Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পুনর্মিলন || Mallik Kumar Saha

পুনর্মিলন || Mallik Kumar Saha

পুনর্মিলন

এই তো সেইদিনের কথা। দুই বৎসর পূর্ণ হইয়া তিন বৎসরের মাথায় আসিয়া ঠেকিয়াছে। অনিরুদ্ধ বিকাল বেলায় তাহার পুরানো এ্যালবামখানি খুলিয়া স্থির নয়নে চাহিয়া আছে। অন্যদিন তাহাকে নির্বিকার চশমা চোখে বিছানায় শুইয়া থাকিয়া একখানা বই পড়িতে দেখা যায়। কি জানি কি ভাবনায় আজ সে এ্যালবামের কোন্ গোপন তথ্য আবিষ্কার করিতে চলিয়াছে ?

পাশের ঘর হইতে শ্রাবণীর শাঁখার শব্দ কানে ভাসিয়া আসিতেই অনিরুদ্ধবাবুর চৈতন্য ফিরিয়া আসিল। বিশুদ্ধ ভাবনার মধ্যে কতক্ষণ যে এমনভাবে কাটিয়াছে তাহা কি আর বলিবার অপেক্ষা রাখে? শ্রাবণী ধীর পায়ে আসিয়া স্বামীর পাশে বসিয়া বলিল, “চল না, কোথা থেকে কয়েক দিনের জন্য ঘুরে আসি।”

এই আবদারটি অনিরুদ্ধর কাছে নতুন নয়। শ্রাবণী অনেক বার তাহাকে এই বিষয়ে অবগত করাইয়াছে। কিন্তু অনিরুদ্ধ প্রতিবার নিরুত্তর থাকিয়াছে। অন্য ব্যাপারে সে কখনও নিরুৎসাহ দেখায় না। এই ঘুরিতে যাইবার ব্যাপারটি লইয়া মনে তাহার অবসাদের কালো মেঘ জমিয়া যায়। অর্থের অভাব কিংবা অন্য কোন দায় কোনটিই তাহার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। স্ত্রীর সঙ্গে আন্তরিকতা কোন অংশে কম আছে বলিলে ভুল বোঝা হইবে। অতএব অনিরুদ্ধর মনের সংগোপনে যাহা কিছু সঞ্চিত ও রক্ষিত আছে তাহার বিন্দু মাত্রও শ্রাবণীর কোমল হৃদয়ে রেখাপাত করে নাই।

অনিরুদ্ধ শ্রাবণীর মুখপানে চাহিয়া একগাল হাসিয়া বলিল, “গত একবৎসর হয়ে গেল তুমি আমার জীবনে এসেছ। অন্যসব ছোটখাটো ইচ্ছেগুলো পূর্ণ করেছি। তাতে কোন সন্দেহ নেই। শুধু তোমাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবার আবদার টুকু অসম্পূর্ণ রয়েছে, তাই না? তাহলে তুমিই বল এবার শীতের ছুটিতে তোমাকে নিয়ে কোথায় যেতে হবে?”

অনিরুদ্ধর এমন কথা শুনিয়া শ্রাবণীর দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিবার সময় আসিয়াছে বোধ হইল। নববর্ষায় বৃক্ষরাজী যেমন সজীব হইয়া উঠে— শাখাপ্রশাখা আন্দোলন করিয়া সুখ প্রকট করে, তদ্রুপ শ্রাবণীর মনের বাসনা পূর্ণ হইবার সুযোগ আসিতেই সমস্ত শিরা উপশিরায় পুলক জাগিল। অনিরুদ্ধর হাত দুইটি সজোরে চাপিয়া ধরিয়া কহিল, “জান, ছোট বেলা থেকেই সাগর দেখার জন্য আমার মন চঞ্চল হয়ে আছে। নদী নালা, খাল-বিল অনেক দেখেছি। নীল আকাশের নীচে নীল সাগরের ফেনিল তরঙ্গ যখন তীরে এসে আঘাত করবে আমার প্রাণের স্পন্দন তখন দ্বিগুন গতিতে স্পন্দিত হবে। আর আমি সেই তরঙ্গে ভেসে যাব। বল না, আমায় তখন সাগরের হাত থেকে বাঁচিয়ে আনতে পারবে তো?”

শ্রাবণীর মুখে সাগরের কথা শুনিতেই অনিরুদ্ধর বুকে যেন প্রবল তরঙ্গ আসিয়া আঘাত করিল। তাহার পুরানো স্মৃতি আবার সজীব হইয়া উঠিল। অবিকল ভাব, আর সেই সঙ্গে অবিকল ভাষা। কোথাও কোন অমিল আছে বলিয়া মনে হইল না। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরও তাহার প্রথমা স্ত্রী সুলোচনাকে আর খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। বছর দুই কাটিয়া যাইবার পর শ্রাবণী তাহার জীবনে দ্বিতীয় পত্নী হিসাবে স্থান পাইয়াছে বটে, কিন্তু সুলোচনার ব্যক্তিত্বের প্রভাব অনিরুদ্ধর উপর স্বাভাবিক ভাবেই অধিক ছিল। প্রথমা স্ত্রীর অনুরোধটুকু পালন করিতে যাইয়া তাহাকে সাগরের স্রোতে ভাসিয়া যাইতে দেখিয়াছে । চোখের নিমেষেই সে যে কোথায় চলিয়া গেল— আর উদ্ধার হইল না। তরঙ্গের স্রোতে ভাসিয়া যাইবার পূর্বে শুধু দুইটি শব্দ কানে আসিল — “আমাকে বাঁচাও।” কিন্তু শেষ রক্ষা আর হইল না। তখন হইতেই অনিরুদ্ধ বাবুর কাছে সাগরের তরঙ্গ ভয়ের অন্যতম কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

প্রায় স্তব্ধ হইয়া অনিরুদ্ধবাবু উত্তর করিল, “সাগরে না গেলেই কি নয়? আমরা বরং পার্বত্য শৈল শহরে ঘুরে আসি। দার্জিলিং কিংবা শিলং— নয় তো অন্য কোথাও। এসবের কোনটি কি তোমার দেখা আছে?”

দার্জিলিং-এর নামটি কানে আসিতেই শ্রাবণীর বুক কাঁপিয়া উঠিল। সমস্ত শরীরের লোম খাড়া হইয়া দাঁড়াইল। টাইগার হিলস্ এর সূর্যোদয়, ওমফা মন্দির — একে একে সব মনের এ্যালবামে তাজা হইয়া ফুটিয়া উঠিল। আর সেই — সেই রোপওয়ের দুর্ঘটনা তাহার জীবন হইতে ছিনিয়া লইয়া গেল সব থেকে বড় পাওনা। আশার আলো হইয়া অন্ধকার দূর করিতে আসিয়া ছিল— ‘অরূপবাবু’। কিন্তু হায়। রক্তাক্ত দেহের সে কি ভয়ানক দৃশ্য।

একটু আনমনা হইয়া শ্রাবণী উত্তর করিল, “দার্জিলিং ফিরে দেখার কোন ইচ্ছে নেই। আমরা বরং এবার ছুটিতে শিলং ঘুরে আসি।”

অনিরুদ্ধ শ্রাবণীর কথায় রাজী হইয়া ‘স্কট্ ল্যান্ড অফ দি ইষ্ট’ অর্থাৎ শিলং- এ যাইবার যাবতীয় বন্দোবস্ত করিতে উদ্যোগী হইল।

ডিসেম্বরের আকাঙ্খিত দিনগুলি শীতের কুয়াশার মতো শরীরে আসিয়া স্পর্শ করিল। সরকারী আবাসে পা রাখিতেই শ্যামলী বৃক্ষরাজীর অপূর্ব সৌন্দর্যে প্রাণ জুড়াইয়া গেল। রাস্তার দুই ধারে সারিসারি পাইন গাছ গুলি দেখিয়া মনে হইল হাতে হাত ধরিয়া তাহাদের অভিনন্দন করিয়া চলিয়াছে। উঁচুনীচু পাহাড়ের চূড়া হইতে সূর্যের প্রথম কিরণ আসিয়া গৃহে প্রবেশ করায় প্রকৃতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে আলিঙ্গনের স্বাদ উপলব্ধি করিল। এক বিকালে শহরের সুপ্রসিদ্ধ ওয়ার্ডসলেক -এ স্নিগ্ধশীতল ছায়ার তলে অনিরুদ্ধ শ্রাবণীর ছবি তোলায় ব্যস্ত হইয়া পড়িল। নীল আকাশের বুকে ঝাঁকে ঝাঁকে রং বাহারী পাখীর দল উড়িয়া যাইতে দেখিয়া শ্রাবণীর আবদারে অনিরুদ্ধ খাঁচা সহ একজোড়া পাখী কিনিয়া দিল। আর সেই পাখী পাইয়া শ্রাবণীর মন নব আনন্দে উৎবেলিত হইল ।

মানুষের সখ বড়ই বিচিত্র। একদিকে মুক্ত পাখীর ন্যায় ডানা মেলিয়া নীল গগনে উড়িয়া যাইবার প্রচন্ড ইচ্ছা; আবার অন্যদিকে সেই উরন্ত পাখীকেই বন্দী করিয়া খাঁচায় ভরিয়া লালন পালন করিবার ইচ্ছা! মুক্ত কিংবা বন্দী— পরস্পর বিপরীতমুখী হইলেও মানুষ যেখানে আনন্দ পায়, সুখ অনুভব করে, তাহা পূর্ণ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া থাকে।

প্রকৃতির কোলে এমন শাস্তির নীড়ে স্বচ্ছ সৌন্দর্য উপভোগ করিতে করিতে অনিরুদ্ধর কানে ভাসিয়া আসিল, “চল না একবার সাগর ঘুরে আসি।”

অমনি অনিরুদ্ধর বুক কাঁপিয়া উঠিল। ইহা যে অতি পরিচিত কণ্ঠ। মনে হইল তাহার প্রথমা স্ত্রী সুলোচনা নিকটেই কোথাও আছে। সঙ্গে সঙ্গে চকিত হরিণীর ন্যায় চারিদিক অন্বেষণ করায় কিছুটা দূরে দেখিতে পাইল অবিকল সুলোচনা— সেই চোখ, সেই মুখ! তবে কি সুলোচনা বাঁচিয়া আছে? অনিরুদ্ধ তাহাকে খোঁজার জন্য তিল পরিমান ত্রুটিও রাখে নাই। যদি তাহার সুলোচনা জীবিত থাকিত তাহা হইলে কি তাহার স্বামীর সংসারে ফিরিয়া আসিত না? সুলোচনা তাহার প্রাণ প্রিয় অনিরুদ্ধকে দূর হইতে চিনিতে পারে নাই বলিয়া ভুল হওয়া সম্ভবপর নয়। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘাত পাছে মাথায় আসিয়া চাপিয়া ধরে তাহার পূর্বেই হারানো ধন পাইবার জন্য মনস্থির করিতে হইবে। মুখের জড়তা ভাঙ্গিয়া সুলোচনা বলিয়া ডাকিতে হাত প্রসারিত করিবার পূর্বেই কানে আসিল, “সন্ধ্যা, চলে এসো। আমাদের এক্ষনি এয়ারপোর্টে যেতে হবে।”
সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিল। মুহুর্তেই শীতের আকাশে কুয়াশা ঢাকিয়া ফেলিল। সম্মুখে আর কাহাকেও দেখা গেল না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *