Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পাথরের মাঝে প্রাণ || Mallik Kumar Saha

পাথরের মাঝে প্রাণ || Mallik Kumar Saha

পাথরের মাঝে প্রাণ

সকলেরই এক কথা,” বড় ঘর এসেছে , অমত করতে নেই। রাজলক্ষ্মী হয়ে থাকবি ।”

সুনন্দা সব কিছুই বুঝতে পারল যে বাপের বাড়ীতে পা জমিয়ে রাখার দিন প্রায় শেষ । সকলেই বলে,” স্বামীর ঘর নিজের ঘর, বাপের বাড়ী পর।” হোক না পর, বাড়ীর মায়া কাটিয়ে দূরের শহরে যাবার ভাবনা তার দুচোখে কখনও ছিল না। আমবন,বাঁশঝাড়,তালবন,নদীর ধার — সবকিছুকেই ফেলে রেখে বড় অট্টালিকার পাষাণে প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যে বড় কঠিন।বিকেল বেলায় ঝম্ ঝম্ নুপূর পায়ে সখীদের সাথে ঘাটপারে গল্পের যে আসর বসতো তা মাথা কুটে মরলেও সে পাবে না। বিয়ের দিনক্ষণ এগিয়ে আসতেই পাড়াগাঁয়ের পিসিমা ও ঠাকুরমাদের ভীড় দেখা দিল। প্রতিবেশী ঠাকুরমা সুনন্দার হাত দুটো ধরে বললেন, ” ওরে খুকি, এবার তাহলে স্বামীর ঘর করবি?”

কথা গুলি শুনেই সুনন্দার দুচোখ লজ্জায় ভরে গেল।যাদের স্নেহে সে এতটা বড় হয়েছে আজ তারাও পর হতে বসেছে। তাদের মায়া কাটিয়ে আসতেই অন্য এক অপরিচিত পরিবেশ তাকে হাতছানি দিচ্ছে। পারিবারিক সম্পর্কগুলি বৃক্ষের শিকরের মতো মাটি কামড়ে আকড়ে ধরে রাখে,আর প্রতিবেশীর সম্পর্কগুলি বৃক্ষের ফল ও ফুলের মতো সময়ে সময়ে শোভা বর্ধন করে।

সুনন্দা পিতার স্নেহে বেড়ে ওঠা আর সেই গ্রাম্য বালিকাটি নেই। এবার দায়িত্ব তার একাধিক।বোঁটা ছিড়ে ফল যেমন গাছের পরিচয়কেই বয়ে নিয়ে চলে,সেও তদ্রুপ পিতৃকুলের সংস্কারটুকু শ্বশুর বাড়ীতে অক্ষুন্ন রাখতে চলেছে। নারীর ‘ রূপ ‘ জগৎকে যত না আলোড়িত করে,তার থেকে ‘ গুন ‘ অধিক মোহিত করে। সুনন্দার সুমার্জ্জিত ব্যবহারে শ্বশুর বাড়ীর আত্মীয় স্বজন প্রশংসায় পঞ্চমুখ । যারা সাতদিনের জন্য আতিথ্য গ্রহণে এসেছিল তারা আরও কয়েকটি দিন সেখানে কাটিয়ে গেল। ক্রমে ক্রমে অতিথিদের প্রত্যাবর্তনে সুনন্দা স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবনযাপনে অভ্যস্ত হলো। কিন্তু এই বিশাল অট্টালিকায় নিজে রাজরানী হয়েই বা কি সুখ ? ছুটি শেষ হলে সুনন্দার বর স্বরাজ তাকে এখানে রেখে যেতে উদ্যত হলো। তিনি দূরের এক মফস্বল গ্রামে সরকারি চাকরি করেন। আর সেই কারণেই তিনি বিবাহিতা নববধূকে এভাবে ঘরে রেখে যেতে এক প্রকার বাধ্য। তবে ঘর সংসারের যাবতীয় কাজকর্মের ভার ছিল তার দুঃসম্পর্কের এক মাসীর উপর। মা – হারা স্বরাজবাবুকে এই মাসীমাই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন।

আত্মীয়স্বজন চলে যেতেই সুনন্দার সজীব মনটি শীতের বাগান বাড়ীর পাতাঝড়া বৃক্ষের মতো রূপ নিল। গ্রাম বাংলায় এতক্ষণ নতুন বউ দেখার হিরিক পড়ে যেত। ঘোমটা উঠিয়ে মুখখানা না দেখানো পর্যন্ত বাড়ীতে ভীড় লেগেই থাকত। আর শোনা যেত — ” একেবারে দুধে আলতা! স্বরাজের পছন্দ বলে কথা ।” আর এই বিশাল অট্টালিকার পাথরে কেমন করেই রূপবতী নববধূ বন্দী হয়ে আছে। ঠাকুরঘর,রান্নাঘর,সাঁঝঘর এবং এক-পা দু-পা করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুটপাতের নানান দৃশ্য। ব্যস্ত শহরের কোলাহল এসে কানে সূচের মতো বিঁধতে লাগল। এরই মধ্যে নিকটবর্তী কোনো স্কুলের ছুটির ঘন্টা বেজে ওঠায় গুড়ি গুড়ি ছেলে মেয়েরা দলধরে এদিক সেদিক ছুটে চলেছে। ছোট ছোট হাতগুলিতে রঙ-বিরঙের আইস্ক্রিম ।কারো মুখে রয়েছে ললিপপ।কেও খাচ্ছে আখের রস।অনতিদূরে গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে দাঁড়িয়ে আছে দুটি শুষ্ক প্রাণ। রসভর্তি গ্লাসের দিকেই নজর তাদের । মনে হলো তাদের পয়সা নেই । দাঁড়িয়ে থেকেই বা কি লাভ তাদের ? কয়েক পা পিছিয়ে এবার তাদের দৃষ্টি পড়ল আখের রস তৈরী করার মেশিনটির দিকে। দোকানদার রস নিংরে রেখে আখের ছোবড়া এক বড় ঝুড়িতে ফেলে দিচ্ছে । দোকানীর ভ্রুক্ষেপ নেই কখন যে গুটি কতক হাত এসে আখের পরিত্যক্ত ছোবড়াগুলি মুখে পুরে দিয়েছে দু ‘ফোঁটা রস মুখে যাবে বলে । জড়তা ও ভয় থাকা সত্বেও নীরস উচ্ছিষ্ট আঁশটুকু মুখে দিতেই শিশুদের মুখে হাসি ফুটে উঠল। নিষ্পাপ শিশুর চরম আকাঙ্খার ঐ দুফোঁটা রস যেন অমৃতসম।

প্রাণহীন শহরের বুকে মানুষরূপী মাটির ঢেলাগুলিকে অবাধে বিচরণ করতে দেখে সুনন্দার দুচোখে দু ‘ফোঁটা জল চলে এল। দূর থেকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে — ” দোকানদার ভাই , তোমার লাভের কিঞ্চিৎ রস ঐ দুই বালককে দিলে কিছু ক্ষতি হবে ? দীন – দুঃখীর ছেলে হবে ; তাই বলে কি তাদের প্রতি এতটা নিষ্ঠুরতা ? পাথরের উপর পাথর বসিয়ে এই শহরের যে দালান তৈরী হয়েছে তাতে বোধ করি প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়নি ।”

অভাবের তাড়না সুনন্দার কোনো কালেও ছিল না। ছিল শুধু দুঃখীর দুঃখ দূর করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা । আর যাই হোক না কেন পিতৃকূলে এমন অবহেলিত লোকের সেবা করতে উৎসাহের সীমা কোনো লক্ষ্মণরেখায় বাধা পড়েনি।রাত্রে ঘুমোতে যাবার আগে সুনন্দার মনের ক্ষত স্থানে প্রলেপ দিবার বৃথা চেষ্টা গাঢ়তর হলো মাত্র। পরের দিন আবার সেখানে দৃষ্টিপাত করে থাকার পরও আখের রস বিক্রেতাকে দেখতে পেল না। মনে ভেবে নিল আজ আর সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।

এই অচেনা শহরের বুকে হাজারও প্রাণীর খেলা ।একের পর এক হকারের দল নিত্য নতুন সুরে এখানে সেখানে পসরা করে বেড়াচ্ছে। কোলাহলে মেতে উঠেছে সমস্ত শহর । জীবনটা যেন এক ছোটাছুটির খেলা ; কে কার আগে ছুটবে ।

এমন গোল্লাছুটের মাঠে সুনন্দা অনেকবার সঙ্গীদের পিছনে ফেলে দৌড় দিয়েছে।এই ভীড়ের পাশ কাটিয়ে একা এক বৃদ্ধ ধীর পায়ে কোথাও একটু বসার জায়গা খুঁজছে।খোলা আকাশের নীচে হাতের তলায় খোলা শাল পাতায় রয়েছে এক মুঠো ভাত — সঙ্গে ডাল,ভাজা ও তরকারী। খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ফুটপাতের এক পাশে উদর পূর্তির লক্ষ্যে খেতে শুরু করেছে । আর পথিকের পায়ের ধূলিকণা নিরীহের ভাতের থালায় মিশ্রিত হচ্ছে। সুনন্দা আর স্থির থাকতে না পেয়ে চীৎকার করে মাসীমাকে ডাকলেন। চীৎকার শুনে তৎক্ষণাৎ মাসীমা এসে সুধালো, ” আবশ্যক কোনো কিছুর প্রয়োজন বৌমা ? “

— ঐ দেখুন ফুটপাতের উপর অবহেলিত এক বৃদ্ধ দুমুঠো অন্নের জন্য কতই না লাঞ্ছিত হয়ে বসে পড়েছে।

মাসীমা উত্তর করলেন, ” ঐ মন্দিরের চাতালে উনার আশ্রয় । যা জোটে তাই প্রসাদ মনে করে খান । শুনেছি জ্ঞাতি বলতে এ সংসারে উনার আর কেউ নেই। এ দুর্ভোগের আর কি কোনো শেষ আছে?”

সুনন্দা মাসীমার কথার উত্তরে অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন,” আর যাই বলুন না কেন, এই মমতাহীন শহরের বুকে চোখের সামনে একজন বৃদ্ধকে লাঞ্ছনার শিকার হতে দেওয়া যাবে না। এক অসহায় বৃদ্ধকে দুমুঠো অন্ন দিতে আমার হাত কখনও কাঁপবে না। যতদিন এখানে আছি,উনাকে আর কারো কাছে অন্ন ভিক্ষা করতে হবে না। আপনি রোজ উনাকে আমার অট্টালিকার বারান্দায় ডেকে আনবেন। আমি নিজ হাতে উনাকে সেবা করবো। ছোট গ্রাম থেকে এলেও বড় শহরের বড় লোকগুলোর মতো ছোট মন নিয়ে আসিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *