তোকে আর তোদর বস্তিতেও ফিরতে হবে না। আমি এখুনি সদ্দারকে ডেকে আনছি। পাটাতনের ফোকর দিয়ে বাঁশের সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে দেল লিজোমু।
এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে রইল সেঙাই। আচমকা তার শিরায় শিরায় চমক খেলে গেল যেন। নিষ্ক্রিয়তা দেহমন থেকে ঝরে গেল। সে জানে, লিজোমু যেই তাদের সর্দারকে খবর দেবে, সঙ্গে সঙ্গে এই গাছের চারপাশে তীরধনুক আর বর্শার ফলায় মৃত্যু ছুটে আসবে। নাঃ, কোনোমেতেই লিজোমুকে নামতে দেওয়া হবে না খাসেম গাছের মগডালের এই ছোট ঘরখানা থেকে। সাঁ করে পাটাতন থেকে মেহেলীর একখানা মেরিকেতসু তুলে নিল সেঙাই। তারপর তাক করে ছুঁড়ে মারল।
অব্যর্থ লক্ষ্য। ধারাল অস্ত্রটা লিজোমুর কোমল বুকের ওপরে গেঁথে গেল। ফিনকি দিয়ে টকটকে তাজা রক্ত বাঁশের পাটাতন ভিজিয়ে দিতে লাগল। আর্তনাদ করে ঘরের মধ্যেই লুটিয়ে পড়ল লিজোমু, আ-উ-উ-উ–
ইতিমধ্যে একটা বাঁশের পানপাত্র তুলে নিয়েছে সেঙাই। সেটা দিয়ে লিজোমুর দেহের ওপর একটার পর একটা আঘাত দিয়ে চলল। অবিরাম, বার বার।
খানিক পর লিজোমুর দেহটা একেবারেই নিস্পন্দ হয়ে গেল। এবার থামল সেঙাই। লিজোমুকে এই ঘর থেকে ছেড়ে দিলে তার নিজের মৃত্যু ছিল অনিবার্য।
পাটাতনের ফোকর দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল সেঙাই। পাহাড়ী উপত্যকা থেকে দিনের আলো মুছে গিয়েছে। অন্ধকার নেমে আসছে উত্তর পাহাড়ের চূড়ায়। আসন্ন রাত্রির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা বিচিত্র চিন্তা খেলে গেল সেঙাই-এর মাথায়।
জা কুলি মাসের রাত্রি অনেক গম্ভীর হয়েছে। প্রথম প্রহর পার হয়ে গিয়েছে খানিকটা আগে।
হো-ও-ও-ও-আ-আ—
হো-ও-ও-ও-আ-আ–
আচমকা সালুয়ালা গ্রামটা কেঁপে কেঁপে উঠল। অজস্র জোয়ানের গর্জনে শিউরে উঠল হিমাক্ত অন্ধকার।
পেন্যু কাঠের অনেকগুলো মশাল অন্ধকারকে ফালাফালা করে ছুটে আসছে খাসেম গাছটার দিকে। মশালের আলোতে বর্শার ফলাগুলো ঝকমক করে উঠছে। উদ্দাম গতিতে ছুটে আসছে একটা পাহাড়ী ঝড়। জোয়ান মানুষের ঝড়। মাথায় তাদের মোষের শিঙের মুকুট। পরনে মানুষের মুণ্ডু-আঁকা পী মুঙ কাপড়। দুচোখে হত্যার প্রতিজ্ঞা।
একেবারে সামনে রয়েছে সালুনারু আর বুড়ো সর্দার।
সর্দার গর্জে উঠল, কোথায় সেঙাই? কেলুরি বস্তির শয়তান আমাদের খোনকেকে মেরেছে। মুণ্ডু ছিঁড়ে মোরাঙে ঝুলিয়ে রাখবে আজ। ইজা হান্টাসা সালো।
সালুনারু বলল, তবে বুঝব সদ্দার তোর মুরোদ। শুধু কি খোকেকে কুঁড়েছে হুই সেঙাই, মেহেলীর সঙ্গে পিরিতও জমিয়েছে। তার ঘরে রাত কাটাতে এসেছে এ বস্তিতে। গাছের মাথায় মেহেলীর ঘরে আছে টেফঙের বাচ্চাটা।
হো-ও-ও-ও-আ-আ–
শোরগোল উদ্দাম হয়ে উঠেছে। রীতিমতো ধুন্ধুমার। সালুয়ালা গ্রামের জোয়ানেরা কি জানত, জা কুলি মাসের এই রাত্রিটা তাদের জন্য এমন একটা হত্যার সুযোগ নিয়ে আসবে?
হো-ও-ও-ও-আ-আ–
খাসেম গাছটার চারপাশ ঘিরে ধরল জোয়ান ছেলেরা। পাহাড়ী মাটির ভাঁজে মশালগুলো পুঁতে দিল। অন্ধকার যেন চারপাশে জমাট বেঁধে গিয়েছে। আর সেই কঠিন অন্ধকার চিরে চিরে মশালের শিখা জ্বলছে। মশালের আলোগুলির চারিদিক ঘিরে গুঁড়ো গুঁড়ো সাদা বরফ ঝরছে। জা কুলি মাসের অসহ্য হিমাক্ত রাত্রি। কিন্তু আদিম এক হত্যার নেশায় সালুয়ালা গ্রামের জোয়ানেরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই হিমঝরা রাত্রি তাদের বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারছে না।
হো-ও-ও-ও-আ-আ—
উত্তেজিত গলায় কে যেন বলল, কি রে সদ্দার, কী করব এবার?
আরো একটা গলা শোনা গেল, আমি কিন্তু সেঙাই-এর মুণ্ডুটা কাটব।
না, আমি, আমি। সর্দারের কাছে সকলেই এক দাবি জানাল; তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল।
চুপ কর টেফঙের বাচ্চারা। আহে ভু টেলো। মাথা ঝাঁকিয়ে বুড়ো সর্দার ধমকে ওঠে। বুকের ওপর সাপের হাড়ের মালাটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। মাথায় মোষের শিঙের মুকুট দুলতে লাগল। রক্তচোখে জোয়ানগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বুড়ো সর্দার বলল, কেউ উঠে হুই ঘর থেকে শয়তানের বাচ্চাটাকে ছুঁড়ে নিয়ে আয়।
উত্তেজনায় একজন সিঁড়ির দিকে ছুটে গেল। তার ডান হাতের মাথায় একটা অতিকায় খারে বর্শা। বাঁ হাত দিয়ে সিঁড়ির বাঁশ চেপে ধরল জোয়ানটা। আচমকা পেছন থেকে আর একজন দুহাতে কোমর জড়িয়ে ধরে টেনে নামিয়ে দিল তাকে, কি রে টেফঙ, মরতে যাচ্ছিস নাকি? ওপর থেকে সেঙাই যদি বর্শা হাঁকড়ায়, তখন? •
তাই তো, এই কথাটা আগে ভেবে দেখেনি কেউ। ওপর থেকে সেঙাই যদি বর্শা চালায়, তবে টুপ করে একটা পাকা খাসেম ফলের মতো নিচে পড়ে যাবে। নির্ঘাত মৃত্যু।
বুড়ো সর্দার জ্বলন্ত চোখে খাসেম গাছের মগডালে আতামারী পাতায় ছাওয়া ছোট্ট ঘরখানার দিকে তাকিয়ে রইল।
আচমকা সালুনারু বলল, উঠলে নির্ঘাত বর্শা দিয়ে খুঁড়বে সেঙাই। বর্শা চালাতে ও ভারি ওস্তাদ। তার চেয়ে পুড়িয়ে মার।
হো-ও-ও-ও-আ-আ–
হো-ও-ও-ও-আ-আ–
ছোট্ট সালুয়ালা গ্রামটা পাহাড়ী মানুষগুলোর অনবরত চিৎকারে শিউরে উঠতে লাগল। খাসা বুদ্ধি জুগিয়েছে সালুনারু। সকলে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সায় দিল, হুস্থ, সেই ভালো।
বুড়ো সর্দার বলল, কিন্তু আগুন ধরাব কেমন করে?
টেনে টেনে ব্যঙ্গভরা গলায় সালুনারু বলল, এই বুদ্ধিতে সদ্দার হয়েছিস! বাঁশের ডগায় মশাল বেঁধে আগুন লাগিয়ে দে।
চুপ কর শয়তানের বাচ্চা। আমার বুদ্ধি নেই? খেঁকিয়ে উঠল বুড়ো সর্দার, কিন্তু খেকানিটা ভয়ানক শোনল না। মনে মনে সে সালুনারুর খাসা মগজের তারিফ করল। অরপর জোয়ানদের দিকে তাকিয়ে বলল, যা, বাঁশ নিয়ে আয় খানকয়েক।
হো-ও-ও-ও-আ-আ–
খাসেম গাছের চারপাশে যে পাহাড়ী ঝড়টা এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিল, এবার সেটা উপত্যকার দিকে সাঁ সাঁ করে নেমে গেল।
একটু পরেই খানকয়েক বাঁশ কেটে নিয়ে এল জোয়ানেরা। তারপর সেই বাঁশের ডগায় মশাল বেঁধে বুড়ো সর্দারের দিকে তাকাল।
বুড়ো সর্দার বলল, এবার হুই ঘরে আগুন লাগিয়ে দে।
হোও–ও–ও-আ-আ–
আকাশের দিকে দিকে জোয়ানদের গলা থেকে ভয়ানক চিৎকার উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মশালগুলো মেহেলীর ঘরখানার দিকে উঠে গেল।
হো-ও-ও-ও-আ-আ–
আতামারী পাতার চালে আগুন লেগেছে। চারপাশ থেকে লকলকে জিভ মেলে ঘরখানাকে ঘিরে ধরেছে অগ্নিশিখা। ফট ফট শব্দে বাঁশ ফাটছে। লতার বাঁধন ছিঁড়ছে। খড়ের দেওয়াল পুড়ে যাচ্ছে। খাসেম গাছের মগডালে নিষ্ঠুর আগুন, আর সেই সঙ্গে এই আদিম হত্যার উল্লাসে সালুয়ালা গ্রামের অজস্র জোয়ান একটানা চিৎকার করে চলেছে, হো-ও-ও-ও-আ-আ-, হো-ও-ও-ও-আ-আ–
আচমকা এই আগুন আর নিচের এই চিৎকারকে চমকে দিয়ে একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শোনা গেল। খাসেম গাছের ডালে জ্বলন্ত ঘরখানা থেকে সেই আর্তনাদ জা কুলি মাসের হিমাক্ত রাত্রিটাকে যেন দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে ফেলতে লাগল, আ-উ-উ-উ-আ–
হো-ও–ও–ও-আ-আ—
নিচে পাথুরে মাটিতে জোয়ানেরা চেঁচাচ্ছে। খাসেম গাছের মগডালে এই মৃত্যুকে তারা উপভোগ করছে, লাফাচ্ছে, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে নাচছে। নাচতে নাচতে সকলে দলা। পাকিয়ে যাচ্ছে।
বীভৎস গলায় বুড়ো সর্দার বলল, শয়তানের বাচ্চাটা মরছে। আমাদের বস্তির জিতই রয়ে গেল। সেঙাইর ঠাকুরদাকে অনেক কাল আগে আমরা মেরেছি। এবার সেঙাইকে মারলাম। হোঃ—হোঃ—হোঃ–
শত্তুর মরল। আজ রাত্তরে কিন্তু ভোজ দিতে হবে সদ্দার। জোয়ান ছেলেরা নতুন করে হল্লা শুরু করে দিল।
দেব, নিশ্চয়ই দেব রে শয়তানের বাচ্চারা। আজ আমাদের কী আনন্দের দিন! সকলের কাছ থেকে একটা করে শুয়োর নিয়ে মোরাঙে খাওয়া হবে।
হোও-ও-ও-আ-আ–
খাসেম গাছের মগডালে আগুন ক্রমশ নিভে আসছে। আতামারী পাতার ছোট্ট ঘরখানা পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।
একসময় সকলে খাড়া উপত্যকা বেয়ে চলে যেতে শুরু করল। এই খাসেম গাছের তলা থেকে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে মশালের শিখাগুলো। শুধু ভয়াল শোরগোলের বেশটা এখনও ভেসে আসছে, হো-ও-ও-ও-আ-আ–
একটা বড় সাপেথ ঝোঁপের কিনার থেকে এই আগুন, এই হত্যা আর জোয়ানদের ভয়ঙ্কর উল্লাস দেখছিল পলিঙা আর মেহেলী। খাসেম গাছের মগডালে ওই আগুনের মতোই চোখ দুটো জ্বলছিল তার, কিন্তু কোনো উপায় ছিল না। সামনে এগিয়ে এলে সেঙাইর সঙ্গে তাকেও পুড়ে ছাই হয়ে যেতে হত। সর্দারের ক্রোধ তাকে ক্ষমা করত না।
শুধু মেহেলীর দু’টি নিরুপায় চোখের দৃষ্টি দেখছিল, কেমন করে সেঙাই নামে এক রমণীয় পুরুষ আতামারী পাতার ঘরে পুড়ে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে একসময় তার হাতের মুঠি থেকে নাকপোলিবার মন্ত্রপড়া ওষুধ ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ল।
মেহেলী তাকাল পলিঙার দিকে। জ্বালাভরা গলায় বলল, দেখলি পলিঙা, কেমন করে সদ্দার পুড়িয়ে মারল সেঙাইকে!
সাপেথ ঝোঁপটার পাশে পাথরের মতো জমাট হয়ে গিয়েছিল পলিঙা। মেহেলীর কথাগুলো তার অবশ দেহটাকে ঝকানি দিয়ে গিয়েছে, হু-হু, এ হুই সালুনারু শয়তানীর কাজ।
চোখদুটো সাপের মণির মতো দপদপ করছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে ভয়ানক গলায় গর্জে উঠল মেহেলী, হু-হু। দেখিস, হুই সালুনারুর কলিজা ফেঁড়ে আমি রক্ত খাব। কেলুরি বস্তি থেকে এখানে এসে শয়তানি শুরু করেছে।
একটা আস্ত ডাইনি হুই মাগী। দেখছিস না, কেমন করে এ বস্তির সদ্দারকে হাত করে নিয়েছে।
আমার কেমন যেন লাগছে পলিঙা। হুই সেঙাইটা মরে গেল, ওরা পুড়িয়ে মারল। হুই সদ্দার, হুই সালুনারু, হুই জোয়ান ছোকরারা, কাউকে আমি রেহাই দেব না। আমার পিরিতের মরদকে ওরা পুড়িয়ে মারল পঙিলা; এর বদলা আমি নেব। প্রতিহিংসায় মেহেলীর চোখমুখ উগ্র হয়ে উঠল। প্রতিটি রক্তকণা যেন তার দাউ দাউ করে জ্বলছে। দু’টি পিঙ্গল চোখের মণি চৌচির করে, তামাভ দেহের প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে ফালা ফালা করে সেই রক্তের কণিকাগুলো যেন ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
অনাবৃত দেহ। দুজনের সারা শরীরে সামান্য আচ্ছাদনও নেই। জা কুলি মাসের হিম নির্মম হয়ে উঠেছে। তবু মেহেলী কি পলিঙার এতটুকু সাড় নেই। সেঙাই-এর বীভৎস মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দু’টি পাহাড়ী যুবতী দৈহিক যন্ত্রণার সবরকম বোধের বাইরে চলে গিয়েছে।
মেহেলী ভাবল, এর বদলা তার নিতেই হবে। প্রতিহিংসা ছাড়া তার মনে আর কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই এই মুহূর্তে।
হঠাৎ মেহেলী চিৎকার করে উঠল, এখন কী করি বল তো পলিঙা? সেঙাইকে না পেলে শরীরে জ্বলুনি কমবে না আজ। কত আশা করেছিলুম, যাতে সেঙাই না ভাগতে পারে, তার জন্যে ডাইনি নাকপোলিবার কাছ থেকে চারটে বর্শা আর দুখুদি ধান দিয়ে ওষুধ নিয়ে এলাম। সব হুই সালুনারু মাগী নষ্ট করে দিল।
মেহেলীর আরো কাছাকাছি ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল পলিঙা। তারপর প্রথামতো তার বুকের ওপর হাতখানা রেখে বলল, কী আর করবি। মোরাঙের একজন জোয়ানকে ধরে লগোয়া পন্যু (প্রেমিক) বানিয়ে নে। সেঙাই যখন নেই তখন আর কী করা যাবে?
না, না। সেঙাই-এর মতো একটা জোয়ানও কি আছে আমাদের বস্তিতে? সব এক একটা ধাড়ী বাঁদর। টেমে নটুঙ। দপদপ করে জ্বলে উঠল মেহেলীর চোখ দুটো।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। জা কুলি মাসের কৃষ্ণপক্ষ সমস্ত আকাশের দিকে দিকে নিবিড় অন্ধকার ছড়িয়ে দিয়েছে। এদিকে সেদিকে দু-চারটে তারা মিটমিট করছে।
একসময় মেহেলী বলল, একবার গাছে উঠে আমার ঘরটা দেখব পলি? কাল অত উঁচু থেকে খাদের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। সেঙাই কিন্তু তখনও মরেনি। আজও তো নাও মরতে পারে।
চল, চল—
দ্রুত পা চালিয়ে খাসেম গাছটার নিচে চলে এল মেহেলী আর পলিঙা।
মেহেলী বলল, তুই এখানে দাঁড়া। আমি দেখে আসি।
বাঁশের সিঁড়িটা খুবই মজবুত। কাঁচা আতামারী লতার কঠিন বাঁধন আগুনে তেমন পোড়েনি। তরতর করে একটা বনবিড়ালের মতো ওপরে উঠে এল মেহেলী।
আতামারী পাতার চাল পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। বাঁশের পাটাতনের ওপর স্থূপাকার হয়ে রয়েছে ঘরপোড়া ছাই। আর সেই ছাইয়ের নিচে রক্তাভ আগুন এখনও একবারে নিভে যায়নি। দু হাত দিয়ে রাশি রাশি ছাই আর অঙ্গার সরিয়ে দেহটা খুঁজে বার করল মেহেলী। জ্বলন্ত অঙ্গারের আলোতে বীভৎস দেখাচ্ছে। চামড়া আর মাংস পুড়ে সমস্ত শরীরটা ঘেয়ো ঘেয়ো হয়ে গিয়েছে।
হাতড়াতে হাতড়াতে পোড়া দেহটির বুকে আচমকা ঝলসানো স্তনের আভাস পেল মেহেলী। সঙ্গে সঙ্গে একটা চমক খেলে গেল মেরুদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে। সমস্ত ইন্দ্রিয় একসঙ্গে যেন ঝঙ্কার দিয়ে উঠল। এ তো সেঙাই নয়!
খাসেম গাছের মগডালে পাটাতনের ওপর থেকে চিৎকার করে উঠল মেহেলী, এই পলিঙা, ওপরে উঠে আয়। সেঙাই এখানে নেই, একটা মাগী পুড়ে মরেছে। সে যে কে, অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারছি না।
সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ওপরে উঠে এল পলিঙা। মেহেলীর পাশে নিবিড় হয়ে বসল। চোখমুখ থেকে তার বিস্ময় ঠিকরে বেরুচ্ছে, কী ব্যাপার মেহেলী! সেঙাই মরেনি! বলিস কী?
বলছি ঠিকই। হু-হু, এই দ্যাখ।
অঙ্গারের রক্তাভ আলোতে মেহেলী আর পলিঙা অনেকক্ষণ ঝলসানো নারীদেহটির দিকে তাকিয়ে রইল। একসময় পলিঙা বলল, এ নির্ঘাত লিজোমু! এই দ্যাখ মেহেলী, বাঁ হাতের দুটো আঙুল নেই। আমাদের বস্তিতে লিজোমুরই তো বাঁ হাতের আঙুল দুটো কাটা। তাই না?
হু-হু। ঠিক, ঠিক।
কিন্তু লিজোমু এখানে এসেছিল কেন?
কী জানি!
জা কুলি মাসের রাত্রিতে দু’টি পাহাড়ী যুবতী মুখোমুখি বসে রইল। কথা বলছে না কেউ। একেবারে চুপচাপ।
চারপাশে পোড়া ঘরের স্তূপাকার ছাই। মেহেলী কি পলিঙার অস্ফুট পাহাড়ী মন সমস্ত বিচার দিয়ে, সমস্ত বুদ্ধি দিয়ে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারছে না। কেন, কেন খাসেম গাছের মগডালে এসে একটু একটু করে ঝলসে মরল লিজোমু। মেহেলী কি পলিঙা জানে না, কেমন করে সেঙাই নামে একটা নিষিদ্ধ কামনার দিকে খারিমা পতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে এসে পড়েছিল লিজোমু। কিন্তু সে কামনা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেল। সে কামনা একটু একটু করে পুড়িয়ে মারল লিজোমুকে।
পলিঙা বলল, সেঙাই নেই তো এখানে?
না, আমি ভালো করে খুঁজে দেখেছি।
সে তবে গেল কোথায়? এক মুহূর্ত চুপচাপ কেটে যাবার পর কী যেন ভেবে নিল পলিঙা, তারপর বলল, সেঙাই নিশ্চয় ভেগেছে। এক কাজ করি আয়, লিজোমুকে আমরা খাদে ফেলে দিই। নইলে সদ্দার কাল সকালে খোঁজ নিলে লিজোমুকে পেয়ে যাবে। তারপর সেঙাই আর তোর ওপর খেপে উঠবে। সদ্দারকে তো জানিস।
ঠিক বলেছিস।
একটু পরেই লিজোমুর পোড়া দেহটা কাঁধের ওপর তুলে নিচে নেমে এল মেহেলী আর পলিঙ। তারপর কয়েকটা টিলা ডিঙিয়ে খাড়াই খাদটার পাশে এসে দাঁড়াল।
মেহেলী বলল, সেদিন সদ্দার দাদাকে খাদে ফেলে মারল। আজ লিজোমুটা পুড়ে মরল। বেঁচে থাকলে ওদের বিয়ে হত।
কথা বলল না পলিঙা। মাথাটা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সায় দিল।
একটুক্ষণ দুজনেই চুপ।
পলিঙা বলল, এবার লিজোমুকে ফেলে দিই।
একটি মাত্র মুহূর্ত। লিজোমুর ঝলসনো দেহটা শূন্যে পাক খেতে খেতে অতল খাদে মিলিয়ে গেল। একটি দুর্দান্ত পাহাড়ী কামনা জা কুলি রাত্রির অন্ধকারে চিরকালের জন্য মুছে গেল।
পোকরি কেসুঙের কাছে চলে এসেছে পলিঙা আর মেহেলী।
মেহেলী বলল, লিজোমুর কথা কাউকে বলিস না পলিঙা।
, তেমন সই আমি না। যা, এবার ঘরে যা। আমিও যাই। বড্ড খিদে পেয়েছে। সামনের একটা বড় টিলার দিকে উঠে গেল পলিঙা।
আর ভীরু ভীরু পা ফেলে পোকরি কেসুঙের সীমানার মধ্যে এসে পড়ল মেহেলী। এখান থেকে পরিষ্কার নজরে আসছে, বাইরের ঘরে পেন্যু কাঠের মশাল জ্বালিয়ে মুখোমুখি বসেছে তার বাপ আর তাদের গ্রামের সর্দার। সামনে রোহি মধুর পূর্ণ পানপাত্র। কাঠের বাসনে খানিকটা ঝলসানো মাংস। সর্দার আর তার বাপের বসবার ভঙ্গিটি বড় ঘনিষ্ঠ, বড় অন্তরঙ্গ।
মোষ বলির হাড়িকাঠটা পেছনে রেখে সতর্কভাবে বাঁশের দেওয়ালের পাশে এসে দাঁড়াল মেহেলী। দেহের সমস্ত শক্তিকে কান আর দু’টি চোখের মণিতে জড়ো করে রুদ্ধশ্বাসে শুনতে লাগল।
সর্দার বলল, তোকে একটা শুয়োর দিতে হবে সাঞ্চামখাবা।
মেহেলীর বাপের নাম সাঞ্চামখাবা। তারিয়ে তারিয়ে সে রোহি মধুর পাত্রটাকে শেষ করে আনছিল। এবার মুখ তুলল, কেন? শুয়োর দিতে হবে কেন?
আজ শত্রুর পুড়িয়ে মেরেছি। হুই কেলুরি বস্তির সেঙাইকে শেষ করেছি। মোরাঙে একটা ভোজ হবে না? বুড়ো সর্দার আরো নিবিড় হয়ে বসল। তারপর খাসেম গাছের মগডালে সেঙাইকে পুড়িয়ে মারার আদ্যোপান্ত কাহিনী বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলল।
হু-হু, নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু সেঙাইটা কে?
হুই কেলুরি বস্তির ছেলে। তোর পিসি নিতিৎসুকে ছিনিয়ে নিতে এসে যে মরেছিল সেই জেভেথাঙের নাতি। কানের নিয়েঙ গয়না দুলিয়ে দুলিয়ে বলল বুড়ো সর্দার।
লাফিয়ে উঠল সাঞ্চামখাবা, বেশ করেছিস সদ্দার। পুড়িয়ে মেরে ঠিক করেছিস। একটা কেন, দুটো শুয়োর দেব আমি।
হু-হু। জানিস, হুই সেঙাই ছোকরা তার মেয়ের পিরিতের জোয়ান ছিল। ফুর্তি করার জন্যে খাসেম গাছের ঘরে তাকে পুষে রেখেছিল তোর মেয়ে। খবর পেয়ে একেবারে জ্যান্ত পুড়িয়ে এলুম। হোঃ-হোঃ-হো পোকরি কেসুঙটাকে কাঁপয়ে বুড়ো সর্দার সারা গা দুলিয়ে হেসে উঠল।
কে? আমার মেয়ে! মেহেলী হুই শত্রুরপক্ষের ছোকরার সঙ্গে পিরিত জমিয়েছে? তার সঙ্গে ফুর্তি করেছে? একেবারে বর্শা দিয়ে ছুঁড়ব মেয়েটাকে। রোহি মধুর মৌতাতে সাঞ্চামখাবার দুচোখ জ্বলে জ্বলে উঠতে লাগল। বলল, মেহেলীকে দেখেছিস সদ্দার?
সাঞ্চামখাবার কথা শুনে বেড়ার ওপাশের দু’টি কান চমকে উঠল। বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা ধকধক করে লাফাতে লাগল মেহেলীর।
বাঁশের পানপাত্রটা একপাশে ছুঁড়ে হুঙ্কার দিল সাঞ্চামখাবা, মেজাজটা ভালো নেই, চারটে বর্শা আর দুখুদি ধান খোয়া গেছে। ভেবেছিলাম ওগুলো দিয়ে অঙ্গামীদের কাছ থেকে আয়োঙ্গে (হার), খারোনজে (এক ধরনের দা) আর অ্যাবেয়া (তলোয়ার জাতীয় অস্ত্র) বদল । করে আনব। আর ইদিকে শয়তানী শত্তুরদের সঙ্গে মজা করেছে!
বুড়ো সর্দার লাল লাল দাঁতগুলো মেলে হাসল। বলল, ধান আর বর্শা মেহেলীই চুরি করেছে। সেঙাইকে বশ করবার জন্যে হুই বর্শা আর ধান বদল করে ডাইনি নাকপোলিবার কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে এসেছে।
ডাইনি নাকপোলিবা! কে বলল তোকে? চড়া গলার আওয়াজ এবার ফিসফিস শোনাল সাঞ্চামখাবার।
সালুনারু বলেছে। সে সব দেখেছে, সে-ই তো সেঙাইকে ধরিয়ে দিয়েছে।
সালুনারু! ও, কেলুরি বস্তি থেকে যে মাগীটাকে খেদিয়ে দিয়েছে?
হু-হু।
বাঁশের দেওয়ালের ওপাশে একটি নারীদেহে এই জা কুলি মাসের হিমাক্ত রাত্রিতে ঘাম ঝরতে শুরু করেছে। হৃৎপিণ্ডটা থেমে থেমে আসছে মেহেলীর। বাপ আর সর্দারের কথাগুলো শুনতে শুনতে চেতনাটা কেমন যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছে।
বুড়ো সর্দার বলল, এবার মেহেলীকে বিয়ে দিয়ে দে।
হু-হু, তাই দিতে হবে। নানকোয়া বস্তির মেজিচিজুঙের বাপ বউপণ পাঠাবে বলেছে।
মেজিচিজুঙ! সে তো বাঘ-মানুষ। তার সঙ্গে বিয়ে দিবি?
হু-হু। মেহেলীর জন্যে অনেক পণ দেবে। শরদের একটা জোয়ানকে তো মেরেছিস। আরো কত জোয়ান আছে কেলুরি বস্তিতে। যুবতী বয়েস, তাগড়া ছোকরা দেখলে কি আর শত্তুর বলে বাগ মানবে! ঠিক পিরিত জমিয়ে বসবে। সারা শরীর নাচিয়ে হাসতে হাসতে বলে উঠল সাঞ্চামখাবা, যে বয়েসের যে ধরম। অন্য কারুর সঙ্গে মজবার আগেই মেহেলীর বিয়ে দেব। হুই নানকোয়া বস্তির বাঘ-মানুষই সই।
মেজিচিজুঙ! একটা বাঘ-মানুষের সঙ্গে তার বিয়ে দেবে সাঞ্চামখাবা! বুকের ভেতরটা ভয়ে আতঙ্কে ধড়াস করে উঠল মেহেলীর।
হু-হু, ঠিক বলেছিস। আমার মেয়ে হুই লিজোমুটাকেও বিয়ে দিতে হবে এবার। খোনকে বেঁচে থাকলে তার সঙ্গে দিতুম। কী আর করা! আনিজাতে টানল ওটাকে। বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল বুড়ো সর্দার, অনেকক্ষণ এসেছি। এবার শুয়োর দিয়ে দে। মোরাঙের ছোরারা গিলবার জন্যে বসে রয়েছে।
হু-হু, দিচ্ছি। বাইরে চল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাঞ্চামখাবা, হুই কেলুরি বস্তির সেঙাই শয়তান খোনকেকে মারল। তাকে পুড়িয়ে মেরেছিস। একটা না, দুটো শুয়োর দেব আমি। ছেলেটা বেঁচে থাকলে তোর মেয়ের সঙ্গেই জুড়ে দিতাম।
দেহটাকে যতখানি সম্ভব ছোট করে দেওয়ালের সঙ্গে মিশে রইল মেহেলী।
দুজনে বাইরে বেরিয়ে এল।
বুড়ো সর্দার বলল, তুই মোরাঙে যাবি না?
হু-হু, যাব। দুটো শুয়োর দেব আর মাংস খেতে যাব না! তোর মতলবটা কী বল দিকি সদ্দার? মোষবলির হাড়িকাঠের পাশে এসে একবার দাঁড়াল সাঞ্চামখাবা। তারপর বলল, পথে মেহেলীকে পেলে পাঠিয়ে দিস। শয়তানীটার চামড়া তুলে নেব আজ। আমার চারটে বর্শা, দুখুদি ধান দিয়ে শত্তুরদের জোয়ানকে বশ করার ওষুধ কিনেছে! আহে ভু টেলো।
হু-হু। দেখা হলেই পাঠিয়ে দেব।
সাঞ্চামখাবা ফুঁসতে লাগল, আমাকে না বলেই মেহেলীটা শব্দুরদের ছোঁড়ার সঙ্গে পিরিত জমাল!
হু-হু।
শুনে মেজাজটা বেয়াড়া হয়ে গিয়েছে সদ্দার। হুই জোহেরি বংশের শয়তানগুলোর সাহস দেখে তাজ্জব লাগে। জেভেথাঙটাকে একবার সাবাড় করলাম, তবু আক্কেল নেই। আবার সেঙাই এসেছিল আমাদের পোকরি বংশের মাগীর সঙ্গে পিরিত ফুটোতে! একটু দম নিয়ে সাঞ্চামখাবা বলল, তা শয়তানটাকে পুড়িয়ে বেশ করেছিস।
হু-হু।
খানিকটা সময় চুপচাপ কাটল।
চল, হুই দিকে শুয়োরগুলো রয়েছে। পোকরি কেসুঙের পেছনের অংশে সাঞ্চামখাবা আর বুড়ো সর্দার অদৃশ্য হয়ে গেল।
আর বাঁশের দেওয়ালটার পাশে দাঁড়িয়ে কর্তব্য স্থির করে ফেলল মেহেলী। আজ রাতে বাপের সামনে গিয়ে তাদের বাইরের ঘরে কিছুতেই দাঁড়াতে পারবে না সে। তাহলে নির্ঘাত বর্শা দিয়ে তাকে ছুঁড়ে ফেলবে সাঞ্চামখাবা। জা কুলি মাসের এই রাত্রিটুকুর জন্য সে পলিঙার বিছানায় আশ্রয় নেবে। সে বিছানা নিরাপদ, নির্বিঘ্ন।
টলে টলে চড়াইটার দিকে উঠতে উঠতে একবার পেছন ফিরল সেঙাই। অনেক, অনেক দূরে টিজু নদীর ওপারে সালুয়ালাঙ গ্রামখানা এখন জা কুলি রাত্রির অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
কপালের দু’পাশে রগ দুটো সমানে লাফিয়ে চলেছে। খাদের মধ্যে আছড়ে পড়ে সমস্ত শরীরটা ফালা ফালা হয়ে ছিঁড়ে গিয়েছিল। সারা দেহে চাপ চাপ রক্ত শুকিয়ে কলো হয়ে। রয়েছে। অনেক রক্ত দেহ থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। অবসাদ আর অপরিসীম শ্রান্তিতে পেশীগুলো কুঁকড়ে কুঁকড়ে আসছে সেঙাই-এর। বুকের ভেতরটা খালি করে বড় বড় নিশ্বাস পড়তে লাগল ঘন ঘন।
চেতনাটা কেমন আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। একবার হিমাক্ত পাথরের ওপর বসে পড়ল সেঙাই। তার অস্পষ্ট ভাবনার ওপর কতকগুলো ঘটনা জট পাকিয়ে গেল। এই দুটো দিন কেমন যেন অসত্য মনে হয়, কেমন যেন অবাস্তব। খোনকে, খাদের মধ্যে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাওয়া, মেহেলী, খাসেম গাছের মগডালে আতামারী পাতার ঘর, লিজোমু। এদের মধ্যে যেন কোনো যোগ নেই, মিল নেই। সব বিচ্ছিন্ন, গ্রন্থিহীন, শিথিলবদ্ধ। আবার সব মিলিয়ে এক, অখণ্ড। পাহাড়ী মানুষ সেঙাই, তার ঘোলাটে চেতনার মধ্যে এখন তাদের কোনো ধারাবাহিক ছবি ধরতে পারছে না।
শুধু মনে পড়ছে লিজোমুকে। উঃ, আতঙ্কে সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন শিউরে ওঠে এখনও। শরীরের সমস্ত শক্তি দু’টি কবজির মধ্যে এনে সে মেরিকেতসুটা ছুঁড়ে মেরেছিল লিজোমুর বুকে। বাঁশের পাটাতনের ওপর আর্তনাদ করে আছড়ে পড়েছিল লিজোমু। তারপর বাঁশের পানপাত্র দিয়ে তার অচেতন দেহটাকে আঘাতের পর আঘাতে অসাড় করে দিয়েছিল সে। সালুয়ালা গ্রামের সর্দারকে তার খবর দেবার সব আশঙ্কাই নির্মূল করে দিয়েছিল।
তারপর আরো খানিকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল সেঙাই। যেই উত্তর পাহাড়ের চূড়ায় সন্ধ্যার ধূসর ছায়া পড়তে শুরু হল, ঠিক তখনই বাঁশের সিঁড়িটা বেয়ে তরতর করে নিচে নেমে এসেছিল। তারও পর ঘন বনের আড়ালে আড়ালে চড়াই উতরাই উজিয়ে, উপত্যকা ডিঙিয়ে, টিজু নদীর নীল ধারা পেরিয়ে এইমাত্র এপারে চলে আসতে আসতে একবারও সালুয়ালা গ্রামখানার দিকে তাকায় নি।
মাত্র কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। তবু যেন মনে হয়, একটা জন্মান্তর ঘটে গিয়েছে। পাথরের টিলায় বসে ফুসফুস ভরে বারকয়েক বাতাস টেনে নিল সেঙাই। তারপর পাশের একটা মেশিহেঙ ঝোঁপ ধরে উঠে দাঁড়াল।
আচমকা সেঙাই-এর নজরে পড়ল, অনেক, অনেক দূরে সালুয়ালা গ্রামের আকাশ চিরে চিরে আগুন উঠছে। সেই আগুন জা কুলি মাসের হিমাক্ত অন্ধকারে রক্তলেখার মতো ফুটে বেরিয়েছে। সেঙাই জানতেও পারল না, ওই আগুন খাসেম গাছের মগডালে আতামারী পাতার ঘরখানাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। সেই ঘর, যেখানে একটু আগেও সে আটক হয়ে ছিল। সে জানতেও পারল না, সেঙাই নামে এক বন্য পুরুষ কামনায় খারিমা পতঙ্গের মতো যে নারীদেহটি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে এখন ওই আকাশছোঁয়া আগুনে ঝলসে ঝলসে মরছে।
টিলাটার ওপর থেকে উঠে পড়ল সেঙাই। ফের টলতে টলতে উপত্যকার দিকে নামতে লাগল। এখনও অনেকটা পথ পেরিয়ে যেতে হবে। তারপর পাওয়া যাবে তাদের ছোট্ট গ্রাম কেলুরির সীমানা।
হো-ও-ও-ও-আ-আ—
হো-ও-ও-ও-আ-আ–
জা কুলি মাসের রাত্রিটাকে চকিত করে উল্লসিত শোরগোল উঠতে লাগল। কেলুরি গ্রামের মোরাঙের সামনে অনেকগুলো মশাল জ্বলছে। পেন্য কাঠের মশাল। আর সেই মশালগুলোর চারপাশে গোল হয়ে বসেছে জোয়ান ছেলেরা। ঠিক মাঝখানে একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হয়েছে। মোটা মোটা খাসেম কাঠে আগুনের গনগনে রক্তাভা।
একপাশে পড়ে রয়েছে গোটা দুই বুনো মোষ। প্রাণী দু’টির সারা গায়ে তীর আর বর্শায় ফলা ফুটে রয়েছে। লাল হেপোন্যে ফুলের মতো থোকা থোকা তাজা রক্ত ঘন হয়ে রয়েছে। পাহাড়ী মানুষগুলো তীর আর বর্শা দিয়ে বুনো মোষের কুচকুচে কালো দেহে নিষ্ঠুর ছবি এঁকেছে যেন। আজ দুপুরে শিকারে গিয়েছিল জোয়ান ছেলেরা। বর্শা আর তীরের ফলায় বুনো মোষ গেঁথে ফিরেছে একটু আগে।
রাত্রি ঘন হচ্ছে। আগুনের কুণ্ডটার চারপাশে নিবিড় হয়ে বসেছে উলঙ্গ জোয়ানগুলো।
একজন বলল, হু-হু, বুনো মোষ দুটো বড় ভুগিয়েছে। তা হোক, আজ ভোজ বেশ জমবে, কি বলিস তোরা?
উত্তরে সকলে উল্লসিত গলায় চিৎকার করে উঠল, হো-ও-ও-ও-আ-আ-হু-হু, কী মজা!
কে যেন বলল, এবার বর্শা আর তীরগুলো খুলে ফেল মোষ দুটোর গা থেকে। বসে না থেকে হাত লাগা সবাই।
হু-হু– পলকের মধ্যে কয়েকটা জোয়ান ছেলে মোষ দুটোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ইতিমধ্যে মোরাঙের বাইরের ঘর থেকে বুড়ো খাপেগা বেরিয়ে এসেছে। মোষ দুটোর দিকে তাকিয়ে তার লোলুপ চোখ ঝলকে উঠল, বেশ তাগড়া জানোয়ার রে। মাংসটা খেয়ে জুত হবে মনে হচ্ছে। এই ওঙলে, এই পিঙলেই, এই পিরনাঙ, যা নিমক নিয়ে আয়। হু-হু, মাংসটা তরিবত করে খাওয়া যাবে।
সকলের মাঝখানে তুলোর দড়ির লেপ জড়িয়ে জাঁকিয়ে বসল বুড়ো খাপেগা। আর ওঙলেরা ছুটল লবণের সন্ধানে।
কে যেন বলল, সেঙাইটা নেই। সে থাকলে মজা হত।
হু-হু, তা হত। বুড়ো খাপেগা কানের লতিতে পিতলের নীয়েঙ দুল দোলাল। বলল, সে নির্ঘাত মরেছে। দু’দিন ধরে এত খুঁজলাম, ছোঁড়াটার পাত্তাই নেই। এ নিশ্চয়ই হুই রেজু
আনিজার কাজ। কোথায় কোন খাদে পড়ে মরে রয়েছে যে শয়তানের বাচ্চাটা!
রেনজু আনিজা! রেজু আনিজা! জোয়ান ছেলেদের গলা এবার ফিস ফিস শোনাতে লাগল।
হু-হু, রেঙকিলানকে যে মেরেছে এ নির্ঘাত তারই কাজ। ও নাম আর করিস না। রাত্তিরবেলা বড় ভয় করে। চুপ করে গেল বুড়ো খাপেগা। খানিক পরেই আবার বলতে লাগল, সেঙাই মরেছে, নিশ্চয়ই মরেছে। নইলে এ দু’দিনে ঠিক খুঁজে পেতুম। সালুয়ালা বস্তির শত্তুররা ওকে মারলে চেঁচিয়ে পাহাড়ে ভূমিকম্প বাধিয়ে দিত না।
একটু আগে সালুয়ালাঙ বস্তির লোকেরা খুব চেঁচাচ্ছিল কিন্তু। একটি জোয়ান ছেলে বলল।
যেতে দে, যেতে দে এখন ওসব কথা। আগে তরিবত করে মাংস খাই। তাগড়া মোষের মাংস।
হু-হু। জিভে জল এসে গেল বুড়ো খাপেগার, কাল দেখা যাবে। দরকার হলে সালুয়ালাঙের সবগুলো শয়তানের মাথা ছিঁড়ে আনব না! বড় শীত আজ। অগ্নিকুণ্ডটার দিকে দুখানা শীর্ণ হাত বাড়িয়ে দিল সে। এখন তার উত্তাপ চাই। জা কুলি রাত্রির হিম থেকে বাঁচবার জন্য প্রচুর উত্তাপ।
খানিকটা পরে ওঙলেরা ফিরে এল। কিন্তু কেউ লবণ আনেনি।
বুড়ো খাপেগা বলল, কি রে, নিমক এনেছিস?
না জেঠা, নিমক নেই।
নিমক নেই তো কী দিয়ে মাংস গিলবি? গর্জে উঠল বুড়ো খাপেগা।
সেঙাইর বাপ তো বস্তি ছেড়ে ভেগেছে। তোরা ভাগিয়ে দিয়েছিস। মোককচঙ কি কোহিমা থেকে সে-ই তো নিমক এনে বস্তির সবাইকে দিত। ওঙলে বলল।
হু-হু। সিজিটোটাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে দেখছি। বুড়ো খাপেগা রক্তচোখে এবার সামনের দিকে তাকাল। তারপর হুঙ্কার দিয়ে উঠল, এই সারুয়ামারু–
বুনো মোষের দেহ থেকে বর্শা আর তীরের ফলাগুলো তুলে ফেলছিল সারুয়ামারু। অন্য কোনো দিকে তার নজর কি কান ছিল না। খাপেগার কথা শুনে ফিরে তাকাল, কী বলছিস রে সদ্দার?
কী আবার বলব! খুব তো শাসিয়েছিলি সিজিটোকে। তোর বউর ইজ্জতের দামও বাগিয়েছিস সিজিটোর মায়ের কাছ থেকে। এখন নিমক দেবে কে? সারা বস্তি নিমক না খেয়ে কি মরবে? লাল লাল দাঁতের সারি বার করে খিঁচিয়ে উঠল বুড়ো খাপেগা।
তা আমি কী করব? সারুয়ামারুর চোখ দুটো যেন ঝিলিক দিয়ে উঠল, আমার বউর ইজ্জত নেবে সিজিটো, তার দাম বাগাব না?
হু-হু, তা তো বাগাবিই। কিন্তু নিমক দিতে হবে তোকে। মোককচঙ কি কোহিমা শহর থেকে সারা বস্তির জন্যে নিমক নিয়ে আসবি কাল। নইলে সিজিটোকে ফিরিয়ে আনবি। এখন আমরা মাংস খাব। তার জন্যে নিমক দিবি। যা, নিমক নিয়ে আয়। বুড়ো খাপেগা হুকুম দিল।
চকিতে উঠে দাঁড়াল সারুয়ামারু, আমার নিমক নেই।
নিমক নেই তো মাংস খাব কী দিয়ে?
কেন? আপুফু ফল দিয়ে খাবি। নিমক না থাকলে টক আপুফু ফলই তো আমরা খাই। তাই নিয়ে আসব?
বড় কষা লাগে ফলগুলো। আজুস্ত্রে (লবণ জলের প্রস্রবণ) থেকে নিমকজল নিয়ে আয় বরং সেই জল দিয়ে মাংস খাব। তবে কাল শহর থেকে নিমক নিয়ে আসতে হবে তোকে। মনে থাকে যেন। পাথরের ওপর আরো জাঁকিয়ে বসল বুড়ো খাপেগা।
সারুয়ামারু একটি জোয়ান ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে নিচের বনভূমির দিকে ছুটল।
ইতিমধ্যে বুনো মোষ দুটোর গা থেকে বর্শা আর তীরের ফলাগুলো উপড়ে নেওয়া হয়েছিল। সকলে মিলে এবার দেহ দুটো অগ্নিকুণ্ডটার মধ্যে ফেলে দিল। বিশাল কুণ্ড। গনগনে আগুন। চারপাশ থেকে মোটা জ্বলন্ত কাঠগুলোকে তুলে মোষ দুটোর ওপর চাপানো হল।
হো-ও-ও-ও-আ-আ–
জোয়ানদের গলা থেকে উল্লসিত হল্লা উঠছে আকাশের দিকে। বিশৃঙ্খল আর হিংস্র শোরগোল, হো-ও-ও-ও-আ-আ–
কে যেন বলল, শুধু শুধু ঝলসাচ্ছিস সদ্দার, কঁচাই মেরে দিলে হত। তর আর সইছে না।
বুড়ো খাপেগা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তারপর খেঁকিয়ে বলল, কে, কে? শয়তানের বাচ্চা হুই কুকী আর সাঙটামদের মতো অসভ্য হয়ে রয়েছে এখনও! কাঁচাই সব গিলতে চায়।
একেবারে বর্শা দিয়ে কুঁড়ে ফেলব। একটু আগুনে ঝলসে না নিলে সোয়াদ আসে মাংসে?
হো-ও-ও-ও-আ-আ–
খাসেম কাঠের আগুনে ঝলসে যাচ্ছে মহাকায় প্রাণী দুটো। চর্বি জ্বলে, চামড়া পুড়ে, দপদপে ঝলকানি উঠছে।
হো-ও-ও-ও-আ-আ–
লোহা আর বাঁশের বড় বড় ছুরি নিয়ে এসেছে সকলে। সামনে বুনো মোষের দেহ পুড়েপুড়ে উগ্র লোভনীয় গন্ধ ছড়াচ্ছে। জা কুলি মাসের রাত্রি আমোদিত হয়ে উঠেছে। যাদের রসনা বেসামাল হয়ে উঠছে, যারা অতিমাত্রায় লোলুপ হয়েছে, তারা এর মধ্যেই অগ্নিকুণ্ডের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তারপর চকিতে একখণ্ড মাংস কেটে নিয়ে আসছে ছুরি দিয়ে। লবণের বদলে ঝরনার লবণ-জল নিয়ে এখনও ফিরে আসেনি সারুয়ামারু আর জোয়ান ছেলেটা। সেদিকে বিন্দুমাত্র প্রক্ষেপ নেই তাদের। পরম তৃপ্তিতে সেই আধপোড়া মাংস লাল লাল দাঁতের ফাঁকে ফেলে চিবোতে শুরু করেছে জোয়ান ছেলেগুলো। আর তারই ফাঁকে ফাঁকে হল্লা করে উঠছে, হো ও–ও–ও-আ—আ–
আচমকা পাহাড়ের ভাজ থেকে গোঙানি ভেসে এল, ও সদ্দার, সদ্দার–আমি এসেছি।
যাদের ধ্যান-জ্ঞান দু’টি পিঙ্গল চোখের মণি হয়ে ঝলসানো বুনো মোষ দুটোর দিকে আটকে ছিল তারা চমকে উঠল।
পাহাড়ের ভাজ থেকে আবারও গোঙানিটা শোনা যেতে লাগল, সদ্দার, ও সদ্দার। আমি সেঙাই। আমাকে একটু ধরে নিয়ে যা; উঠতে পারছি না। শিগগির আয়।
আনিজা! আনিজা! সেঙাই তো মরেছে। পালা, পালা সব। একটা সন্ত্রস্ত কোলাহল উঠল আগুনের কুণ্ডটার চারপাশে। জনকয়েক দৌড়ে মোরাঙের মধ্যে গিয়ে ঢুকল।
চুপ কর শয়তানের বাচ্চারা। কালো পাথরখানা থেকে লাফিয়ে উঠল বুড়ো খাপেগা, এত মানুষের সামনে আনিজারা আসে না। মশাল নিয়ে আমার সঙ্গে আয়।
একটু পরেই পাহাড়ের ভাজ থেকে সেই-এর প্রায়-অচেতন দেহটা তুলে মোরাঙে নিয়ে এল জোয়ান ছেলেরা। এতটা চড়াই উতরাই পার হয়ে আসতে আসতে হিমে সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গিয়েছিল সেঙাই-এর। সামনের পাথরের ভাজে এসে লুটিয়ে পড়েছিল সে।
কিছু সময়ের জন্য বুনো মোষের লোভনীয় মাংসের কথা ভুলে থাকতে হল। সেঙাই-এর চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়েছে সকলে। তার কাছে উত্তেজক খবর নিশ্চয়ই কিছু আছে। সে লোেভও কম নয়।
বুড়ো খাপেগা বলল, কি রে, কী ব্যাপার? সারা গায়ে এত রক্ত কেন? কী হয়েছে?
থেমে থেমে দু’টি দিনের সব কাহিনি বলে গেল সেঙাই। কথার ফাঁকে ফাঁকে বার বার থামতে হল। কখনও তার গলা ফিসফিস শোনল, কখনও অত্যন্ত উত্তেজিত। খোকে, মেহেলী, লিজোমু, গভীর খাদ কিছুই বাদ দিল না সে। শেষে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, কিছুক্ষণ আগে সেই খাসেম গাছের ঘরখানা থেকে তাল বুঝে নেমে এসেছি। বড় খিদে পেয়েছে সদ্দার।
বুড়ো খাপেগা বলল, এই ওঙলে, বুনো মোষের মাংস নিয়ে আয়। এই পিঙলেই, তুই তামুন্যুকে (চিকিৎসক) ডেকে আন। এই পিঙকুটাঙ, তুই রোহি মধু নিয়ে আয়।
মোরাঙের বাইরে ঘন অন্ধকার। ওঙলে, পিঙলেই আর পিঙকুটাঙ তিন দিকে ছুটে গেল।
সেঙাই আবারও বলল, হুই মেহেলী আমাকে বাঁচিয়েছে সদ্দার, ওকে আমি বিয়ে করবই। তুই দেখিস, ওর বাপ আমার সঙ্গে বিয়ে না দিলে লড়াই বাধিয়ে দেব।
হু-হু, বিয়ে করবি। সালুয়ালাঙ বস্তি মেহেলীকে না দিলে ছিনিয়ে নিয়ে আসব। এই তো চাই সেঙাই। তোর ঠাকুরদাকে হুই বস্তি থেকে নিতিৎসুকে এনে দিতে পারিনি। সেদিন আমরা হেরে গিয়েছিলাম, সেদিন জেভেথাঙ মরেছিল। তোর জন্যে হুই মেহেলীকে ছিনিয়ে এনে আমাদের জিততে হবে। যেমন কারেই হোক সালুয়ালাঙ বস্তিকে হারিয়ে দিতে হবে। কেলুরি গ্রামের অতীত কাল এই বুড়ো খাপেগা। তার দুচোখে এক ভয়ানক প্রতিজ্ঞা জ্বলতে লাগল।
অনেক দিন পর সেঙাই-এর মধ্যে তার যৌবনকালকে দেখতে পেয়েছে বুড়ো খাপেগা। সেই রক্তাক্ত অতীতের দিনগুলো আর নিতিৎসু-জেভেগাঙকে নিয়ে দুই গ্রামের লড়াই চেতনার মধ্যে দোল খেয়ে উঠছে। সেঙাই এবং মেহেলীকে নিয়ে একালে আর একটা সংঘাতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। খাপেগার উল্লাসের দিন বৈকি আজ। একালের ছোকরাদের কাছে সে অতীত কালের ভেলকি দেখিয়ে ছাড়বে।
হঠাৎ কী ভেবে বুড়ো খাপেগা বলল, বুঝলি সেঙাই, তোর বাপ সিজিটো হুই সারুয়ামারুর বউর ইজ্জত নিয়েছে।
ছিলাকাটা ধনুকের মতো মাচানের ওপর উঠে বসল সেঙাই, বর্শা দিয়ে ফুঁড়ে ফেলেছিস বাপটাকে?
না।
তবে কী সদ্দার হয়েছিস! ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ল সেঙাই-এর। বুকে বিশাল একখান থাবা চেপে দম নিল সে, পরের বিয়ে করা মাগীর দিকে নজর! আমি হলে সাবাড় করে ফেলতুম। তা সে যেই হোক না। হু-হু।
ইজ্জতের দাম আদায় করেছি তোর ঠাকুমার কাছ থেকে, আর সিজিটো শয়তানটা ভেগেছে।
বাপটা ভেগেছে? বেশ হয়েছে। ইজ্জত্রে দাম আদায় করেছিস? তা হলে তো সব কিছু চুকেই গেছে। উত্তেজনায় উঠে বসেছিল সেঙাই। এবার ক্লান্তিতে মাচানের ওপর এলিয়ে পড়ল।
একসময় সারুয়ামারু আর জোয়ান ছেলেটি লবণ জল নিয়ে মোরাঙে ফিরল। ওঙলে এল বুনো মোষের মাংস নিয়ে, পিঙলেই এল তামুন্যুকে নিয়ে, আর রোহি মধু-ভরা বাঁশের পানপাত্র নিয়ে ফিরল পিঙকুটাঙ।
দুপুরের দিকে বুড়ো সর্দার লিজোমুকে খুঁজতে বেরুল। সালুয়ালা গ্রামের টিলাগুলো ডিঙিয়ে কেসুঙে কেসুঙে থামতে লাগল।
তোরা কেউ লিজোমুকে দেখেছিস?
কই, না তো। যে মেয়েটি উত্তর দিল সে আবার অখণ্ড মনোযোগে ফাফ্যা দিয়ে দড়ির লেপ বুনতে শুরু করেছে।
একটা বাঁক ঘুরল বুড়ো সর্দার। একপাশে কপিশ রঙের পাথরের ওপর কতকগুলো জোয়ান ছেলের জটলা বসেছে। পিতলের এলস্ (ক্ষুর জাতীয় অস্ত্র দিয়ে গোল করে তাদের মাথা কামিয়ে দিচ্ছে জন দুই ছোকরা। আর একদিকে বড় ভেরাপাঙ গাছের ছায়াতলে নিবিড় হয়ে বসেছে কয়েকটি যুবতী মেয়ে। তাদের সুঠাম অঙ্গশ্রীর ওপর দুপুরের রোদ নেশার মতো জড়িয়ে রয়েছে। টুগু পাতার আঠা আঙুলে মাখিয়ে বাহুসন্ধির কেশ একটি একটি করে নির্মূল করছে তারা। ঠিক তেমনি প্রক্রিয়ায় একটু দূরের কয়েকজন জোয়ান ছেলে তাদের চিকন দাড়ি গোঁফ উপড়ে ফেলছে। এ সব এই পাহাড়ী নারীপুরুষের অবশ্য করণীয় প্রথা।
বুড়ো সর্দার বিশাল ভেরাপাঙ গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল, কি রে, তোরা লিজোমুকে দেখেছিস?
না সদ্দার। কাল দুপুরের পর থেকে তাকে আর দেখি নি।
তাই তো, গেল কোথায় শয়তানের বাচ্চাটা! এই দ্যাখ না, আজ সন্ধের সময় জুকুসিমা বস্তি থেকে জানথাঙ আসবে। কী করি বল তো? হতাশ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাল বুড়ো সর্দার।
এবার সকলে রীতিমত উৎকর্ণ হয়ে বলল, জানথাঙ কে রে সদ্দার?
পিমঙের পিসি।
পিমঙ! সেই যে ছোঁড়ার সঙ্গে কাল সেঙাইকে পোড়াবার আগে লিজোমুর বিয়ে ঠিক করলি?
হু-হু, পিমঙের পিসি বউপণ নিয়ে আসবে। বিয়ের বায়না দিয়ে যাবে আজ। কিন্তু কোথায় গেল যে টেফঙের বাচ্চাটা! এতক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর দস্তুরমত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বুড়ো সর্দার। এবার সে যতটা বিরক্ত হল, তার চেয়ে শঙ্কিত হল অনেক বেশি।
লিজোমুর বিয়ে। ভোজ হবে, ভোজ হবে।
সাদা শুয়োর খাওয়াতে হবে কিন্তু সদ্দার। না বললে শুনব না।
জোয়ান-জোয়ানীরা সকলে মিলে শোরগোল করতে লাগল। সেই হইচই সমস্ত সালুয়ালাঙ গ্রামটাকে যেন মাতিয়ে তুলল।
চুপ কর শয়তানের বাচ্চারা। লিজোমুকে খুঁজে বার কর আগে, তবে তো বিয়ে! গর্জে উঠল বুড়ো সর্দার।
কে যেন বলল, লিজোমু তো মেহেলীর সই। তার কাছে খোঁজ নিলে নিশ্চয়ই লিজোমুকে পাওয়া যাবে।
ঠিক বলেছিস। বুড়ো সর্দার পোকরি কেসুঙের দিকে পা বাড়িয়ে দিল।
আচমকা একটি যুবতী মেয়ে বলল, খোনকের সঙ্গে না লিজোমুর বিয়ে হবার কথা ছিল, কি রে সদ্দার?
ছিল তো। খোনকেকে আনিজাতে মারল। কাল আবার পিমঙের বাপ এসেছিল, সে তার ছেলের সঙ্গে লিজোমুর বিয়ের কথাটা পাড়ল। খোনকে মরেছে, তাই আমিও রাজি হলুম। পিমঙের বাপ আমার স্যাঙাত। আমরা একসঙ্গে কেলুরি বস্তির সঙ্গে লড়াই করেছি। যাক সে কথা। জুকুসিমা বস্তির সঙ্গে আমাদের কতদিনের কুটুম্বিতে। ওরা কত খাতির করে। বলতে বলতে সামনের টিলার দিকে উঠে গেল বুড়ো সর্দার।
বুড়ো সর্দার টিলাটার ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
একটি যুবতী মেয়ে ঘাড়খানা অপরূপ ভঙ্গিতে বাঁকিয়ে বলল, খোনূকেটা এই সবে মরল, সদ্দারের আর তর সয় না। এর মধ্যেই লিজোমুর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে!
মেয়ে বেচে কত পণ পাবে বল দিকি! সে খেয়ালটা আছে তোর? খাসেম গাছের ছায়াতলে আর একটি গলা শোনা গেল।
সাসুমেচু! আমাদের সদ্দার একটা আস্ত সাসুমেচু (ভয়ানক লোভী মানুষ)।
পাহাড়ী জোয়ান আর জোয়ানীদের মধ্যে মৃদু একটা গুঞ্জন উঠল।
সবাই চুপ, একেবারে চুপ। সদ্দার শুনতে পেলে সক্কলকে সাবাড় করবে। যুবতী মেয়েটি সতর্ক করে দিল। এরপর কেউ আর একটি কথাও বলল না।
খোখিকেসারি কেসুঙ থেকে পোকরি কেসুঙের দিকে আসছিল পলিঙা আর মেহেলী। একখণ্ড বিশাল পাথরের পাশে সর্দারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তাদের।
বুড়ো সর্দার বলল, লিজোমুকে দেখেছিস মেহেলী? কি রে বলিঙা, তুই দেখেছিস?
বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড থমকে গেল মেহেলী আর পলিঙার। চট করে একবার পলিঙা তাকাল মেহেলীর দিকে। মেহেলীও তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়েছে। চোখের পলক পড়ছে না। দুজন অনেকক্ষণ তাকিয়েই রইল।
বুড়ো সর্দার আবারও বলল, কি রে, দেখেছিস তোরা? লিজোমু তো তোদের সই। কাল দুপুরের পর থেকে তাকে পাচ্ছি না।
কাঁপা গলায় মেহেলী বলল, কই, আমরা দেখিনি তো।
বড় অসহায় দেখাল বুড়ো সর্দারকে। ঘোলাটে চোখের ঠিক নিচেই বর্শার ফলার মতো ফুঁড়ে বেরিয়েছে হনুদুটো। সারা মুখের রাশি রাশি কুঞ্চনে জরা স্থায়ী ছাপ ফেলেছে। ভাঙা গলায় বুড়ো সর্দার বলল, কী করি বল তো মেহেলী? খুঁজেই পাচ্ছি না। এদিকে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বাপণ এসে যাবে দু-একদিনের মধ্যে।
বউপণ! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মেহেলী।
হু-হু, কাল সন্ধের সময় এসেছিল পিমঙের বাপ, হুই জুকুসিমা বস্তি থেকে। আমাদের সঙ্গে ওদের খুব খাতির। তোর দাদা খোনকেটা তো মরল। তাই ওদের ছেলে পিমঙের সঙ্গে লিজোমুর বিয়ে ঠিক করলাম। বংশটাও ভালো। লোখেরি বংশ। ফিসফিস গলায় বলতে বলতে একসময় একেবারে থেমে গেল বুড়ো সর্দার।
মেহেলী ভাবছে অন্য কথা। লিজোমুর ঝলসানো বীভৎস দেহটা এখনও যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে। না না, সর্দারকে সে কিছুতেই বলতে পারবে না, কেমন করে খাসেম গাছের মগডালে লিজোম একটু একটু করে পুড়ে মরেছে। বুকের মধ্যে ধমনীটা ছিঁড়ে রক্ত উছলে। উছলে পড়ছে, তারপর ফেনিয়ে ফেনিয়ে শিরা-উপশিরার ধারাপথে ছড়িয়ে যাচ্ছে। অসহ্য এক যন্ত্রণায় শরীরের পেশীগুলো যেন অসাড় হয়ে আসতে শুরু করেছে মেহেলীর। টেনেন্য মিঙ্গে লু! বউপণ! না হোক তার দাদা খোনকের সঙ্গে লিজোমুর বিয়ে, তবু তার বিয়ে হত সুদূর পাহাড়ী গ্রাম জুকুসিমায়। সোয়ামীর সোহাগে সোহাগে, পাহাড়ী গ্রামের কোনো বনস্পতির ছায়াতলে একটি সুন্দর গৃহস্থালিতে সার্থক হত লিজোমু। চরিতার্থ হত তার যৌবনের কামনা। কিন্তু সে আজ নেই, ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছে। লিজোমু পুড়ে পুড়ে মরেছে। নিজের কামনা আর বন্য বাসনার মধ্যে মেহেলী লিজোমুর মনের ছায়াই তো দেখতে পায়। পাহাড়ী গ্রামে এক সুন্দর গৃহকোণ, এক আদিম আর বলিষ্ঠ পুরুষ। কিছুই পেল না সে। শত হলেও লিজোমু তার সই। তার জন্য প্রাণটা পোড়ে বৈকি মেহেলীর।
বুড়ো সর্দার বলল, কাল সেঙাইকে পোড়ালুম, তারপর সারা রাত মোরাঙে হল্লা হল, মাংস, খাওয়া হল। কেসুঙে আজ ফিরে দেখি, লিজো নেই। তোরা তবে তাকে দেখিসনি?
না। অস্ফুট গলায় বলল মেহেলী। তারপর ছুটে গেল পোকরি কেসুঙের দিকে। সর্দারের মুখোমুখি আর দাঁড়াতে পারছে না সে।
মেহেলীর পিছন পিছন পলিঙাও ছুটতে লাগল।