Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আমরা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলেই রহমত চাচা আমাদের দেখতে আসতেন। লম্বা-চওড়া মানুষ, এ বয়সেও শরীর পাথরের। মতো শক্ত। আমরা তখন ছোট, আমাদের দু-তিনজনকে এক হাতে টেনে তুলে ফেলতেন ঘাড়ের ওপর। খাওয়ার সময় আমরা সবিস্ময়ে তাঁর খাওয়া দেখতাম-একজন মানুষ যে এত খেতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। খাওয়া শেষ হবার পর হাত ধুয়ে উঠে। পড়ছেন, তখন তার থালায় কেউ প্রায় এক গামলা ভাত ঢেলে দিত, সাথে সমান পরিমাণ মাছ, মাংস বা শুধু ডাল। খানিকক্ষণ চ্যাঁচামেচি করে আবার খেতে শুরু করতেন, দেখতে দেখতে সব শেষ হয়ে যেত। তার পেটে কোথায় যে এত জায়গা কে জানে। আমাদের খাওয়া দেখতেন আর মাথা নেড়ে বলতেন, এত কম খেয়ে থাকিস কেমন করে? কোনদিন তো বাতাসে উড়ে যাবি।

রহমত চাচার সবচেয়ে যেটা মজার সেটা হচ্ছে তার গল্প বলার ঢং। পড়াশোনা জানেন না, জীবনে কোনো বই পড়েন নি, তাই তার সব গল্পই নিজের জীবনের সত্যি গল্প। এমন স্বাভাবিক। গলার স্বরে এমন একটা অস্বাভাবিক গল্প বলে যেতেন যে শুনে আমরা হতবাক হয়ে যেতাম। যেমন : অমুক গ্রামের সব মানুষ চোর ছিল, মানুষেরা তাদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে পুলিশে খবর দিল। তখন ব্রিটিশের রাজত্ব, তারা এসে সবাইকে ধরে নিয়ে গেল, নেওয়ার সময় যদি কেউ পালিয়ে যায় তাই সবার হাতের তালু ফুটো করে তার ভেতর দিয়ে দড়ি ঢুকিয়ে সবাইকে একসাথে বেঁধে রেখেছিল। আমরা অবিশ্বাস করি কেমন করে, তাঁর নিজের চোখে দেখা। আরেকবার নারকেল নিয়ে কথা হচ্ছে, রহমত চাচা বললেন, কবে নাকি নারকেলগাছ থেকে নারকেল নামানো হয়েছে, নারকেল কেটে পানি গ্লাসে ঢালা হলো, দেখা গেল পানির ভেতর কুচো চিংড়ি, পানির সাথে মিশে আছে, ভালো করে না দেখলে দেখা যায় তার নিজের চোখে দেখা ঘটনা-আমরা কি বলব?

সবচেয়ে মজার ছিল তার ভূতের গল্পগুলি। যখন শুনেছি তখন অবিশ্যি মজার মনে হয় নি, ভয়ে হাত-পা শরীরের ভেতর সেঁধিয়ে গিয়েছিল। এজন্যে কখনো আমাদের সামনে ভূতের গল্প করতে চাইতেন না, ভূতের গল্প শুনে ভয় পেয়ে আমরা নাকি ভীতু হয়ে যাব। তাকে কিছুতেই বোঝানো যেত না যে ভয় পাওয়ার জন্যেই তো ভূতের গল্প শোনা, তাছাড়া আমরা তো এমনিতেই ভীতু, নতুন করে ভীতু হবার প্রশ্ন কোথায়? যখন বড়রা বসে গল্প করত, কথায়-কথায় ভূতের গল্প উঠে যেত, তখন রহমত চাচা একটা-দুটো ভূতের গল্প বলতেন। ভয়ংকর সব গল্প, শুনে হৃদস্পন্দন থেমে যেতে চায়। তার কাছ থেকে শোনা সবচেয়ে যেটা ভয়ের গল্প সেটা এরকম, তার নিজের ভাষাতেই বলি।

সে অনেকদিন আগের কথা, আমার বয়স তখন মাত্র পঁচিশ কি ছাব্বিশ। সে সময়ে আমাদের পাশের গায়ে রশীদ মিয়া নামে একজন লোক থাকত। এরকম বদমায়েশ লোক আমি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। এমনিতে তার সুদের কারবার ছিল, কিন্তু এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যেটা সে করে নি। লোকজনকে ফাঁকি দিয়ে তাদের জমি লিখে নেওয়া থেকে শুরু করে কমবয়েসি মেয়েদের জোর করে বিয়ে করে ফেলা, কিছুতেই তার আপত্তি নেই। শুকনো দড়ির মতো চেহারা, থুতনিতে অল্প কিছু দাড়ি, মাথায় টুপি, মুখে সব সময় পান, কষ বেয়ে পানের পিক পড়ছে, দাঁতগুলি লাল। সেই রশীদ মিয়াকে এক রাতে কারা এসে খুন করে গেল। বাজার থেকে ফিরে আসছিল, বাড়ির কাছে বাঁশঝাড়, তার কাছে আসতেই লাঠির এক আঘাতে মাথা দুর্ফাক। ধড়ফড় করতে করতে কিছুক্ষণের মাঝেই সে শেষ। মানুষ মারা গেলে খুশি হতে নেই, কিন্তু রশীদ মিয়া মারা গেলে তিন-চার গ্রামের অনেক মানুষ খুশি হয়েছিল।

পরদিন অনেক থানা-পুলিশ হলো। সদর থেকে দারোগা নিজে এলেন, লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কাগজপত্রে সবকিছু লিখে নিলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন রশীদ মিয়ার লাশ শহরে নিয়ে যেতে। খুনের মামলা-লাশ নাকি কেটে দেখতে হবে।

কে যাবে রশীদ মিয়ার লাশ নিয়ে? দুচোখের বিষ ছিল এলাকার সব লোকের, কারও এতটুকু গরজ নেই। গ্রামের মাতব্বরেরা তখন অনেক কষ্ট করে আমাদের কয়েকজনকে রাজি করালেন। জোয়ান বয়স তখন, ভাবলাম, কী আছে, নিয়ে যাই লাশটাকে। মরে যখন গেছে রাগ পুষে আর কী হবে? দুজন বলল, তারা যেতে পারে কিন্তু লাশ পৌঁছেই তাদের ফিরে আসতে হবে, বাড়িতে জরুরি কাজ। মাতব্বরেরা তাতেই রাজি, গরমের দিন লাশ বেশিক্ষণ ফেলে রাখা যায় না।

আমরা চারজন আর গ্রামের মাতব্বর, মোট পাঁচজন রওনা দিলাম শহরে। শুকনো টিংটিঙে রশীদ মিয়ার শরীর, কিন্তু কী ওজন, জান বের হয়ে গেল চারজন জোয়ান মানুষের! আমাদের মাঝে আফজালের বয়স কম, ভয় বেশি, একটু পরেপরে বলল, লাশ এত ভারী কেন? তেনারা ভর করেছেন নাকি? তেনারা কি না জানি না, কিন্তু চাটাই দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁশের সাথে বেঁধে লাশ আনতে আনতে আমাদের কালোঘাম ছুটে গেল।

নদীর একদিকে শহর, অন্যদিকে লাশকাটা ঘর। আশেপাশে ধানিজমি, মাঝখানে ছোট একটা লাল রঙের ঘর। চারপাশে বুনো জঙ্গল ঘরটাকে প্রায় ঢেকে রেখেছে। দরজায় তালা মারা ছিল, কিন্তু পুরানো জং-ধরা তালা ধাক্কা দিতেই নিজে থেকে খুলে গেল। ভিতরে উঁচু টেবিল, কংক্রিট দিয়ে লাশকাটা ঘরের সাথে পাকাপাকীভাবে তৈরি করা হয়েছে। টেবিলের ওপর রশীদ মিয়াকে রেখে আমরা বের হয়ে এলাম, ভিতরে কী বোটকা গন্ধ!

বাইরে এসে দেখি কিছু কুকুর। অদ্ভুত কুকুর সেগুলি, লাশকাটা ঘরের আশেপাশে থাকে, মানুষকে ভয় পায় না। বেওয়ারিশ লাশ নিশ্চয়ই জানাজা না পড়িয়েই আশেপাশে পুঁতে ফেলে। দেখলাম, কুকুরগুলি মাটি খুড়ে খুড়ে হাড়গোড় বের করছে। আমাদের দেখে সরে গেল না, উলটো আমাদের চোখের দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে রইল, ভাবখানা এই-লাশগুলি হেঁটে বেড়াচ্ছে কেমন করে? দেখে কেমন জানি ভয় লাগে।

যে দুজনের ফিরে যাবার কথা তারা একটু বিশ্রাম নিয়ে তাড়াতাড়ি রওনা দিয়ে দিল, বেশি রাত হবার আগেই তারা গ্রামে পৌঁছাতে চায়। আমরা বাকি তিনজন অপেক্ষা করছি, কিন্তু লাশ কাটার জন্যে ডাক্তার বা অন্য কেউ-ই আসে না। আবার রাত হয়ে গেলে মুশকিল, তাই আমাদের মাতব্বর ঠিক করলেন থানায় গিয়ে খোঁজ নেবেন। একা যেতে ভরসা পান না, গ্রামের মানুষ শহরে গেলে মানুষের ভিড়ে তাল হারিয়ে ফেলেন, সাথে আরেকজনকে নিয়ে যেতে হয়।

আফজাল কখনো শহর দেখে নি, আমি তাকে বললাম সাথে যেতে, শহরটা দেখে আসুক। মরা একটা লাশ তো পালিয়ে যাবে না, একজন থাকলেই হয়। ওই বাজে কুকুরগুলি না থাকলে পাহারা দেবারও দরকার ছিল না। আফজাল আমাকে একা রেখে যেতে ইতস্তত করছিল, জায়গাটা নাকি ভালো নয়। আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম, পরিষ্কার দিনের বেলা, চারপাশে ধানের ক্ষেতে চাষিরা কাজ করছে-ভয়ের কি আছে?

ওরা চলে গেলে আমি একা একটু দূরে বসে রইলাম, মাঝে মাঝে তাকিয়ে তাকিয়ে লাশকাটা ঘরটাকে দেখি। কুকুরগুলি ঘুরঘুর করছে, গোঁ গোঁ করে চাপাস্বরে নিজেদের ভিতর ঝগড়া করে, মাঝে মাঝে মাটি থেকে খুঁড়ে তুলে কী যেন কচমচ করে খায়, ভারি অস্বস্তি লাগে মনে। কথা ছিল ওরা ঘণ্টাখানেকের মাঝে ফিরে আসবে, কিন্তু বেলা পড়ে এলো, তবু তো কেউ আসে না! আমি পড়েছি মুশকিলে, না পারি যেতে না পারি থাকতে। চাষিরা সবাই বাড়ি ফিরে যেতে শুরু করে। দু-একজন কৌতূহলী মানুষ আমার সাথে কথাবার্তা বলল, রশীদ মিয়া কে, বাড়ি কোথায়, কীভাবে খুন হলো সব বৃত্তান্ত খুলে বলতে হলো। লাশটাকে দেখতে চাইলে আমি ভিতরে নিয়ে চাটাই খুলে দেখালাম। মানুষের এই একটা জিনিস বড় আশ্চর্য, একটা মরা মানুষ না দেখে কিছুতেই যাবে না। মরে যাবার পর রশীদ মিয়ার চোখ কেউ বন্ধ করে দেয় নি, তাই চোখ খোলা, ওপরের দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে আছে। মুখটা অল্প হাঁ করা, ময়লা হলুদ দাঁত বের হয়ে আছে, দেখে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। চাষিরা আমাকে বলল লাশকাটা ঘরের দরজাটা দড়ি দিয়ে বেঁধে চলে যেতে। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, আজ আর কেউ আসবে না। আর এই জায়গাটা নাকি বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ, মানুষজন নাকি দিনদুপুরেই ভয় পায়। রাতে নাকি বিরাট বিরাট সাদা রঙের কুকুর ঘোরাঘুরি করে এখানে, কোথা থেকে আসে কোথায় যায় কেউ জানে না। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের গ্রামের মাতব্বর খুব দায়িত্বশীল মানুষ, আমি জানি তিনি আফজালকে নিয়ে ফিরে আসবেনই। একা আমাকে এখানে রেখে গেছেন সেটা তাদের খুব ভালো মনে আছে, ফিরে এসে আমাকে না দেখলে আবার উলটো ঝামেলা হয়ে যাবে। ভূতের ভয় আমার নেই, আমি ঠিক করলাম আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি, এর মাঝে তারা যদি না আসে কিছু একটা করা যাবে।

আমি একা বসে বসে মশার কামড় খাচ্ছি আর রশীদ মিয়াকে গালি দিচ্ছি, শালা বেঁচে থাকতে তো জ্বালিয়েছেই, মরেও জ্বালিয়ে গেল। কতক্ষণ বসে ছিলাম মনে নেই, হঠাৎ শুনি শো শো বাতাসের শব্দ। অন্ধকারে বুঝতে পারি নি কখন আকাশ মেঘে ঢেকে ফেলেছে, প্রচণ্ড বাতাস দিচ্ছে। দেখতে দেখতে ভীষণ ঝড় শুরু হলো, পারলে আমাকে প্রায় উড়িয়েই নেয় বাতাসে। একটু পর বাতাসের সাথে শুরু হলো বৃষ্টি, দেখতে দেখতে আমি ভিজে একেবারে চুপসে গেলাম, ঠাণ্ডাও লাগছে প্রচণ্ড। ভাবলাম অনেক হয়েছে আর নয়, এখন পালাই। ঝড়ের মাঝে যাব কোথায় তাও জানি না। যখন চলে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছি তখন হঠাৎ শুনি গলার আওয়াজ। ঝড়ের মাঝে বোঝা যায় না, কিন্তু মনে হলো মাতব্বরের গলার স্বর। আমিও চেঁচিয়ে ডাকলাম তাদের, তারাও উত্তর দিল আমি স্পষ্ট শুনলাম। আমার বুকে তখন সাহস ফিরে এলো, সবাই ফিরে আসছে তাহলে। প্রচণ্ড বৃষ্টি তখন, ভাবলাম বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজে কী লাভ, লাশকাটা ঘরের ভিতরে গিয়ে অপেক্ষা করি, মাথার ওপর অন্তত একটা ছাদ তো আছে!

আমি লাশকাটা ঘরে ঢুকছি, হঠাৎ কেন জানি মনে হলো কাজটা ভালো হচ্ছে না, কে জানি মনের ভিতরে বলে উঠল, খবরদার! যাস নে, ভিতরে বিপদ হবে। কেমন জানি শিরশির করে উঠল আমার শরীর। কিন্তু তখন জোয়ান বয়স, বুদ্ধি কম, সাহস বেশি। ভাবলাম, আরে ধুর! আমার ভয়টা কিসের, ওই তো সবাই এক্ষুনি এসে যাবে। আমি ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম, ভীষণ বৃষ্টি আসছিল। আড়চোখে তাকিয়ে রশীদ মিয়ার লাশটাকে একবার দেখলাম। এমনিতে অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, বিদ্যুৎ চমকালে দেখা যায় রশীদ মিয়ার লাশ একই ভঙ্গিতে স্থির হয়ে পড়ে আছে।

ভিজে কাপড় খুলে নিংড়িয়ে মাথাটা মুছে একটু আরাম হলো, বাইরে তখনও বৃষ্টি। লাশটার দিকে পেছন দিয়ে দরজার কাছে বসে ওদের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি, কিন্তু ওরা তো আর আসে না! একটু একটু করে অনেকক্ষণ পার হয়ে গেল, কিন্তু ওদের তো আর দেখা নেই! আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, ওটা নিশির ডাক ছিল, সাথে সাথে ভয়ে আমার সারা শরীর কাটা দিয়ে ওঠে।

মানুষ বেশি ভয় পেলে কিছু করতে পারে না, চিন্তাভাবনা গুলিয়ে যায়, বুদ্ধি-বিবেচনা কমে আসে। আমি নড়তে সাহস পাই না, দরজা খুলে বাইরে যাবার শক্তি নেই, মনে হয় দাঁড়ালেই পেছন থেকে রশীদ মিয়া লাফিয়ে পড়বে আমার ওপর। অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করলাম, বোঝালাম, কিছু নয়, রশীদ মিয়া মরে গেছে, মরা মানুষ কী করবে? বৃষ্টিটা একটু কমলে বের হয়ে শহরের দিকে যাব, আজ অনেক হয়েছে, আর নয়। চুপচাপ বসে আছি, হঠাৎ মনে হলো পেছনে কী একটা শব্দ হলো, চাটাইয়ে শুয়ে-থাকা রশীদ মিয়া নড়ে উঠলে যেরকম শব্দ হবে সেরকম। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল ভয়ে, কিন্তু নিজেকে বোঝালাম ইঁদুর হবে নিশ্চয়ই। বৃষ্টিটা তখন কমে আসছে, আরেকটু কমলেই বের হয়ে যাব।

আমি এখন বুঝতে পারি আমার ওপর কিছু একটা ভর করেছিল সে রাতে, বিচার-বুদ্ধি কমে গিয়েছিল কোনো কারণে। প্রথমে এভাবে একা ওরকম একটা জায়গায় ঢোকা আমার মোটেও উচিত হয় নি। তাছাড়া যখন বুঝতে পেরেছিলাম ওদের গলার স্বর আসলে ভুল শুনেছি, তখন-তখনই আমার বের হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। যাই হোক, আমি ভিতরে বসে আছি। হঠাৎ মনে হলো বাইরে কী একটা যেন ছুটে গেল। আমি চমকে উঠি, কিন্তু চমকে উঠে বসেই থাকি, আর কিছু করি না। বাইরে তাকাতে ভয় হয় তাই দরজাও আর খুলি না। কাঠ হয়ে বসে আছি, হঠাৎ আবার স্পষ্ট শুনলাম টেবিলে চাটাইয়ের ওপর রশীদ মিয়ার শরীর বেশ ভালোভাবে নড়েচড়ে উঠল। ভয়ে আমার শরীরের সব লোম খাড়া হয়ে যায়। ইঁদুরের শব্দ এটা নয়, ইঁদুর এত জোরে শব্দ করতে পারে না। পেছনে তাকানোর সাহস নেই, যদি কিছু একটা দেখি!

বৃষ্টি কমে এসে তখন আকাশ পরিষ্কার হয়ে এসেছে। আকাশে বেশ বড় একটা চাঁদ, লাশকাটা ঘরের ওপরে ঘুলঘুলি দিয়ে ভিতরে আলো এসে পড়েছে। মাঝে-মাঝেই চাঁদ মেঘে ঢেকে যায় আবার মেঘ থেকে বের হয়ে আসে, আমি বসে বসে তা-ই দেখছি। কতক্ষণ এভাবে বসে ছিলাম জানি না, মনে হয় কয়েক যুগ। বাইরে তখন ছোটাছুটির শব্দটা ভীষণ বেড়েছে। কুকুর-শেয়াল কিছু একটা এদিক থেকে সেদিক সেদিক থেকে এদিক ক্রমাগত ছোটাছুটি করছে। আমি দেখি আর পারি না, নড়তে-চড়তে ভয় হয়, শুধু মনে হয় পেছন থেকে কিছু একটা আমার ওপর লাফিয়ে পড়বে। তবু খুব সাহস করে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম আর সাথে সাথে আমার স্পষ্ট মনে হলো চাটাই থেকে রশীদ মিয়া উঠে বসল। অসম্ভব ভয় পেলাম আমি, চ-ন-ন-ন করে মাথায় রক্ত উঠে গিয়ে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা কী একটা বয়ে গেল। তাড়াতাড়ি দরজা খোলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দরজা কে যেন বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছে, যতই ধাক্কা দিই দরজা আর খোলে না। পাগলের মতো লাথি দিচ্ছি দরজায়। আর তখন হঠাৎ মনে পড়ল যে, দরজাটা ভিতর দিয়ে খোলে। ভয়ে তখন ঘেমে গেছি। আমি একটানে দরজা খুলে ফেললাম, এক দৌড় দেব, কিন্তু সামনে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

এইটুকু বলে রহমত চাচা একটু থামলেন, তার নিশ্চয়ই পুরো দৃশ্যটা মনে পড়ে গেছে। মাথা ঝাঁকিয়ে খানিকক্ষণ একপাশে তাকিয়ে থেকে আবার শুরু করলেন সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি লাশকাটা ঘরে গোল হয়ে বসে আছে কুকুরের মতো কতগুলো প্রাণী। দেখতে কুকুরের মতো হলেও কুকুর থেকে অনেক বড়, চোখগুলি জ্বলজ্বল করছে অন্ধকারে, গায়ের রং ধবধবে সাদা। আমাকে দেখে সবগুলি নড়েচড়ে বসে, চাপাস্বরে ডাকে, কেমন যেমন হিংস্র ভাবভঙ্গি, যেন সবগুলি একসাথে লাফিয়ে পড়বে আমার ওপর। আমি আতঙ্কে পাগলের মতো হয়ে আবার ভিতরে ঢুকব, তখন তাকিয়ে দেখি রশীদ মিয়া দুহাত টেবিলটা ধরে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। মুখে কেমন একটা ধূর্ত হাসি, কিন্তু চোখের দৃষ্টি স্থির, পাথরের মতো, অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না। কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে আমার দিকে তাকিয়ে আমার ভিতর দিয়ে যেন দেখছে।

মানুষ বেশি ভয় পেলে সব বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। আমার শুধু মনে হতে লাগল এক্ষুনি গিয়ে রশীদ মিয়াকে চেপে শুইয়ে দিতে হবে। কেন আমার সেরকম মনে হচ্ছিল এখনও আমি জানি না। শুধু মনে হচ্ছিল ও মরা মানুষ, ওর বসে থাকার কথা না, ওর বসে থাকা সাংঘাতিক একটা সর্বনাশের ব্যাপার। নিশ্চয়ই পাগলটাগল হয়ে গিয়েছিলাম, সত্যি সত্যি যখন ভিতরে ঢুকছি তখন হঠাৎ শুনি প্রচণ্ড এক ধমক, কে? কে ওখানে?

মুহূর্তে আমার জ্ঞান ফিরে এলো। ভাবলাম, সর্বনাশ, আমি এ কী করতে যাচ্ছি! তাড়াতাড়ি ঘুরে বাইরে তাকিয়ে দেখি একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না। মনে হলো বয়স্ক, লম্বা-চওড়া, গায়ে লম্বা পাঞ্জাবি। আমাকে তাকাতে দেখে আবার প্রচণ্ড জোরে একটা ধমক দিল, কী করছ ওখানে? বের হয়ে এসো এক্ষুনি, এক্ষুনি বের হয়ে এসো।

ভয়ে তখন আমার সারা শরীর কুলকুল করে ঘামছে, আমি কোনোমতে টলতে টলতে বের হয়ে এলাম। রশীদ মিয়ার লাশ দেখিয়ে কিছু একটা বলতে যাব, লোকটা আবার ধমকে উঠল, খবরদার, পেছনে তাকাবে না, সোজা বের হয়ে এসো।

আমি লাশকাটা ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। কুকুরের মতো জন্তুগুলি কেন জানি অনেক পেছনে সরে গেছে, সেখান থেকেই চাপাস্বরে গোঁ গোঁ করছে। আমি লোকটার দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম, লোকটা আবার ধমকে উঠল, এদিকে না, তুমি সোজা সামনের দিকে হাঁটো।

আমার নিজের ওপর তখন কোনো জোর নেই, লোকটার কথামতো টলতে টলতে হাঁটতে থাকি। পেছন থেকে লোকটা বলল, সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটো, খবরদার, পেছনে তাকাবে না।আমি আচ্ছন্নের মতো হাঁটতে থাকি, খানিকক্ষণ পর কী একটা বলতে যাব, লোকটা বলল, কোনো কথা নয়, সোজা সামনের দিকে হাঁটো।

আমার হঠাৎ খটকা লাগল, লোকটা বুঝল কেমন করে আমি কথা বলব? তাছাড়া এত বৃষ্টি হয়ে চারদিকে কাদাপানি হয়ে আছে, আমি ছপছপ করে হাঁটছি, লোকটার হাঁটায় কোনো শব্দ নেই কেন? ঘুরে পেছনদিকে তাকাব, লোকটা তখন আবার প্রচণ্ড ধমক দিল, খবরদার, পেছনে তাকাবে না।

আমার কী হলো জানি না, তবু আমি পেছনে তাকালাম। তাকিয়েই বুঝলাম কেন সে পেছনে তাকাতে নিষেধ করেছে। চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখা যায় পেছনের লোকটা আসলে মানুষ নয়, চেষ্টা করছে মানুষের মতো রূপ নিতে। অন্তত দশ ফুট উঁচু–কালো, নাক-মুখ-চোখ আছে, কিন্তু যেরকমভাবে থাকার কথা সেরকমভাবে নেই, অন্যভাবে আছে। আমি তাকাতেই জিনিসটা অদ্ভুত একটা শব্দ করে দাঁড়িয়ে গেল। দেখলাম ওর চোখ-নাক-মুখ নড়তে থাকে, যেন প্রাণপণ চেষ্টা করছে সেগুলিকে আটকে রাখতে, যেন খুলে আসবে হঠাৎ করে…

এরপর আমার আর কিছু মনে নেই।

পরে আফজালদের কাছে শুনেছি আমাকে ওরা যখন পেয়েছে তখন আমি নাকি পাগলের মতো ছুটছি, ওরা যেদিক দিয়ে আসছিল সেদিকেই। ওরা দুজন মিলে নাকি ধরে রাখতে পারে না, সারা শরীর থেকে নাকি তেলতেলে পিছল কী একটা জিনিস বের হচ্ছে। যখন জোর করে ধরে কিল-ঘুষি মেরে আমাকে ধাতস্থ করল, আমি নাকি বিড়বিড় করে কী একটা কথা বলে জ্ঞান হারালাম। ওরা শুধু রশীদ মিয়ার লাশ কথাটা বুঝতে পারল। থানার লোকজনের খামখেয়ালিপনার জন্যে ওদের দেরি হয়েছিল, তাড়াহুড়ো করে যখন নদীর ঘাটে এসেছে, তখন ঝড়ের জন্যে খেয়া বন্ধ। ঝড় কমে যাওয়ার পরেও কাউকে পাওয়া যায় না, অনেক কষ্ট করে একজনকে রাজি করিয়ে ওরা নদী পার হয়েছে। আমাকে ধরাধরি করে ওরা পাশের গ্রামে নিয়ে গেল, সেখান থেকে পরের দিন বাড়িতে।

রহমত চাচা থামতেই কে একজন জিজ্ঞেস করল, রশীদ মিয়ার লাশের কী হলো?

লাশকাটা ঘরের মেঝেতে পড়ে ছিল, কুকুর-শেয়াল টেনে নামিয়েছে হয়তো। কে জানে! রহমত চাচা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমাকে আসলে সে রাতেই মেরে ফেলত, লোকজন ঠিকই বলেছিল, জায়গাটার দোষ আছে। আমি মরেই যেতাম, জিনটা বাঁচিয়ে দিয়ে গেল।

আমরা জিজ্ঞেস করলাম, জিন? আপনি বুঝতে পারলেন কেমন করে সেটা জিন?

রহমত চাচা বললেন, তখন বয়স কম ছিল, অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই বুঝতে পারি নি, এখন বুঝি।

কীভাবে বোঝেন? আর কখনো জিন দেখেছেন?

রহমত চাচা হঠাৎ উঠে পড়েন, ধমক দিয়ে বলেন, যাও যাও, ঘুমাও গিয়ে, বাচ্চা ছেলেরা কেন জিন-ভূতের গল্প শুনতে চাও?

আমরা তবু বসেই থাকি, ওঠার সাহস অনেক আগেই চলে গেছে। দিনের আলো দেখার আগে কোনো ওঠাউঠি নেই।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *