গাড়ি
আমি তখন নতুন আমেরিকায় এসেছি। সিয়াটল নামে একটি শহরে থাকি। সিয়াটল একেবারে একটা ছবির মতো শহর-নীল হ্রদ, সবুজ চিরহরিৎ গাছ আর তুষারে-ঢাকা পাহাড় দিয়ে ঘিরে রয়েছে শহরটি। দেখে মন জুড়িয়ে যাওয়ার কথা। আমার কিন্তু একেবারেই দম বন্ধ হয়ে আসার অবস্থা। না, শহরটির কোনো দোষ নেই, দোষ আমার কপালের, পুরো শহরে তখন বাঙালি বলতে আমি একা। দেখে বাঙালি মনে হয় ওরকম মানুষ দেখলেই আমি তখন ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ভাই, আপনি বাংলা জানেন? দেখা যায়। তাদের কেউ শ্রীলংকার মানুষ, কেউ-কেউ দক্ষিণ ভারতীয়। একজন আবার বের হলো মাদাগাস্কার। সারাদিন কাজকর্ম করে রাতে যখন বাসায় ফিরে আসি, তখন মাঝে মাঝে মনে হয় ডাক ছেড়ে কাদি। তখন মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছি ধারকর্জ করে প্লেনের টিকিটের টাকাটা তুলে ফেলেই দেশে চলে যাব। মাসখানেকের বেশি এ দেশে থাকছি না। মানুষ বড় বিচিত্র জীব, তিন মাসের মাথায় আবিষ্কার করলাম-বাংলায় কথা না বলার কষ্টটা সয়ে এসেছে। নিজে রান্না করা শুরু করেছি। গরম ভাতে আলুভর্তা আর মাখন দিয়ে খেতে একেবারে অমৃতের মতো লাগে। একটি চীনে দোকান আবিষ্কার করলাম, সেখানে আবার কাঁচামরিচও পাওয়া যায়। আলুভর্তায় কাঁচামরিচ কুচি করে দিয়েই নিজের রান্নার ওপর আত্মবিশ্বাস দশগুণ বেড়ে গেল।
এভাবে বছরখানেক পার হয়ে গেল। বাঙালি ছেলে, কোনোরকম বদঅভ্যাস নেই, মদ-গাঁজা খাই না, ঊনষাট ডলার ভাড়া দিয়ে একটা খুপরিতে থাকি। মাসের শেষে বেতনের যে পরিমাণ টাকা পাই পুরোটাই বেঁচে যায়। ছয় মাসের মাথায় আবিষ্কার করলাম ব্যাংকে প্রায় সাতশো ডলার জমা হয়ে গেছে। দেশের টাকায় হিসাব করলে আমি তখন রীতিমতো বড়লোক। ঠিক তখন একটা গাড়ি কিনে ফেললাম।
গাড়ি কেনার আমার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। চালাতে পারি না কিছু না, গাড়ি দিয়ে আমি কী করব? কিন্তু তবু গাড়ি কিনে ফেললাম। কেন কিনলাম সেটা এখনও আমার নিজের কাছেই পরিষ্কার নয়। সম্ভবত দেশে আজীবন মধ্যবিত্ত পরিবারে মানুষ হয়েছি, গাড়ি যারা চড়ে তাদের দূর থেকে দেখে এসেছি, সব সময়েই ভেবে এসেছি যারা গাড়ি চড়ে তারা বুঝি অন্য জগতের মানুষ, পৃথিবীর সব সুখ বুঝি তাদেরই। তাই যখন হঠাৎ করে দেখলাম আমার কাছে যে টাকা আছে সেটা দিয়ে একটা গাড়ি-পুরনো হলেও সত্যিকারের গাড়ি, কিনে ফেলা যায়, আমি আর দেরি করলাম না।
আমার এক বন্ধু সেটা চালিয়ে আমার বাসার সামনে এসে রেখে গেল। আমি সকাল-বিকাল সেটাকে দেখি, ঝেড়ে-পুছে রাখি। সময় পেলেই ভিতরে বসে থাকি। ভিতরে একটা রেডিও আছে, সেটা চালিয়ে আবহাওয়ার খবর শুনি।
গাড়ি চালানো শিখে নিতে হলো তাড়াতাড়ি। ঘরের সামনে। একটা ঢাউস গাড়ি পড়ে আছে, আমি শুধু ভিতরে বসে রেডিওটা চালিয়ে গান শুনি, ব্যাপারটাতে কেমন জানি একটা হাস্যকর দিক আছে। আমার আমেরিকান বন্ধুরা কয়েকজন মিলে আমাকে গাড়ি চালানো শিখিয়ে দিল। প্রচণ্ড ধৈর্য তাদের, আমি লিখে দিতে পারি, কোনো বাঙালি বন্ধু আমাকে সেটা শেখাতে পারত না। ফজলুল হক হলে যখন থাকতাম, একবার ব্রিজ খেলা শেখার চেষ্টা করেছিলাম। ভুল ডাক দিয়েছিলাম বলে বন্ধুর কাছে এমন গালি শুনেছি যে, ব্রিজ খেলাতেই ঘেন্না ধরে গেছে, খেলাটাই আর শেখা হলো না।
গাড়ি চালানো শেখার পর প্রথম প্রথম কয়দিন একটু ভয়ে ভয়ে চালাতাম। সব সময়ে মনে হতো অন্য সবাই বুঝি আমার গাড়ি চালানো দেখে হাসাহাসি করছে। কয়দিন পরেই
বুঝতে পারলাম আমাকে নিয়ে লোকজন মোটেই হাসাহাসি করছে না। অন্য দশটা গাড়িকে লোকজন যেভাবে দেখছে। আমাকেও ঠিক সেভাবেই দেখছে। কিছু একটা ভুল করে তাদের অসুবিধে করলে একটু বিরক্ত হতে পারে, কিন্তু হাসাহাসি কখনো করবে না। তখন আমার সাহস বেড়ে গেল। কাজ থেকে ফিরে এসে আমি গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যেতাম। কাজ নেই, কর্ম নেই, কোথাও যাবার উদ্দেশ্য নেই, শুধু গাড়ি চালানোর জন্যেই বের হওয়া। সস্তা গাড়ি, সেজন্যে গাড়িটা একটু বড়, পেট্রল লাগে বেশি। কিন্তু এখানে পেট্রল ভারি সস্তা। পেট্রলকে অবিশ্যি পেট্রল বলে না বলে গ্যাস-গ্যাসলিনের সংক্ষেপ। মাসখানেকের মাঝেই আমি গাড়ি চালানোতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। আমাকে দেখে কে বলবে, বছরখানেক আগেও আমি কয়বার গাড়িতে উঠেছি হাতে গুনে বলে দেওয়া যেত! বাঙালিদের থেকে আলাদা থেকে আমার আরও একটি পরিবর্তন হয়েছে, সেটা আমি তখনও জানি না। সেটা টের পেলাম একদিন দুপুরবেলা, যেদিন অফিসে আমার একটা ফোন এলো। ফোন ধরতেই শুনলাম একজন পরিষ্কার বাংলায় বলছে, জাফর ইকবাল সাহেব? আপনি কি বাংলাদেশের?
আমি বলতে চাইলাম, জি, আমি বাংলাদেশের। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, আমার মুখে বাংলা কথা আসছে না। ইংরেজিতে বললাম, হ্যাঁ, আমি বাংলাদেশের। অপর পাশে ভদ্রলোক ইংরেজি উত্তর শুনে কেমন জানি মিইয়ে গেলেন। আস্তে আস্তে বললেন, আপনি বাংলাদেশ থেকে কবে এসেছেন?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার আমার মুখ থেকে ইংরেজি বের হয়ে এলো। ভদ্রলোক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন আপনি বাংলায় কথা বলতে পারেন না?
আমি কাতর স্বরে প্রায় জোর করে প্রথমবার বাংলায় বললাম, পারি। তারপর ইংরেজিতেই বলতে হলো, আমি প্রায় এক বছর বাংলায় কথা বলি নি। তাই মুখে বাংলা আসছে না। একটু ধৈর্য ধরেন আপনি-আমি ঠিক বাংলায় কথা বলব।
সত্যি, তা-ই হলো। মিনিট দুয়েক পরে হঠাৎ করে মুখের বাঁধন খুলে গেল। আর আমার মুখে বাংলা কথা যেন খইয়ের মতো ফুটতে শুরু করল।
ভদ্রলোকের নাম আবিদ হাসান, একটা কনফারেন্সে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। কী একটা প্রাইজ পেয়েছেন, বিনয়ী ভদ্রলোক টেলিফোনে ঠিক পরিষ্কার করে বললেন না। প্রাইজ দেওয়ার জন্যে কনফারেন্সের লোকজন তাকে সপরিবারে এনেছে। ওয়াশিংটন প্লাজা নামে এখানকার সবচেয়ে ভালো হোটেলের একটা বড় সুইটে যত্ন করে রেখেছে। হাতখরচের জন্যে এত টাকা দিয়েছে যে তিনি নাকি দুই হাতে খরচ করেও শেষ করতে পারছেন আমাকে অবিশ্যি এসব বলার জন্যে ফোন করেন নি। অনেক খুঁজে-পেতে আমাকে বের করেছেন, এক সপ্তাহ হয়ে গেছে কোনো বাঙালি না দেখে নাকি হাঁপিয়ে উঠছেন, তাই। তার চেয়ে বড় কথা ভাত খাওয়ার জন্যে নাকি তার পুরো পরিবার প্রায় পাগল হয়ে উঠেছে। আমি কোন বাঙালি রেস্টুরেন্টের ঠিকানা জানি কি না আর তাদের সাথে সেই রেস্টুরেন্টে যেতে পারব কি না জানতে চাইলেন।
আমি বললাম, কোনো বাঙালি রেস্টুরেন্টের কথা আমার জানা নেই। কিছু ভারতীয় রেস্টুরেন্ট চিনি। যদি আপত্তি না থাকে আমার বাসায় এলে ভাত রান্না করে খাওয়াতে পারি। ভদ্রলোক ভদ্রতা করে যেটুকু আপত্তি করতে হয় তার বেশি না করেই রাজি। হয়ে গেলেন। আমি আমার গাড়ি করে নিয়ে আসতে চাইলাম, তিনি বললেন, তার প্রয়োজন নেই। একটা ট্যাক্সি করে চলে আসবেন।
আমি প্রফেসরকে বলে সকাল-সকাল বাসায় চলে এলাম। একা মানুষ ঊনষাট ডলারের একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্টে থাকি। সে অ্যাপার্টমেন্টের যা অবস্থা, আগে গিয়ে পরিষ্কার না করলে কারও ঢোকার সাধ্যি নেই! আগে দোকান থেকে একটু বাজার করে আনলাম, বাসায় প্রথমবার অতিথি আসছে, তাও বাঙালি অতিথি, একটু যত্ন তো করতেই হয়।
ঘরদোর পরিষ্কার করে কিনে-আনা মুরগি কেটেকুটে পরিষ্কার করতে করতে দরজায় শব্দ হলো। খুলতেই দেখি একজন বাঙালি ভদ্রলোক তার স্ত্রী আর ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
ভদ্রলোক হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে বললেন, আমি আবিদ হাসান, আপনি নিশ্চয়ই জাফর ইকবাল? এই আমার স্ত্রী রুখসানা আর আমাদের মেয়ে রুণু। জোর করে আপনার বাসায় খেতে চলে এলাম। বাঙালির কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কী আশা করবেন?
আমি বললাম, কী যে বলেন আপনি! আমি এক বছরের ওপর কোনো বাঙালিকে দেখি নি। আজ আপনাদের দেখলাম। তাও ভেজাল বাঙালি নয়, একেবারে খাঁটি বাংলাদেশের বাঙালি।
বাচ্চা মেয়েটি তার মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, ভিতরে ঢুকে একটু অবাক চোখে এদিক-সেদিক তাকাল। আমি বললাম, আপনারা আসবেন জানলে ঘরদোর আরও আগে থেকে পরিষ্কার করে রাখতাম।
ভদ্রমহিলা বললেন, অনেক পরিষ্কার আছে, একা মানুষের বাসা এর চেয়ে পরিষ্কার থাকলে ভালো দেখায় না।
বললাম, বাঁচালেন আপনি। আপনারা একটু বসুন, আমি দেখতে দেখতে রান্না শেষ করে ফেলব। খেতে পারবেন কিনা জানি না, কিন্তু রান্না হয়ে যাবে।
ভদ্রমহিলা বললেন, ছিঃ! আপনি কী রাঁধবেন? এত তাড়াহুড়ো করে তাহলে এলাম কী জন্যে? কোথায় রান্নাঘর দেখিয়ে দিন আমাকে।
আমার কোনো আপত্তি না শুনে তিনি কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে রান্না শুরু করে দিলেন। আমি যে খুব আপত্তি করেছিলাম সেটা দাবি করব না, একজন বাঙালি মহিলার রান্না কতকাল খাই না! হেলা করে সে সুযোগ নষ্ট করার কী অর্থ হতে পারে?
বসার ঘরে আমি ভদ্রলোক আর তার মেয়ের সাথে কথাবার্তা বলতে থাকি। দেখা গেল ছেলেবেলায় তিনি আমার স্কুলে বছরখানেক পড়াশোনা করেছিলেন, আশ্চর্যের ব্যাপার, আমার
অঙ্ক-স্যার নাকি তাকেও অঙ্ক করিয়েছেন!
ভদ্রলোকের মেয়েটি ভারি মিষ্টি। এ দেশের বাচ্চাদের মতো ডানপিটে নয়। কেমন জানি একটা বাঙালিসুলভ কোমলতা আছে। আমি ছোট বাচ্চাদের সাথে ঠিক করে কথাবার্তা বলতে পারি না। ছোট বাচ্চারা যেটুকু বুঝতে পারে বলে আমার ধারণা, দেখেছি তারা তার থেকে ঢের বেশি বোঝে। নেহাত প্রয়োজন না হলে আমি ছোট বাচ্চাদের ধারেকাছে ঘেঁষি না। এ বাচ্চাটির বেলায় কিন্তু কীভাবে কীভাবে জানি আমার খুব ভাব হয়ে গেল। খুব সুন্দর কথা বলে মেয়েটি। কোনো পাকামো নেই, একটা শিশুসুলভ সরলতা আছে। তার সাথে কথাবার্তা হলো এরকম:
ইকবাল চাচা, আপনি রান্না করতে পারেন?
একটু একটু পারি।
আব্বু তো পারে না।
তোমার আম্মু নিশ্চয়ই খুব ভালো রান্না করতে পারে, সেজন্যে তোমার আব্বু শেখে নি।
খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, আপনার বউ নেই?
না।
আপনার যখন বউ হবে, সে কি আপনার থেকে ভালো রান্না করবে?
সেটা তো এখনও জানি না। তোমার কী মনে হয়?
মনে হয় পারবে না। আপনার তো অনেক বেশি প্র্যাকটিস।
তা ঠিক।
অনেকদিন পর খুব ভালো করে খেলাম। রুখসানা ভাবী খুব ভালো রান্না করেন। নিজের রান্না খেয়ে প্রায় ভুলেই যাচ্ছিলাম ভালো খাওয়া কাকে বলে। খাওয়ার পর দীর্ঘ সময় গল্পগুজব হলো। রুণু আমার গাঘেঁষে বসে থেকে আমাদের গল্প শুনতে শুনতে একসময় আমার পায়ের ওপর ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমন্ত শিশুর মুখে এত নিষ্পাপ একটা ভাব থাকে আমার জানা ছিল না। বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে কেন জানি আমার বুকের ভিতর মমতায় টনটন করতে থাকে।
অনেক রাতে তারা উঠলেন। ট্যাক্সি নিয়ে চলে যেতে চাইছিলেন, আমি তাদের রাজি করিয়ে গাড়ি করে তাদের হোটেলে পৌঁছে দিলাম। রুণু ঘুমিয়ে একেবারে কাদা হয়েছিল, কিন্তু গাড়িতে ওঠামাত্র হঠাৎ করে পুরোপুরি জেগে উঠল। তার মা চেষ্টা করলেন আবার তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে, কিন্তু সে আর ঘুমাল না। পেছনের সিটে জ্বলজ্বলে চোখে চুপচাপ বসে রইল। সারা সন্ধ্যে আমার সাথে কথা বলেছে, কিন্তু এখন কেন জানি সে আর একটি কথাও বলল না। ওয়াশিংটন প্লাজাতে নামিয়ে দেওয়ার পর দেখলাম, সে তার বাবার ঘাড়ে মাথা রেখে আবার ঘুমিয়ে গেছে। বাচ্চা মেয়ের ওপর সারাদিন নিশ্চয়ই খুব ধকল গেছে।
পরদিন খুব সুন্দর রোদ উঠল। দেশের লোকজন রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের কদর করে না। প্রতিদিনই রোদ উঠলে কদর করবেই-বা কেন? সিয়াটল শহরে সমুদ্রের জোলো হাওয়ার স্পর্শ, প্রায়দিনই থমথমে বৃষ্টি, তাই হঠাৎ করে রোদ উঠলেই কেন জানি ভালো লাগতে থাকে। এ শহরে সুন্দর দিনে আরও একটি ব্যাপার ঘটে, শখানেক মাইল দূরে মাউন্ট রেইনিয়ার নামে একটি পর্বতের চুড়ো আছে, সেটি দেখা যায়। ভারি সুন্দর সেই পাহাড়ের চুড়ো। আজও সেটা দেখা যেতে লাগল, ঝকঝকে পাহাড়ে ধবধবে সাদা বরফের আভরণ, অপূর্ব একটি দৃশ্য! এমন দিনে কাজ করতে ইচ্ছে করে না। খোঁজ নিয়ে জানলাম, আমার প্রফেসর আজকে আসেন নি। ফাঁকি দেওয়ার জন্যে এর চেয়ে ভালো দিন আর কোথায় পাওয়া যায়? বের হবার আগে আমি আবিদ সাহেবের হোটেলে ফোন করলাম। ভাবী ফোন ধরলেন, আবিদ সাহেব কনফারেন্সে বের হয়ে গেছেন, ভাবি তার মেয়েটিকে নিয়ে বের হবেন, একটু হাঁটাহাঁটি করবেন। আমি জানতে চাইলাম তারা কোথাও যেতে চান কি না, আমি নিয়ে যেতে পারি। শুনে ভাবী খুব খুশি হয়ে উঠলেন। তিনি কোথাও একা একা যেতে চান না, এ দেশে হাঁটাহাঁটি করতে তার নাকি ভয় করে।
তাদের নিয়ে আমি একটু ঘোরাঘুরি করলাম। ভাবী একটু কেনাকাটা করলেন, মেয়েটি আমার হাত ধরে আপনমনে কথা বলে যেতে থাকে, ভারি ভালো লাগে শুনতে। চোখ বড় বড় করে হাঁটতে থাকে, এক জায়গায় রাস্তার মোড় ঘুরতেই হঠাৎ আবার দূরে মাউন্ট রেইনিয়ারকে দেখা গেল। মেয়েটি আগে কখনো পাহাড় দেখে নি, জিজ্ঞেস করলাম, রুণু, যাবে তুমি মাউন্ট রেইনিয়ার দেখতে?
মেয়েটির চোখ বড় বড় হয়ে যায়, কাছে থেকে?
হ্যাঁ।
একেবারে অনেক কাছে থেকে?
হ্যাঁ।
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে মেয়েটির মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আম্মা, যাবে? ভাবী কিছু বলার আগেই আমি বললাম, চলুন ভাবী, আপনাদের নিয়ে যাই। মাত্র একশো মাইল এখান থেকে। পাহাড়ি রাস্তা তাই একটু সময় নেবে তবু তিন ঘণ্টায় পৌঁছে যাব।
রুণু তার মার হাত ধরে লাফাতে থাকে, চলো মা যাই। চলো মা যাই।
ভাবী একটু দোটানায় পড়ে গেলেন, যাবার ইচ্ছে আছে, কিন্তু এভাবে হঠাৎ করে এতদূর যাবার সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। রুণুকে শান্ত করার জন্যে বললেন, তোর আব্বা আসুক, জিজ্ঞেস করে দেখি।
আমরা সবাই মিলে ফিরে এলাম হোটেলে আবিদ হাসানের জন্যে। আবিদ হাসান না এসে একটা টেলিফোন করলেন, কী নাকি কাজ পড়েছে, আসতে দেরি হবে। রুণু মাউন্ট রেইনিয়ার যেতে চাইছে শুনে ভাবীকে বললেন ওকে নিয়ে চলে যেতে, আমার যদি কোনো অসুবিধা না হয়।
ভাবী খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, গাড়িতে চড়লেই তার একটু পরে।
পেট্রলের গন্ধে কেমন জানি বমি-বমি লাগতে থাকে। আমায় বললেন রুণুকে নিয়ে চলে যেতে। আমাকে জ্বালাতন করতে পারে, আগে থেকে সাবধান করে দিলেন। সেটা শুধু কথার কথা। রুণু চমৎকার মেয়ে, জ্বালাতন করা শেখে নি। আমার সাথে মাত্র একদিনের পরিচয়, আমাকে এভাবে বিশ্বাস করে বাচ্চা মেয়েটিকে সারাদিনের জন্যে ছেড়ে দেওয়ায় আমি খানিকটা অভিভূত হয়েছি সত্যি, কিন্তু আমি ঠিক এভাবে রুণুকে নিয়ে যেতে চাইছিলাম না। সাথে অভিভাবক থাকলে ভালো হয়, শিশুদের নিয়ে আমার একেবারে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু রুণুর প্রবল উৎসাহে আমি আর না করতে পারলাম না।
আমি দেরি না করে রুণুকে নিয়ে তখন-তখনই রওনা হয়ে গেলাম। মেয়েটির খুশি দেখে কে! বরফে পাহাড় ঢাকা দেখবে কাছে থেকে, এর থেকে উত্তেজনার ব্যাপার একটা বাচ্চা মেয়ের জন্যে আর কী হতে পারে? রুণুর একটানা কথা শুনতে শুনতে তাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। গাড়িতে ওঠার সাথে সাথে একটা আশ্চর্যের ব্যাপার ঘটল, মেয়েটি হঠাৎ চুপ করে গেল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম সে কেমন যেন জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার মনে পড়ল কাল রাতেও গাড়িতে উঠে সে ঘুম ভেঙে জ্বলজ্বলে চোখে বসে ছিল। আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, রুণু, কী হয়েছে?
সে কোনো কথা বলল না, আবার জিজ্ঞেস করতেই মাথা নেড়ে ইংরেজিতে বলল, কিছু হয় নি।
তার ইংরেজি কথাটির কেমন জানি অদ্ভুত শোনাল আমার কানে। গত দুদিনে তাকে একবারও একটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে শুনি নি। বাচ্চা মেয়েটির মুখে স্পষ্ট বাংলা কথা গত দুদিন আমার কানে প্রায় মধুবর্ষণ করে এসেছে। শুধু তাই-নয়, এ মুহূর্তে সে যে ইংরেজি কথাটি বলেছে, তার উচ্চারণ বিশুদ্ধ আমিরিকান উচ্চারণ। আমি আড়চোখে রুণুকে একবার দেখে গাড়ি ছেড়ে দিলাম। ছোট বাচ্চাদের বোঝা খুব মুশকিল। শহরের ভিড় কাটিয়ে ফ্রি ওয়েতে উঠে গাড়ি ছোটালাম দক্ষিণে।
খানিকক্ষণ চেষ্টা করার পর আবার রুণু একটু স্বাভাবিক হয়ে আসে। কথাবার্তা শুরু করে, কিন্তু আমি একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম। তার কথাবার্তা আর যেন বাচ্চার কথাবার্তা নয়। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, কথা বলতে বলতে সে আমাকে ইকবাল চাচা না বলে ডেভিড চাচা বলে ডাকতে থাকে। আমি দুবার শুনে তৃতীয়বার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, রুণু, তুমি আমাকে ডেভিড চাচা ডাকছ?
সে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
রুণু আমার দিকে তাকিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল, কারণ তুমি ডেভিড আইমেল।
শুনে আমি চমকে উঠলাম, আর হঠাৎ কেন জানি ভয় লাগতে থাকে। আস্তে আস্তে বললাম, রুণু, তুমি এসব কী বলছ?
মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, হঠাৎ তাকে খুব বিষণ্ণ দেখাতে থাকে। একটু পর দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, ইকবাল চাচা, আমার এরকম লাগছে কেন?
কীরকম লাগছে?
জানি না-সে আরও জোরে জোরে কেঁদে ওঠে।
আমি গাড়ি চালাতে চালাতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলি, রুণু, চলো আমরা ফিরে যাই আজ। আরেক দিন আমরা সবাই মিলে মাউন্ট রেইনিয়ারে যাব। ঠিক আছে?
সে মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, না, আজকেই যাব ইকবাল চাচা।
আজকেই যেতে চাও?
হ্যাঁ।
গাড়ি থেকে নেমে একটু হাঁটতে চাও?
রুণু খুব খুশি হয়ে বলল, হা হা।
বললাম, পেট্রল নেবার জন্যে যখন থামব, তখন তুমি একটু হেঁটে নিও।
রুণু বলল, আর দুই মাইল পরেই পেট্রল স্টেশন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি কী করে জানো?
রুন খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, আমি জানি।
আমি আশা করছিলাম যে দুই মাইল পরে দেখা যাবে কোনো পেট্রল পাম্প নেই, রুণু এমনি কথাটা বলেছে। কিন্তু অবিশ্বাস্য ব্যাপার, ঠিক দুই মাইলের মাথায় একটা পেট্রল পাম্প দেখা গেল। ঠিক জানি না কেন, রুণুর দিকে তাকিয়ে কেন জানি আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
গাড়ি থেকে নেমেই কিন্তু রুণু অন্য মানুষ। ঠিক আগের মতো করে হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে ছুটোছুটি করতে থাকে। কে বলবে গাড়িতে একটু আগে সে এরকম অদ্ভুত ব্যবহার করেছিল! আমার মনটা হালকা হয়ে আসে।
মিনিট দশেক পর রুণুকে ডেকে বললাম, চলো, গাড়িতে ওঠো।
সে সাথে সাথে কেমন জানি বিবর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু কোনো কথা না বলে খুব ধীরে ধীরে গাড়িতে উঠে বসে। আমি দেখলাম, সে শক্ত কাঠ হয়ে গাড়িতে বসে আছে, চোখ দুটি আবার আগের মতো জ্বলজ্বলে।
মাউন্ট রেইনিয়ারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা তিনটা বেজে গেল। যদি ছুটির দিন হতো, এখানে তিলধারণের জায়গা থাকত আজ কিন্তু সেরকম ভিড় নেই। গাড়িটা এক জায়গায় পার্ক করে আমি রুণুকে নিয়ে নামলাম। নেমে রুণুর খুশি দেখে কে! মাউন্ট রেইনিয়ার এত সুন্দর একটি পাহাড়, যে না দেখেছে তাকে। বোঝানো সম্ভব নয়। পাইনগাছের সারির পেছনে ধবধবে সাদা বরফের হিমবাহে ঢাকা একটি অপূর্ব পাহাড়। পাহাড়ের চুড়ায়। একটি মেঘ আটকে রয়েছে, যেন যাই-যাই করেও যেতে পারছে না।
আমি রুণুকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে বেশ খানিকটা ওপরে উঠে গেলাম। রুণু কখনো তুষার দেখে নি। মাইলখানেক হেঁটে গেলে তুষার দেখা যায়। রুণু যেতে পারবে কি না নিশ্চিত ছিলাম না, কিন্তু সে দিব্যি হেঁটে গেল। পাহাড়ের পাদদেশে ধবধবে সাদা বরফ দেখে তার খুশি দেখে কে! বরফে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে খেলে তার আর আশ মেটে না। ভাবী তাদের ক্যামেরাটি হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা দিয়ে তার ছবি তুলে পুরো ফিল্মটা শেষ করে ফেললাম। বেলা পড়ে যাচ্ছিল, একটু আগেও রোদে বেশ তাপ ছিল, এখন হঠাৎ করে ঠাণ্ডা পড়ে যেতে থাকে। আমাদের সাথে সেরকম গরম কাপড় নেই। আমি রুণুকে নিয়ে ফিরে আসতে থাকি। রুণুর নানা কিছু নিয়ে কৌতূহল, আসতে আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওনা হওয়ার আগে ক্যাফেটেরিয়াতে কিছু খেয়ে নিলাম। আজকাল বাইরে খেতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না, রুণু বেচারি অবিশ্যি বেশি সুবিধা করতে পারল না। রাতের খাওয়া সারল খানিকটা আলুভাজা-অজ্ঞাত কারণে একে বলা হয় ফ্রেঞ্চফ্রাই, আর একটা আইসক্রিম দিয়ে।
গাড়ির কাছাকাছি এসে রুণু হঠাৎ কেমন জানি বিবর্ণ হয়ে যায়। আমার হাত ধরে বলল, আমি গাড়িতে উঠতে চাই না ইকবাল চাচা।
আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, কেন রুণু?
আমার ভালো লাগে না।
কেন?
আমি জানি না।
ওকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে গাড়িতে তুললাম। গাড়িতে উঠেই সে শান্ত হয়ে গেল, আবার জ্বলজ্বলে চোখে সোজা হয়ে কাঠের মতো বসে রইল, মুখে আর একটি কথাও নেই। আমি স্টার্ট নেবার আগে সে হঠাৎ পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল, রাস্তায় একটু থেমো ডেভিড।
আমার হঠাৎ কী মনে হলো জানি না, ড্যাশবোর্ডটা খুলে গাড়ির পুরনো কিছু কাগজপত্র বের করলাম। আগের মালিকের নাম-ঠিকানা লেখা একটি পুরনো রেজিস্ট্রেশন ফরম দেখেছিলাম একসময়। ফরমটি খুঁজে পেলাম, সেখানে গাড়ি আগের মালিক হিসেবে দুজনের নাম লেখা রয়েছে, ডেভিড আইমেল এবং তার স্ত্রী ক্যাথি আইমেল। আমি কাগজগুলি তুলে রেখে ভয়ে ভয়ে রুণুর দিকে তাকালাম। সে জ্বলজ্বলে চোখে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে তাকাতে দেখে ইংরেজিতে বলল, চলো, ডেভিডকে রাস্তা থেকে তুলে নিতে হবে।
ডেভিডকে?
হ্যাঁ।
ডেভিড কে?
ডেভিড আইমেল।
আমি জানি খুব নির্বোধের মতো হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা। তবু জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, তোমার নাম কি রুণু?
রুণু শান্ত স্বরে বলল, ক্যাথি। ক্যাথি আইমেল।
আমি নিঃশ্বাস আটকে রেখে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। খোদা, ভালোয়-ভালোয় পৌঁছে দাও আমাকে এবারে।
পাহাড়ে হঠাৎ অন্ধকার নেমে আসে, এবারও তা-ই হলো, হঠাৎ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো। গাড়ির হেডলাইট ছাড়া আর কোনো আলো নেই, আঁকাবাঁকা রাস্তায় সেই আলো যেন অন্ধকারকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে গাড়ি ছুটিয়ে নিতে থাকি।
পাশের সিটে রুণু বসে আছে চুপচাপ। আমি শুনতে পাই আস্তে আস্তে সে যেন কেমন টেনে টেনে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করেছে। আমি আড়চোখে দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। আস্তে আস্তে ডাকলাম, রুণু
কোনো উত্তর নেই।
গলা উঁচিয়ে বললাম, রুণু, কী হয়েছে তোমার?
হঠাৎ রুণু তীব্রস্বরে চিৎকার করে ইংরেজিতে বলল, চুপ করো নির্বোধ কোথাকার। আমি চমকে উঠি, গলার স্বরটা অচেনা, তীক্ষ্ণ রিনরিনে একটি গলার স্বর। আমি একটি কথাও না বলে গাড়ির এক্সেলেটারে চাপ দিই। আশেপাশে কোনো জনমানুষ নেই, দুই পাশে ঘন জঙ্গল। আমি গুলির মতো ছুটছি, হঠাৎ করে একটা আতঙ্ক এসে ভর করেছে আমার ওপর।
হঠাৎ রুণু আবার রিনরিনে গলার স্বরে চিৎকার করে ওঠে, থামাও, গাড়ি থামাও।
কেন?
ডেভিডকে তুলতে হবে।
কোথায় ডেভিড?
ওই যে–
হাত তুলে দেখায় সে, আর আতঙ্কিত হয়ে দেখি দূরে রাস্তার পাশে সত্যি ছায়ার মতো কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। আমি দাঁতে দাঁত কামড়ে এক্সেলেটারে চাপ দিলাম, পাহাড়ের বাঁকে আশি মাইলে গাড়িটা ঘুরে বের হয়ে গেল। শুনতে পেলাম রুণু তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে ড্যাশবোর্ডে মাথা ঠুকতে শুরু করেছে। মুখ থেকে অশ্রাব্য ইংরেজি গালি বের হয়ে এলো তার। প্রলাপের মতো কথা বলতে বলতে ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদতে থাকল সে।
দূরে হঠাৎ সেই পেট্রল পাম্পটি দেখতে পেলাম। আমার বুকে সাহস ফিরে এলো। কাছে এসে দেখি পেট্রল পাম্পটি বন্ধ করে লোকজন চলে গেছে। গাড়িটি না থামিয়ে আবার সোজা পথে উঠে পড়লাম। রুণু হঠাৎ করে কান্না থামিয়ে সামনের দিকে তাকাল। তারপর ফিসফিস করে বলল, ডেভিড।
আমি ঢোঁক গিলে বললাম, কোথায়?
সামনে। গাড়ি থামাবে তুমি?
এক্সেলেটারে চাপ দিলাম আমি, গাড়ির গতি হঠাৎ বেড়ে গেল। দূরে দেখতে পেলাম রাস্তার পাশে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে সে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়াল, দুহাত ওপরে তুলল অনেকটা আশীর্বাদের মতো।
প্রাণপণে হর্ন দিলাম আমি, কিন্তু লোকটি দাঁড়িয়েই রইল। পাশ কাটিয়ে যাব কি আমি? একটু অসতর্ক হলে অতল খাদে। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। প্রায় চোখ বন্ধ করে পাশ কাটিয়ে গেলাম আমি, সমস্ত স্নায়ু টানটান হয়েছিল কোনো একটি আঘাতের জন্যে। কিন্তু কিছু হলো না। আমি নিঃশ্বাস আটকে রুণুর দিকে তাকালাম, সে কি আবার অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে শুরু করবে?
রুণু কিছু বলল না। আমার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ, তারপর বলল, আমি এখন যাব।
কোথায়?
ডেভিডের সাথে।
আমি কোনো উত্তর দিলাম না।
রুণু আবার বলল, আমি এখন যাব ডেভিডের সাথে। তুমি ডেভিডকে তার গাড়ি চালাতে দাও।
আমি কোনো কথা বললাম না।
দাও ডেভিডকে।
কোথায় ডেভিড?
এই তো। রুণু হাত দিয়ে পেছনে দেখায়।
আমি দেখব না দেখব না করেও পেছনে তাকাই। আবছা অন্ধকারে দেখতে পাই গাড়ির পেছনের সিটে কে যেন বসে আছে, মাথার চুল ভেজা, চোখ দুটিতে স্থির দৃষ্টি।
চিৎকার করে সামনে তাকাতেই দেখি গাড়িটি তাল হারিয়ে ঘুরে যাচ্ছে। পেছন থেকে কে যেন খলখল করে হাসতে শুরু করল হঠাৎ।
কী যেন হঠাৎ একটা ঘটল আমার, মনের ভিতরে কে যেন বলল, বাঁচতে হবে, তোমার বাঁচতে হবে যেভাবে হোক বাঁচতে হবে। ব্রেকে পা দিলাম প্রাণপণে, প্রচণ্ড শব্দ করে গাড়িটা তাল হারিয়ে ঘুরে গেল, কোথায় জানি ধাক্কা লাগে একবার, তারপর আরেকবার, তারপর আরেকবার। গাড়িটা পুরোপুরি উল্টে যায়, এবারে, পড়ে যাচ্ছে অতল খাদে। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে গাড়িটা থেমে গেল। ইঞ্জিনটা চলছে তখনও। উচ্চস্বরে কে যেন হাসছে। গাড়ির পেছনে, রুণু প্রাণপণে চিৎকার করছে, ডেভিড, আমার ডেভিড–
প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে কোথায় যেন, ধরতে পারছি না, কিন্তু যন্ত্রণায় নিঃশ্বাস নিতে পারছি না আমি। সারা গাড়ি ভরে যাচ্ছে ধোঁয়ায়। এখন কি প্রচণ্ড বিস্ফোরণে উড়ে যাবে এই গাড়ি? জ্ঞান হারাচ্ছিলাম আমি, কিন্তু অনেক কষ্ট করে একটা ঘোরের মাঝে থেকে ফিরে এলাম। বাঁচতে হবে আমাকে, রুণুকেও বাঁচতে হবে। হাতড়ে হাতড়ে রুণুকে খুঁজে বের করি পাশের সিটে, কোনোরকমে সিটবেল্ট খুলে তাকে টেনে আনি নিজের দিকে, তারপর দুজনে দরজা খুলে টেনেহিঁচড়ে বের হয়ে আসি গাড়ি থেকে। পেট্রলের তীব্র গন্ধ এসে লাগে নাকে। ইঞ্জিনটা চলছে কেন এখনও?
আমি রুণুকে জাপটে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে সরে যেতে থাকি, পায়ের কোথাও ভেঙে গেছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় জ্ঞান হারাব যে কোনো মুহূর্তে। তার মাঝে আমি সরে যেতে থাকি এই অশুভ গাড়ি থেকে, যতদূর সম্ভব। প্রায় দুশো ফুট দূরে গিয়ে আমি থামলাম, আর ঠিক তক্ষুনি গাড়িটাতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে আগুন ধরে গেল। আগুনের লকলকে শিখায় দেখতে পেলাম গাড়ির পেছনের সিটে বসে কে যেন উল্লাসে নৃত্য করছে। সত্যি দেখছি আমি, নাকি আমার চোখের ভুল?
রুণু হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, ইকবাল চাচা, তুমি কেন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে? কেন?
আমি তাকে ছেড়ে যাই নি, কিন্তু সেটা নিয়ে আর কথা বললাম না, শক্ত করে ধরে বললাম, আর কখনো তোমাকে আমি ছেড়ে যাব না, রুণু, কখনো যাব না।