পুরস্কারের অন্নপ্রাশন
আমি সাহিত্য সভা সেরে বাড়ি ফিরলেই মায়ের প্রথম প্রশ্ন আজও মেমেন্টো এনেছিস? দেখি কেমন দেখতে। আমায় দিবি ঘরে সাজিয়ে রাখব। বলেই আমার হাত থেকে নিয়ে বলে, বাঃ সুন্দর দেখতে। বাবা থাকলে খুবই খুশি হোত। নিরক্ষর নই তবে আমি তো পড়ালেখা জানি না। তাই তোরা পুরস্কার পেলে আনন্দে গর্বে বুকটা ভরে ওঠে। জানিস প্রথম সেদিনও খুব আনন্দ হয়েছিল। মহাজাতি সদন হলের চেয়ারে বসে আমি যখন দেখলাম তুই মঞ্চে উঠেছিস পুরস্কার নিতে। কিন্তু তোর হাতে দেখেছিলাম রজনীগন্ধার গোরের মালা। ঘোষণা করল তোর নাম করে, এবার মালা প্রদান করে বরণ করে নেবে সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীকে। দেখলাম তুই তার গলায় মালা পড়িয়ে প্রণাম করলি।আর উনি তোর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে তোর গলায় ওই মালাটি খুলে ঝুলিয়ে দিলেন।শোনা গেলো হল জুড়ে করতালির প্রতিধ্বনি। যেন আজও তা কানে বাজে।সালটা ছিল ১৯৭৩। স্কুল “SUNBEAMS SCHOOL”রাজেন্দ্রদেব রোড।কলকাতা। ঠনঠনে কালীবাড়ির বিপরীতে দেব পরিবারের প্রতিষ্ঠিত স্কুল। এই স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন “অশোকা দেব”। তিনিও তোকে খুবই স্নেহ করতেন।
বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান চলছিল “মহাজাতি সদন” হলে। ঘোষণা করল তোর নাম করে সব বিষয়ে প্রথম নার্সারি সি সেকশনের এই শিশুটি।তার হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী। দেখলাম তোর গলায় একটা রূপার পদক লাল ফিতে বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে আবার আশীর্বাদ করলেন। মা আমার হাতে রূপার পদক টি দিয়ে বলে,ধর তোর শৈশবের প্রাপ্তি। তোর সন্তানদের দেখাব বলেই যত্ন করে রেখেছিলাম। মনে পড়ছে খুব আবছা। পুরস্কারের মর্ম তখন বুঝনি। পদক সহ আরও কিছু বই নিয়ে মঞ্চ থেকে নেবে তা দিদিয়ার হাতে দিয়েছিলাম। মায়ের পাশেই দিদিয়া বসেছিল। আমি দিদিয়া বলতাম ঠাকুমাকে। তাকেই বেশি করে চিনতাম। ঠাকুমার স্নেহেই আমার বড় হয়ে ওঠা। তিনিই আমার দেখভাল করতেন। তাই তিনি ছিলেন ভালবাসার প্রিয়জন।
পদকটি হাতে নিয়ে দেখছি আর ভাবছি। বারবার উলটে পালটে নেড়েচেড়ে দেখে খুব হাসছি আর অবাক হয়েছি এই ভেবে যে আমিই এইটা অর্জন করেছিলাম।
মা বললে হাসির কি আছে হোক সে নার্সারি শ্রেণী। সব বিষয়ে শিশু শ্রেণীতে প্রথম স্থান পাওয়া কম কথা নয়। বলতো তোর সন্তানেরাও তো নার্সারিশ্রেণীতে পড়েছে। কেউ সকল বিষয়ে প্রথমস্থান অর্জন করেছে? তোর জন্য আমি আজ গর্বিত। আমি মাকে প্রণাম করে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদলাম বললাম বাবাকে দেখাতে পারলাম না। মনে হল মায়ের কাছে আজও আমি শিশু। জীবনের প্রথমবার শৈশবের প্রাপ্তি। এ যেন আমার প্রথম পুরস্কারের অন্নপ্রাশন।