নেকড়ে
জমাট আড্ডা হচ্ছিল বসার ঘরে। গোড়াতে বিষয়বস্তু ছিল রাজনীতি, কিছুক্ষণেই সেটা স্বাভাবিক গতিতে অসৎ ব্যক্তি এবং খুনখারাবিতে চলে এসেছে। খানিকক্ষণ সেটাতে স্থির থেকে আলোচনার বিষয়বস্তু হঠাৎ মৃত্যু এবং মৃত্যুর পর কী হয় তাতে চলে এলো। এটি একটি জনপ্রিয় বিষয়বস্তু, দেখা গেল সবারই কিছু-না-কিছু বলার আছে। কাদের যে ভাঙা জাহাজের ব্যবসা। করে প্রচুর পয়সা কামিয়েছে, বলল, মরে গেলে শেষ, আবার কী?
লুৎফুর ফিলসফিতে এমএ করেছে। সে গম্ভীর গলায় বলল, শেষ কথাটির মানে কী? আপনার কাছে যেটা শেষ, আরেকজনের কাছে সেটা শুরু হতে পারে।
আরিফ কট্টর ইঞ্জিনিয়ার। সে বলল, শরীরটা হচ্ছে কম্পিউটারের মতো, মরে যাওয়া মানে হচ্ছে অপারেটিং সিস্টেম ক্র্যাশ করে যাওয়া।
কম্পিউটার সবাই বোঝে না, তাই ব্যাপারটি ঠিক অনুভব করা গেল না। নজীবুল্লাহ এখনও প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজে যায়, সে গলা উঁচিয়ে বলল, মানুষের শরীর আর আত্মা এক জিনিস নয়, মরে যাওয়া মানে শরীর ধ্বংস হয়ে যাওয়া, আত্মার ধ্বংস নেই। কোরান শরিফে আছে-পদার্থবিজ্ঞানের লেকচারার কায়েস বাধা দিয়ে বলল, প্রমাণ করতে পারবেন? একটা আত্মাকে বোতলে ভরে এনে দিতে পারবেন? হাই ভোল্টেজ দিয়ে ডিসচার্জ করে স্পেক্ট্রামটা দেখতাম।
উত্তরে নজীবুল্লাহ কী একটা বলতে যাচ্ছিল, সরকারি চাকুরে শওকত সাহেব বাধা দিয়ে বললেন, আমার মনে হয় মরে যাওয়াটা একটা ঘুমের মতো। ঘুমালে যেরকম কিছু আপনি জানেন না সেরকম–
নজীবুল্লাহ উচ্চস্বরে বলল, তার মানে আপনি বলতে চান পরকাল বলে কিছু নেই? নাহ্।
সাথে সাথে ঘরে তুমুল হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। পরকাল আছে, পরকাল নেই এবং থাকলেই-বা কী আর না থাকলেই-বা-কী–ঘরের সব মানুষ এই তিন দলে ভাগ হয়ে গেল। তিন দলের তুমুল বাগ্বিতণ্ডায় ঘরে থাকা মুশকিল হয়ে যাবার অবস্থা।
ঘরের কোনার দিকে বসেছিলেন কামাল সাহেব, নতুন এসেছেন, এখনও সবার সাথে ভালো করে পরিচয় হয় নি। ভদ্রলোক কথা কম বলেন তাই মনে হতে পারে যে অহংকারী, কিন্তু সেটা সত্যি নয়। আমি লক্ষ করলাম পরকাল নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা শুরু হওয়ামাত্রই তিনি খুব তীক্ষ্ণ চোখে সবাইকে লক্ষ করতে শুরু করেছেন। কারও কারও কোনো কথা শুনে তার মুখে সূক্ষ্ম হাসি খেলে যতে থাকে, অবুঝ শিশুদের কথা শুনে বড়রা যেরকম হাসে, অনেকটা সেরকম। কট্টর পদার্থবিজ্ঞানী কায়েস যখন অলৌকিক বিষয়ের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বসল, তখন দেখলাম, তিনি কী-একটা কথা বলতে গিয়ে চেপে গেলেন। শুধু চেপে গেলেন তা-ই নয়, মুখে একটা বিদ্রুপের হাসিকে সাবধানে গোপন করে শেলফ থেকে একটা বই নিয়ে ঘরের কোনায় সরে গেলেন।
আমার একটু কৌতূহল হলো, তাই উত্তপ্ত আলোচনায় একটু ভাটা পড়তেই গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, কামাল সাহেব!
কী হলো?
পরকাল নিয়ে আপনার কী ধারণা?
তিনি একটু হেসে বললেন, কখনো ভেবে দেখি নি। তবে—
তবে কী?
আমার মনে হয় অলৌকিক জিনিসপত্র সত্যি রয়েছে পৃথিবীতে।
বেশ কয়েকজন ঘুরে তাকাল তার দিকে। আবিদ বলল, আপনার এরকম ভাবার কারণ কী? দেখেছেন নাকি কখনো কিছু?
কামাল সাহেব এক মুহূর্ত ভেবে বললেন, দেখেছি।
দেখেছেন! এবারে সবাই ঘুরে তাকাল তার দিকে।
কী দেখেছেন?
কামাল সাহেব একটু দ্বিধা করে বললেন, কী দেখেছি সেটা আমি নিজেও এখনও ঠিক জানি না। তবে–
তবে কী?
তবে আমি আমার জীবনে খুব একটা অস্বাভাবিক জিনিস দেখেছি।
বলুন দেখি-শুনি কী দেখেছেন।
অনেক লম্বা গল্প সেটি, গুছিয়ে বলা মুশকিল। সত্যি শুনতে চান?
হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনি।
সবাই এবারে একটু এগিয়ে আসে।
কামাল সাহেব মাথা চুলকে বললেন, আমি আবার গুছিয়ে বলতে পারি না, আগেরটা পরে, পরেরটা আগে বলে ফেলি, কিছু বলতে গেলে যেটা বলার দরকার নেই সেটা বলে সময় নষ্ট করতে থাকি।
কিছু ক্ষতি নেই, আমি সাহস দিয়ে বলি, গল্প ভালো হয়, কীভাবে বলা হলো তাতে কিছু আসে-যায় না।
তা ঠিক, তবে মুশকিল হলো গল্পটা ভালো কি না সেটাও আমি জানি না। শুনুন তাহলে
আমি তখন নতুন আমেরিকায় গেছি। সে দেশের হালচাল ভালো জানি না। নেহাতই গোবেচারা ছাত্র, পড়াশোনা করতে করতে দম ফেলার অবসর নেই। কনডেন্স কোর্সে পরীক্ষা পাস করে গেছি, আমেরিকাতে এসে একেবারে অতল পানিতে ডুবে যাবার অবস্থা।
আমাদের ইউনিভার্সিটির কয়েকজন বাঙালি ছেলে ছিল, তার মাঝে একজন মহাচালবাজ, তার নাম ফরিদ। আমি নতুন এসেছি, তাই তখনও টের পাই নি। সে আমাকে মাঝে মাঝে নানারকম জ্ঞান-বুদ্ধি দেয়। গোবেচারা বাঙালি আমি, সে যেটাই বলে আমি সরলমনে বিশ্বাস করি। অনেক গল্প আছে তার, কিন্তু এখন সেটা থাক।
সেই ফরিদ একদিন আমাকে এসে জিজ্ঞেস করল, এই শনি-রবিবারে কী করছ কামাল?
আমি বললাম, হোমওয়ার্ক আছে দুটা, শেষ করতে হবে। বাসায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল চিঠি লেখা হয় নি, মা হয়তো দুশ্চিন্তা করছেন।
এইজন্যে বাঙালির উন্নতি হয় না, ফরিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এত বড় হয়েছ এখনও মায়ের আঁচল ধরে ঘোরাঘুরি? জানো, আমি ছয় মাস দেশে কোনো চিঠি লিখি নি!
আপনার মা চিন্তা করেন না?
করলে করবে, আমার কী? আমেরিকানরা কী করে জানো? বয়স ষোলো হতেই ঘর থেকে গেট আউট। এই জাতির উন্নতি হবে না তো কার হবে?
বাসা থেকে গেট আউটের সাথে জাতির উন্নতির সম্পর্কটা চট করে ধরা মুশকিল, আমি সে চেষ্টা না করে বললাম, কিন্তু হোমওয়ার্ক দুটা?
আরে ধুত্তুরি তোমার হোমওয়ার্ক! ফরিদ ধমক দিয়ে বলল, একটা-দুটা হোমওয়ার্ক দেরি করে দিলে কিছু হয় না। চলো এই শনি-রবিবারে ক্যাম্পিং করে আসি।
আমেরিকা এসে কোথাও বের হই নি, পড়াশোনার চাপে একেবারে শেষ হয়ে যাবার অবস্থা। ফরিদের কথা শুনে কেমন জানি নরম হয়ে গেলাম, দুদিনের জন্যে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে ক্যাম্পিং করতে যাব, ভেবেই কেমন জানি জিবে পানি এসে গেল।
ফরিদ আমাকে কী কী নিতে হবে তার একটা লম্বা লিস্ট দিয়ে গেল। সেখানে নেই এমন জিনিস নেই, আমি তবু কষ্ট করে অনেক লোকজনকে ধরাধরি করে জিনিসপত্র জোগাড় করে শুক্রবার রাতে সকাল-সকাল শুতে গেলাম। শনিবার খুব ভোরে আমাকে ফরিদের এসে তুলে নেবার কথা, কিন্তু আমাকে ঘুম থেকে তুলল মুশকো জোয়ান এক আমেরিকান ছেলে। এ দেশের লোকের কথা তখনও ভালো করে বুঝতে পারি না, ভাসাভাসাভাবে বুঝলাম ফরিদ তাকে পাঠিয়েছে আমাকে তুলে নেবার জন্যে। আমি ভেবেছিলাম শুধু ফরিদ আর আমিই যাব, বিদেশি লোকজন থাকলে আমি কি আর যাই? যাই হোক, তখন কিছু করার নেই, আমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বের হলাম। ঢাউস একটা গাড়ি হাঁকিয়ে সে সাথে সাথে রওনা দিয়ে দিল। ফরিদকে তার বাসা থেকে না তুলেই যখন সে হাইওয়েতে উঠে গেল, আমি একটু অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ফরিদকে তুলবে না?
সে আরও অবাক হয়ে বলল, ফরিদ? সেটা কে?
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। তোতলাতে তোতলাতে কোনোমতে বললাম, আমি যে যাব তুমি কেমন করে জানলে?
ছেলেটি কাঁধ-ঝাঁকিয়ে বলল, আমি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পিংয়ের দায়িত্বে আছি, লোকজনকে খোঁজখবর দিই। গত সপ্তাহে একজন ফোন করে বলল, তুমি নাকি খুব ক্যাম্পিংয়ে যেতে চাও, তোমাকে যেন কেউ একজন নিয়ে যায়। এ সপ্তাহে আমি যাচ্ছিলাম, তাই তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।
আমার তখনও বিশ্বাস হয় না, চিঁচিঁ করে বললাম, ফরিদকে তুমি চেনোই না?
ছেলেটি মাথা নেড়ে বলল, নাহ্। কখনো নামও শুনি নি।
আমি চোখে আঁধার দেখলাম। পড়াশোনা ছেড়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত মুশকো একজন আমেরিকানের সাথে দুদিনের জন্যে গভীর জঙ্গলে পাঠিয়ে দেওয়ার মতো রসিকতা যে ফরিদ ছাড়া আর কেউ করতে পারে না সেটা আমি তখনও জানি না। এখানকার খবরের কাগজে কতরকম খুনখারাবির কথা পড়ি, এই লোক যদি আমাকে খুন করে জঙ্গলে পুঁতে ফেলে, কেউ তা জানতেও পারবে না।
ছেলেটি কিছু একটা আঁচ করতে পারল, বলল, তুমি যদি তোমার বন্ধুকে ছাড়া একা একা যেতে না চাও আমাকে বলো, তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়ে দিই। আমি প্রায়ই যাই ক্যাম্পিং করতে, পরেরবার তোমার বন্ধুকে নিয়ে একটা প্রোগ্রাম করা যাবে।
ছেলেটির সহৃদয় কথাটি আমায় একটু সাহস দিল, বললাম, না, চলো যাই। আমি আগে কখনো ক্যাম্পিংয়ে যাই নি, তাই আমাকে নিয়ে তোমার খুব সমস্যা হবে।
ছেলেটি একগাল হেসে বলল, কাউকে নিয়েই সমস্যা হয় না, জঙ্গলে তো আর নিয়মকানুন নেই যে তুমি ভুল করবে! তুমি ঘাবড়িও না, দেখবে খুব মজা হবে।
আমি তখন প্রথমবার নিজেকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করতে থাকি যে সত্যি খুব মজা হবে।
একটু পর সত্যি সত্যি আমার মজা লাগতে থাকে। আগে কখনো ঘর থেকে বের হই নি, যেটাই দেখি মুগ্ধ হয়ে যাই। এই এলাকাটা ভারি সুন্দর, একই সাথে পাহাড় আর হ্রদ, তার মাঝে সবুজ ঘন অরণ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ছেলেটি, যার নাম জন ল্যামিং, একটু ভাবুক ধরনের ছেলে, খুব-একটা কথা বলে না, কিন্তু খুব সহৃদয় ধরনের মানুষ। বুঝতে পেরেছে যে আমি এ দেশে একেবারেই নতুন, কিছুই জানি না। সে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে সবকিছু বলে দিতে থাকে। দুপুরে যখন ম্যাকডোনাল্ড নামে হ্যামবার্গার খাবার জায়গায় থামলাম, সেখানেও সে আমাকে বুঝিয়ে দিল যে এটার নাম হ্যামবার্গার হলেও জিনিসটা গোরুর মাংস দিয়ে তৈরি। শুধু তা-ই নয়, আমেরিকানদের সব রীতিনীতি ভঙ্গ করে সে আমার খাবারের পয়সা দিয়ে দিল, কিছুতেই আমাকে দিতে দিল না। আমার তখন ছেলেটিকে ভালো লাগতে শুরু করেছে এবং প্রথমবার ফরিদ যে সাথে নেই সেজন্যে খুশি হয়ে উঠতে থাকি।
প্রায় সারাদিন গাড়ি চালিয়ে বিকেল তিনটার দিকে আমরা গন্তব্যস্থানে পৌঁছালাম। পাহাড়ের গাঘেঁষে ছবির মতোন একটা জায়গা। নাম ওলিমাওয়া, রেড ইন্ডিয়ানদের দেওয়া নাম। জন তার গাড়ি এক জায়গায় পার্ক করে গাড়ি থেকে নামল। সেখানে আরও কয়েকটা গাড়ি পার্ক করে রাখা আছে। অন্যান্য যারা এসেছে তারাও এখানে গাড়ি রেখে পাহাড়ের ওপর উঠে গেছে। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। জনের সাথে হাত লাগিয়ে জিনিসপত্র বের করা হলো, তার একটা ঢাউস ব্যাকপেকে জিনিসপত্র ভরে রাখা আছে। আমি এ ব্যাপারে নতুন, জিনিসপত্রের প্রায় বেসামাল অবস্থা। জন একটু ঠিকঠাক করে দিল, তারপর সময় নষ্ট না করে প্রায় সাথে সাথেই আমরা রওনা দিয়ে দিলাম। জনের কাছে ছোট একটা বই আছে, তাতে নাকি লেখা হাজার দুয়েক ফুট উঠে গেলে পাহাড়ের গাঘেঁষে একটা হ্রদ পাওয়া যাবে। ভারি চমৎকার একটা জায়গা, সেখানে তাঁবু খাটানোর ইচ্ছা।
আমি খুব শক্ত মানুষ নই, তবে ছেলেবেলায় কাদায় গড়াগড়ি করে খুব ফুটবল খেলেছি। সে কারণেই কি না জানি না বেশ খাটার ক্ষমতা আছে। প্রকাণ্ড ব্যাকপেক-বোঝাই জিনিস ঘাড়ে নিয়ে জনের পিছুপিছু পাহাড়ে উঠতে শুরু করি। ঘারে বোঝা নিয়ে যাওয়া এক কথা, কিন্তু বোঝা নিয়ে পাহাড়ে ওঠা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। যারা কোনোদিন সেটা করে নি, তারা বুঝতে পারবে না ব্যাপারটি কী অমানুষিক। জন আমার জন্যে আস্তে আস্তে হাঁটছিল, কিন্তু যত ঘনঘন থামা উচিত তত ঘনঘন থামছিল না। আমার ঘাড়ে তখন দেশের ইজ্জত-তাকে একটু পরপর বলতে পারি না যে আর পারি না, একটু থামো!
দুই হাজার ফুট ওপরে উঠতে আমার যে পরিমাণ পরিশ্রম হলো সারাজীবনে আমার কখনো তত পরিশ্রম হয় নি। শেষ পর্যন্ত যখন সেই হ্রদের তীরে এসে হাজির হলাম, মনে হলো এখন হয়তো মরেই যাব। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমার তাকানোর শক্তি হলো, দেখলাম হ্রদটা সত্যি চমৎকার, পাহাড়ের এত ওপরে যে হৃদ থাকতে পারে ধারণাই ছিল না। চারদিক পাইনগাছে ঢাকা। গাঢ় নীল রঙের পানি ঝকঝক করছে। পড়ন্ত সূর্যের আলোতে কেমন যেন একটা অশরীরী ভাব। হ্রদের তীরে ইতস্তত আরও কয়েকটা তাঁবু। জন এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, চলো, আরও একটু উপরে যাই।
আমি আঁতকে উঠে বললাম, আরও উপরে? কেন?
দেখছ না মানুষের ভিড় এখানে! উপরে নিরিবিলি হবে।
আমি বিশ্বাসই করতে পারলাম না যে ইতস্তত কয়েকটা তাঁবু দেখে জনের কাছে মনে হচ্ছে এখানে অনেক ভিড়। ক্ষীণ একটা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করবার আগেই দেখি সে তার ঢাউস ব্যাকপেক ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। আমি কী আর করি, আমার ব্যাকপেক ঘাড়ে নিয়ে পিছু পিছু রওনা দিলাম।
আরও শখানেক ফুট ওপরে উঠে জন একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বের করল। জায়গাটা দেখে আমি অবিশ্যি এই গোঁয়ারগোবিন্দ নির্জনতাপ্রিয় মানুষটিকে মাফ করে দিলাম। একটু ওপর থেকে দৃশ্যটিকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, দূরে দেখা যাচ্ছে পর্বতশ্রেণী। নীল, হালকা নীল হয়ে সেগুলি মিশে গিয়েছে দূরে। দেখে মনে হলো জন্ম বুঝি এতদিন পরে সার্থক হলো।
জনকে দেখেই বোঝা যায় সে পাহাড়ে-পাহাড়েই ঘোরাঘুরি করে সময় কাটায়। ব্যাকপেক থেকে তাঁবুটা বের করে চোখের পলকে দাঁড় করিয়ে ফেলল, গোল গম্বুজের মতো তাঁবু-সামনে ছোট দরজা, হাঁটু গেড়ে ভিতরে ঢুকতে হয়। ভিতরে আমাদের স্লিপিং ব্যাগ দুটি পেতে দেওয়া হলো। দেখে ভিতরে বেশ একটা আরামদায়ক আস্তানার মতো মনে হতে থাকে। ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই শুয়ে পড়ি, কিন্তু শোয়া গেল না। বাইরে জন খুটখাট শব্দ করে কী যেন করছে। বের হয়ে দেখি সে ছোট একটা গ্যাসোলিনের চুলায় রান্না চাপিয়েছে। রান্না অবিশ্যি সত্যিকার অর্থে রান্না নয়, বাটিতে পানি গরম করছে, সাথে স্যুপের প্যাকেট আছে। ফুটন্ত পানিতে প্যাকেট খুলে ছেড়ে দিলেই নাকি গরম স্যুপ হয়ে যাবে। আমি নতুন এসেছি, এখানকার খাবারদাবারে এখনও অভ্যস্ত হতে পারি নি, কিন্তু সারাদিন পরিশ্রমের পর ঠাণ্ডায় এই গরম স্যুপের কথা চিন্তা করেই জিবে পানি এসে গেল। আমি সাথে কিছু ফলমূল আর শুকনো খাবার এনেছি, সেগুলিও গরম করে ফেলার ব্যবস্থা করা হলো।
হ্রদের কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে আমরা আরাম করে বসি। চারদিকে এর মাঝে সুমসাম অন্ধকার, তার মাঝে হিসহিস করে গ্যাসোলিনের চুলা জ্বলছে। নীলাভ আলো অন্ধকার দূর করতে পারছে না, বরং কেমন যেন আধিভৌতিক আবহাওয়ার সৃষ্টি করে রেখেছে।
জনের সাথে আজই আমার প্রথম দেখা, কিন্তু সারাদিন একসাথে কাটিয়ে এখন রাতের বেলা এই নিরিবিলিতে তাকে বেশ কেমন যেন আপনজনের মতো মনে হতে থাকে। দুজনের জন্ম হয়েছে দুই দেশে, বড় হয়েছি দুই পরিবেশে, ভাষা দুই রকম সবকিছুই কেমন জানি হঠাৎ গুরুত্বহীন হয়ে যায়। মনে হতে থাকে দুজন দুজনকে দীর্ঘদিন থেকে চিনি। আস্তে আস্তে কথায়-কথায় নিজেদের পরিবার, ভাই-বোন, বাবা-মায়ের কথা চলে আসতে থাকে।
খাওয়ার পর জন দুই মগ কফি তৈরি করল। আমি তখনও কফি খাওয়া শিখি নি। প্রচুর দুধ এবং চিনি মিশিয়ে পায়েসের মতো করে দিলে খেতে পারি। এখানে দুধ এবং চিনি কিছুই নেই। তবু জনকে খুশি করার জন্যে সেই বিস্বাদ তেতো পোড়া গন্ধের কফি খাওয়ার চেষ্টা করতে থাকি।
গল্পে গল্পে অনেক রাত হয়ে গেল, অন্তত আমি তা-ই ভেবেছিলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি মোটে সাড়ে আটটা। বনজঙ্গলে সব সময় এরকম হয়, কিন্তু কিছু করার থাকে না বলে ঘড়ি চলতে চায় না। জন কিন্তু ঘড়ি দেখে চমকে উঠল, বলল, সর্বনাশ, সাড়ে আটটা বেজে গেছে! চলো শুয়ে পড়ি।
এখনই?
হ্যাঁ। রাতে তো কিছু করার নেই, কিন্তু সকালে উঠতে পারলে লাভ আছে। মনে কোরো না যে তুমি খুব আরামে ঘুমাবে, একটু পরপর ঘুম ভাঙবে সারারাত। ছাড়াছাড়াভাবে ঘুমাবে তুমি। ঘুম যদি নাও হয় বিশ্রাম হবে, সেটাই দরকার।
আমরা উঠতে যাব হঠাৎ করে যেন জাদুমন্ত্রের মতো চারদিক আলো হয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে বললাম, কিসের আলো?
চাঁদ।
পাহাড় এতক্ষণ চাঁদকে আড়াল করে রেখেছিল বলে দেখতে পাই নি, এখন হঠাৎ করে বের হয়ে চারদিক আলো করে দিয়েছে। প্রকৃতির এই অস্বাভাবিক সৌন্দর্য দেখে আমি কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারি না। দূরে পাহাড়ের সারি, পাইনগাছ, পাথরের ওপর দিয়ে একটা ছোট ঝরনা বয়ে যাচ্ছে-সব মিলিয়ে একেবারে অলৌকিক একটা দৃশ্য।
জন আস্তে আস্তে বলল, আমার মনে ছিল না, আজ পূর্ণিমা।
আমি বললাম, শহরে কি আর কেউ অমাবস্যা-পূর্ণিমার কথা খেয়াল রাখে!
আমি রাখি। আমি পূর্ণিমার রাতে কখনো ঘর থেকে বের হই না। যদি জানতাম পূর্ণিমা, আজ আসতাম না।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
আছে একটা ব্যাপার। জন গম্ভীর হয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মুখে কেমন যেন একটা ভয়ের ছাপ পড়ে গেছে। আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। জন খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি অলৌকিক জিনিস বিশ্বাস করো?
আমি? না।
তোমাদের দেশে তো অনেক রকম রহস্যময় ব্যাপার আছে। তবু বিশ্বাস করো না?
না। আমাদের দেশে কোনো রহস্যময় ব্যাপার নেই। অনেক কুসংস্কার আছে, কিন্তু কোনো রহস্যময় ব্যাপার নেই।
তুমি ‘ওয়ার উলফ’-এর কথা শুনেছ?
আমি একটু হেসে বললাম, হ্যাঁ শুনেছি? পূর্ণিমার রাতে কোনো কোনো মানুষ নেকড়ে বাঘ হয়ে যায়।
হ্যাঁ। মানুষ কীভাবে ‘ওয়ার উলফ’ হয়, জানো?
না।
একটা ওয়ার উলফ যদি অন্য একজন মানুষকে কামড়ায় তাহলে সেই মানুষটি ওয়ার উলফ হয়ে যায়।
মজার ব্যাপার তো! আমি ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করলাম, আছে নাকি তোমার পরিচিত কোনো ওয়ার উলফ?
জন উত্তর না দিয়ে আবার চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, কী ব্যাপার জন? তুমি মনে হচ্ছে একটু চিন্তিত?
নাহ্, চিন্তা করে আর কী হবে? একটু থেমে বলল, তোমাকে বলি তাহলে ব্যাপারটা। বছর দুয়েক আগে একবার আমি ক্যাম্পিং করতে গিয়েছিলাম। একটা ছোট পেট্রল পাম্পে পেট্রল নিচ্ছি, তখন সেখানকার লোকটা বলল, এ এলাকায় নাকি একটা ওয়ার উলফ আছে। পূর্ণিমার রাতে বের হয়, সারারাত ডাকাডাকি করে। রেঞ্জার, ফরেস্ট অফিসার অনেক রকম চেষ্টা করেও ধরতে পারেনি।
আমি ব্যাপারটাতে কোনো গুরুত্ব দিইনি। একটা নদীর ধারে ক্যাম্প করে রাত কাটাতে গিয়েছি। সেদিনও পূর্ণিমা রাত। গভীর রাতে শুনি কে যেন আমার তাঁবুর ওপর নখ নিয়ে শব্দ করছে। আমি টর্চলাইট জ্বালিয়ে ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতেই দেখি একটা ভালুক। ভালুক আমি আগে থেকেই অনেক দেখেছি, মানুষকে সাধারণত ঘাঁটায় না, আমি ভাবলাম এবারেও তা-ই হবে। কিন্তু ভালুকটা সরে না গিয়ে দাঁড়িয়ে গজরাতে লাগল। আমি ভয় দেখানোর জন্যে যেই টর্চলাইটটা হাতে নিয়ে হাত নেড়েছি, সেটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাঁবুর ওপর দিয়েই হাতে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল। আমি চিৎকার করে টর্চলাইট দিয়ে ওটার মাথায় মারতে লাগলাম, তখন হঠাৎ করে আমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেল।
হাত থেকে রক্ত পড়ছিল, কিন্তু আমি কিছু করতে পারছিলাম না। বের হয়ে সাহায্যের জন্যে যাব তার উপায় নেই, ভালুকটা সারারাত আশেপাশে নাকিসুরে কাদার মতো শব্দ করছিল। আমি কোনোমতে ফার্স্ট এইডের জিনিস দিয়ে হাত বেঁধে রক্ত বন্ধ করে বসে রইলাম। ভোররাতের দিকে হঠাৎ করে ভালুকটার সাড়াশব্দ বন্ধ হয়ে গেল, তখন বের হয়ে এসে কোনোমতে রাস্তার পাশে হাজির হলাম। খুব বাঁচা বেঁচে গেছি সেবার।
আমি প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনছিলাম, জিজ্ঞেস করলাম, সেই ভালুকটার কী হলো?
কিছু হয় নি। কেউ ধরতে পারে নি। অনেকদিন নাকি পূর্ণিমার রাতে ফিরে আসত, কিন্তু সে পর্যন্তই। অনেকে বলে সেটাই ওয়ার উলফ–
কিন্তু তুমি তো বললে ভালুক। ভালুক ওয়ার উলফ হবে। কেমন করে? উলফ মানে তো নেকড়ে–
তা আমি জানি না। যে কোনো প্রাণীই নাকি ওয়ার উলফ হতে পারে। অনেকে বলেছে, সেটা আমাকে কামড়েছে, তাই আমি নাকি হঠাৎ করে কোনো রাতে ওয়ার উলফ হয়ে যাব।
আমি শব্দ করে হাসতে গিয়ে থেমে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম, তুমি সত্যি সেটা বিশ্বাস করো?
আগে করতাম না। কিন্তু এক পূর্ণিমার রাতে বাসায় ফিরছি। ইউনিভার্সিটির মোড়ে যেই গাড়ি ঘুরিয়েছি দেখি আকাশে মস্ত পূর্ণিমার চাঁদ। দেখামাত্র আমার শরীর কাটা দিয়ে উঠল।
সত্যি?
হ্যাঁ। তারপর হঠাৎ আমার শরীর কাঁপতে শুরু করে। মনে হতে থাকে নখগুলি লম্বা হয়ে যাচ্ছে, দাঁতগুলি বের হয়ে যাচ্ছে-আর সারা শরীর গরমে ঘেমে যাচ্ছে। আমি ভয় পেয়ে কোনোমতে গাড়ি চালিয়ে বাসায় এসেছি, দৌড়ে বাসায় ঢুকে বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম।
কী দেখলে?
দেখলাম, কিছু না। আমি ঠিকই আছি।
তোমার মনের ভুল।
হতে পারে। জন একটা ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, আমার কিন্তু জীবনে আর কখনো মনের ভুল হয়নি। সেই থেকে আমি পূর্ণিমার রাতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে পাবে গিয়ে বিয়ার খেয়ে আধা-মাতাল হয়ে যাই। বনে-জঙ্গলে আর যাই না।
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, জন আমি যদি নিজের চোখেও দেখি যে তুমি আস্তে আস্তে ভালুক না হয় নেকড়ে হয়ে যাচ্ছ, আমি বিশ্বাস করব না। কিছু-কিছু জিনিস হতে পারে না।
ঠিকই বলেছ। জন চুপ করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
দুজনে তাঁবুর ভিতরে ঢুকে স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে পড়ি। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা, আমার পরনে অন্তত তিনপ্রস্থ কাপড়, মাথায় মানকি ক্যাপ। স্লিপিং ব্যাগটাও হাঁসের পালক দিয়ে তৈরি, এখানে বলে ডাউনের। এই ডাউনের স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে নাকি বরফের ওপর ঘুমানো যায়। আমার অবিশ্যি সেরকম মনে হলো না, ভিতরে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকি। মাথা ভিতরে ঢুকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে ফেলে ভিতরে একটু গরম করে নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। জন একেবারে চুপচাপ শুয়ে আছে। পূর্ণিমার চাঁদটা দেখে এরকম করে ঘাবড়ে যাবে কে জানত! এ দেশেও এত লেখাপড়া জানা লোকজনের ভিতরে এত রকম কুসংস্কার আছে! আমি শুয়ে শুয়ে পাহাড়ের নদীর, জঙ্গলের শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। জনের কথা সত্যি, ঘুমটা হলো ছাড়া-ছাড়া, একটু পরপর আমার ঘুম ভেঙে যেতে লাগল।
মাঝরাতে হঠাৎ কী একটা শব্দে আবার আমার ঘুম ভেঙে গেল। কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে আমি কোথায়। হঠাৎ করে আমার সবকিছু মনে পড়ে। কিছু একটা বিচিত্র শব্দে আমার ঘুম ভেঙেছে। আমি বোঝার চেষ্টা করতে থাকি শব্দটা কোথা থেকে এসেছে। কান পেতে শুনলাম, জন কেমন জানি একধরনের শব্দ করছে। অনেক কেঁপে জ্বর উঠলে মানুষ যেরকম শব্দ করে, সেরকম। আমি মাথা বের করে ডাকলাম, জন!
জন কোনো উত্তর দিল না। আমি ভয়ে ভয়ে গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, জন। কী হয়েছে জন?
জন উত্তর না দিয়ে হঠাৎ গোঙানোর মতো শব্দ করতে থাকে। আমি তার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই।
মাথার কাছে টর্চলাইট ছিল। হাতড়ে হাতড়ে সেটা বের করে জ্বালালাম। জন স্লিপিং ব্যাগের ভিতর পুরোপুরি মাথা ঢেকে শুয়ে আছে বলে তাকে দেখতে পেলাম না। আমি আবার কঁপা গলায় ডাকলাম, জন–
হঠাৎ করে জন মাথার ওপর থেকে স্লিপিং ব্যাগ সরিয়ে নিল, তাকে দেখে আমি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠি। বীভৎস একটি মুখ–জনের চিহ্নমাত্র নেই সেখানে। সারা মুখ কালো চুলে ঢেকে গেছে, উঁচু কপাল, লম্বা মুখমণ্ডল। বিস্তৃত মুখ থেকে ধারালো দাঁত বের হয়ে আছে। মুখের দুপাশ থেকে হলুদ রঙের তরল গড়িয়ে পড়ছে। সারা তাঁবু দূষিত দুর্গন্ধে ভরে গেল হঠাৎ।
সেই বীভৎস প্রাণীটি যেটি নিশ্চয় জন, আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ শিউরে উঠে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে কোনোভাবে উবু হয়ে বসার চেষ্টা করতে থাকে। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি। সত্যিই কি সে আমার চোখের সামনে ভালুক হয়ে যাচ্ছে! এও কি সম্ভব! কিন্তু আমি নিজের চোখকে অবিশ্বাস করি কেমন করে?
জন হঠাৎ ভয়ংকরভাবে কেঁপে ওঠে, আর আমি অবাক হয়ে দেখি তার মুখটা আরও ইঞ্চিখানেক লম্বা হয়ে গেছে। সে প্রাণপণে তার ঘাড় ঝাঁকাতে থাকে, শরীর বাঁকা করে নাড়তে থাকে। শরীরের ভিতর থেকে হঠাৎ কেমন জানি মটমট শব্দ বের হয়ে আসে, কেউ যেন ভিতরে তার হাড়গোড় চূর্ণ করে দিচ্ছে। আমি অবাক হয়ে দেখি তার শরীরটা আশ্চর্যরকমভাবে বিকৃত হয়ে একটা চতুষ্পদ প্রাণীর মতো হয়ে যাচ্ছে।
আমি আতঙ্কে পাথর হয়ে বসে থাকি। কী করব বুঝতে না পেরে শুকনো গলায় আবার ডাকলাম, জন–
প্রাণীটি আমার দিকে তাকাল। আশ্চর্য এক জোড়া নীল চোখে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর আবার প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করতে শুরু করে। থরথর করে খানিকক্ষণ কেঁপে আবার আমার দিকে তাকাল, মুখটা আরও লম্বা হয়ে গেছে। সমস্ত শরীর কালো লোমে ঢেকে যাচ্ছে, মুখের কষ বেয়ে লালা ঝরছে। হঠাৎ করে প্রাণীটি মুখ হাঁ করে, দুপাটি ধারালো দাঁত টর্চের আলোতে চকচক করে উঠল।
আমার ভিতর হঠাৎ জান্তব একটা ভয় এসে ভর করল। এখান থেকে আমাকে পালাতে হবে, এই প্রাণীটির হাতে প্রাণ খোয়ানোর আগে পালাতে হবে। আমি সাবধানে পেছনে সরে আসতে চেষ্টা করলাম। তাঁবু থেকে বের হওয়ার জন্যে ছোট দরজা মাথার কাছে, চেন দিকে আটকানো। আমি সাবধানে খোলার চেষ্টা করলাম–জন্তুটা হঠাৎ ঘুরে আমার দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকাল। দাঁত বের করে গর্জন করল একবার চাপাস্বরে। আমি আতঙ্কে তখন জ্ঞান-বুদ্ধি হারিয়েছি। হাতের টর্চলাইটটা জ্বালিয়ে জন্তুটাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলাম। হঠাৎ কিছু বোঝার আগেই জন্তুটা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি চিৎকার করে হাত দিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলাম। জন্তুটা আমার বাম হাত কামড়ে ধরে প্রচণ্ড শক্তিতে ঝাঁকাচ্ছে। মনে হচ্ছে হাতটা আমার শরীর থেকে টেনে ছিঁড়ে নিতে চায়। যন্ত্রণা নয়, প্রচণ্ড ভয়ে আমি হাতের টর্চলাইটটা দিয়ে প্রাণপণে সেটার মাথায় আঘাত করতে থাকি।
এরকম পরিবেশে মানুষ সচরাচর পড়ে না। আর এরকম পরিবেশে না পড়া পর্যন্ত মানুষ বলতে পারেন না সে তখন কী করবে। আমার মনে নেই আমি কী করেছিলাম, বেঁচে থাকার আদিমতম প্রবৃত্তি নিশ্চয়ই কাজ করছিল, কারণ অন্ধকারে হুটোপুটি করতে করতে হঠাৎ আমি আবিষ্কার করলাম, আমি তাঁবুর বাইরে। কীভাবে সেটা সম্ভব হয়েছিল এখনও আমি জানি না।
তাঁবু থেকে বের হয়ে আমি দৌড়াতে শুরু করলাম। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, আমার তখন সেটা খেয়াল নেই। ঠাণ্ডার জন্যে পায়ে মোজা পরে শুয়েছিলাম তবুও পাথরের আঘাতে পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। আমি অন্ধকারে চিৎকার করতে করতে নিচে ছুটে এলাম–
সেখানে বেশ কয়েকটা তাঁবু, বিকেলে আমি আর জন তাদের পার করে ওপরে উঠে গিয়েছি।
আমার চিৎকারে তাঁবু থেকে সবাই বের হয়ে এলো। জ্ঞান হারানোর আগে আমি কিছু বলেছিলাম কি না মনে নেই। বলে থাকলেও নিশ্চয়ই বাংলাতেই বলেছি-ওরকম অবস্থায় মানুষ ইংরেজিতে কথা বলবে কেমন করে?
কামাল সাহেব এই পর্যন্ত বলে একটু থামলেন। আমরা রুদ্ধ নিঃশ্বাসে শুনছিলাম, নিঃশ্বাস আটকে রেখে বললাম, তারপর?
দেখতেই পাচ্ছেন জানে বেঁচে গেলাম। আমাকে দেখেই সবাই বুঝতে পেরেছে ভালুক বা অন্য কোনো প্রাণী আক্রমণ করেছে। নিচে খবর পাঠানো হলো, রেঞ্জার ছুটে এলো ওপরে, স্ট্রেচারে করে নামানো হলো আমাকে নিচে-আমি অবিশ্যি এসব কিছু জানি না।
আর জনের কী হলো?
কামাল সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, সেটা আরেক কাহিনী। পুলিশ আর রেঞ্জার আমাদের তাঁবুতে গিয়ে দেখে পুরো তাঁবু লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে, জনের চিহ্নমাত্র নেই। সবাই আশঙ্কা করল ভালুকের হাতে জনের কিছু একটা হয়েছে
অনেক খোঁজাখুঁজি করা হলো জনের, সে রাতে তাকে পাওয়া গেল না। সে ফিরে এলো পরদিন ভোরে-বিধ্বস্ত চেহারা, রাতে কী হয়েছে কিছুই মনে করতে পারে না। সবাই অবাক হয়েছিল দেখে যে একই তাঁবুতে থেকে আমার প্রাণ যাবার অবস্থা হয়েছিল ভালুকের আক্রমণে, কিন্তু তার গায়ে আঁচড়টিও লাগে নি।
হাসপাতালে আমার সাথে একদিন দেখা করতে এসেছিল জন। যখন আশেপাশে কেউ ছিল না, তখন আমার কাছে এসে বলল, আমাকে একটা সত্যি কথা বলবে তুমি?
কী সত্যি কথা?
সে রাতে কি আমি তোমাকে আক্রমণ করেছিলাম?
হাসপাতালের ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে আছি, মাথার কাছে মনিটরে আমার হৃদস্পন্দন রক্তচাপ মাপা হচ্ছে, সামনে টেলিভিশন স্ক্রিনে একটা হাসির অনুষ্ঠান হচ্ছে।
আমার বাম হাতে একটা সুইচ, টিপলেই একজন নার্স ছুটে আসবে। এরকম অবস্থায় আমার নিজেরই বিশ্বাস করা শক্ত যে জন ভালুক হয়ে আমাকে আক্রমণ করেছিল। আমি মাথা নেড়ে বললাম, না, তুমি আক্রমণ করো নি, একটা ভালুক আক্রমণ করেছিল।
আমি দেখলাম জনের বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেল। আস্তে আস্তে বলল, তুমি যে আমাকে কী শান্তি দিলে বোঝাতে পারব না। আমি সত্যি বিশ্বাস করা শুরু করেছিলাম যে আমি একটা ওয়ার উলফ!
জন খানিকক্ষণ গল্প করে চলে যাচ্ছিল। আমি যাবার আগে বললাম, তুমি আমাকে একটা কথা দাও।
কী?
পূর্ণিমার রাতে তুমি আর কখনো ক্যাম্পিংয়ে যাবে না।
সাথে সাথে জনের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। ঢোঁক গিলে বলল, এ কথা বলছ কেন?
আমি সহজ গলায় বললাম, দেখা গেছে পূর্ণিমার রাতে অনেক জন্তু-জানোয়ার খেপে যায়-পূর্ণচন্দ্রের একটা প্রভাব থাকতে পারে। কে জানে হয়তো তোমার ওপরে আবার আক্রমণ হবে-আমার ওপর যে রকম হয়েছিল! দরকার কী? জন। খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ঠিক আছে। এরপর জনের সাথে আমার আর দেখা হয় নি। শুনেছি এই ইউনিভার্সিটি ছেড়ে চলে গেছে।
কামাল সাহেব থামলেন। আমরা বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলাম। কট্টর ইঞ্জিনিয়ার আরিফ একটু কেশে বলল, আপনি বলেছেন ভালুকটা আপনাকে কামড়েছিল। সেটা সত্যিই যদি ওয়ার উলফ হয়ে থাকে তাহলে আপনিও ওয়ার উলফ। পূর্ণিমার রাতে আপনি কি কখনো ভালুক হয়েছেন? জানেন তো আজ পূর্ণিমা? ভেবেছিলাম কামাল সাহেব হেসে উঠবেন। তিনি হাসলেন না। আস্তে আস্তে বললেন, আমি জানি না।
ঘরের পরিবেশটা হঠাৎ করে কেমন যেন থমথমে হয়ে উঠল।