Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

কলেজে পড়ার সময় আমাদের এক বন্ধু একদিন ফুটপাত থেকে একটা বই কিনে আনল। বইটার নাম জন্মান্তর রহস্য’। সাধু ভাষায় লেখা বই, পড়তে রীতিমতো কষ্ট হয়, তবু সবাই মিলে আমরা বইটা পড়ে ফেললাম। বইটিতে নানারকম ভৌতিক গল্প ছাড়াও কেমন করে মৃত মানুষের আত্মাকে নিয়ে আসা যায় সেটি পরিষ্কার করে লেখা আছে। পড়ে মনে হলো ব্যাপারটি এমন কিছু কঠিন নয়। রাত্রিবেলা কয়েকজন মিলে অন্ধকার ঘরে গোল হয়ে বসে একজন আরেকজনের হাতের ওপর হাত রেখে একটা গোল ‘চক্রে’ বসে গভীরভাবে মৃত মানুষের কথা ভাবলেই নাকি আত্মার আবির্ভাব হয়। আত্মা একজন মানুষের ওপর আসবে, তার মুখ। দিয়ে কথা বলবে। চক্রে বসার আগে ঘরটা পরিষ্কার করতে হয়, নিজে গোসল করে ধোয়া কাপড় পরতে হয়, লঘুপাক খাবার খেতে হয় ইত্যাদি নানারকম বিধিনিষেধ আছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার ব্যাপারটি চেষ্টা করা যেতে পারে, তবে হোস্টেলে থাকি বলে খাবারে কোনো হাত নেই। লঘুপাক গুরূপাক যেটাই দেয় সেটাই খেতে হয়।

সবাই মিলে ঠিক করলাম একদিন ব্যাপারটা চেষ্টা করে দেখতে হয়। ব্যাপারটা বেশি জানাজানি করে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন একদিন রাতে মৃত আত্মাকে ডাকার জন্যে একত্র হলাম। গোসল করে পরিষ্কার কাপড় পরে এসেছি। টিপু দাবি করল তার বিছানার চাদর মাত্র ধোয়া হয়েছে, কাজেই তার বিছানাতেই বসা হলো। বইয়ের কথা অনুযায়ী একজনের হাতের ওপর আরেকজনের হাত রেখে ঘর অন্ধকার করে দেওয়া হলো।

এরপর গভীর মনোযোগের সাথে পরকালের কথা ভাবার কথা। ব্যাপারটা সহজ নয়, ঘুরেফিরে শুধু ইহকালের কথা মনে আসে, রাতে কী খেয়েছি, বাসায় চিঠি লেখা হয় নি, ভালো একটা সিনেমা এসেছে এইসব। প্রায় আধঘণ্টা চেষ্টা করে আমরা হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম, হঠাৎ করে টিপু আমার হাতে চিমটি কাটল। মৃত আত্মা আসার সময় শরীর কাঁপতে থাকার কথা, নিঃশ্বাস দ্রুত হওয়ার কথা, কিন্তু কখনোই চিমটি কাটার কথা না। সম্ভবত টিপু কিছু একটা সংকেত দিতে চাইছে। টিপু আমার ছেলেবেলার বন্ধু, তার মতো পাজি মানুষ বেশি তৈরি হয় নি। আমার সন্দেহ হলো সে কিছু একটা বদ মতলব ভেবে বের করেছে। অন্ধকারে আন্দাজ করে তার কাছে মাথা নিয়ে গেলাম, টিপু ফিসফিস করে বলল, মজা দেখার জন্যে রেডি হ।

মৃত আত্মার আবির্ভাব আর যা-ই হোক, মজা হতে পারে না। তাছাড়া টিপুর কাছে যেটা মজা মনে হয় আমি তার থেকে শত হস্ত দূরে থাকার চেষ্টা করি। মজাটা কী হতে পারে আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম, হঠাৎ দেখি টিপুর হাতকাঁপা শুরু হয়েছে। টিপুর অন্য পাশে বসেছিল রেজা, সে ভয়ার্ত গলায় বলল, সর্বনাশ, এসে গেছে!

সাথে সাথে আমি বুঝে গেলাম টিপু কী করতে চাইছে-মৃত আত্মার আবির্ভাবের একটা অভিনয় করে দেখাবে। আমি এখনই পুরো ব্যাপারটা ফাস করে দিয়ে টিপুকে নিবৃত্ত করতে পারি। কিংবা ইচ্ছা করলে টিপুর সাথে তাল মিলিয়ে মৃত আত্মার আবির্ভাবটিকে

আরও জলজ্যান্ত করে তুলতে পারি। আমি টিপুর সাথে তাল মিলিয়ে যাওয়াই ঠিক করলাম। টিপু পাজি মানুষ সত্যি, কিন্তু আমিও ধোয়া তুলসীপাতা নই। গলায় স্বর গম্ভীর করে বললাম, কোনো কথা নয়, আত্মার কষ্ট হতে পারে। সবাই পরকালের কথা ভাব।

ঘরে কোনো শব্দ নেই, নিংসন্দেহে সবাই প্রচণ্ড মনোযোগে পরকালের কথা ভাবা শুরু করেছে। টিপুর হাতাপাও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে, আস্তে আস্তে গলা থেকে একটা বিকট আওয়াজ বের হতে শুরু করে। আমি বইয়ের নির্দেশমতো জিজ্ঞেস করলাম, হে বিদেহী আত্মা, আপনি এসেছেন?

টিপু গোঙানোর মতো একটা শব্দ করল, যার অর্থ হ্যাঁ কিংবা না দুই-ই হতে পারে।

রেজা কাঁপা গলায় বলল, ভয় লাগছে আমার। বন্ধ করে দে

আমি বললাম, বন্ধ করব কী? একটা আত্মা এসেছে, কথা বলব না?

আপত্তি করলে ভীতু হিসেবে প্রমাণিত হয়, তাই কেউ বেশি আপত্তি করল না।

আমি আবার বিনয়ে গলে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার। সাথে একটু কথা বলতে পারি।

টিপু বিকট গলায় বলল, কী কথা?

আপনার নাম কী?

নাম দিয়ে কী করবি?

আপনি কোথায় থাকেন?

এত কেন কৌতূহল?

প্রশ্নের উত্তর যখন প্রশ্ন দিয়ে হয়, সেই কথোপকথন বেশিক্ষণ চালিয়ে যাওয়া যায় না। আমি তবু চেষ্টা করলাম, আপনি কীভাবে মারা গিয়েছিলেন? টিপু উত্তর না দিয়ে গোঙানোর মতো একটা শব্দ করতে শুরু করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কি কষ্ট হচ্ছে?

হ্যাঁ। অনেক কষ্ট, অনেক কষ্ট-এই বলে টিপু মাথা নিচু করে উৎকট শব্দ করতে শুরু করে, মনে হয় কেউ বুঝি পেছন থেকে ক্রমাগত ছোরা মারছে। ঘরের অনেকেই এবারে ভয় পেয়ে গেল, রেজা বলল, আর নয়। এখন বন্ধ করে দিই।

টিপুও বলল, আমি যাব। আমি যাব–

আমি বললাম, ঠিক আছে আপনি যান। টিপু শরীর কাঁপাতে কঁপাতে বলল, আমি যেতে পারছি–যেতে পারছি না।

কেন?

তোরা আমাকে আটকে রেখেছিস। যেতে দে, আমাকে যেতে দে-টিপু করুণ সুরে কাঁদতে শুরু করে।

ভয়-পাওয়া গলায় একজন বলল, যেতে পারছে না কেন?

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, চক্রে বাঁধা পড়ে গেছে। হাত ছেড়ে চক্র ভেঙে দিলেই চলে যাবে। সবাই হাত ছেড়ে দাও।

সবাই হাত ছেড়ে দিল, আর সত্যি সত্যি টিপু ভালোমানুষের মতো সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?

ঘরের বাতি জ্বালানো হলো। উত্তেজনায় কেউ কথা বলতে পারছে না। রেজা তোতলাতে তোতলাতে বলল, তু-তু-তুই জানিস না?

কী জানি না?

তোর ওপর আত্মা এসেছিল।

আমার ওপর? টিপু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকায়-আমার ওপর?

হ্যাঁ।

সত্যি?

সত্যি।

খোদার কসম?

খোদার কসম। তোর কিছু মনে নেই?

নাহ। মনে হলো ঘুমের মতন–তারপর কিছু মনে নেই।

বিস্ময়ে কারও মুখে কথা ফোটে না।

টিপুর এই দুষ্কর্মের ফল হলো ভয়ানক। পরদিন সারা হোস্টেলে ঘটনাটির কথা ডালপালা গজিয়ে ছড়িয়ে পড়ল। সারাদিন ধরে হোস্টেলের ছেলেরা একের পর এক এসে সত্যি কী হয়েছিল জানার চেষ্টা করতে থাকল। বিকেলের দিকে আমরা বিরক্ত হয়ে উঠলাম এবং সন্ধ্যের পর যখন প্রায় সারা হোস্টেলের ছেলেরা টিপুর ঘরে স্বচক্ষে ভূত দেখার জন্যে হাজির হলো, আমি প্রমাদ গুনলাম।

এত লোকের ভিড়ে আমার চক্রে বসার কোনো ইচ্ছে ছিল না। কয়েকজনকে বোকা বানানো মজার ব্যাপার হতে পারে। কিন্তু ঘরভর্তি মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করায় বিপদের ঝুঁকি আছে। চক্রে বসতে হলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়, ঘর নিরিবিলি হতে হয়, মন পবিত্র থাকতে হয় এরকম বড় বড় কথা বলে বেশির ভাগ উৎসাহী দর্শককেই ভাগিয়ে দেওয়া গেল। তবু জনাবিশেক কিছুতেই নড়ল না, তারা স্বচক্ষে আত্মার আবির্ভাব না দেখে নড়বে না। তাদের উৎসাহেই আবার চক্রে বসতে হলো-টিপু আবার আগের মতো অভিনয় করে দেখাবে, সবাই খুশি হয়ে ঘরে ফিরে যাবে, আমার সেরকমই ধারণা ছিল। কিন্তু দেখা গেল আজ টিপুর সেরকম কোনো ইচ্ছা নেই। ঘর তখন মোটামুটি ফাঁকা হয়ে গেছে, যারা তখনও ধৈর্য ধরে বসে আছে তাদের মাঝে একজন হচ্ছে নুরুল। নুরুল মফস্বলের ছেলে, কাজেই আমাদের মতো চালবাজ ধরনের শহুরে ছেলেদের সাথে তার বেশি যোগাযোগ নেই। আমরা আড়ালে নুরুল এবং তার মতো মফস্বলের ছেলেদের ‘ক্ষেত’ বলে ডাকি।

নুরুল ধৈর্য ধরে বসে রইল, ওঠার কোনো নাম নেই। তার দেখাদেখি আরও কয়েকজন তবু বসে রইল। অন্য সবাই হাল ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু রেজা বাদ সাধল। সে বলল, জন্মান্তর রহস্য বইটিতে সে পড়েছে চক্রে যদি আত্মার আবির্ভাব না হয় তাহলে পরকাল নিয়ে আলোচনা বা ভৌতিক ঘটনার উল্লেখ করলে অনেক সময় আত্মার দ্রুত আবির্ভাব হয়ে থাকে। গালগল্পে আমার জুড়ি কম, তাই আমাকেই ভৌতিক ঘটনা বর্ণনার দায়িত্ব নিতে হলো। কিছুদিন আগে একটা বিদেশি ভূতের গল্প পড়েছিলাম, গোরস্তান থেকে মৃত মানুষ উঠে-আসা সংক্রান্ত ভয়াবহ একটা গল্প। গল্পটির সব চরিত্রগুলিকে আমার মামাবাড়ির বিভিন্ন চরিত্রে পালটে দিয়ে সবার সামনে সেটি ফেঁদে বসলাম। গল্পটি ভয়ংকর একটি গল্প, অন্ধকার ঘরে সেটি সবার ভিতর একটা জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করল। গল্প শেষ করে আবার যখন আমরা চক্রে বসলাম আমার নিজেরই কেমন একটা সন্দেহ হতে শুরু করল যে, হয়তো এবারে সত্যি একটা আত্মার আবির্ভাব ঘটে যাবে। কিন্তু তখন যে জিনিসটি ঘটল তার জন্যে আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।

পাশের বিছানায় আরও কয়েকজনের সাথে নুরুল বসে ছিল, সে হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দড়াম করে বিছানার ওপর পড়ে গেল। অন্ধকারে প্রথমে আমরা প্রচণ্ড একটা শব্দ, তারপর সবার গগনবিদারী চিতকার শুনতে পেলাম। ঘরটায় হঠাৎ একটা অচিন্তনীয় আতঙ্কের সৃষ্টি হলো এবং হাতের কাছে লাইটের সুইচটা থাকা সত্ত্বেও সেটা জ্বালাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গেলাম। শেষ পর্যন্ত যখন ঘরে আলো জ্বালানো হলো, দেখা গেল বিছানায় নুরুল উপুড় হয়ে আছে, বেকায়দায় পড়ে মাথার পাশে খানিকটা কেটে গেছে, সেখান থেকে দরদর করে রক্ত বের হচ্ছে। সবচেয়ে যেটা আশ্চর্য, সেটা হচ্ছে তার শরীরের কাঁপুনি। একজন মানুষের শরীর যে কখনো এভাবে কাঁপতে পারে, নিজের চোখে না দেখলে আমি কখনো বিশ্বাস করতাম না।

আমরা ধরাধরি করে নুরুলকে চিত করে শোয়ালাম। তার চোখ বন্ধ, কিন্তু শরীর তখনও থরথর করে কাঁপছে। মাথার পাশে যেখানে কেটে গেছে, সেখানে একটা রুমাল চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করে আমি ডাকলাম, নুরুল, এই নুরুল!

নুরুল পুরোপুরি অচেতন। আমার কথা তার কানে গিয়েছে বলে মনে হলো না। দেখে আমার মনে হলো, সে হয়তো মরেই যাচ্ছে। আমি আবার ডাকলাম, নুরুল, এই নুরুল!

নুরুল বিড়বিড় করে কী একটা বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি আবার ডাকলাম, তখন হঠাৎ নুরুল ভারী গলায় বলল, ছেলেটাকে ধরে রাখো।

আমি চমকে উঠলাম, কার গলার স্বর এটা? ঢোঁক গিলে বললাম, কোন ছেলেটাকে? এই ছেলেটাকে। দেখছ না কেমন কাঁপছে।

হঠাৎ করে আমি ভয়ে আঁতকে উঠলাম, নুরুল তার নিজেকে ধরে রাখার কথা বলছে। আমি ভয়ে ভয়ে গিয়ে নুরুলকে চেপে ধরলাম। আমার দেখাদেখি টিপু এবং রেজাও এগিয়ে এলো। নুরুলের সারা শরীর এত জোরে জোরে কাঁপছে যে, আমরা তিনজন মিলেও তাকে ধরে রাখতে পারি না। আমি ভয়-পাওয়া গলায় বললাম, নুরুল, কী হয়েছে তোর?

নুরুল সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষের গলায় বলল, শক্ত করে ধরে রাখো। ছেলেটার অনেক কষ্ট হচ্ছে।

আমি ঢোঁক গিলে বললাম, আপনি কে?

নুরুল চোখ বন্ধ রেখেই ভারী গলায় বলল, আমি মুগাবালী, একটু থেমে নিজেই যোগ করল, আমি একজন জিন।

আলোকোজ্জ্বল ঘরে এতজন মানুষের উপস্থিতিতেও একটা অশরীরীর আতঙ্কে আমার সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠল। শুধু আমার নয়-সবার, কারণ রেজা আর টিপু নুরুলকে ছেড়ে দিয়ে এক লাফে পিছিয়ে গেল। আমি একা নুরুলকে ধরে রাখতে পারি না। কিন্তু তবু তারা এগিয়ে এলো না।

আমি সাহসে ভর করে আস্তে আস্তে বললাম, আপনি এখন যান।

নুরুল একটা বিচিত্র শব্দ করল, অনেকটা হাসির মতো শব্দ, তারপর বলল, আমি যাব না।

কেন যাবেন না?

নুরুলের মুখ দিয়ে সেই অশরীরী প্রাণীটি উত্তর দিল, আমি এই ছেলেটাকে নিয়ে যাব।

শুনে আতঙ্কে আমাদের সবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। সত্যিই যদি নুরুলকে নিয়ে যায়? সত্যি যদি তাকে মেরে ফেলে? কী সর্বনাশ!

জন্মান্তর রহস্য বইয়ে লেখা ছিল বিদেহী আত্মার আবির্ভাব হলে যখন তাকে চলে যেতে বলা হয় সে নিজে থেকেই চলে যায়। হঠাৎ হঠাৎ কখনো একটি দুটি দুষ্ট আত্মার আবির্ভাব হয়, তারা নিজে থেকে যেতে চায় না। তখন তাদের বিদেয় করার জন্যে ঘরের সব বাতি জ্বালিয়ে দিতে হয়, যার ওপর আবির্ভাব হয়েছে তার মুখে পানির ঝাঁপটা দিতে হয়। ঘরে ইতিমধ্যে সব আলো জ্বালানো হয়ে গেছে, আমি আলি রেজাকে বললাম এক গ্লাস পানি আনার জন্যে। পানি এনে নুরুলের মুখে পানির ঝাঁপটা দেওয়া হলো, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। নানির কাছে শুনেছিলাম আয়াতুল কুরসি পড়ে ফুঁ দিলে জিন-ভূত থাকতে পারে না। নিজেদের মুখস্থ নেই, একজনকে জোগাড় করা হলো যার মুখস্থ আছে, তাকে দিয়ে নুরুলের কানে আয়াতুল কুরসি পড়া হলো, কিন্তু তবু লাভ হলো না। উলটো মুগাবালী নুরুলের মুখ দিয়ে অনর্গল কথা বলা শুরু করল। কথার বিষয়বস্তু খুব বিচিত্র।

একটা বড় অংশ নুরুলকে নিয়ে যাকে সে এই ছেলেটা বলে সম্বোধন করছে। বারবার বলছে ছেলেটা খুব দুঃখী এবং তাকে সে সাথে নিয়ে গিয়ে সব দুঃখের অবসান করতে চায়।

আতঙ্কের প্রথম ধাক্কাটা কেটে যাবার পর আমরা প্রকৃত বিপদটুকু টের পেলাম। যদি আমরা নুরুলকে এই জিন থেকে ছুটিয়ে আনতে না পারি এবং এই খবর হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট পর্যন্ত পৌঁছায়, তাহলে আমাদের কপালে অনেক দুঃখ আছে। এর থেকে অনেক ছোট অপরাধের জন্যে মাসখানেক আগে একজনকে হোস্টেল ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।

আমি মাথা ঠাণ্ডা রেখে পুরো ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করলাম। সবকিছু অন্য কারও ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায়, যদিও ব্যাপারটা নিজের জন্যে সম্মানজনক নয়। পীর-ফকিররা ঝাড়ফুঁক দিয়ে জিন নামায় বলে শুনেছি, কিন্তু এই মধ্যরাতে আমি পীর-ফকির খুঁজে পাব কোথায়? একমাত্র যে-জিনিসটা করা যায় সেটি হচ্ছে নুরুলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। ডাক্তারদের জিন নামানো শেখানো হয় বলে শুনি নি, কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে।

টিপু মুখ কাচুমাচু করে বলল, কী করা যায়?

হাসপাতালে নেওয়া ছাড়া তো আর কোনো পথ দেখি না।

হাসতাপাল? কেমন করে নিবি?।

সুপারিনটেনডেন্ট স্যারকে ডেকে তুলে হাসপাতালে ফোন করতে হবে।

টিপু চোখ কপালে তুলে বলল, তোর মাথা-খারাপ হয়েছে?

আমি বললাম, তাহলে কী করবি? টিপু খানিকক্ষণ মাথা চুলকে বলল, কী অবস্থা হবে জানিস?

কিন্তু উপায় কী?

নুরুল তখনও খলখল করে হাসছে। বলছে, কী করবে তোমরা? হাসপাতালে পাঠাবে? হা হা হা! গোরস্তানে পাঠাও, গোরস্তানে। হাসপাতালে না।

নুরুলকে দেখে আর কারও অপেক্ষা করার সাহস হলো না। টিপু সাথে আরেকজনকে নিয়ে সুপারিনটেনডেন্ট স্যারকে ডাকতে গেল। রাত দুটোর সময় হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্টকে ডেকে তুলে কীভাবে এ খবরটি দেওয়া যায় আমার জানা নেই, কিন্তু টিপু যে কায়দা ব্যবহার করল তার তুলনা নেই। স্যারের বাসার দরজা সে লাথি মেরে প্রায় ভেঙে ফেলার অবস্থা করে তাকে ঘুম থেকে তুলল। লুঙ্গিতে গিট মারতে মারতে স্যার যখন উঠে এলেন, টিপু তাঁকে বলল, কী দেখে ভয় পেয়ে নুরুল মরে গেছে।

একজন হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্টের জীবনে এর থেকে ভয়ংকর কোনো ঘটনা ঘটতে পারে না–তিনি পাগলেরে মতো ছুটে এসে যখন দেখলেন নুরুল তখনও মরে নি, তার আনন্দের সীমা রইল না। তক্ষুনি হাসপাতালে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স আনালেন।

পনেরো মিনিটের ভিতর সাইরেন বাজাতে বাজাতে অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির হলো, সারা হোস্টেলের ছেলেদের ঘুম থেকে জাগিয়ে স্ট্রেচারে করে নুরুলকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো। সঙ্গে গেলাম আমি, হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট সাথে যেতে চাইছিলেন, অনেক বুঝিয়ে তাকে রাখা হলো। অন্যদের দায়িত্ব হলো ঘটনাটি ঠিকভাবে তাকে বোঝানো।

হাসপাতালের ডাক্তার একটা কমবয়সী ছেলের মতো। নুরুলকে টিপেটুপে দেখে আমার দিকে তাকাল। আমি জিনের কথা বলতেই সে এত জোরে হাসা শুরু করল যে আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। ঠোঁটের ফাঁকে একটা সিগারেট চেপে ধরে সিরিঞ্জে কী একটা ওষুধ ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, এই বয়সে এত নেশা ভাঙ শুরু করা ঠিক না।

আমি আপত্তি করে কী একটা বলতে চাইছিলাম, ডাক্তার বাধা দিয়ে বলল, গল্প বানাতে চাও বানাও, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য গল্প তো বানাবে। রাত তিনটার সময় যদি বলো জিনে ধরেছে-হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।

আমি বললাম, বিশ্বাস করেন, সত্যি জিনে ধরেছে।

ডাক্তার আমার কথায় বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে বলল, কী নাম বললে? মসুরালী?

না, মুগাবালী।

মুগাবালী! হাঃ হাঃ হাঃ! খাসা নামটা দিয়েছ।

আমি কাতর গলায় বললাম, বিশ্বাস করেন, সত্যি জিনে ধরেছে।

ডাক্তার মুখে কৃত্রিম একটা গাম্ভীর্য এনে বলল, ঠিক আছে বিশ্বাস করলাম। কিন্তু কোনো ভয় নেই। পেথিড্রিন দিয়ে দিচ্ছি। পেথিড্রিনের ওপরে ওষুধ নেই। জিন-ভূত, রাক্ষস-খোক্কস সব পালাবে। এই দ্যাখো-বলে ডাক্তার খোচ করে সিরিঞ্জের সুচটা নুরুলের হাতে ঢুকিয়ে দিল।

পেথিড্রিনের ফল না অন্য কোনো কারণ আমি জানি না, নুরুল কিছুক্ষণের মাঝেই শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ডাক্তার ঘুরে এসে তাকে একবার দেখে বলল, তুমি আর থেকে কী করবে? বাড়ি যাও।

আমি ভোর চারটার সময় হোস্টেলে ফিরে এলাম।

নুরুল পরের দিনই সুস্থ হয়ে ফিরে এলো। মুগাবালী জিন বা অন্য কোনো কিছুই তার মনে নেই। আমরা তাকে আর বেশি ঘাটালাম না। কারণ একদিনেই তার চোখের কোণে কালি পড়ে গেছে। মুখ রক্তশূন্য এবং চেহারার মাঝে কেমন একটা উদভ্রান্তের মতো ভাব।

চক্রে বসে আত্মার আবির্ভাব করানোর চেষ্টা আমাদের সেইদিন থেকেই ইতি। ভৌতিক কারণ থেকেও বড় কারণ হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট। তিনি বলে দিয়েছেন, হোস্টেলে এ ধরনের কোনো ঘটনা আবার ঘটলে যারা যারা এ-ব্যাপারে জড়িত থাকবে তাদের সবাইকে হোস্টেল থেকে বের করে দেওয়া হবে।

এরপর বেশ কয়েদিন কেটে গেছে। নুরুলের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়, কিন্তু যতবারই দেখি আমার কেমন জানি অস্বস্তি হয়। তার ভিতরে কী যেন একটা পরিবর্তন হয়েছে। বেশ রোগা হয়ে গেছে, মুখে-চোখে কেমন জানি একটা ছন্নছাড়ার মতো ভাব, কাপড়-জামা অগোছালো, চোখের দৃষ্টি কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থের মতো। আমি একদিন নুরুলকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নুরুল তোর কী হয়েছে?

নুরুল ভীষণ চমকে উঠে বলল, না না, কিছু হয় নি।

সত্যি করে বল।

সত্যি বলছি। খোদার কসম। তারপর প্রায় দৌড়ে আমার কাছ থেকে সরে গেল।

আমি ঠিক করলাম, তার রুমমেটকে জিজ্ঞেস করতে হবে। সে নিশ্চয়ই বলতে পারবে নুরুলের সত্যিই অস্বাভাবিক কিছু হয়েছে কি না। তার রুমমেটের নাম জলিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল সে প্রায় মাসখানেক হলো বাড়ি গেছে, কোনো একটা পারিবারিক জটিলতার জন্যে আসতে পারছে না। অনেকে সন্দেহ করছে তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপাতত নুরুল একাই আছে তার রুমে।

আমার ভিতরকার অস্বস্তিটা আরও দানা বেঁধে উঠতে থাকে, কিন্তু আমি কী করব বুঝতে পারলাম না।

আরও কয়দিন কেটে গেল তারপর। আমি আবার একদিন খোঁজ নিতে গেলাম। নুরুলের রুম ভিতর থেকে বন্ধ। বেশ কয়েকবার জোরে জোরে ধাক্কা দেবার পর নুরুল দরজাটা একটু খুলে আমার দিকে তাকাল। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, ভিতরে। অন্ধকারে তার চোখ জ্বলজ্বল করছে বিড়ালের মতো।

আমি একটু ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নুরুল, কী ব্যাপার?

কিছু না। বলে নুরুল প্রায় আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল।

আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে পাশের রুমে যারা আছে তাদের কাছে খোঁজ নেবার চেষ্টা করলাম। বেশিরভাগই ক্লাসে চলে গেছে, পাওয়া গেল কিংকং নামের কমার্সের পেটরোগা ছেলেটিকে। তার দুর্বল স্বাস্থ্যকে উপহাস করে নববর্ষে তাকে কিংকং উপাধি দেওয়া হয়েছিল। উপাধিটা কীভাবে জানি আটকে গেছে, আজকাল কেউ তার সত্যিকার নামটা মনেও করতে পারে না।

কিংকং আমাকে জানাল, গভীর রাতে নুরুলের রুমের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় সে তাকে প্রায়ই এক একা কথা বলতে শোনে।

জিজ্ঞেস করলাম, কি কথা?

কিংকং বলল, জানি না। মাঝে মাঝে যখনই শোনার জন্যে বাইরে দাঁড়াই ভিতর থেকে কীভাবে জানি বুঝে যায়, তখন কথা বন্ধ করে দেয়। একবার শুধু শুনেছি

কী?

শুনেছি নুরুল বলছে, না-না যাব না।

কিংকংয়ের সাথে কথা বলে আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম। ব্যাপারটি অন্যদের সাথে আলোচনা করতে হবে। কে জানে হয়তো সুপারিনটেনডেন্টকে জানাতে হবে। কিন্তু সবার আগে নুরুলের সাথে কথা বলা দরকার।

অনেক ধাক্কাধাক্কি করার পর নুরুল আবার দরজা একটু খুলে বাইরে উঁকি দিল। আমি তাকে প্রায় ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেলাম। ভিতরে এই দিনের বেলাতেই বেশ অন্ধকার, দরজা-জানালা পুরোপুরি বন্ধ। ঘরের এক কোনায় কয়টা আগরবাতি জ্বলছে, আর একটা অস্বস্তিকর গন্ধ ভিতরে। আমি নুরুলের দিকে তাকিয়ে বললাম, দরজা-জানালা বন্ধ করে রেখেছিস কেন?

না, মানে ইয়ে নুরুল অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল।

তুই নাকি কলেজে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস?

না, যাই তো। কে বলেছে যাই না?

ঠিক করে বল তো কী হয়েছে?

কিছু হয় নি।

বল আমাকে। না হলে আমি কিন্তু সুপারিনটেনডেন্টকে জানাব।

নুরুল কাতর-মুখে আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমার বড় বিপদ।

কী হয়েছে?

রাত্রিবেলা সে আসে।

কে?

ওই যে আরেকবার এসেছিল।

কে?–জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আমার গলা কেঁপে গেল।

মুগাবালী।

মুগাবালী! সেই জিন?

হ্যাঁ।

কীভাবে আসে?

এমনি এসে যায়।

এসে কী করে?

এসে বসে থাকে। আমাকে নিয়ে যেতে চায়।

কোথায় নিতে চায়?

জানি না। শুধু বলে আমার সাথে চল। আমার খুব ভয় করে।

আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, তুই আমাদের আগে বলিস নি কেন?

বলে কী হবে!

দেখব শালার মুগাবালী কীভাবে আসে। ঠ্যাং ভেঙে ফেলে দেব না।

এই প্রথমবার নুরুলের মুখে একটা ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে। আমি বললাম, তুই খবরদার ভয় পাবি না। আজ থেকে আমরা কয়েকজন তোর ঘরে থাকব। তোর কোনো ভয় নেই।

সত্যি থাকবি? নুরুলের চোখে কাতর অনুনয় দেখে আমার প্রায় বুক ভেঙে গেল। বললাম, থাকব। দেখে নেব শালার মুগাবালীকে।

সেদিন থেকে আমরা কয়েকজন মিলে নুরুলের ঘরে রাত কাটাতে শুরু করলাম। জিনকে লাঠি দিয়ে ঠ্যাঙানো যায় বলে শুনি নি, কিন্তু তবু ঘরে দুটো হকিস্টিক রাখা হলো। নুরুলের সাথে থাকার ফল হলো সাথে সাথে, তার দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। তার হতচ্ছাড়া ভাব কেটে একটা হাসি-খুশির ছোঁয়া লাগে। আবার নিয়মিত ক্লাসে যাওয়া শুরু করে সে।

প্রথম সপ্তাহ যাবার পর কয়েকজন থাকার বদলে পালা করে শুধু একজন করে থাকা শুরু করলাম। নুরুলের রুমমেট জলিলের একটা চিঠি এলো। তার বিয়ে হয় নি,অন্তত চিঠিতে তার উল্লেখ নেই। সে এসে যাবে কয়েকদিনের মাঝেই, তখন আর আমাদের নুরুলের সাথে থাকতে হবে না। মুগাবালীর ব্যাপারটা সত্যি না নুরুলের মনগড়া জানার উপায় নেই, কিন্তু ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হয়েছে, সেটাই বড় কথা।

দিন দশেক পরের কথা। আমার সে রাতে নুরুলের ঘরে শোবার কথা। সেকেন্ড শোতে একটা সিনেমা দেখে আসতে আসতে বেশ রাত হয়ে গেছে। এত রাতে নিজের বিছানা ছেড়ে বালিশ, চাদর নিয়ে নুরুলের ঘরে যাবার কোনো ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু তবু গেলাম। দরজা ধাক্কা দেবার সাথে সাথে নুরুল দরজা খুলে দিল, মনে হলো সে যেন দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। নুরুলের মুখ ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য, মরা মানুষের মতো সাদা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, নুরুল, কী হয়েছে?

না না না, কিছু না। নুরুল দ্রুত মাথা নাড়তে থাকে, কিছু না। কিছু না। আমি কথা বাড়ালাম না। ভিতরে ঢুকেই একটা অপরিচিত গন্ধ পেলাম। হালকা একটা গন্ধ, কিসের গন্ধ টের পাওয়া যাচ্ছে না, দীর্ঘদিন অব্যবহৃত আসবাবপত্র থেকে যেরকম গন্ধ বের হয় অনেকটা সেরকম। কয়েকবার নাক কুঁচকে নিঃশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিসের গন্ধ এটা নুরুল?

গন্ধ? নুরুল চমকে ওঠে, গন্ধ পাচ্ছিস তুই?

হ্যাঁ।

নুরুলের মুখ আরও রক্তশূন্য হয়ে যায়। কোনোরকমে বলল, ও এলে কেমন একটা গন্ধ বের হয়।

আমি ভিতরে ভিতরে চমকে উঠলেও মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব এনে বললাম,

আরে ধুর।

জুতা খুলে আমি বিছানায় ঢুকে পড়ি। নুরুল ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি গায়ে চাদর টেনে নিয়ে বললাম, নুরুল শুয়ে পড়।

নুরুল ঠোঁট নেড়ে কী একটা দোয়া পড়ে নিজের বুকে ফুঁ দিল, তারপর ঘরের এক কোনায় গিয়ে একবার হাততালি দিল।

আমি অবাক হয়ে বললাম, ওটা কী হলো?

নুরুল একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আয়াতুল কুরসি পড়ে হাততালি দিলে নাকি জিন-ভূত আসে না।

আমি বললাম, যে ঘরে আমি আছি সেখানে এমনিতেই কোনোদিন জিন-ভূত আসবে না। ঘুমা।

চাদর গায়ে দিয়েও আমার ঠাণ্ডা লাগতে থাকে। এ বছর এত তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা পড়ে গেল।

আমি শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকি। কেন জানি ঘুম আসতে চায় না। অস্বীকার করে লাভ নেই, নুরুলের কথাবার্তা শুনে কেমন জানি চাপা ভয় এসে ভর করেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি এই ঘরটার মাঝে কোনো একটা সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, অসম্ভব ঠাণ্ডা এই ঘরটি, এই সময়ে এত ঠাণ্ডা হওয়ার কথা নয়। তার ওপর সারা ঘরে অস্বস্তিকর একটা গন্ধ। গন্ধটা আস্তে আস্তে মনে হচ্ছে বাড়ছে। মিষ্টি গন্ধ, তবু কেন জানি গা গুলিয়ে আসে।

আমি জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকি। কে জানে হয়তো আমার জ্বর আসছে, তাই এরকম ঠাণ্ডা লাগছে। মানুষের জ্বর এলে ইন্দ্রিয় নাকি তীক্ষ্ণ হয়ে আসে, ছোটখাটো জিনিস বড় হয়ে ধরা পড়ে। চাদরটা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকি, যদিও মনে হচ্ছিল আজ রাতে ঘুম আর আসবে না।

কিন্তু ঘুম ঠিকই এসেছিল, তাই যখন হঠাৎ করে ঘুম ভাঙল, আমি ভীষণ চমকে উঠলাম। সাধারণত ঘুম ভাঙার পর মানুষ আধো জাগা আধো ঘুমের মাঝে থাকে খানিকক্ষণ। আমি কিন্তু পুরোপুরি জেগে উঠলাম-মনে হতে থাকে ভয়ানক কোনো ব্যাপার হয়েছে এই ঘরে।

আমি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করি। আধো অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না, কিন্তু অস্পষ্ট বোঝা যায় মশারির ভিতরে নুরুল সোজা হয়ে বসে আছে। যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য সেটা হচ্ছে মশারির বাইরে আরেকজন-চেহারা বা অবয়ব দেখা যায় না কিন্তু বোঝা যায় একটি মানুষ। অস্বস্তিকর মিষ্টি সেই গন্ধে নিঃশ্বাস নেওয়া যায় না। ঘরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা-তার মাঝে আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলাম। শুনলাম, নুরুল কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমি যেতে চাই না যেতে চাই না।

বাইরে দাঁড়ানো লোকটি নড়ে উঠল আর মনে হলো যেন বাতাসে ভেসে ওপরে উঠে গেল খানিকটা। আবার দুলে দুলে নেমে এলো নিচে। তারপর খসখসে শুষ্ক একটা গলার স্বর শুনতে পেলাম, অনেক চিৎকার করে মানুষের গলা পুরোপুরি ভেঙে গেলে যেরকম একটা আওয়াজ বের হয় অনেকটা সেরকম। কথাগুলি বোঝা গেল না, মনে হলো দুর্বোধ্য কিছু শব্দ। আমার পরিচিত কোনো ভাষা এটি নয়। নুরুল কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারল সেই কথা। কারণ শুনলাম, অনুনয় করে বলল, না না না-আমি চাই না। চাই না।

শুষ্ক ধাতব সেই কণ্ঠস্বর হঠাৎ যেন প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়ল আর সাথে সাথে নুরুল প্রায় গুঙ্গিয়ে গুঙ্গিয়ে বলল, ঠিক আছে ঠিক আছে, আমি আসছি।

দেখলাম মশারির ভিতর নুরুল নড়ে উঠল, তারপর হঠাৎ কাতর স্বরে কেঁদে উঠল।

প্রচণ্ড আতঙ্কে আমার বোধশক্তি প্রায় পরোপুরি লোপ পেয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারছি আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে, মনে হতে থাকে নুরুল যদি মশারির ভিতর থেকে বের হয়ে আসে, ভয়ানক কিছু একটা ঘটে যাবে, তাকে মেরে ফেলবে এই অশরীরী প্রাণী। কিন্তু নুরুলের নিজের ওপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই-আমি স্পষ্ট দেখছি গুঙ্গিয়ে গুঙ্গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মশারির ভিতর থেকে বের হয়ে আসছে নুরুল।

আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকি, কী হবে এখন? কী হবে? বুকের ভিতর হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে আমার। অশরীরী প্রাণী কি শুনতে পাচ্ছে আমার হৃদস্পন্দন? আসবে কি এখন আমার কাছে? আমার ভিতর হঠাৎ কী হলো জানি না, উঠে লাফিয়ে বসে হঠাৎ গলা ফাটিয়ে অমানুষিক স্বরে চিৎকার করে উঠলাম, না নুরুল না-না। সাথে সাথে প্রচণ্ড একটা ধাক্কায় আমি ছিটকে পড়লাম বিছানার ওপর। কিছু একটা ধাক্কা দিয়ে আমাকে ফেলে দিয়েছে। আমি চোখ খুললাম, বুকের ওপর কিছু একটা বসে আছে আমার, ছোটখাটো শিশুর মতো একটা প্রাণী। মুখের কাছে মুখ এনে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না, কিন্তু বোঝা যায় প্রচণ্ড আক্রোশ সেই দৃষ্টিতে। মানুষের মতো কিন্তু ঠিক মানুষ নয়–

প্রচণ্ড চিৎকার করে আমি জ্ঞান হারালাম।

রাত দুটোর সময় টিপু আবার গিয়ে হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্টকে ঘুম থেকে তুলেছিল।

আমার ধারণা সে রাতে আমিই নুরুলের প্রাণ বাঁচিয়েছিলাম। নুরুলও সেটা বিশ্বাস করে, কিন্তু তবু সে আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করে নি। কারণ সে ঘটনার পর আমাদের দুজনকে হোস্টেল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সেজন্যে সে আমাকেই দায়ী মনে করে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *