পাশাপাশি
টাকা পয়সা না থাকায় খুবই টানাটানি যাচ্ছিল। নবনীতার ঘুম ভাঙত টাকার চিন্তা নিয়ে, রাত্রে শুতে যাবার সময় পর্যন্ত সেই টাকার চিন্তা। এমন কি সুকুমারের পাশে শুয়েও যতক্ষণ না ঘুম আসছে নবনীতা টাকার কথা ভাবত। হয়ত স্বপ্নেও দেখত, তার আলমারি ফাঁকা, ব্যাগ ফাঁকা, বিছানার তোশকের তলাতেও কিছু খুচরো পয়সা ছাড়া কিছু নেই। এই যে নিঃস্ব শূন্য অবস্থা—নবনীতার এটা ভালো লাগত না, সারাটা দিন সে বিরক্ত জর্জরিত হয়ে থাকত, তার সুশ্রী মুখ অর্থের তাড়নায় অপ্রসন্ন, গম্ভীর হয়ে থাকত—তবু সে সুকুমারকে প্রায় কিছুই বলত না।
একটানা অনেক দিন এইভাবে কাটল, মাস কয়েক। অভাব থাকলেও এতটা বাড়াবাড়ি আগে ছিল না। কোনরকমে চলে যেত। কিন্তু হালে এমন হল যে বাড়িটা যেন ভিখিরির মতন হাত পেতে থাকত, দিনের পর দিন।
অন্য সংসারে এমন অবস্থা চলতে থাকলে যা হত নবনীতার সংসারে তা প্রায় হল না বলা যায়। নবনীতা স্বামীর সঙ্গে বচসা করল না, ঝগড়াঝাঁটি করল না, একটা দিনও স্বামীর পাশে বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল না। তার অভিযোগ দু’চারটি ছোট্ট কথায় মাত্র প্রকাশ পেত; যেমন সে বলত, ‘দুধের কার্ড করাতে পারলাম না এবার, কাল শেষ দিন’; বা ‘সাবান ছিল না, তোমার গেঞ্জি কাচতে পারি নি।’
নবনীতা বরাবরই কম কথা বলে। কথা কম বলার জন্য তাকে গম্ভীর, ভীষণ শান্ত, সহিষ্ণু এবং চাপা মনে হয়। স্বামীর প্রতি তার কর্তব্য এবং ভালোবাসার পাল্লা সমান কি না, কিংবা ঠিক কোন দিকটা ঝুঁকে আছে তাও বোঝা যেত না। বোঝা যেত না, সে প্রচণ্ড কাতর অথবা ক্ষুব্ধ কি না!
মাস তিন চার এইভাবে কাটার পর সুকুমার একদিন বাড়ি ফিরে স্ত্রীর হাতে হাজার খানেক টাকা দিল। একটা একশো টাকার নোট ভাঙিয়ে সুকুমার কিছু বাজার করেছিল—চা, দুধ, খুচরো বিস্কিট, চানাচুর, প্যাকেট দুই সিগারেট এই সব।
নবনীতা টাকাটা আলমারির মধ্যে তুলে রাখল। আহ্লাদে গলে গেল না, উচ্ছ্বাসে চঞ্চলও হল না। টাকাটা কি করে এল তাও তখন স্বামীকে জিজ্ঞেস করল না।
পরে, সুকুমার যখন বাথরুম থেকে ফিরে এসে হাত পা ছড়িয়ে ঘরে বসেছে, নবনীতা স্বামীর জন্যে চা আনল, বলল, ‘কে দিল?’
সুকুমার বলল, ‘একজন পার্টি অ্যাডভান্স দিয়ে গেছে।’
—’পুরো টাকাটাই বাড়ির? না তোমার কারখানায় লাগবে?’
—’আমার লাগবে না। তোমার ধারটাও অনেক হয়েছে, কিছু শোধ করে দিও।’
নবনীতা আর কিছু বলল না।
সেদিন রাত্রে নবনীতা বিছানায় শুয়ে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে পারল।
পরের সপ্তাহে সুকুমার আবার শ’পাঁচেক টাকা এনে স্ত্রীকে দিল।
নবনীতা টাকাটা নিতে নিতে স্বামীকে একটু আগ্রহের চোখে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, ‘আবার কেউ দিয়ে গেছে?’
—’না, সেই পুরোনো পার্টি।’
—’এতোদিন পরে একটা ভালো লোক পেয়েছ তা হলে?’
—’তাই তো দেখছি।’
টাকাটা নবনীতা আলমারিতে তুলে রাখল।
রাত্রের দিকে যখন সুকুমার বিছানায় শুয়ে একটা থ্রিলার পড়ছে, নবনীতা কাজকর্ম সেরে গা হাত ধুয়ে এসে শাড়ি জামা পালটে নিচ্ছে—তখন সুকুমার হঠাৎ বলল, ‘আমাকে দিন দুয়েকের জন্যে বাইরে যেতে হবে।’
—’কোথায়?’
—’প্রথমে যাব দুর্গাপুর, সেখান থেকে আসানসোল।’
—’সে তো তুমি এখান থেকেই আসা-যাওয়া করতে পারো।’
—’না, তা হবে না। কাজ রয়েছে। ঘোরাঘুরি করতে হবে।’
নবনীতা আর কিছু বলল না। শাড়ির আঁচলটা কোমরের পাশ থেকে টেনে নিয়ে ভেজা-ভেজা মুখটা আরও একবার মুছল। আলগা করে ঘাড়ে গলায় মুখে সামান্য পাউডার দিয়ে মাথার চুল ঠিক করে নিল।
এখনও এমন কিছু বেশী রাত হয় নি। তবু নবনীতা স্বামীকে জিজ্ঞেস করল, ‘খাবে?’
—’ক’টা বাজল?
—’সোয়া নয়-টয় হবে—’—নবনীতা দেরাজের মাথায় রাখা টাইমপিস ঘড়ির দিকে তাকাল।
—’দশটা বাজুক।’
অগত্যা নবনীতা সামান্য দাঁড়িয়ে থেকে ঘরের একপাশে চেয়ারে বসল। বসে মনে হল তার বুকের কোথায় যেন একটা চাপা ব্যথা এসেছে। ঠিক যে কোথায় বোঝা যায় না, ডান না বাঁ দিকে, অথচ ব্যথাটা এক একবার করে ঠেলে উঠে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। চোরা অম্বল? বেকায়দায় কোথাও লেগেছে নাকি? নবনীতা বার কয়েক নিশ্বাস বন্ধ করে থাকল।
স্বস্তি লাগছিল না বলে সে পাশের ঘরে চলে গেল, যাবার সময় সুকুমারকে বলল, ‘খাবার সময় ডেকো, আমি ও-ঘরে রয়েছি।’
পাশের ঘরটা অন্ধকারই ছিল। নবনীতা বাতি জ্বালল না। জানলা দিয়ে বাইরের যেটুকু আলো আসছে তাতেই ঘরের সব কিছু ঝাপসাভাবে দেখা যায়। লম্বা সোফাটায় গিয়ে শুয়ে পড়ল নবনীতা। পাশ ফিরে।
এই যে ব্যথাটা এখন হচ্ছে—এটা একেবারে আচমকা নয়। মাস কয়েক ধরেই মাঝে মাঝে হচ্ছে। বার দুই বেশ জোর হয়েছিল। জোর ব্যথা হলে হাত ঝিমঝিম করে, অসাড় অসাড় লাগে, কপালে গলায় কেমন ঘাম জমে যায়। হার্টের কোনো অসুখ নাকি? এই বয়সেই?
চুপ করে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকার পর আরাম লাগল নবনীতার। ব্যথাটা আর উঠল না, ধীরে ধীরে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। মিলিয়ে গিয়ে কোমরের বাঁ দিকে নেমে গেল বোধ হয়, কেন না নবনীতা আচমকা অনুভব করল, তার কোমরের দিকটই ভার লাগছে। হয়ত খেয়াল করে নি নবনীতা, ব্যথাটা কোমর থেকে উঠে এসেছিল, আবার নেমে গেল। শরীরের কিছু বোঝা যায় না।
বিয়ের আগে নবনীতা শরীরের দিক থেকে নিখুঁত ছিল। সচরাচর যে সব ছোটখাট আধিব্যাধি মানুষের হয়—যেমন সর্দি, মাথাধরা, পেটের হঠাৎ কিছু গোলমাল—এ-সব ছাড়া তার কোনো বড় রোগ হয় নি। স্বাস্থ্য তার ভালো ছিল। সে নীরোগ ছিল। এক একসময় শুধু চোখের তলায় একটা ব্যথা হত। ওটা কিছু না।
নবনীতার বাবা মেয়ের জন্যে দু’একজন সুপাত্রও বেছে রেখেছিলেন। তিনি প্রায় নিশ্চিন্ত ছিলেন, সুশ্রী নিরোগ শিক্ষিতা এই মেয়েকে নিতে কোনো পাত্রই আপত্তি করবে না। সেই দু’একজন মনোমত পাত্রের মধ্যে সুকুমার ছিল না। সুকুমার নবনীতার পছন্দ।
নবনীতার সঙ্গে সুকুমারের যে ধরনের পরিচয় ও ভাব ছিল তাকে খুব অন্তরঙ্গ বলা যায় না। সুকুমার মাঝে মাঝে বিডন স্ট্রীটে তার এক বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা মারতে আসত। বাড়িটা নবনীতার মাসির বাড়ি। ওই বাড়িতেই সুকুমারকে প্রথম দেখেছিল নবনীতা, সেখানেই আলাপ আর ওই বাড়িতেই নবনীতা জানতে পারে, তার সমবয়সী মাসতুতো বোন কেতকীর সঙ্গে সুকুমারের অস্পষ্ট একটা সম্পর্ক রয়েছে। কেতকীর স্বভাবের ধরনটা ছিল শরৎকালের মেঘের মতন, তাকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যেত, সে কখন যে কোথায় মনোহর হয়ে উদয় হত, আর কখন যে ভেসে যেত—বোঝা যেত না। তার সবটাই ছিল হালকা; সে কখনও কখনও এত নীচু দিয়ে ভেসে যেত যে মনে হত হাত বাড়ালেই ধরা যাবে। সুকুমার এখানে ঠকে গেল। হাত বাড়াল—কিন্তু ধরতে পারল না—কেতকী অনেক বড় জায়গায় পালিয়ে গেল। যা সাধারণ, যেখানে দু’বেলা খাওয়া পরার চিন্তা করেই দিন কাটাতে হবে, সকালে উনুন ধরানো, মাছ কোটা, অফিসের ভাত দেওয়া আর মাসে দু একটা দিন বরের সঙ্গে রিকশায় কি ট্রামে চেপে সিনেমা দেখতে যাওয়া—কেতকী সেখানে নেই। জীবনটাকে কেতকী বাহারী, সুখী, হালকা করতে চেয়েছিল। সুকুমার এ-সবের কাছাকাছি যায় না। কাজেই কেতকী সুকুমারকে ভাইদের তাস খেলার আড্ডায় বসিয়ে রেখে চলে গেল।
নবনীতার কেন যেন এটা ভালো লাগে নি। কিংবা এমন হতে পারে, নবনীতা সুকুমারের সাধারণত্ব যে ভেঙে পড়ার মতন নয়—এটা বোঝাবার জন্যে হঠাৎ কেমন সদয় হয়ে উঠল সুকুমারের ওপর। ঠিক যে কি কারণে সে সুকুমারকে পছন্দ করে ফেলল তা কেউ জানে না। খুব সম্ভব নিজেও নয়। সুকুমারের চেহারা মোটামুটি, সে কোনো অর্থেই রূপবান নয়, কিন্তু দোহারা চেহারা এবং মুখের কোমলতার জন্যে তাকে দেখতে ভালো লাগত। সুকুমার পেশায় ছিল কেমিস্ট, মাঝারি কেমিক্যাল ফার্মে চাকরি করত। থাকার মধ্যে ভাগের বাড়ি ছিল সুকিয়া স্ট্রিটে। সামান্য একটা অংশ। বাবা ওই বাড়ির অংশটুকু এবং সেকেলে কিছু আসবাবপত্র রেখে গিয়েছিলেন। কোনো দায়দায়িত্ব রেখে যান নি। না মা, মা বোন, না ছোট ভাই। সুকুমার ঝাড়া হাত পা ছিল।
নবনীতা নিজের থেকেই যেটুকু দুর্বলতা দেখাল সুকুমারের পক্ষে তাই যেন আশাতীত ছিল। তবু সে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল!
—’তুমি কিন্তু ব্যাপারটা ভালো করে ভেবে দেখ।’
—’দেখেছি।’
—’তুমি কোয়ালিফায়েড, তোমার বাবা অনেক ভালো জামাই টামাই পেতে পারেন’
—’আমার বাবা তোমার দুশ্চিন্তা?’
—’না, বলছি—’
—’বলতে হবে না। বরং তুমি নিজেই ভেবে দেখ…।’
—’কি বলছ! আমি স্বপ্নেও যা ভাবতে পারি না, তুমি তাই দিচ্ছ!’
—’স্বপ্নে ভেবো না। ভেবে তো বুঝেছ, জীবনটাকে জীবনের নিয়মেই নেওয়া ভালো।’
সুকুমার রীতিমত বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল।
বিয়ের পর এক দেড়টা বছর ভালোই কেটেছিল। নবনীতা যে কত গুছোনো, সংসারের নানা দিকের আলগা সুতো যে কেমন করে গিঁট দিয়ে জুড়তে হয়, সুখ এবং তৃপ্তি যে ঘরের মধ্যে ফুলের গন্ধের মতন ছড়িয়ে দেওয়া যায়—এ-সব সে সুকুমারকে একটার পর একটা দেখিয়ে দিল। যে ঘরবাড়ির চেহারায় কোনো শ্রী আর রুচি ছিল না, নবনীতা সেই বাড়ির মধ্যে শ্রী ফিরিয়ে আনল। ছিমচাম, সুন্দর, পরিচ্ছন্ন এক সংসার গড়ে তুলল নবনীতা। সুকুমারকে দেখাল, সব জলে তেষ্টা মেটানো যায় না, যে-জলে তেষ্টা মেটে সুকুমার ভাগ্যবশে সেটাই পেয়েছে।
সুকুমার সুখী হতে পেরেছিল। তার সুখ এবং তৃপ্ত সে সব সময় প্রকাশ করে ফেলত। এবং সর্বদাই মনে করত, সে ভাগ্যবান। শুধু একটা ব্যাপারে সুকুমার কিছুটা বিভ্রান্ত বোধ করত। নবনীতার স্বভাবে উচ্ছ্বাস ছিল না, ছেলেমানুষি ছিল না, প্রগলভতা ছিল না। সুকুমার চাইত, নবনীতা যুবতী স্ত্রীর মতন এমন কিছু কিছু ব্যবহার করুক যা তাকে মজা দেবে।
—’তোমায় নিয়ে একদিন চীনে হোটেলে যাব ভাবছি—’
—’কেন?’
—’চাইনিজ ফুড যা ডেলিসাস—’
—’খেয়েছি। আমার ভালো লাগে না।’
—’বিয়ের আগে খেয়েছ, এখন বরের সঙ্গে খেয়ে দেখো।—’
—’বাড়িতে বরের সঙ্গে খেতে তো আমার ভালোই লাগে।’
সুকুমার এরপর আর কথা খুঁজে পায় না।
আবার একদিন সুকুমার বলল, ‘এই, দীঘায় যাবে?’
—’দীঘায় কেন?’
—’চলো বেড়িয়ে আসি। দিন দুই। আমার এক বন্ধু সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দেবে বলেছে।’
—’এখন টাকা খরচ করতে পারব না।’
—’তুমি অত টাকার কথা ভাব কেন! একটু টানাটানি করে চালিয়ে দিও। বিয়ের পর আজ পর্যন্ত তোমায় নিয়ে কোথাও বেরুনো হল না।’
—’আমি তো কোথাও যেতে চাই নি।’
—’না চাও, তবু মাঝে মাঝে এক আধটা ট্যুর ভালো। মন চাঙ্গা হয়ে যায়।…সমুদ্রের ধারে দু’জনে বসে থাকব, সন্ধ্যে হবে, চাঁদ উঠবে—হু হু বাতাস বইবে—তোমার ভালো লাগে না ভাবতে?’
—’না।’
—’কেন?’
—’বাইরে থেকে সুখ আনতে আমার ইচ্ছে করে না।…দীঘা পালিয়ে যাচ্ছে না; থাকবে। যেদিন এই ঘরে তোমার পাশে বসেও আমার ভালো লাগবে না সেদিন নিয়ে যেও তোমার দীঘায় চাঁদ দেখতে…।’
—’তোমার সব অদ্ভুত যুক্তি।’
—’আমি যখন তোমায় বিয়ে করতে চেয়েছিলাম—তখন কি তোমার মনে হয় নি আমি অদ্ভুত।’
সুকুমার বাধ্য হয়েই যেন চুপ করে যায়।
আবার একদিন সুকুমার রাত্রে বিছানায় শুয়ে একটা বই দেখিয়ে বলে, ‘এসো, তোমায় একটা দুটো জায়গা পড়ে শোনাই।’
—’কী বই?’
—’ইংরেজি বই। নাম করা। এই বই নিয়ে হইহই হচ্ছে আজ কত বছর।’
নবনীতা বালিশে মাথা রেখে শুলো।
সুকুমার পড়তে লাগল।
সামান্য পড়তেই নবনীতা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘থামো। আমায় শোনাতে হবে না।’
—’কেন? এর মধ্যে দোষটা কোথায়? তা ছাড়া তুমি পাঁচ লাইন শুনেই সব বুঝে গেলে?’
—’আমার শোনার দরকার নেই। তোমার ভালো লাগে তুমি মনে মনে পড়, আমায় শুনিয়ো না।’
সুকুমার একটু জেদের সঙ্গে বলল, ‘দেখো নীতা, তোমার এই গোঁড়ামির মানে হয় না। তাছাড়া তুমি আমার বউ, এর মধ্যে এমন কিছু নেই যা শুনলে তোমার লজ্জা হতে পারে। সহজভাবে, হালকাভাবে, মজার সঙ্গে এটা নিতে তোমার আপত্তি কি!’
নবনীতা পাশ ফিরে শুলো, সুকুমারের দিক পিঠ করে। বলল, ‘সব মজা সকলের ভালো লাগে না। আমি যদি মজা করে তোমার পাশে শুয়ে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়ি তোমার ভালো লাগবে?…তোমার ওই মজা আমার ভালো লাগে না।’
সুকুমার রাগ করে বলল, ‘জীবনটাকে তুমি এত সভ্য, শালীন করবার চেষ্টা করছ কেন? শেষ পর্যন্ত খুব আর্টিফিসিয়াল মনে হবে।’
—’মনে হলে, বলব।’
এরপর আর কিছু বলার থাকতে পারে না; সুকুমার চুপ করে গেল।
এইভাবেই দেড় দুটো বছর কেটে গেল। সুকুমার খানিকটা উচ্ছ্বাসপ্রবণ, চঞ্চল, স্ফূর্তিবাজ ছেলে ছিল। তার স্বভাবে একটা বাইরের দিক ছিল যা যৌবনের স্বাভাবিক চাঞ্চল্য প্রকাশ করে আনন্দ পেত। নবনীতার সঙ্গে থাকতে থাকতে সুকুমারের স্বভাব পালটে যেতে লাগল ধীরে ধীরে। মনে হত, নবনীতার ব্যক্তিত্ব তাকে গ্রাস করে ফেলেছে, সে স্ত্রী পছন্দ ও রুচির মানুষ হয়ে উঠছে। এটা তার পছন্দ হত না। কিন্তু সে কিছুই করতে পারত না।
এই সময় এক কাণ্ড হল। অফিসে একটা অশান্তি চলছিল, সুকুমার আর তার ওপরওয়ালার মধ্যে। একদিন আর সহ্য হল না, প্রচণ্ড রাগারাগি আর ঝগড়া করে সুকুমার চাকরি ছেড়ে চলে এল।
মাথা সামন্য ঠান্ডা হবার পর সুকুমারের মনে হল, নবনীতা চাকরি ছাড়ার খবরে গুম হয়ে যাবে, ভীষণ অসন্তুষ্ট হবে, রাগ করবে। সুকুমার বড়লোক নয়, তার চাকরিও এমন কিছু ছিল না যে সঞ্চয় করতে পেরেছে। দু’জন মানুষের ভদ্রভাবে কেটে যেত, অনটনে পড়ত না। চাকরি না থাকার অর্থ সংসার চলবে না।
ভয়ে ভয়ে এক সময় সুকুমার স্ত্রীর কাছে কথাটা ভাঙল। এবং অপেক্ষা করতে লাগল, নবনীতা কতক্ষণে স্বামীর এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতার জন্যে গর্জন করে ওঠে।
খুবই আশ্চর্যের কথা সে-রকম কিছুই হল না। নবনীতা মন দিয়ে সব শুনল। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। মুখ কালো করল না, শুধু আরও গম্ভীর থমথমে হয়ে থাকল।
অনেকক্ষণ পরে নবনীতা বলল, ‘এরপর কী করবে?’
সুকুমার অপরাধীর মতন মুখ করে বসে থাকল, নবনীতা কেন যে রাগে বিরক্তিতে ফেটে পড়ল না তাও সে বুঝতে পারছিল না। অবাক হচ্ছিল, ভয়ও করছিল। শেষে সুকুমার বলল, ‘ভাবছি। আবার একটা চাকরি খুঁজতে হবে।’
—’দেখো।’
—’চাকরির যা বাজার—চট করে পাওয়াও মুশকিল। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে দেখি।…চাকরির ব্যাপারটাই খারাপ। এত নীচু করে দেয়।’
নবনীতা কিছু বলল না।
এর কয়েক দিন পরে সুকুমার স্ত্রীকে বলল, সে আর চাকরি করতে চায় না। একটা ছোটখাট ব্যবসা করবে, এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হয়েছে, জায়গা পেয়েছে—কিছু কেমিক্যাল প্রাোডাক্টস তৈরি করবে, বড় বড় কারখানায় সাপ্লাই দেবে। কিংবা বাজারে বেচবে।
নবনীতা আপত্তি করল না।
সুকুমার চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় কিছু টাকা পয়সা পেয়েছিল, তার দু’একজন বন্ধু ব্যাংক থেকে সামান্য টাকা বের করে দেবার ব্যবস্থা করল। মোটামুটি এই টাকা নিয়ে এবং প্রচণ্ড উদ্যম নিয়ে নেমে পড়ল সুকুমার।
প্রথমটায় মনে হয়েছিল, ভগবান মাথার ওপর হাত রেখেছেন সুকুমারের। শুরু করেই অর্ডার। টাকা যেন আকাশ থেকে কেউ ছুঁড়ে দিল। মাস দুয়েকের মধ্যে সুকুমার কারখানা কারখানা করে নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেল। তখন তার মনে হত, হায় হায় চাকরিতে গিয়ে সে জীবনের কতটা না অপচয় করল! যদি তখন ব্যবসায় নামত—এতদিনে তার অনেক হত।
ছ’মাসের মাথাতেই কিন্তু ভগবান হাত সরিয়ে নিলেন। যে-বন্ধু জায়গা দিয়েছিল সে বেঁকে বসল। হয় সমান সমান পার্টনার করো, না হয় জায়গা ছাড়। সুকুমারও সমান জেদী, বলল, জায়গা ছেড়ে দেব।
আবার নতুন জায়গায় কারখানা করতে পরিশ্রম গেল, টাকা গেল। বাজারও পড়তে লাগল। সুকুমার বিপদে পড়ে গেল। কোনো রকমে লেগে থাকল, কারখানা যেন আর চলে না। এই অবস্থায় চলতে চলতে গত তিন চারটে মাস যেন আর নড়তে চাইল না, মনে হল—কারখানা তুলে দিতে হবে। ভীষণ টানাটানি যাচ্ছিল, চার পাঁচটা লোক কাজ করে কারখানায়, এমন কিছু মাইনে নয়, তাদের মাইনে দিতেও পারছিল না সুকুমার ঠিক মতন, বাজারে কাঁচা মালের দাম বাড়ছে হু হু করে—মাল কেনার সঙ্গতি সে হারিয়ে ফেলছিল, অর্ডার যাও বা জোটে টাকা পায় না, ব্যাংকে আর হাত পাতাও যায় না।
এই রকম যখন অবস্থা, সুকুমার প্রায় পাগল হয়ে যাবার যোগাড়, মন-মেজাজ ভালো থাকে না, হাজার রকম দুশ্চিন্তা, মন ভেঙে পড়ছে—তখন কিন্তু নবনীতা সবই সহ্য করে গেছে। সংসারের জন্যে, টাকার জন্যে স্বামীকে বিব্রত করে নি, পীড়ন করে নি। কেমন করে যে নবনীতা সংসার টেনে যাচ্ছিল সুকুমারও বুঝতে পারত না। স্ত্রীর হাতে সে প্রায় কিছুই দিতে পারত না, কখনো পঁচিশ পঞ্চাশ টাকা, কখনো দশ বিশ। নীচের তলায় দু’ঘর দোকান ভাড়া ছিল, পাড়ার দোকান, সেই আয়টাই ছিল বাঁধা। কিন্তু সে আর ক’টা টাকা?
নবনীতার এই সহিষ্ণুতা, ধৈর্য, সুকুমারকে উত্যক্ত না করার সঙ্কল্প এবং এক রকম মুখ বুজেই অভাব অনটন সহ্য করে যাওয়া যে কত কঠিন সুকুমার তা বুঝতে পারত। স্ত্রীর কাছে সে নিশ্চয় কৃতজ্ঞ হয়ে থাকত। আর এই কষ্টের দিনে সুকুমার স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের কাছে যেন পুরোপুরি নিজেকে সমর্পণ করে দিল। কেমন করে যেন তার সেই চঞ্চলতা, উচ্ছ্বাস, আবেগপ্রবণতা কেটে গেল। সেও গম্ভীর হয়ে গেল, কথাবার্তা কম বলত, নিজেকে স্ত্রীর তুলনায় নিকৃষ্ট মনে করত; আর একটা চাপা অক্ষমতার বোধ তাকে যেন কেমন অপরাধী করে রাখত।
কয়েকটা মাস এই অবস্থায় কাটার পর একদিন সুকুমার আবার স্ত্রীর হাতে নগদ হাজারটা টাকা তুলে দিতে পারল। দিয়ে এমন কোনো লক্ষণ দেখাল না যে সে আবার কোনো রাজত্ব জয় করে এনেছে। পরের সপ্তাহে আবার শ’পাঁচেক টাকা। এবারও সুকুমার একই রকম নির্বিকার। যখন টাকা ছিল না, সংসারটাকে কী করে টেনে নিয়ে যাবে—এই ভাবনা ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাচ্ছিল নবনীতা—তবু স্বামীকে পীড়ন করেনি নির্বিকার ছিল; ঠিক সেই সময় সুকুমার আবার যখন টাকা আনতে পারল, স্ত্রীর হাতে তুলে দিল—তখনও সে সমান নির্বিকার থাকল।
নবনীতা ঘুমোয়নি, তন্দ্রার মতন এসেছিল, সুকুমার ডাকছে শুনতে পেয়ে উঠে বসল।
সুকুমার এ-ঘরে এসেছিল, বাতি জ্বালায় নি।
—ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
—না। শুয়ে ছিলাম।
—খেতে দাও। দশটা বাজল।
ঘরের বাইরে চওড়া ঢাকা বারান্দায় সংসারের অনেক খুঁটিনাটি রয়েছে। তারই একপাশে দু’জনের খাবার ছোট টেবিল।
নবনীতা বাথরুম থেকে ঘুরে এসে স্বামীকে খাবার দেবার ব্যবস্থা করতে লাগল।
দু’জনে মুখোমুখি খেতে বসে প্রায় কোনো কথাই বলছিল না। আজকাল এইরকমই হয়ে গেছে। দু’জন মানুষ, একই বাড়িতে থাকছে, খাচ্ছে, একই বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে থাকছে রাতের পর রাত—অথচ তেমন কোনো কথাবার্তা নেই, সুখ দুঃখের গল্প নেই, একের কষ্ট অন্যকে প্রায় জানতেই দেয় না। আবার দু’জনের মধ্যে কলহ নেই, ইতরতা নেই। যেন কোনো অদ্ভুত শর্ত সামনে রেখে দু’জনে জীবন কাটিয়ে যাচ্ছে।
সুকুমার এক সময় বলল, তোমায় বলতে ভুলে গিয়েছি, বড়দির সঙ্গে আজ দেখা হয়েছিল, এসপ্লানেডে। তুমি অনেক দিন ও বাড়ি যাও নি বললেন।
—সময় হয়ে ওঠে না, নবনীতা বলল।
—কবে যেন একদিন তুমি ফোন করেছিলে জামাইবাবুকে…
—করেছিলাম।
—’উনি তো এসেছিলেন।’
—হ্যাঁ—’
নবনীতা ছোট করে জবাব দিল। দিয়ে খেতে খেতে হঠাৎ কেমন বিরক্ত হয়ে বলল, ‘জামাইবাবুর সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল?’
—’না।’
—’আশ্চর্য লোক।’
সুকুমার কিছু বলল না। নবনীতার নিজের কোনো দিদি নেই, ছোট বোনও নয়। বড়দি তার জ্যাঠামশাইয়ের মেয়ে। তাও বাবার খুড়তুতো ভাই, নিজের ভাই নয়। নিজের কেউ নেই নবনীতার বাবার। নবনীতারও নিজের এক ছোট ভাই, যাদবপুর থেকে পাশ করে সবে চাকরি পেয়েছে। কলকাতায় থাকে না।
খাওয়া শেষ করে সুকুমার বলল, ‘আমি উঠছি’। বলে চেয়ার ছেড়ে ওঠবার সময় স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, নবনীতার মুখ কেমন শুকনো হয়ে যাচ্ছে আজকাল।
দুই
যে-বাড়িতে অনেক দিন টাকা পয়সা আর আসত না, বা এলেও পঁচিশ পঞ্চাশের বেশী আসত না, টাকার খরা চলছিল বলা যায়—সেই বাড়িতে হঠাৎ একদিন আবার টাকা আসতে শুরু করল। সুকুমার দু’চার দিন অন্তর দু’শো চারশো আনতে শুরু করল।
দুর্গাপুর আসানসোল থেকে ফিরে এসে সুকুমার একদিন হাজার দেড়েক টাকা এনে দিল। বলল, হাজারখানেক আলাদা করে রেখো, আমার দরকার হবে।
নবনীতা টাকা তুলে রাখতে রাখতে বলল, তোমার সেই একই পার্টি এত দিচ্ছে?
—’না, একই পার্টি কেন হবে? অন্য।
—এতদিন এরা কোথায় ছিল?
—ছিল; আমার কপালে জোটে নি। আমায় খুব সাপোর্ট দিচ্ছে নতুন একটা ব্লিচিং করেছি, কাপড় চোপড় কাচার কাজে লাগবে, আবার ঘরদোর মোজাইক, কাচের বাসনপত্র সব কিছু পরিষ্কারের কাজে লাগবে। ভালো চলছে। ওটার পুরো এজেন্সি ওদের। আমরা শুধু তৈরি করে বটলিং করে দি।
নবনীতা বলল, বাড়িতে তো আনলে না?
আনব। মনে থাকে না।
দিন দুই পরে সুকুমার তার নতুন ব্লিচিং আনল। তরল ব্লিচিং। শিশিতে কোনো লেবেল নেই। বাড়ির জন্যে আনছে বলে হয়ত সাধারণভাবে শিশিতে ভরে এনেছে।
নবনীতা বলল, এর নাম কি? লেবেল কোথায়?
সুকুমার বলল, লেবেল লাগাই নি। নাম আর কি—তেমন কোনো নাম নেই; ব্লিচিং সল্যুসন হিসেবেই বিক্রি হয়।
সুকুমার এই প্রথম লক্ষ্য করল, নবনীতা কেমন যেন কৌতূহলী হয়ে উঠছে, আগে সে কারখানার কথা, ব্যবসার কথা খুব কমই জিজ্ঞেস করত। ইদানিং প্রায়ই করছে। কেন? টাকার জন্যে? টাকা আসছে বলেই কি এই কৌতূহল?
যে কোনো কারণেই হোক সুকুমার এটা পছন্দ করল না।
পরের সপ্তাহে সুকুমার আর বাড়িতে টাকা আনল না। তার পরের সপ্তাহেও হাত টান করে টাকা দিল, শ’দুই। নবনীতা কিছু বলল না। কেন না বলার মুখ সুকুমার আগেই মেরে রেখেছিল, বলেছিল—কারখানার পেছনে কিছু খরচ যাচ্ছে, তার ওপর পুরোনো ধার দেনা, ব্যাংকের টাকা কিছু কিছু শোধ করতে হচ্ছে।
মাস দুই তিন সুকুমার এইভাবে কাটাল : কখনও স্ত্রীর হাতে ঝপ করে কিছু বেশী টাকা তুলে দিত, কখনও কিছুই দিত না, কখনও অল্পস্বল্প। সে দেখল, তার ধারণাও একটু ভুল হয়েছিল। ঘন ঘন টাকা এনে দেবার পর সুকুমার ভেবেছিল, নবনীতার কারখানা সম্পর্কে কৌতূহল দেখা দিচ্ছে। টাকা বন্ধ করে সুকুমার নবনীতার এই কৌতূহল দমাতে চেয়েছিল। অবশ্য তার এমন সন্দেহও হয়েছিল, একবার টাকার স্বাদ পেয়ে হঠাৎ হাতে টাকা আসা বন্ধ হয়ে গেলে নবনীতা অসন্তুষ্ট হতেও পারে। কিন্তু নবনীতা তা হল না। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার; নবনীতাকে কখনোই কিছু হতে দেখা গেল না, যখন সুকুমার চাকরি করত—তখনও নবনীতা যেমন, যখন চাকরি ছেড়ে দিয়ে সুকুমার ব্যবসা ধরল—তখনও সেই রকম। টাকা টাকা করে সারা বাড়ি যখন মাথা খুঁড়ছে তখনও নবনীতা যা, টাকার আসা-যাওয়া শুরু হলেও তাই। মানে, না থাকার সময় নবনীতা যেমন কেঁদে ককিয়ে ঝগড়া করে গালাগাল দিয়ে বাড়ি মাথায় করে নি, তেমনিই টাকা আসার পরও আহ্লাদে আতিশয্যে বেহিসেবী খরচে বাড়িতে সাড়া পড়িয়ে দেয় নি। নবনীতার সমস্ত পরিবর্তনই যেন হিসেব করা, মাপা; অভাবেও সে যেমন গম্ভীর, চাপা, চিন্তিত ছিল—, স্বাচ্ছন্দ্যেও সেই রকম শান্ত, গম্ভীর, চাপা। কিন্তু চিন্তিত কী? সুকুমার বোঝবার চেষ্টা করেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিল না।
এই সময় সুকুমার মাঝে মাঝেই বাইরে যাচ্ছিল। দুর্গাপুর, আসানসোল, বর্ধমান ছাড়াও সে কখনো কখনো অন্যত্র চলে যাচ্ছিল। দূরে গেলে তার ফিরতে তিন চারদিন লাগত। ফিরে এসে নিজের ঝোড়ো শুকনো চেহারা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করত, তুমি ভালো ছিলে? বলত আর স্ত্রীর চোখ দেখার চেষ্টা করত মনোযোগ দিয়ে।
নবনীতা সাধারণভাবে বলত, খারাপ থাকব কেন, ভালোই ছিলাম।
সুকুমার আর কিছু বলত না।
সেবার বর্ষায় একটা ঘটনা ঘটে গেল।
সুকুমার দিন দুয়েকের জন্যে বাইরে গিয়েছিল, ফিরে এসে দেখল নবনীতা বাড়িতে নেই। এ-রকম কখনও ঘটে না। যে মেয়েটি বাড়িতে কাজকর্ম করে সেও নেই, বিকেলের পর তার অবশ্য থাকার কথা নয়। সদরে তালা দেওয়া। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।
সুকুমার কিছুক্ষণ সদরের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করল নবনীতার। তারপর বিরক্ত হয়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে পাড়ার এক চায়ের দোকানে চা খেতে চলে গেল। নীচে তাদের ভাড়াটে দোকান দুটোর একটা লন্ড্রী, অন্যটা মুদির। সেখানে গিয়ে বসতে ইচ্ছে করল না।
সন্ধ্যের মুখে ফিরে এসে দেখল নবনীতা বাড়ি এসেছে।
সুকুমার বিরক্ত গলায় বলল, কোথায় গিয়েছিলে? আমি ঘন্টাখানেক হল এসেছি। চায়ের দোকানে গিয়ে বসে ছিলাম।
নবনীতা সদ্য বাইরের কাপড় ছেড়েছে, শাড়িটা এখনও গোছ করে তুলে রাখতে পারেনি। গায়ের জামাটাও পোশাকী। সুকুমার লক্ষ্য করল নবনীতার শাড়ি জামা সাদামাটা নয়, সিল্ক পরে সে বেরিয়েছিল—সচরাচর যা পরে না। মুখে প্রসাধনের চিহ্ন বাদলায় বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে গেলেও একেবারে পুরোপুরি উঠে যায়নি। মাথায় খোঁপা।
সুকুমার এ-সব দেখতে অভ্যস্ত নয় তেমন। নবনীতাকে সাজে গোজে প্রসাধনে পরিপাটি হতে সে কমই দেখছে।
নবনীতা বলল, হঠাৎ জোরে বৃষ্টি এসে পড়ায় আটকে গিয়েছিলাম।
—গিয়েছিলে কোথায়?
—সিনেমায়।
—সিনেমায়? তুমি তো সিনেমায় যাওই না এক রকম।
—আজ গিয়েছিলাম।
—ও!…আচ্ছা! একলা?
—এক বন্ধুর সঙ্গে।
—বন্ধু! সুকুমার বুঝতে পারল না।
নবনীতা ততক্ষণে জামা পালটে শাড়ি জামা আলনায় রেখেছে। অন্যমনস্কভাবেই বলল, চা খাবে তো?
—হ্যাঁ
নবনীতা ঘরে ছেড়ে চলে গেল।
সুকুমার পোশাক ছেড়ে বাথরুমে চলে গেল। ফিরে এসে গায়ে পাঞ্জাবি চাপাল। পরনে পাজামা। মুখ মুছে, চুল আঁচড়ে শোবার ঘরেতেই বসল।
ওমলেট আর চা এনে দিল নবনীতা।
সুকুমার বলল, বাইরেও দেখলাম বেশ বৃষ্টি হচ্ছে এবার।
নবনীতা কথার জবাব দিল না, আবার চলে গেল।
সুকুমার ঠিক বুঝতে পারল না। নবনীতা কথা কম বলে—সেটা তার স্বভাব, তাবলে এত চুপচাপ? বাইরের কথা দু’ চারটে জিজ্ঞেস করে সে। এবারে কিছু করল না। কি হল নবনীতার? সেজেগুজে সিনেমায় গেল বন্ধুর সঙ্গে, যা সে যায় না। কোন বন্ধু নবনীতার? পূর্ণিমাদি ছাড়া তো কোনো বন্ধুই নেই নবনীতার! কেউ কখনো এবাড়ি আসে না। চিঠিপত্রও লেখে বলে সুকুমার শোনে নি। যাই হোক, আজকের ব্যাপারটা তেমন স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।
চা খেয়ে সুকুমার একবার স্ত্রীর কাছে যাবে ভাবল। শেষ পর্যন্ত গেল না। সিগারেট ধরিয়ে রেডিয়ো খুলল, ভালো লাগল না, বন্ধ করে দিল। খুঁজে পেতে একটা স্পাই থ্রিলার বের করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
নবনীতা রান্নাবান্নার কাজ সারছে বোধ হয়। বাড়ি একেবারে চুপচাপ। বৃষ্টি পড়ছে। জলের শব্দ কখনো প্রবল হয়ে উঠছে, আবার থেমে যাচ্ছে।
একবার এল নবনীতা। কথা বলল না। আবার চলে গেল।
সামান্য রাত হয়ে যাবার পর নবনীতা আবার এল। আলনা থেকে শাড়ি জামা তুলে নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরে নবনীতা যখন বাথরুম থেকে ফিরে এসে ঘরের শাড়িটা গুছিয়ে পরছে, মুখ মুছে কপালের ঘাড়ের চুল পরিষ্কার করে নিচ্ছে, সুকুমার স্ত্রীকে বলল, রান্না-বান্নার একটা লোক রাখো না কেন?
—নিয়ে এসো।
এই ধরনের জবাবে সুকুমার বিরক্ত বোধ করল। তার মানে? আমি কোথথেকে নিয়ে আসব?
—তুমিই লোকের কথা বলছ।
—বলছি বলে আমায় আনতে হবে! রান্নার লোক খোঁজা আমার কাজ! বাঃ!
ড্রেসিং টেবিলের দিক থেকে সরে যেতে যেতে নবনীতা বলল, আমিই কি পাড়ায় ঘুরে ঘুরে লোক খুঁজে বেড়াব!
সুকুমার স্ত্রীর গলার স্বরে অবাক হয়ে গেল। নবনীতা এ-ভাবে বড় একটা কথা বলে না; তার উত্তেজনা নেই, হাজার বিরক্ত হলেও ঠান্ডা, নিস্পৃহ উদাসীন এবং অবজ্ঞার স্বরেই কথা বলে। এখন তাকে ভীষণ রুক্ষ ও ঝাঁঝালো শোনাল।
সুকুমার চটে উঠলেও তা প্রকাশ করতে সাহস পেল না। গলা নামিয়ে বলল, রান্নার লোক খোঁজা মেয়েদেরই কাজ, তাই বললাম।
নবনীতা কোনো জবাব দিল না কথার।
রাত্রে বিছানায় শুয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো কথা হল না। সুকুমার পাশ ফিরে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ল। নবনীতা জেগে থাকল অনেকক্ষণ, তার পিঠ থাকল স্বামীর পিঠের দিকে।
পরের দিন সকালেও দু’ পক্ষ চুপচাপ। সাধারণ কোনো কথাও কেউ বলল না, পরস্পরের চোখের দিকে তাকাল না পর্যন্ত।
সুকুমার তার উল্টোডিঙির কারখানায় চলে গেল।
সন্ধ্যেবেলায় বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি ফিরে সুকুমার দেখল, নবনীতা কোথাও যাবার জন্যে তৈরি হয়ে বসে আছে। বৃষ্টির দরুন এবং সুকুমার না ফেরার জন্য বোধ হয় বেরুতে পারছিল না। সুকুমার অবাক হল; কিছু বলল না।
বৃষ্টি থামল না। বরং তুমুল হয়ে এল। এমন বৃষ্টি এই মরসুমে কলকাতায় যেন হয় নি।
অগত্যা নবনীতাকে শাড়ি-জামা পালটে ফেলতে হল।
সুকুমার যথারীতি শোবার ঘরে শুয়ে বসে সময় কাটাতে লাগল। নবনীতা পাশের ঘরে অন্ধকারে সোফায় শুয়ে থাকল। বাইরের বৃষ্টি এবং ঘরের এই থমথমে স্তব্ধ ভাব ক্রমশই এমন এক মানসিক ভার চাপিয়ে দিতে লাগল যে সুকুমার আর সহ্য করতে পারল না। সিগারেটের টুকরোটা নিভিয়ে দিয়ে সে পাশের ঘরে গেল। বৃষ্টির জন্যে জানলা বন্ধ। বাইরের আলো আসছে না। বারান্দার আলোর হালকা আভা ঘরে আসছিল। ঝাপসা ভাব। বড় সোফায় নবনীতা পা গুটিয়ে শুয়ে আছে।
সুকুমার বাতি জ্বালল না। স্ত্রীর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর মাথার কাছে এসে ডাকল। এই—!
কোনো সাড়া দিল না নবনীতা
সুকুমার একটু ঝুঁকে মুখ দেখার চেষ্টা করল স্ত্রীর। ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি! গা নাড়া দিয়ে আবার ডাকল, এই—শুনছ?
নবনীতা নড়াচড়া করল।
সুকুমার বলল, ‘সরো, আমি বসি।’
—’আর জায়গা নেই?’
—’আছে। আমি এখানেই বসব। তোমার সঙ্গে কথা আছে।’
নবনীতা যেন বিরক্ত হয়ে উঠে বসল।
সুকুমার বসল। বলল, ‘কী হয়েছে তোমার?’
জবাব দিল না নবনীতা।
অপেক্ষা করে সুকুমার বলল, ‘মুখ বুজে থাকার কোনো মানে হয় না। তোমার এই ব্যবহার দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। কী হয়েছে তোমার?’
—’আমার ব্যবহার তোমার ভালো না লাগলে আমার কি!’
সুকুমার চটে যাচ্ছিল। রুক্ষ গলায় বলল, ‘না, তোমার তো কিছুই নয়। চার বছর বিয়ে করে আমার সে শিক্ষা হয়েছে। তোমায় আমি বেশ চিনেছি।’
—’বেশী বেশী কথা বলছ।’
—’হ্যাঁ, বলছি। বলব। তুমি আমায় চুপ করাতে পারবে না।’
—’তা হলে আমিই চুপ করে থাকব।’
—’না, থাকবে না’ সুকুমার অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘যদি তোমার কিছু বলার থাকে বলবে; যদি না বলার থাকে কাল থেকে আমায় এ বাড়িতে দেখবে না।’
নবনীতা স্বামীর দিকে ঘাড় ঘোরাল। ভঙ্গিটা তেজের। বলল, ‘তুমি আমায় ভয় দেখাচ্ছ?’
—’না। তোমায় কে ভয় দেখাবে! তুমিই বরাবর ভয় দেখিয়ে এসেছ।’
—’আমি তোমায় বরাবর ভয় দেখিয়ে এলাম?’
—’নিজেই ভেবে দেখ।’
নবনীতাযেন প্রচণ্ড ঘা খেল। এমন একটা আঘাত সে বোধ হয় প্রত্যাশা করে নি। সামান্য চুপ করে থেকে ঝাঁঝের গলায় বলল, ‘তুমি বড় বেইমান। পুরুষমানুষ এই রকমই হয়। কেতকী তোমায় ঠিকই চিনেছিল।’
সুকুমার অনেকদিন পরে এ বাড়িতে কেতকীর নামটা আবার শুনতে পেল। নবনীতা ওই নামটা মুখে আনাও ভুলে গিয়েছিল।
সুকুমার বলল, ‘কেতকীর কথা থাক, তোমার নিজের কথা বল। আমি তোমায় আবার বলছি, তুমি যুদি স্পষ্ট করে আমায় না বলো কী হয়েছে—আমি সত্যি সত্যি কাল থেকে বাড়িতে আসব না।’
—’জানি,’ নবনীতা বিশ্রী ধরনের গলায় বলল, ব্যঙ্গ করে।
—’জানো মানে?’
—’তুমি কোথায় গিয়ে থাকবে জানি।’ সুকুমার কেমন চমকে উঠল। অবিশ্বাস্য মনে হল। নবনীতার দিকে ভয় এবং ক্রোধের চোখে তাকিয়ে থাকল। ঘর অন্ধকার থাকার দরুন একেবারে স্পষ্ট করে কেউ কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না। তবু হালকা আলোর সঙ্গে মেশানো অন্ধকারে নবনীতার শক্ত মুখ, কঠিন চিবুক এবং অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সুকুমার অনুভব করতে পারছিল।
সুকুমারকে বলতে হল না, নবনীতা নিজেই বলল, ‘তুমি প্রতিমা বলে একটা মেয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকবে।’
সুকুমারের মুখ যেন রক্তহীন শুকনো হয়ে গেল। গলার কাছটায় শক্ত। ঢোঁক গিলতেও পারছিল না। বুকের মধ্যে কাঁপছিল। নির্বাক। হাতের তালুতে ঘাম জমছে। কপালও যেন ভিজে এল।
—’প্রতিমার কথা তোমায় কে বলল?
—’তোমার কারখানার লোক। একদিন একজন খুব দরকারে এসেছিল। তুমি ছিলে না। তুমি বাইরে ছিলে। সে বলল, না—সে তোমায় তাদের পাড়ায় দেখেছে। তুমি কলকাতায় আগের দিন ফিরে এসেছ।…’
কিছুক্ষণ অসাড় হয়ে বসে থাকার পর সুকুমার আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করল না। বুঝতে পারল অনিমেষ তাকে দেখেছে। বলল, ‘প্রতিমা আমার ছেলেবেলার বন্ধুর স্ত্রী।’
—’তোমার স্ত্রী নয়।’
—’ভদ্রভাবে কথা বলো।
—’কে বলবে? আমি না তুমি?…তোমার ব্যবসায় হঠাৎ এত টাকা কোথথেকে আসে? কে দেয়? কার সঙ্গে তুমি বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াও?’ নবনীতা ঘৃণার সঙ্গে বলল।
সুকুমার যেন ক্রমশই কোণঠাসা হতে হতে বেপরোয়া হয়ে উঠছিল। নবনীতা তার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করেছে। অনিমেষই হয়ত তার গোয়েন্দা। সাধনদের পাড়াতেই অনিমেষ থাকে। সুকুমারকে অনেকদিন দেখেছে। খোঁজ খবরও রেখেছে নিশ্চয়। ঠিক আছে, অনিমেষকে দেখে নেবে সুকুমার। কিন্তু নিজের অবস্থাটা এখন এমন শোচনীয় যে বাঁচবার আর কোনো পথ না পেয়ে হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে সুকুমার বলল ‘প্রতিমা দিয়েছে। সে দেয়। তাতে তোমার মাথা ব্যথা কেন? তার টাকা আছে। সে দিতে পারে। তুমি জান, তার স্বামী মস্ত বিজনেসম্যান। দশ রকম ব্যবসা করে। সাধন, আমার বন্ধু—সাধন আমায় টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য না করলে আমি ডুবে যেতাম।’
—’তোমার এই ছেলেবেলার বন্ধু সাধন কোথায় ছিল এতোদিন?’ বাঁকা করে বিদ্রূপ করে নবনীতা বলল।
—’তুমি মূর্খের মতন কথা বলছ—’, সুকুমার ক্ষেপে গিয়ে বলল, ‘আমার কোনো পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে আমার পরে দেখা হয়ে যেতে পারে না? নাকি তাকে ব্যবসাদার হতে নেই, বড় লোক হতে নেই!….আমি তোমায় বলছি, ভগবানের দিব্যি, ছেলেপুলে থাকলে আমি তাদের মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি করে বলতাম, একদিন স্ট্র্যান্ড রোডে এক অফিসে সাধনের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়। আমি আমার কাজে লাহিড়ীদার কাছে গিয়েছিলুম, ফেরার পথে সাধনের সঙ্গে দেখা। সে আমায় তার অফিসে টেনে নিয়ে গেল।’
—’তারপর বাড়িতে…!
—’যাবেই তো, কেন যাবে না!’
—”যাক না, হাজার বার যাক; কিন্তু সাধন যখন তার বউ প্রতিমাকে তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিল তখন তুমি ওই মেয়েটাকে ঘাড়ে নিলে কেন?’
সুকুমারের অসহ্য লাগছিল। নবনীতা এত নোঙরাভাবে কথা বলছে যে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। সুকুমার বলল, ‘তোমার মুখের কি কথা! ভদ্রলোকের বাড়ির মেয়ে বউ বলে তো মনে হচ্ছে না।’
ধারালো গলায় নবনীতা বলল, ‘এই মুখ তোমার আর ভালো লাগছে না বলেই প্রতিমার মুখ দেখতে যাও।…তাই যাও। আমি গ্রাহ্য করি না।’ বলতে বলতে নবনীতা উঠে পড়ল। উঠে ঘর থেকে চলে গেল।
বৃষ্টি অনেকক্ষণ থেমে গিয়েছিল। বাইরে হয়ত মেঘ ছিল, সারা রাতই থাকবে। এই বাড়ির মধ্যে দুটি মানুষ থমথমে মুখ করে থাকল। দেখলে মনে হবে, অদ্ভুত গুমোট, আসন্ন কোনো বিপর্যয়ের মধ্যে যেন এই দু’জন কোনো রকমে নিজেদের ধরে রাখছিল।
রাত হয়ে গেল। খাওয়া-দাওয়ায় কারও রুচি ছিল না। টেবিলে বসল, উঠল। সুকুমার সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
নবনীতা এল আরও খানিকক্ষণ পরে।
বাতি নিবিয়ে অন্ধকারে বিছানায় এসে নবনীতা বুঝল, সুকুমার জেগেই আছে। থাকুক।
সুকুমার ভাবছিল, তার মতন তাড়িত, উৎপীড়িত, দুঃখী মানুষ সংসারে নেই।
নবনীতা ভাবছিল, যে-মানুষকে সে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিল, যার জন্যে এত সহ্য করেছে সে তাকে বঞ্চিত করল।
আরও রাত হল। সমস্ত পাড়াই নিস্তব্ধ। পাতলা বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে আবার। নবনীতার আঁচল সরানোর শব্দ হল, গলা পরিষ্কারের চাপা শব্দও শোনা গেল। সুকুমার তার বাঁ পা সরাতে গিয়ে নবনীতার পায়ের পাতায় আঙুল ছোঁয়াল। পা সরিয়ে নিল নবনীতা।
অদ্ভুত এক স্তব্ধতা যেন দু’জনকে ক্রমশই পৃথক করে দিতে লাগল। শেষ পর্যন্ত এমন দূরত্বে গিয়ে পড়ল সুকুমার যে আর যেন সহ্য করতে পারল না। তার মনে হল, সে শেষ সীমায় চলে গেছে, এরপর আর যাওয়া যায় না, গেলেই সম্পর্কটা ভেঙে যাবে।
আচমকা সুকুমার বলল, ‘তুমি অনেক খবর যোগাড় করেছ, কি করে করেছ আমি জানি না। একটা খবর যোগাড় করার দরকার অবশ্য মনে করো নি। প্রতিমার গলায় ক্যানসার হয়েছে। সাধন অনেক ডাক্তার ফাক্তার দেখিয়েছে। কোনো লাভ হয় নি। প্রতিমা জানে সে আর বেশীদিন বাঁচবে না, সাধনও জানে। ওদেরও আমাদের মতন অবস্থা, ছেলেপুলে নেই। এক সম্পর্কের ভাইঝিকে কাছে এনে রেখেছে। সে নিজের তালে থাকে।’ বলে সুকুমার একটু থামল, ছাদের দিকে মুখ করে বলল, ‘প্রতিমার মাথায় কেমন একটা গোলমালও দেখা দিয়েছে। হয়ত মরতে যাচ্ছে বলেই। এমনিতে কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু থেকে থেকেই কেমন ছটফট করে, কলকাতায় থাকতে চায় না, বাইরে যাবার জন্যে জেদ করে। সাধন কাজের মানুষ, সে ব্যবসাপত্র ফেলে দিয়ে বাইরে বাইরে বউ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে না। তা ছাড়া সে ও-রকম রুগী নিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা থাকতেও পারে না। ভয় পায়, টেনশান ফিল করে। ওর আবার হাই প্রেসার।… কাজে কাজেই আমাকেই প্রতিমাকে নিয়ে বাইরে যেতে হয়।’
নবনীতা কোনো সাড়া দিল না।
সুকুমার বলল, ‘কথা বলছ না যে?’
নবনীতা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না, পরে বলল, ‘তোমার বন্ধুর বউকে তুমি নার্স করছ বলে তারা টাকা দিচ্ছে?’
—’নার্স করবে কেন? সঙ্গ দি’।’
—’কেন দাও?’
—’বাঃ এই কেনর কোনো জবাব আছে! মানুষ হিসেবে দি’, বন্ধু হিসেবে দি’।’
—’তোমার বন্ধুও তো মানুষ।’
—’মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?’
নবনীতা যেন বিদ্রূপের গলায় বলল, ‘বুঝতে পারছ না? তোমার সাধন বন্ধু তার বউকে সঙ্গ দিতে পারছে না?’
সুকুমার আবার বিরক্ত হল। কোনো কথাই কি নবনীতা বুঝবে না? মেয়েমানুষ হলেই কি নির্বোধ হতে হয়? একবার যা মাথায় ঢোকে তার বাইরে আর ভাবতে পারে না? আশ্চর্য!
সুকুমার বলল, ‘আমি তোমায় বললাম কি! সাধন ব্যস্ত মানুষ। তার নিজেরই হাই প্রেসার। তা ছাড়া সামান্যতেই সে অস্থির হয়ে ওঠে। সে আমায় নিজেই বলেছে, ভাই, আমি পারি না; আমার চোখের সামনে আমার বউ মরার অপেক্ষা করছে আমি কিছুই করতে পারছি না—এ আমি সহ্য করতে পারি না। ভীষণ টেনসান হয়, নার্ভ রাখতে পারি না।’
নবনীতা কথা বলল না। পাশও ফিরল না।
সুকুমার অপেক্ষা করে থাকতে থাকতে বলল, ‘তুমি যা ভাবছ তা নয়। সাধন পারে না বলেই আমি…’
বাধা দিয়ে নবনীতা বলল, ‘যার বউ সে সহ্য করতে পারছে না—আর তুমি পারছ?’
—’এতে অবাক হবার কি আছে? বরং সাধনের বউ বলেই সাধন যা পারছে না, আমি সেটা পারতে পারি। কারণ প্রতিমা আমার বউ নয়। নিজের ব্যাপারে মানুষ অনেক কিছুই পারে না, অন্যের ব্যাপারে পারে। আজ যদি আমার বাবা বেঁচে থাকত আর হঠাৎ মারা যেত আমার যত প্রাণে লাগত, তোমার লাগত না। কারণ আমার বাবা আমারই, তোমার নয়, তোমার শ্বশুর।’
নবনীতা বিছানার ধারে তার হাত ঝুলিয়ে রাখল। জ্বালা করছে। পায়ের তলাও জ্বালা করছিল। সুকুমার মিথ্যে চালাকি করার চেষ্টা করছে। তার মনুষ্যত্ব দেখানোর এই চেষ্টা যে কত ফক্কিবাজি সে জানে। তবু নিজেকে বাঁচানোর কত চেষ্টা!
সামান্য সময় চুপ করে থেকে নবনীতা ব্যঙ্গ করে বলল, ‘তোমার এত মায়াদয়া মনুষ্যত্ব আছে জানতাম না।’
—জানার কোনো দরকার তো বোধ কর নি। ভেবেছে যা আছে সব তোমারই আছে। দয়া, মায়া, সহ্য-শক্তি, ভদ্রতা, রুচি…’
—’না, আমার আর থাকবে কেন? তোমার আছে।
—’আমার তো নেই। তোমার আছে—এই অহঙ্কারে তুমি আজ চার বছর ধরে আমায় বোবা করে রেখেছ।’
নবনীতার মাথার শিরায় যেন লাগল, ছিঁড়ে যাবার মতন যন্ত্রণা হল। দাঁতে দাঁত চেপে, চোখের পাতা বুজে যন্ত্রণাটা সামলে নেবার চেষ্টা করল। তারপর আচমকা সোজা হয়ে শুলো। ধারালো ছুরির মতন হিংস্র গলায় বলল, ‘তুমিও তো কম অহঙ্কার দেখাচ্ছ না! খুব বড় বড় কথা বলছ! মনুষ্যত্ব দেখাচ্ছ! কিসের মনুষ্যত্ব তোমার? সাধনের বউ মরতে বসেছে তাকে সঙ্গ দিচ্ছি! সঙ্গ দিচ্ছ, না—সেই মেয়েটাকে সঙ্গ দেবার নাম করে তার আর তার স্বামীর টাকা এনে নিজের পেট ভরাচ্ছ?’
সুকুমারের মনে হল, কে যেন তার গালে ঠাস করে এক চড় মারল। এত জোরে মারল যে তার আঘাত এবং জ্বালা সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। জলে ডুবতে থাকলে মানুষ দম বন্ধ হয়ে যাবার ভয়ে মুখে শ্বাস টানার প্রাণপণ চেষ্টা করে, সুকুমার সেইভাবে শ্বাস টানতে টানতে বলল, ‘কী বলছ তুমি?’
নিষ্ঠুর গলায় নবনীতা বলল, ‘যা বলছি, ঠিক বলছি। তুমি মনুষ্যত্ব দেখাচ্ছিলে! কিসের মনুষ্যত্ব তোমার! বন্ধু বউয়ের কাছে গিয়ে বসে থাকো, তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াও, তার তোষামোদ কর, তার দুঃখে গলে যাও—এর মধ্যে তোমার কোনো মনুষ্যত্ব নেই। আছে স্বার্থ; চালাকি। এই ভালোমানুষি দেখিয়ে, ছল করে তুমি ওদের টাকা আনছ।’
সুকুমার যেন লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসল। তার গা কাঁপছে থরথর করে, মাথায় আগুন ধরে গেছে। চিৎকার করে সুকুমার বলল, ‘চুপ করো। চুপ করো তুমি। আর একটাও কথা বলবে না।’
—’বলব! হাজার বার বলব!… লজ্জা করে না তোমার? তুমি আমায় কিসের মনুষ্যত্ব দেখাচ্ছ!’
সুকুমার যেন ঝাঁপ দিয়ে নবনীতার বুকের কাছে কাপড় জামা খামচে ধরল। ধরে টান মারল। নবনীতাকে সে টেনে উঠিয়ে বসিয়ে দেবে। দিয়ে যে কি করবে সে জানে না।
নবনীতাকে উঠে বসতে হল।
সুকুমার বলল, ‘তুমি এতো ছোট? নোঙরা? ইতর?’
নবনীতা বলল, ‘হ্যাঁ, আমি ইতর। তোমার আর তোমার বন্ধু সাধনের মতন মনুষ্যত্ব আমার নেই।’
সুকুমার অন্ধকারে তার স্ত্রীর চোখ দেখবার চেষ্টা করছিল হিংস্রভাবে।
নবনীতা স্বামীর হাত সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘আমার কথার জবাব তুমি দিতে পারবে না। সাধন তার বউয়ের দায় এড়ানোর জন্যে তোমায় পেয়েছে, পেয়ে বেঁচে গেছে। আর তুমি সাধনের বউকে সঙ্গ দেবার ছুতো করে ওদের মন ভোলাচ্ছ। তোমার বন্ধু দায় এড়াবার জন্যে তোমায় টাকা দিয়ে হাতে রাখতে চাইছে, আর তুমি তোমার বন্ধুর বউয়ের চাকর হয়ে পেছন পেছন ঘুরে বেড়াচ্ছ ওদের মন রেখে টাকা পাবার ধান্ধায়। সত্যি করে বলো তো, এই ক’মাস ধরে এত টাকা ওরা কেন দিয়েছে?’
সুকুমার তার শক্ত হাত নবনীতার গলার কাছে উঠিয়ে আনার জন্যে যেন অপেক্ষা করছিল।
নবনীতা বলল, ‘তুমি আর তোমার বন্ধু, দু’জনেই স্বার্থপর। কে বেশী, কে কম আমি জানি না। একটা মেয়ের জীবনের শেষ ক’টা দিনকে সামনে রেখে তোমরা দুই পুরুষ বাজি খেলছ। এর মধ্যে মনুষ্যত্ব নেই।’
—’নেই?’
—’না, নেই। মনুষ্যত্ব থাকলে টাকা থাকত না।’
দাঁতে দাঁত চেপে সুকুমার বলল, ‘এই টাকা তোমার জন্যে!’
—’আমার জন্যে?’
—’হ্যাঁ, তোমার জন্যে। টাকা যখন ছিল না—ডুবতে বসেছিলাম—তখন তুমি পাথরের মূর্তির মতন শক্ত থেকে আমায় রোজ লজ্জা দিয়েছ, আমায় তোমার পায়ে মাথা লুটিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে আনন্দ পেয়েছ। তুমি আমার ব্যক্তিত্বের যেটুকু বাকি ছিল তাও শুষে নিয়েছ। আমি ভেবেছিলাম, টাকা এনে তোমার এই অহঙ্কারের খানিকটা আমি ভাঙব।’
—’ও! পেরেছ ভাঙতে?’
—হ্যাঁ, পেরেছি।…তোমার অন্তত এই অহঙ্কার আর নেই যে তুমি একেবারে অসাধারণ। তুমি সাধারণ। তুমি সব কিছু উপেক্ষা করতে পার না। তোমার রাগ, ঘেন্না, নোঙরামি, ঈর্ষা, লোভ—সবই আছে। আমায় কৃপা করে ভালোবেসেছিলে, বিয়ে করেছিলে—এই অহঙ্কারে আর মাথার ওপর চড়ে থেকো না, নীচে নেমে এসো। সাধন আমায় কৃপা করলে দোষ হয়, তুমি করলে হয় না? মনুষ্যত্ব যদি আমাদের না থাকে তোমারও নেই।’
নবনীতার যে কি হল সে বুঝতে পারল না। মাথায় যেন দপ করে কি জ্বলে উঠল। রাগ, ঘৃণা না কি আক্রোশ? অথবা কোনো অপমান তাকে কাণ্ডজ্ঞানহীন করে ফেলল, সে বুঝল না। হঠাৎ সে স্বামীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিশ্রীভাবে চেঁচিয়ে বলল, ‘না, আমার কিছু নেই। আমি কিছু রাখব না।
এমন ঘটনা এর আগে কখনো ঘটে নি। চার বছরের পুরোনো বিছানায়—বিবাহিত জীবনে এই দুই স্বামীস্ত্রী পরস্পরকে কোনোদিন হিংস্র পশুর মতন আক্রমণ করে নি। আজ করল। নবনীতা সুকুমারের গেঞ্জি ছিঁড়ে দিল, গালে বুকে হাতে অজস্র আঁচড় দিল নখের, মাথার চুল মুঠো করে ছিঁড়ল, কামড় দিল দাঁতের—যত্রতত্র। আর সুকুমার স্ত্রীর শাড়ি ছিঁড়ল, গলার পাতলা হার ছিঁড়ে দিল, কতবার যে লাথি মারল পায়ের দিকে, উরুতে। খোঁপা ভেঙে, জামা টুকরো টুকরো করে এক ভীষণ কাণ্ড করল।
দু’জনেই ইতর হল, কুৎসিত হল, নোঙরা হয়ে গেল। দু’জনেই হাঁফাচ্ছিল, নবনীতা প্রথমে কাঁদল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। সুকুমারের চোখে শুধু জল ভরে উঠল।
আশ্চর্য, এই কলহ কখন যেন গোপনে, আস্তে আস্তে দু’জনেরই ভেতর থেকে এক অন্য ধরনের তাপ ও ক্ষুধা সৃষ্টি করছিল। কেউই বুঝতে পারল না, এত ইতরতার পর কেমন সব দু’হাতে ঠেলে দিয়ে তারা পরস্পরকে ভোগ করার জন্যে কাতর হয়ে উঠল। ভোগ না অনুভব? তারা এতদিন শারীরিক কারণে বহুবার ঘনিষ্ঠ হয়েছে। কিন্তু কোথায় যেন একটা বিচ্ছিন্নতা ছিল। মনে? নাকি অনুভবের মধ্যে? আজ যেন তারা আর বিচ্ছিন্ন থাকল না। একজন অন্যজনের এত কাছে এল—যা আর আসে নি।
অবশেষে দু’জনেই পাশাপাশি তাদের বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। তখনও বুকের শ্বাস স্বাভাবিক নয়, সমস্ত দেহ যেন ভেঙে পড়েছে, বড় ক্লান্ত।
ওদের দেখে মনে হয়, অনেক দূর থেকে দুটো গাড়ি পাশাপাশি বাজি ধরে ছুটে আসছিল; ছুটে আসতে আসতে শেষ পর্যন্ত আর পারল না। ধুলো ভরা, মলিন, দম ফুরোনো অবস্থায় পথের পাশে পাশাপাশি থেমে গেছে। থেমে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আশেপাশে কেউ কোথাও নেই।