Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পুরনো পল্টন || Tarapada Roy

পুরনো পল্টন || Tarapada Roy

পুরনো পল্টন

পল্টনকে নিয়ে আমি এখনও কিছু লিখিনি। কিন্তু না লিখলেই নয়। যাদের নিয়ে ইতিমধ্যে লেখা হয়ে গেছে, তারা রীতিমতো গোলমাল শুরু করে দিয়েছে, কেন পল্টন থাকতে আমি তাদের হাস্যাস্পদ করছি।

পল্টনকে নিয়ে যে কিছু লিখিনি তার কারণ একমাত্র এই নয় যে পল্টন খুব শক্তিশালী, তার চেয়েও বড় কারণ পল্টনকে নিয়ে লেখা আরম্ভ করা আর আমার দিদিমার সঙ্গে কথা বলা এক ব্যাপার। বলে কিংবা লিখে শেষ করা যাবে না।

দশ বছর আগের পল্টনের রুটিন বলি৷ ভোর সাড়ে চারটায় ঘুম থেকে উঠল পল্টন। তারপর আদাগুড় দিয়ে দেড়পোয়া ছোলা খেল। খালি গায়ে জাঙ্গিয়া পরে প্রায়ান্ধকার হাজরা রোড ধরে জগন্নাথ ব্যায়ামাগারে প্রবেশ, মিনিট-পনেরো বারবেল ভেঁজে ফাস্ট ট্রাম ধরে, ওই পোশাকেই, টালিগঞ্জ ট্রাম-ডিপোতে গমন। সেখানে ট্রামের লোকদের সঙ্গে–এই ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, চেকার এদের সঙ্গে গায়ে পোয়াখানেক তেল মেখে (প্রসঙ্গত ওই ভোরে বেরুনোর সময় পল্টন তেলের শিশি হাতে নিয়ে বেরুত) কুস্তি। এই ট্রাম-ডিপোতে কুস্তির ব্যাপারে পল্টনের আশ্চর্য একটা যুক্তি ছিল, এইভাবে ট্রামের লোকদের সঙ্গে বিশেষ বন্ধুত্ব হয়ে যায় আর ট্রামভাড়া লাগে না। শেষরাত্রে গায়ে তেলমাটি মেখে যার সঙ্গে কুস্তি করেছি, সে কি আর সারাদিন ট্রামভাড়া চাইতে পারে? তখন আমার উদ্দাম বেকার অবস্থা। স্বীকার করি, আমিও প্রলোভিত হয়েছিলাম। কিন্তু হর্বচন সিং নামে এক ভোজপুরি ড্রাইভার প্রথম দিনেই আমার পিঠে হাঁটু দিয়ে এমন ভীষণ আঁতা দিয়ে ধরেছিল যে, বিনা ভাড়ায় ট্রাম চড়ার লোভ পরিত্যাগ করতে হল, জীবনে আর কোনওদিন ইজিচেয়ারে শুয়ে সুখ পেলাম না, এমনকী বিছানায়ও চিত হয়ে শুলে সমস্ত শিরদাঁড়া প্রতিবাদ করে ওঠে, খচখচ করে শব্দ হয়।

সে যা হোক, পল্টনের কুস্তি শেষ হলে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরত। কেননা ততক্ষণে বেলা হয়ে গেছে। বিশেষ করে ওই সময়ে আমাদের পাড়ার মেয়েরা সকালবেলার কলেজে যায়, তার মধ্যে নাকি অনেকেই পল্টনের অনুরাগিণী ছিল, তাই ব্যায়ামের পোশাকে তাদের সম্মুখীন হতে পল্টনের দ্বিধা ছিল। কিন্তু তবুও ফেরার জন্যে একটা বাড়তি পোশাক, অন্তত একটা লুঙ্গি কেন পল্টন নিয়ে যেত না, সে বিষয়ে কোনওদিন কিছু জানা যায়নি পল্টনের কাছ থেকে। কিছু প্রশ্ন করলে স্বভাবসিদ্ধ মৃদু হেসেছে। পল্টন-চরিত্রের আরও বহু রহস্যের এই একটি।

ট্যাক্সিতে করে বাড়ি ফিরে, হাতে ধুতি আর গামছা নিয়ে হেঁটে বাবুঘাট গঙ্গাস্নান। শুনেছি, সেখানে নাকি মিনিট-পনেরো সন্ধ্যা-আহ্নিকও করত; তারপর আবার পায়ে হেঁটে বাড়ি। এবার নতুন অধ্যায়। বাড়িতে ফিরে আবার স্নান। চন্দন সাবান দিয়ে স্নান, মাথায় গন্ধ-তেল, বাক্স থেকে ধোপাবাড়ির কাঁচা তাঁতের ধুতি, সিলকের পাঞ্জাবি, সব পাট-পাট নিখুঁত। এক কাপ চা আর দুটো মুচমুচে বিস্কুট খেয়ে পল্টন যেত গানের ইস্কুলে। সেখানে রবীন্দ্রনাথের গান, কমলমুকুলদল খুলিল আর পল্টনের খুব প্রিয় গান ছিল নানা রঙের দিনগুলি। মিহিগলায় ঝকঝকে পোশাকে গান শিখে, তারপর সকালবেলার আড্ডা দশটা নাগাদ। এই সময়ে প্রতিদিনই পল্টনের সঙ্গে আমার দেখা হত। আমরা দুজনে প্রতিবেশী এক সম্পাদকের বাড়িতে যেতাম। সেখানে গিয়ে সনেটের রূপ-বৈচিত্র্য এবং আধুনিক কবিতার ক্রমশ পতন বিষয়ে উষ্ণ আলোচনা হত।

সময়মতো বলে রাখি, পল্টন অনেক খবর রাখত। একদিন মৃদু মৃদু হাসছিল, বললাম, হাসছিস কেন?

বলল, জানিস বলরামবাবুর ডাকনাম গদাই! ওর মেজমামা ওকে গদাই বলে ডাকে।বলরামবাবু তখন এক বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। তার সম্বন্ধে পল্টন এত জানে, এই তথ্য আমাকে খুবই বিচলিত করেছিল।

আরেক দিন পল্টন বলেছিল, জানিস মহেন্দ্রবাবুর ভাইঝি ফেল করেছে! মহেন্দ্রবাবুও আরেকজন সম্পাদক। আমি এসব কিছুই জানতুম না, আর ভাবতুম আমার কিছুই হবে না।

সংগীত শিক্ষা এবং কবিতা আলোচনার পর্ব শেষ হলে পল্টন চলে যেত সায়েন্স কলেজে। ফলিত পদার্থবিদ্যায় কী একটা জটিল গবেষণা, যার উপরে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ, বিশেষ করে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নাকি নির্ভরশীল ছিল, তারই দায়িত্ব ছিল পল্টনের। সেখান থেকে বেলা তিনটে নাগাদ সোজা রেডক্রশ, ফাস্ট-এড়ে খুব ভাল ট্রেনিং নিয়েছিল পল্টন। পরবর্তী জীবনে অবশ্য এই শিক্ষা তার খুব নিজের কাজে লেগেছে। বহুবার নিজেকে ফাস্ট-এড দিতে হয়েছে পল্টনের।

অবশ্য এর মধ্যে সময় পেলে একবার স্টুডিওপাড়া থেকে ঘুরে আসতে হত তাকে। কী একটা ফিল্মে কখনও সহকারী পরিচালক, কখনও টেকনিশিয়ান, কখনও পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়–কী যেন করার কথা ছিল তার, সে নিজেও ভাল করে জানত না।

তারপর অপরাহ্নে প্রেম।

প্রেম করতে বড় ভালবাসত পল্টন। ষোলো বছর বয়স থেকে। মল্লিকমশায় বলতেন, সোলো (solo) পারফরমান্স। সেই শুরু, তারপর একযুগ অতিক্রান্ত, হাজরা মোড়ের বুড়ো ভিখারি মরে গেল, তার ছেলেরা এখন ভিক্ষা করছে, রাজেনবাবুর মাথা খারাপ হয়ে গেল, মল্লিকমশায় হাকিম হয়ে গেলেন, আমি মাইনে-করা হাস্যরসিক হয়ে গেলাম–আরও কত কী হল, এমনকী পল্টন পর্যন্ত। পাড়া ছেড়ে চলে গেল কিন্তু প্রেম তাকে ছাড়ল না।

জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার। পল্টন নামল, সাঁতার শিখল, সাড়ে তিনশো টাকা খরচ করে মিলান থেকে নীল ডোরাকাটা সুইমিং কম আনাল, দেড় মাস অনবরত চিড়িয়াখানায় গেল, ছয় মাস পার্ক স্ট্রিটে ফরাসি ভাষা অধ্যয়ন করল, একদিন হাজরা পার্কে বক্তৃতা করল, ভুখা-মিছিলের সামনে কালো ফ্ল্যাগ নিয়ে চৌদ্দ মাইল রাস্তা হেঁটে অজ্ঞান হয়ে গেল–কত কী করল পল্টন, সবই সেই মীনকেতনের অলক্ষ্য নির্দেশে।

ষোলো বছরের পল্টনের প্রথম প্রেমের অরুণরাগরঞ্জিতা দুলালীকে নিয়ে রসিকতা এককালে অনেক করেছি। এখন আর সাহস নেই। দুলালীর তৃতীয় মেয়েকে সেদিন দেখলাম, সবে কয়েকটা দুধ-ত উঠেছে, হঠাৎ অতর্কিতে আমার হাঁটু কামড়ে দিয়েছিল, তার ওপরে দুলালীর স্বামী রাইফেল ফ্যাকটরিতে কাজ করে–কোনও রসিকতা এখানে এখন আর চলবে না।

বরং মাধুরীকে নিয়ে চলতে পারে। পল্টনকে বড় কষ্ট দিয়েছিল মাধুরী।

শিখ সর্দারজিদের মতো পল্টন একদিন একটা পাগড়ি মাথায় দিয়ে চলে এল, বলল, আজ থেকে দাড়ি রাখছি।

কী ব্যাপার? আমাদের সকৌতূহল প্রশ্নের উত্তরে পল্টন জানাল, মাত্র পৌনে চার টাকা, জগুবাবুর বাজারে, ভীষণ চিপ!

মল্লিকমশায় বললেন, দাড়ি রাখতে পৌনে চার টাকা খরচ, কী সাংঘাতিক! এ দামে দাড়িসুদ্ধ ছাগল পোষা যায় মশায়।

পল্টন মল্লিকমশায়ের কথা শুনেই খেপে যায়, দাড়ির কথা কে বলেছে মশায়, পাগড়ির কথা বলছি।

মল্লিকমশায় কিন্তু থামলেন না, ও পাগড়ি–আপনি পুলিশে চাকরির চেষ্টা করছেন, বলেননি তো।

একটা হাতাহাতি হয়ে যেত, যদি আমরা না থাকতাম। তা ছাড়া পাগড়ির ব্যাপারটা কী তাও আমাদের জানা দরকার। জিজ্ঞেস করতে পল্টন মৃদু হাসল, আবার প্রশ্ন আবার মৃদু হাসি৷ কিঞ্চিৎ লাজনম্রতাও যেন জড়িত ছিল সে হাসির সঙ্গে! সন্দেহ হল ব্যাপারটা প্রেমঘটিত। মল্লিকমশায় টোপ ফেললেন, বাঙালি মেয়েদের আজকাল বড় পাগড়ি, তলোয়ার দাড়ি, এইসব সর্দারজিদের প্রতি খুব ঝোঁক হয়েছে।

পল্টন মৃদু হাসতে লাগল, তারপর মুখ খুলে একটা শব্দ উচ্চারণ করল, মাধুরী!

মজুমদারসাহেব তখন অবিবাহিত, শ্রীমতী মজুমদার তখনও নেপথ্যে, প্রেম-ট্রেম ব্যাপারে তখন আমরা তাকে অথরিটি বলে মান্যগণ্য করি। তিনি খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, কেসটা খুব ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। তারপর পল্টনকে কী একটা গোপন ইঙ্গিত করলেন, পল্টন আর মুখ খুলল না।

অনুমান করি, এর পরে পল্টনকে তিনি কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। পল্টন দিন-সাতেকের পরে একদিন এসে বলল, ট্যাক্সির ব্যবসা করব, আমার একটা ট্যাক্সির পারমিট চাই।

মল্লিকমশায় বললেন, ট্যাক্সির পারমিট পেতে খুব অসুবিধে। তার চেয়ে আপনি কিছুদিন বাস কন্ডাক্টরি করুন।

পল্টন আবার মারমুখী। অমিত মল্লিকমশায় বললেন, নিশ্চয় মজুমদারসাহেবের পরামর্শ। আপনি পুরোপুরি সর্দার হয়ে যেতে চাইছেন। প্রেমের জন্যে, ওই বোকা মাধুরীর জন্যে বাঙালিত্ব বিসর্জন দিতে আপনার দ্বিধা হচ্ছে না!

বোকা মাধুরী? এই রকম কী একটা প্রশ্নবোধক চিৎকার করে পল্টন এমন সময় লাফিয়ে উঠল যে মল্লিকমশায় না হয়ে অন্য কেউ হলে অজ্ঞান হয়ে যেত। কিন্তু ওই লাফের পরেই পল্টন ঘরের থেকে বেরিয়ে গেল। বোঝা গেল আর সহজে আসছে না। অন্তত মল্লিকমশায়ের সামনে তো নয়ই।

দিন যেতে লাগল। পল্টনের পাগড়ির রং ঘন ঘন পালটাতে লাগল। দাড়ি ঘন থেকে ঘনতর হল, হাতে লোহার বালা উঠল। আহাটু-লম্বিত কোর্তা আর সংক্ষিপ্ততম নিম্নাঙ্গের পোশাক। রাস্তায় দেখা হলে পল্টন আর আমাদের সঙ্গে কথা বলে না। আমরাও বাঁচোয়া। কে একজন এসে খবর দিল, পরেশনাথের মিছিলে সকলের আগে ঘোড়ায় চড়ে চলেছে পল্টন, শোনা গেল নিয়মিত গুরুদ্বারে যাচ্ছে। অথচ কোনও সূত্রেই এমন কিছু দেখা বা শোনা গেল না যাতে জানা যায় যে মাধুরী পল্টনের। নিকটবর্তিনী হয়েছে।

মাসখানেক পরে খবর পাওয়া গেল মজুমদারসাহেবের কাছে। মজুমদারসাহেব বললেন, আরে মশাই, মেয়েটা ভয়ংকর দুষ্টু। ওর বাপ টাকা ধার করেছে কোন এক কাবুলির কাছে। ওর ধারণা কাবুলিরা শিখদের ভয় পায়। আর তাই শিখ সাজিয়ে পল্টনকে বাড়ির চারপাশে ঘোরাচ্ছে, যাতে ওর বাবাকে ধার-টার শোধ করতে না হয়।

অবশেষে নিদারুণতম ঘটনাটি ঘটল। ধর্মের অঙ্গ হিসেবে আঠারো ইঞ্চি লম্বা ভোজালি কিনতে গিয়ে অস্ত্র-আইনে পল্টন পুলিশের হাতে ধরা পড়ল। মাধুরী নাকি বলেছিল, ওটাও চাই।

মল্লিকমশায় থানায় গিয়ে জামিন হয়ে পল্টনকে ছাড়িয়ে আনলেন।

পল্টন কিন্তু মাধুরীকে ছাড়ল না।

উচিত শিক্ষা হয়েছিল মাধুরীর। মাথার উপরে ন্যায়পরায়ণ ঈশ্বর আছেন, আর আমাদের হাজরার চৌমাথায় ছিল জনার্দন।

জর্নাদন আর নেই, জর্নাদন সাম্রাজ্যের কেউই প্রায় নেই আর আজ। এখন এতদিনে পল্টন-মাধুরী প্রণয়কাহিনির সুযোগে একটু জনার্দনলীলা বর্ণনা করা যেতে পারে। জনার্দন-স্মৃতিচারণ যেমন মধুর তেমনই রোমাঞ্চকর।

কলকাতার রাস্তায় সততসঞ্চারমান জনার্দন এবং তার সঙ্গীদের, ধর্মের ষাঁড়গুলিকে, আজ অনেকদিন লালবাবার আশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিরীহ নাগরিকেরা হয়তো স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বেঁচেছেন, কিন্তু আমরা যারা শক্তির পূজারী, আমাদের এতে বিশেষ মনোবেদনা হয়েছে।

দক্ষিণে মনোহরপুকুর, উত্তরে আশুতোষ কলেজ, পশ্চিমে কাটা গঙ্গা আর পুবে ল্যান্সডাউন এই ছিল জনার্দনের সাম্রাজ্যের স্বাভাবিক সীমা। অবশ্য একাধিকবার তাকে এই এলাকার বাইরেও দেখেছি। হিন্দি সিনেমার পোস্টার খেতে খুব ভালবাসত জনার্দন। একবার চেতলা হাটে সস্তায় গামছা কিনতে গিয়ে দেখেছিলুম, নিচু নিচু চালা দোকানঘরের বেড়া থেকে স্বল্পবসনা সুললিতা নায়িকার ছবি আপাদমস্তক চিবিয়ে খাচ্ছে। গড়িয়াহাট ফাড়ির কাছে এক সন্ধ্যায় অপর প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ করে দেড় ঘন্টা ট্রাফিক জ্যাম রাখবার কৃতিত্বের অংশীদারও জনার্দন। তবু একটা নির্দিষ্ট চৌহদ্দির মধ্যেই রাজত্ব করতে ভালবাসত সে।

জনার্দন নাম কে দিয়েছিল, বলতে পারব না। আমরা যতদিন কালীঘাট পাড়ায় আছি এই নামে এই ষাঁড়টিকে দেখে এসেছি। আমাদের পাড়ার সমস্ত সামাজিক ব্যাপারেই জনার্দনের কিঞ্চিৎ দায়িত্ব ছিল। ভজগোপালের ছোড়দির বিয়ে, বেপাড়ার বরযাত্রীরা ভীষণ হই-হুঁল্লোড় করছে, কেউ কিছু বলতেও পারছে না, হঠাৎ একটা পানের দোকানের সামনে থেকে তিনজন বরযাত্রীকে তাড়া করে সোজা আশুতোষ কলেজের দোতলায় উঠিয়ে দিয়ে সারারাত জনার্দন গেটে বসে রইল। অভুক্ত, বিনিদ্র সেই বরযাত্রীদের অপর সঙ্গীরা সেদিন রাত্রে পরে বড় চুপচাপ ছিল, কোনও হইচই নেই, রাস্তায় ছুঁচোবাজি নেই। ভোর চারটায় জনার্দন গেট ছেড়ে যখন মোড়ের দিকে এল তখনই শুধু সুযোগ পেয়ে সেই বরযাত্রীরা দোতলা থেকে নেমে, বিয়েবাড়ি নয়, সোজা ট্যাকসি করে কোথায় চলে গেল।

জনার্দনের সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য ছিল, (হিন্দি সিনেমার পোস্টার বাদে অবশ্য) আতরমাখানো রুমাল আর কাটা ঘুড়ি।

আমাদের পাড়ায় রুমালে সেন্ট মাখা উঠেই গিয়েছিল জনার্দনের আমলে। কিন্তু অন্য পাড়ার লোকেরা জানবে কী করে? ট্রাম থেকে নামলেন শৌখিন ভদ্রলোক, পকেটের কোণায় বেরিয়ে রয়েছে সিল্কের রুমালের কোণকাটা ফুল। ইভনিং ইন প্যারির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আলস্যমন্থর গতিতে জনার্দন এগুল ভদ্রলোকের পাশে। কিছু বুঝবার আগে কিংবা বুঝতে বুঝতেই জনার্দন জিভ বাঁকিয়ে পকেট থেকে তুলে রুমালটা চিবোতে লাগল। দু-একবার দেখেছি রুমালের সঙ্গে মানিব্যাগও উঠে এসেছে, কিন্তু জনার্দন মানিব্যাগ খেতো না, একটু চিবিয়েই ফেলে দিত।

দোকানে দোকানে বিক্রির জন্যে ঘুড়ি টাঙানো থেকেছে, কিন্তু জনার্দন সেদিকে চোখ তুলেও তাকাবে না। তার অপরিসীম উৎসাহ ছিল কাটাঘুড়ি খাওয়ায়। বিশ্বকর্মা পুজোর সময় দেখেছি, কঞ্চি হাতে, বাঁশ হাতে ছেলেরা ছুটোছুটি করছে এদিক থেকে ওদিক। ভোকাটা-ভো, এই একটা ঘুড়ি কাটল-জনার্দন আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়িয়ে একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে কাটা ঘুড়িটা দেখল, তারপর কখনও হেলতে দুলতে কখনও ছুটে চলল ছেলেদের সঙ্গে। অত্যন্ত কায়দা করে গা। বাঁচিয়ে যাতে কারও বিশেষ কোনও চোট না লাগে, শিং দিয়ে একে একটা আলতো গুঁতো দিয়ে ওকে ছোট একটা ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে সর্বশেষ সে এক অত্যাশ্চর্য শারীরিক কৌশলে সামনের পা দুটো। আকাশের দিকে তুলে গলা বাড়িয়ে ঘুড়িটাকে জিভ দিয়ে ধরে ফেলত। এই প্রতিযোগিতায় হেরে হেরে শেষে আমাদের পাড়ার ছেলেরা ঘুড়ি ধরা ছেড়েই দিয়েছিল। দীর্ঘকাল আমাদের পাড়া থেকে খবরের কাগজে ঘটনা দুর্ঘটনায় ঘুড়ি ধরিতে গিয়া বালকের মৃত্যু এই রকম কোনও সংবাদ বেরোয়নি আর।

জনার্দনের এসব ব্যাপারের তবু ব্যাখ্যা ছিল। কিন্তু তার কতকগুলি আচরণ আমাদের বুদ্ধিরও অগম্য ছিল। ট্রাফিক সিগন্যাল আশ্চর্য বুঝত, পুলিশের হাত দেখলেই মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়ত, হাত নামালে তবে রাস্তা পার হত। যখন ট্রাফিক লাইটিং-এর ব্যবস্থা হল, একদিন দেখলাম জনার্দন খুব গম্ভীর হয়ে লালসবুজ আলোগুলো লক্ষ করছে, তারপর থেকে সবুজ আলো না দেখে রাস্তা পেরুত না।

রামপ্রসন্নবাবুর ভাগিনেয়ী যে সন্ধ্যাবেলা লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করত আমরা কোনওদিনই টের পেতুম না, যদিনা একদিন অন্ধকারে তিনতলার চিলেকোঠায় জনার্দন উঠে যেত। সেদিন রুষ্ট যণ্ডের আক্রমণ থেকে গোপন প্রেমিকের আত্মরক্ষা অসম্ভব ছিল, যদি সে (পরে জানতে পেরেছিলাম) সেবছর লং ডিস্ট্যান্স জাম্পের বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন না হত। এক লাফে প্রেমিকের বাহুপাশ থেকে পাশের বাড়ির ছাদে, তারপর হইচই, চোর-চোর, জনার্দন, রামপ্রসন্নবাবুর ভাগিনেয়ীর ফোঁপানি ইত্যাদি সে এক কেলেঙ্কারি।

পল্টনকেও জনার্দনই রক্ষা করেছিল। আমাদের সাধারণত জনার্দন কিছু বলত না, শুধু আমাদের পাড়ার মতির একটু পানদোষ ছিল, একবার প্রথমদিকে যখন সে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরত সেই সময় একদিন তাড়া করে জনার্দন তাকে ডাস্টবিনের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল, নেশা না কাটা পর্যন্ত ছাড়েনি, ডাস্টবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে ফোঁসফোঁস করেছে। শেষে মতির বাড়ির লোকেরা এবং আমরা যখন হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, জনার্দনও আর মতিকে কিছু বলত না, তবে বেপাড়ার মাতালদের সঙ্গে নিয়ে এলে তাদের পুঁতিয়ে একাকার করে দিত।

পল্টন যখন দাড়ি রাখল, পাগড়ি চাপাল তখন একদিন পল্টনের দিকেও তেড়ে গিয়েছিল জনার্দন, কিন্তু বিশেষ কিছু বলেনি। তবে চোখে একটা ওয়ার্নিং ছিল, যাকে বলা যেতে পারে অনুক্ত সাবধানবাণী। জনার্দনের সেই রোষ কষায়িত লোচন যে দেখেনি সে জানে না ব্যাপারটা কী। কিন্তু সামান্য একটা ষাঁড়ের চোখরাঙানিতে প্রেমে ইস্তফা দেবে পল্টনের গোঁয়ার্তুমি এত কম ছিল না।

ইতিমধ্যে জনার্দন খুব দুর্দান্ত হয়ে উঠেছিল, একটু বেপরোয়াই বলা যেতে পারে। একটা ঠেলাগাড়িওয়ালা পথ আটকিয়ে রাখার জন্যে তাকে কী সব কটুক্তি করেছিল, জনার্দন ঠেলাওয়ালাকে কিছু বলল না, তাড়া করে তাকে অন্য ফুটপাথে তুলে দিয়ে ফিরে এসে নৃশংসভাবে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে ঠেলাটাকে একেবারে চুরমার করে ফেলল। সেইদিন রাত্রেই জনাপাঁচেক ঠেলাওলা একত্র হয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জনার্দনকে খুব মোটা দড়ি দিয়ে জড়িয়ে ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে বেঁধে ওর শিং দুটো একেবারে নিমূল করে কেটে দিল। এর পরে দিন কয়েক জনার্দনকে বড় নির্জীব, অসহায় বলে মনে হল আমাদের। কোনওদিন তেল মাখানো হয়নি, কিন্তু ওরকম তৈলমসৃণ শৃঙ্গ বিশেষ দেখা যায় না। শিং কাটার পর জনার্দনকে মুকুটহীন সম্রাটের মতো মনে হত।

পল্টন-মাধুরী পর্ব তখন প্রায় জমে এসেছে। মজুমদারসাহেব সাড়ে বারো গজ কাপড় দিয়ে বিশাল ঘের দেয়া এক পাজামা করিয়ে দিয়েছে হাওড়া হাটের পাশের এক খাঁটি পাঞ্জাবি দরজির দোকান থেকে পল্টনকে। সেই পাজামা, গোলাপি কোর্তা, দাড়ি, জরির ঝিলিক-লাগানো পাগড়ি পল্টনকে আমরা বেশ এড়িয়ে চলতুম। কিন্তু মাধুরী বেশ ঘন হয়ে এল।

মধ্যে মধ্যে মাধুরীকে দেখা যেতে লাগল পল্টনের সঙ্গে। সেই সময়ের একদিনের ঘটনা।

.

আমরা মোড়ের মাথায় রেলিংয়ের উপর বসে সিগারেট খাচ্ছি, আর মাঝে মধ্যে এদিক-ওদিক তাকিয়ে উদাস মন্তব্য করছি। এমন সময় মজুমদারসাহেব বললেন, ওই যে পল্টন!

তাকিয়ে দেখে আমি বললুম, আসুন চ্যাঁচাই।

মজুমদারসাহেব আপত্তি জানালেন, না, দেখছেন না সঙ্গে মেয়েটি রয়েছে।

সত্যিই মাধুরী রয়েছে, গদগদভাবে কীসব বলছে, আর পল্টন খুব গর্বিতভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। চ্যাঁচাতে হলে এই তো সময়।

আমি বললুম, চ্যাঁচানোর সুবর্ণ সময়।

মজুমদারসাহেব উত্তেজিত, আপনার কোনও সেন্স অফ এটিকেট নেই মাথায়। একটি মেয়ের প্রেমকে মর্যাদা দিতে শিখুন।

মর্যাদা দিতে বাধ্য হলাম। কিন্তু এই বিচিত্র নাটকীয় প্রেমের মর্যাদা কিন্তু জনার্দন দিল না। হঠাৎ পল্টনের গলার স্বর বেশ ভীত এবং উত্তেজিত, এই মাধুরী, চট করে এই দোকানটার ভিতরে চলে এসো।

ওপাশের ফুটপাথে শুয়ে শুয়ে জাবর কাটতে কাটতে এতক্ষণ জনার্দন নির্বিকারভাবে পল্টন মাধুরীকে দেখেছিল, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়েছে। জনার্দনের মেজাজের সঙ্গে পল্টন আমাদের মতোই সুপরিচিত, সুতরাং সন্ত্রস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মাধুরী প্রতিবাদ জানাল, হঠাৎ দোকানে ঢুকব কেন, কী ব্যাপার? এই মোড়ের মাথাতেই একটু দাঁড়াই না?

আরে, ওই ষাঁড়টা আসছে যে!পল্টনের কথা শুনে মাধুরী যখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে তখন রাস্তা পার হচ্ছে জনার্দন ধীর মন্দ গতিতে, দেখলে কিছু অনুমান করাই কঠিন।

মাধুরী যেন একটু চটেই গেল, মাথা খারাপ হল নাকি? ষাঁড়টা কী করবে?

কী আর করবে, গুঁতো দেবে! যা বলছি শোনো, এই দোকানের ভিতরে চলে এসো। পল্টন চাচা বাঁচা থিয়োরি অনুসরণ করে একাই দোকানে ঢুকে পড়ল।

একটা নিরীহ শিং কাটা ষাঁড়কে এত ভয়…

কথাটা শেষ করতে পারল না মাধুরীকরুণ আর্তনাদে আমরা ছুটে গেলাম। বিশেষ কিছু না পর পর দুটো গুঁতো–কাটা শিংয়ে এর বেশি প্রয়োজন ছিল না। শাড়ির চার জায়গা থেকে চারটে ভেঁড়া টুকরো, তিনটে চুলের কাঁটা, সামান্য রক্ত, কয়েকটি দ্রুত দীর্ঘশ্বাস আর গোটা দশেক ভাঙা লাল কাঁচের চুড়ি হাজরার মোড়ের ফুটপাথে একটি অসম্পূর্ণ প্রেম-কাহিনির উপর যবনিকা টেনে দিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress