Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পাসপোর্ট || Sanjit Mandal

পাসপোর্ট || Sanjit Mandal

২০২১ এর আগষ্ট মাসে কেন যে পাসপোর্ট তৈরী করে ছিলাম সে কথা আজ আর মনে নেই, হয়তো বা বিদেশ যাত্রার একটা ইচ্ছে অবচেতন মনে কাজ করেছিলো। যদিও ১৯৭৫ সালে দ্বারভাঙ্গা থেকে বিরাট নগর হয়ে নেপালের জনকপুর ধামে ঘুরে এসেছি নেপাল রাজার কাঠের ট্রেনে চড়ে, পাসপোর্ট লাগেনি। ১৯৮৩ সালে নেপালে গেছি শিলিগুড়ি থেকে পানিট্যাংকি হয়ে পাসপোর্ট লাগেনি, ১৯৮৪ তে ভুটানের ফুন্টসোলিং গেছি আলিপুর দুয়ার থেকে, পাসপোর্ট লাগেনি। তখন লাগতো না,এখন লাগে বোধহয়, জানিনা। তবে ২০২২ সালের শেষ দিকে প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সভার আমন্ত্রণ আমাকে ভীষণ ভাবে উদ্বুদ্ধ করলো, ভাবলাম সেই ১৯৭২ এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যে উল্লাস প্রকাশ করেছিলাম, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেগ মথিত কন্ঠস্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রেমী মানুষকে যেভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলো, পশ্চিম বাংলার অগণিত মানুষ যখন এক জাতি এক প্রাণ, এক ভাষা এক গান সংকল্প করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলো, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি রবীন্দ্র সংগীত যেভাবে আকাশ বাতাস মুখরিত করেছিলো, সেই আবেগে মথিত হয়ে আমিও ৭২ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে সারারাত আনন্দে আগুন জ্বেলে বাজি ফাটিয়ে রবিঠাকুরের গান অগুন জ্বালো গেয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছিলাম। ২০২২ এর শেষ দিকে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পঞ্চাশ বছর পরে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা রাঙামাটির পার্বত্য কাব্য থেকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে যাবার আমন্ত্রণ পত্র পেয়ে তেমন ভাবেই আনন্দিত হলাম, ভিসার আবেদন করে ছয় মাসের মেয়াদি ভিসা পেলাম, আর তল্পিতল্পা বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম ১৬/ ০১/২০২৩ তারিখে গেদে লোকাল ধরে দর্শনা সীমান্তের দিকে । এই বয়সে একা একা ভ্রমণ মোটেই অভিপ্রেত নয়, তাই আমরা একসাথে চলেছি সাতজন, আমাদের দলের প্রত্যেকেই আমন্ত্রিত, প্রত্যেকেই সম্মানিত কবি, সাহিত্যিক, তাদের প্রত্যেকের নাম উল্লেখযোগ্য, প্রবীর কুমার চৌধুরীর নেতৃত্ত্বে আমরা সবাই, আমি সঞ্জিত মণ্ডল, নমিতা গোস্বামী, চন্দ্রাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়, রীতা চট্টোপাধ্যায়, প্রতিমা সরকার, মতিয়ূর রহমান। আমাদের গ্রুপের আরও একজন সদস্য মধুমিতা হালদার তার স্বামীর সাথে একদিন আগেই রওনা দিয়েছে।
আমার এক বন্ধু সঞ্জয় চৌধুরীর বাংলাদেশে শিকড় আছে, আমাদের বাংলাদেশে যাবার কথা শুনে উনিই পরামর্শ দেন দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ওপার বাংলায় যেতে, তাতে একদিকে যেমন ফাঁকায় ফাঁকায় সীমানা পেরোনো যাবে, তেমনই তিনি মধ্যস্থতা কারীর নামও বলে দিয়েছিলেন যাতে আমাদের কোনও অসুবিধে না হয়। সত্যিই কোনো অসুবিধে হয়নি। ভালো দামেই নোট এক্সচেঞ্জ করতে পারলাম। সঞ্জয় বাবুকে ধন্যবাদ।
দর্শনা সীমান্তে ভরপেট ডাল ভাত আলুভাজা খেতে গিয়েই বিপদ হলো, একদম ঘরোয়া রান্না, যেমন সুস্বাদু তেমনই খিদের মুখে গোগ্রাসে গেলা, সামান্য ডাল ভাত আলুভাজা আর তেলাপিয়া মাছের ঝাল, তাই আমাদের অমৃত মনে হলো। আর বিপদও ঘটলো, আমাদের জন্য নির্ধারিত বাস আমাদেরকে ফেলে রেখেই ঢাকায় চলে গেলো। কি করা যায়, স্থানীয় লোকের সাহায্য নিয়ে কিছু গুণগার দিয়ে মাইক্রো বাসে ঢাকায় পৌঁছে গেলাম রাত সাড়ে আটটার মধ্যে। ঢাকায় শ্রী শ্রী মাধ্ব গৌড়ীয় মঠে সকলের অবস্থান পাকা হলো। মেয়েরা চার তলার দুটো ঘরে ভাগাভাগি করে আর আমরা তিনজন পুরুষ মানুষ পাঁচতলার একটি ঘরে।সামান্য বিশ্রাম নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বেরোলাম। খেতে খেতে রাত এগারোটা বেজে গেলো, এসে দেখলাম মঠের গেট তালা বন্ধ, চীৎকার শুরু করলাম সকলে মিলে, কা কস্য পরিবেদনা। কেউ গেট খুললো না। আমরা বিমর্ষ হয়ে পড়ছি, এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কি আতান্তরে পড়া গেলো ভাবছি, জিনিস পত্র পোশাক আশাক মায় টাকা কড়িও সব মঠের পাঁচ তলার ঘরে বন্দী, খোলা আকাশের নীচে রাত কাটানো ছাড়া অন্য উপায় নেই। এমন সময়ে দেবদূতের মতো মঠের এক সদস্য হাজির হয়ে পাহারাদার কে ফোন করে আমাদের উপস্থিতির কথা জানালে সে গেট খুলে আমাদের ঢুকতে দিলো, আর কড়া গলায় জানিয়ে দিলো এখানকার নিয়মকানুন খুব কড়া, এখানে থাকতে গেলে এদের নিয়ম মেনে চলতে হবে। এখানে আমাদের জন্য তিনটি ঘরের বন্দোবস্ত হয়েছে, পাঁচ তলার ৫০৯ নম্বর ঘরে আমি, প্রবীর বাবু, আর মতিয়ূর রহমান। চারজন মহিলা চারতলার দুটো ঘরে।
দর্শনা হয়ে ঢাকা যাওয়ার পথে যে সমস্ত মিষ্টি নামগুলো পেয়েছি এবার তার কথা বলি। দর্শনার পরে চুয়াডাঙ্গা, তার পরে ঝিনাইদহ, মাগুরা, ফরিদপুর, পদ্মাসেতু, পার হয়ে ঢাকা, সেখান থেকে ওয়ারি থানা, নারিন্দা আর গৌড়ীয় মাধ্ব মঠ। বাংলাদেশের বন্ধু রবিউল আলম রবি, যাকে সকলে রবি সরকার বলে চেনে, সে আর সবুজ ভাই, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, যিনি একজন ব্যারিস্টার ও বটে, এরা দুই জনে অতি যত্ন সহকারে আমাদের গৌড়ীয় মঠে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে তবে ঘরে ফিরলেন। ওদের কর্তব্য নিষ্ঠা এবং অতিথি পরায়ণতা আমাদের মুগ্ধ করলো। যাবার সময় ওরা পরদিন সন্ধ্যায় ঢাকা শিল্পকলা ভবনে যাবার কথা বলে গেলো, সেখানে একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক আলোচনা চক্রে আমাদের জন্য অভ্যর্থনার আয়োজন আছে।
কথামতো সন্ধ্যায় আমরা সবাই রিক্সা সহযোগে পৌঁছে গেলাম শিল্পকলা ভবনে, সেখানে রবিউল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল, আমরা পৌঁছাতে সে আমাদের সবাইকে নিয়ে যাত্রা ভবনের ছয় তলায় বিশাল আলোচনা সভায় নিয়ে গেলো, ঢুকেই দেখলাম মহ কামরুল ইসলাম অতিথি আপ্যায়ন করছেন এবং সভা পরিচালনা করছেন। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ এর জেনারেল সেক্রেটারি এবং আমার পূর্ব পরিচিত, ২০১৯ এ শান্তি নিকেতনে যে বিশ্বসভায় আমি আমন্ত্রিত ছিলাম সেই সভার আয়োজন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আনুকুল্যে কামরুল ইসলাম ই বিশ্বজুড়ে সাহিত্য প্রেমী বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে বিশ্বভারতীর বাংলাদেশ ভবনে একত্রে আনতে পেরেছিলেন, তার সাংগঠনিক দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, সেদিনের কথা বলামাত্র উনি চিনতে পেরে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এরপর আমরা সবাই কনফারেন্স রুমের টেবিলে বসলাম, প্রত্যেকের সামনে মাইক, প্রত্যেকে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে স্বরচিত কবিতা পাঠ করলাম, ভারত থেকে আমরা যারা গিয়েছিলাম তাদের প্রত্যেকের হাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৬ তম জন্মদিবস উপলক্ষে প্রকাশিত বঙ্গোত্তম শেখ হাসিনাকে নিবেদিত কবিতা কামরুল ইসলামের সম্পাদনায় ও উপদেষ্টা সম্পাদক আজিজুর রহমান আজিজের দ্বারা ছিয়াত্তর জন কবির কবিতা বইটি তুলে দেওয়া হলো। আমরা আবেগাপ্লুত ও আনন্দিত হলাম। গৌড়ীয় মঠে ফিরে হোটেল থেকে তন্দুরি রুটি আর পাঁচমিশালি সবজি খেয়ে রাতে অঘোরে ঘুমালাম।
১৬ তারিখ রাত্রে পৌঁছে ছিলাম, ১৭ তারিখে বিশ্রাম, কাছাকাছি ঘোরা আর শিল্প কলা কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক সাহিত্য আলোচনা চক্রে সময় কেটে গেলো, ১৭ তারিখেই ঠিক হলো ঢাকার দ্রষ্টব্য স্থান গুলো দেখবো। গৌড়ীয় মঠের সামনে থেকে মঠের প্রহরী প্রশান্ত তালুকদার আমাদের জন্য রিক্সা ঠিক করে দিলো, প্রতি রিক্সা তিনশো টাকায়, আমরা তিনটি রিক্সা নিয়ে শহর পরিক্রমায় বের হলাম। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি ঢাকার রাস্তায় রিক্সা ছাড়া উপায় নেই, ঢাকা শহরে ঠিক কতো লক্ষ রিক্সা চলে তার হদিস কেউ দিতে পারে না, এবং অসমসাহসী সব রিক্সা ওয়ালা, গায়ের উপর দিয়ে ভলভো বাস বিশাল ট্রাক, দ্রুতগামী গাড়ি চলে গেলেও এমন ভ্রুক্ষেপহীন অকুতোভয় দুঃসাহসী রিক্সা ওয়ালা আমি আর কোথাও দেখিনি। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ দেখলাম না, কয়েকটি রাস্তায় ট্রাফিক সিগনাল আছে বটে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সুদীর্ঘ যানজট ঢাকা শহরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু কি অদ্ভুত মানুষের ধৈর্য, এতো দীর্ঘ যানজটে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় নষ্ট হলেও কারোর কোনো তাপ উত্তাপ নেই। এই যানজট থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র উপায় প্রচুর সংখ্যক উড়াল পুল নির্মাণ, মেট্রোরেল পরিবহন, সারকুলার রেল পথ নির্মাণ, ঢাকা মেট্রোপলিটন বাইপাস দিয়ে দ্রুত গামী গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকায় দেখেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় আর সুযোগ্য নেতৃত্বে বহু ধরনের কর্মযজ্ঞ চলছে, আগামী প্রজন্মকে আরও ভালো রাখার অদম্য প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে যা নিঃসন্দেহে বর্তমান প্রজন্মকেও আলো দেখাবে।
এবারে ঢাকা পরিক্রমায় রিক্সা সহযোগে যা যা দেখলাম সে কথা বলি, ঢাকা ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন ক্যাম্পাস, কৃষি বিভাগ, মৎস্য বিভাগ, শিল্প বিভাগ, রসায়ন বিভাগ ইত্যাদি, বিশাল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ঈর্ষা জাগানোর মতো। ধানমন্ডির মুজিবুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত বাসস্থান, শহীদ স্মৃতি প্রাঙ্গণ, ঢাকা শিল্পকলা ভবন, নাট্যমঞ্চ, সাংস্কৃতিক ভবন, ঢাকার বৃহত্তম সৌন্দর্য মণ্ডিত বাইতুল্লাহ মসজিদ, নিউমার্কেট, ঐতিহ্যমন্ডিত ঢাকা কালীবাড়ি, রমনা ময়দান, ক্যানটনমেন্ট এরিয়া, ঝিনাইদহ লেক, ইত্যাদি দেখার ফাঁকে কাসুন্দি মাখানো পিয়ারা খেয়েছি। এতো কিছুর মধ্যেও শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ও তৎসংলগ্ন সংগ্রহ শালায় গিয়ে মন বিষণ্ণতায় ভরে গিয়েছে, তার আবাসস্থলে যত্রতত্র গুলি ও রক্তের দাগ এখনো জাজ্বল্যমান। মহাত্মা গান্ধীর কথাও মনে পড়ে যায়, জাতির জনক যারা হয় তাদের বুঝি এভাবেই ঘাতকের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়।
১৮/১/২৩ তারিখে প্রথিতযশা প্রফেসর ডাক্তার মামুন আল মহতাব (স্বপ্নীল) এর পাঠানো গাড়ি মাইক্রো বাসে আমরা গৌড়ীয় মঠ থেকে সোজা ওনার ল্যাব এড স্পেশালাইজড হসপিটালের পথে যেতে একবার ঢাকা ইউনিভার্সিটি মার্কেট কাঁটাবনে থামলাম, এখানে প্রথিতযশা কবি অসীম সাহার সাথে দেখা করার কথা, তাকে সম্মান জানিয়ে তার হাতে কাব্যতরীর কাব্যগ্রন্থ ও মেমেন্টো তুলে দিলেন প্রবীর চৌধুরী । তিনিও তার লেখা ম বর্ণের শোভিত মুকুট আমাদের সকলের হাতে তুলে দিলেন। আমিও আমার সম্পাদিত হৃদয় দুয়ার খোলো বইটি তার হাতে তুলে দিতে পেরে আনন্দিত হলাম। আমরা উভয়েই কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ ও নিবেদন করলাম।
এরপর আমরা ডাক্তার মামুনের হসপিটালের পথে এগিয়ে চললাম, যেতে আড়াইঘন্টা লেট, যথারীতি ঢাকার বিখ্যাত যানজট। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ডাক্তার অভুক্ত থেকেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, আমরা সাড়ে নটায় নারিন্দা থেকে রওয়ানা দিয়েএক ঘন্টার পথ ঢাকা ধানমন্ডি তে পৌঁছলাম সাড়ে চারটের সময়। মাঝে অবশ্য কবি অসীম সাহার সাথে সময় কেটেছে পৌনে এক ঘন্টার মতো। রাসেল বলে যে ছেলেটি আমাদের গাইড করে নিয়ে যাচ্ছিল তারও অসীম ধৈর্য। দেরীতে ভ্রুক্ষেপহীন, কর্তব্য পরায়ণ, লক্ষ্যে অবিচল।
অসাধারণ ডাক্তার, দেরি করে আসার জন্য মুখে এতো টুকু বিরক্তির ছাপ নেই, আজ দুপুরের লাঞ্চ পার্টি উনি দিচ্ছেন চন্দ্রাবলীর সৌজন্যে, বলা ভালো পশ্চিম বঙ্গের বন্ধুদের স্বাগত জানাতে তিনি একটি ব্যানারও তৈরী করে রেখেছেন, গার্ডেন বিষ্টো রেস্টুরেন্টে আমাদের সকলের কয়েক দফা ফটো সেশনের পরে লাঞ্চ শুরু হলো, মেনুতে ডাল ভাত ভাজি, চিকেন, চাটনি ইত্যাদি, লাঞ্চের শেষে চা বা কফি যে যেমনটা চায়। তার পরে আর এক দফা ফটো সেশন। তারপর গাড়িটা উনি আমাদের জন্য বরাদ্দ করে দিলেন, রাসেলকে বলে দিলেন, আমরা যেখানে যেতে চাই সেখানে নিয়ে গিয়ে একেবারে যেন মঠেই ছেড়ে আসে।
এবারে আমাদের গন্তব্য স্থল শিল্প কলা ভবন, সেখানে আমাদের সান্ধ্য চায়ের আসরে আমন্ত্রণ দিয়ে রেখেছেন প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিক আসাদুল্লাহ। অসাধারণ মানুষ তিনি, নিজে শিল্প কলা ভবনের অধিকর্তা হয়েও এতোটুকু অহংকার নেই, অমায়িক নিয়মনিষ্ঠ ও বিনয়ী মানুষটিকে দেখলে বোঝা যাবে না তিনি কতো উচ্চ পদাধিকারী। তিনি তার তিনটি কাব্যগ্রন্থ যথাক্রমে, মা যে কী, বেলা বার বেলা নেই ও যাহা বলিব সত্য বলিব আমাদের সকলের হাতে তুলে দিলেন, আমরা কৃতজ্ঞ চিত্তে গ্রহণ করলাম।
১৯/১/২৩ তারিখ সকাল বেলায় নারিন্দার কাছাকাছি ইসকন মন্দিরে ভুনাখিচুড়ি সহযোগে প্রাতরাশ সারলাম সত্তর টাকার বিনিময়ে। বলতে ভুলে গেছি একাদশীর দিনে মঠ ও মন্দিরে খাওয়া দাওয়া বন্ধ, সকলেই উপবাস করে, পরের দিনে পারণে শুধু মাত্র সবজি ও ফল গ্রহণ করে, অন্ন ভোগ কিন্তু বেলা দুটোর পর। বলে রাখা ভালো, এখানে ভাতকে কেউ ভাত বলে না বলে অন্ন। যাই হোক দিনটা আমাদের বিশ্রাম নিয়ে আর টুকিটাকি কেনাকাটা করে চলে গেলো। আজ রাত্তিরটা ক্রুশিয়াল, সন্ধ্যে বেলায় মঠের ঘর ছেড়ে সাড়ে নটার মধ্যে শ্যামলী বাসস্ট্যান্ডে হাজির হতে হবে, ওখান থেকে চট্টগ্রাম হয়ে আমাদের যেতে হবে রাঙামাটিতে, আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে। পার্বত্য জেলা রাঙামাটির এক ঐতিহ্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছেন পার্বত্য কাব্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক রেজাউল করিম ভাই, নীরব কর্মী রাখেন কাচাইন, ক্বশেন, এ আর কে মিন্টু, আনিস নিয়াজী, চন্দ্রাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়, লক্ষ্মী চন্দ, রোকশানা আবেদা, নান্টু বড়ুয়া, সয়েলা খান, ইলা কারকেট্টা, পত্রলেখা ঘোষ, রাব্বানি সরকার, জাবুন খান, হাসান মঞ্জু, শম্পা চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অসংখ্য কর্মী ও সাহিত্য অনুরাগী।
আমাদের জন্য রাঙামাটিতে যে এতো উষ্ণ অভ্যর্থনা এতো আতিথেয়তা অপেক্ষা করছিল তা আমরা কল্পনাও করিনি। কাছের আর দূরের মিলিয়ে প্রায় চার শতাধিক মানুষের সমাগমে মুখরিত হয়েছিল সভা প্রাঙ্গণ, কবিতা পাঠের ফাঁকে ফাঁকে সাহিত্য আলোচনা, সাহিত্য সম্মাননা দেওয়া ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় বারো ঘন্টার অনুষ্ঠান। দুপুরের সামান্য বিরতিতে চিকেন বিরিয়ানি, বিকেলে চা কেক ইত্যাদি মিলিয়ে জমজমাট এক অনুষ্ঠান।
সকালে আমরা লেক সিটি হোটেলে উঠেছিলাম, সেখান থেকে তৈরী হয়ে সভাস্থলে গিয়েছিলাম, সভা শেষে টেনিস ক্লাবের গেস্টহাউসে এক রাত কাটিয়ে রাঙামাটি জেলা উন্নয়ন পর্ষদের রেস্টরুমে পৌঁছে গেলাম, নাজীম আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো।
লেক সিটি হোটেলের মুনশি কবীর হোসেন আমাদের দাওয়াত দিয়ে রেখেছেন সাহিত্য সভার পরেরদিন ষ্টীমার পার্টি হবে। রাঙামাটির কাপ্তাই লেকে, পরেরদিন সাড়ে নটায় সময় রেখেছেন, দলের সব সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার ফলে সবাই আশিটা সিঁড়ি ভেঙে স্টিমারঘাট এ পৌঁছাতে এগারোটা বেজে গেলো। তারও আধঘন্টা পরে ডি যে বক্স মাইক্রোফোন ইত্যাদি উঠলো, লঞ্চ ছাড়লো। অনেকেই সুন্দর করে গান করলেন, অনেকে আবৃত্তি করলেন, অনেকে নৃত্য পরিবেশন করলেন, এইসব করতে করতে সুভলং ঝর্ণা এসে গেলো, লঞ্চ থেকে নেমে দুরূহ পাহাড়ি ঢাল বেয়ে অতি কষ্টে প্রাণ হাতে করে ঝর্ণার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলাম, দীর্ঘদিন বৃষ্টি হয়নি, তাই ঝর্ণার পানি নেই শুধু তিরিশ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ঝর্ণার উৎস মুখ দেখতে পেলাম। আর দেখতে পেলাম একশ টাকার বিনিময়ে এক একটা দোমালা নারকেল বিক্রি হচ্ছে, শাঁসে জলে অনেকে ই তাই কিনে খাচ্ছে।
আর বিক্রি হচ্ছে ছোট ছোট আনারস দু রকম সাইজের, একটা পেয়ারার সাইজের আনারস তিরিশ টাকা, তার থেকে সামান্য বড়ো সাইজ চল্লিশ টাকায়। শুধু ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে ডাঁটিটা হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে, মাঝখানে চিরে দিচ্ছে তাই লোকে কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে।
এরপর আবার সেই একই কষ্ট করে লঞ্চে ওঠা। লঞ্চ এগিয়ে চলে, দুপাশের পাহাড়ি জঙ্গল আর সবুজের সমারোহ আমাদের মন কেড়ে নেয়। আমরা শহরের মানুষ, সবুজ বনানী, শ্যামল পাহাড়, দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি, ঘন নীল আকাশের নীলিমা, দূষণ মুক্ত বাতাস, অত্যন্ত লোভীর মতো চেটেপুটে খেতে চাই, দুচোখে খুশীর ঝিলিক মুখে উদ্ভাসিত আনন্দ। এমন রাজকীয় অভ্যর্থনা ভাবতে ও পারিনি।
এসে গেলো আদিবাসীদের বাজার আর হোটেল আমাদের নামতে হবে, দুপুরের খাবার খেতে হবে, আমরা বিভিন্ন জায়গায় ভাত খেলেও আমাদের সঙ্গী নমিতা দি কোথাও ভাত খায়নি কিন্তু এখানে ভাত খেতে রাজি হলো। ছোট হোটেল সবাই সব কিছু পেলোনা, ভাত ডাল তরকারি সবই ফুরিয়ে গেলো, একসাথে এতো লোক যে খেতে আসবে তা ওদের জানা ছিলো না।
আবার সেই লঞ্চে ওঠা, এবার ফিরে চলা, বেলা পড়ে এসেছে, লঞ্চঘাটে নেমে সেই আশিটা সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠা। বাজার বসেছে, চেলা মাছের মতো দেখতে মাছকে মুরলি মাছ বলছে দাম তিনশো টাকা কেজি, বড়ো বড়ো তেলাপিয়া চারশো টাকা কেজি, কাঁচকি মাছ দুশো টাকা কেজি। এখানে তেলাপিয়া মাছের কদর আছে। নদী মাতৃক দেশ, খাল বিলে প্রচুর মাছ হলে কি হবে, দাম কিন্তু কম নয়।
মেয়েরা চলে গেলো টেনিস ক্লাবের রেষ্টরুমে, আমরা ছেলেরা রাঙামাটি উন্নয়ন পর্ষদের রেষ্ট হাউসে। এখানে একটা ই ডবল বেডের খাট পাতা আছে, বালিশ দুটো, কম্বল একটা, কেয়ার টেকারকে অনেক বলে আর একটা বালিশ ও কম্বল আনানো গেলো, দুটো কম্বল আর তিনটে বালিশে আমরা তিন ভাই আমি প্রবীর বাবু আর মতিয়ূর রহমান দিব্যি দুটো রাত কাটিয়ে দিলাম। সকাল বেলায় চা খেতে যাওয়ার পথে আশপাশের অঞ্চল ঘুরে দেখলাম, দেখলাম ওই সুদূর নীচে সিঁড়ি নেমে গেছে পাহাড়ি গ্রামের দিকে, ছোট ছোট টিলা আর জঙ্গল ভেদ করে, যত দূরে চোখ যায় পাহাড়ি শ্যামলীমা মুগ্ধ হয়ে দেখি, এখানে বাতাসে বিষ নেই, নির্মল পবিত্র শুচি স্নিগ্ধ বাতাস জীবন জুড়িয়ে দেয়।
পরেরদিন চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বাস ধরলাম। শৈলী শহরের সম্পাদিকা মুকুল চক্রবর্তীর সাথে আলাপ ছিলো আগেই, নতুনভাবে আলাপ হলো কবি ও সাহিত্যিক তাপস সাহার সাথে। বিদগ্ধ মানুষ, গল্পে কথায় চট্টগ্রামে পৌঁছে গেলাম।
এখানে এসে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে শুনলাম কলকাতার টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না, শ্যামলী ট্রাভেলস এর ফারুক ঠাকুর ব্যবস্থা করে দিলেন, বনগাঁর বাসে চেপে বসলাম। সেই ঢাকা, পদ্মাসেতু, কুমিল্লা, নূরজাহান হোটেল সব পিছনে পড়ে রইলো, বনগাঁ সীমান্তে হাজার হাজার লোক দেখে আমাদের চোখ ছানাবড়া হবার জোগাড়, বাসের হেল্পার আমাদের সবার জামায় শ্যামলী বাসের স্টিকার লাগিয়ে দিলো। সেটা দেখে অনেকে ই লাইন ছেড়ে দিলো আমরা অন্ততপক্ষে তিনশো মানুষের আগে এসে গেলাম, দালালকে দুশো টাকা দিতে হয়েছে। সামনে আরও সাত আটশো লোকের লাইন, খাঁচার মধ্যে দিয়ে অতি ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছি বাংলাদেশের চেকিং হয়ে গেছে, ভারতীয় কাস্টমস পার হতে হবে, আমাদের ভারতীয় পাসপোর্ট, লাগেজ স্ক্যানের পরে বাইরে গিয়ে অনুমোদিত সরকারি ডিলারের কাছ থেকে টাকা বদল করলাম। পঞ্চাশ টাকা পারহেড ভাড়া দিয়ে আমি প্রবীর বাবু আর চন্দ্রাবলী অটোতে চেপে বসলাম রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। বনগাঁ মাঝেরহাট ট্রেনে চেপে বসলাম। ২৩ শে জানুয়ারি ছুটির দিন দুপুরবেলা তাও অসহ্য ভীড়, দম বন্ধ হবার জোগাড়। আমাদের ওই বড়ো বড়ো লাগেজ দেখে এক ভক্তিপরায়ণ মানুষ অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে আমাদের লাগেজ দমদম স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে অত্যন্ত উপকার করলেন, তার উপকার ভুলবো না। সত্যি বলতে একা চন্দ্রাবলীর পিঠের বোঝা আড়াই মণের কাছাকাছি। মেয়েটার পিঠ বেঁকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে বইয়ের বোঝা এনেছে ও।
দমদমে মেট্রোরেলের টিকিট কাটলাম , চন্দ্রাবলী দীনেশ দাস স্টেশনে, প্রবীর বাবু কাজী নজরুল স্টেশনে আর আর আমি কবি সুভাষ স্টেশনে নেমে গেলাম। আমাদের বাকী বন্ধুরা বনগাঁতে যে যার সুবিধা মতো গাড়ি নিয়ে আপন আপন গন্তব্যে পৌঁছে গেছেন। আমাদের আন্তর্জাতিক সাহিত্য সভায় যোগদান অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ ও সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে এ কথা মুক্ত কন্ঠে স্বীকার করছি, ধন্যবাদ জানাই আমাদের বাংলাদেশের প্রিয় ভাই বন্ধু ও বোনেদের।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress