সুতোর
ছেলেবেলা থেকেই আনিস একটু পাগলা গোছের। সে প্রথমবার বাড়ি থেকে পালিয়েছিল বারো বছর বয়সে। নিজেই ফিরে এসেছিল সপ্তাহখানেক পরে। চাচার বাড়িতে মানুষ, চাচা-চাচি মিলে তখন গোরুর মতো পেটাল তাকে। আমরা ভাবলাম শিক্ষা হয়েছে, আর পালাবে না। কোথায় কী! ছয় মাসের মাথায় আবার বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল, ফিরে এলে আবার চাচা-চাচি মিলে পালা করে পেটাল তাকে।
মার খেয়ে আনিস বিশেষ কান্নাকাটি করত না। শরীরটা নরম করে রাখলে নাকি মার খেলে ব্যথা লাগে না। তাছাড়া সে নাকি এক পাগলা ফকিরের কাছ থেকে কুফুরি কালাম’ শিখে এসেছে। দুচোখ বন্ধ করে একবার সেই কুফুরি কালাম পড়ে নিলে সব যন্ত্রণা নাকি বাতাসের মতো উবে যায়। দশ টাকা দিলে আমাকে সব শিখিয়ে দেবে বলেছিল। ছেলেবেলায় পুরো দশ টাকা একসাথে কখনো জোগাড় করতে পারি নি বলে সেই অমূল্য মন্ত্র আমার আর শেখা হয় নি।
আনিস বাড়ি থেকে পালিয়ে বিচিত্র সব জায়গায় যেত। কোন ভাঙা মন্দিরে নাঙ্গা সন্ন্যাসী থাকে, কোন পুকুরে জ্যোৎস্নারাতে পরী নেমে আসে, কোন শ্মশানে পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক থাকে এসব খোঁজখবর তার নখদর্পণে ছিল। কারও সাথে কথাবার্তা বেশি বলত আমার মনটা একটু নরম ছিল বলে চাচা-চাচি মিলে তাকে পিটিয়ে যখন আধমরা করে রাখত, আমি একটু সেবা-শুশ্রূষা করতাম, সেজন্যে আমাকে মাঝে মাঝে সে একটা-দুটো মনের কথা বলত।
সেই আনিসের সাথে আমার দেখা হলো প্রায় কুড়ি বছর। পরে। কমলাপুর স্টেশনে চশমা-পরা একজন মানুষ আমার কাছে এসে বলল, ইকবাল না?
আমি বললাম, হ্যাঁ। আপনি?
আমি আনিস। মনে আছে চাচা মেরে একদিন রক্ত বের করে দিল, তুই দুর্বা চিবিয়ে লাগিয়ে দিলি? ইনফেকশন হয়ে গেল তখন
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, পাগলা আনিস!
হ্যাঁ। আনিস ভুরু কুঁচকে বলল, দারোয়ানদের মতো গোঁফ রেখেছিস দেখি।
আমি হেসে বললাম, ছাত্র পড়াতে হয়, গোঁফ না থাকলে চেহারায় গাম্ভীর্য আসে না। তোর কী খবর?
দাঁড়া, বলছি। যাবি না কিন্তু খবরদার! আমি একটা কাজ সেরে আসি।
আমাকে দাঁড় করিয়ে আনিস চলে গেল। ফিরে এলো একটি পরেই। এসে বলল, বিষ্যৎবার করে গৌরীপুর থেকে এই লোকটা আসে। কতদিন থেকে ধরার চেষ্টা করছি
কী রকম লোক?
ব্লাক আর্টিস্ট। শয়তানের উপাসক।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, তুই এখনও তন্ত্রমন্ত্র করে বেড়াচ্ছিস?
কেন করব না? চাচাও নেই যে ধরে পেটাবে! এখনই তো সময়।
আশ্চর্য ব্যাপার!
আশ্চর্যের কী আছে? কাজ না থাকলে চল আমার বাসায়।
কাজ ছিল বলে সেদিন যেতে পারিনি। পরের সপ্তাহেই গিয়েছি। আনিস হতচ্ছাড়া ধরনের মানুষ ছিল। ধারণা ছিল কোনোদিনই গুছিয়ে উঠতে পারবে না। দেখলাম বেশ গুছিয়ে নিয়েছে। জহুরির কাজ করে। মূল্যবান পাথর দেখে তার মান-বিচার করে। এ দেশে এর কদর নেই, বিদেশ থেকে কিছু-কিছু মানুষ মাঝে মাঝে তার কাছে আসে। মোটা টাকা দেয় তারা-সেটাতেই তার বেশ চলে যায়।
আনিসের বাসাটা যে রকম হবে ভেবেছিলাম গিয়ে দেখি ঠিক সেরকম। দিনে কী রকম হয় জানি না-রাতে সেটা সব সময়েই আধো অন্ধকার। বেশি উজ্জ্বল বাতি নাকি আনিসের ভালো লাগে আনিসের সারা বাসা জুড়ে শুধু নানা আকারের আলমারি আর শেলফ। তার মাঝে নানা আকারের বোতল, বয়াম, শিশি আর। বাক্স। তার ভিতরে নানারকম জিনিস। বিদঘুঁটে প্রাণীর ফসিল, হাড়গোড়, পাথর, প্রাচীন ব্যবহারী জিনিস, পুরনো বই, পুঁথিপত্র, ছবি-কী নেই!
আনিসের সাথে নানারকম কথাবার্তা হলো। পুরনো বন্ধুরা এখন কে কোথায় আছে, কী করে সেটা নিয়ে কথা বলে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দিলাম। চলে আসার আগে তার আজগুবি শখ নিয়ে কথা উঠল, বললাম, বাসা দেখি দুনিয়ার হাবিজাবি জিনিসে ভরে রেখেছিস!
আনিস হেসে বলল, ঠিকই বলেছিস।
কী করবি এগুলি দিয়ে?
কিছু একটা করতেই হবে? এমনি রেখেছি। শখ।
তোর সবকিছুই আজগুবি!
আজগুবি তুই দেখিস নি-তাই এগুলিকে বলছিস আজগুবি।
গল্পের সন্ধান পেয়ে আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন, তুই দেখেছিস নাকি?
সারাজীবন কাটিয়ে দিলাম এর পেছনে, আমি দেখব না তো কে দেখবে?
কী দেখেছিস?
দেখবি?
দেখা।
আনিস উঠে গিয়ে আলমারি খুলে একটা ছোট কালো কাঠের বাক্স নিয়ে এলো। আমার কাছে বসে সাবধানে বাক্স খুলে। তামার একটা চৌকোনা জিনিস বের করে আমার হাতে দিল। বলল, এটা দ্যাখ। খুব সাবধান, নিচে ফেলবি না।
কী এটা?
এক তান্ত্রিক সাধু আমাকে বিশেষ স্নেহ করত। সে মরার আগে আমাকে দিয়ে গেছে।
কিন্তু জিনিসটা কী?
বলতে পারিস এক রকমের তাবিজ। হাতের মাংস কেটে শরীরের ভিতর ঢুকিয়ে রেখেছিল সে। মরার আগে কেটে বের করে দিয়ে গেছে সে।
শুনে ঘেন্নায় আমার শরীর একটু ঘিনঘিন করে উঠল। জিনিসটা বাক্সে রেখে বললাম কী হয় এটা দিয়ে?
হাতের মুঠোর ভিতরে শক্ত করে চেপে ধরে বলবি সুতোরন্তু।
কী হবে তাহলে?
বলে দ্যাখ।
আমি জিনিসটা হাতে নিয়ে শক্ত করে মুঠো চেপে বললাম, কী বলব এখন?
সুতোরন্তু। ধরে রাখবি এটা, ছাড়বি না।
আমি ধরে রেখে বললাম, সুতোর। আর কী আশ্চর্য, মনে হলো জিনিসটা যেন নড়ে উঠল হাতের ভিতর!
আনিস বলল, ধরে রাখ, ছাড়িস না।
কেন? কী হবে?
দেখবি নিজেই।
আমি হঠাৎ অবাক হয়ে লক্ষ করলাম মুঠোর জিনিসটা আস্তে আস্তে গরম হয়ে উঠেছে।
কিছু টের পাচ্ছিস?
হ্যাঁ। মনে হচ্ছে গরম হচ্ছে জিনিসটা। মনে হচ্ছে একটু একটু নড়ছে।
আনিস একটু হেসে বলল, আরেকবার বল সুতোরন্তু, দেখবি আরও গরম হবে।
আমি বললাম, সুতোরন্তু। কী মনে হলো, কয়েকবার বললাম কথাটি-সুতোরন্তু সুতোরন্তু সুতোরন্তু-আর সাথে সাথে মনে হলো হাতের মুঠোয় তামার চাকতিটি গনগনে গরম হয়ে কিলবিল করে নড়ছে। চিৎকার করে হাত থেকে ফেলে দিলাম জিনিসটা।
আনিস লাফিয়ে উঠে হাহা করে বলল, কী সর্বনাশ! কী সর্বনাশ! কী করলি এটা? কী করলি?
কেন, কী হয়েছে?
ঠিক হলো না এটা। আনিস গম্ভীর হয়ে বলল, একেবারেই ঠিক হলো না। তোকে বললাম আর একবার বলতে, তুই এতবার বললি কেন?
কেন, কী হয়েছে?
এটা একবার হাতের মুঠোয় নিয়ে সুতোরন্তু বলার পর নিচে রাখার একটা নিয়ম আছে। কখনো হাত থেকে ফেলে দিতে হয় না।
কী হয় ফেলে দিলে?
তুই বুঝতে পারছিস না। এটা একটা সাংঘাতিক জিনিস। হাতে নিয়ে তুই যখন বলেছিস সুতোরন্তু, তখন তুই একটা ব্যাপার শুরু করেছিস।
কী ব্যাপার?
তোকে বোঝানো মুশকিল। আনিস খুব গম্ভীর হয়ে বলল, তান্ত্রিক সাধুরা দীর্ঘদিন সাধনা করে নানারকম অপদেবতা বশ করে। সেসব অপদেবতা তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তান্ত্রিকদের সাথে থাকে, তাদের আদেশ মেনে চলে। তুই সেরকম একটা অপদেবতাকে ডেকেছিস। সে আসছে। তাকে ফিরিয়ে দেওয়া যেত, কিন্তু তুই জিনিসটা হাত থেকে ফেলে দিয়েছিস, এখন আর তাকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না।
আবছা অন্ধকার, বিচিত্র সব জিনিসপত্র চারদিকে, আনিসের থমথমে গলার স্বর, আমি আরেকটু হলে তার কথা প্রায় বিশ্বাসই করে ফেলেছিলাম। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বেশ জোরেই হেসে উঠলাম, বললাম, বলছিস এটা আলাদিনের চেরাগ? ঘষে দিলেই দৈত্য চলে আসে?
আনিস একটু আহত দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুই আমার কথা বিশ্বাস করলি না?
না।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আনিস বলল, সুতোরন্তু আসবে। ইকবাল, তোর ওপর বড় বিপদ।
সুতোরন্তু কি দৈত্যটার নাম?
ঠাট্টা করিস না। সুতোরন্তু ঠিক নাম নয়, বলতে পারিস গোত্র। সে আসছে। তোর ওপর খুব বিপদ–
ভালো। আমি হেসে বললাম, বিপদ-আপদ আমার ভালোই লাগে।
আনিস একটু অধৈর্য হয়ে বলল, তুই এখন থেকে আমার সাথে থাকবি।
তোর সাথে?
হ্যাঁ।
কেন?
তুই জানিস না এখন কী করতে হবে। আমি জানি। সুতোরন্তু কিছু একটা নিয়ে যাবে, তুই বুঝতে পারছিস না।
কবে আসবে সুতোরন্তু?
জানি না। আজও আসতে পারে, দুসপ্তাহ পরেও আসতে পারে।
আর যতদিন না আসছে আমার সব কাজকর্ম ফেলে তোর বাসায় থাকতে হবে?
হ্যাঁ।
আনিস, তোর বাসায় থাকতে আমার কোনোই আপত্তি নেই। আমি এসে থাকব কিছুদিন, কিন্তু এখন নয়। তুই সুতোরন্তুকে আসতে দে, আমি একাই ম্যানেজ করব। ভালো করে চা-নাস্তা খাইয়ে দেব।
ইকবাল-আনিস থমথমে গলায় বলল, এটা ঠাট্টার জিনিস না। তোকে আমার কথা শুনতে হবে। তোকে এখন থেকে আমার সাথে থাকতে হবে।
সম্ভব না। আমার অনেক কাজ।
আনিস অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলল, তোর এখন আমার কথা শুনতেই হবে। যা যা বলি শোন। তোর কিংবা অন্য কোনো একজন মানুষের জীবন নির্ভর করছে এর ওপর।
আনিস যা বলল তার সারমর্ম এই : পৃথিবীতে যে রকম মানুষ এবং নানারকম জীবজন্তু রয়েছে, তেমনি পরকালের জগতেও মানুষের সমজাতীয় প্রাণী এবং জন্তু-জানোয়ারের সমজাতীয় বিদেহী শক্তি রয়েছে। তান্ত্রিক সাধু বা নানা রকমের সাধকেরা। সাধনা করে পরজগতের এইসব প্রাণীর সাথে যোগাযোগ করেন। সেইসব প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা বেশি হলে তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখা যায়। নিচুজাতীয় প্রাণী হলে তাদের জোর করে বশে রাখতে হয়। সুতোরন্তু নীচজাতীয় একটা ভয়ংকর প্রাণী। তাকে জোর করে বশ করে রাখা হয়েছে। সাধকেরা শক্তি পরীক্ষা করার জন্যে এদের বশ করে রাখেন। সুতোরন্তু নামের বিদেহী যুক্তিতর্কহীন এই প্রাণীটি অত্যন্ত শক্তিশালী, তাকে ভুল করে আহ্বান করা হলে তাকে আসতে হয়-তাকে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে সে একটা বিভীষিকার সৃষ্টি করে যায়। যে তান্ত্রিক মারা গিয়েছে সে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, আর কেউ পারবে সেরকম কোনো নিশ্চয়তা নেই।
আনিস অত্যন্ত জোর দিয়ে কথাগুলি বলেছিল বলে চুপ করে আমি শুনে গেলাম। কিন্তু তার কথা আমার ঠিক বিশ্বাস হলো না। কথা শেষ হলে বললাম, ধরা যাক তোর সব কথা সত্যি। তোর সুতোরন্তু ভয়ংকর শক্তিশালী একটা বিদেহী প্রাণী। কিন্তু সে মানুষের জগতে বাস করে না, কাজেই মানুষের জগতে সে কিছুই করতে পারবে না।
আনিস মাথা নেড়ে বলল, তোর কথা খানিকটা সত্যি, কিন্তু পুরোপুরি সত্যি নয়। সাধক মানুষেরা যে রকম তাদের জগতে যোগাযোগ করতে পারে, এরাও খানিকটা পারে। এদের যোগাযোগটা হয় ভয়ংকর। মানুষ ভয় পেয়ে যায়। ভয় পেয়ে গেলেই ওরা পুরোপুরি সর্বনাশ করতে পারে।
আমি বললাম, আমি ভয় পাই না। ভূত-প্রেতে আমার বিশ্বাস নেই, তাই ভয়ও নেই। বাজি ধরে আমি লাশকাটা ঘরের টেবিলে বিছানা করে ঘুমিয়েছি।
আনিস খানিকক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, সত্যিই যদি তুই ভয় না পাস, তোকে সুতোরন্তু কিছু করতে পারবে না। মানুষ থেকে শক্তিশালী কোনো প্রাণী নেই। তবু তোকে দুটি কাজ করতে হবে।
কী?
প্রথমত, তোর সাথে একটা জীবিত প্রাণী রাখবি।
কেন?
এরা যখন আসে সব সময়ে কোনো একটা কিছুর প্রাণ নিয়ে যায়। চেষ্টা করে মানুষের নিতে, না পারলে অন্য কিছুর। ঘরে খাঁচায় একটা পাখি রাখা সবচেয়ে সহজ।
আমি ঠাট্টা করে বললাম, আমার ঘরে অনেক মশা আছে। দেয়ালে টিকটিকি–
আনিস হাসার ভঙ্গি করে বলল, সুতোরন্তু যখন এসে হাজির হবে তুই বেশ অবাক হয়ে লক্ষ করবি আশেপাশে কোনো প্রাণী থাকবে না। কীটপতঙ্গ, পশুপাখি কোনো কোনো ব্যাপারে মানুষ থেকে অনেক বেশি বুঝতে পারে। আর দ্বিতীয় জিনিস যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে–
কী?
হাত বাড়িয়ে দে।
আমি ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে দিলাম। আনিস একটা ছোট শিশি থেকে কী যেন একটা তরল পদার্থ নিয়ে হাতের পিঠে লম্বা কী একটা দাগ দিয়ে দিল।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, এটা কী?
একটা কেমিক্যাল। তোর হাতের উলটো পিঠে একটা চিহ্ন এঁকে দিলাম। কাল, পরশু এটা স্পষ্ট হবে। উল্কির মতো-তবে ভয় নেই, সারাজীবন থাকবে না। মাসখানেকের মধ্যেই মুছে যাবে।
কী হবে এটা দিয়ে?
যদি কখনো কিছু দেখে খুব ভয় পাস, এই চিহ্নটা বুকের কাছে ধরবি, দেখিস, ভয় চলে যাবে। একটা শক্তি পাবি।
আমি তাবিজ-কবজ বিশ্বাস করি না।
না করিস তো ভালো, সেইজন্যে চামড়ার ওপর পাকাপাকিভাবে করে দিলাম। আজকাল হাত একটু জ্বালা করতে পারে, ইনফেকশন হবার কথা নয়। যদি হয় অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে নিবি।
আমি ওঠার সময় বললাম, দ্যাখ আনিস, ভূত-প্রেত আছে কি নেই সেটা নিয়ে আমি তোর সাথে তর্ক করতে চাই না। থাকলে থাকুক, আমি তাদের ছাড়াই জীবন কাটিয়ে এসেছি, বাকিটাও তাদের ছাড়াই কাটিয়ে দেব।
আনিস বলল, চমৎকার। এই হচ্ছে বাপের ব্যাটা!
রিকশা করে বাসায় আসার সময় আমি পুরো ব্যাপারটা ভেবে দেখলাম। ভয়াবহ সুতোরন্তু এসে আমাকে সত্যি খুন করে রেখে। যাবে কি না সে নিয়ে আমার ভিতরে।
বিন্দুমাত্র দুশ্চিতা নেই। যে জিনিসটা আমাকে অবাক করেছে, সেটা হচ্ছে তামার মাদুলিটা, সেটার হঠাৎ করে গরম হয়ে যাওয়াটা। এটা কীভাবে ব্যাখ্যা করি। আনিস হয়তো আমাকে সম্মোহন করেছে। তাহলে গরম লাগাটা আমি ব্যাখ্যা করতে পারি, কিন্তু হাতের তালুতে পোড়া দাগটা? সম্মোহন করে মানুষের হাতের তালুতে গরম অনুভূতি দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু পোড়াবে কেমন করে?
ব্যাপারটা আমি ভুলেই যেতাম, কিন্তু ভুলতে পারলাম না হাতের উলটো পিঠে আনিসের এঁকে-দেওয়া চিহ্নটির জন্যে। চিহ্নটি আস্তে আস্তে ফুটে উঠল। যখনই হাত দিয়ে কিছু করি, সেটা ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। পরিচিত বন্ধুবান্ধবও বেশ অবাক হলো এ বয়সে হাতের পিঠে ছবি এঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছি দেখে। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলাও সহজ নয়।
এভাবে সপ্তাহ দুয়েক কেটে গেছে। সম্ভবত সুতোরন্তু এসে ঘুরে গেছে, আমি টের পাই নি। হাতের চিহ্নটিও আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি আনিসকে বেশ জোর গলাতেই বলেছিলাম যে ভূত-প্রেত আমি বিশ্বাস করি না, তবু কয়দিন ভিতরে ভিতরে একটু সতর্কই ছিলাম। কে জানে কিছু তো আর বলা যায় না!
এর মাঝে আমার ছোট খালার বিয়ে উপলক্ষে বাসার সবাই দলবেঁধে নেত্রকোনা চলে গেল। রয়ে গেলাম আমি এবং জিতু মিয়া। জিতু মিয়া কাজের ছেলেটি, বয়স দশের কাছাকাছি। মহাধুরন্ধর ব্যক্তি, সুযোগ পেলে জাতীয় পরিষদের মেম্বার হয়ে যাবে সেটা আমি লিখে দিতে পারি। সেদিন সন্ধ্যেবেলা বাসায় ফিরতেই জিতু মিয়া একগাল হেসে বলল, বাই, আফনে লাটকের চান্দা দেন নাই মনে আছে?
বাই মানে ভাই, লাটক মানে নাটক-আমার একটু চিন্তা করে বের করতে হলো। কিছুদিন আগে গুণ্ডাধরনের কিছু ছেলে নাটক করবে বলে চাঁদা চাইতে এসেছিল। অপরিচিত ছেলে, তাই কী নাটক, কোথায় হবে, কে পরিচালনা করবে এসব নিয়ে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করছিলাম। তখন একজন গরম হয়ে গেল বলে পুরো দলটাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলাম। বাসার সবার ধারণা কাজটা সুবিবেচনার হয়নি। আমি একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন? কী হয়েছে।
আফনের গরে গিয়া দেহেন। বাংলায় অনুবাদ করলে যার অর্থ-আপনার ঘরে গিয়ে দেখেন।
আমি আমার ঘরে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ঘরের দেয়ালে মৃত প্রাণীর নাড়িভুঁড়ি ছুঁড়ে ছুঁড়ে মেরেছে। কিন্তু এখনও দেয়ালে লেগে আছে, কিছু দেয়াল থেকে খুলে নিচে পড়েছে। দেয়ালে বীভৎস রং, ঘরের ভিতরে উৎকট দুর্গন্ধ।
আমি রাগে প্রায় অন্ধ হয়ে গেলাম। হাতের কাছে জিতুকে পেয়ে তাকেই দু-এক ঘা লাগানোর জন্যে হুঙ্কার দিয়ে বললাম, জানালা খুলে রেখেছিলি কেন?
খুলি নাই বাই। খোদার কসম।
তাহলে?
জানালা বন্ধ থাকা অবস্থায় কেমন করে দেয়ালে এগুলি ছুঁড়ে মারা যায় সেটা নিয়ে জিতু মিয়াকে ভাবিত দেখা গেল না। খাঁটি রাজনীতিবিদদের মতো সে সমস্যার সামনাসামনি এলে মস্তিষ্ক সুইচ টিপে বন্ধ করে দেয়।
একজন লোক ডাকিয়ে সময় লাগিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করা হলো। আজকালকার ছেলেরা এরকম নোংরা কাজ করতে পারে, নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না।
রাতে খেতে বসার পর জিতু মিয়া আমাকে দ্বিতীয় খবরটি দিল। বলল, আম্মার মশা মারণের ওষুধ একেবারে ফাস কেলাশ।
মা মশা মারার ওষুধ কিনেছেন সেটা মশাদের বিরুদ্ধে খুব কার্যকর শুনে আমি শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। যেটা মশার জন্যে বিষাক্ত সেটা মানুষের জন্যেও বিষাক্ত। বিদেশে যেসব কীটনাশক ওষুধ বাজেয়াপ্ত করে দেওয়া হয়েছে, সেগুলি রুটিনমাফিক এ দেশে পাঠানো হয়। আমি জিতু মিয়াকে বললাম, নিয়ে আয় তো মশা মারার ওষুধটা! সাবধানে ধরবি।
জিতু মিয়া স্টোররুম থেকে ফিনাইলের একটা কৌটা নিয়ে এলো। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা মশা মারার ওষুধ?
জে।
এটা দিয়ে মশা মারা হচ্ছে?
জে। বাসায় কুনো মশা নাই।
কোনো মশা নেই?
না বাই।
আমার বুকটা হঠাৎ ধক করে উঠল। আনিস বলেছিল, সুতোরন্তু যখন আসবে তখন বাসায় কোনো কীটপতঙ্গ, পশুপাখি থাকবে না।
আমি দেয়ালের দিকে তাকালাম। লাইটের কাছে একটা পুরুষ্ট টিকটিকি পোকা ধরে খায়। আজ পোকাও নেই, কোনো টিকটিকিও নেই। আলমারির কোনায় মাকড়সার জালে কিছু নিরীহ মাকড়সা থাকে, সেখানেও কিছু নেই। আমি জিতুকে বললাম, জিতু, স্টোররুমে কি তেলাপোকা আছে?
তেউল্যাচুরা?
হ্যাঁ।
আছে বাই। ক্যান?
একটা ধরে আনতে পারবি?
মনের মতো একটা কাজ পেয়ে জিতু মিয়ার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কী বলেন বাই! পারুম না ক্যান!
জ্যান্ত ধরে আনতে হবে কিন্তু।
দীর্ঘ সময় জিতু মিয়া স্টোররুমের জিনিসপত্র টানাটানি করে মুখ কালো করে ফিরে এলো। অবিশ্বাস্য ব্যাপার, স্টোররুম আঁতিপাতি করে খুঁজেও সে কোনো তেলাপোকা পায়নি!
আমিও ঘরের আনাচে-কানাচে খুঁজে দেখিছি কোনো ধরনের পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ কিছু নেই। সব যেন ম্যাজিকের মতো উবে গেছে। তবে কি আনিসের কথাই সত্যি?
সুতোরন্তু আসছে আজ রাতে? একটা প্রাণ নিয়ে যাবে? কার প্রাণ? আমার? জিতুর?
আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল হঠাৎ।
রাত এগারোটায় আমি নিজের ঘরে ফিরে এলাম। ঘরে ঢুকেই আমি চমকে উঠি। দেয়ালে ছোপ-ছোপ রক্ত। কোথা থেকে এলো? সারা ঘরে বাসি রক্তের একটা বোটকা গন্ধ। শুধু তা-ই নয়, ঘরের ভিতরটা কেমন যেন ঠাণ্ডা, শরীর শিউরে শিউরে ওঠে। আমি ঘরের মাঝখানে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘরের লাইটটি বারবার নিবুনিবু হয়ে আসছে। ঝড়ের রাতে যখন ইলেকট্রিসিটি চলে যায়-যায় করে ফিরে আসে, তখন এরকম হয়। কিন্তু আজ পরিষ্কার আকাশ। যদি ইলেকট্রিসিটি সত্যি চলে যায়, তখন কী হবে? বাসায় কোথায় যেন একটা টর্চলাইট আছে সেটা এখন নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ বাসায় কোনো জিনিসপত্র ঠিক জায়গায় রাখা হয় না, দরকারের সময় জিনিস খুঁজে পাওয়ার ঘটনা এ বাসাতে এখনও ঘটেনি। সিগারেট খাই বলে পকেটে ম্যাচ থাকে। এখন সেটাই একমাত্র ভরসা।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই আমি হঠাৎ শুনলাম শোঁ শোঁ করে বাতাসের শব্দ হলো, তারপর হঠাৎ সব জানালা দড়াম করে খুলে আবার বন্ধ হয়ে গেল। ভয়ানক চমকে উঠলাম আমি, আর জীবনে প্রথমবার ভয় পেলাম। মনে হলো আমার পেছনে ভয়াবহ কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে, এক্ষুনি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার কণ্ঠনালি ছিঁড়ে নেবে।
তাহলে সত্যিই সুতোরন্তু আসছে?
আমি বসার ঘরে এসে দেখি সেখানে জিতু মিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি কেমন জানি বিভ্রান্ত। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে জিতু?
বাই, বাসাডা কাফে ক্যান?
কাঁপে?
জে বাই, কাফে। আমার কেমুন জানি ভর করে বাই।
তাহলে আমি একা নই, জিতুও ব্যাপারটা টের পেয়েছে। কিছু একটা হচ্ছে এ বাসায়। আনিসের কথা মনে পড়ল, সুতোরন্তু এসে একটা প্রাণ নিয়ে যাবে। সত্যি?
আমি পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা দশ টাকার নোট জিতুর হাতে ধরিয়ে বললাম, টাকাটা সাথে রাখ। আজ রাতে তুই বাসায় আসবি না।
জিতু অবাক হয়ে বলল, কই যামু তাইলে?
জানি না, যেখানে ইচ্ছা, কিন্তু এই বাসায় না। যা, বের হ। এক্ষুনি বের হ। মনে রাখিস কাল সকালের আগে বাসায় ঢুকবি না।
জিতু অবাক হয়ে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছু না বলে বের হয়ে গেল
আমি দরজা বন্ধ করে ফিরে এসে দেখলাম খাবারের টেবিলের ওপর একটা কাক মরে পড়ে আছে। আমার হঠাৎ গা গুলিয়ে বমি এসে গেল। আমি আস্তে আস্তে অনেকটা নিজের মনেই বললাম, ঠিক আছে সুতোরন্তু, তুমি এসো। দেখি তুমি কী করতে চাও।
স্টোররুমে একটা শাবল থাকে, সেটা খুঁজে বের করে আনলাম। অশরীরী প্রাণীর সাথে এটা কী কাজে লাগবে জানি না, কিন্তু একেবারে খালি হাতে কীভাবে কারও সাথে মুখোমুখি হই? বাসার আলো নিবুনিবু করছে, টর্চলাইটটা পেলে ভালো হতো, কিন্তু খুঁজে পেলাম না। ড্রয়ারে একটা বড় মোমবাতি পাওয়া গেল, পকেটে দেশলাই রয়েছে, সেটাই ভরসা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় বারোটা, এই কালরাত কি কখনো শেষ হবে?
আমি বসার ঘরে দেয়ালঘেঁষে একটা চেয়ার নিয়ে এসে বসে একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেটে দুটো টান দিয়ে স্নায়ু একটু শীতল হলো। কী আশ্চর্য! এই বিংশ শতাব্দীতে বসে আমাকে সত্যিই অপদেবতা দেখতে হবে?
সিগারেট খেতে খেতে একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম। হঠাৎ একটা বিচিত্র জিনিস ঘটতে শুরু করল। সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আবছা আবছা একটা প্রাণীর রূপ নিতে শুরু করে। সত্যি দেখছি, না চোখের ভুল? আমি ফুঁ দিতেই প্রাণীটা মিলিয়ে গেল, কিন্তু সাথে সাথে ঝনঝন শব্দ করে দেয়াল থেকে ফ্রেমে ঝোলানো একটা জলরঙের ছবি খুলে পড়ল, কাঁচ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে। আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম, অবিশ্বাস্য ব্যাপার, হঠাৎ মনে হতে লাগল আমি ছাড়াও ঘরে আরও কেউ আছে! ভয়ানক কিছু একটা আছে।
চণ্ড আতঙ্কে আমার চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পেয়ে গেছে, অনেক কষ্ট করে আমি নিজেকে শান্ত করে রাখলাম, দেখা যাক কী হয়। আমি চেয়ারে শান্ত হয়ে বসে আস্তে আস্তে কিন্তু জোর দিয়ে বললাম, সুতোরন্তু, তুমি যাও। তুমি চলে যাও।
নিজের কাছে নিজের কণ্ঠস্বরটি শোনাল ভারি অদ্ভুত। তার সাথে সাথে সারা বাসা যেন থরথর করে কেঁপে উঠল। টেবিলে পেয়ালা-পিরিচ, টেবিলল্যাম্প, ঘরের শেকল ঝনঝন শব্দ করে কেঁপে উঠল, আমি দেখলাম লাইটটা ডান থেকে বামে ঝুলতে শুরু করেছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সেটা শব্দ করে ফেটে গেল, সাথে সাথে সারা বাসা অন্ধকার হয়ে গেল। ফিউজ কেটে গেছে নিশ্চয়ই।
হা হা হা শব্দ করে সারা ঘরে কী যেন একটা ছুটে গেল, একটা গরম বাতাসের হালকা টের পেলাম আমি। পকেট থেকে দেশলাই বের করে একটা কাঠি জ্বালালাম কঁপা হাতে, ঘরের অন্ধকার দূর না হয়ে যেন আরও বেড়ে গেল। আমি আবছা দেখতে পেলাম ঘরের এক কোনায় মেঝেতে গুঁড়ি মেরে কী যেন বসে আছে। মনে হলো তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, ঝাঁপিয়ে কি পড়বে আমার ওপর? আমি সাবধানে মোমবাতিটা জ্বালালাম, দপদপ করে শিখা কাঁপতে লাগল, মনে হতে লাগল নিভে যাবে যে কোনো মুহূর্তে। আমি মোমবাতিটা শক্ত করে ধরে রেখে ঘরের কোনায় তাকালাম সত্যি কি কিছু আছে? কিছু দেখা গেল না।
ঠকঠক করে দরজায় শব্দ হলো হঠাৎ। আমি চমকে উঠলাম, পর মুহূর্তে শুনলাম জিতুর গলার স্বর। ভেউভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, বাই বাই গো, ও বাই
আমি ভয় পেয়ে দরজা খুলতে খুলতে বললাম, কী হয়েছে জিতু?
আমার ট্যাহা–
দরজা খুলতেই জিতু হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে বলল, আমার ট্যাহা দেয় না–
হঠাৎ করে জিতু চুপ করে গেল। আমি ভয় পেয়ে ডাকলাম, জিতু–
জিতু কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকাল। মোমবাতির আলোতে হঠাৎ বিচিত্র দেখাল জিতুকে। চোখ দুটিতে আতঙ্ক, রক্তহীন মুখে যেন প্রাণের চিহ্ন নেই। আমি বললাম, কী হয়েছে জিতু? কী হয়েছে?
জিতু উদ্ভান্তের মতো একবার চারদিকে তাকাল। কী একটা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছু বলতে পারল না। তার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমার বুকটা ধক করে উঠল। মোমবাতির শিখাটা দপদপ করে হঠাৎ নিভে গেল আর আমি শুনলাম একটা প্রাণফাটানো আর্তচিৎকার।
আমি শক্ত করে জিতুকে আঁকড়ে ধরি, জিতু থরথর করে কাঁপছে, তাকে ধরে রাখা যাচ্ছে না।
জিতু-আমি চিৎকার করে ডাকলাম, জিতু-কী হয়েছে তোর?
জিতু কোনো উত্তর দেয় না। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো শব্দ করতে থাকে। মনে হয় যেন সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।
আমার হঠাৎ আনিসের কথা মনে পড়ল। বলেছিল সুতোরস্তু একজনের প্রাণ নিয়ে যাবে। তাহলে জিতুই কি সেই একজন?
ঠিক তখন আমার মনে পড়ল আমার হাতের চিহ্নটার কথা। আনিস বলেছিল হাতটা বুকের কাছে ধরে রাখতে, ভয় চলে যাবে তাহলে। আমি জিতুকে শক্ত করে চেপে ধরে হাতটা জিতুর বুকের ওপর চেপে ধরলাম, ফিসফিস করে জিতুর কানের কাছে বললাম, জিতু, কোনো ভয় নেই
বলার সাথে সাথে সত্যি সত্যি আমার ভিতর কেমন জানি সাহস ফিরে এলো। সত্যি মনে হতে থাকল কোনো ভয় নেই। জিতুকে আঁকড়ে ধরে আবার বললাম, আমি আছি-কোনো ভয় নেই তোর।
ঘরের ভেতর গরম বাতাসের একটা হালকা খেলে গেল একবার। দরজা-জানালা সব খুলে গেল, তারপর হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল।
আমি চিৎকার করে বললাম, থামো।
ঝনঝন করে কী একটা যেন ভেঙে পড়ল।
আমি নিঃশ্বাস নিয়ে আবার চিৎকার করে বললাম, দূর হয়ে যাও এক্ষুনি।
কী একটা যেন আছড়ে পড়ল ঘরের মাঝে।
জমাটবাঁধা একটা অন্ধকার হঠাৎ যেন ছুটে আসতে শুরু করে আমার দিকে। আমি জিতুকে শক্ত করে ধরে রেখে বললাম, খবরদার
আর কী আশ্চর্য-সেটা যেন থেমে গেল।
আশ্চর্য একটা শক্তি অনুভব করলাম আমি নিজের ভিতরে। প্রথমবার আমার মনে হলো এই অশরীরী শক্তি আমাকে কিছু করতে পারবে না। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম, যাও তুমি। দূর হয়ে যাও–
হঠাৎ করে মনে হলো কিন্তু সত্যিই চলে গেছে, কোনো ভয় নেই আর।
আমি তবু চুপচাপ বসে রইলাম। ঘরে আর কোনো শব্দ নেই, সুমসাম নীরবতা।
জিতু আস্তে আস্তে বলল, বাই ডর করে।
আমি জিতুকে শক্ত করে ধরে রেখে বললাম, ভয় কী জিতু? আমি আছি না?
জিতু হঠাৎ ফাঁচফ্যাচ করে কাঁদতে শুরু করল। আমি তাকে কাঁদতে দিলাম–বেচারা বড় ভয় পেয়েছে।
হঠাৎ শুনি কানের ভিতর একটা মশা গুনগুন করছে। খোলা জানালা দিয়ে মশা ঢুকেছে ভিতরে। মশার শব্দে আমি জীবনে আর কখনো এত আনন্দ পাই নি। জিতুকে নামিয়ে বললাম, আর কোনো ভয় নেই জিতু। আয় বাতি জ্বালাই এবার।
আনিস সব শুনে বলল, তোকে বলেছিলাম মনে আছে, মানুষের চেয়ে শক্তিশালী কিছু নেই? দেখলি তো?
আমি বললাম, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তোর এই চিহ্নটার কথা মনে পড়লে কী হতো কে জানে! যেই বুকের কাছে ধরলাম সাথে সাথে–
আনিস হঠাৎ হো হো করে হাসতে শুরু করে। আমি থতমত থেয়ে বললাম, কী হলো, হাসছিস কেন?
এই চিহ্নটার অলৌকিক শক্তির কথা শুনে।
কেন?
তুই কি ভেবেছিস এটা কোনো জাদুমন্ত্র?
তাহলে কী?
এখানে লেখা স্বরে অ-স্বরবর্ণের প্রথম অক্ষর। উলটো করে লিখেছি, তাই ধরতে পারিস নি।
আমি অবাক হয়ে আমার হাতের দিকে তাকালাম। সত্যিই তাই, একে উলটো করে লিখেছে, তার ওপর মাত্রা দেয় নি, সেজন্যে ধরতে পারি নি। বোকার মতো আনিসের দিকে তাকালাম আমি।
আনিস বলল, মানুষের জোর নিজের ভিতরে। বিশ্বাসটা সেই জোরকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আমি ওটা লিখে দিয়েছিলাম যদি ওটাকে বিশ্বাস করে আরও খানিকটা জোর পাস সেজন্যে। আর কিছু না।
আমি মুখ হাঁ করে বসে রইলাম।