পূর্বপার্বতী (Purbaparvati) : 03
বিকেলের শুরুতে খেতে খেতে ফসলহীন আগাছা পুড়িয়ে উত্তর পাহাড়ে চলে গিয়েছিল সেঙাই। আর ওঙলেরা ফিরে এসেছিল তাদের ছোট্ট গ্রামটিতে। সকলে মিলে ঠিক করেছিল নাচগানের মাতাল ঘূর্ণিতে আর উল্লাসে আজকের বাকি দিনটা জমিয়ে তুলবে।
একসময় সেই নাচ শুরু হল সারুয়ামারুর ঘরের সামনে, অর্থাৎ জোরি কেসুঙে। সমস্ত গ্রামখানা চারপাশ থেকে এসে জমা হয়েছে সেখানে। পাথুরে মাটির ওপর চক্রাকারে বসে পড়েছে সবাই। তামাটে পাহাড়ী মানুষ। কানে পিতলের নীয়েঙ গয়না। চাপা চাপা ছোট চোখে, চ্যাপ্টা নাকে, গোলাকার কামানো মাথায় আর অনাবৃত দেহে খুশির হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। সারা দেহ ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে, প্রতিটি অঙ্গ দুলিয়ে দুলিয়ে উল্লাস কি ক্রোধ ফুটিয়ে তোলে এই পাহাড়ী মানুষেরা।
মেয়ে আর পুরুষ–সব পাশাপাশি বসেছে। ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে একজন আর একজনের কাঁধের ওপর হাত তুলে দিয়েছে। আর নাচের তালে তালে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। উলঙ্গ আকাশের তলায় এই বিচিত্র পাহাড়ী গ্রাম। এই আকাশের মতো, এই পাহাড়ের মতো অকপট তাদের হাসি আর শোকের প্রকাশ।
একপাশে কয়েকটা পালিত শুয়োর আর কুকুর ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে। আর মাঝে মাঝে খুশির গলায় অস্ফুট জান্তব শব্দ করে উঠছে। তারপরেই হয়তো পাহাড়ী মানুষগুলোর গায়ে এসে গড়াগড়ি দিয়ে পড়ছে। নাচের আসরে জানোয়ার আর মানুষের কোনো প্রভেদ নেই। দুয়েরই উল্লাস প্রকাশের ধারা এক। নাচের ফাঁকে ফাঁকে হল্লা করে উঠছে পাহাড়ী মানুষগুলো, হোঃ–হোঃ—ওঃ—ওঃ–
জোরি কেসুঙের সামনে অর্ধ-গোলাকার পাথরখানার ওপর এসে বসেছে বুড়ো খাপেগা। তার পরনে আরি হু কাপড়। যারা শত্রুপক্ষের দুটো মাথা গেঁথে আনতে পারে বর্শার মুখে, তারাই এই কাপড় পরার গৌরব অর্জন করে। কাপড়খানা ঘোর রক্তবর্ণ, হাঁটুর ওপরে তার প্রান্তটা ঝুলছে। কাপড়ের ওপর চামড়ার ঢাল, বাঘের চোখ, হাতির মাথা, চিতাবাঘ, মোষ, সম্বর আর বর্শা আঁকা রয়েছে।
হো-ও-ও-ও—
বেলাশেষের আকাশের দিকে দিকে মাতাল উল্লাস উঠে যাচ্ছে।
জোয়ান ছেলেরা চারপাশে বসে বসে খুলি (এক ধরনের বাঁশি) বাজিয়ে চলেছে। আর একদিকে প্রকাণ্ড জয়টাকের মতো গোটা কয়েক মেথি কেকোয়েনঘা খুলি বসানো হয়েছে। কয়েকজন মিলে মোটা মোটা মোষের হাড় দিয়ে সেগুলো প্রচণ্ড উৎসাহে পিটিয়ে চলেছে। দ্রাম—দাম—ম–ম–
দক্ষিণ পাহাড়ের দিকে দিকে সেই গম্ভীর শব্দ তরঙ্গিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। কেলুরি গ্রামখানা যেন থরথর করে কাঁপছে সে আওয়াজে।
চারপাশে ঘন হয়ে বসেছে গ্রামের মেয়েপুরুষ। তাদের মাঝখানে রাঙা ধুলো-ভরা জায়গাটায় উদ্দাম নাচ চলছে।
একদিকে ছটি জোয়ান ছেলে, পরস্পরের কাঁধের ওপর হাত দিয়ে দাঁড়ানো যেন একটি পাহাড়ী ছন্দ। আর একপাশে ছটি যুবতী মেয়ে। জোয়ানদের মতো তারাও কাঁধে কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটু পর্যন্ত তাদের বিচিত্র রঙের কাপড়ে মানুষের কঙ্কাল, মোষের মাথা আর বর্শা এবং ঢাল আঁকা রয়েছে। দু’টি দলের সকলেরই কোমরের ওপর থেকে উদেহ অনাবৃত।
যুবতীদের কানে পিতলের নীশে দুল। মণিবন্ধে হাতির দাঁতের মোটা মোটা বালা। চুলের ভঁজে ভাঁজে সম্বরের ছোট ছোট শিঙ গোঁজা। কানের পাতায় সাঙলিয়া লতার নীলাভ ফুল। ছেলেদের মাথায় মোষের শিঙের মুকুট। কানে আউ পাখির পালক গোঁজা। গলায় কড়ির মালা।
দুই দলের মাঝখানে তিনটে বাঁশের খুঁটি পোঁতা রয়েছে। সেই খুঁটিগুলোকে চক্রাকারে ঘিরে একবার দুটো দল নাচতে নাচতে মুখোমুখি হচ্ছে। পরস্পরের মাথায় মাথা ঠেকছে। তার পরেই আবার পেছন দিকে পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে পিছিয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে থামছে। মাত্র একটি মুহূর্ত। আবার সামনের দিকে ঝুঁকে ছন্দিত পা ফেলে ফেলে অন্য দলটির দিকে এগিয়ে যাওয়ার পালা।
দ্রাম—ম্–ম্–ম্–
গম গম শব্দ উঠছে মেথি কেকোয়েনঘু খুলি বাদ্যযন্ত্র থেকে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়েছে বাঁশির সুর। আর সেই আবহ বাজনার সঙ্গে পা ফেলে ফেলে নাচ চলেছে। উদ্দাম নাচ, দুর্বার নাচ, অবিরাম নাচ। পায়ের আঘাতে আঘাতে রাঙা ধুলোর মেঘ উড়ছে।
পাহাড়ীদের এই নাচকে বলে ইয়াচুমি কোঘিল নাচ।
হো –ও—ও–ও—
নাচের সঙ্গে সঙ্গে চলছে উচ্চকিত কণ্ঠের হইচই।
বুড়ো খাপেগা ঘন ঘন পাকা মাথাখানা দোলাচ্ছে। হাত নেড়ে নেড়ে তারিফ করছে নাচ আর বাজনার।
জোরি কেসুঙে নাচ হচ্ছে। তাই সারুয়ামারু আর তার বউ জামাতসু বাঁশের পানপাত্রে সকলের সামনে রোহি মধু দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
হো-ও-ও-ও–
আকাশে বিবর্ণ বেলাশেষ। দূরের পাহাড়চূড়া আবছা হয়ে আসছে। পশ্চিমের বনশীর্ষ থেকে রোদের রং মুছে গিয়েছে।
মাতাল দেহের মুদ্রাভঙ্গে নেচে চলেছে পাহাড়ী যুবতী। উদ্দাম ছন্দে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে আসছে পাহাড়ী জোয়ান। তার সঙ্গে সঙ্গে জলদ তালে বাজছে বাজনা।
খাপেগা খুবই খুশি। মাথা নাড়ছিল সে। আচমকা তার পাশে এসে দাঁড়াল সিজিটো। তার দিকে তাকিয়ে খালোগা বলল, কি রে, কী ব্যাপার? নাচ আর বাজনা বেশ জমেছে। বোস, বোস।
বিরক্ত দৃষ্টিতে আসরটার দিকে তাকিয়ে ছিল সিজিটো। আর অখণ্ড মনোযোগে বুক, কপাল। আর কাঁধের পাশে দুই বাহুসন্ধি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ক্রস আঁকছিল। সারা মুখে দাড়ি-গোঁফের লেশ নেই। একটা কঠিন ভ্রুকুটি ফুটে বেরুল সিজিটোর, এসব আমার ভাল লাগে না সদ্দার। তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।
কী কথা? পাকা ভুরু দুটো কুঁচকে তাকাল বুড়ো খাপেগা।
একটু দাঁড়া। হুই সারুয়ামারুকে ডেকে আনি আগে।
জোরি কেসুঙের একপাশে দাঁড়িয়ে সারা দেহ বিচিত্র ভঙ্গিমায় বাঁকিয়ে চুরিয়ে এই আদিম নৃত্যকলা উপভোগ করেছিল সারুয়ামারু। সিজিটো তাকে ডাকল, এই সারুয়ামারু, ইদিকে আয়। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টেফঙের (বাঁদর) মতো খুব যে নাচছিস!
ঝড়ের মতো একে চিত করে ফেলে, ওর ঘাড়ের ওপর দিয়ে লাফিয়ে ছুটে এল সারুয়ামারু, কি রে সিজিটো, কোহিমা থেকে ফিরলি বুঝি?
হু-হু। সাহেব তোকে যেতে বলেছে।
সমানে ক্রস এঁকে চলেছে সিজিটো। খুশির গলায় সে বলল, এই দ্যাখ, সাহেব আমাকে কী দিয়েছে। গায়ে একটা বড় হরিণের ছাল জড়ানো ছিল সিজিটোর। তার তলা থেকে একটি সাদা ধবধবে জামা বার করে আনল সে। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে আত্মপ্রসাদের হাসি হাসল, হু-হু, তুই গেলে তুইও পেতিস।
ইতিমধ্যে নাচ আর বাজনা থেমে গিয়েছিল। বিচিত্র কৌতূহলে গ্রামের মেয়েপুরুষ, সকলে সিজিটোর চারপাশে নিবিড় হয়ে এল।
পাহাড়ী মানুষগুলোর গলায় এবার বিস্ময়টা সরবে ফেটে পড়ল, এটা কী? এটা কী?
এর আগে তারা কোনোদিন জামা দেখেনি। সভ্যতা থেকে অনেক, অনেক দূরে এই তুচ্ছ পাহাড়ী গ্রামে এই প্রথম জামার আবির্ভাব। এবার আত্মপ্রসাদের হাসিটা সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল সিজিটোর। প্রচণ্ড শব্দ করে হেসে উঠল সে, হো-ও-ও-ও, হো–ও–ও। এর নাম হল জামা। ফাদার আমাকে দিয়েছে।
এটা দিয়ে কী হয়?
কী আর হয়, গায়ে দেয়। সাদা ধবধবে জামাটা পরে দেখিয়ে দিল সিজিটো, কি রে, কেমন দেখাচ্ছে?
ভালো ভালো, খুব সুন্দর। চারপাশ থেকে পাহাড়ী মানুষগুলো হইচই করে উঠল।
দেখবি, ফাদার আমাকে আরো কত জিনিস দেবে। পায়ের পাতা পর্যন্ত প্যান্ট দেবে, কোট দেবে, আরো অনেক কিছু দেবে। সকলের মুখের ওপর দিয়ে গর্বিত দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিয়ে গেল সিজিটো।
প্যান্ট, জামা, কোট বিচিত্র সব শব্দ, অদ্ভুত সব নাম। পাহাড়ীদের কাছে এই নামগুলো একান্তই অজানা। নির্বাক তাকিয়ে থাকে সকলে।
কথা বলছে, আর সঙ্গে সঙ্গে ক্রস এঁকে চলেছে সিজিটো-অবিরাম। আচমকা তার দৃষ্টি এসে পড়ল সারুয়ামারুর ওপর। ভয়ঙ্কর গলায় সে বলল, কি রে, তুই ক্রস করছিস না যে আমার মতো? ফাদার যে বলে দিয়েছিল।
ও-সব আমার ভালো লাগে না। আগে কখনও করিনি। বিব্রত সুরে বলল সারুয়ামারু।
তুই ভারি নিমকহারাম তো। ফাদার তোকে নিমক দিয়েছে, আরো কত কী দিয়েছে। আর তুই বেইমানি করলি! কটমট করে তাকিয়ে রইল সিজিটো।
একেবারে বর্শা দিয়ে ফুঁড়ে ফেলব। নিমকহারামি করে, বেইমানি করে পাহাড়ের ইজ্জত নষ্ট করবে! হাতের মুঠিতে একটা বর্শা তুলে নিল বুড়ো খাপেগা।
হো-ও-ও-ও–
চারপাশ থেকে চিৎকার করে ওঠে মানুষগুলো। সেই প্রচণ্ড চিৎকার ছাপিয়ে সিজিটোর গলা পর্দায় পর্দায় চড়তে লাগল, বুঝলি সদ্দার, আমাদের কেলুরি বস্তির কেউ কোনোদিন কারো সঙ্গে নিমকহারামি করেনি। হুই শয়তান সারুয়ামারু করেছে। ফাদার ওকে নিমক দিয়েছে, কাপড় দিয়েছে। আর তার বদলা সম্বরের ছাল নেয়নি। শুধু সে বলেছিল, কপালে-বুকে কাঁধে আঙুল ঠেকাতে। ফাদার বলে, এর নাম ক্রস আঁকা। সেই ক্রস সারুয়ামারু শয়তানটা আঁকে না।
বর্শার ফলাটা সারুয়ামারুর বুকের কাছে ঠেকিয়ে হুমকে ওঠে বুড়ো খাপেগা, সাহেব যা বলেছিল, তাই কর। নিমক খেয়েছিস, তার কথা রাখবি না? একেবারে জানে মেরে ফেলব। শয়তানের বাচ্চা।
কলের পুতুলের মতো কপাল, বুক আর বাহুসন্ধি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ক্রস আঁকতে লাগল সারুয়ামারু। আর বীভৎস গলায় বুড়ো খাপেগা বলল, পাহাড়ী মানুষ কখনও কারো সঙ্গে বেইমানি করে না, নিমকহারামি করে না। কেউ করলে তার জান চলে যাবে বর্শার মুখে।
হো-ও-ও-ও—
আকাশের দিকে দিকে আর একবার উদ্দাম চিৎকার উঠে গেল।
শহরে গিয়েছিলি, সেই গল্প বল। যে মানুষটা তোকে জামা দিয়েছে, তার গল্প বল। চারপাশ থেকে পাহাড়ী মানুষগুলো এবার ঘিরে ধরল সিজিটোকে।
বিচিত্র মানুষ এই সিজিটো। মাঝে মাঝে কত পাহাড় ডিঙিয়ে, কত জলপ্রপাত উজিয়ে, কত মালভূমি আর উপত্যকা পাড়ি দিয়ে সে চলে যায় শহরে-মোককচঙে কি কোহিমায়। অবশ্য আরো অনেকে শহরে যায় এই গ্রাম থেকে। সারুয়ামারু যায়, বুড়ো নড্রিলো যায়। লবণের সন্ধানে অনেককেই যেতে হয়। সারুয়ামারুই সিজিটোকে প্রথম নিয়ে গিয়েছিল শহর কোহিমায়। তারপর থেকে শহর এক বিচিত্র আকর্ষণে তাকে বার বার টেনে নিয়ে গিয়েছে। এই ছোট্ট জনপদে তার তৃষিত কামনা যেন তৃপ্ত হয় না। এই নিবিড় বন, এই টিজু নদী, দক্ষিণ আর উত্তরের তরঙ্গিত উপত্যকা, মাথার ওপর অবারিত আকাশ–এ-সবের মধ্যেই একদিন জন্ম নিয়েছিল সিজিটো। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই সে তার প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন। তার রক্তে রক্তে অরণ্যের আহ্বান নেই, এই ভয়াল শৈলচূড়ার প্রতি আকর্ষণ নেই। কী যে সে চাইত, তার অস্ফুট বন্য মন তার হদিস পেত না। তারপর একদিন কৈশোরের সীমা ডিঙিয়ে দুর্বার যৌবন এল দেহমনে। পাহাড়ী প্রথা অনুযায়ী বিয়ে হল সেঙাইর মায়ের সঙ্গে।
সিজিটো জানত, তার বাপ জেভেথাকে হত্যা করেছিল টিজু নদীর ওপারের সালুয়ালা গ্রামের মানুষেরা। জেভেথাঙের মুণ্ডু কেটে বিজয় গৌরবে পোকরি বংশ উৎসব করেছিল, এ সংবাদও তার অজানা নয়। তবু তার রক্তে প্রতিহিংসার জ্বালা নেই, প্রতিশোধের আগুন নেই। কেমন যেন নিরুত্তাপ মানুষ সিজিটো। বুড়ো খাপেগা অনেকবার জেভেথাঙের কাহিনি তার কাছে বলেছে। কিন্তু এতটুকু উত্তেজনার চিহ্ন নেই তার মনের কি দেহের কোথাও। কেমন একটা নিস্পৃহ ভাব, একটা শীতল নিরাসক্তি। বিরক্ত হয়ে অবশেষে গর্জন করে উঠেছে বুড়ো খাপেগা, ইজা হান্টসা সালো। এত ভীরু তুই! এই বস্তির নাম তুই ডোবাবি টিজু নদীর জলে। একেবারে মাগীরও অধম। এ বস্তির মাগীরাও বর্শা দিয়ে ফুড়ে শত্রুর মুণ্ডু আনতে পারে। তুই একটা কী!
কোনো প্রতিবাদ করত না সিজিটো। বন-পাহাড়ের মানুষ হয়েও তার রক্তে অরণ্যের হিংসা নেই। চকিত দুটো চোখ তুলে সে উঠে যেত মোরাঙ থেকে।
মাঝে মাঝে একা একা দূরের পাহাড়ে চলে যেত সিজিটো। কোনো নিঃসঙ্গ জলপ্রপাতের কিনারে অন্যমনস্কর মতো বসে থাকত। কখনও বিশাল একটা ভেরাপাঙ গাছের মগডালে উঠে অনেক, অনেক দূরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিত। সুদূর পাহাড়ী দিগন্ত, তার ওপরে নীল আকাশ, তার পরের পৃথিবী আর দৃশ্যমান নয়। সেই অদৃশ্য জগৎ, সেই রহস্যের পৃথিবী প্রতিনিয়ত তাকে হাতছানি দিত। এক দুর্বার আকর্ষণে এই পাহাড়, দূরের ওই আকাশ ডিঙিয়ে তার বিচিত্র পাহাড়ী মন হারিয়ে যেতে চাইত। তাদের ছোট্ট জনপদ কেলুরি, পরিচিত মানুষগুলো, আরো অন্তরঙ্গ করে জানা বন, পাহাড়, উপত্যকা, বনভূমিতে শ্বাপদের সংসার, সব একেবারে অসহ্য হয়ে উঠত সিজিটোর কাছে।
একদিন আকাশের ওপারে সেই রহস্যের পৃথিবীটা দরজা খুলে দিল। সারুয়ামারুই তাকে নিয়ে গিয়েছিল কোহিমায়। পাহাড়ী শহর কোহিমা। অবাক বিস্ময়ে চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিল সিজিটো। তাদের পরিচিত ছোট ছোট গ্রাম, ধান আর জোয়ারের খেত, শ্যামল মালভূমির বাইরে এমন সুন্দর সাজনো একটা জনপদ থাকতে পারে, তা কি সে জানত? এই শহরেই আর একটা জগৎ তার পাহাড়ী মনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। সারুয়ামারুই পাদ্রীসাহেবের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। হুন্টসিঙ পাখির পালকের মতো ধবধবে গায়ের রং সাহেবের। চোখের মণি দুটো কী উজ্জ্বল! কী নীল!
ওই কোহিমা শহর, ওই পাদ্রীসাহেব বার বার সভ্যতা থেকে অনেক দূরের এক বিচিত্র পাহাড়ী মনকে আকর্ষণ করে আনল। অনেক গল্প শুনল সিজিটো। যীশুর কাহিনী, বাইবেলের গল্প। সেসব গল্পের প্রায় সবগুলোই সঙ্গে সঙ্গে ভুলে গেল সে। অনেক জামাকাপড় উপহার পেল। লালচে রঙের পানীয় আর খাবার খেয়ে এসে তার কথা সবিস্তার গ্রামের সকলকে বলল। পাদ্রী সাহেব একটু একটু করে ক্রস আঁকতে শেখাল তাকে। সে অনেক ইতিহাস।
এই কোহিমা পেরিয়ে সে সাহেবের সঙ্গে গিয়েছিল মোককচঙ, মোককচঙ থেকৈ মাও, মাও পেরিয়ে ইম্ফল। সাহেব তাকে আশ্বাস দিয়েছে, ডিমাপুরে নিয়ে যাবে। মস্ত বড় শহর গুয়াহাটিও বাদ যাবে না। সেখান থেকে শিলং।
সুদূর স্বপ্নবৎ শহরের গল্প বলে বলে সে গ্রামের সকলকে হকচকিয়ে দেয়। এই নগণ্য পাহাড়ী গ্রাম, আর ওই ছয় আকাশ ছয় পাহাড়ের ওপারে যে বিচিত্র জগৎ ছড়িয়ে রয়েছে, এই দুইয়ের মধ্যে সিজিটো হল সেতুবন্ধ। সারুয়ামারুই তাকে প্রথম শহরে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সারুয়ামারুর দৌড় কোহিমা পর্যন্ত। সারুয়ামারুকে অনেক পেছনে ফেলে অনেক এগিয়ে গিয়েছে সিজিটো।
কয়েক দিন আগে সে কোহিমা গিয়েছিল। এই মাত্র ফিরে এসেছে। অপূর্ব এক পৃথিবীর সংবাদ সে নিশ্চয়ই নিয়ে এসেছে। নিশ্চয়ই সে সংবাদ রূপকথার মতো মনোরম। গ্রামের মানুষগুলো সিজিটোর গল্প শোনার জন্য আগ্রহে, কৌতূহলে উদগ্রীব হয়ে রয়েছে।
বুড়ো খাপেগা বলল, এবার তো কোহিমা থেকে ফিরলি। সেখানকার গল্প বল সিজিটো। সকলে শুনি।
আকাশে সন্ধ্যার ছায়া গাঢ় হয়ে আসছে। বাতাস হিমাক্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। সিজিটো বলল, এখুনি রাত নামবে। চল, মোরাঙে গিয়ে বসি।
সারুয়ামারুর বউ জামাতসু এগিয়ে এল সামনে। সে বলল, আমরা মাগীরা তো মোরাঙে ঢুকতে পারব না। এখানে বসেই গল্প বল সেঙাইয়ের বাপ। আমি মশাল জ্বালিয়ে দিচ্ছি। আর হাত-পা সেঁকবার জন্যে কাঠে আগুন ধরাচ্ছি।
সিজিটোকে দেখে চোখ দুটো বিচিত্র আনন্দে ধক ধক জুলছিল জামাতসুর। সিজিটো এসেছে। রক্তকণাগুলো আগুনের বিন্দু হয়ে শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে তার।
জামাতসুর দিকে একবিন্দু হৃক্ষেপ নেই। সিজিটো সমানে বলে চলল, বুঝলি সদ্দার, তোর সঙ্গে একটা কথা আছে।
বুড়ো খাপেগা এই ছায়া-ছায়া অন্ধকারে সিজিটোর মুখের দিকে তাকাল, কী কথা রে সিজিটো?
ফাদার একবার আমাদের বস্তিতে আসতে চায়। তা আমি বললাম, আমাদের সদ্দারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিই। তারপর আমি খবর দিলে যাবি। আমাদের পাহাড়ী বস্তিতে না বলে কয়ে গেলে শেষে কে কোথা থেকে বর্শা হাঁকড়ে বসবে, তার কি কিছু ঠিক আছে? তোকে তো চেনে না আমাদের বস্তির লোকেরা। হয়তো তোকে শত্রু মনে করতে পারে। গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলল সিজিটো।
কিন্তু তোর ফাদার আমাদের বস্তিতে আসবে কী করতে? বুড়ো খাপেগার কপালে অসংখ্য বলিরেখায় সংশয় ফুটে বেরুল।
বস্তির সকলকে ক্রস আঁকা শেখাবে।
আমরা তো কেউ নিমক নিইনি তোর সাহেবের কাছ থেকে। তবে আমাদের ও-সব। শেখাবে কেন? তুই আর সারুয়ামারু নিমক নিয়েছিস, আরো কত কিছু নিয়েছিস, তোরা তোদের ফাদার যা বলবে, তাই করবি। খবদ্দার নিমকহারামি করবি না। আমরা নিমক নিইনি, আমরা কেন ও-সব শিখতে যাব? বুড়ো খাপেগার ভ্র দুটো কাঁকড়া বিছের মতো কুঁচকে এল।
হো-ও-ও-ও—
পাহাড়ী মানুষগুলো চিৎকার করে উঠল।
এই থাম শয়তানের বাচ্চারা। হুঙ্কার দিয়ে উঠল বুড়ো খাপেগা। তারপর আবার সিজিটোর দিকে তাকাল, না না, এই বস্তিতে হুই সব ভিনদেশী মানুষ ঢুকতে পারবে না। আনিজার গোসা এসে পড়বে। তোরা বস্তির বাইরে গিয়ে যা খুশি করিস। কিন্তু বস্তিতে হুই সব চলবে না।
আচমকা কে যেন বলে উঠল, রাত্তির হল, এখনও তো সেঙাই ফিরল না উত্তরের পাহাড় থেকে। ওর কী হল সদ্দার?
নাচ আর বাজনার তুমুল উল্লাসের মধ্যে সেঙাইর কথা খেয়াল ছিল না কারো। তার ওপর কোহিমা থেকে ফিরেছে সিজিটো। সঙ্গে নিয়ে এসেছে অফুরন্ত গল্পের ভাণ্ডার। সুদূর অজানা শহরের গল্প, বরফসাদা সাহেবদের গল্প। সেসবের ভেতর মগ্ন হয়ে গিয়েছিল ছোট্ট পাহাড়ী গ্রাম কেলুরির মানুষগুলো।
আচমকা সবাই চকিত হয়ে উঠল। তাই তো, সেঙাই নেই এই নাচ বাজনার আসরে, এই বিশাল আকাশের নিচে গল্পকথার উল্লসিত কলরবের মধ্যে।
বুড়ো খাপেগা বলল, উত্তর পাহাড়ে কখন গেল সে?
ওঙলে বলল, আমরা সকলে খুনোতে (আবাদী জমি) গিয়েছিলাম দুপুরে। আগাছায় আগুন দিয়ে ফিরবার পথে সেঙই গেল উত্তর পাহাড়ে। সে বলল, তোরা গিয়ে নাচ গান শুরু কর। আমি এখুনি আসছি। তখন বিকেল হয়েছে। গান বাজনার মধ্যে ওর কথা আর খেয়াল ছিল না। তাই তো, এখন কী করব সদ্দার?
কী সর্বনাশ! হুই দিকটা ভালো নয়। টিজু নদী পেরিয়ে হুই সালুয়ালাঙ বস্তির শয়তানেরা মাঝে মাঝে এপারে আসে। ওরা হল আমাদের শত্রু। শিগগির তোরা মশাল নিয়ে একবার যা। দ্যাখ কী হল?
সিজিটো বলল, যেতে হবে না। সেঙাই ঠিক এসে পড়বে।
আকাশ থেকে শীতের রাত এই নাগা পাহাড়ের ওপর গাঢ় অন্ধকার ঢালছে। নিবিড় অন্ধকার। কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই।
দাঁতমুখ খিঁচিয়ে সিজিটোর দিকে তাকাল বুড়ো খাপেগা, তুই চুপ কর। সায়েবদের গা চাট গিয়ে।
আচ্ছা আচ্ছা। আমি ঘরে যাই তবে। সামনের দিকে পা বাড়িয়ে দিল সিজিটো।
একসময় গোটাকয়েক মশাল জ্বলে উঠল। তারপর সেই মশালগুলো তীরের ফলার মতো সাঁ সাঁ করে নেমে গেল উপত্যকার দিকে।
হো-ও-ও-ও—
একটা ভয়ঙ্কর পাহাড়ী ঝড় উত্তর পাহাড়ের দিকে ধেয়ে চলল।
সালুয়ালা গ্রামের ওপর জা কুলি মাসের রাত্রি এখন নিথর হয়ে আছে। কেসুঙে কেসুঙে পাহাড়ী মানুষগুলো অসাড়ে ঘুমুচ্ছে। অন্ধকারের সঙ্গে গুঁড়ো গুড়ো বরফের কণা ঝরছে আকাশ থেকে। মোরাঙের মধ্যে পেন্যু কাঠের মশাল এখন নিভে গিয়েছে। অগ্নিকুণ্ড থেকে এতটুকু রক্তাভাসও বেরিয়ে আসছে না বাইরে।
হিমার্ত বাতাস মাঝে মাঝে চাবুকের মতো আছড়ে পড়ছে বনশীর্ষে। এই তুষারঝরা রাতে শুধুই কনকনে বাতাস আর নিবিড় অন্ধকার। পাহাড়ী গ্রামটা শীত ঋতুর ভয়াল রাতের থাবা থেকে পালিয়ে দড়ির লেপের নিচে ডুব দিয়েছে। একটা নিটোল আর মসৃণ ঘুমের অতল স্তরে তলিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।
কোথাও শব্দ নেই। নিস্তব্ধ জনপদ। এমনকি শুয়োর আর কুকুরগুলো পর্যন্ত একটু উত্তাপের জন্য পাহাড়ের খাঁজে ঢুকে গিয়েছে। কুণ্ডলী পাকিয়ে হিমাক্ত পাথরের ওপর স্থির হয়ে পড়ে রয়েছে পোষা মোষের দল।
এই সময় অনেক দূরের পোকরি কেসুঙ থেকে একটা মশালের আলো মোরাঙের দিকে। এগিয়ে আসতে লাগল। ক্ষীণ একটু আলোকবিন্দু। চারপাশের জমাট অন্ধকারকে সামান্য সরিয়ে আবছা পথ করে নিতে পেরেছে। মশাল ঘিরে ঝাপসা আলোর বৃত্ত। আর সেই বৃত্ত ঘিরে গুড়ো গুড়ো বরফের কণা উড়ছে।
একটু একটু করে মশালের আলোটা মোরাঙের পেছনে এসে দাঁড়াল। পাশে অতল খাদ। বনের বাঁধনে জটিল হয়ে পাহাড় খাড়া নিচের দিকে নেমে গিয়েছে। মশালের নিস্তেজ আলো খাদের গভীরে পৌঁছুতে পারেনি। চারপাশ থেকে গাঢ় কুয়াশা আলোকবিন্দুটির শ্বাসনলী চেপে ধরেছে যেন। আলো বেশিদুর ছড়িয়ে পড়তে পারছে না।
মশালের দু’পাশে দু’টি নারীমূর্তি। জানু থেকে মাথার ওপর পর্যন্ত দড়ির লেপ দিয়ে জড়ানো। তাদের ভৌতিক ছায়া এসে পড়েছে মোরাঙের দেওয়ালে। ছায়া দুটো কাঁপছে।
মোরাঙের দিকে দুজনে চনমনে চোখে তাকাল। তারপর একজন ভীরু গলায় বলল, খুব সাবধান মেহেলী, ওরা জানতে পারলে একেবারে টুকরো টুকরো করে কাটবে। আমার কিন্তু বড্ড ভয় করছে।
ভয় করলে কেসুঙে ফিরে যা লিজোমু। তুই আমার দাদাকে না পিরিত করতিস! তুই না দাদার পিরিতের মাগী ছিলি! তোর মতো মেয়েকে বর্শা দিয়ে কুঁড়ে মোরাঙে ঝুলিয়ে রাখা দরকার। মেহেলীর চোখ দুটো অন্ধকারেও জ্বলে উঠল।
আশ্চর্য! লিজোমু খেপে উঠল না। শুধু ফিসফিস গলায় বলল, খোকেকে খাদে ফেলে দিয়েছে সদ্দার। সে কি আর বেঁচে আছে?
খাদে ফেলার সময় একপাশে দাঁড়িয়ে আমি দেখেছি। এই ঘন বন। এর মধ্যেই হয়তো কোথাও আটকে আছে দাদা। তুই একটু দাঁড়া, আমি নিচে নেমে দেখে আসি। এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবি। খবদ্দার, মোরাঙের ওরা যেন টের না পায়। শেষ দিকে গলাটা কেঁপে কেঁপে উঠল মেহেলীর, তুই দেখিস, দাদা মরেনি। ও ঠিক আবার বেঁচে উঠবে। যদ্দিন সেরে না ওঠে, ওকে লুকিয়ে রাখতে হবে গাছের ওপরের ঘরে।
মোরাঙটার দিকে শঙ্কিত চোখে একবার তাকাল লিজোমু, আমার কিন্তু বুক কাঁপছে মেহেলী। আনিজার ভয়ে সদ্দার খোকেকে হুই খাদে ফেলে দিয়েছে। খোকেকে তুলে আনলে যদি আনিজার রাগ এসে পড়ে!
আতঙ্কে হঠাৎ মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেল মেহেলীর। তাই তো, এ ব্যাপারটা সে একবারও ভেবে দেখেনি। আনিজা! ওই একটি নামে ধমনীর ওপর রক্ত উথলপাথল হয়ে ওঠে। চেতনা কেমন যেন অসাড় হয়ে যায়। একবার টোক গিলল মেহেলী। পাহাড়কন্যা সে, হাতের মুঠিতে একটা বর্শা ধরা থাকলে শত্রুর হৃৎপিণ্ড এফেঁড় ওফোড় করে দিতে পারে। প্রয়োজন হলে মেরিকেৎসুর একটি আঘাতে গুড়ো গুঁড়ো করে দিতে পারে বুনো বাঘের মাথা। কিন্তু এই আনিজা নামটির মুখোমুখি হয়ে মেহেলী আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর কোত্থেকে সারা ধমনী মাতিয়ে মাতিয়ে রক্তের উচ্ছ্বাস খেলে গেল। একটা বিচিত্র দুঃসাহস কোত্থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সব দ্বিধা ভাসিয়ে নিয়ে গেল। সব ভীরুতা মুছে গেল পাহাড়ী মেয়ের চেতনা থেকে।
মেহেলী বলল, দাদা নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। এই বনের মধ্যে একটু একটু করে পচে মরবে সে! তুই কি তাই চাস লিজোমু? দেখি না, যদি বাঁচাতে পারি–
কিন্তু আনিজার রাগ? আর সদ্দার জানতে পারলে–বাকিটুকু আর শেষ করতে পারল না লিজোমু। অজানা আশঙ্কায় গলাটা আপনা থেকেই বুজে এল তার।
যা হবার হবে। আমার অত ভয় নেই। আনিজার রাগ হলেও মরব আর সদ্দার জানতে পারলেও বাঁচব না। তুই ওপরে দাঁড়া লিজোমু। আমি খাদে নামছি।
মশালটা বাঁ হাতের থাবায় চেপে ধরে খাড়াই পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে খাদের দিকে নেমে গেল মেহেলী। আর একটা প্রেমূর্তির মতো মোরাঙের পাশে, তুষারঝরা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে রইল লিজোমু।
পাহাড়ী অরণ্য। গহন আর নীরন্ধ্র। মশালটা নিয়ে সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে নামছে মেহেলী। গাছের ফাঁক দিয়ে, ঝোঁপের পাশ দিয়ে পথ করে করে এগুতে হচ্ছে। দুটো চোখের দৃষ্টিকে মশালের আলোর চেয়েও তীক্ষ্ণতর করে একটি মানবদেহের সন্ধানে চারিদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফেলছে সে। খোনকের দেহের এতটুকু চিহ্ন কোথাও দেখতে পেলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারপর দু’টি হাত দিয়ে জাপটে ধরে তুলে নিয়ে আসবে। মেহেলীর স্থির বিশ্বাস, খোনকের দেহটা খাদের অতলে গড়িয়ে যায়নি। এই বনের কোথাও, নিশ্চয়ই কোনো শিকড়ে কি গাছের ডালে, কি ঝোঁপের মাথায় আটকে আছে।
হিমঝরা এই বনের মধ্যে শ্বাপদের চিহ্নমাত্র নেই। গুহার সঙ্কীর্ণ বিস্তারের মধ্যে নিজেদের শরীর গুঁজে দিয়ে একটু উত্তাপ সৃষ্টি করছে তারা। বাঘ, চিতা কি বুনো মোষ জা কুলি মাসের এই প্রখর শীতের দাপটে তাদের সহজ বিচরণের রাজ্য থেকে পালিয়ে গিয়েছে।
জানুর তলা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত অনাবৃত। শীতের রাত শরীরের সেই অংশটুকুর ওপর কেটে কেটে বসছে। পা দুটো যেন পক্ষাঘাতের তাড়নায় অসাড় হয়ে আসতে শুরু করেছে মেহেলীর।
সামনের জীবো গাছটাকে কঠিন বাঁধনে জড়িয়ে ধরেছে একটা কালো রঙের লতা। আচমকা মেহেলীর মশাল কেমন করে যেন সেই লতায় গিয়ে লাগল। সাঁ করে লতাটা সোজা। হয়ে গেল, তারপরেই কালো বিদ্যুতের মতো পাশের একটা ঝোঁপের ওপর আছড়ে পড়ে অদৃশ্য হল। লতা নয়, একটা পাহাড়ী অজগরের বাচ্চা।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল মেহেলী। কিছুক্ষণ পর সতর্কভাবে আবার নিচের দিকে পা চালিয়ে দিল সে।
জা কুলি মাসের রাত্রি ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে! অসহ্য শীতে আঙুলের ডগাগুলো চিনচিন করতে শুরু করেছে। চামড়া চৌচির করে ফিনকি দিয়ে যেন এখুনি রক্ত বেরিয়ে আসবে।
অসহায় চোখে চারিদিকে একবার তাকাল মেহেলী। কোথাও খোকের চিহ্নমাত্র নেই। যেদিকে তাকানো যাক, নিবিড় বন আর গাঢ় অন্ধকার হা হা গ্রাস মেলে রয়েছে। পাহাড়ী মেয়ে মেহেলীর বুকের মধ্যে ভয়ের শিহরন খেলে গেল। সমস্ত দেহটা শিরশির করে উঠল তার।
পাশেই কোনো একটা গুহা থেকে এই অতল খাদ কাঁপিয়ে গর্জন করে উঠল একটা খ্যাপা বাঘ। সেই গর্জনের প্রতিধ্বনি দু’পাশের পাহাড়ে আছাড়ি পিছাড়ি খেতে খেতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কোথায় কোন বনচূড়া থেকে প্রেতকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল এক ঝাক টানডেলা পাখি। পাখি নয়, যেন আনিজার কান্না। বাইরেই কেবল হিম ঝরছে না, অপরিসীম ভয়ে সারা দেহের রক্ত গুড়ো গুঁড়ো বরফ হয়ে ধমনীর ওপর আছাড় খেতে লাগল মেহেলীর। একসময় প্রায় অসাড় শরীর নিয়ে পাহাড়ের একটা খাঁজের মধ্যে বসে পড়ল সে। তার হাতের থাবা থেকে মশালটা ছিটকে পড়ল ঘাসের ওপর।
শুকনো ঘাস। জা কুলি রাত্রির হিমে ভিজে গিয়েছিল। তবে পেন্যু কাঠের মশালের শিখা লেগে জ্বলে উঠল। শীতে আড়ষ্ট দু’টি হাত আর দু’টি পা সেই আগুনের দিকে বাড়িয়ে দিল মেহেলী।
সারা দেহের পেশীতে পেশীতে চেতনা ছিল না তার। একটু একটু করে আগুনের উত্তাপে রক্ত সঞ্চালন শুরু হল। জা কুলির রাত্রির হিমঝরা শীতে আগুনের শিখাটুকুতে মধুর আরাম রয়েছে।
সেই আগুন একটু পরেই নিস্তেজ হয়ে এল। ঊর্ধ্বমুখ শিখা ক্ষীণ হল। আগুনের অল্প অল্প আভা রয়েছে শুধু। আচমকা সেই ক্ষীণ রক্তাভায় সামনের দিকে তাকাতেই সারা দেহে কেমন চমক খেলে গেল মেহেলীর। স্নায়ুগুলো ঝঙ্কার দিয়ে উঠল। সামনের ভেরাপাঙ গাছের ঝাঁকড়া মাথায় একটা মানুষের দেহ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে তার হাত বাইরে বেরিয়ে এসেছে। নিশ্চয়ই খোনকে।
পাহাড়ী ঘাসের আগুন নিভে আসছে। বিষণ্ণ রক্তাভা মুছে যেতে শুরু করেছে। হঠাৎ রক্তে প্রখর উত্তেজনা ঝা ঝা করতে শুরু করল মেহেলীর। জা কুলি রাত্রির হিমে শরীরটা অসাড় হয়ে এসেছিল। সে কথা ভুলে গেল মেহেলী। বিদ্যুতের স্পর্শে যেন লাফিয়ে উঠল সে। তারপর পে কাঠের মশালটা ঘাসের আগুনে গুঁজে দিল। কিন্তু নিভন্ত আগুনে মশাল জ্বলে উঠল না।
একপাশে মশালটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল মেহেলী। তারপর নিরুপায় চোখে একবার এদিকে সেদিকে তাকিয়ে নিল। কিন্তু জা কুলি মাসের এই তুষারঝরা রাত্রি বড় নির্মম, ভীষণ নিষ্ঠুর। এতটুকু আগুন, এতটুকু উত্তাপের আভাসকে টুটি টিপে ধরার জন্য চারিদিকে ওত পেতে রয়েছে সেটা।
নাঃ, মূর্তির মতো এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। যেমন করেই হোক, খোনকের কাছে এখুনি পৌঁছুতে হবে মেহেলীকে। পাহাড়ী ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে সামান্য আগুন থেকে যে আলোটুকু বেরুচ্ছে সেটুকু ভরসা করেই মেহেলীর দেহমনে প্রেরণার উচ্ছ্বাস খেলে গেল। সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে সামনের ভেরাপাঙ গাছটার তলায় এসে দাঁড়াল মেহেলী।
প্রায় নিরেট অন্ধকার। ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে যে রক্তাভ আলো রয়েছে তার রেশ এতদূর এসে পৌঁছুতে পারেনি। আন্দাজে আন্দাজে, হাতড়ে হাতড়ে শেষ পর্যন্ত সেই নরদেহটির কাছে উঠে এল মেহেলী। এমনকি তার হাতখানা পর্যন্ত ছুঁতে পারা যাচ্ছে। বিশাল গাছ বেয়ে এই। মগডালে উঠতে হাঁপ ধরে গিয়েছিল মেহেলীর। দ্রুত তালে কয়েকটা নিশ্বাস পড়ল ঘন ঘন। ফুসফুস ভরে বারকয়েক বাতাস টেনে নেবার পর নিজের শরীর থেকে দড়ির লেপখানা খুলে ফেলল মেহেলী। তারপর অসাড় নরদেহটির আগাগোড়া নিবিড় করে জড়িয়ে দিল।
অনাবৃত দেহ। শীতের রাত চারিদিক থেকে নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেহেলীর ওপর। মনে হল, দাঁতে দাঁতে, নখে নখে এই হিমঝরা রাত্রি ফালা ফালা করে ছিঁড়ে ফেলবে তাকে। আর অপেক্ষা করা চলবে না। প্রতিটি মুহূর্তে এই রাত তাকে একটু একটু করে গ্রাস করছে।
গাছের মাথা থেকে সেই নিশ্চেতন নরদেহটিকে পিঠের ওপর তুলে নিল মেহেলী। ভারী সবল দেহ। মেরুদণ্ডটা বেঁকে যাবার উপক্রম হল তার। দড়ির লেপের দু’টি প্রান্ত দিয়ে নিজের পেটের সঙ্গে নরদেহটিকে বেঁধে নিল মেহেলী। পাহাড়কন্যা সে। পাথরের মতো কঠিন তার দেহের পেশী। ধীরে ধীরে সতর্কভাবে পা ফেলে ফেলে সরু ডাল থেকে মোটা শাখায়, তারপর বিশাল গুঁড়ি বেয়ে বেয়ে নামতে লাগল মেহেলী।
নিচে নেমে মানুষটাকে নামিয়ে বারকয়েক জোরে জোরে শ্বাস টানল সে। তারপর ঠাণ্ডা নরদেহটিকে আবার পিঠের ওপর তুলে নিল। এবার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বেয়ে খাড়া চড়াইর দিকে উঠতে লাগল সে। পিঠের ওপর অচেতন মানুষটির দেহভারে ধনুকের মতো বেঁকে গিয়েছে মেহেলী। মেরুদণ্ডটা টনটন করছে, যেন দেহ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাবে সেটা। দুহাত দিয়ে সামনের লতাপাতার বাধা সরিয়ে এগুতে লাগল মেহেলী।
হঠাৎ ডান পাখানা পিছলে গেল মেহেলীর। ছিটকে একটা পাহাড়ী গর্তের মধ্যে পড়ে গেল সে। কোমরের ওপর প্রচণ্ড চোট লেগেছে। মনে হচ্ছে, শরীরের নিচের দিকটা ছিঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। জা কুলি রাত্রির এই চোটের কারণে মজ্জায় মজ্জায় তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা চমক দিয়ে যাচ্ছে তার। তীব্র গলায় আর্তনাদ করে উঠল মেহেলী, আ-উ-উ-উ–
কয়েক মুহূর্ত পর আবার খাড়া হয়ে উঠল মেহেলী। ইতিমধ্যে নরদেহটিকে পিঠ থেকে কাঁধের ওপর তুলে নিয়েছে সে।
নিস্তব্ধ আর নির্জন চড়াই। কাঁধে একটি অচেতন মনুষ্যদেহ ছাড়া আর কোথাও কোনো প্রাণের সাড়া নেই। এই মুহূর্তে কোনো হিংসে শ্বাপদের চোখে খানিকটা নীল আগুন দেখতে পেলেও আশ্বস্ত হতে পারত মেহেলী। কিন্তু এই ভয়াল শীতের রাতে কোনো আরণ্যক প্রাণীর সান্নিধ্য পাওয়া যাবে না কোথাও।
একসময় খাদের অতল থেকে ওপরে উঠে এল মেহেলী। একবার মোরাঙের পাশে দাঁড়িয়ে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। নাঃ, ভয়ের কারণ নেই। মোরাঙের জোয়ান ছেলেরা দড়ির লেপের নিচে স্বপ্নের মনোরম জাল বুনে চলেছে এখন। সেই জালের কেন্দ্রবিন্দুতে একটি মাত্র মুখ। সে মুখ তাদের লগোয়া লেনদের (প্রেমিকাদের) মুখ।
একবার নিচের দিকে তাকাল মেহেলী। তারপর ফিসফিস গলায় ডাকল, লিজোমু, এই লিজোমু–
কোনো উত্তর নেই।
ফের ডাকল মেহেলী, এই লিজোমু–
খাদের ওপরে এই মোরাঙের কিনারে লিজোমু নামে কোনো নারীর গলা থেকে এবারও উত্তর এল না। নিশ্চয়ই সে এই অসহ্য শীতরাত্রির হিম সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে গিয়ে দড়ির লেপের উষ্ণ আরামে এতক্ষণে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়েছে।
আচমকা মোরাঙের মধ্যে মৃদু কলরব শোনা গেল। জেনুর (মধ্যরাত্রি) আগে গ্রামে গ্রামে নাগারা একবার জেগে ওঠে। নাগা পাহাড়ে এ একটা প্রচলিত রীতি।
আর দাঁড়াল না মেহেলী। মোরাঙের কিনার থেকে দ্রুত পাশের টিলার দিকে উঠে গেল সে। এই রাত্রিবেলায় সর্দার তার পিঠে খোনকের দেহটি দেখতে পেলে উপায় থাকবে না। নিদারুণ আতঙ্কে পায়ের পেশীতে পেশীতে দুর্বার বেগ নেমে এল। জা কুলির এই হিমা রাতেও গল গল করে ঘাম ছুটতে শুরু করেছে মেহেলীর।
এক এক করে নগুরি কেসুঙ, কাতারি কেসুঙ, নিপুরি কেসুঙ, পেরিয়ে গ্রামের প্রান্তে চলে এল মেহেলী। চারপাশে ঘন কুয়াশার পর্দা নেমে এসেছে। নানা কেসুঙের ঘরগুলোতে অস্পষ্ট আলো দেখা যায়। মাঝরাতে পাহাড়ী প্রথা অনুযায়ী সমস্ত সালুয়ালাঙ গ্রামখানা ঘুমের অতল স্তর থেকে জেগে উঠেছে। সামান্য কয়েকটি মুহূর্ত। মুঠি মুঠি কাঁচা তামাকপাতা চিবিয়ে কি বাঁশের পানপাত্রে কয়েক চুমুক রোহি মধু খেয়ে স্নায়ুগুলোকে চাঙ্গা করে তুলবে পাহাড়ী মানুষগুলো। তারপর আবার দড়ির লেপের তলায় মসৃণ একখানা ঘুমের মধ্যে ডুবে যাবে।
কখন যে বিশাল খাসেম গাছটার তলায় এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল ছিল না মেহেলীর। এখন আর অস্বস্তি নেই। অন্তত সূর্য ওঠার আগে পর্যন্ত সে নিশ্চিন্ত। সকালের আলোতে পাহাড়ী মানুষগুলির হিংস্র চোখ খুলবার আগেই সে খোনকেকে লুকিয়ে ফেলতে পারবে।
একটু পর বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে গাছের ওপর উঠে এল মেহেলী। কাঁধে সেই আচেতন নরদেহ। গাছের ডালে ছোট্ট একখানি ঘর। বাঁশের দেওয়ালে লতার বাঁধন আর মাথায় আতামারী পাতার চাল। এই ঘরখানা মেহেলীর। রাতে এখানেই তার নিঃসঙ্গ বিছানা পাতা হয়। কুমারী মেয়ের একক শয্যা পুরুষের কামনা থেকে অনেক, অনেক উঁচুতে যেন উঠে এসেছে।
ধীরে ধীরে মাচানে মানুষটিকে শুইয়ে দিল মেহেলী। তারপর একটা হরিণের ছাল নিজের সারা গায়ে জড়িয়ে মানুষটির দিকে ঝুঁকে পড়ল। পাতার চাল, চারপাশে বাঁশের বেড়া আর সমস্ত দেহে হরিণের ছাল জড়ানো। সব মিলিয়ে একটা উষ্ণ আরামদায়ক পরিমণ্ডল।
মেহেলী ডাকল, দাদা, এই দাদা–
নিরুত্তর পড়ে রইল মানুষটি। একটু চুপ করে রইল মেহেলী, তারপর একখানা হাত সেই লোকটার ঠাণ্ডা শরীরে বিছিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর একটু একটু কঁকানি দিতে লাগল সে। নাঃ, জীবনের কোনো লক্ষণ, চেতনার কোনো আভাসই নেই সেই দেহে। অনেকক্ষণ আগে খোকেকে সেই খাদের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল মোরাঙের জোয়ানেরা! জা কুলি রাতের হিমে হিমে একেবারে জমাট বরফ হয়ে গিয়েছে তার দেহ। মানুষটির নাকের কাছে হাত রাখল। মেহেলী। অনেকটা পর পর গরম নিশ্বাসের ক্ষীণ এক একটা ধারা তিরতিরিয়ে পড়ছে হাতের ওপর। এই শ্বাসপতন বুঝিয়ে দিচ্ছে খোনকে বেঁচে আছে। নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। সর্বাঙ্গে ঢেউ খেলে গেল মেহেলীর। তার এই দুঃসাহস, আনিজার বিরুদ্ধে এই সক্রিয় প্রতিবাদ তবে ব্যর্থ হয়নি।
ঘরের এক কোণে মাটির পাত্রে একরাশ নিভু নিভু আগুন রয়েছে। হামাগুড়ি দিয়ে পাত্রটার কাছে চলে এল মেহেলী। ওটার ঠিক পাশেই অনেকগুলো বাঁশের চোঙা, রোহি মধুতে কানায় কানায় পূর্ণ। একটা পানপাত্র তুলে ঢকঢক করে আকণ্ঠ গিলে নিল মেহেলী। শরীরটা এবার বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। শীতার্ত ইন্দ্রিয়গুলো সক্রিয় হচ্ছে তার। এখন হিমঝরানো জা কুলির রাতটার সঙ্গে অনেকক্ষণ লড়াই করতে পারবে মেহেলী।
বাঁশের পাটাতন থেকে আগুনের আধারটা তুলে নিল সে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে আবার সেই মানুষটির কাছে চলে এল। আগুন নিভে এসেছিল, জোরে জোরে কয়েকটা ফুঁ দিল মেহেলী। ওপরের সাদা রঙের ছাই সরে গিয়ে আগুনটা বেরিয়ে এল।
পাটাতনের একপাশে একপিণ্ড কার্পাস তুলো পড়ে ছিল। সেটা তুলে আগুনের পাত্রটার ওপর মেলে ধরল মেহেলী। পরম মমতায় গরম তুলো দিয়ে সেঁক দিতে শুরু করল সে। বার বার। অচেতন দেহে একটু একটু করে প্রাণের সাড়া জাগল যেন, তারপর থরথর করে কেঁপে উঠল সেটা।
হঠাৎই ঘটে গেল ঘটনাটা। সেঁক দিতে দিতে মেহেলীর হাতখানা মানুষটার বুকের কাছে চলে এসেছিল। কিন্তু হাতড়ে হাতড়ে সেই বুকের কোথাও বিশাল ক্ষত খুঁজে পেল না মেহেলী। তবে, তবে এ কে? এ দেহ কার? খাদের অতল অরণ্য থেকে জা কুলি মাসের এই হিমাক্ত। রাত্রিতে কার দেহ বয়ে এনেছে মেহেলী? এ তো খোনকে নয়!
আনিজা! আনিজা! খাসেম গাছের মগডালে কুমারী মেয়ের এই ছোট্ট শোওয়ার ঘর। এই ঘরে কি খোনকের বদলে কোনো প্রেতাত্মার দেহ তুলে আনল মেহেলী? আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠতে চাইল সে, কিন্তু থাবা দিয়ে কে যেন কণ্ঠনলী চেপে ধরেছে। একটা শব্দও বেরিয়ে এল না তার গলা থেকে। অপরিসীম আতঙ্কে একেবারে পাথর হয়ে গিয়েছে যেন মেহেলীর সারাটা দেহ।
প্রচণ্ড আতঙ্ক খেলে গেল দেহমনে। গাছের ওপর এই শূন্যের আশ্রয় থেকে মেহেলী পালিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু প্রাণান্ত চেষ্টাতেও বাঁশের সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে দেবার সামর্থ্যটুকুও সে হারিয়ে ফেলেছে। নিপ্রাণের মতো বসেই রইল মেহেলী।
জমাট অন্ধকার। একসময় সামনের নিঃসাড় দেহটা থেকে একটা অস্ফুট কাতরোক্তি শুনতে পেল মেহেলী, আ-উ-উ-উ–
নাঃ, আনিজা নয়। একটি জীবন্ত মানুষ রয়েছে এই ছোট্ট ঘরখানার মধ্যে। খানিকটা সাহস ফিরে এল মেহেলীর স্নায়ুগুলোতে। সাহস নয়, দুঃসাহস। আগুনের পাত্রটা মানুষটির মুখের
কাছে নিয়ে এল মেহেলী। এক অদম্য কৌতূহলে তার নিশ্বাস দ্রুততর হয়ে উঠেছে।
অগ্নিপাত্রটার ওপর ঝুঁকে বারকয়েক জোরে জোরে ফুঁ দিল মেহেলী। আর সেই রক্তাভ আগুনের আভায় মানুষটির মুখখানা দেখে চমকে উঠল সে। খোনকে নয়, এ তো টিজু নদীর ওপারের কেলুরি গ্রামের ছেলে সেঙাই। তাদের শত্রুপক্ষ। বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে রইল মেহেলী। তবে তো খাদের গভীর পাতাল থেকে শত্রুপক্ষের ছেলেকে পিঠের ওপর তুলে নিয়ে এসেছে সে! তারপর পরম মমতায় নিজের বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে।
আ-উ-উ-উ– এবার দেহটা নড়তে শুরু করেছে। আর মাঝে মাঝে অস্পষ্ট গলায়। আর্তনাদ করে উঠছে সেঙাই।
সেঙাই! তাদের শত্রুপক্ষের ছেলে। কয়েক দিন আগের একটা মোহময় বিকেল চেতনার মধ্যে দোল খেয়ে উঠল যেন মেহেলীর। সেদিন জোহেরি বংশের দুর্দান্ত যৌবনের মুখোমুখি হয়েছিল সে। একটা বর্শার ফলা তার দিকে তুলে ধরেছিল সেঙাই।
আশ্চর্য! রোজ টিজু নদী ডিঙিয়ে কী এক অদম্য আকর্ষণে ওপারের সেই নিঃশব্দ ঝরনাটার পাশে চলে যেত মেহেলী। টানডো পাখির মতো জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে স্নান করতে বড় ভালো লাগত। বিচিত্র যোগাযোগ। সেই ঝরনার পাশেই দেখা হয়েছিল সেঙাইর সঙ্গে। বর্শা তুলে ধরেছিল বটে, কিন্তু সামান্য একটু আত্মসমর্পণ করতে আর তাকে ঘা দেয়নি শত্রুপক্ষের ছেলে। পাহাড়ী জোয়ানের পিঙ্গল দু’টি চোখে বিচিত্র এক ভাষা দেখে তার যৌবন ঝঙ্কার দিয়ে উঠেছিল। সোনালি বুক, নিটাল দেহ, মসৃণ শরীর। বুকের ভেতর শিহরন খেলে গিয়েছিল তার। পাহাড়ী কুমারীর যৌবন জলপ্রপাতের মতো উদ্দাম। সেদিন সেঙাই-এর বর্শার নিচেই নিজেকে সমর্পণ করেনি মেহেলী, ভেবেছিল নিবিড় আলিঙ্গনে জোহেরি বংশের এক খ্যাপা যৌবন যদি তাকে পিষে ফেলত, তা হলে হয়তো সে চরিতার্থ হতে পারত। তার নিজেকে সমর্পণ সার্থক হয়ে উঠত। কিন্তু সেদিন সেঙাই তাকে ছুঁয়েও দেখেনি, নিঃশব্দে চলে গিয়েছিল। তারপর আরো কদিন ঝরনার ধারে সেঙাই-এর খোঁজে গিয়েছে মেহেলী। কিন্তু শত্রুপক্ষের যুবকটিকে আর দেখা যায়নি।
সেদিনের বিকেল ঘিরে তার বন্য কামনার কথা থাক। একটা হিসাব কিছুতেই মিলছে না মেহেলীর। এই অতল খাদের মধ্যে কী করে এসে পড়ল সেঙাই? টিজু নদী ডিঙিয়ে সালুয়ালাঙ গ্রামের খাদে কিসের সন্ধানে এসেছিল সে?
আ-উ-উ-উ–আর্তনাদটা এবার বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
চকিত হয়ে উঠল মেহেলী। হামাগুড়ি দিয়ে রোহি মধু-ভরা একটা বাঁশের পানপাত্র নিয়ে এল। হাতিয়ে হাতিয়ে সেঙাই-এর মুখখানা খুঁজে বার করল। ঠোঁট দুটো দৃঢ়বদ্ধ। ডান হাতের আঙুল দিয়ে সেঙাই-এর মুখটা ফাঁক করে দিল মেহেলী। তারপর বাঁশের পানপাত্র থেকে ফোঁটা ফোঁটা রোহি মধু ঢেলে দিতে লাগল জিভে। প্রথমে চেটে চেটে সেই উষ্ণ পানীয়ের আস্বাদ নিতে লাগল সেঙাই। পরে ঢকঢক করে গিলে পানপাত্রটা শূন্য করে দিল।
মেহেলী ডাকল, এই সেঙাই, এই—
সাড়া নেই। শরীর আবার নিথর হয়ে গিয়েছে। নিরুত্তর পড়ে রইল সেঙাই।
এবার দুহাত দিয়ে আঁকানি দিল মেহেলী। তবু জবাব নেই সেঙাই-এর তরফ থেকে। তেমনই চুপচাপ পড়ে রয়েছে সে।
সমস্ত দেহের রক্তকণাগুলো সরীসৃপের মতো কিলবিল করতে শুরু করেছে মেহেলীর। একটি কঠিনপেশী জোয়ান ছেলে, এই শীতের রাত্রি, সেই জোয়ান ছেলেটিকে আগুনের তাপে উষ্ণ করে তুলেছে সে, রোহি মধুর মৌতাত দিয়ে তার স্নায়ুগুলোকে উত্তেজিত করে তুলতে চেয়েছে। কিন্তু এ কী হল? সেঙাই-এর হিমার্ত দেহের শুশ্রূষা করতে করতে এক বিচিত্র সম্ভাবনা শিরায় শিরায় বিদ্যুতের মতো খেলে গিয়েছে তার। এই কুমারীগৃহ দু’টি পাহাড়ী যৌবনকে নিয়ে সার্থক হয়ে উঠতে পারে। এই নিঃসঙ্গতা মনোরম হয়ে উঠতে পারে। মেহেলী ভুলে গিয়েছে খোকের কথা। তার রক্তে রক্তে আদিম অরণ্য ডাক দিয়েছে।
খ্যাপা বাঘিনীর মতো সেঙাই-এর পাশে বসে ফুলতে লাগল মেহেলী। এই শীতের হিমে আচমকাই যদি শত্রুপক্ষের পুরুষ তার কাছে এসে পড়েছে, কেন সে তার কুমারী জীবনের বাসনাকে অতৃপ্ত রেখে দেবে? বুকের ভেতর মেহেলীর ফুসফুসটা ফুঁসে ফুঁসে উঠছে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় কেঁপে উঠছে সারা দেহ।
আচমকা সেঙাই-এর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল মেহেলী। দু’টি হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল তার দেহটা। মেহেলীর ধারাল নখ কেটে কেটে বসে গেল সেঙাই-এর বুকে পিঠে গলায় ঘাড়ে।
ময়াল সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটা উত্তপ্ত নিশ্বাস পড়ল সেঙাই-এর বুকে। মেহেলী চাপা গলায় গর্জন করে উঠল, এই সেঙাই, এই
নিথর পড়ে রয়েছে সেঙাই। একবার শুধু অপরিসীম ক্লান্ত গলায় আর্তনাদ করে উঠল সে, আ-উ-উ-উ–
হিস হিস করে উঠল মেহেলী, আমি তোকে খাদ থেকে তুলে আনলাম। আর আমার কথাটা শুনতে পাচ্ছিস না শয়তানের বাচ্চা!
মেহেলীর আলিঙ্গন তীব্র হল, তারপর তীব্রতর। তার শাণিত নখ আর দাঁতগুলো ফালা ফালা করে ছিঁড়ে ফেলতে লাগল সেঙাই-এর দেহ।
আ-উ-উ-উ–
সমস্ত শরীর শিথিল হয়ে গিয়েছে সেঙাই-এর। পাহাড়ী যুবতী মেহেলী তার দেহের সমস্ত উত্তাপ দিয়ে, তার মনের সমস্ত কামনার আগুন দিয়ে, তার বন্য উত্তেজনা দিয়ে আর ধারাল নখ-দাঁতের আঘাত দিয়েও সেঙাইকে মাতিয়ে তুলতে পারল না।
জা কুলি মাসের একটা উত্তেজক রাত মেহেলীর কাছে ব্যর্থ হয়ে গেল। একসময় পাহাড়ের ওপর আলোর অস্পষ্ট আভাস দেখা দিল। ঘন কুয়াশা ভেদ করে সেই আলো এসে পড়েছে খাসেম গাছের এই ছোট্ট ঘরখানায়।
সেঙাই-এর বুকের পাশে সারা রাত শুয়ে ছিল মেহেলী। এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলল। প্রথম ভোরের এই অস্পষ্ট আলোতে সেঙাই-এর দিকে তাকিয়ে একটা তীব্র চমক খেলে গেল তার চেতনায়। কী ভয়ানক, কী বীভৎস দেখাচ্ছে সেঙাইকে।
একটু পর আস্তে আস্তে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেম গেল মেহেলী।
দক্ষিণ পাহাড় থেকে এখন কুয়াশা সরে গিয়েছে। উত্তর পাহাড়ের ঘন সবুজ উপত্যকা রোদের আলোতে ঝলমল করছে। কাল রাতে আকাশ থেকে যে অজস্র তুষারকণা ঝরেছিল, সূর্যের উত্তাপে টলটলে জলবিন্দু হয়ে ঘাস বা গাছের পাতায় সেগুলো ঝলমল করছে।
এদিকে পাহাড়ের চড়াইতে এই ছোট্ট পাহাড়ী গ্রাম সালুয়ালাঙ জেগে উঠেছে। কেসুঙে কেসুঙে নানা মানুষের চেঁচামেচিতে, আউ পাখির চিৎকারে, কুকুর আর মোরগগুলোর অবিশ্রান্ত ডাকাডাকিতে উদ্দাম পাহাড়ী জীবনের পরিচয়।
খাসেম গাছের মগডালে একটি নিঃসঙ্গ কুমারী মেয়ের বিছানা। তার ওপর একটু একটু করে চোখ মেলল সেঙাই। পিঙ্গল চোখ এখন লাল। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছে না সে। অপরিসীম ক্লান্তিতে চোখ দুটো আপনা থেকেই বুজে আসছে। প্রচণ্ড নেশার পর পেশীগুলো যেমন শিথিল হয়ে আসে, ঠিক তেমনই এক অবসাদে দেহের গ্রন্থিগুলো যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।
কিছুক্ষণ নির্জীবের মতো পড়ে রইল সেঙাই। তারপর আবার চোখ মেলল। চোখ মেলল, কিন্তু কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছে না। তার দৃষ্টির সামনে চারিদিক ঝাপসা ঝাপসা। উপত্যকায় ওই রোদের রং, দক্ষিণ পাহাড়ের সারা গায়ে ওই নিবিড় বন-সব এক তরল ছায়ালোকের আড়ালে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মাথার রগগুলো ঝনঝন করে ছিঁড়ে পড়ছে সেঙাইর, মজ্জায় মজ্জায় তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা চমক দিয়ে যাচ্ছে।
আরো অনেকটা সময় পার হয়ে গেল।
এবার চারিদিকে একবার চোখ দুটো ঘুরিয়ে আনল সেঙাই। মাটি থেকে অনেক উঁচুতে এই ঘর। নিচে বাঁশের পাটাতন, একপাশে গোটা কয়েক রোহি মধু-ভরা বাঁশের পাত্র, স্থূপাকার কার্পাস তুলোর পাঁজ, হরিণ আর মোষের কঁচা ছাল থেকে উগ্র দুর্গন্ধ–এ ছাড়া ঘরের মধ্যে আর কিছু নেই। অন্য কাউকেও এখানে দেখা যাচ্ছে না।
একসময় নিজের দিকে তাকাল সেঙাই। সারা দেহে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। থকথকে রক্ত হিমে জমে যাবার কারণে কালো হয়ে গিয়েছে। কপাল গলা বুক–দেহের প্রতিটি অংশে ফালা ফালা আঘাতের দাগ। কোথাও বা নখ আর দাঁতের অগভীর ক্ষত।
নিজের শরীরের এই বীভৎস আঘাতগুলোর কথা ভাবছে না সেঙাই। তার চেতনার মধ্যে চমক দিয়ে যাচ্ছে কালকের হিমাক্ত রাতটা। অস্পষ্ট কতকগুলি দৃশ্য। সেগুলোর ধারাবাহিকতা নেই, অসংলগ্ন সেই সব দৃশ্যের মিছিল সেঙাই-এর স্নায়ুর ওপর দোল খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে।
সালুয়া গ্রাম। সেখানকার মোরাঙ। খোনকের বুকের ক্ষতমুখে মেটে রঙের হৃৎপিণ্ড। তামুন্য। সালুয়ালা গ্রামের সর্দার। মোরাঙের দরজায় মশাল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল মেহেলী। একসময় খোনকেকে খাদে ফেলতে এসেছিল এই গ্রামের কয়েকটি জোয়ান ছেলে। তার আগেই খানিকটা নিচের দিকে নেমে একটা বিশাল পাথরের চাই ধরে আশ্রয় নিয়েছিল সেঙাই। তারপর হিম আর হিম। আশুমি সাপের বিষের মতো জা কুলি রাত্রির হিম তার দেহটাকে জর্জরিত করে দিয়েছিল। অবশ হয়ে গিয়েছিল চেতনাটা। একসময় খোনকেকে খাদে ফেলে গিয়েছিল জোয়ান ছেলেরা। খাড়াই পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে, নিবিড় বনের ফাঁক দিয়ে, গুম গুম শব্দ করতে করতে নেমে গিয়েছিল খোনকের দেহ। তারপরেই আশ্চর্য হিমে হাতের থাবা শিথিল হয়ে গিয়েছিল সেঙাই-এর। অস্পষ্ট চেতনার মধ্যে বুঝতে পারছিল, শূন্যে পাক খেতে খেতে সে নেমে যাচ্ছে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
কিন্তু এই মুহূর্তে সেঙাই-এর দুর্বল স্মৃতি কিছুতেই ধরতে পারছে না, কেমন করে এই অচেনা ঘরের মধ্যে সে চলে এল? কে তাকে এই নিঃসঙ্গ বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গিয়েছে?
হঠাৎ বাঁ দিকে তাকাল সেঙাই। একটা কাঠের পাত্রে একপিণ্ড ভাত, খানিকটা ঝলসানো মাংস আর বাঁশের পানপাত্রে রোহি মধু রয়েছে। তার চোখ দুটো ধক করে জ্বলে উঠল। মনে পড়ল, কাল দুপুরের পর এক কণা ভাতও পেটে পড়েনি। আর কিছু ভাবার সময় নেই। পেটের মধ্যে খিদের ময়াল এতক্ষণ পাক দিচ্ছিল। অসীম অবসাদের জন্য খিদের বোধটা কেমন যেন ভোতা হয়ে ছিল। এই মুহূর্তে ভাতের পাত্রটা দেখবার সঙ্গে সঙ্গে পেটের সেই ময়ালটা দাপাদাপি শুরু করে দিল।
বুক হিঁচড়ে হিঁচড়ে পাত্রটার কাছে এগিয়ে এল সেঙাই। ভাতের দলার ওপর অনেকগুলো পাহাড়ী পিঁপড়ে জমা হয়েছে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই তার। ব্যগ্র একখানা থাবা পাত্রটার দিকে বাড়িয়ে দিল সে। বড় বড় গ্রাসে ভাত আর মাংস শেষ করে ফেলল। একপাশে বাঁশের পানপাত্রটা পড়ে ছিল, সেটা তুলে এক চুমুকে শূন্য করে দিল সেঙাই।
এখন অবসাদ অনেকটা কেটে গিয়েছে ইন্দ্রিয়গুলো থেকে। বেশ সুস্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। ভাত, মাংস আর রোহি মধু খাওয়ার পর শরীরটা রীতিমতো চাঙ্গা হয়ে উঠল সেঙাই-এর। এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে খাচ্ছিল, এবার বাঁশের পাটাতনের ওপর উঠে বসল।
খানিকটা সময় কেটে গেল। তারপর নিচের দরজার কাছে এসে মুখখানা বকের মতো বাড়িয়ে দিল সেঙাই। অচেনা গ্রাম। টিলার টিলায়, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অজানা মানুষের জটলা। যুবতী মেয়েরা সরু বাঁশের ফ্যাফা দিয়ে তুলো পিঁজছে। কেউ কেউ ন দিয়ে দড়ির লেপ বুনছে। আরো দূরে মেয়ে-পুরুষরা একসঙ্গে বেতের ত্রিকোণ আখুতসা (চাল রাখার ঝোড়া) বানাচ্ছে। নারী-পুরুষের যৌথ পরিশ্রমে এই পাহাড়ী গ্রাম দিনের কাজ শুরু দিয়েছে। কেউ কেউ পাথরের ওপর বর্শার ফলা শানিয়ে নিচ্ছে। এখানে প্রতিকূল প্রকৃতি। হিংস্র চিতা কি বুনো মোষ, হিংস্রতর প্রতিবেশী তাদের সঙ্গে বসবাস। অতএব, ধারাল বর্শার চেয়ে গভীর অন্তরঙ্গতা আর কার সঙ্গে সম্ভব? রোদের আলোতে ঝকমক করে উঠছে বর্শার ফলাগুলো।
গাছের ওপর ছোট্ট ঘরখানায় নিশ্চুপ বসে রইল সেঙাই। এখানকার একটি মানুষও তার পরিচিত নয়। এই অজানা গ্রামে এখন নামা নিরাপদ হবে না। ওই বর্শার ফলাগুলো তা হলে চৌফালা করে ফেলবে তাকে। আগে রাত্রি নামুক, তারপর দেখা যাবে। অন্ধকারের আড়াল ছাড়া এখান থেকে পালানো কোনোমতেই সম্ভব নয়। চারপাশে মৃত্যু ওত পেতে রয়েছে। ভাবতেও সেঙাই-এর মেরুদণ্ড বেয়ে হিমধারা নামতে শুরু করল।
বাঁশের মাচানের ওপর ফের শুয়ে পড়ে সেঙাই।
অনেকক্ষণ পর দূর থেকে মোষ বলির বাজনা ভেসে আসে। মেথিকেকোয়েনঘা খুলির গম্ভীর শব্দ উপত্যকার ওপর দিয়ে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। দ্রাম-ম-ম-ম-ম। সেই সঙ্গে খুঙের ভয়ঙ্কর আওয়াজ। বাজনার শব্দে নেশা ধরে গেল সেঙাই-এর। বন্দি শ্বাপদের মতো গর্জন করে উঠতে চাইল সে। কিন্তু না, অচেনা গ্রামের মানুষগুলো একবার টের পেলে রক্ষে নেই। অতএব, বুকের মধ্যে নিরুপায় গর্জনটাকে স্তব্ধ করে দিতে হল।
এখন দুপুর। সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘরের মধ্যে আটকে থাকতে হবে তাকে। অসহায় আক্রোশে ফুলতে লাগল সেঙাই।
আচমকা বাঁশের সিঁড়িতে শব্দ হল। আর সেই শব্দটা এই ঘরের দিকে উঠে আসছে। চমকে উঠল সেঙাই, তারপর দ্রুত নিচের ফোকরটার কাছে চলে এল।
বাঁশের সিঁড়িটা সরাসরি পাটাতন ছুঁড়ে ওপরে উঠে এসেছে। সেটা বেয়ে বেয়ে ঘরের মধ্যে চলে এল মেহেলী।
পায়ের শব্দে চমকে উঠেছিল সেঙাই। মেহেলীকে দেখে অপার বিস্ময়ে চোখ দুটো ভরে গেল তার। নির্নিমেষে তাকিয়ে রইল সে।
মেহেলী বলল, কি রে, উঠে পড়েছিস দেখছি–
সেঙ্গাইর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দপ করে চোখ জ্বলে উঠল মেহেলীর। সাঁ করে ঘরের এক কোণ থেকে লোহার একটা মেরিকেতসু তুলে এনে তাক করল সে।
মাথার ওপর উদ্যত মেরিকেতসু। আর পাহাড়ী মেয়ের দুচোখে নিষ্ঠুর ঝিলিক। অসহায় করুণ হয়ে এল সেঙাই-এর দৃষ্টি। আর্ত গলায় সে বলল, আমাকে মারিস না মেহেলী, কাল রাত্তিরে খাদে পড়ে গিয়েছিলাম। এই দ্যাখ, মাথা-হাত-পা কেটে ফালা ফালা হয়ে গেছে।
উবু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মেহেলী। এবার লোহার মেরিকেতসুটা বাঁশের পাটাতনের ওপর নামিয়ে সেঙাই-এর পাশে এসে বসল।
সেঙাই-এর দৃষ্টি থেকে তখনও ভয় আর চমক একেবারে মুছে যায়নি। ফিসফিস গলায় সে বলল, তুই এখানে কী করে এলি মেহেলী!
বাঃ, বেশ বললি তো! আমাদের বস্তিতে আমি থাকব না? হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল মেহেলী।
আমি এখানে এলাম কী করে?
আমার পিঠে চেপে। খাদের বন থেকে আমি তুলে নিয়ে এসেছি তোকে।
কৃতজ্ঞতায় চোখ দুটো কোমল হয়ে এল সেঙাই-এর। গলাটা কেমন যেন মধুর শোনাচ্ছে তার, তুই না তুলে আনলে আমি মরেই যেতাম মেহেলী। তুই আমাকে বাঁচিয়েছিস। সেঙাই এর দৃষ্টিটা মেহেলীর মুখের ওপর এখনও নিষ্পলক হয়ে রয়েছে।
হাসির প্রপাত এবার উদ্দাম হয়ে উঠল মেহেলীর, বাঁচাবার জন্যে তোকে তুলে আনিনি সেঙাই। ভালো করে মারার জন্যে এনেছি। তুই আমার দাদাকে মেরেছিস। তার শোধ তুলব না? সন্ধের সময় মোরাঙের সামনে তোকে বলি দেওয়া হবে। এখুনি গিয়ে জোয়ান ছেলেদের ডেকে আনছি।
মেহেলী! প্রায় আর্তনাদ করে উঠল সেঙাই।
কী বলছিস? মেহেলীর চোখ কুঁচকে গেল।
সেদিন আমাদের বস্তিতে তুই গিয়েছিলি। আমিও তোকে মারতে পারতাম। কিন্তু মারিনি। আজ আমাকে বাঁচা তুই। কেলুরি গ্রামের পাহাড়ী যৌবনকে বড় অসহায় দেখাচ্ছে এই মুহূর্তে। সেঙাই-এর করুণ অবস্থাটা একটু একটু করে উপভোগ করতে লাগল মেহেলী।
তুই আমার দাদাকে মেরেছিস। তার কী হবে?
তোর দাদা কে? চমকে উঠল সেঙাই।
খোনকে। খোনকেকে ওরা কাল খাদে ফেলে দিয়েছিল আনিজার ভয়ে। দাদাকে খুঁজতে খাদে নেমেছিলাম। অন্ধকারে ভুল হল; দাদার বদলে আমার পিঠে চড়ে তুই এলি। একটু থামল মেহেলী, তারপর বলল, আজ সারা সকাল দাদাকে কত খুঁজে এলাম। খাদের কোথাও তাকে পেলাম না। হয়তো বাঘেরা তাকে খেয়ে ফেলেছে।
মেহেলীর সমস্ত মুখখানা বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। দু’টি কপিশ চোখে কয়েক বিন্দু লবণাক্ত জলের আভাসও ফুটে বেরুল। মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত। তারপরেই সে গর্জে উঠল, তুই এই বস্তিতে এসেছিলি কী করতে? মরতে? জানিস সবাই জেনে গেছে, তুই আমার দাদাকে মেরেছিস। আমাদের বস্তির ছোকরারা তোকে পেলে একেবারে কিমা বানিয়ে ছাড়বে।
কে বলেছে আমি খোকেকে মেরেছি? কাঁপা গলায় জিগ্যেস করল সেঙাই। সালুনারু, তোদের বস্তির রেঙকিলানের বউ। সে সব বলে দিয়েছে আমাদের সদ্দারকে। দুর্বল স্মৃতির ওপর কালকের সন্ধ্যাটা ফুটে উঠল সেঙাইর। পাহাড়ের একটা ভাজ থেকে সে দেখেছিল সালুনারুকে। একটা মশাল নিয়ে সে অনেক দূরের কেসুঙগুলোর আড়ালে অদৃশ্য। হয়ে গিয়েছিল।
শিথিল গলায় সেঙাই বলল, সালুনারু তা হলে তোদের বস্তিতে এসে আস্তানা গেড়েছে। আমাদের বস্তি থেকে পালিয়ে এসেছে টেফঙের বাচ্চাটা। সদ্দার ওকে পেলে বর্শা দিয়ে ফুড়ে ফেলবে একেবারে। জানিস, কত বড় শয়তানী হুই সালুনারু!
কী করেছে সালুনারু?
যেদিন তোর দাদা খোনকেকে আমি বর্শা দিয়ে ফুঁড়েছিলুম সেদিন রাত্তিরে রেঙকিলান তো রেজু আনিজার রাগে পাহাড় থেকে পড়ে মরল। এক তাজ্জবের ব্যাপার সেটা। আমি, রেঙকিলান, ওঙলে আর পিঙলেই বস্তিতে ফিরে যাচ্ছি। আচমকা সালুনারুর মতো গলায় কে যেন ডাকল। আর তাই শুনে রেঙকিলান বাইরের পাহাড়ের দিকে চলে গেল।
তারপর? মেহেলীর চোখেমুখে কৌতূহল।
সকালবেলা সালুনারু এল রেঙকিলানের খোঁজে। সে নাকি আগের রাত্তিরে রেঙকিলানকে ডাকেনি বাইরের পাহাড় থেকে। বস্তির জোয়ানরা সকলে মিলে সদ্দারের সঙ্গে খুঁজতে বেরুলাম। তারপর দক্ষিণ পাহাড়ের খাদে নেমে দেখলাম, রেঙকিলান মরে পড়ে রয়েছে।
তারপর কী হল?
কী আবার হবে। আমাদের সর্দারের সঙ্গে ঝগড়া করলে সালুনারু, রেজু আনিজাকে গালাগালি দিলে। তখন সদ্দার যেই বর্শা দিয়ে খুঁড়তে উঠল, সে বনের মধ্যে পালিয়ে গেল।
কী সর্বনাশ! রেজু আনিজাকে গালাগালি দিল সালুনারু! বিস্ময়ে, আতঙ্কে শিউরে উঠল মেহেলী।
দূরের কোনো একটা কেসুঙ থেকে মোষ বলির সেই বাজনাটা ভেসে আসছে। গম্ভীর আর ভয়ঙ্কর শব্দ তরঙ্গিত হয়ে যাচ্ছে এই নগণ্য জনপদটার ওপর দিয়ে।
ওপরে আতামারী পাতার চাল। তার ফাঁক দিয়ে দুপুরের রোদ এসে পড়েছে ঘরখানায়। ঝলমলে রোদ। জা কুলি মাসের সূর্য বড় আরামদায়ক, বড় মনোরম।
হঠাৎ গাছের ওপরে আদিম এই গৃহকোণ নিঝুম হয়ে গেল। এখন আর কেউ কথা বলছে না। সেঙাই তাকাল মেহেলীর দিকে, মেহেলী তারই দিকে অপলক তাকিয়ে রয়েছে। সেঙাই আর মেহেলী। টিজু নদীর এপার আর ওপার। পোকরি আর জোহেরি বংশের দুই বন্য যৌবন। মুখোমুখি হয়েছে। সালুয়ালাঙ আর কেলুরি গ্রামের দুই শত্রুপক্ষ দুজনের সারা দেহে সংকেতময় কোনো আরণ্যক ভাষা সন্ধান করে বেড়াচ্ছে।
মেহেলী একসময় বলল, কাল সারারাত তোর পাশে আমি শুয়ে ছিলাম সেঙাই। আঁচড়েছি, কামড়েছি, তবু তোর সাড়া পাইনি।
কাল কি আমার জ্ঞান ছিল? কত ওপর থেকে পড়ে গিয়েছিলাম। তুই না থাকলে কি আমি বাঁচতাম! এই দ্যাখ, গায়ে চাপ চাপ রক্ত জমে রয়েছে। বস্তিতে ফিরে একবার তামুনুর (চিকিৎসক) কাছে যেতে হবে।
সন্ধের পর আমাদের বস্তির তামুনুর কাছ থেকে ওষুধ এনে দেব তোকে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর ফের মেহেলী বলল, তুই দাদাকে মারলি কেন বল তো?
আমার ঠাকুরদাকে তোদের বস্তির লোকেরা মেরেছিল। তার শোধ নেব না? দুই চোখ ধক ধক করে জ্বলে উঠল সেঙাইর।
হু-হু। সেই জন্যে বুঝি খোকেকে মারলি? বেশ, শোধবোধ হয়ে গেল।
হু-হু, শোধবোধ হল।
আচ্ছা সেঙাই, আমি শুনেছি তোদের আর আমাদের এই দুটো বস্তি মিলিয়ে একটাই বস্তি ছিল অনেক কাল আগে। তার নাম কুরগুলাঙ। টিজু নদীর দুধারের লোকদের মধ্যে খুব খাতির ছিল, পিরিত ছিল।
আমিও তাই শুনেছি। আমাদের খাপেগা সদ্দার মোরাঙে বসে সেসব গল্প বলেছিল।
মেহেলী বলতে লাগল, তার কণ্ঠ এখন আশ্চর্য কোমল শোনাচ্ছে, আচ্ছা, আমাদের বস্তির লোক তোর ঠাকুরদার মুণ্ডু কেটেছিল। তুইও আমার দাদাকে মারলি। শোধবোধ হয়ে গেল। এবার দুবস্তিতে আবার পিরিত হতে পারে না? বেশ হয় তা হলে। তোদের হুই ঝরনার জলে। চান করতে যেতে আমার এত ভালো লাগে!
পিরীত হলে তো ভালোই হয়। কিন্তু ঠাকুরদার খুনের শোধ আর নিতে পারলাম কই? খোনকের মুণ্ডুটা তো আর কেটে নিয়ে যেতে পারিনি। অথচ তোরা আমার ঠাকুরদার মাথাটা। কেটে এনেছিলি সেদিন। সেঙাইর চোখের দৃষ্টি হিংস্র হয়ে ওঠে। সারা মুখে চাপ চাপ, শুকনো । রক্ত। এই মুহূর্তে অত্যন্ত বীভৎস দেখাচ্ছে তাকে।
ধূসর অতীতের স্মৃতি নিয়ে দু’টি পাহাড়ী যৌবন কখনও কোমল, কখনও ভয়াল, কখনও স্বপ্নাতুর, কখনও আবার নির্মম হয়ে উঠতে লাগল।
আবোল তাবোল কথার তুফান উঠল এক সময়। কোনো পারস্পর্য নেই, সঙ্গতি নেই, সুষ্ঠু ধারাবাহিকতা নেই কথাগুলোর মধ্যে। এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে চকিতে সরে সরে আসতে লাগল সেঙাই আর মেহেলী।
বাইরে মোষ বলির বাজনা উদ্দাম হয়ে উঠেছে। দ্রাম-ম-ম-ম–দ্রাম-ম-ম-ম। চরম মুহূর্ত বোধ হয় উপস্থিত। বিশাল একটা কালো জানোয়ারের দেহ থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। টকটকে তাজা রক্তে লাল হয়ে উঠবে পাহাড়ী গ্রামের মাটি।
মেহেলী বলল, আমাদের এই সালুয়ালাঙ বস্তিতে কেন এসেছিলি, বললি না তো সেঙাই?
তোর খোঁজে। আমাদের ঝরনায় আজকাল আর যাস না কেন? সোজাসুজি তাকাল সেঙাই।
সদ্দার যেতে বারণ করে দিয়েছে।
এই সময় নিচের মাটি থেকে একটি নারীকণ্ঠ ভেসে এল, মেহেলী, এই মেহেলী কী করছিস ঘরে?
বাঁশের পাটাতন কাটা দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিল মেহেলী, কী আবার করব! যাচ্ছি রে পলিঙা। একটু দাঁড়া। এখুনি যাচ্ছি।
খাসেম গাছটার এলোমেলো শিকড়গুলির কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটি কুমারী মেয়ে–পলিঙা। সে বলল, কাটিরি কেসুঙে মোষ বলি হয়েছে। দেখবি আয়। মাংস আনবি তো?
আনব। মুখখানা ঘরের ভেতর টেনে এনে সেঙাই-এর দিকে তাকাল মেহেলী, এখন যাই। সন্ধের সময় খাবার আর রোহি মধু নিয়ে আসব। তামুনুর কাছ থেকে ওষুধও নিয়ে আসব তোর ঘায়ে লাগিয়ে দেবার জন্যে।
সেঙাই বলল, সন্ধের পর আমি চলে যাব। অন্ধকার না নামা পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে। তোদের বস্তির লোকেদের কাছে আমার কথা বলিস না মেহেলী। কাতর আর্তি ফুটল সেঙাই এর গলায়।
অত সহজে যেতে পারবি না এই বস্তি থেকে। হুই খাদ থেকে পিঠে করে বয়ে এনেছি, সারা রাত তুলো গরম করে সেঁক দিয়ে তোকে বাঁচিয়েছি, সে কি এমনি এমনি? যতদিন আমার খুশি, যতদিন আমার আশা না মিটবে ততদিন এই ঘরে আটকে থাকতে হবে তোকে। দাদাকে সাবাড় করেছিস, তার বদলে একটু একটু করে তোকে খুন করব আমি। সারা জীবন তোকে এই ঘরে আটকে রাখব। পাহাড়ী মেয়ে মেহেলী অপরূপ রহস্যময়ী হয়ে উঠল। আউ পাখির মতো একবার ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল সে। তারপর বাঁশের সিঁড়িটার দিকে পা পাড়িয়ে দিল। নিচে তারই জন্য অপেক্ষা করছে পলিঙা।
কাটিরি কেসুঙে মোষের মাংস আনতে যাবে তারা।
কাল রাত্তিরে টিজু নদীর কিনারায় অনেকক্ষণ বসে ছিল ওঙলেরা। আকাশের এক কোণে আনিজা উইখু (ছায়াপথ) বিবর্ণ রেখায় ফুটে ছিল। এলোমলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল কয়েকটা নিস্তেজ তারা। আর টিজু নদীর পারে ওঙলেদের পাশে নিবিড় বনের মধ্যে গোটাকয়েক মশাল দপদপ করে জ্বলছিল।
একসময় ওঙলে বলেছিল, কী করা যায় বল দিকি? হুই দিক থেকে তো কোনো আওয়াজ পাচ্ছি না।
হু-হু, তাই তো৷ সবাই মাথা নেড়েছে।
সেঙাই হুই দিকেই যে গিয়েছে, তারই বা ঠিক কী। ওঙলে ফের বলেছিল।
হু-হু, অন্য কোথায় যে যায়নি, তাই বা কে বলবে। দু-একজন ওঙলের কথায় সায় দিয়েছিল।
পিঙলেই কিন্তু জোর দিয়ে বলেছিল, নির্ঘাত হুই দিকেই গিয়েছে। সেঙাই সেই যে মেহেলীর কথা বলত, মনে আছে তোদের? মেহেলী সালুয়ালাঙ বস্তির মেয়ে। তার তল্লাশেই হুই বস্তিতে গিয়েছে সেঙাই। হু-হু।
হু-হু, ওকে খুব পিরিত করে সেঙাই। মেহেলী হল তার পিরিতের মাগী। এবার সরব হয়ে উঠেছিল আর-একটি জোয়ান ছেলে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। পেন্যু কাঠের মশাল একটানা অন্ধকার আর হিমের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছিল। জা কুলি মাসের রাত্রি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। হিমের দাঁত কেটে বসেছে অনাবৃত দেহগুলোর ওপর। মশালের অগ্নিবিন্দুর চারপাশে সাদা ঘন কুয়াশা ঘনতর হয়েছে।
কে যেন বলেছিল, বড় শীত ওঙলে। আর এখানে বসে থাকা যাবে না। নির্ঘাত মরে যাব।
ওঙলে বলেছিল, তাই তো, সালুয়ালাঙ বস্তিটা মড়ার মতো পড়ে রয়েছে। সেঙাই-এর মাথা বর্শা দিয়ে গেঁথে নিয়ে যেতে পারলে এতক্ষণে হল্লা করে পাহাড় ফাটিয়ে ফেলত হুই শয়তানের বাচ্চারা।
হু-হু– সকলেই গোলাকার কামানো মাথা ঝাঁকিয়েছিল।
ওঙলে আবারও বলতে শুরু করেছিল, এক কাজ করি আয়, আমরা হল্লা শুরু করে দিই। যদি সত্যি সত্যি সেঙাই-এর মাথা ওরা নিয়ে থাকে, ঠিক সাড়া দেবে সালুয়ালাঙের রামখোরা।
হু-হু–
একটু পরেই টিজু নদীর নীল ধারাকে চমকে দিয়ে অনেকগুলো গলায় গর্জন উঠেছিল। সে গর্জনে শিউরে উঠেছিল আকাশের আনিজা উইথু।
হো-ও-ও-ও– য়া–আ—আ—
হো-ও-ও-ও– য়া –আ-আ–
একসময় গর্জনের রেশ থেমে গিয়েছিল। তারপরও অনেকক্ষণ টিজু নদীর কিনারায় উৎকর্ণ হয়ে থেকেছে ওঙলেরা। তাদের এই হুঙ্কারের জবাব ওপারের সালুয়ালা গ্রাম দেয় কিনা তা শোনার জন্য তারা ব্যর্থ হয়ে ছিল।
কিন্তু নাঃ, কেউ পালটা হুঙ্কার দেয়নি। সালুয়ালাঙ বস্তিটা একেবারেই নিঝুম হয়ে ছিল।
ওঙলে বলেছিল, ওপারে সেঙাই যায়নি বলেই মনে হচ্ছে। তবে সে গেল কোথায়? যাবি না কি একবার সালুয়ালাঙ বস্তিতে?
ওঙলের প্রশ্নগুলোর জবাব দেবার আগেই কয়েকটা গলায় উল্লসিত আওয়াজ শোনা গেল, চিতাবাঘ, হুই যে চিতাবাঘ—
জোয়ান মানুষগুলোর কৌতূহল চোখের পিঙ্গল মণিতে এসে ঘন হয়েছিল। সামনে, ঠিক টিজু নদীর মাঝামাঝি একটা কালো পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে জন্তুটা। দুই চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দু পাশের উপত্যকায় কী যেন খুঁজছিল চিতাটা। এই জা কুলি মাসের হিমাক্ত রাত্তিরে কী কারণে সে বেরিয়ে এসেছিল গুহার উষ্ণ আরাম ছেড়ে, কে জানে। মসৃণ একটি ঘুমের অতলে ডুবে যাবার ইচ্ছা তার হয়তো ছিল না।
চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একবার মৃদু গর্জন করে উঠেছিল চিতাবাঘটা, হো-উ-উ–ম-ম–
ওঙলে এবার বলেছিল, তার গলাটা জা কুলি রাত্রির ভৌতিক অন্ধকারে আশ্চর্য ফিসফিস শুনিয়েছিল, তোরা সব বোস্। আমি আর পিঙলেই যাচ্ছি। বর্শা দিয়ে চিতাটাকে ছুঁড়ে আনব। তারপর মশালের আগুনে ঝলসে খাওয়া যাবে। বড় খিদে পেয়ে গেছে। খবদ্দার, হল্লা করবি কেউ।
ওঙলে আর পিঙলেই নিঃশব্দে পাহাড়ের উতরাই বেয়ে টিজু নদীর দিকে নেমে গিয়েছিল। আর খানিকটা উঁচুতে ঘন খাসেম বনের মধ্যে কয়েকটা রক্তবিন্দুর মতো জ্বলছিল পেন্য কাঠের মশালগুলো। আর সেগুলোকে ঘিরে ঘন হয়ে বসেছিল কেলুরি গ্রামের জোয়ান ছেলেরা। জা কুলি মাসের সেই রাত ক্রমশ ভয়ানক হয়ে উঠতে শুরু করেছিল।
একসময় থমকে দাঁড়িয়েছে পিঙলেই আর ওঙলে। এখান থেকে বর্শার সীমানায় পাওয়া যাচ্ছে চিতাবাঘটাকে।
অস্পষ্ট গলায় ওঙলে বলেছিল, এখানে দাঁড়া পিঙলেই। আমি আগে তাক করি। তারপর তুই বর্শা ছুড়বি।
পরক্ষণে সাঁ করে ওঙলের হাতের মুঠি থেকে উল্কার মতো ছুটে গিয়েছিল বর্শাটা। অব্যর্থ। লক্ষ্য। চিতাটার কোমরের ঠিক ওপরে আধহাত লম্বা ফলাটা গিঁথে গিয়েছিল। টিজু নদীকে শিউরে দিয়ে হুঙ্কার ছেড়েছিল জন্তুটা, হো-উ-উ-উ-ম-ম–
এবার পিঙলেই-এর থাবার বর্শাটা আকাশের দিকে উঠে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা ছোঁড়ার আগেই চিতাবাঘের গলার সঙ্গে মিলিয়ে একটি মানবিক কণ্ঠ কানে এসেছে। মৃত্যু যন্ত্রণায় গলার স্বরটা এই বনভূমি আর জা কুলি মাসের এই রহস্যময় রাতকে চৌচির করে আর্তনাদ করে উঠেছিল, আ-উ-উ-উ–
হো-উ-উ-ম-ম–তারপর টিজু নদীর ওপারে উপত্যকার নিবিড় বনভূমিতে চিতাবাঘটা লাফাতে লাফাতে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। তার সঙ্গে সঙ্গে মানবিক গলার আর্তনাদও মিলিয়ে গিয়েছিল।
পিঙলেই-এর হাতের বর্শা স্থির হয়ে ছিল আকাশের দিকে। আর পাথরের মূর্তি হয়ে গিয়েছিল ওঙলে। দুজনে এতটুকু নড়ছিল না। একেবারে স্থির, নিশ্চল। দুজোড়া চোখ শুধু নিষ্পলক টিজু নদীর ওপারে তাকিয়ে ছিল।
হো–উ-উ-ম-ম—
আ–উ—উ–উ–
একটি হিংস্র শ্বাপদের আর একটি মানুষের আর্তনাদ ওপারের উপত্যকায় একসময় ক্ষীণ হতে হতে মিলিয়ে গিয়েছিল।
ভয়ে আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে দুজনে। এবার ওঙলে কাঁপা গলায় বলেছে, টেমি খামকোয়া (বাঘ-মানুষ)। ও নির্ঘাত বাঘ-মানুষ। শিগগির চল। চিতাবাঘ চালান করলে একেবারে সাবাড় হয়ে যাব সবাই। তার গলায় বিভীষিকা ফুটে উঠেছে।
হু-হু–আবছা গলায় দু’টি শব্দ কোনোরকমে বলতে পেরেছে পিঙলেই।
তারপর সমস্ত শরীর থেকে সব নিষ্ক্রিয়তা ঝরে গিয়েছিল ওঙলে আর পিঙলেই-এর। টিজু। নদীর কিনার থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ওপরের চড়াইতে দৌড়ে চলে এসেছিল দুজনে। পেছন ফিরে আর একবারও তাকায়নি কেউ। বার বার তাদের মনে হয়েছে, ঝাঁকে ঝাকে চিতাবাঘ দিগদিগন্ত থেকে থাবা বাগিয়ে, দাঁত বার করে সাঁ সাঁ করে ছুটে আসছে। আর উপায় নেই, আর রক্ষা নেই। বাঘ-মানুষের ক্রোধে তাদের দুজনের কেউ রেহাই পাবে না। তারা কি জানত, ওই চিতাবাঘের পেছনে একটা বাঘ-মানুষের ভয়ঙ্কর উপস্থিতি রয়েছে!
তীরের মতো ছুটতে ছুটতে পেন্যু কাঠের মশালগুলোর কাছে এসে পড়েছিল ওঙলেরা। জা কুলি মাসের এই হিমঝরা রাতে তাদের গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছিল। বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁপাতে শুরু করেছিল ওঙলে আর পিঙলেই।
পেন্যু কাঠের মশালের চারপাশে জোয়ান ছেলেরা অসহ্য শীতে কুঁকড়ে যাচ্ছিল তখন। হিমের কামড় থেকে নিজেদের দেহগুলো বাঁচাবার জন্য সবাই কুণ্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে পরস্পরের গায়ে গা ঘষে উত্তাপ সৃষ্টি করে নিচ্ছিল।
চমকে জোয়ান ছেলেরা তাকিয়েছিল ওঙলে আর পিঙলেই-এর দিকে, কি রে, কী ব্যাপার? চিতাটা কোথায়?
আতঙ্কগ্রস্তের মতো ওঙলে বলেছে, শিগগির উঠে পড়। বাঘ-মানুষ হুই চিতাটার পেছনে রয়েছে। চল, চল।
বাঘ-মানুষ! ভয়ে প্রথমটা কাঠ হয়ে গিয়েছে জোয়ান ছেলেগুলো। পরক্ষণে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। মাটিতে পেন্য কাঠের মশাল পুঁতে রাখা ছিল। পট পট করে সেগুলো তুলে ফেলেছিল তারা।
ওঙলে বলেছিল, বস্তির দিকে পালাই চল। হুই বাঘ-মানুষ যদি বাঘ চালান করে, তাহলে নির্ঘাত সাবাড় হয়ে যাব। চল চল–দৌড়ো, দৌড়ো–
প্রাণ বাঁচানোর তাড়নায় জোয়ান মানুষগুলো মশাল হাতে খাড়া চড়াইয়ের দিকে উঠে গিয়েছিল।
কে যেন বলেছিল, সেঙাইটা কোথায় যে পড়ে রইল! তাকে খুঁজে বার করতে হবে না? সেঙাই-এর কথা সদ্দারকে কী বলবি, কি রে ওঙলে?
থাম শয়তানের বাচ্চা, আগে বাঘ-মানুষের হাত থেকে জান বাঁচা। তারপর সেঙাই-এর কথা ভাবিস।
অন্য একজন বলেছিল, এ নির্ঘাত হুই নানাকোয়া বস্তির মেজিচিজুঙ। পশ্চিম, উত্তর আর দক্ষিণ পাহাড়ের বনে ওর অনেক বাঘ পোষা আছে। রাত্তিরে বাঘ নিয়ে বেরোয় ইদিকে সিদিকে।
বনের মধ্যে দিয়ে চড়াই উতরাই পেরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে কেলুরি গ্রামের মোরাঙের সামনে চলে এসেছিল ওঙলেরা। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে তারা।
মোরাঙের চারপাশে গোল হয়ে ঘিরে বসে ছিল গ্রামের মেয়েপুরুষ। পুরুষদের মধ্যে কেউ কেউ মোরাঙের ভেতর চলে এসেছিল। বিশাল পাথরখানার ওপর দাঁড়িয়ে খ্যাপা মোষের মতো তখন ফোঁসফোঁস করছে বুড়ো খাপেগা, সিজিটোর ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিতে হবে। এত বড় পাপ চলবে না এই বস্তিতে। হু-হু, সিধে কথা।
বুড়ো খাপেগার পাশে একটা বর্শা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সারুয়ামারু। তার চোখ দুটো দপদপ করছিল। সেই মুহূর্তে সে হত্যা পর্যন্ত করতে পারত, সে পারত একটা বাঘের মতো গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
ওঙলেরা মোরাঙের মধ্যে ঢুকে জিগ্যেস করেছিল, কী ব্যাপার সদ্দার?
কী আবার? সিজিটো হুই সারুয়ামারুর বউ জামাতসুর ইজ্জত নিয়েছে। শয়তানটাকে জানে মেরে ফেলে দেব একেবারে।
হু-হু। আমি মোরাঙে এসেছিলাম, সেই ফাঁকে হুই শয়তান সিজিটোটা আমার কেসুঙে হাজির হয়েছে। আমি ঘরে ঢুকে হাতেনাতে ধরেছি। তা আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে হুই পাহাড়ের দিকে পালিয়ে গেল। একেবারে কলিজা ফেঁড়ে রক্ত নিয়ে আনিজাকে দেব। ইজাহান্টসা সালো–হাতের থাবায় বিশাল বর্শাটায় ঝাঁকানি দিয়ে, রক্তাভ চোখ দুটোকে আরো দপদপে করে হুঙ্কার দিয়ে উঠেছে সারুয়ামারু।
মোরাঙের বাইরে একটানা হইচই চলছিল। ছোট্ট গ্রাম কেলুরির সমস্ত মানুষ সমস্বরে চেঁচাচ্ছিল। সে চিৎকারের ছেদ নেই, বিরতি নেই। ওঙলে জিগ্যেস করেছিল, জামাতসু আর সিজিটো কোথায়?
সারুয়ামারু খ্যাপা গলায় গর্জে উঠেছে, বললাম তো, সিজিটো হুই বাইরের পাহাড়ের দিকে পালিয়েছে। আর জামাতসুকে বর্শা দিয়ে ফুড়ে রেখে দিয়েছি। আহে ভু টেলো। কদর্য গালাগালিতে জা কুলি মাসের রাতটাকে কুৎসিত করে তুলেছে সারুয়ামারু, সিজিটোর ঘরবাড়ি পুড়িয়ে তবে এবার ছাড়ব। রামখোটাকে পেলে বর্শা দিয়ে ছুঁড়ব।
মোরাঙের বাইরে দাঁড়িয়ে সিজিটোর মা বুড়ি বেঙসানুও সমানে ভাঙাচোরা দাঁতগুলোতে কড়মড় আওয়াজ করে বলেছে, ইজা রামখো। আমার আবার জানতে বাকি আছে! হুই সারুয়ামারুর বউ জামাতসু মাগীর কথা বস্তির কে না জানে! শয়তানীর সঙ্গে সব জোয়ানের পিরিত। যত দোষ হল সেঙাইর বাপের! আপোটিয়া।
দৌড়ে মোরাঙের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল সারুয়ামারু, চুপ কর বুড়ি মাগী। বেশি বকর বকর করবি তো একেবারে গলা টিপে মেরে ফেলব। সাউঁকিরি করতে হবে না ছেলের হয়ে। মোরাঙের দিকে হুসিও পাখির মতো গলাটা বাড়িয়ে দিয়ে সারুয়ামারু চেঁচিয়ে উঠেছে, সদ্দার, তুই ইদিকে আয়। একবার খালি বল, সিজিটোর ঘরবাড়ি সব জ্বালিয়ে দিই–
কয়েক দিন আগে সূর্য ওঠার রূপকথা নিয়ে সারুয়ামারুর সঙ্গে বুড়ি বেঙসানুর প্রায় একটা খণ্ডযুদ্ধ বাধবার উপক্রম হয়েছিল। সেদিন এই কেলুরি গ্রামের সব মানুষ বর্শা বাগিয়ে বেঙসানুর পাশে দাঁড়িয়েছিল। তারাই আজ আবার সারুয়ামারুর পাশে অন্তরঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাতের থাবায় তাদের জীমবো পাতার মতো ভয়াল বর্শাফলক। আর গলায় প্রবল চিৎকার।
হো-ও-ও-আ—আ–
মশালের আলোতে তাদের ভয়ঙ্কর হিংস্র দেখাচ্ছিল। ভিড়ের ভেতর একজনেরও তর সইছিল না। তারা বলছিল, কই রে সারুয়ামারু, চল তাড়াতাড়ি। সিজিটোর ঘরখানা পুড়িয়ে আসি।
ও সদ্দার, তুই একবার খালি বল। অনেকগুলো গলা উত্তেজনায় ক্রমশ উঁচু পর্দায় চড়ছিল, তুই বললেই আমরা মশাল নিয়ে আসি।
বুড়ো খাপেগা একপাশে দাঁড়িয়ে মানুষগুলোর ভাবগতিক লক্ষ করছিল। এবার সে রায় দিয়েছে। সব গলার কোলাহল ছাপিয়ে তার হুঙ্কার উঠেছে আকাশের দিকে, চুপ কর শয়তানের বাচ্চারা। কানের পর্দা ফাটিয়ে দিচ্ছে সবগুলো মিলে।
বুড়ি বেঙসানুর দিকে তাকিয়ে খাপেগা বলেছে, শোন বেঙসানু, সিজিটো হুই জামাতসুর ইজ্জত নিয়েছে। তার দাম দিতে হবে তোকে। সারুয়ামারু হল জামাতসুর সোয়ামী। দুটো শুয়ার আর সাতটা বর্শা দিয়ে দে সারুয়ামারুকে।
বুনো বানরীর মতো খেঁকিয়ে উঠেছে বুড়ি বেঙসানু, কেন? এত দেব কেন? হুই জোরি বংশের বউর ইজ্জত এত দামি নাকি? বলিস কি রে খাপেগা শয়তান!
খাপেগা আর বুড়ি বেঙসানু যখন কথা বলছিল, চারপাশে মানুষের জটলাটা চুপ করে শুনছিল। ফের তারা তুমুল শোরগোল বাধিয়ে দিয়েছে। সবার ওপর গলা চড়িয়েছিল সারুয়ামারু, ইজ্জতের কথা বলতে তোর লজ্জা হল না বুড়ি মাগী? নো ইহি-আঙশিঙ ইহাঙসা! বস্তির সবাই জানে, তোর সোয়ামী জেভেথাঙের মুণ্ডু কেটে নিয়ে গিয়েছিল সালুয়ালাঙের মানুষগুলো। তার বদলা নিতে পেরেছিস? তবে কোন মুখে ইজ্জতের ফুটানি করছিস লো শয়তানী!
সকলে মাথা ঝাঁকিয়েছে, হু-হু–
এবার মিইয়ে গিয়েছে বুড়ি বেঙসানু। নিস্তেজ গলায় সে বলেছে, আচ্ছা আচ্ছা, হুই দুটো শুয়ার আর সাতটা বর্শা দিয়ে তোর বউটার ইজ্জতের দাম দেব। আমার সোয়ামীর মুণ্ডুর কথা বললি, সেঙাই যে সেদিন খোনকেকে মেরে এল। তাতে বুঝি বদলা নেওয়া হয় না?
খুব বদলা নিয়েছে! তাচ্ছিল্যে ঠোঁট দুটো বেঁকে গেল সারুয়ামারুর, মাথা আনতে পেরেছে সেঙাই? তোদের জোহেরি বংশের মাথা ওরা নিয়েছে। ওদের পোকরি বংশের মাথা যেদিন আনতে পারবি সেদিন মুখ নেড়ে কথা বলবি, তার আগে নয়। হু-হু–
হু-হু– সকলে গোলাকার কামানো মাথা ঝকিয়ে সায় দিয়েছে।
দুটো শুয়োর আর সাতটা বর্শার বদলে সারুয়ামারুর বউ জামাতসুর ইজ্জতের দাম ঠিক করে দিয়েছিল খাপেগা সর্দার। এবার সকলে ছত্রখান হয়ে যে যার কেসুঙের দিকে চলে যেতে শুরু করেছে।
ভিড়ের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠেছিল, আমরা ভাবতাম, সিজিটোটা অন্যরকম। আমাদের সঙ্গে তার হালচাল মেলে না। এখন দেখছি তা নয়।
ঠিক বলেছিস। জা কুলি রাতের অন্ধকারে কে একজন মজাদার ভঙ্গিতে বলেছে, পরের বউর কাছে পিরিত ফুটাবে না তো কেমনতরো পাহাড়ী মানুষ! জরিমানা দেবে, দুটো মাথা ফাটবে মেয়েমানুষের জন্যে, তা নয়, মাঝে মাঝে বস্তি ছেড়ে কোথায় কোনো চুলোয় যে চলে যায় হুই সিজিটো! আজ দেখলাম, নাঃ, যতই দূরদেশে যাক, যতই সাদা মানুষের গল্প বলুক, আসলে ও পাহাড়ীই। পাহাড়ী রক্ত রয়েছে ওর বুকে। শয়তানটা আমাদের থেকে আলাদা হয়ে থাকে। এইবার? হো-হো-হো
হু-হু– আরো কজন সায় দিতে দিতে দূরের কেঙগুলোর দিকে চলে গিয়েছিল, আজকের রাত্তিরটা সিজিটোর গল্প করে কাটানো যাবে বউর সঙ্গে। বড় মজাদার কেচ্ছা।
সিজিটোর একটা নতুন পরিচয় জানতে পেরেছে কেলুরি গ্রামের মানুষগুলো। আর সেই অপূর্ব উত্তেজক পরিচয়টা নানা রঙে, নানা কথায় আর নানা রসে ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে সারা রাত ধরে তারা উপভোগ করবে।
প্রায়ই সুদূর পাহাড়চূড়া ডিঙিয়ে, অগুনতি উপত্যকা পেরিয়ে, কত মালভূমি উজিয়ে দূরের শহরে চলে যায় সিজিটো। আশ্চর্য রহস্যময় মানুষ সে। কত বিচিত্র দেশের, কত বিচিত্র মানুষের, কত অনাস্বাদিত খাবারের গল্প বলে। একই গ্রামের মানুষ হয়েও সে যেন আলাদা। এই মুহূর্তে জামাতসুর ইজ্জত নেবার মধ্যে কেলুরি গ্রামের লোকেরা জেনে গিয়েছে সিজিটো তাদেরই মতো। তাদের সঙ্গে সিজিটোর বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। এটুকু আবিষ্কার করে তারা খুব খুশি।
মোরাঙের সামনে থেকে কেলুরি গ্রামের মানুষগুলো যার যার কেসুঙে চলে গিয়েছিল। চারপাশে খানিক আগের হইহল্লা আর নেই।
এবার বুড়ো খাপেগা তাকিয়েছে ওঙলের দিকে। তারপর বলেছে, কি রে, সেঙাই কোথায়? তাকে নিয়ে এসেছিস?
তাকে পেলুম না।
তাকে না নিয়েই চলে এলি তোরা? খাপেগার ঘোলাটে চোখ দুটো ধক করে জ্বলে উঠেছিল, কি রে রামখোর বাচ্চারা?
কী করব, তুই বল তো জেঠা। সেঙাই-এর খোঁজেই তো গেলাম। টিজু নদীর ওপারে চিতাবাঘ নিয়ে বেরিয়েছে টেমি খামকোয়ানু (বাঘ-মানুষ)। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যে আসতে পেরেছি, তাই যথেষ্ট। ভয়ের সুরে বলেছে ওঙলে। একটু আগের চিতাবাঘ মারতে যাবার কাহিনী, চিতাবাঘের গায়ে বর্শা লাগার পর চিতাবাঘ এবং সেই সঙ্গে একটি মানবিক গলার আর্তনাদ–কিছুই সে বাদ দেয়নি।
হু-হু, বুঝতে পেরেছি। এ হুই নানাকোয়া বস্তির মেজিচিজুঙের কাজ। হুই সালুয়ালাঙ আর নানকোয়া বস্তিতে বড় পিরিত। আচ্ছা দেখা যাক, কী করা যায়–দাঁতে দাঁত ঘষে বলেছে বুড়ো খাপেগা।
আমার মনে হচ্ছে, বুঝলি জেঠা, সেঙাই সালুয়ালাঙের দিকে যায়নি। নদীর পারে দাঁড়িয়ে আমরা কত তড়পালুম। হো হো করে অনেক হল্লা করলুম। তবু সালুয়ালাঙ বস্তির দিক থেকে কোনো সাড়া পেলুম না। ওঙলে বলেছিল।
হু-হু– আশ্চর্য গম্ভীর দেখিয়েছিল বুড়ো খাপেগার দাড়িগোঁফহীন মুখখানা। কী একটা ভাবনার অতল স্তরে সে যেন তলিয়ে গিয়েছে, তাই তো, সেঙাইটা গেল কোথায়?
এতক্ষণ মোরাঙের বাইরে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সারুয়ামারু। এইমাত্র সে ফিরে এসে বলেছে, দুটো শুয়োর আর সাতটা বর্শা দিয়ে আমার বউর ইজ্জতের দাম দিলে চলবে না সদ্দার। হুই শয়তান সিজিটো একবার বস্তিতে ঢুকলে হয়, জানে মেরে ফেলব।
দাঁতমুখ খিঁচিয়ে গর্জে উঠেছে বুড়ো খাপেগা, চুপ কর শয়তানের বাচ্চা।
কেলুরি বস্তিটা কাল সারা রাত এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমোত পারেনি। দু’টি মানুষ ছাড়া সকলে সিজিটোর কেলেঙ্কারি নিয়ে রাতভোর গল্প করেছে। একটা আঁশটে কেচ্ছার গন্ধ পেলেই হল। সেটার ওপর রং চড়িয়ে পাহাড়ী মানুষগুলো ফেনিয়ে তুলতে থাকে।
সবাই সিজিটোকে নিয়ে মেতে ছিল। শুধু বুড়ো খাপেগা তার ব্যাপারে মাথা ঘামায়নি। তার অতন্দ্র চোখে সেঙাই-এর মুখখানা বার বার ভেসে উঠেছে। গেল কোথায় ছেলেটা? এই কেলুরি গ্রামের আর তার স্যাঙাত জেভেথাঙের বংশের সম্মান যে রাখতে পারে, সে হল সেঙাই। ছেলেটার মধ্যে খাপেগা তার নিজের যৌবনকালের প্রতিচ্ছায়া দেখতে পায়। যেমন করে হোক, সেঙাইকে ফিরে পেতেই হবে।
ওদিকে জোরি কেসুঙে বাঁশের মাচানে শুয়ে ধক ধক করে চোখদুটো জ্বলছিল জামাতসুর। আশ্চর্যভাবে তারা ধরা পড়ে গেল কাল। সিজিটো! সিজিটো! সারুয়ামারু যখন কেঙে থাকত না, যখন কোহিমা কি মোককচঙে চলে যেত, সকলের অগোচরে এমনি কতদিন রাতে সে এসেছে তার বিছানায়। দু’টি বাহুর বেষ্টনে তার তামাভ শরীর জড়িয়ে ধরে দূর শহরের গল্প বলেছে। তাকে নিয়ে পালিয়ে যাবার ফন্দি এঁটেছে। একটি মনোরম স্বপ্নের কথা বলে জামাতসুর দুচোখে কোহিমা কি মোককচঙের নেশা এঁকেছে। এ দৃশ্য কেলুরি বস্তির কেউ কোনোদিন দেখেনি। সিজিটো-জামাতসুর নিভৃত জীবনের ইতিহাস সকলের কাছে গোপন ছিল। গ্রামের কেউ তাদের প্রণয়ের কথা জানত না।
সেই সিজিটোই কাল ফিরে এসেছিল কোহিমা থেকে। সারুয়ামারু ঘরে ছিল না। সুযোগ বুঝে সন্ধের পর জোরি কেসুঙে ঢুকেছিল, কই লো জামাতসু–
জামাতসু ডেকেছিল, এই তো। আয় আয়। শয়তানটা ঘরে নেই। মোরাঙের দিকে গেছে। কাল জোরি কেসুঙে নাচ আর বাজনার আসর বসেছিল। তারপরেই খোঁজ পড়েছিল সেঙাই-এর। বুড়ো খাপেগা আর জোয়ান ছেলেদের সঙ্গে মোরাঙের দিকে চলে গিয়েছিল সারুয়ামারু। সেই মানুষই কী কারণে যেন আচমকা ঘরে ফিরেছিল, আর ফিরেই পরস্পরের বাহুবন্দি দু’টি পাহাড়ী নরনারীকে দেখেছিল। সিজিটো আর জামাতসু। বন্য মানুষ। সাঁ করে বাঁশের দেওয়াল থেকে বর্শা নিয়ে ছুঁড়ে মেরেছিল সারুয়ামারু। অব্যর্থ লক্ষ্য। ফলাটা জামাতসুর কবজিতে গেঁথে গিয়েছিল। আর মাচান থেকে লাফিয়ে উল্কার মতো বাইরের পাহাড়ে পালিয়ে গিয়েছিল সিজিটো। সিজিটোর সঙ্গে সঙ্গে কোহিমায় গিয়ে ঘর বাঁধার রমণীয় স্বপ্নটাও বিলীন হয়ে গিয়েছিল জামাতসুর।
কিছুক্ষণ আগে তামুন্যর কাছ থেকে খানিকটা আরেলা পাতা নিয়ে এসে জামাতসুর কবজির ক্ষতে লাগিয়ে দিয়েছে সারুয়ামারু। তারপর বুড়ি বেঙসানুর কাছ থেকে দুটো শুয়োর আর সাতটা বর্শা এনেছে। জামাতসুর ইজ্জতের দাম। ঘরে এসে হুঙ্কার দিয়েছিল সারুয়ামারু, দ্যাখ মাগী, তোর ইজ্জতের দাম আদায় করলাম।
এখন তারই পাশে একটা প্রকাণ্ড মোষের মতো ভোঁসভোঁস করে ঘুমোচ্ছে সারুয়ামারু।
কিন্তু ঘুম আসছে না জামাতসুর। কোন সুদূরে, আকাশের আনিজা উইখুর পরপারে নির্বাসিত হয়েছে তার ঘুম। শুধু দুচোখের মণিতে একটি মুখের প্রতিচ্ছায়া ফুটে উঠেছে। সে ছবি সিজিটোর। সিজিটো এখন কত দূরে? সে কি তার কথাই ভাবছে? তার স্বপ্নই দেখছে?
কাটিরি কেসুঙে আজ বিরাট ভোজ। আওশে ভোজ। এই ভোজের জন্য একটা প্রকাণ্ড মোষ বলি দেওয়া হয়েছে। কেসুঙের সামনে পাথুরে চত্বরটা রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে। বিশাল প্রাণীটার ধড় আর মুণ্ডু আলাদা হয়ে দু’দিকে ছিটকে পড়ে রয়েছে।
পলিঙা এবং মেহেলী চলে এল কাটিরি কেসুঙে। কেসুঙের চারপাশে গ্রামের সব মানুষ পাহাড়ী মৌমাছির মতো ভনভন করছে। এমন একটা ভোজের কারণে সকলে রীতিমতো উল্লসিত। কাটিরি কেসুঙে আজ সমস্ত গ্রামখানার নিমন্ত্রণ। এই বংশের ছেলে বিয়ে করে সালুয়ালাঙ গ্রামটাকে আজ প্রথম ভোজ খাওয়াচ্ছে। প্রথমতো ভোজ দিয়ে দাম্পত্য জীবনের জন্য স্বীকৃতি আর শুভেচ্ছা আদায় করছে সমাজের কাছ থেকে।
বাঁ দিকে রান্নার আয়োজন। বড় বড় মাটির পাত্র। পুরুষানুক্রমে পুড়তে পুড়তে সেগুলো কালো হয়ে গিয়েছে। বিরাট বিরাট কাঠের হাতা। আরেক দিকে অজস্র মানুষের জটলা। তুমুল হইচইতে কাটিরি কেসুঙটা মুখর হয়ে উঠেছে, উত্তাল হয়ে উঠেছে।
এদিকে আসতে আসতে পলিঙা বলল, কি লো মেহেলী, তোর লগোয়া পনকে (প্রেমিক) তো দেখালি না? শুধু গল্পই বললি তার। কেমন দেখতে সেঙাইকে? খাসা চেহারা বুঝি?
চমকে মেহেলী তাকাল পলিঙার দিকে। হ্যাঁ, পলিঙা তার সই, তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। তার কাছে সেই আশ্চর্য বিকেলে সেঙাইকে প্রথম দেখার পর তার অনেক গল্প করেছে মেহেলী। পাহাড়ী কুমারী তার যৌবনের সমস্ত মাধুর্য দিয়ে সে গল্পে রং চড়িয়েছে। তার মনের মানুষের রূপ দিয়ে একটি চকিত বিভ্রমের সৃষ্টি করেছে পলিঙার চেতনায়।
পলিঙা আবার বলল, এত ভালো তোর পিরিতের মানুষটা! এত সুন্দর! কত কথা বলেছিস তার সম্বন্ধে, একদিনও তো তাকে দেখালি না। দেখালে আমি ভাগিয়ে নেব নাকি?
চারিদিকে একবার চনমনে চোখে তাকিয়ে চাপা গলায় মেহেলী বলল, আজ দেখাব। এখন কাটিরিদের মাংস নিয়ে বাড়ি ফিরব। তারপর যাব ডাইনি নাকপোলিবার কাছে। সেখান থেকে ফিরে তোকে দেখাব সেঙাইকে। খবদ্দার সেঙাই-এর কথা আর কাউকে বলবি না।
পলিঙার মুখচোখে বিস্ময় ফুটে বেরিয়েছে। বিচিত্র আগ্রহে তার চোখ দুটো চকচক করছে। পলিঙা ভরসা দিয়ে বলল, কোথায় সেঙাই? নাকপোলিবা ডাইনির কাছে যাবি কেন? তারপর গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে বলল, সেঙাইকে আটক করে রেখেছিস নাকি?
হু-হু। কাউকে বলিস না। তা হলে সবাই সেঙাইকে খুঁজতে শুরু করবে। সদ্দার জানতে পারলে আমার পিরিতের মরদটাকে একেবারে সাবাড় করে ফেলবে।
পলিঙা ভরসা দিয়ে বলল, না না, তুই আমার সই, তোর ভালোবাসার মানুষকে আমি ধরিয়ে দেব না। জানি সেঙাইরা এই বস্তির শত্তুর। ওকে পেলে সদ্দার নির্ঘাত বর্শা দিয়ে ফুঁড়বে।
কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে পলিঙার দিকে তাকাল মেহেলী, তাকিয়েই রইল। তার চোখের মণি দুটো আশ্চর্য কোমল হয়ে উঠেছে।
একসময় কাটিরি কেসুঙ থেকে আওশে ভোজের মাংস নিয়ে এল মেহেলী আর পলিঙা। এটা এই পাহাড়ী জনপদগুলির রীতি। আওশে ভোজের দিনে প্রতিবেশীদের মোষের মাংস বিতরণ করলে নব দম্পতির জীবন সুখ শান্তিতে ভরে উঠে।
মাংস নিয়ে ফিরতে ফিরতে মেহেলী বলল, তুই তোদের কেসুঙে মাংস রেখে আয়। তারপর আমাদের কেসুঙের পেছনে এসে দাঁড়াবি।
কেন?
কেন আবার, নাকপোলিবা ডাইনিকে দাম দিতে হবে না? তার ওষুধের দাম? সেই যে সেঙাইকে আটকে রেখে চারটে বর্শা আর দুখুদি (আড়াই সের পরিমাণ) ধান নিয়ে যেতে বলেছিল, মনে নেই তোর? খুব মৃদু শোনাচ্ছে মেহেলীর কণ্ঠ, আচ্ছা পলিঙা, নাকপোলিবা ডাইনির ওষুধে কাজ হবে তো?
নিশ্চয়ই হবে। রীতিমতো জোর দিয়ে বলল পলিঙা।
আমার বড় ভয় করে বুড়িটাকে। বলে একটু থামল মেহেলী। তারপর ফের শুরু করল, সেঙাইকে আমার চাই। যেমন করে তোক, ওকে আমার পেতেই হবে। হু-হু। সেঙাইকে যখন আটক করেছি, সারা জনমের মতো ঠিক ধরে রাখব।
কাটিরি কেসুঙে আওশে ভোজের মোষ বলি দেখতে সবাই চলে গিয়েছিল। বাইরের ঘরে এখন কেউ নেই। দ্রুত ভেতর দিকের ঘরগুলো একবার দেখে নিল মেহেলী। নাঃ, তাদের পোকরি কেসুঙ একেবারে ফাঁকা। তার বাবা-মা, এমনকি ছোট ছোট ভাইবোনেরা পর্যন্ত বুনো মোষ বলির মজা দেখতে চলে গিয়েছে। কেউ ফিরে আসেনি। পোকরি কেসুঙ এখন নির্জন।
এমন একটা অপূর্ব সুযোগ তার বরাতে লেখা ছিল তা কি জানত মেহেলী? সন্তর্পণে বাঁশের মাচানের তলা থেকে চারটে বর্শা আর ঝুড়ি থেকে ধান নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা উথলপাথল হচ্ছে। আশঙ্কায় নিশ্বাস দ্রুত তালে উঠছে, নামছে। বাপের মুখোমুখি হলে আর রেহাই থাকবে না। এই বর্শাগুলো দিয়েই তার চামড়া উপড়ে রোদে শুকোতে দেবে, যেমন করে একটা হরিণ কি চিতাবাঘের ছাল শুকোতে দেয়।
শত্রুপক্ষের ছেলে সেঙাই। তার কামনার পুরুষ। প্রতিটি রক্তকণায় সে পেতে চায় সেঙাইকে। তার আদিম আলিঙ্গনের মধ্যে ধরতে চায় সেঙাইকে। এ কথা পলিঙা আর লিজোমু ছাড়া আর কাউকে বলেনি মেহেলী। এ খবর তার বাপ জানে না, তার মা জানে না, ভাইবোনরা জানে না। একে শত্রুপক্ষের যৌবন, আর তার জন্য চারটে বর্শা আর দুখুদি ধানের বদলে ওষুধ আনার মনোবিলাসকে কিছুতেই বরদাস্ত করবে না মেহেলীর বাপ। তাই সকলের অগোচরে নাকপোলিবার ওষুধের দাম হাতিয়ে আনতে হল মেহেলীকে।
পূর্বপার্বতী কেসুঙের পেছন দিকে কথামতো দাঁড়িয়ে আছে পলিঙা। তার সঙ্গে লিজোমুও এসেছে। সতর্কভাবে চারিদিক দেখতে দেখতে পলিঙাদের কাছাকাছি চলে এল মেহেলী। বলল, চল। তিন জনে উত্তরের পাহাড়ে নাকপোলিবার আস্তানার দিকে দ্রুত পা চালিয়ে দিল।
বাদামি পাথরের মধ্যে দিয়ে সুড়ঙ্গটা অন্ধকার গুহায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। সেটার দু’পাশে উদ্দাম বন। গুহার মধ্যে পাথরের ভাঁজে ভাঁজে আগুন জ্বলছে। আর সেই ভয়াল অন্ধকারে পাথরের আগুনের পাশে দু’টি আগ্নেয় গোলক স্থির হয়ে আছে। এই ধক ধক অগ্নিপিণ্ড দু’টি ডাইনি নাকপোলিবার চোখ।
গ্রাম থেকে অনেক, অনেক দূরে এই ভয়ঙ্কর গুহার অন্ধকারে অতন্দ্র বসে থাকে ডাইনি নাকপোলিবা। কোন অনাদি অনন্ত কাল ধরে সে এখানে আছে, তার হিসেব নেই। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কিভাবে তার কেটে যায়, কেউ জানে না। শুধু এই নির্জন গুহার দু’টি আগ্নেয় গোলক দিবারাত্রি দূর পাহাড়ের দিকে, উপত্যকার দিকে, অনেক দূরের টিজু নদীর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। এই অগ্নিপিণ্ড দু’টির নির্বাণ নেই, অবিরাম জ্বলে জ্বলে নিভে যাবার মুহূর্ত কোনোকালে আসবে কিনা, আশেপাশের পাহাড়ী মানুষরা তা জানে না।
এদিকে গ্রামের মানুষরা বড় কেউ আসে না। এখানে নাকপোলিবার ডাইনি নামটা একটা বিভীষিকার মতো রাজত্ব করে। ওই দু’টি আগ্নেয় গোলকের ওপর কোনো মানুষের ছায়া পড়লে নাকি আর উপায় থাকে না। সে মানুষের রক্ত একটু একটু করে বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। তারপর একদিন একটি কঙ্কালের আকার নিয়ে কোনো পাহাড়চূড়া থেকে অতল খাদে আছড়ে পড়ে মরে যায় তাজা মানুষটা। তাই ডাইনি নাকপোলিবার দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে বহু দূরের পাহাড়ে পাহাড়ে গ্রাম বসানো হয়েছে।
মানুষ আসে না, কিন্তু মাঝে মাঝে আসে যুবক-যুবতীরা। বুকে তাদের বন্য বাসনার জ্বালা। কামনার একটি পুরুষ কি একটি নারীর অভাবে পৃথিবী যখন শূন্য হয়ে যায়, যখন প্রেমিক বা প্রেমিকা ধরা দেয় না, তখন ডাইনি নাকপোলিবার কাছে ছুটে আসে তারা।
ডাইনি নাকপোলিবা। তার হিসাবহীন বয়সের এই জীর্ণ দেহের হাড়ে হাড়ে, চামড়ার কুঞ্চনে কুঞ্চনে, কত মন্ত্র-তন্ত্র। এই গুহার মধ্যে নির্বাসিত থেকে কত আনিজার সঙ্গে যে সে সই পাতিয়েছে, কত প্রেতাত্মার সঙ্গে যে তার অন্তরঙ্গতা!
পাহাড়ী প্রেম আর বন্য মানুষের কামনা যেমন ভীষণ, তেমনই দুর্বার। একবার দেহমনে। যৌবনের জ্বালা ধরলে সাত পাহাড়ের অরণ্যের মধ্য দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো পাহাড়ী যুবক যুবতীরা চলে আসে নাকপোলিবার গুহায়। বর্শা আর ধানের বিনিময়ে মন্ত্রপড়া গাছের শিকড় নিয়ে যায়। নাকপোলিবার মন্ত্রপড়া শিকড়ের মহিমায় নাকি কামনার মানুষটি একটি পোষা বানরের মতো ধরা দেয়।
জা কুলি মাসের বিকেল। বাইরের উপত্যকায় ঘন রোদ ছড়িয়ে রয়েছে। সোনালি আমেজে মাখামাখি হয়ে রয়েছে বন, পাহাড়, মালভূমি।
আচমকা সুড়ঙ্গের ওপর একটি ছায়া পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে গুহাগর্ভের অগ্নিপিণ্ড দু’টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। কর্কশ গলা ভেসে এল নাকপোলিবার, কে রে শয়তানের বাচ্চা, কে ওখানে?
আমি সালুনারু?
ভেতরে আয়।
হামাগুড়ি দিয়ে গুহার মধ্যে চলে এল সালুনারু। চারপাশে অন্ধকার। যেন আদিম কোনো দুর্নিরীক্ষ্য কাল থেকে রাশি রাশি প্রেত ওত পেতে রয়েছে নাকপোলিবার গুহায়। এই প্রেতগুলির সঙ্গে নাকপোলিবার সর্বক্ষণ বসবাস। বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা ছমছম করে উঠল সালুনারুর।
চারপাশে পাথরের ভাঁজে ভাঁজে পেন্যু কাঠের রক্তাভ আগুন জ্বলছে। আগুন নয়, যেন সেই প্রেতাত্মাদের নিষ্পলক দৃষ্টি।
নাকপোলিবা বলল, কী চাই তোর? ভালোবাসার লোককে বশ করার কায়দা শিখতে এসেছিস? তার দাম এনেছিস তো? চারটে বর্শা, দুখুদি ধান। কি লো পাহাড়ী জোয়ানী?
আতঙ্কে হৃৎপিণ্ডের ওপর রক্ত চলকে চলকে পড়ছিল সালুনারুর। এবার অনেকটা ধাতস্থ হল সে, ভালোবাসার নাগরকে বশ করতে আসিনি তোর কাছে। ডাইনি হতে এসেছি। আমাকে মন্ত্র-তন্ত্র শিখিয়ে দে। আমি ডাইনি হব।
বলে কী মেয়েটা! বয়সের হিসাব নেই নাকপোলিবার, লেখাজোখা নেই অভিজ্ঞতার। এই অসংখ্য বছরের জীবনে পাহাড়ী উপত্যকায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম কত মানুষই না দেখেছে ডাইনি নাকপোলিবা। কুরুগুলাঙ গ্রাম দেখেছে। তারপর সেই গ্রাম ভেঙে রক্তক্ষয়ের মধ্যে কেমন করে গড়ে উঠল এই কেলুরি আর সালুয়ালাঙ জনপদ, তাও দেখেছে। কত ঝড়-তুফান দেখেছে। নাকপোলিবা, পাহাড়ী পৃথিবীর কত জন্ম-মৃত্যু দেখেছে! তার সীমাসংখ্যা নেই। কত যুবক যুবতী এসেছে তাদের ভালোবাসার মানুষটিকে বশ করার মন্ত্র নিতে, সুলুক সন্ধান জানতে। কিন্তু সালুনারুর মতো এমন কথা কেউ কোনোদিন বলেনি। এমন কথা আগে আর কোনদিন শোনেনি ডাইনি নাকপোলিবা।
অগ্নিপিণ্ড দুটো আশ্চর্য বিস্ময়ে সালুনারুর মুখের ওপর স্থির হয়ে রয়েছে। সারা বুকে উল্কি। পৃথিবীর আদিম শিল্প নাকপোলিবার অনাবৃত দেহে যথেচ্ছ রেখায় আঁকা রয়েছে। শীর্ণ দু’টি স্তনের নিচে বুকটা ধুকপুক করে নড়ছে নাকপোলিবার। সে বলল, কী বললি–ডাইনি হবি!
হু-হু—
কেন? তুই কোন বস্তির মেয়ে?
আমি হুই কেলুরি বস্তির মেয়ে। আমাকে ওখানকার সদ্দার ভাগিয়ে দিয়েছে। ডাইনি হয়ে ওদের সবাইকে খতম করব। ক্রুদ্ধ সাপিনীর মতো ফণা তুলল সালুনারু, তুই আমাকে ডাইনি করে দে।
তুই বিয়ে করেছিস? সোয়ামী আছে?
বিয়ে করেছিলাম। সোয়ামীকে রেজু আনিজা মেরে ফেলেছে।
চকিত হয়ে উঠল ডাইনি নাকপোলিবা, রেঞ্জু আনিজা মেরেছে? নাম কি তোর সোয়ামীর?
রেঙকিলান।
রেঙকিলান! রেজু আনিজা! নিদাঁত মাড়ি বার করে প্রেতের মতো হেসে উঠল ডাইনি নাকপোলিবা। তার বীভৎস হাসিটা গুহার দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে ভীতিকর প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল। হাসির দমকে আগুনের গোলক দুটো একবার নিভতে লাগল, আবার জ্বলতে লাগল।
রেঙকিলান! রেজু আনিজা! আমিই তো রেজু আনিজা। তোর সোয়ামীকে আমিই মেরেছি। কী মজার খেলা বল তো। রেঙকিলানের নাম ধরে সেদিন দক্ষিণ পাহাড় থেকে ডাক দিলাম। ব্যস, তারপরেই খাদে পড়ে শয়তানটা একেবারে খতম। আমি এতদিন খালি ভেবেছি, ছোঁড়াটা আবার মরল কিনা। তুই আমাকে বাঁচালি। খেলাটা নতুন ধরেছি কিনা। বেশ ভালোই মনে হচ্ছে। হিঃ হিঃহিঃ–আগের মতোই ফের হেসে উঠল সে।
তুই মেরেছিস আমার সোয়ামীকে? কঁপা গলায় বলল সালুনারু। কেউ শুনল না সে কথা। নাকপোলিবা না, হয়তো সালুনারু নিজেও না। প্রেতাত্মা! বুড়ি নাকপোলিবা শুধু ডাইনিই না, একটা ভয়ানক আনিজা। সে-ই তবে রেঙকিলানকে ডেকে ডেকে বিভ্রান্ত করে খাদের অতলে ফেলে মেরেছে! সালুনারুর মনে হল, একটা প্রচণ্ড উৎক্ষেপে খ্যাপা বাঘিনীর মতো তার দেহটা ঝাঁপিয়ে পড়বে ডাইনি নাকপোলিবার ঘাড়ের ওপর। তারপর ধারাল নখে নখে, দাঁতে দাঁতে টুকরো টুকরো করে ফেলবে তাকে। কিন্তু কিছুই হল না। চারপাশের পাথরের ভাজে ভাঁজে প্রেতদৃষ্টির মতো আগুন, নাকপোলিবার হাসি আর অন্ধকার। এধারে ওধারে কারা যেন হিম নিশ্বাস ফেলছে। চেতনাটা অবশ হয়ে আসতে থাকে সালুনারুর।
নাকপোলিবা বলল, ডাইনি হবি? মন্ত্র শেখার দাম এনেছিস?
আড়ষ্ট গলায় সালুনারু বলল, আমার সোয়ামীর জান নিয়েছিস। হুই জানের দামে আমাকে। ডাইনি করে দে। কেলুরি বস্তিকে আমি সাবাড় করে ছাড়ব।
আচ্ছা, তাই দেব। ডাইনিই বানিয়ে দেব তোকে। কিন্তু এখানে থাকতে হবে। পারবি তো?
বুকটা কেঁপে উঠল সালুনারুর। ভীরু গলায় সে বলল, পারব।
আচমকা সুড়ঙ্গের ওপর আবার তিনটি ছায়া পড়ল।
গুহার মধ্য থেকে তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে উঠল নাকপোলিবা, কে? কে ওখানে? ভেতরে আয় শয়তানের বাচ্চারা।
আমরা পিসি। মেহেলী, লিজোমু আর পলিঙা হামাগুড়ি দিয়ে গুহার মধ্যে ঢুকল।
নাকপোলিবা বলল, কী চাই তোদের?
মেহেলী বলল, তোর ওষুধের দাম নিয়ে এসেছি পিসি। ওষুধ দে।
কই, দেখি দেখি–
মেহেলীর হাতের মুঠি থেকে চারটে বর্শা আর দুখুদি ধান ছিনিয়ে নিল ডাইনি নাকপোলিবা। সেগুলো পাথরের খাঁজে লুকিয়ে রাখতে রাখতে বলল, কিসের ওষুধ?
সেদিন আমি আর পলিঙা এসেছিলুম। তোকে বলে গেলুম, সেঙাইকে আমার মনে ধরেছে। ওকে আমার চাই। আমাদের শত্রু ওরা, তাই বশ করতে হবে।
হু-হু, মনে ধরেছে
এপাশ থেকে সালুনার তীব্র গলায় বলে উঠল, সেঙাই? কোন সেঙাই? কেলুরি বস্তির সেঙাই নাকি?
হু-হু–শান্ত গলায় বলল মেহেলী।
সেঙাই না তোর দাদাকে বর্শা দিয়ে কুঁড়েছে? বিস্ময়ে কেঁপে উঠল সালুনারুর গলা।
বর্শা দিয়ে কুঁড়েছে দাদাকে, তাতে আমার কী? সে আমার পিরিতের মানুষ। তাকে আমার চাই। কণ্ঠটা কেমন আবিষ্ট হয়ে এল মেহেলীর।
চুপ কর সব। কত দেখলাম এই বয়েসে। পিরিত হয়েছে, তা সে যত শত্ৰুই হোক, বর্শা দিয়ে ফুড়ে যাক নিজেকে, তবু বিছানায় শুলে তার কথা মনে পড়ে। তাকে না হলে ঘুম আসে না। মন সোয়াস্তি মানে না। কী বলিস লো মেহেলী? বুকের মধ্যে যেন ঘা মেরে যায় জোয়ানেরা। হিঃ হিঃ করে গা-ছমছম হাসি হেসে উঠল ডাইনি নাকপোলিবা।
কিছুক্ষণ বিরতি। সুড়ঙ্গের ওধারে বনময় উপত্যকায় বিকেলের রোদ নিভে আসতে শুরু করেছে। ছায়া ছায়া হয়ে আসছে পাহাড়ী পৃথিবী। গুহার অন্ধকার আরো ঘন হচ্ছে।
একসময় মেহেলী বলল, আমার ওষুধ দে পিসি।
সেঙাইকে আটক করেছিস তো? যে ওষুধ দেব, তার গায়ে না ছোঁয়ালে সে বশ হবে না কিন্তু। একবার ছোঁয়াতে পারলে পোষা বাঁদর বনে যাবে।
হু-হু। সেঙাই শয়তানটাকে আটক করেছি আমার শোবার ঘরে।
শোনামাত্র একটি মুহূর্তও দাঁড়াল না লিজোমু। সুড়ঙ্গপথের মধ্য দিয়ে একটা ছিলামুক্ত তীরের মতো তার নগ্ন দেহটা সাঁ করে বাইরের উপত্যকায় ছিটকে পড়ল।
সেঙাই! খ্যাপা একটা বাঘিনীর মতো লাফিয়ে উঠল সালুনারু। কেলুরি গ্রামের একজনকে অন্তত সে তার থাবার সীমানায় পেয়েছে। কেলুরি গ্রাম! বুড়ো খাপেগা তাকে বর্শা দিয়ে শাসিয়ে দিয়েছে, ও গ্রামে ঢুকলে আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে হবে না। দেহের প্রতিটি ইন্দ্রিয় প্রখর হয়ে উঠল সালুনারুর। সে বলল, আমিও যাব একটু সালুয়ালাঙ বস্তিতে। সে-ও আর দাঁড়াল না। সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে তার অনাবৃত দেহ একটা নিক্ষিপ্ত বল্লমের মতো বাইরের অরণ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
একপাশে নিথর হয়ে বসে সব কিছু দেখল আর শুনল পলিঙা এবং মেহেলী।
ইতিমধ্যে রাশি রাশি বাঁশের চোঙা বার করেছে বুড়ি নাকপোলিবা। পোড়া চুল, পিঁপড়ের মাটি, গুনু পাতা আর আতামারী লতার শিকড় মুঠোতে নিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগল সে। মাঝে মাঝে একটানা ফুঁ দিয়ে চলল। তারপর মরা মানুষের করোটি আর মোষের হাড় সেগুলোতে ঠেকিয়ে মেহেলীর দিকে জীর্ণ হাতখানা বাড়িয়ে দিল নাকপোলিবা, এগুলো সেঙাইয়ের গায়ে ঠেকাবি। খবদ্দার, ও যেন দেখতে না পায়। দেখবি একটা পোষা বাঁদর হয়ে দিনরাত তোর গায়ের গন্ধ শুকবে সেঙাই।
আবার অট্টহাসি বেজে উঠল নাকপোলিবার নিদাত মুখে। সে হাসি গুহার অন্ধকারে ভয়ানক হয়ে বাজতে লাগল।