গোবিন্দ বিশ্বাসের বাজার
গোবিন্দ বিশ্বাসের বাজার হয়ে যায় একেবারে সাতসকালে। দিনের আলো ফোটবার আগেই, যখন নন্দপুরের মানুষজন ঘুম থেকে ওঠেইনি ভাল করে। তা বাজার করার জন্য গোবিন্দ বিশ্বাসের কোনও ঝামেলাই নেই, এমনকী, তাঁকে বাজারে অবধি যেতে হয় না। সামনের বারান্দায় ঝুড়ি, ধামা, গামলা সব সাজানো থাকে পরপর। ব্যাপারিরা বাজারে যাওয়ার পথে আলু, বেগুন, পটল মুলো যখনকার যা সব ঝুড়িতে দিয়ে যায়। মাছওলারা এক-একজন এক-একদিন পালা করে মাছ দিয়ে যায় চুবড়ির মধ্যে। সপ্তাহে দুদিন গোবিন্দ বিশ্বাস মাংস খান, তা ঠিক দিনে
হরু কষাই সবচেয়ে পুরুষ্টু পাঁঠাটি কেটে রাং আর দাবনার সরেস মাংস রেখে যায়। দুধওলা গামলা ভরে দুধ দিয়ে যায়। মাসকাবারি জিনিসপত্র মাস পয়লা পৌঁছে দিয়ে যায় মুদি। গোবিন্দ বিশ্বাসের ভৃত্য মগন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব নজর রাখে, তারপর জিনিসপত্র ঘরে নিয়ে যায়। বন্দোবস্তটা বাজারের ব্যাপারিরা নিজেদের বাঁচাতেই করেছে। আগে গোবিন্দ বিশ্বাস নিজেই বাজারে যেতেন আর তাঁকে দেখতে পেলেই বাজারে হুলুস্থুলু পড়ে যেত। ব্যাপারিরা সব চোখে চাপা দিয়ে চোঁ-চাঁ দৌড়ে পালাত। নিদেন পালাতে না পারলে মুখ ঢাকা দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকত। বাজার হয়ে যেত সুনসান। তো তারাই একদিন এসে হাতজোড় করে গোবিন্দ বিশ্বাসকে বলল, “আজ্ঞে, আপনার মতো মান্যগণ্য লোক কষ্ট করে বাজার করলে আমাদেরই লজ্জা। বাজারে আপনি কেন যাবেন? বাজার নিজেই হেঁটে আসবে আপনার দরজায়। দামের কথা তুলে আমাদের লজ্জায় ফেলবেন না। আপনার জন্য যে এটুকু করতে পারছি সেই আমাদের কত ভাগ্যি!”
সেই থেকে গোবিন্দ বিশ্বাস বাজারে যাওয়া ছেড়েছেন। পয়সা বাঁচছে, সময় বাঁচছে, ঝামেলা বাঁচছে। তা ছাড়া ব্যাপারিরা যা দিয়ে যায় সব বাছাই জিনিস। পচা-ঘচা, বাসি বা নিরেস জিনিস কেউ দেয় না। সকলেরই তো ভয় আছে। অপয়া হওয়ার যে কী সুখ তা তিনি আজ গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। সামনের কয়েক জন্ম এরকম অপয়া হয়েই তাঁর জন্মানোর ইচ্ছে।
আজ সকালে বেশ তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল গোবিন্দবাবুর। উঠে দাঁতন করতে করতে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন, আজ মাছের চুবড়িতে চিতল মাছের পেটি, লাফানো কই আর রুই মাছের মস্ত একটা খণ্ড পড়েছে। মেঠাইওলা রঘু আজ এক হাঁড়ি গরম রসগোল্লা রেখে গেছে। এক ডজন ডিম আর এক শিশি ঘিও নজরে পড়ল। মনটা ভারী খুশি হয়ে গেল তাঁর। ব্যাপারিদের বাড়বাড়ন্ত হোক। হিরের টুকরো সব।
ভৃত্য মগন জিনিসগুলো সব ঘরে আনার পর তিনি দাঁতন করতে করতেই একটু বারান্দায় বেরোলেন। আজকাল আর আগের মতো প্রাতভ্রমণ হয় না। অন্য যারা সব প্রাতভ্রমণ করে তারাই চাঁদা তুলে মাসের শেষে থোক কিছু টাকা দিয়ে যায়। সকলের দিকই তো দেখতে হবে, তাই প্রাতভ্রমণ বন্ধ করেছেন। বারান্দাতেই একটু হাঁটাহাঁটি করেন।
আজ হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ল, পাশের বাড়ির বারান্দায় বসে একটা লোক তাঁকে খুব ড্যাব ড্যাব করে দেখছে। তিনি ভারী অবাক হলেন। নতুন লোকই হবে। নইলে এই সকালবেলায় তাঁর মুখের দিকে চাইবে এমন বুকের পাটা কার আছে!
তবে তিনি খুশিও হলেন। মাঝে-মাঝে নিজের অপয়া ব্যাপারটা এভাবেই শামিয়ে নেওয়া যায়। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে তিনি মোলায়েম গলায় বললেন, “নতুন বুঝি?”
লোকটা একটু রোগাভোগা, চেহারাটাও ফ্যাকাসে। মেজাজাটা বেশ তিরিক্ষে। খ্যাঁক করে উঠে বলল, “কে নতুন?”
“এই তোমার কথাই বলছি ভায়া। সুবুদ্ধির কেউ হও বুঝি? কবে আসা হল?”
লোকটা রেগে গিয়ে বলল, “এই গাঁয়ে আমার সাত পুরুষের বাস তা জানেন? আসা হবে কেন? এই গাঁয়েই থাকা হয়।”
গোবিন্দবাবু অবাক হয়ে বললেন, “থাকা হয়? কোন বাড়ি বলো তো! এ-গাঁয়ে আমার ঊর্ধ্বতন দ্বাদশ পুরুষের বাস।”
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “ভাল মনে পড়ছে না। আমিও ব্যাপটা ঠিক চিনতে পারছি না। এ বাড়িটা অঘোর সেনের তা জানি, কিন্তু বাদবাকি সব রাতারাতি পাল্টে গেছে দেখছি!”
“অঘোর সেন! আ মলো, অঘোর সেনটা আবার কে?”
“অঘোর সেনকে চেনেন না? আর বলছেন দ্বাদশ পুরুষের বাস!”
লোকটা পাগলটাগল হবে। আর না-ঘাঁটানোই ভাল, বিবেচনা করে গোবিন্দ বিশ্বাস বললেন, “তা সুবুদ্ধি ভায়াকে দেখছি না যে!
সে কোথায় গেল?”
“সে কুয়োর পারে হাত-পা ধুচ্ছে আর তার ভাগ্নে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু আমি ভাবছি এ কি দৈত্যদানোর কাণ্ড নাকি? এত সব বাড়িঘর রাস্তাঘাট কোথা থেকে হল? কবে হল?”
গোবিন্দ বিশ্বাস একটু হেসে বললেন, “জন্মাবধিই দেখে আসছি। নতুন তো হয়নি। তা ভায়া কি এতদিন বিলেতে ছিলেন?”
“বিলেত! বিলেতে থাকব কেন মশাই? ম্লেচ্ছ দেশ, সেখানে গেলে একঘরে হতে হবে না?”
“হাসালে ভায়া। আজকাল আর ওসব কে মানে বলো তো! আকছার লোকে যাচ্ছে। ওসব হত সেই আগের দিনে।”
সনাতন কেমন ক্যাবলার মতো চেয়ে থেকে বলল, “আচ্ছা মশাই, অঘোর সেনের বাড়ির এ পাশটায় তো একটা আমবাগান ছিল, আর বাঁশবন। তা আপনার এই বাড়িখানা কী করে রাতারাতি এখানে গজিয়ে উঠল?”
“তোমার মাথায় একটু পোকা আছে ভায়া। রাতারাতি গজিয়ে উঠবে কেন? পুবপাড়ায় বাপ-পিতেমোর আমলের বাড়ি ছেড়ে এখানে বাড়ি করে চলে এসেছি সেও আজ পঁচিশ বছর।”
সনাতন মাথায় হাত দিয়ে বলল, “উঃ, কী যে সব শুনছি তার দেখছি আর ঠিক-ঠিকানাই নেই। পুবপাড়ায় তো আমারও বাস। আপনাকে তো জন্মে দেখিনি মশাই!”
গোবিন্দ বিশ্বাস বিজ্ঞের মতো হেসে বললেন, “আগেই সন্দেহ করেছিলুম, ভায়ার মাথায় একটু গণ্ডগোল আছে। পূর্বপাড়ায় যাকে জিজ্ঞেস করবে সেই দেখিয়ে দেবে বিশ্বাসবাড়িটা কোথায়। এ-তল্লাটে আমাকে চেনে না এমন লোক পাবে না।”
“বিশ্বাসবাড়ি! মশাই, মাথার গণ্ডগোল আমার না আপনার? পুবপাড়ায় তো বিশ্বাসবাড়ি একটাই। আর সেই বাড়িই যে আমার। ঊর্ধ্বতন সপ্ত পুরুষের বাস মশাই। পিতা শ্রীহরকালী বিশ্বাস, পিতামহ স্বৰ্গত জগদীশচন্দ্র বিশ্বাস। সবাই চেনে কিনা। আপনি হুট করে বিশ্বাসবাড়িটা নিজের বলে গলা তুললেই তো হবে না!”
“হাসালে ভায়া। বেশ মজার লোক তুমি হে। হোঃ হোঃ
হোঃ…”
“কেন, এতে হাসার কী আছে? সহজ সরল ব্যাপার।”
“নাঃ, স্বীকার করতেই হচ্ছে যে, তুমি বড় রসিক মানুষ। পুবপাড়ার বিশ্বাসবাড়িটাও যে তোমার বাড়ি, জেনে বড্ড খুশি হলুম।”
সনাতন একটু ভ্যাবলা হয়ে বলল, “এ তো বড় মুশকিল দেখছি! সেই বাড়িতে জন্ম হল, এইটুকু থেকে এতবড়টি হলুম, আর আপনি বলছেন রসিকতা? হাতে পাঁজি মঙ্গলবার, অত একরারে কাজ কী? গিয়েই দেখাচ্ছি। এখনই শরীরটা একটু টালমাটাল করছিল বলে জিরিয়ে নিচ্ছিলুম একটু, নইলে অঘোর সেনের বাড়িতে বসে আছি কি সাধে?”
“অঘোর সেনের বাড়ি? হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ… বাপু হে, শরীর তোমার টালমাটাল করছে কি সাধে? এই বয়সেই নেশাভাঙ ধরে ফেলেছ বুঝি? এই বুড়ো মানুষটার কথা যদি শোনো তবে বলি ও-পথে আর হেঁটো না। শুনেছি নেশাভাঙ করলে পরের বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে হয়, নর্দমাকে মনে হয় শোওয়ার ঘর, বাঘকে মনে হয় বেড়াল। আর হরকালী বিশ্বাসের কথা কী বলছিলে যেন?”
“কেন, তিনি আমার পিতাঠাকুর।”
“হাঃ হাঃ হাঃ …হোঃ হোঃ হোঃ …হরকালী বিশ্বাস যদি তোমার পিতাই হন, তা হলে তোমার বয়সটা কত দাঁড়ায় জানো?”
“কেন, আঠাশ বছর।”
“আঠাশ বছর! হাসতে-হাসতে পেটে যে খিল ধরিয়ে দিলে ভায়া! আঠাশের আগে যে আরও একশো বা দেড়শো বছর জুড়তে হবে, সে-খেয়াল আছে? হরকালী বিশ্বাস, জগদীশচন্দ্র বিশ্বাস কবেকার লোক তা জানো? এঁরা সব আমারই নমস্য পূর্বপুরুষ। তাঁদের নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি নয়। সেইজন্যই তো বলি, নেশাভাঙ করলে এরকম যত গণ্ডগোল হয়।”
সনাতন বিশ্বাস দুর্বল পায়ে উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বলে উঠল,”খবরদার বলছি, নেশাভঙের কথা তুলে খোটা দেবেন না! আমি জন্মে কখনও তামাকটা অবধি খাইনি! আমাদের বংশে নেশাভাঙের চলন নেই। কেউ বলতে পারবে না যে, সনাতন বিশ্বাস কখনও সুপুরিটা অবধি খেয়েছে!”
গোবিন্দ বিশ্বাস হঠাৎ হেঁকে উঠে বললেন, “কে? কার নাম করলে? সনাতন বিশ্বাস!”
“যে আজ্ঞে। এই অধমের নামই সনাতন বিশ্বাস, পিতা হরকালী, পিতামহ জগদীশচন্দ্র বিশ্বাস। আরও শুনবেন? প্রপিতামহ তারাপ্রণব বিশ্বাস। বৃদ্ধ প্রপিতামহ অক্ষয়চন্দ্র বিশ্বাস।”
চোখ গোল করে গোবিন্দ বিশ্বাস বললেন, “এ যে আমার কুলপঞ্জি তুমি মুখস্থ বলে যাচ্ছ হে! কিন্তু এত সব তো তোমার জানার কথা নয়, সনাতন বিশ্বাস নাম বলছ? তা তিনিও আমার এক প্রাতঃস্মরণীয় পূর্বপুরুষ। তাঁর দুই ছেলে নিত্যানন্দ আর সত্যানন্দ। সত্যানন্দ সাধু হয়ে গিয়েছিলেন, নিত্যানন্দের সাত ছেলে অভয়পদ, নিরাপদ, কালীপদ, ষষ্ঠীপদ, শীতলাপদ, দুর্গাপদ আর শিবপদ। আমরা হলুম গে দুর্গাপদর বংশধারা। তাঁর ছিল পাঁচ ছেলে…”
“থামুন মশাই, থামুন। নিত্যানন্দর বয়স এখন মাত্র ছয় বছর। তার সাতটা ছেলে হয় কোত্থেকে? গাঁজা আমি খাই, না। আপনি খান?”
ঝগড়াটা যখন ঘোরালো হয়ে উঠছে, তখন সুবুদ্ধি এসে মাঝখানে পড়ল, “আহা করেন কী, করেন কী বিশ্বাসমশাই? সদ্য লম্বা ঘুম থেকে উঠেছেন, এখন কি এত ধকল সইবে? পৌনে দুশো বছর বয়সের শরীরটার কথাও তো ভাবতে হয়! আসুন, ঘরে আসুন।”
বলে সনাতনকে একরকম টেনেহিঁচড়েই ঘরে নিয়ে গেল সুবুদ্ধি।
গোবিন্দ বিশ্বাস একটু হেঁকে বললেন, “যতই তর্ক করো বাপু, আজ ঠেলাটি বুঝবে। প্রাতঃকালেই আজ এই শর্মার মুখোনা দেখেছ, যাবে কোথায়? বলে কিনা উনিই সনাতন বিশ্বাস। সনাতন বিশ্বাস হওয়া কি মুখের কথা? অনেক জন্ম তপস্যা করে তবে সনাতন বিশ্বাস হতে হয়। তাঁর মতো অপয়া ভূ-ভারতে ছিল না। আর অত নামডাক হচ্ছিল বলেই তো তাঁকে গুমখুন করে ফেলা হয়। লাশটার অবধি হদিস কেউ পায়নি। আর ইনি কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে বুক বাজিয়ে বলছেন, আমিই সনাতন বিশ্বাস। উঁঃ।”
ঘরের মধ্যে তখন সনাতন বিশ্বাস চোখ গোলগোল করে গোবিন্দর চেঁচামেচি শুনতে-শুনতে সুবুদ্ধিকে বলল, “কী বলছে বল তো লোকটা?”
“আজ্ঞে, ওদিকে কান না দেওয়াই ভাল। আর আপনিও বড্ড ভুল করে বসেছেন। প্রাতঃকালে ওঁর মুখোনা না দেখলেই ভাল করতেন। উনি ঘোর অপয়া লোক। ভুলটা আমারই। আপনাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত ছিল। যাকগে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। আজ একটু সাবধানে থাকবেন।”
সনাতন একটু আত্মবিশ্বাসের হাসি হেসে বলল, “আমাকে অপয়া দেখাচ্ছিস! শুনলেও হাসি পায়। ওরে, আমি এমন অপয়া লোক যে, প্রাতঃকালে আমার মা অবধি আমার মুখ দেখত না। আমি রাস্তায় বেরোলে কুকুর-বেড়াল অবধি পাড়া ছেড়ে পালাত।”
“অ্যাঁ,” বলে সুবুদ্ধি এমন হাঁ করল যে, তাতে চড়াইপাখি ঢুকে যেতে পারে। তারপর ঢোক গিলে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “তা হলে কী হবে! আমি যে প্রাতঃকাল থেকে আপনার মুখ দেখছি।”
সনাতন ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তা অবশ্য ঠিক। তবে তোকে একটা গুপ্ত কথা বলতে পারি। খবরদার আর কাউকে বলবি না তো?”
“আজ্ঞে না।”
“পাশের বাড়ির লোকটা কীরকম অপয়া বল তো!”
“আজ্ঞে সাঙ্ঘাতিক।”
“দূর দূর! তেমন অপয়া হলে পাড়ায় কুকুর-বেড়ালও থাকত না। আমি তো দেখলুম, ওর বারান্দার সিঁড়িতে দিব্যি গ্যাঁট হয়ে একটি বেড়াল বসে আছে। তা যাকগে, কমজোরি অপয়া হলেও চলবে। তুই যদি সকালে দু-দুটো অপয়ার মুখ দেখে ফেলিস, তা হলে আর ভয় নেই। একটার দোষ আর-একটায় কেটে যাবে।”
“বটে!”
“খবরদার, পাঁচ কান করিস না।”
“আজ্ঞে না।”
“তা হলে আমি এবার বাড়ি চললুম। গিয়ে গোরুগুলোকে মাঠে ছাড়তে যেতে হবে, গেরস্থালির আরও কত কাজ পড়ে আছে। অঘোরবাবুকে পেলে টাকাটা আদায় করে নিয়ে যেতুম। কিন্তু আর দেরি করার জো নেই।”
সুবুদ্ধি খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, “যে আজ্ঞে, বাড়ি যাবেন সে আর বেশি কথা কী? তবে একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে কিনা, তাই বলছিলুম–”
“গণ্ডগোল! কিসের গণ্ডগোল?”
“আজ্ঞে, আপনার ঘুমটা একটু বেশি লম্বা হয়ে গেছে কিনা, তাই”
“অ্যাাঁ! খুব লম্বা ঘুম ঘুমিয়েছি নাকি? তা সেটা কত লম্বা? দু’দিন, তিনদিন নাকি রে?”
“আজ্ঞে না। আর একটু উঠন।”
“ওরে বাবা! দু-তিনদিনেরও বেশি? তবে কি দিনপাঁচেক?”
“আরও একটু উঠুন।”
“আরও? ও বাবা, আমার যে মাথা ঘুরছে।”
“তা হলে একটু শক্ত হয়ে বসুন। তারপর একটু চিড়ে দুই ফলার করে নিন। তাতে গায়ে একটু বল হবে। মনটাকে বেশ হালকা করে রাখুন। “
সনাতন দই-চিঁড়ে খেল। তারপর বিছানায় বেশ জুত করে বসল, “এবার বল তো বৃত্তান্তটা কী।”
“আজ্ঞে আপনি টানা দেড়শো বছর ঘুমিয়ে ছিলেন।”
সনাতন সোজা হয়ে বসে বলল, “দেড় বছর! বলিস কী রে ডাকাত! দেড় বছর কেউ ঘুমোয়? তুইও দেখছি নেশাখোর!”
“দেড় বছর হলে তো কথাই ছিল না মশাই। দেড় বছর নয়। দেড়শো বছর।”
সনাতন এবার এমন হাঁ হল যে, তাতে একটা ছোটখাটো বেড়াল ঢুকে যায়। তারপর খানিকক্ষণ খাবি খেয়ে বলল, “তুই খুব নেশা করিস।”
“আজ্ঞে না। ভাল করে যদি চেয়ে দেখেন চারদিকটায় তা হলেই বুঝতে পারবেন। কিছু কি আর আগের মতো আছে। দেখছেন? অত বড় আমবাগান আর বাঁশবাগান কোথায় গেল?”
সনাতন ঢোক গিলে বলল, “একটু-একটু মনে পড়ছে সব। অঘোরবাবুর বাড়ির উলটো দিকে একটা মস্ত ঝিল ছিল। সেটাও তো দেখছি না।”
“আজ্ঞে, দেড়শো বছর লম্বা সময়।”
“তা হলে আমার বাড়ি! আমার বাপ-মা ছেলেপুলে সব? তাদের কী হল?”
“আজ্ঞে, দেড়শো বছরে কি কিছু থাকে? তবে পুত্রপৌত্রাদি এবং তস্য তস্য পুত্রপৌত্রাদি নিশ্চয়ই আছে।”
“তার মানে কেউ বেঁচে নেই বলছিস নাকি?”
“বেঁচে থাকলে কি ভাল হত মশাই? তবে সবাই বেশ দীর্ঘজীবী হয়েই সাধনোচিত ধামে গমন করেছেন।”
“এ-হো-হো…!” বলে সনাতন ডুকরে কেঁদে উঠল। সেই বুক-ফাটা কান্নায় সুবুদ্ধিরও চোখে জল এসে গেল। সে তাড়াতাড়ি সনাতনের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “অত উতলা হবেন না। বয়সটার কথাও একটু বিবেচনা করুন। এই পৌনে দুশো বছর বয়সে অত উতলা হলে ধকল সামলানো যে মুশকিল হবে।”
সনাতন হঠাৎ কান্না থামিয়ে সচকিত হয়ে বলল, “কত বললি?”
“আজ্ঞে হিসেবমতো পৌনে দুশো বছরেরও একটু বেশি।”
“উরে বাবা রে! তা হলে তো বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি! সর্বনাশ! এত বুড়ো নাকি রে আমি? হিসেবে কিছু ভুল হয়নি তো রে?”
“আজ্ঞে না। দু-চার বছর এদিক-ওদিক হতে পারে।”
“একটু কম করে ধরলে হয় না রে?”
“চাইলে করতে পারেন। আসলে আপনি তো আটকে আছেন সেই আঠাশেই।”
“আঠাশ! এই যে বলছিস পৌনে দুশো!”
“দুটোই ঠিক। একদিক দিয়ে দেখলে আঠাশ, অন্যদিক দিয়ে দেখতে গেলে পৌনে দুশো।”
“ওরে বাপ রে? তা হলে আমি বুড়ো হতে-হতে জরদগব হয়ে পড়েছি। হাঁটাচলা করতে পারব কি? চোখে ছানি হয়নি তো! হ্যাঁ রে দাঁতগুলো সব গেছে নাকি? আরও কী কী হল দেখ তো ভাল করে।”
“আজ্ঞে, ওসব ঠিকই আছে।”
“ঠিক আছে কী রে? পৌনে দুশো বছরে যে লোহা অবধি ক্ষয় হয়ে যায়। দাঁড়া বাপু দাঁড়া, ভাল করে হেঁটেচলে দেখি পায়ের জোড়গুলো ঠিক আছে কি না।”
“আজ্ঞে আছে। এতক্ষণ হাঁটাচলাই করছিলেন। দিব্যি পাতালঘর থেকে ওপরে উঠে এলেন।”
হঠাৎ সনাতন কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, “হ্যাঁ রে, আমার নিত্যানন্দ আর সত্যানন্দ। তারা বেঁচে নেই?”
“দুঃখ করবেন না বিশ্বাসমশাই। তাঁরা সব পাকা বয়সেই গেছেন। শুনলেন তো, নিত্যানন্দের সাত ছেলে ছিল।”
“নিত্যানন্দকে যে মাত্র ছ’ বছরের রেখে আমি কালঘুম ঘুমোতে এলাম। কত বয়স হয়েছিল তার বল তো?”
সুবুদ্ধি বানিয়ে বলল, “আজ্ঞে নব্বই বছর। দুঃখের কিছু নেই, এই তো শুনলেন আমাদের গোবিন্দ বিশ্বাসই আপনার অধস্তন কত পুরুষ যেন।”
“ওই বিচ্ছিরি ঝগড়টে লোকটা?”
“যে আজ্ঞে।” সনাতন খানিকক্ষণ গুম হয়ে থেকে হঠাৎ চনমনে হয়ে বলল, “ওরে ডাক তো খোকাটিকে। আমারই তো বংশ। ডাক তো, ভাল করে একটু মুখোনা দেখি।”
“আজ্ঞে, এই ডাকছি।” বলে বারান্দায় গিয়ে ভারী বিনীত গলায় সুবুদ্ধি ডাকল, “গোবিন্দদা! ও গোবিন্দদা। একটু বাইরে আসবেন?”
গোবিন্দ বিশ্বাস বারান্দায় এসে সুবুদ্ধির দিকে অবাক চোখে চেয়ে বললেন, “এই প্রাতঃকালটায় আমার মুখ দেখে ফেললে যে! তোমার তো বড় সাহস দেখছি হে! বিপদে পড়লে আমার দোষ দিয়ো না যেন। আমি পাড়াপ্রতিবেশীকে কখনও বিপদে ফেলতে ভালবাসি না।”
সুবুদ্ধি মাথা চুলকে হাসি-হাসি মুখ করে বলল, “আজ্ঞে সেই কথাটাই বলার জন্য ডাকা আপনাকে। অপরাধ নেবেন না। অপয়া দর্শনের একটা ভাল নিদান পাওয়া গেছে। দয়া করে যদি গরিবের বাড়িতে একটু পায়ের ধুলো দেন!”
“নিদান পেয়েছ! তবে তো ভয়ের কথা হল হে। নিদানটা আবার পাঁচজনকে চিনিয়ে বেড়িয়ো না। করে-কর্মে খাচ্ছি, ব্যরসা লাটে উঠবে। দাঁড়াও, চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে আসছি।”
গোবিন্দ বিশ্বাস এলেন এবং মন দিয়ে সব শুনলেন। তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগল, গলা ধরে এল, গলবস্ত্র হয়ে একেবারে উপুড় হয়ে পড়লেন সনাতনের পায়ে, “এও কি সম্ভব? এই চর্মচক্ষে আপনার দেখা পাব–এ যে স্বপ্নেও ভাবিনি! আপনি হলেন আমার ঠাকুদার ঠাকুরদার ঠাকুদা… না, একটা ঠাকুদা বোধ হয় কম হল!”
সনাতন বড় আদরে গোবিন্দর মুখোনা তুলে দু হাতে ধরে নিরীক্ষণ করতে করতে গদগদ হয়ে বললেন, “তা হোকগে, একটা ঠাকুদার কম বা বেশি হলে কিছু না। আহা, এ তো দেখছি আমার নিত্যানন্দের মুখ একেবারে কেটে বসানো? নাকখানা অবশ্য সত্যানন্দের মতো। আহা, খোকাটিকে দেখে বুক জুড়িয়ে গেল। তা হ্যাঁ রে দুষ্টু, তোর বাপ বেঁচে নেই?”
চোখের জল মুছতে মুছতে গোবিন্দ বিশ্বাস বললেন, “আজ্ঞে আছেন। বিরানব্বই চলছে।”
“ডাক, ডাক তাকে। বিরানব্বই আবার একটা বয়স নাকি! দুধের শিশুই বলতে হয়।”
তা বিরানব্বই বছরের বাপও এসে সব শুনে ভেউ ভেউ করে কেঁদে সনাতনের পা জড়িয়ে ধরলেন। সনাতন তাঁকে আদরটাদর করে, গালে ঠোনা মেরে খুব চনমনে হয়ে উঠলেন। শোকটা কেটে গেল।
তারপর গোবিন্দ বিশ্বাসের দিকে চেয়ে বললেন, “তুই নাকি খুব অপয়া রে ভাই?”
গেবিন্দ বিশ্বাস তাড়াতাড়ি সনাতনের পায়ের ধুলো নিয়ে লজ্জায় মাথা নত করে বলল, “আপনার তুলনায় নস্যি। তবে অপয়া বলেই চারটি খেতে-পরতে পারছি। লোকে মানে গোনে।”
“বাঃ বাঃ। শুনে খুব খুশি হলুম। তবে মুশকিল কী জানিস? প্রাতঃকালে যদি দু-দুটো অপয়ার মুখ দেখতে পায় মানুষ, তা হলে
আর অপয়ার দোষ থাকে না। কেটে যায়।”
গোবিন্দ আঁতকে উঠে বললেন, “সর্বনাশ! তা হলে যে ব্যবসা লাটে উঠবে! সুবুদ্ধি বুঝি এই নিদানের কথাই বলছিল?”
সনাতন গম্ভীর হয়ে বলল, “হ্যাঁ। তবে তোর ব্যবসা আমি নষ্ট করব না। ঘর-সংসার যখন নেই তখন আর এখানে থেকে হবেটা কী? ভাবছি, হিমালয়ে গিয়ে সাধু হয়ে যাব।”
“আজ্ঞে তাই কি হয়?” বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন সমাজ মিত্তির আর ভূতনাথ নন্দী। তাঁদের একটু পেছনে বটকেষ্ট আর দ্বিজপদ। সুবুদ্ধি শশব্যস্তে তাদের বসবার জায়গা করে দিল।
সমাজ মিত্তির সনাতনের পায়ের ধুলো নিয়ে বললেন, “ঘটনাটা এই মাত্র সেদিন এক বিলিতি জানালে বেরিয়েছিল। তারাও খুব একটা বিশ্বাস করেনি। তারা কেবল তাদের পুরনো জানাল থেকে রিপ্রিন্ট করেছিল খবরটা। তাতেই আমি জেনেছিলুম যে, পাগলা বৈজ্ঞানিক অঘোর সেন কী একটা পদ্ধতি জানতেন যাতে মানুষকে অবিকৃত অবস্থায় বহু বছর ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায়। এবং সে বাবদে একটা এক্সপেরিমেন্টও নাকি করে গেছেন। কিন্তু এক্সপেরিমেন্টটা কোথায় করেছিলেন তার হদিস জানালটায় দিতে পারেনি। শুধু লেখা ছিল, নন্দপুর গাঁয়েই একটা লোককে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। লোকটার নাম সনাতন বিশ্বাস। কিন্তু অঘোরবাবু বিয়ে করেননি, তাঁর বংশধর বলেও কেউ নেই। ফলে মৃত্যুর পরই তাঁর বাড়িতে অন্য সব লোক বসবাস শুরু করে। তবে জানালে প্রবন্ধটা বেরনোর পর আমার মতো দু-চারজন খোঁজখবর শুরু করেছিল। এই যে ভূতনাথ নন্দী, ইনিও তাঁদের মধ্যে একজন। তিনি অবশ্য বুদ্ধি করে অঘোর সেনের নাম উহ্য রেখে এ-গাঁয়ের পুরনো ভূতের বাড়ি খুঁজতে থাকেন। তিনি অবশ্য একটা বাড়ি অনুমানে ভর করে কিনেও ফেললেন। কিন্তু সেই বাড়ি অঘোর সেনের নয়। অঘোর সেনের বাড়িটা কিনল সুবুদ্ধি রায়। যাই হোক, গতকাল থেকে এ-গাঁয়ে একজন সাঙ্ঘাতিক লোকের উদয় হয়েছে, যে অঘোর সেনের বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোনওরকম বাধা দিলেও সে মেরে বসছে লোককে। বাধা না দিলেও সন্দেহের বশে মারছে। আমাদের সন্দেহ, লোকটা অঘোর সেনের ল্যাবরেটরি আর সনাতন বিশ্বাসের সন্ধান করে মস্ত দাঁও মারার চেষ্টায় আছে। দেড়শো বছর আগেকার ল্যাবরেটরিতে কী কাণ্ড করেছিলেন অঘোর সেন, তা জানলে দুনিয়া তাজ্জব হয়ে যাবে। আর সনাতনবাবুকে তো ছিঁড়ে খাবে দুনিয়ার বৈজ্ঞানিকরা। কাজেই এখন সনাতনবাবু এবং অঘোর সেনের ল্যাবরেটরি হামলাবাজদের হাত থেকে বাঁচানোটাই আমাদের প্রধান কাজ।”
ভূতনাথবাবু বললেন, “আমি নিজেই একজন সায়েন্টিস্ট। আমি জানি, ঘটনাটা প্রায় অলৌকিক। অঘোর সেন আইনস্টাইনের চেয়ে কম নন।”
সনাতন বলে উঠল, “ইঞ্জিরি বলছ নাকি খোকা? ওইসব ভাষা যে আমি বুঝি না।”
ভূতনাথ বললেন, “আপনার বোঝার কথাও নয়। আইনস্টাইন আপনার অনেক পরে জন্মেছেন। কিন্তু কথা হল, আমাদের সামনে এখন কঠিন বিপদ। লোকটা কাল আমাকে আর আমার সহচরটিকে প্রায় যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। ঘরে-ঘরে গর্ত খুঁড়ে দেখেছে কোথাও পাতালঘর আছে কি না। এর পর সে দ্বিজপদকেও মেরে তাড়ায়। শুনলাম সে মধ্যরাতে সুবুদ্ধি রায়কেও নাকি মেরে একটা গর্তে ফেলে দেয়।”
সুবুদ্ধি বিনয়ের সঙ্গে বলল, “সে কাজটা উনি ভালই করেছেন। গর্তে আমাকে ফেলে দিয়েছিলেন বলেই অঘোর সেনের ল্যাবরেটরি আর সনাতনবাবুর হদিসটা পাওয়া গেল। কিন্তু লোকটা কে বলুন তো! বাংলায় কথা বলছিল বটে কিন্তু বাঙালি বলে মোটেই মনে হল না। আর গায়ে কী সাঙ্ঘাতিক জোর। আমাকে যেন পুতুলের মতো তুলে সপাং করে ছুঁড়ে ফেলে দিল। এরকম পালোয়ান লোক আমি জন্মে দেখিনি।”
ভূতনাথ চিন্তিতভাবে বললেন, “সেইটেই ভয়ের কারণ। লোকটা কে বা কোত্থেকে এল তা আমরা জানি না। কিন্তু সে যে সাঙ্ঘাতিক বিপজ্জনক লোক, তাতে সন্দেহ নেই। যাকগে, ওটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আপাতত আপনাদের আপত্তি না থাকলে
ল্যাবরেটরিটা আমি একটু দেখতে চাই।”
“আসুন, আসুন,” বলে সুবুদ্ধি খাতির করে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল সবাইকে।
একটু কষ্ট করেই একে-একে ল্যাবরেটরিতে নামলেন ভূতনাথ সুবুদ্ধি আর সমাজ মিত্তির। আর কাউকে যেতে দিলেন না ভূতনাথ। প্রদীপটা এখনও জ্বলছে। ঘরভরা উজ্জ্বল আলো।
প্রথমে প্রদীপটাই একটু পরীক্ষা করলেন ভূতনাথ। মাথা নেড়ে বলেন, “এরকম কখনও দেখিনি। আমাদের বিজ্ঞান এ-জিনিস এখনও কল্পনা করতে পারেনি।”
টেবিলের ওপর যে দুটো বন্ধ বাক্স রয়েছে, খুব সাবধানে একে একে সে-দুটোও খুললেন ভূতনাথ। ভেতরে ঝকঝকে কিছু অদ্ভুতদর্শন জিনিস এবং যন্ত্র রয়েছে। ভূতনাথ অনেকক্ষণ ধরে টর্চ জ্বেলে ভেতরটা দেখে নিয়ে ফের মাথা নেড়ে বলেন, “এসব যন্ত্রপাতি দেড়শো বছর আগে কেউ কল্পনা করেছিল, ভাবাই যায় না! এসব তো আজকের দিনেও আমরা কল্পনাই করি মাত্র। অঘোর সেন কী ধরনের মানুষ ছিলেন বুঝতে পারছি না। এসব সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি তৈরিই বা করলেন কী করে। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার।”
সুবুদ্ধি বলল, “সনাতনবাবু বলছিলেন, হিকসাহেব বলে কে একজন অঘোরবাবুর কাছে আসত। সে নাকি মানুষ নয়, ভূত। অঘোরবাবু ওই বাক্সটার গায়ে সাঁটা কাগজটাতেও হিক সাহেবের কথা লিখেছেন।”
ভূতনাথবাবু লেখাটা দেখে বললেন, “হুঁ। অঘোর সেনের আমলে যে এসব সফিস্টিকেটেড যন্ত্রপাতি পৃথিবীতে তৈরি হত না সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু হিসাহেবটা কে, তা বুঝতে পারছি না। হিক নামে কোনও বড় বৈজ্ঞানিকের নাম তো শুনিনি!”
সুবুদ্ধি বলল, “সনাতনবাবু বলেন, হিক আকাশ থেকে কৌটো করে নেমে আসত। আর তখন নন্দপুরে বিনা মেঘেও বিদ্যুৎ চমকাত।”
ভূতনাথ হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, “আকাশ থেকে! কৌটো করে! এসব তো আষাঢ়ে গল্প।”
সনাতনবাবুর দৃঢ় বিশ্বাস হিসাহেব ভূত ছাড়া কিছু নয়।
ভূতনাথবাবু বললেন, “ভূত বলে কিছু নেই। তবু হিক যদি ভূতই হয় তা হলেও বাঁচোয়া! কিন্তু ভূত না হলে চিন্তার কথা। চলুন সমাজবাবু, ওপর যাওয়া যাক। ল্যাবরেটরিটা এক অমূল্য সম্পদ। একে রক্ষা করার জন্য ভাল ব্যবস্থা করতে হবে। আবার পাঁচকান করা চলবে না। তা হলে গুচ্ছের লোক এসে ভিড় করবে। বাছা বাছা লোকজন নিয়ে পাহারা বসানো দরকার। নইলে ওই হামলাবাজটা এসে আবার ঝামেলা পাকাতে পারে।”
“যে আজ্ঞে, যথার্থই বলেছেন। লোকটা ঝামেলা পাকাবেই। আমাকে গর্তের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে লোকটা যখন পালিয়ে যায় তখন আমার ভাগ্নে কার্তিক বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। লোকটাকে দেখে সে একটা থামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। সে নিজের কানে। শুনেছে লোকটা চাপা গলায় অদ্ভুত ভাষায় কী যেন বলছিল। ভাষাটা সে বুঝতে পারেনি। তবে দেখেছে, লোকটা চকের মতো একটা জিনিস দিয়ে আমাদের বাইরের দেওয়ালে একটা ঢ্যাঁড়া কেটে দিয়ে চলে যায়। সেই ঢ্যাঁড়ার দাগটা নাকি অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছিল।”
“বলেন কী?” ভূতনাথবাবু অবাক হয়ে বললেন, “এতক্ষণ বলেননি কেন?”
“আজ্ঞে। একসঙ্গে অনেক ঘটনার ধকল সামলাতে হচ্ছে তো! কোনটা আগে বলব, কোনটা পরে, তার তাল রাখতে পারছি না।”
“চলুন তো দাগটা দেখি।” মাথা নেড়ে সুবুদ্ধি বলল, “আমি দেখেছি, কোনও দাগ নেই। মনে হচ্ছে ওটা এমন একটা জিনিস, যা রাত্রে জ্বলজ্বল করে, কিন্তু দিনের আলোয় অদৃশ্য হয়ে যায়।”
ভূতনাথ গম্ভীর হয়ে বললেন, “হ্যাঁ, এরকম জিনিস থাকতেই পারে। তার মানে বাড়িটা দেগে রেখে গেছে। তার মানেই হচ্ছে লোকটা রাতের দিকেই আসবে। আর তার মানে হচ্ছে, লোকটা বুঝতে পেরেছে যে, এটাই অঘোর সেনের বাড়ি।”
সুবুদ্ধি একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, তার মানে হচ্ছে আমাদের সামনে এখন অঘোর বিপদ। অঘোরবাবু এতসব কাণ্ড ফাণ্ড না করলে আজ এত নাকাল হতে হত না।”
ভূতনাথবাবু করুণ অসহায় গলায় সমাজবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, “এ-গাঁয়ে ব্যায়ামবীর-টির নেই? কিংবা ক্যারাটে, কুংফু জানা লোক?”
সমাজ মিত্তির মাথা নেড়ে বললেন, “না হে, নন্দপুরে ব্যায়ামবীর কেউ আছে বলে জানি না। ক্যারাটের নামও কেউ শুনেছে কি না সন্দেহ।”
“আচ্ছা, কার কার বাড়িতে বন্দুক-পিস্তল আছে বলুন তো!”
“না রে বাপু, গাঁয়ের লোকের অত পয়সা কোথায়? যদু সামন্তর একটা গাদা বন্দুক ছিল, তাও বহু পুরনো। সেদিন দেখলুম যদু সামন্তর নাতবউ সেটা দিয়ে নর্দমা পরিষ্কার করছে।”
“তা হলে তো চিন্তার কথা!”