পারস্য দেশের কবিতা
আবু আব্দুল্লাহ জাফর ইবনে মুহাম্মদ আল রুদাকি একজন পারস্য দেশের কবি।
তাকে আধুনিক ফারসী ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তিনি রুদাকি নামেই সমধিক পরিচিত। ‘এডাম অব পোয়েট’ বলেও তাকে ডাকা হয়।
তাঁর জন্ম – ৮৫৯ সালে (রুদাক) সামানি সাম্রাজ্য (বর্তমানে তাজিকিস্তান)
মৃত্যু- ৯৪১ সালে (৮৩ বছর বয়সে)।
তাঁর রচনাগুলির মধ্যে অধিকাংশই গজ়ল
এবং রুবাই, কিছু কাসিদাও আছে।
উল্লেখযোগ্য কাজ (সমূহ)
“Lament in Old Age”,
“Mother of Wine”,
কালিলা va ডিমনা।
রুদাকি প্রথম আধুনিক ফারসী বর্ণমালায় কবিতা রচনা করেছিলেন এবং এই কারণেই শাস্ত্রীয় ফারসী সাহিত্যের জনক বলা হয়।
তার কবিতায় ‘কোয়ারেন’ সহ পার্সিয়ান কবিতার প্রাচীনতম ঘরানার অনেকগুলি উপস্থিত রয়েছে। তার কাব্য সম্ভারের খুব অল্প অংশই এখন পাওয়া যায়। তবে ধারণা করা হয় নবম শতাব্দীতে রুদাকির মধ্যে কবিতা, গান, আবৃত্তি এবং কপি লেখক সত্বার যে সংমিশ্রন ঘটেছিলো সেটা তার পূর্বে আর কারও মধ্যে এভাবে পাওয়া যায়নি। তাই রাজসভায় তিনি ছিলেন বিশেষ মর্যাদার অধিকারী।
রুদাকি খুবই সাধারণ ধাঁচের কবিতা লিখতেন কিন্তু আশা এবং আনন্দের সংমিশ্রনে সেগুলোই অভাবনীয় ব্যঞ্জনা তৈরী করত।
শেষ জীবনে তাঁর কবিতায় ঠিক বিপরীত ধারা চলে আসে কোন এক আকস্মিক কারণে।
হৃদয়স্পর্শী বেদনার গল্প স্থান পায় কবিতা জুড়ে।
” মেঘের দিকে তাকাও, দেখো শোকের স্তুতি,
বজ্রনিনাদ যেন প্রেমিকের আর্তনাদ।
মেঘের আড়াল ভেদে রবির প্রস্ততি,
যে ভাবে বন্দী খোঁজে মুক্তির স্বাদ। “
রূদাকির কবিতাগুলিতে জাতিগত সমতা, ইরানীদের স্বাধীনতা, কিংবদন্তি, পৌরাণিক এবং জাতীয় বীরদের গাথা সহ সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক ও সামাজিক পটভূমি উঠে এসেছে। সমসাময়িক আরবরা যে বিষয়ের অভাব বোধ করছিল, প্রাক-ইসলামী যুগের উৎসব ও অনুষ্ঠানগুলির উদ্দেশ্যমূলক পুনর্জাগরণ, বিজ্ঞানবাদ, যুক্তিবাদ এবং মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার উপর জোর দেওয়া, এর সমস্ত কিছুই তার কবিতায় স্থান পায়।
তাঁর রচিত- ১,৩০০,০০০ শ্লোকের মধ্যে, মাত্র ৫২ টি কাসিদা, গজল এবং রুবাই অক্ষত ছিল। স্থানীয় অভিধানের কিছু লুপ্ত-প্রায় লাইনের বাইরে তাঁর মহাকাব্যগুলোর কিছুই আর আজ নেই বলা যায়। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে আবদুল্লাহ ইবনে আল-মুকফার প্রাচীন রূপকথা গ্রন্থ কালীলা ও ডিমনার (পঞ্চতন্ত্র) আরবি সংস্করণ অনুবাদ যা তাঁর রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকের অনুরোধে তিনি পারস্যের শ্লোকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তবে বেশ কিছু টুকরো টুকরো অংশ আসাদি তুসি (লুঘাট আল-ফার্স, এড। পি। হর্ন, গ্যাটিংজেন, ১৮৯৭ সালে) এর পার্সিয়ান অভিধানে সংরক্ষিত রয়েছে।
পারসিক ইতিহাসবিদদের মতানুসারে রুদাকি জন্মান্ধ ছিলেন, বর্তমানে তাঁর কয়েকজন জীবনীকার অবশ্য এ নিয়ে মতানৈক্য প্রকাশ করেছেন।
এ’কালে তাঁকে ‘Adam of poets’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।
৯১৪-৯৪১ সময়কালে রুদাকি, পারস্যের সমানিদ্ শাসক দ্বিতীয় নাসেরের সভাকবি ছিলেন। জন্মভূমি পাঞ্জাকেতেই ৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ৮২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
এই পৃথিবী একটি স্বপ্নের মতো
——————————————
” এই পৃথিবী একটি স্বপ্নের মতো
এ দুনিয়া আদতে স্বপ্নের সংবদ্ধ আচরণ—
সে জেনেছে এ হৃদয় নিয়ত জাগ্রত
ক্রমশ যার অন্তর দীর্ঘ বিমুক্ত হয়
নিমেষে জেনেছে সে— এ চরাচর নিত্য উদারতায় সরিয়েছে নিঠুর তীব্রতা
এখানে সুখের ক্রম নিরন্তরতা সরিয়েছে দুঃখের গতিপথ
তবু কেন এত তৃপ্ত তুমি, যখন বিন্যাসহীন বিশ্ব উঠছে গড়ে
এখানে সমস্ত মুখ কী প্রসন্ন-সুন্দর!
অথচ কদর্য রীতিও আছে সুপ্ত—
এখানে প্রতিটি সত্তায় বিমোহিত প্রাণ
অথচ নীরবে এখানে পরিপ্লুত,
মানুষের অবিনয় ঘ্রাণ… “
নিয়তির দরজা
——————–
“নিয়তির এই দুয়ারকে যেমন ভেবেছ তুমি
জেনো সে তোমার কাছে তেমনই।
এখানে এখন সুখ আছে, খুশি হও তাতে—
অথচ তুমি বিষণ্ণ কেন?
হারিয়েছো কোন চিন্তাতে?
তোমার জন্য যা প্রয়োজন,
জেনো ভাগ্য সে খেলা জানে
এ কথা গ্রহণ কর—
উজিরের সমৃদ্ধ উপায় তোমার তো নয়
নিয়তি জানে কতটুকু প্রাপ্য তোমার…
এ জীবনচক্র— দেখেছ কি অদ্ভুত মিতাচারী
কখনও তোমার মতো রচিত হয় না আর কেউ
তবু আশ্চর্য দ্যাখো,
আরও একশ’ ভাল দরজা খোলার আগে
ঈশ্বর তাঁর দুয়ার স্তব্ধ করে না কখনও…”
শহীদের কাফেলা
—————————
” আমাদের থেকে আরও এগিয়ে গেল শহীদের দৃপ্ত-করুণ কাফেলা
বিশ্বাস রাখো, চলে যেতে হবে আমাদেরও একদিন।
এ কাফেলায় গুণে নাও চোখেদের সারি
মেপে নাও সহস্র বোধের সুদীর্ঘ অধোগতি…
মৃত্যু এসে বেঁধে দিক পা—
তবু তার আগে মর্মবৃক্ষের কাছে,
সংগ্রহ করে আনো সমস্ত উর্বর ফসল!
মৃত্যু এখানে সুবৃহৎ হয়নি কখনও—
তাই যা কিছু সংগ্রামশীল সঞ্চয়
জেনো এত সহজে তা হারাবার নয়…”
হাফিজ় শিরাজী:
———————–
১৩১৫ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পারস্যের শিরাজ শহরে তাঁর জন্ম। হাফিজ় মূলত একজন সুফি কবি, তথাপি যে কোনও প্রকার অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারের কট্টর সমালোচক ছিলেন তিনি। তাঁর গজ়লগুলিই সর্বাধিক বিখ্যাত।
প্রেম, সুরা এবং ক্ষমতার উন্মত্ততার কথা হাফিজ়ের কবিতায় বারবার ফুটে উঠেছে। এক প্রকারভাবে তাঁর কবিতাকে বলা যায় শাসনের বিরোধাভাস— যা জীবনকে শৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীন পরমানন্দ চেতনার সন্ধান দেয়।
১৩৯০ খ্রিস্টাব্দে মাতৃভূমি শিরাজ শহরেই ৭৫ বছর বয়সে তাঁর দেহাবসান হয়।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ— ‘দিওয়ান-এ-হাফিজ়’।
সুরা বন্দনা
—————–
” চেয়ে দ্যাখো শুঁড়ি, রাত্রি শেষ হয়
মদে ভরে দাও শূন্য পেয়ালা
তুঙ্গে বয়ে যায় সময়ের ভেলা
তাড়াতাড়ি করো শুঁড়ি, নেশা শেষ হয়।
এই নশ্বর পৃথিবী আর কতদিন হায়
দয়া করো তার ধ্বংসের আগে
হে শুঁড়ি, আমাকে নীরবে সমাপ্ত করো
পুষ্প-রক্তিম সুরার আঘাতে!
মধুভাণ্ডের পুবদিকে দ্যাখো
পবিত্র রূপে ধরা দেয় সুরা;
সেখানেই যদি তুমি চাও স্বর্গীয় সুখ
উড়িয়ে দাও নিদ্রহীন রাত, ছড়িয়ে দাও প্রবল মদিরা…
মহাশূন্যেও পাব মাটি এইটুকু
আকাশ গড়ে দেবে পাত্রের সমারোহ
তবু আমাদের পার্থিব ঘট
এসো, অফুরান মদিরায় ভরো।
কখনও করিনি পূজা, হইনি সংযমী
নেই অনুতাপ তাতে, নেই বেয়াদবি
শোনো, ভীত নই আমি
সুরার পাত্র হাতে স্বাগতম বলো শুঁড়ি…
মদের পেয়ালা ছোঁয়া কী ভীষণ ভালো
হাফিজ়, সে কথা মনে রেখো—
ঘুরিয়ে দাও যা আছে— শপথের দুরূহ মুখ
যেদিকে রয়েছে ওই বিমোহ দ্রব্য।”
মৃত্যুর মুহূর্ত আগে
—————————
” কোনখানে আছে তোমার আসঙ্গ মিলনের ডাক?
ভেঙে যেতে হবে সমস্ত বন্ধন-শোক,
এ শরীর ছেড়ে যেতে আর ক্ষণকাল
মুক্ত বিহঙ্গ আমি, ছুঁয়ে যাই সে মহাশূন্যলোক।
যদি প্রেম স্বীকার করো সমর্থ চোখে
যদি মেনে নাও ক্রীতদাস বলে আমাকে
তবে দেশ ও কালের নিয়ম উড়িয়ে
এ নগর ত্যাগ করে যাব অনায়াসে…
সুরা ও সুরকার সহ তুমি
এসে বসো আমার কবরের কাছে
বিশ্বাস রাখো তারই সুগন্ধে আমি
এসে যাব নৃত্যময় উচ্ছ্বাসে।
বিমুক্ত ছন্দে এই গতি-বিভঙ্গে, প্রিয়া
চেয়ে থাকো অমৃতমুখে নির্নিমেষ আমাতে;
হাতের রেখা ধুয়ে ফেলি পিপাসার জলে
যেতে হবে বহুদূর— এ যাপন পৃথিবী ছেড়ে!
বৃদ্ধ তবুও, একটি বিপুল রাত্রি—
উন্মুখ করো হৃদয় তোমার
দ্যাখো নিদ্রা ভেঙে অমলিন ভোরে
জীবনের প্রবেশপথে আলোকিত নবযৌবন দুয়ার।
মৃত্যুর দিন শুধু সামান্যকাল
যদি চকিতে পান করি দৃষ্টি তোমার
হাফিজ়ের মতো এ প্রাণ, এ বিশ্বলোক—
ভেঙে উড়ে যাবে পাখি— বন্দি খাঁচার…”
সঈব তবরিজ়ী : মির্জা মহম্মদ আলি সঈব
——————————————————–
আজরবাইজানি তবরিজ়ী-র জন্ম ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে ইরানের তবরিজ় নগরে। তাঁর কবিতায় পারস্য দেশের স্তুতি বা বন্দনা সর্বাধিক চর্চিত বিষয়। আধুনিক গবেষকরা যাকে ‘Persian panegyric poetry’ বলে উল্লেখ করেছেন। তবরিজী ১৬২৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন।
পরে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে দীর্ঘ কয়েক বছর মুঘল রাজদরবারে অবস্থান করেন। তিনি কাশ্মির ও কাবুলেও কয়েক বছর অতিবাহিত করেন এবং ১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ দেশে ফেরেন। ইরানের ইসফাহান নগরে ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে ৮৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
তাঁর কয়েকটি লেখা
১).
” যদিও আমরা কোনও এক তৃপ্ত কাহিনীর জন্য ঘুমিয়েছিলাম
কিন্তু আমাদের সেই ঘুম ভেঙে গেল সুললিত গল্পের কারণে…
প্রতিটি ঘুমের ভিতর স্বচ্ছ আয়না আছে—
যাকে আলোকিত করে চাঁদ, সূর্য— আরও কত শত নক্ষত্রমালা
অতঃপর,
দ্যাখো একসাথে মিশে যায় আলো ও ঘুমের কাহিনীরেখা…”
২).
“এই তরুণ শরতের চেয়ে, পুরনো ইচ্ছেরা আরও বেশি সতেজ হোক
এখানে প্রতিটি গাছের পাতায় বিবিধ রং আসে
দ্যাখো, তাঁর ভালোবাসা এসে
আমাকে দূরে নিয়ে গেছে ধর্মের থেকে—
তবু সূর্য যখন প্রকাশিত হয়
নক্ষত্রের আড়ালও তো তৈরি করে কথা বলবার সুযোগ।
যখন আমরা দেখা করি একে অপরের সাথে
জানো পরিস্কার নয় এও,
দেখা হবে কিনা আবার আমাদের
দেখা হবে কিনা জলে ভাসমান কাঠের মতো…!
৩).
” ফুলের প্রতি আমাদের ভালোবাসা থেকে
গান গাওয়া পাখিটির নাম জানি—
কিন্তু তা না হয় যদি,
তবে কী এসেছে ফিরে একগুচ্ছ পালকের ভরে?
যাবতীয় জটিল সমস্যা থেকে সুদীর্ঘ নিঃশ্বাসে
তুমি শূন্য করতে পারো হৃদয় তোমার
জেনো, একটি সংবাদ-বাহকের আগমন
শত পত্রের জন্য যথেষ্ট মনে হয়…”
মাওলানা জালালউদ্দিম রুমি – এর কবিতা
———————————————————-
রুমির (মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি,১২০৭-১২৭৩) মৃত্যুর পর তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে সর্ব ধর্ম এবং সর্ব বিশ্বাসের লোকেরা এসেছিল। একজন মুসলিম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কেন এসেছো? তা’রা উত্তর দিলো, ‘তাঁর কবিতা আমাদের সমস্ত জীবনকে, আমরা এই পৃথিবীতে যে-যেখানেই যে-জীবন যাপনই করি না কেন, তাকে গভীর ভাবে শ্রদ্ধেয় করে তুলেছেন।’
— এই হচ্ছে সেরা পারস্য প্রতিভা, কবি রুমি। আপনি যে মুহূর্তে এই লেখাটি পড়ছেন, সেই মুহূর্তেও পৃথিবীর কোনো-না-কোনো প্রান্ত থেকে রুমির কবিতার বই বিক্রি হচ্ছে। বলা হয় যে, কবিতার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া কবিতার বই, রুমির কবিতার বই।
কেন?
সে জিজ্ঞাসা পাঠকের মনেও জেগে উঠুক। এখানে তাঁর কয়েকটি কবিতার ভাবানুবাদ পেশ করা হলো। কবিতাগুলো তাঁর “খরঃঃষব নড়ড়শ ড়ভ ষরভব” থেকে নেওয়া হয়েছে।
১).
” একদিন খুব ভোরে বাগান থেকে
আমি একটি ফুল তুললাম,
হঠাৎ করে বাগানের মালী এসে পড়লো,
এবং
আমি ভয়ে আতংকে
থর থর করে কাঁপতে লাগলাম,
মালী বললো,“যেখানে আমি
সমস্ত বাগান তোমাকে দিয়ে দিয়েছি,
সেখানে একটা ফুলের জন্য
তুমি দুশ্চিন্তা করছো!”
২).
” জ্ঞানোনমত্ত পণ্ডিত,
নেমে এসো চূড়া থেকে,
এমনভাবে ডুবে যাও
প্রেমের গভীরে, যেন তুমি
নির্জ্ঞান, নির্বোধ!
একটি ধূলির বিনয় জাগুক
তোমার শরীরে,
কী তরুণ, কী বৃদ্ধ, কী ভালো,
কী মন্দ,– এ- যাত্রায় যদি
সাথে নাও সবাইকে, তবেই
তুমি হবে অধিশ্বর, একদিন।”
৩).
” তোমার সমস্ত ঝুড়ি ভরে আছে রুটিতে,
তবু তুমি সামান্য এক টুকরো
রুটির জন্য
ঘুরে বেড়াচ্ছ দ্বারে দ্বারে।
তোমার হাঁটু অব্দি জল,
তবু
যেই চলে গেল এই পথ দিয়ে
তার কাছে চাইলে
এক ফোঁটা তৃষ্ণার জল।
কেন তুমি এত অন্ধ,অচল?
সব ছেড়ে ফিরে আসো,
শুধু হৃদয়ের কাছে
ভিক্ষা চাও। “
৪).
” হৃদয়, বিবেচক হও,
আত্মা, সহিষ্ণু হও,
ধৈর্য, যদি বইতে না পারো
দুঃখের ভার, তবে পালাও,
আর যুক্তি, যাও, তুমি তোমার
শিশুতোষ খেলাগুলো খেলো। “
৫).
” যে দুঃখ হৃদয়ের গভীরে,
যদি প্রকাশ করো,
সে নেই হয়ে যাবে।
একটি ফুলের দিকে তাকাও,
দেখো,
সে কখনোই তার
গন্ধ, রঙ
কিছুই লুকোয় না। “
৬).
” তোমাকে হারানোর পর থেকে,
এই বসন্ত আর কোনো আনন্দ বয়ে আনেনি,
সমস্ত বাগান ঢেকে গেছে কাঁটায়,
সমস্ত পাথর গলে বৃষ্টি পড়ছে।”
৭).
” নিজেকে হারিয়ে
আমি ঈশ্বরের অনুবাদক বনে গেলাম,
এখন, পানোনমত্ত অথবা অনুনমত্ত,
যে অবস্থায়ই থাকি না কেন,
মুখ থেকে কোনো শব্দই আর বের হয় না।”
৮).
” আমার সমস্ত শিরায় প্রেম বয়ে গেল,
এবং আমি শূন্য হয়ে গেলাম।
এখন আমার সমস্ত জুড়ে আছে সে,
আর আমার সম্পদ বলতে নিজের
নাম ছাড়া আর কিছু নেই। “
৯).
” রাতে প্রবল বায়ুর মতো
আমি শহরময় বিচরণ করি,
ঘুম নেই চোখে,
ভদ্রলোকেরা
বারবার
বিষয়-বুদ্ধির দিকে আমার চোখ ফেরাতে চায়,
কিন্তু আমার মন তা শুনতে অপ্রস্তুত,
কারণ ভালোবাসার এই মদে
আমি
লুপ্ত এবং মত্ত হয়ে আছি। “
১০).
” আমার চিন্তা গভীর আবেগের মধ্যে
ঘুরপাক খাচ্ছে,
আমার হৃদয় বাতাসের মধ্যে ঘুরছে,
যেমন করে উঁচুতে
পাখিরা ঘুরতে থাকে,
আমার সত্ত্বার
প্রতিটা পরমাণু ঘুরছে,
আমার ভালোবাসার মানুষও কি
ঘুরছে—- সমস্ত চরাচরে,
এমনি করে?”
তাঁর আরও দুটি খন্ড-কাব্য
১).
হৃদয়ে লুকিয়ে রাখা গোপন কথা, আর মিথ্যাচার
চোখের তারায় দৃশ্যমান দিনের মত পরিষ্কার।
২).
হৃদয়ের নেই কোন দেশ …
তবে রুমির প্রেমবাদ আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় তার একশ বছর আগে জন্ম নেওয়া এক চারণ কবি নিজামি গানজাভির মহাকাব্যের কারণে।
গানজাভি
—————
গানজাভি নামটির উৎপত্তি গানজা এলাকা থেকে (তার নামের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে গানজা নামের এলাকার নিজাম নামক ব্যক্তিটি) যা বর্তমানে আজারবাইজানের অংশ।
এখানে তার কিছু মহাকাব্যে খসরো ও শিরিন থেকে কিছু চরণ তুলে ধরা হল, খসরো ছিলেন এক সাসানীয় শাসক তিনি আর্মেনিয়ার রাজকন্যা শিরির হৃদয় জয় করার জন্য নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ফরহাদের সাথে কবিতার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে।
প্রশ্ন – তুমি কী হৃদয় দিয়ে বেসেছ ভালো?
উত্তর – তোমার হৃদয় বলে কথা, আর আমি বলি আত্মা দিয়ে,
প্রশ্ন – কখন তুমি তোমার ভালবাসা থেকে নিজের হৃদয় সরিয়ে নেবে?
উত্তর – যখন আমি কেবল কবরে শায়িত হব
প্রশ্নে বলা হল – হৃদয় থেকে শিরিনের ভালবাসা মুছে ফেলো
উত্তর এলো – তবে আমি আমার আত্মা ছাড়া আমি বাঁচবো কি করে?
আইয়ান আল কোজাত হামাদানি’র কবিতা
——————————————————–
আইয়ান আল কোজাত হামাদানি পারস্যের হামেদান শহরে ১০৯৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। বিখ্যাত দার্শনিক এবং মরমী সাধক। জীবনের দীর্ঘ সময় তাঁর কেটেছে জেলে। তেত্রিশ বছরের জেল হয়েছিল তাঁর বিধর্মের জন্য। তিনি বিখ্যাত আবু হামেদ গাজ্জালীর উপর ব্যাপক পড়াশোনা করেন এবং পরে তাঁর ভাইয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর ভাইয়ের কাছে লেখা চিঠিগুলি জগৎ-বিখ্যাত। তাঁর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কাজ ‘তামহিদ’, এটা শুধুমাত্র ফরাসি ভাষায় অনুবাদ পাওয়া যায়। ইংরেজিতে তাঁর একমাত্র যে অনুবাদটি পাওয়া যায়, সেটা হচ্ছে, ‘সাকওয়া-ই-গারিব”। এই বইটি তিনি মৃত্যুর কিছুদিন আগে, জেলে থাকা অবস্থায় লিখেছিলেন। নীচে যে কবিতাটি দেওয়া হলো , সেটি তাঁর সবচেয়ে বহুল পঠিত কবিতা।
খণ্ডাংশ ১
না-থাকার গভীরে আরো
এক গভীর না-থাকা,
সেই আমার নিয়ম।
হারিয়ে যাবার গভীরে
আরো এক গভীর
হারিয়ে যাওয়া,
সেই আমার ধর্ম।
খণ্ডাংশ ২
আমি জানি,
এই-যে যেখানে তুমি আছো,
সেখানে আমি আসতে পারি না ;
আমি জানি,
এই-যে যেখানে আমি আছি,
সেখানে তুমি আসবে না ;
আমি জানি।
খণ্ডাংশ ৩
হায়! ঐ চোখ কী
কখনো তার
মুখ দেখেনি!
ঐ হৃদয় কী
কখনো তার
চোখের পাপ
অনুভব করেনি!
পরম তৃষ্ণা আমার
যতদিন এই প্রাণ প্রাণময়,
তোমাকে ভালোবাসার
দুঃখ আমি
পান করে যাব,
মৃত্যুর কালেও
কাউকে দেবনা
তার ভার,
কাল
পুনরুত্থানের দিনে,
এই পরম তৃষ্ণা নিয়ে
হেঁটে যাব সম্মুখে।
নিষিদ্ধ হেরেম
——————
যদি আমার পা দুটো অসার
হয়ে আসে, তোমার পিছে
ছুটবো না, ভেব না
আমার হৃদয় তোমার
ভালোবাসার জালে আটকা পড়েনি,
ভেব না, তোমার প্রেম বহুজনে,
এই ভেবে আমি স্থাণু;
আমার চোখ নিষিদ্ধ হয়ে আছে
তোমার দৃষ্টির হেরেমে।
দরজায় কড়া নেড়ে চলেছে যে
—————————————–
আমার সমস্ত স্বপ্ন জুড়ে ছিলো সে,
ঠোঁটের উপরে ঠোঁট,
স্তন ছুঁয়ে ছিলো স্তন;
তার কানে কানে বললাম,
“আমার হৃদয়, এই রাত্রিকে
অশেষ করে তোলো…”
হঠাৎ জেগে উঠে দেখি,
আমি শুধু দরজায়
কড়া নেড়ে চলেছি।
নাজমদ্দিন কোবরা
————————–
নাজমুদ্দিন কোবরা ১১৪৫ খ্রিস্টাব্দে খিভায় (খাওয়ারাজাম নামে পরিচিত) জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি এখানেই কাটান। তিনি বিদ্যাশিক্ষার জন্য নিশাপুর, পরে, মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়ায় যান, যেখানে তিনি রাজবেহান আল-ওয়াযান আল-মেসরির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি নিজে একজন মহান সুফি সাধক ছিলেন। ১২২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি যুদ্ধে মারা যান।
নীচের কবিতাটি তাঁর বহুল পঠিত একটি কবিতা।
” যা-কিছু অস্তিত্বমান নয়, তা
হাতে একমুঠো হাওয়া ছাড়া আর
কিছুই রেখে যায় না;
যা-কিছু অস্তিত্বমান, তা
ব্যর্থতা ও অপূর্ণতা ছাড়া আর
কিছুই দিতে পারে না ;
সেক্ষেত্রে, একজন শুধু স্বপ্ন দেখতে
পারে তারই—-যা কখনই ছিল না;
এবং সেজন্যই সে সত্য;
মনে রেখো,
এই সত্য কখনোই অস্তিত্বমান নয়।”
এমনকি আরো খানিকটা পিছিয়ে যাওয়া যাক (৮৫৮-৯৪১ খিস্টাব্দ), পাঞ্জিকেনতে (আধুনিক তাজিকিস্তান ) কবি রুদাকি, কারো কারো মতে যে ফার্সী কবিতার পুরোধা।
” তোমার ভালবাস আস্থা আর আমার আত্মা ছিনিয়ে সুন্দর মুখশ্রী আমার মন ও হৃদয়কে করে ফেলে এলোমেলো
আমার হৃদয়ে যে বিষাদ, এক পাহাড় চেপে রাখা বুক
তোমার বক্ষের নীচে পাথর হৃদয়, নেইকো যেথায় দুঃখ সুখ,
একদিন আমি স্মৃতির মাঝে হব বিলীন
প্রিয়ে, তুমি তোমার স্মৃতির মাঝে আমার হৃদয় খুঁজে দেখো
আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি আমার হৃদয়কে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে।।
কারণ তারা আমাকে এক শীতল শরতে আটকে রেখেছে… “
আধ্যাত্মিক কবি হাফিজ
——————————————————-
কবি হাফিজ (১৩২৫-১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দ) শুধু ইরানেরই নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের প্রথিতযশা কবিদের একজন। তিনি ইরানের শিরাজ নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম হলো শামসুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ হাফিজ শিরাজী এবং কবি নাম বা ভনিতা হলো হাফিজ। তাঁর পিতা বাহাউদ্দীন ছিলেন ইসফাহানের একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী। পরবর্তীকালে তিনি এ ব্যবসা উপলক্ষে ইসফাহান ত্যাগ করে শিরাজে চলে আসেন। তাঁর মা ছিলেন কাজরুনের অধিবাসী। তাঁর দুই ভাই ছিল যারা তাঁর চেয়ে বয়সে বড় এবং বয়ঃপ্রাপ্তির পর তারা শিরাজ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। কিন্তু হাফিজ মায়ের সাথেই আর্থিক সংকটের মধ্যে শিরাজে থেকে যান এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি শিরাজেই অবস্থান করেছিলেন।
মৃত্যুর পর তাঁকে ‘খাকে মুসাল্লা’ নামক স্থানে দাফন করা হয়।
হাফিজের শৈশব খুব একটা সুখের ছিল না। কারণ, পিতৃহারা হাফিজকে সংসারের দায় শৈশব থেকেই বহন করতে হয়েছিল। যে কারণে অর্থ উপার্জনের দায় তিনি মাথা পেতে নিয়েছিলেন। প্রসিদ্ধ ইরানি লেখক ও সাহিত্যিক আব্দুন্নবী তাঁর ‘মেইখানে’- নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, হাফিজ স্থানীয় একটি রুটির দোকানে কাজ করতেন আর সেখান থেকে পাওয়া অর্থ দিয়েই দিনযাপন করতেন ( আমাদের দেশের কবি নজরুল ইসলামও একটি রুটির দোকানে কাজ করতেন।) এই রুটির দোকানের পাশেই একটি বিদ্যালয় ছিল যেখানে কাওয়াম উদ্দিন আবদুল্লাহ (মৃত্যু ৭৭২ হি.) নামে একজন প্রসিদ্ধ আলেম শিক্ষা দান করতেন। হাফিজ রুটির দোকানে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর কাছ থেকে বিদ্যার্জন করতেন। শুধু প্রাথমিক শিক্ষাই নয়, বরং কুরআন হেফ্জ করা থেকে কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও দর্শনশাস্ত্রেরও জ্ঞান অর্জন করেন। এরপর ধীরে ধীরে ইসলামের বিধি-বিধান ও সাহিত্য সংক্রান্ত জ্ঞান নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করতে শুরু করেন। যেহেতু সেকালে সাহিত্যের জ্ঞান শরীয়তের জ্ঞান লাভের পটভূমি ছিল, সেহেতু তিনি ধর্মীয় জ্ঞানেও প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করেন। হাফিজের যুগে শিরাজ ছিল ধর্মীয় জ্ঞান ও কবি-সাহিত্যিকদের আবাসভূমি। এই বিষয়টি তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞানার্জনে বিস্ময়কর প্রভাব বিস্তার করে।
হাফিজ উপরিউক্ত শিক্ষক ছাড়াও শামসুদ্দীন আবদুল্লাহ শিরাজী ও কাজী এযদুদ্দীন আবদুর রহমান ইয়াহইয়ার নিকট থেকে দর্শন ও তাসাউফের জ্ঞান অর্জন করেন। জানা যায়, হাফিজ চল্লিশ বছর পর্যন্ত বিদ্যার্জনে রত ছিলেন। কুরআন কণ্ঠস্থকরণ ও কুরআনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণেই অবশেষে ‘খাজা হাফিজ’ নামে তিনি অভিহিত হয়েছিলেন।
তাঁর কাব্যের ছত্রে ছত্রে এই কুরআনের প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। হাফিজ নিজেই এ ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন –
ندیدم خوشتر از شعر تو حافظ به قرآنی که اندر سینه داری
[হে হাফিজ ! তোমার বক্ষে ধারণকৃত এই কুরআনের চেয়ে
সুন্দর ও সুমিষ্ট বাণী আর কিছুই দেখি নি।]
ইরানিরা কবি হাফিজকে আদর করে ‘বুলবুলে শিরাজ’ অর্থাৎ শিরাজের বুলবুল বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। তারা হাফিজকে লেসানুল গায়েব (অজ্ঞাতের বাণী), তরজমানুল আসরার (রহস্যের মর্ম সন্ধানী) প্রভৃতি অভিধায় অভিহিত করে থাকেন।
হাফিজ ছোটবেলা থেকেই কাব্যচর্চায় অনুরক্ত হয়ে পড়েন। আবদুন্নবী তাঁর ‘মেইখানে’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, শিরাজে যেখানে তিনি অবস্থান করতেন তার সন্নিকটে একটি বাজার ছিল। বাজারে একজন বড় বস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন। যিনি ছিলেন কাব্যপ্রেমিক ও রসিক প্রকৃতির লোক। যেখানে রসিক কবি-সাহিত্যিকরা এসে জড়ো হতেন এবং কাব্যচর্চায় মুখরিত থাকতেন।
হাফিজও এখানে যাতায়াত করতেন এবং সমকালীন কবিদের সান্নিধ্য লাভ করতেন। তাঁর কাব্যচর্চা দেখে অনেক সময় বন্ধুরা তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত। উল্লেখ্য যে, তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে খোদায়ী প্রেমের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। কেননা, এ খোদায়ী প্রেমই কাব্য সাধনায় তাঁকে উজ্জীবিত করেছিল।
হাফিজের মতে, প্রেম-ভালোবাসা এমন এক ঐশী চেতনা যা মানুষকে তার প্রেমের মূলে তথা প্রেমাস্পদের সান্নিধ্য লাভে উদ্বুদ্ধ করে।
স্রষ্টার আকর্ষণ তার মধ্যে এমনিভাবে এক বিশাল আকার ধারণ করে যে, সৃষ্টির যে কোনো সৌন্দর্যই তাকে স্রষ্টার স্মরণে আকুল করে তোলে( এই ধারণার সাথে রবীন্দ্র ভাবনার অনেকখানি মিল আছে)। কবি হাফিজ এই প্রেমকে এমন এক মূল্যবান অর্ঘ্য বলে মনে করতেন যার প্রাপ্তি কেবল তার প্রেমাস্পদের একান্ত অনুগ্রহেই সম্ভব হতে পারে। হাফিজ মনে করেন, তাঁর মাঝে যে ঐশীপ্রেম বিদ্যমান রয়েছে তা কেবল তাঁর স্রষ্টার বিশেষ অনুগ্রহ ও দান। বিশ্বলোকের অন্যান্য প্রাণীকুল এই অনুগ্রহ ও দান থেকে বঞ্চিত। হাফিজের কবিতা ও গজলের ছত্রে ছত্রে সেই প্রেমের দৃষ্টান্ত ও প্রতিভাস খুঁজে পাওয়া যায়। লৌকিক প্রেমের পাশাপাশি তিনি স্বর্গীয় প্রেমকে অত্যন্ত নিপুণভাবে তাঁর কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে হাফিজের ভাষায় এ প্রেম কোনো সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। প্রেম সলিলে অবগাহন করতে হলে প্রেমিকের জন্য যে অফুরন্ত ও অসীম সাধনার প্রয়োজন রয়েছে তা তাঁর কাব্যে ভাস্বর হয়ে ফুটে উঠেছে।
হাফিজ বলেন –
الا یا ایها الساقی ادر کأسا و ناولها که عشق آسان نمود اول ولی افتاد مشکلها
به بوی نافهای کاخر صبا زان طره بگشاید ز تاب جعد مشکینش چه خون افتاد در دلها
“হায় বধুয়া! দাও পেয়ালা ঢালো শরাব মধুক্ষরা
সহজ ছিল পথটি প্রেমের দেখছি এখন কাঁটা ভরা।
ভেবেছিলাম ভোর বাতাসে কস্তুরী-বাস আসবে ভেসে
বধুর চিকন চিকুর হতে, কলজে হলো ঘায়েল শেষে” (হাফিজ, ১৯৮ : ১৭).
হাফিজের একটি দিভান তথা কাব্যসমগ্র রয়েছে। এতে গজল ও রুবাই সহ নানা আঙ্গিকের কবিতা আছে। কিন্তু হাফিজ গজল রচনা করেই বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন এবং গজল রচনায় তাঁকে ফারসি সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি বলা হয়ে থাকে। হাফিজ মধুর কণ্ঠে ও সুললিত ভাষায় তাঁর গজলসমূহে সুফি তত্ত্বই বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর কবিতার মধ্যে বসন্ত, গোলাপ, বুলবুল, মদ, যৌবন, সৌন্দর্য এবং বিশেষ করে প্রেমিকা ও প্রেমাস্পদের রূপ, গুণ ও দোষের বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু তাঁর এ সকল বর্ণনা রূপকভাবে খোদার প্রতি ভালোবাসার অপূর্ব কাহিনী মাত্র।
হাফিজের গজল শেখ সাদির প্রেমময় বিষয়বস্তু এবং ফরিদ উদ্দিন আত্তার ও মাওলানা রুমির আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তুকে ধারণ করে আছে। এছাড়া কবি সানায়ির সামাজিক ও সমালোচনামূলক বিষয়ও তাঁর কাব্যে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে তিনি কাসিদার ন্যায় স্তুতি বর্ণনায়ও পারদর্শী ছিলেন। তাঁর কবিতার সম্বোধিত বিষয়বস্তু হলো প্রভু, প্রেমাস্পদ ও প্রশংসিত ব্যক্তি। তাই তাঁর কবিতা সাদির গজলের ন্যায় দ্রুত বুঝা যায় না এবং মাওলানা রুমীর প্রতীকী কবিতার মতো তা বুঝতে কঠিন বলেও মনে হয় না। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই হলো আধ্যাত্মিক ভাবনা সুলভ।
হাফিজ তাঁর কবিতাগুলোকে এমনভাবে বিন্যস্ত করেছেন যাতে পাঠক তৎক্ষণাৎ তা থেকে একটি কল্পিত ভাব গ্রহণ করতে পারে।
হাফিজের কবিতার অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হলো কবিতার শ্লোকগুলোর সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক। তাঁর গজলগুলোতে একটি নীরব চিন্তাধারার প্রবাহমানতা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
হাফিজের গজলে পদগুলোর ধারাবাহিকতায় একটি পংক্তি বা ছত্রের সাথে অপর একটি পংক্তি বা ছত্রের বিষয়বস্তুগত সাধুর্য্য বাহ্যিকভাবে লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু যখন কোনো অনুসন্ধিৎসু পাঠক তাঁর পুরো একটি গজলের বিষয়বস্তু হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন তখন তিনি একটি শ্লোকের সাথে অপর শ্লোকের বিষয়বস্তুগত যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে তা অনায়াসে বুঝতে পারবেন।
হাফিজ তাঁর কাব্যে শুধু রূপক প্রেমের বর্ণনাই করেন নি, বরং কবিতার কাঠামো নির্মাণে বিভিন্ন প্রকারের কাব্যালঙ্কাকারের এমন প্রয়োগ দেখিয়েছেন যা তুলনা রহিত। তিনি তাঁর কবিতার শ্লোকগুলোতে ইহাম (দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্য বা পরোক্ষ ইঙ্গিত), এস্তেখ্দাম (একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ), তাশ্বিহ (উপমা বা সাদৃশ্য), তাজনিস (সাদৃশ্য), কেনায়া (রূপক) অত্যন্ত দক্ষতা ও নিপুণতার সাথে ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে ইহাম তথা দ্ব্যর্থবোধক শব্দ তাঁর কবিতায় বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি তাঁর কাব্যে সুন্দর-সুন্দর উপমা ও উৎপ্রেক্ষা বর্ণনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাছাড়া আরবি ও ফারসি সাহিত্যের একটি বড় বিষয় হচ্ছে কাফিয়া তথা অন্ত্যমিল। এই অন্ত্যমিল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তাঁর দক্ষতার নিপুণ ছাপ পরিলক্ষিত হয়। যেমন –
لعل سیراب به خون تشنه لب یار من است وز پی دیدن او دادن جان کار من است
[সতেজ, রক্তবর্ণ মণি বিশেষের ন্যায় আমার বন্ধুর ঠোঁট রক্তপিপাসু
এবং আমার কর্তব্য তাকে পেয়ে আত্মোৎসর্গ করা।]
বিদ্রƒপাত্মক ও সমালোচনাধর্মী বিষয়গুলোও তাঁর দিভানে বহুল পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়
এবং সাধারণতঃ তিনি কপট ও বক-ধার্মিকদেরকে শ্লেষ-মিশ্রিত ভাষায় সমালোচনা করেছেন।
চিন্তা-চেতনার দৃষ্টিকোণ থেকে হাফিজের কবিতা হলো ‘নেযামে রেন্দি’ তথা সূক্ষ্মদর্শী তাপসের জীবন পদ্ধতি। রেন্দি হলো বাকচাতুর্যে পটু এমন একজন তাপস ব্যক্তি বা সূক্ষ্মদর্শী আরেফ, যিনি চিন্তা ও কর্মে প্রেম বা এশকের ওপর নির্ভর করে থাকেন। এমনিভাবে এশক্ শব্দটি প্রায়শই তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে এবং তা প্রায় ২৩৪ বার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। হাফিজের ভাষায় মূলতঃ রেন্দির সাথে এশকের একটা পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে, সাধারণত সে কারণেই এ শব্দ দুটি তাঁর কাব্যে একত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, শরাবের বর্ণনা হাফিজের কাব্যে অসংখ্যবার এসেছে।
কারণ এটাই যে, হাফিজ ‘শরাব’-কে দুঃখ-বেদনার উপশম হিসাবে মনে করেছেন। তাঁর নিকট এটিই একমাত্র বস্তু যার মাধ্যমে জীবনের যত রকমের তিক্ততা ও বিস্বাদ আছে তা দূর করা যেতে পারে। যেমন হাফিজ বলেন –
ساقیا برخیز و درده جام را خاک بر سر کن غم ایام را
[হে সাকী! ওঠ, আমাকে শরাবের পেয়ালা দাও,
আর দুঃখের দিনের শিরে ধূলি নিক্ষেপ কর।]
হাফিজের কাব্যে এই যে উন্মত্ততার বহিঃপ্রকাশ তার অন্তর্নিহিত ও গূঢ় রহস্য অত্যন্ত ব্যাপক।
তাঁর এই উন্মত্ততা এই জন্য নয় যে, তিনি কিছুক্ষণের জন্য শরাব পান করে নিজেকে অসাড় ও তন্ময়গ্রস্ত করে তুলবেন, বরং তিনি চেয়েছেন এই প্রেম মদিরা পান করে নিজেকে সতেজ-সজীব ও প্রাণবন্ত করে তাঁর প্রেমাস্পদের বা আরাধ্যের সমীপে উপস্থিত করতে। এছাড়া তিনি চেয়েছেন এই প্রেমের শরাব পান করে তাঁর মধ্যে এমন একটি যোগ্যতা সৃষ্টি করতে, যাতে তিনি একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেকে প্রেমাস্পদের সম্মুখে হাজির করতে পারেন।
হাফিজ দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত জ্ঞান সাধনা করেছেন যা তাঁর নিজের গজল থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে –
علم و فضلی که به چل سال دلم جمع آورد ترسم آن نرگس مستانه به یغما ببرد
[দীর্ঘ চল্লিশ বছরের সাধনায় আমার অন্তরে
যে জ্ঞান-বৈশিষ্ট্য সঞ্চিত হয়েছে,
ভয় হয়, না জানি প্রেয়সীর চোখের চাহনি
তা হরণ করে নিয়ে যায়।]
কাব্যচর্চার পাশাপাশি তাঁর এই জ্ঞানচর্চা নিছক কোনো বৈষয়িক জ্ঞান নির্ভর ছিল না। অধিকন্তু ক্ষেত্রে তা ছিল আধ্যাত্মিক বা পরমার্থিক জ্ঞান।
তবে এই আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে হাফিজ মুরশিদের আবশ্যকতা উপলব্ধি করেছেন।
বিধায় তিনি বাহাউদ্দিন নকশেবন্দীসহ একাধিক প্রসিদ্ধ সুফির সংস্পর্শে সময় ব্যয় করেছেন। এ ব্যাপারে হাফিজের মত হচ্ছে এই মুর্শিদ ব্যতীত প্রেমের পথে পা বাড়িও না।
এ পথের পথপ্রদর্শক (সালেক) বা মুর্শিদ না পেলে পথিককে পথভ্রান্ত হতে হয়। তবে এ ক্ষেত্রে সচেতনতা ও সতর্কতা অপরিহার্য।
কারণ, গুরু চিনতে ভুল করলে শিষ্যের জীবনে ভ্রান্তি, ভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতি নেমে আসা একান্তই স্বাভাবিক।
হাফিজ বলেন –
به می سجاده رنگین کن گرت پیر مغان گوید که سالک بیخبر نبود ز راه و رسم منزلها
[তোমার খাঁটি পীর যদি বলে তবে শরাব রং-এ তোমার মুসাল্লা রাঙ্গিয়ে নাও,
কেননা, সালেক মানযিলের পথ-পদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক অবগত।]
হাফিজ তাঁর কাব্যে সুরা-সাকী প্রভৃতি শব্দ কতটা রূপক (অপ্রকৃত) বা প্রকৃত অর্থে ব্যবহার করেছেন তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে বলে অনেকে মনে করেন।
গোঁড়াপন্থীরা যাই বলুন, হাফিজ যে একজন ধর্মপ্রাণ, খোদাভক্ত মুসলমান ছিলেন, তাঁর রচিত কাব্যের বহু স্থানে সেই সত্য বিক্ষিতপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। এই প্রসঙ্গে হাফিজের ইন্তেকালের পর জানাযা নিয়ে গোঁড়াপন্থী ও উদারপন্থীদের মধ্যে যে বিরোধ উপস্থিত হয়েছিল তা উল্লেখযোগ্য।
গোঁড়াপন্থীরা হাফিজকে ধর্মদ্রোহী শারাবখোর বলে তাঁর জানাযা দিতে অস্বীকার করে এবং এই নিয়ে হাফিজের উদারপন্থী ভক্তবৃন্দের সাথে তাদের বিবাধ ঘটে। কতিপয় লোকের হস্তক্ষেপের ফলে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, হাফিজের রচিত কবিতা একত্র করে সেখান থেকে যে কোনো একটি কবিতা তুলে দেখা যাক, এ সম্বন্ধে তিনি কিছু লিখে গেছেন কি-না। তাই করা হলো এবং যে কবিতাটি প্রথম তুলে নেয়া হলো তা হলো –
قدم دریغ مدار از جنازه حافظ که گر چه غرق گناه است میرود به بهشت
[হাফিজের জানাযা থেকে ফিরে যেও না ভাই
যদিও সে পাপে মগ্ন রয়েছে তথাপি বেহেশতে পাবে ঠাঁই।]
এই কবিতাটি উদ্ঘাটনের পর হাফিজকে ‘লেসানুল গায়েব’ বা অদৃষ্টের রসনা বলে স্বীকার করে উভয় দল মহাসমারোহ ও সম্মানের সাথে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন। অনেকের বিশ্বাস এখন পর্যন্ত কেউ তাঁর দিভান খুলে দিভানের যে কবিতার ওপর প্রথম দৃষ্টি পড়ে, সে কবিতায় তার ভবিষ্যৎ ইঙ্গিত লাভ করে।
হাফিজ তাঁর গজল ও রূবাইগুলোতে বিশুদ্ধ প্রেমের মাহাত্ম্য ও খোদাপ্রাপ্তির তথা খোদার নৈকট্য লাভের উপায় বর্ণনা করেছেন।
হাফিজের কাব্যে কোথাও ধর্মের ভান বা প্রতারণার অবকাশ নেই। তাঁর মতে খোদার প্রেমে অবগাহন করে যে নিজেকে বিলীন করে দিতে পারে সেই প্রকৃত খোদা-প্রেমিক।
ধর্মের নামে প্রতারণা বা ভান করা সম্পর্কে হাফিজ বলেন –
آتش زهد و ریا خرمن دین خواهد سوخت حافظ این خرقه پشمینه بینداز و برو
[কপটতা ও প্রতারণার আগুন ধর্মের ভারকে অবশ্যই জ্বালিয়ে ফেলবে,
হে হাফিজ! এ দরবেশি পোশাক পরিত্যাগ করে সামনে অগ্রসর হও।]
বাহারে হেজাজ (কবিতার এক প্রকার ছন্দের নাম) ছন্দে লিখিত কবি হাফিজের এই শ্লোকটি অথবা অনুরূপ আরো অনেক শ্লোকই তাঁর শব্দচয়ন, ভাষা-ছন্দ ও অলংকারের নিপুণতার স্বাক্ষর বহন করে।
তিনি আরো বলেন –
سخن عشق نه آن است که آید به زبان ساقیا می ده و کوتاه کن این گفت و شنفت
[মুখে যা কিছু উচ্চারিত সেটাই প্রেমের কথা নয়,
হে সাকী! ঢালো শরাব আর সংক্ষিপ্ত কর তোমার কথাবার্তা।]
প্রেম-বিরহ এবং মায়া-মমতা ঘেরা এই নশ্বর পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা তুচ্ছ নিরর্থক নয়।
মানুষের জীবনে সুখ-শান্তির পাশাপাশি বিরহ-বেদনা, দুঃখ-যাতনা অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। মানুষ এই পৃথিবীতে স্বপ্নের তাজমহল গড়তে চেষ্টা করে। সংসার গড়ে। স্ত্রী-পুত্র পরিজনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
আর এই পথ ধরে মানুষের জীবনে আসে নিরবচ্ছিন্ন প্রেমের তাগাদা।
কবি হাফিজের জীবনও হয়তো এর ব্যতিক্রম ছিল না। তাই আমরা তাঁর যৌবনের শুরুতেই দেখতে পাই শাখ-ই-নাবাতের মত এক প্রেয়সীর সান্নিধ্য লাভের একান্ত বাসনা। কবির জীবনে এটা কতটা সত্য তা আমরা জানি না, তবে জীবনীকাররা এ ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
হাফিজ সংসার ধর্ম যাপন করেছেন।
তাঁর পুত্রসন্তান ‘বুলবুল’ অকালে প্রাণ হারালে হাফিজ তার জন্য কেঁদে বলেছেন –
دلا دیدی که آن فرزانه فرزند چه دید اندر خم این طاق رنگین
به جای لوح سیمین در کنارش فلک بر سر نهادش لوح سنگین
“ওরে হৃদয়” তুই দেখেছিস,যে পুত্র আমার আমার কোলে
কি পেয়েছে সে এই রঙিন গগণ-চন্দ্রাতপের তলে।
সোনার তাবিজ রূপার সেলেট মানাতো না বুকে রে যার,
পাথর চাপা দিল বিধি হায় কবরের সিথানে তার।” (নজরুল, ১৯৯৬: ৪৩)
কবির জীবনে প্রেমের এই যে বিচিত্র লীলাখেলা তা কতটা লৌকিক আর কতটা স্বর্গীয় তা নির্ণয়ের ভার হাফিজের বোদ্ধা পাঠক ও সমালোচকদের ওপরেই ছেড়ে দেয়াই ভালো। তবে তিনি যে যৌবনের প্রারম্ভেই এই প্রেমসাগরে অবগাহন করেছেন তা তাঁর কাব্যে বিচিত্রভাবে বিধৃত হয়েছে। হাফিজ বলেন –
اگر آن ترک شیرازی به دست آرد دل ما را به خال هندویش بخشم سمرقند و بخارا را
بده ساقی می باقی که در جنت نخواهی یافت کنار آب رکن آباد و گلگشت مصلا را
[শিরাজের সেই তুর্কী তন্বী যদি আমার হৃদয় হরণ করে
তবে তার কালো তিলের তরে সমরকন্দ ও বোখারা দান করে দেব।
ওগো সাকী, অবশিষ্ট শরাবটুকু আমায় দাও, কেননা বেহেশতে
রোকনাবাদের স্রোতস্বতী ও মোছাল্লায় পুষ্প উদ্যান মিলবে না।]
হাফিজ আল্লাহর প্রেমে নিমগ্ন হলেও দেশ, দেশের মাটি ও মানুষকে গভীর অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন। এই ভালোবাসা ছিল যেমনি সনাতন তেমনি নির্বিশেষ।
হাফিজ শিরাজের লোক। শিরাজকে তিনি কীভাবে ভালোবেসেছেন তার নির্দশন আমরা খুঁজে পাই তাঁর কবিতার পরতে পরতে।
কবি হাফিজ জীবনভর শিরাজ নগরীর সঙ্গে তাঁর অন্তরকে বেঁধে রেখেছিলেন।
যেমন তিনি বলেন :
اگر چه زنده رود آب حیات است ولی شیراز ما از اصفهان به
[যদিও ইসফাহান হচ্ছে সঞ্জিবনী সুধা, কিন্তু আমাদের শিরাজ হচ্ছে
ইসফাহানের তুলনায় সহস্রগুণে শ্রেষ্ঠ।]
خوشا شیراز و وضع بیمثالش خداوندا نگه دار از زوالش
[শিরাজ নগরী তুলনাহীন, তার প্রশংসা আর কত করব
হে খোদা! যে কোনো ধরনের পতন থেকে একে রক্ষা কর।]
তিনি সব সময়ই এ সবুজ শ্যামল ও সুখময় স্থান তথা তাঁর স্থায়ী বাসস্থানের সঙ্গে নিজের অন্তরকে বেঁধে রেখেছিলেন। জানা যায় তিনি একবার ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন। কিন্তু শিরাজ থেকে ইয়ায্দ পর্যন্ত পৌঁছেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তিনি তাঁর প্রিয় শিরাজ নগরীকে বার বার স্মরণ করেন এবং বলেন –
خرم آن روز کز این منزل ویران بروم راحت جان طلبم و از پی جانان بروم
دلم از وحشت زندان سکندر بگرفت رخت بربندم و تا ملک سلیمان بروم
[সেই সৌভাগ্যপূর্ণ দিনগুলো কখন ফিরে আসবে,
যখন আমি এই বিরাণ ভূমি থেকে প্রত্যাবর্তন করতে পারব?
কখন সে দুঃখ-বেদনা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং প্রিয়তমার সাক্ষাৎ লাভ হবে?
আলেকজান্ডারের জেলখানার আতংকে আমার অন্তর সংকীর্ণ ও আড়ষ্ট হয়ে গেছে,
কখন সফরের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করব
কখন সোলাইমানের নগরীতে প্রত্যাবর্তন করব?]
কবি রচিত এই কবিতাগুলোতে আধ্যাত্মিকতা চিন্তা করলে কবির অন্তরের গভীর অনুধ্যান কী তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। এখানে উল্লিখিত দ্বিতীয় শ্লোকটির ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে, ইতিহাস এবং প্রাচীন উপাখ্যানসমূহে লিপিবদ্ধ আছে যে, আলেকজান্ডার যখন ইরানে পদার্পণ করেন তখন তিনি ইয়াযদ নগরীতে তাঁর জেলখানা স্থাপন করেন। অর্থাৎ যখনই কাউকে গ্রেফতার করা হতো তখন তাকে ইয়াযদের কয়েদখানায় প্রেরণ করা হতো। অন্যদিকে সে সু-প্রাচীনকাল থেকেই ‘শিরাজ’ এবং ‘তাখ্তে জামশিদ’ সোলাইমান নগরী বলে খ্যাত।
হাফিজের কাব্যের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আশাবাদ। প্রেমের ক্ষেত্রে তিনি কখনো নৈরাশ্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর জীবনে অন্য কবিদের মতো বিরহ-বিচ্ছেদের অন্ধকার গভীর রজনী উপস্থিত হয়েছে বটে, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন এ রাত দীর্ঘস্থায়ী হবে না। প্রেম-ভালোবাসার মধ্য দিয়ে অচিরেই উজ্জ্বল প্রভাত অন্ধকারের কুহেলিকা ভেদ করে আবির্ভূত হবে, যা খুশির বার্তা বয়ে আনবে এবং বিষন্ন কুটির একদিন আনন্দের বাগানে পরিণত হবে।
যেমন তিনি বলেন –
یوسف گم گشته بازآید به کنعان غم مخور کلبه احزان شود روزی گلستان غم مخور
[হারানো ইউসুফ আসবে ফিরে আবার কেনানে, চিন্তা করো না তাই,
এই বিষন্ন কুটির একদিন হবে যে গুলিস্তান, চিন্তা করো না ভাই।]
প্রেমের শক্তিমত্তার কথা তুলে ধরে হাফিজ বলেন –
دولت عشق بین که چون از سر فقر و افتخار گوشه تاج سلطنت میشکند گدای تو
[প্রেমের শক্তি ও মর্যাদার প্রতি দৃষ্টি দাও, কেননা, এর গৌরব এতটাই যে,
তোমার ক্রন্দন ও ফরিয়াদে সাম্রাজ্যের কোনা ধসে পড়বে।]
হাফিজের অবস্থান ছিল ভাবজগতের এতটাই ঊর্ধ্বে যে, তিনি নিজেকে কখনো কোনো সম্প্রদায়ের গরিমা নিজের মধ্যে ধরে রাখতে চেষ্টা করেন নি। তাঁর মতে প্রেমের রাজ্যে কোনো ভেদা-ভেদ নেই। কবি হাফিজের অন্যকিছু ভাবার সময় ছিল না।
বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দীন সেকান্দর শাহ (৭৬৮ হি.) সিংহাসনে আরোহণের পর এই গজল সম্রাটকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এই সোনার বাংলায় তাঁর রাজধানীতে। কবি আসতে পারেন নি বটে, কিন্তু সুদূর ইরান থেকে তাঁর অন্তরের নির্যাস-স্বরূপ যে মিছরি-খন্ড পাঠিয়েছিলেন তার অমিয় স্বাদ এখনও আমাদের রসনাকে তৃপ্ত করছে বিপুলভাবে।
কবির সে বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি শ্লোক এখানে উদ্ধৃত করা হলো :
شکرشکن شوند همه طوطیان هند زین قند پارسی که به بنگاله میرود
طی مکان ببین و زمان در سلوک شعر کاین طفل یک شبه ره یک ساله میرود
কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই চরণ দু’টির মর্মার্থ নিম্ন-রূপ উল্লেখ করেছেন –
“আজকে পাঠাই বাঙলায় যে ইরানের এই ইক্ষু-শাখা,
এতেই হবে ভারতের সব তোতার চঞ্চু মিষ্টিমাখা।
দেখ গো আজ কল্পলোকের কাব্যদূতীর অসম সাহস,
এক বছরের পথ যাবে যে, একটি নিশি যাহার বয়স।” (নজরুল, ১৯৯৬: ৪৫)
প্রেম সহজ না
———————
– কবি হাফিজ
” এসো সাকি, এসো, রেখো না বসিয়ে
হাতে হাতে দাও ভর্তি পেয়ালা ;
আগে ভাবতাম প্রেম কী সহজ,
আজ দেখি তাতে কী বিষম জ্বালা।
খোঁপা থেকে মৃগনাভির সুরভি
ভেসে এসেছিল ভোরের হাওয়ায়
চমকানো তার চূর্ণ অলক
হৃদয়ে রক্তগঙ্গা বহায় ।
প্রাণ বঁধুয়ার পান্থশালায়
এ সুখশান্তি কদিনের বলো !
দিনরাত খালি বাজছে ঘন্টা :
‘গোটাও তোমার পাততাড়ি, চলো !’
কী ঘোর রাত্রি, কী ভীষণ ঢেউ,
রসাতলে টানা ঘূর্ণী এমন –
কী করে জানবে শুকনো ডাঙায়
ঝাড়া হাত-পায় যে করে ভ্রমণ !
বুড়ো মাজি বলে, নমাজ পড়ার
আসনে ছুটুক মদের ফোয়ারা ;
সদগুরু নয় অজ্ঞ, সে জানে
সঠিক লক্ষ্যে চলবার ধারা ।
পরিণামে রটে নিন্দে, কারণ
যা করেছি শুধু নিজেরই জন্য;
সে রহস্য থাকে গোপন কিভাবে
জানাজানি হলে এ জনারণ্যে !
হাফিজ, চাও কি তার দর্শন ?
করো না নিজেকে আড়াল তাহলে ;
দেখা দিলে প্রিয়া, এই জগতটা
ভুলে যেয়ো তুমি, ছেড়ে যেয়ো চলে ।।
——————–
তথ্যনির্দেশ:
১). আব্দুল হাফিজ (১৯৮৪ খ্রি.): হাফিজের গজল গুচ্ছ, বাংলাডেমী ঢাকা
২). আল্লামা শিবলী নোমানী, শেরুল আজম (পারস্যের কবি), এম ফরমান আলী এন্ড সন্স বুক সেইলারজ, লাহোর
৩). আয়াতুল্লাহ মুর্তজা মোতাহারী (১৯৮৭ খ্রি.): হিজরত ও জিহাদ, [অনুবাদ : অধ্যাপক সিরাজুল হক], সাজেমানে তাবলিগাতে ইসলামি (বাংলা বিভাগ), তেহরান
৪). আহমাদ তামীমদারী (২০০৭ খ্রি.) : ফার্সী সাহিত্যের ইতিহাস, [বাংলা ভাষায় অনূদিত],আলহুদা আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা, ইরান
৫). কাজী নজরুল ইসলাম (১৯৯৬) : নজরুল রচনাবলী, (২য় খ-) বাংলা একাডেমী, ঢাকা
৬). বাহাউদ্দীন খুররম শাহী (১৯৮৭ খ্রি.) : হাফেজ নামে (হাফিজের সাহিত্যকর্ম), সরুশ প্রকাশনী, তেহরান, (১ম ও ২য় খ-)
৭). মির্যা মকবুল বেগ বাদাখশানি, আদব নামে ইরান (ইরানের সাহিত্য), (২য় খ-) ইউনিভার্সিটি বুক এজেন্সী, লাহোর
৮). মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন (১৩৭৫ বঙ্গাব্দ) : ইরানের কবি, বাংলা একাডেমী, ঢাকা
৯). মুহাম্মদ সুদি বাসনুভি (১৯৮৬ খ্রি.) : শারেহ সুদি বার হাফেজ (মুহাম্মদ সুদি বাসনুভিকৃত হাফিজের কবিতার ব্যাখ্যা) [অনুবাদ: আছমাত সেতারে যাদেহ], র্যারিন প্রকাশনী তেহরান
১০). মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ (২০০০ খ্রি.) : পারস্য প্রতিভা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা
১১). রেযা যাহেদ শাফাক, তারিখে আদাবিয়্যাতে ইরান (পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস), পাহলভী বিশ্ববিদ্যালয়, ইরান
১২). হরেন্দ্র চন্দ্র পাল (১৩৬০ বঙ্গাব্দ) : পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস, শ্রী জগদীশ প্রেস, কলকাতা
১৩). হাফেজ শিরাজী (১৯৯৯ খ্রি.) : দিভানে গাযালিয়াতে মাওলানা শামসুদ্দীন হাফেজ শিরাজী (হাফিজের গজলসমগ্র), সাফি আলী শাহ প্রকাশনী, ইরান।
————————————–
* ঋণ স্বীকার –
১).নাসিরুল ইসলাম
২).রূপায়ণ ঘোষ
৩).তারিক সিরাজী