মামা আর ভাগ্নে পাশাপাশি
গভীর রাত্রি। মামা আর ভাগ্নে পাশাপাশি দুটো চৌকিতে অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। দু দিন খুব খাটাখাটনি গেছে। শরীর দু’জনেরই খুব ক্লান্ত। পাড়াটা শান্ত, চুপচাপ। মাঝে-মাঝে রাতচরা পাখির ডাক, ঝিঁঝির শব্দ, কখনও কুকুরের একটু ঘেউ-ঘেউ। তাতে ঘুমটা আরও গভীরই হয়েছে দু’জনের।
রাত যখন প্রায় একটা, তখন সুবুদ্ধি হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে বসল। তার মনে হল, কে যেন করুণ স্বরে কাকে ডাকছে। বারবার ডাকছে, অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে।
“কার্তিক! ওরে কার্তিক?”
আধো-ঘুমের মধ্যেই কার্তিক বলল, “কী মামা?”
“কে কাকে ডাকছে বল তো! কারও বিপদ-আপদ হল নাকি?”
“হলেই বা! তুমি ঘুমাও।”
“ওরে না। পাঁচজনের বিপদে-আপদে দেখতে হয়। পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ে বাস করতে গেলে অমন মুখ ঘুরিয়ে থাকলে হয় না।”
কার্তিক উঠে বসল। হাই তুলে বলল, “কোথায়, আমি তো কিছু শুনতে পাচ্ছি না!”
“কান পেতে শোন।”
কার্তিক কানখাড়া করল। কিছুক্ষণ পর বলল, “কোথায় কী? তুমি স্বপ্ন দেখেছ।”
সুবুদ্ধিও শব্দটা আর শুনতে পাচ্ছিল না। বলল, “স্বপ্ন দেখা যায়। স্বপ্ন কি শোনা যায় রে? আমি শব্দটা শুনেছি।“
“রাত্রিবেলা কতরকম শব্দ হয়। ঘুমোও তো।”
“উঁহু, ভুল শুনেছি বলে মনে হয় না। মিলিটারিতে ছিলাম, আমাদের অনেক কিছু শিখতে হয়েছে।”
কার্তিক শুয়ে চোখ বুজল, আর সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। সুবুদ্ধিও শুল। তবে তার মনটা খচখচ করছিল। একটু এপাশ-ওপাশ করে সেও শেষ অবধি ঘুমোল।
রাত দুটো নাগাদ হঠাৎ কার্তিক ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, “মামা, ও মামা! শব্দটা শুনেছ?”
সুবুদ্ধি ঘুম ভেঙে বলল, “কিসের শব্দ?”
“তোমার শব্দটাই গো! কে কাকে ডাকছে। শোনোনি?”
সুবুদ্ধি টর্চটা নিয়ে মশারি তুলে বেরিয়ে এল, “চল তো দেখি।”
“ও মামা, এবাড়িতে ভূত নেই তো!”
“দুর! ভূত থাকলে বাড়িটা এত শস্তা হত নাকি? ভূতের দাম শুনলি না?”
“তাই তো!”
“কী নাম ধরে ডাকছিল বুঝতে পারলি?”
“কার্তিক মাথা নেড়ে বলল, “না। খুব অস্পষ্ট শব্দ। তবে মনে হল কী বাবু বলে যেন ডাকছিল।”
“আমিও ওরকমই শুনেছি। ঘোষবাবু না বোসবাবু কী যেন।”
“মামা, আমার বড় ভয়-ভয় করছে।”
সুবুদ্ধি একটু হাসল, “ভয়টা কিসের? মানুষ বিপদে পড়ে মানুষকে ডাকে।”
“কিন্তু তুমি টর্চ নিয়ে চললে কোথায়? শব্দটা কোথা থেকে আসছে, কে করছে তা না জেনে হুট করে বেরিয়ে পড়লেই তো কাজ হবে না। মনে হচ্ছে শব্দটা বেশ দূর থেকে আসছে।”
সুবুদ্ধি চিন্তিত মুখে বলল, “ভাবছি পাড়াটা একটা চক্কর দিয়ে আসব। তুই বরং ঘুমিয়ে থাক, আমি বাইরে তালা দিয়ে যাচ্ছি।”
কার্তিক তড়াক করে উঠে পড়ে বলল, “পাগল নাকি? আমি এই ভুতুড়ে বাড়িতে একা থাকতে গেছি আর কি! চলো, আমিও সঙ্গে যাই।”
সুবুদ্ধি একটু ভেবে তার লাঠিটাও নিয়ে নিল। দরজায় তালা
লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ল দুজনে।
রাস্তাঘাট অতীব নির্জন। রাস্তায় কুকুরটা বেড়ালটা অবধি দেখা যাচ্ছে না। আশপাশে যে দু-চারটে বাড়ি আছে, সব অন্ধকার। সুবুদ্ধি হাঁটতে-হাঁটতে বলল, “শব্দটা কোন দিক থেকে আসছিল বল তো?”
কার্তিক মাথা নেড়ে বলল, “বলতে পারব না। ভুলও শুনে থাকতে পারি।”
“দু’জনেই শুনেছি। ভুল বলে মনে হচ্ছে না।”
গোটা পাড়াটা ঘুরে-ঘুরে দেখল তারা। কোথাও কারও বিপদ হয়েছে বলে মনে হল না।
কার্তিক বলল, “চলো মামা, ফেরা যাক।”
সুবুদ্ধি মাথা নেড়ে বলল, “তাই চল।”
নিজেদের বাড়ির দরজায় এসে দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তালাটা ভাঙা, দরজার একটা পাল্লা হাঁ হয়ে খোলা।
কার্তিক ভয়ার্ত গলায় বলল, “মামা, এ কী?”
সুবুদ্ধি চাপা গলায় বলল, “চুপ। শব্দ করিস না। চোর ঢুকেছে মনে হচ্ছে। শব্দ করলে পালাবে।”
কার্তিক মামার হাত চেপে ধরে বলল, “ভেতরে ঢুকো না মামা। চোর হলে তোমাকে মেরে বসবে।”
সুবুদ্ধি হাসল। বলল, “মারতে আমিও জানি। মিলিটারিতে কি ঘাস কাটতুম রে? তুই বরং বাইরেই থাক। আমি দেখছি।”
সুবুদ্ধি ঘরে ঢুকে দেখল, ভেতরে যে হ্যারিকেনটা তারা জ্বালিয়ে গিয়েছিল, সেটা নেভানো। অন্ধকার হলেও সুবুদ্ধি ঠাহর করে বুঝল, প্রথম ঘরটায় কেউ নেই। থাকলে সুবুদ্ধির তীক্ষ্ণ কানে শ্বাসের শব্দ ধরা পড়ত। দ্বিতীয় ঘরটাতেও কেউ ছিল না। সেটা পেরিয়ে তিন নম্বর ঘরটায় ঢুকবার মুখেই সুবুদ্ধি থমকে দাঁড়াল। তার প্রখর অনুভূতি বলল, এ-ঘরে কেউ আছে। কিন্তু কে?
অন্ধকার এবং অজানা প্রতিপক্ষ সামনে থাকলে একটু কৌশল নিতেই হয়। সুবুদ্ধি তাই সোজা ঘরটায় ঢুকল না। উবু হয়ে বসে হামাগুড়ি দিয়ে চৌকাঠটা পেরিয়ে সে আবছা দেখতে পেল, ঘরের মেঝের গর্তটার সামনে একটা বিরাট চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আছে। সুবুদ্ধি লাঠিটা বাগিয়ে ধরে রইল, কিন্তু কিছু করল না। সে শুনতে পেল লোকটা বিড়বিড় করে বলল, “এটাই কি অঘোর সেনের বাড়ি? এটাই কি…”
সুবুদ্ধি সাহসী হলেও হিংস্র নয়। সে ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল।
সুবুদ্ধি একটু গলাখাঁকারি দিয়ে খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আজ্ঞে না, এটা অঘোর সেন মশাইয়ের বাড়ি নয়।”
লোকটা বিদ্যুদ্বেগে ফিরে দাঁড়াল। অতবড় শরীরটা যে এমন চিতাবাঘের মতো দ্রুত নড়াচড়া করতে পারে, তা দেখে সুবুদ্ধি
অবাক হল। লোকটা চাপা হিংস্র গলায় বলল, “তুই কে?”
সুবুদ্ধি আরও বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আমার নাম সুবুদ্ধি। সম্প্রতি এই বাড়িটা কিনেছি। কিছু যদি মনে করেন তো বলি, তালা ভেঙে বাড়িতে ঢোকাটা আপনার ঠিক হয়নি। চোর-ছ্যাঁচড়রাই এমন কাজ করে।”
কথাটা শেষ করেছে কি করেনি, কী যে একটা ঘটে গেল, তা সুবুদ্ধি বুঝতেই পারল না। প্রথমে তার মুখে একটা প্রবল ঘুসি মুগুরের মতো এসে পড়ল। তাতেই মাথা অন্ধকার হয়ে গেল সুবুদ্ধির। আর সেই অবস্থাতেও টের পেল কেউ তাকে দুহাতে তুলে নিয়ে গর্তের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর সুবুদ্ধির আর জ্ঞান নেই।
সুবুদ্ধি কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে ছিল, তা সে বলতে পারবে না। তবে তার জ্ঞান যখন ফিরল তখন সে দুটো জিনিস টের পেল। এক, তার চারদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। আর দুই হল, সে অজ্ঞান অবস্থাতেও হাঁটু মুড়ে বসে আছে।
মিলিটারিতে ছিল বলে সুবুদ্ধির সহ্যশক্তি আর সাহস দুটোই প্রচুর। গায়ের জোরও খুব কম নয়। নিজের অবস্থাটা বুঝতে তার খানিকটা সময় লাগল। চারদিকে হাতড়ে দেখল, সে একটা বেশ অপরিসর গর্তের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে। নীচে-ওপরে কোথাও কোনও রন্ধ্র আছে বলে মনে হচ্ছে না। তার ওপরে একটা ফুটো নিশ্চয়ই আছে, নইলে সে এখানে এসে সেঁধোয় কী করে!
সুবুদ্ধি উঠে দাঁড়িয়ে ওপর দিকটা হাতড়ে দেখল। কিছুই নাগাল পেল না। চেঁচিয়ে কার্তিককে কয়েকবার ডাকল, বুঝতে পারল ঘরের গর্তটা কেউ বুজিয়ে দিয়েছে, গলার স্বর ওপরে যাচ্ছে না।
সাহসী সুবুদ্ধির একটু ভয়-ভয় করতে লাগল। এখনই যদি কিছু করা না যায়, তা হলে এই কবরের মধ্যে অক্সিজেনের অভাবে তার মৃত্যু অনিবার্য। গর্তের ভেতরে ভ্যাপসা গরমে তার শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে।
সুবুদ্ধি ওপরে ওঠার ফিকির খুঁজতে লাগল। ওপরে ওঠা ছাড়া বেরোবার তো পথ নেই। কাজটা শক্ত নয়। গর্তটার খাঁজে-খাঁজে পা রেখে ওঠা সহজ ব্যাপার। সুবুদ্ধি চারদিকটা হাতড়ে দেখে নিল। নরম মাটি। খাঁজখোঁজও অনেক। সুবুদ্ধি একটা খাঁজে পা রেখে ভর দিয়ে উঠতে গিয়েই হড়াস করে মাটির দেওয়াল খসে ফের নীচে পড়ল। কিন্তু ধৈর্য হারালে চলবে না। নরম মাটিতে আবার একটা গভীর খাঁজ তৈরি করে নিল সে। কিন্তু মাটি বড্ডই নরম। খাঁজ ভেঙে মাটির চাপড়া খসে পড়ে গেল।
গাছের শেকড়-বাকড় থাকলে ভাল হত। কিন্তু তা নেই। বারবার চেষ্টা করতে লাগল সুবুদ্ধি, আর বারবার মাটির চাপড়া
ভেঙে পড়ে যেতে লাগল। সুবুদ্ধি ঘামছে। শ্বাসের কষ্ট এখনও শুরু হয়নি। তবে হবে। তাই সে একটু ধৈর্য হারিয়ে গর্তের একটা দেওয়ালে হাত দিয়ে খুবলে বেশ বড় একটা খাঁজ তৈরি করতে লাগল। মাটি খানিকটা খুবলে আনতে গিয়েই হঠাৎ একটা কঠিন জিনিসের স্পর্শ পেল সে। মনে হল, যেন পাথর বা ওই জাতীয় কিছু। গর্তটা সে খুবলে আরও একটু বড় করে ফেলল। তারপর হাতড়ে হাতড়ে দেখল।
প্রথমটায় পাথর বলে মনে হলেও আরও কিছু মাটি খসাবার পর দরজায় যেমন লোহার কড়া লাগানো থাকে তেমনই একটা মস্ত এবং ভারী কড়া হাতে পেল। মাটির নীচে চোর কুঠুরি থাকা বিচিত্র নয়। অনেক সময়ে এসব চোর কুঠুরিতে সোনা-দানা, টাকা-পয়সা পাওয়া যায়। সুবুদ্ধি কৌতূহলবশে ওপরে ওঠার চেষ্টা ছেড়ে কড়াটা নিয়ে নাড়াঘাটা করতে লাগল। এটা দরজাই হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু খোলা শক্ত। মাটি না সরালে খোলা যাবে না।
সুবুদ্ধি একটু জিরিয়ে নিল। ঘাম ঝরে যাচ্ছে, শরীর দুর্বল লাগছে, তেষ্টা পাচ্ছে, এই অবস্থায় হঠাৎ বেশি পরিশ্রম করলে তার দম একেবারেই ফুরিয়ে যাবে। অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কাজ করছে আন্দাজে আন্দাজে। টর্চটা থাকলে কাজের সুবিধে হত।
সুবুদ্ধি কিছুক্ষণ জিরিয়ে ফের মাটি সরাতে লাগল। তাড়াহুড়ো করল না। ক্রমে-ক্রমে মাটি ঝরে গর্তটা যেন আরও ছোট হয়ে যাচ্ছিল। তবে সামনে ধীরে-ধীরে একটা সরু দরজার মত জিনিস হাতড়ে হাতড়ে বুঝতে পারল সুবুদ্ধি। একটু ধাক্কা দিয়ে দেখল। না, দরজাটা নড়ল না। আবার ধাক্কা দেওয়ার জন্য হাতটা তুলেছিল সে। হঠাৎ তার সর্বাঙ্গ যেন ভয়ে পাথর হয়ে গেল। সর্বাঙ্গে একটা হিমশীতল শিহরন। সে স্পষ্ট শুনতে পেল, মাটির তলা থেকে কে যেন ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকছে, “অঘোরবাবু! অঘোরবাবু! কোথায় গেলেন?”
মিলিটারি সুবুদ্ধিরও যেন মাথা গুলিয়ে গেল। মাটির তলায় চোরা-কুঠুরিতে অশরীরী ছাড়া তো কারও থাকার কথা নয়। তবে কি যক বলে সত্যিই কিছু আছে? এ কি সেই যকেরই কণ্ঠস্বর? জীবনে সুবুদ্ধি এত ভয় কখনও পায়নি। তার বুক ধড়াস ধড়াস করছে। হাতে পায়ে খিল ধরে গেছে।
সুবুদ্ধি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রাম নাম করল। মাটির নীচের কণ্ঠস্বর ওই একবারই ডেকে চুপ মেরে গেছে। তবে একটু আগে সে তার কার্তিক যে এই কণ্ঠস্বর শুনেছিল, তাতে সুবুদ্ধির সন্দেহ রইল না।
সুবুদ্ধি বসে বসে ভাবল, এই গভীর গর্তের মতো জায়গায় তার মরণ এমনিতেই লেখা আছে। মরতেই যদি হয় তো আর ভয়ের কী আছে? দরজাটা খুললে যদি কোনও সুড়ঙ্গটুড়ঙ্গ পাওয়া যায় তো ভাল, না হলে কপালে যা আছে হবে।
সুবুদ্ধি কড়াটা ধরে এবার নিজের দিকে টানল। কিন্তু দরজাটা নড়ল না। দরজাটা কোন দিকে খুলবে, তাও বুঝতে পারছিল না সে। টানবে না ঠেলবে, সেটাও তো বোঝা দরকার। ছিটকিনি বা ওই জাতীয় কিছু আছে কি না দেখার জন্য সুবুদ্ধি দরজাটা ফের আগাপাশতলা হাতড়াতে লাগল। একেবারে দরজার মাথায় মাটির একটা টিবলি খুবলে নিতেই একটা শিকল পেয়ে গেল সুবুদ্ধি। শিকলে একটা তালাও মারা রয়েছে। সুবুদ্ধি ভাবল, বহুকালের পুরনো তালা আর শিকল হয়তো কমজোরি হয়ে এসেছে। সে হ্যাঁচকা টান মারল।
শিকল খুলল না। তাতে হার না মেনে বারবার হ্যাঁচকা টান দিতে থাকল সে। কারণ এ ছাড়া আর পথ নেই।
অন্তত বারদশেক হ্যাঁচকা টান দেওয়ার পর হঠাৎ যেন তালা লাগানোর আংটাটা একটু নড়বড়ে মনে হতে লাগল। উৎসাহের চোটে সুবুদ্ধি দ্বিগুণ জোরে হ্যাঁচকা মেরে তালা ধরে প্রায় ঝুলে পড়ল। তাতে আংটা খুলে তালাটা পটাং করে এসে সুবুদ্ধির মাথায় লেগে একটা আলু তুলে দিল।
কিছুক্ষণ মাথাটা ঝিমঝিম করল সুবুদ্ধির। ক্ষতস্থান থেকে রক্তও পড়ছিল। সুবুদ্ধি খানিকটা মাটি নিয়ে ক্ষতস্থানে চাপা দিল। এর চেয়ে ভাল ফার্স্ট এইড এখন আর কী হতে পারে!
খুব ধীরে-ধীরে দরজাটা ঠেলল সুবুদ্ধি। বহুকালের পুরনো জং-ধরা কবজা আর এঁটেল মাটিতে আটকে যাওয়া পাল্লা সহজে খুলল না। বেশ খানিকক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করার পর অল্প-অল্প করে দরজাটা ওপাশে সরতে লাগল। তারপর সরু একটা ফালি ফোকর উন্মোচিত হয়ে গেল সুবুদ্ধির সামনে। ভেতরে একটা বহুকালের পুরনো সোঁদা বাতাসের গন্ধ।
সুবুদ্ধি সন্তর্পণে দরজার ফাঁকটায় দাঁড়িয়ে ভেতরের অবস্থাটা আন্দাজ করার চেষ্টা করল। সামনে কোন বিপদ অপেক্ষা করছে তার ঠিক কী? পা বাড়িয়ে সে দেখল, সামনে মেঝে বলে কোনও জিনিস নেই। তার পা ফাঁকায় খানিকক্ষণ আঁকপাকু করে ফিরে এল। খুব চাপা একটা শিস দিল সুবুদ্ধি। শিসের শব্দটা বেশ খানিকটা দূর অবধি চলে গেল। অর্থাৎ ঘরটা ছোট নয়। সুবুদ্ধি একটা মাটির ঢেলা নিয়ে ফেলল নীচে। অন্তত দশ ফুট নীচে ঢেলাটা থপ করে পড়ল।
দশ ফুট লাফ দিয়ে নামা সুবুদ্ধির কাছে শক্ত কিছু নয়। প্যারাট্রুপারের ট্রেনিংয়ের সময় এরকম লাফ সে বহু দিয়েছে। তবে চিন্তার বিষয় হল, নীচে কী আছে তা না জেনে লাফ মারলে বিপদ হতে পারে। নীচে আসবাবপত্র, কাঁচের জিনিস বা
পেরেক-টেরেক থাকলে বিপদের কথা। সুবুদ্ধি তাই নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে দেখল নীচে নামবার কোনও মই-টই কিছু আছে কি না, নেই।
সুবুদ্ধি হুট করে লাফ না দিয়ে দরজার চৌকাঠ ধরে আগে নিজের শরীরটাকে নীচে ঝুলিয়ে দিল। তারপর হাত ছেড়ে দিতেই দড়াম করে পড়ল নীচে একটা বাঁধানো জায়গায়। পড়েই অভ্যাসবশে গড়িয়ে যাওয়ায় চোট বিশেষ হল না।
খুব ধীরে-ধীরে সুবুদ্ধি উঠে দাঁড়াল, তারপর হাতড়ে হাতড়ে দেখতে লাগল কোথায় কী আছে। সামনেই একটা টেবিলের মতো জিনিস। তাতে মেলা শিশি, বোতল, নানা আকৃতির বয়াম বা জার রাখা আছে। রবারের নলের মতো জিনিসও হাতে ঠেকল তার।
আরও একটু এগিয়ে সে আরও বড় একটা টেবিলে আরও বড় বড় এবং কিস্তৃত সাইজের বয়াম, শিশি আর জার ঠাহর করল। এগুলোতে কী আছে তা জানার সাহস হল না তার। তবে একটু তুলে দেখার চেষ্টা করল। বড্ড ভারী।
এর পর একটা লম্বা টানা টেবিলের ওপর রাখা কাঠের লম্বা-লম্বা বাক্স ঠাহর করল সে। এই বাক্সে গুপ্তধন থাকলেও থাকতে পারে। থেকেও অবশ্য লাভ নেই তার। এখান থেকে বেরোতে না পারলে গুপ্তধনের সঙ্গে সেও গুপ্ত এবং লুপ্ত হয়ে যাবে।
মস্ত ঘরটা ঘুরে-ঘুরে সে কিছু কোদাল আর শাবল জাতীয় জিনিসও পেল। কাজে লাগলে এগুলোই লাগতে পারে। কিন্তু আপাতত তার দরকার একটা বাতি। সে ব্যবস্থা নেই বলেই মনে হচ্ছে। তবু সে হাল ছাড়ল না। নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে দু’খানা হাতকেই চোখের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে খুঁজতে লাগল। আবার প্রথম আর দ্বিতীয় টেবিল হাতড়াতে-হাতড়াতে হঠাৎ তার মনে হল, দুটো পাথর পাশাপাশি রাখা আছে। চকমকি নয় তো!
পাথর দুটো হাতে নিয়ে ঠুকবার আগে একটু ভাবল সুবুদ্ধি, মাটির নীচে এই ঘরে কী ধরনের গ্যাস জমে আছে তা জানা নেই। হঠাৎ যদি আগুন লেগে যায়, তা হলে পুড়ে মরতে হবে।
কিন্তু যা তোক একটা কিছু তো করতেই হবে। অন্ধকারটা আর সে সহ্য করতে পারছিল না। সুবুদ্ধি ঠাকুরকে স্মরণ করে ঠুক করে চকমকি ঠুকল।
ঠুকতেই এক আশ্চর্য কাণ্ড! বাঁ হাতের পাথরটা দপ করে জ্বলে উঠে একটা নীল শিখা লকলক করতে লাগল। সুবুদ্ধি ‘বাপ রে’ বলে পাথরটা ফেলে দিতেই সেটা নিভে গেল। এরকম কাণ্ড সুবুদ্ধি আগে কখনও দেখেনি।
হতবুদ্ধি হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে ফের নিচু হয়ে হাতড়ে হাতড়ে পাথরটা তুলে নিল। পাথরটায় যখন আলো হয় তখন এটাকে ব্যবহার না করারও মানে হয় না।
ফের ইকতেই যখন পাথরটা জ্বলে উঠল তখন সে চট করে চারদিকটা দেখে নিল। টেবিলের ওপর একটা পেতলের প্রদীপ রয়েছে, পাশেই একটা শিশি। শিশিতে তেল থাকার সম্ভাবনা। জ্বলন্ত পাথরটাকে টেবিলের ওপর রেখে সে সেই আলোয় শিশি থেকে প্রদীপে তেল ঢালল। তারপর জ্বলন্ত পাথর থেকে প্রদীপটা ধরিয়ে নিল। পাথরটা কিন্তু জ্বলতে-জ্বলতে দ্রুত ক্ষয়ে তারপর ফুস করে নিভে গেল, আর তার অস্তিত্বই রইল না।
প্রদীপটাই এখন তার মস্ত ভরসা। আলোটাও হচ্ছে বেশ ভাল। সাধারণ প্রদীপের আলো যেমন টিমটিম করে, এর তা নয়। বেশ সাদাটে জোরালো একটা শিখা স্থির হয়ে জ্বলছে। ষাট বা একশো ওয়াটের বালবের চেয়ে কম নয়। হতে পারে অনেকক্ষণ অন্ধকারে ছিল বলেই আলোটা এত বেশি উজ্জ্বল লাগছে তার চোখে।
ঘরখানা বেশ বড়। অন্তত কুড়ি ফুট লম্বা আর পনেরো ফুট চওড়া হবে। চারদিকে টেবিল, আর টেবিলের ওপর নানা কিস্তৃত যন্ত্রপাতি। শিশি-বোতল আর জারের অভাব নেই। একধারে লম্বা টেবিলের ওপর পরপর তিনটে কাঠের লম্বা বাক্স। বাইরে থেকে গোটা কয়েক নল বাক্সগুলোর মধ্যে কয়েকটা ফুটো দিয়ে গিয়ে ঢুকেছে। সুবুদ্ধি চারদিকে ভাল করে চেয়ে-চেয়ে দেখল। তার মনে হচ্ছিল, এটা আদ্যিকালের কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারই হবে। খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার।
হাতলওলা পিতলের প্রদীপটা নিয়ে সে চারদিক একটু ঘুরে দেখল। ঝুল, ধুলো, মাকড়সা এই নীচের ঘরেও কিছু কম জমেনি। একধারে একটা কাঁচ বসানো আলমারিতে অনেক বই
সাজানো আছে। চামড়ায় বাঁধানো বইগুলোর নাম পড়া গেল না, কাঁচে ময়লা জমে যাওয়ায়।
হঠাৎ তার সর্বাঙ্গে হিমশীতল একটা শিহরন বয়ে গেল। কে যেন শিস দেওয়ার মতো চিকন তীব্র স্বরে ডেকে উঠল, “অঘোরবাবু! অঘোরবাবু! আপনি কোথায়?”
এত চমকে গিয়েছিল সুবুদ্ধি যে, আর একটু হলেই প্রদীপটা তার হাত থেকে পড়ে যেত। স্বরটা এত তীব্র যে, সেটা এ-ঘর থেকেই হচ্ছে বলে মনে হল তার। কিন্তু এ-ঘরে কে থাকবে? অশরীরী অবশ্য হতে পারে।
কাঁপা হাতে প্রদীপটা শক্ত করে ধরে সে ধীরে-ধীরে লম্বাটে বাক্সগুলোর দিকে এগোল। ভয় পেতে-পেতে সে ভয় পাওয়ার শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে। এখন যা থাকে কপালে, তাই হবে।
প্রথম বাক্সটার ডালা খুলতে গিয়েই সে টের পেল, খোলা সহজ নয়। বজ্ৰ-আঁটুনি আছে।
সুবুদ্ধি প্রদীপটা ধরে ভাল করে বাক্সটা দেখল। বাক্সের গায়ে একটা পুরনো বিবর্ণ কাগজ সাঁটা। তার গায়ে বাংলা হরফেই কিছু লেখা আছে। সুবুদ্ধি নিচু হয়ে দেখল, পুঁথিতে যেমন থাকে তেমনই অদ্ভুত হাতের লেখায় সাবধান করা হয়েছে, “ইহা শ্বাস নিয়ামক যন্ত্র। বাক্সটি দয়া করিয়া খুলিবেন না। খুলিলে যন্ত্র বিকল হইবার সম্ভাবনা। “
দ্বিতীয় বাক্সটার গায়েও একটা বিবর্ণ কাগজ। তাতে লেখা, “ইহাতে মৎ আবিষ্কৃত অমৃতবিন্দুর সঞ্চার ঘটিতেছে। বৎসরে এক ফোঁটা মাত্র অমৃতবিন্দু দেহে প্রবেশ করিয়া তাহা সজীব রাখিবে। বাক্সটি দয়া করিয়া খুলিবেন না।”
তৃতীয় বাক্সটার গায়েও কাগজ সাঁটা। তাতে লেখা, “এই ব্যক্তির নাম সনাতন বিশ্বাস, অদ্য ১৮৪৫ খ্রিস্ট অব্দের সেপ্টেম্বর মাসের ৩০ তারিখে ইহার বয়ঃক্রম আঠাশ বৎসর হইবেক। সনাতন অতীব দুষ্টপ্রকৃতির লোক। তাহার অখ্যাতি বিশেষ রকমের প্রবল। আমার গবেষণার জন্য ইহাকেই বাছিয়া লইয়াছি। সনাতনকে নিদ্রাভিভূত করিতে পারিলে গ্রামের মানুষ হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিবে। সনাতন অবশ্য সহজে ধরা দেয় নাই। কৌশল অবলম্বন ও প্রলোভন প্রদর্শন করিতে হইয়াছে। যে গভীর নিদ্রায় তাহাকে অভিভূত করা হইয়াছে তাহা সহজে ভাঙিবার নহে। যুগের পর যুগ কাটিয়া যাইবে, তবু নিদ্রা ভঙ্গ হইবে না। সনাতনের শ্বাসক্রিয়া ও হৃদযন্ত্রের স্পন্দনের মাত্রা অতিশয় হ্রাস করা হইয়াছে। ফলে তাহার শরীরে শোণিত চলাচল মন্দীভূত হইবে এবং ক্ষয় একপ্রকার হইবেই না। এ ব্যাপারে আমি হিক সাহেবের পরামর্শ লইয়াছি। অমৃতবিন্দুর সঞ্চার যদি অব্যাহত থাকে তবে সনাতনের প্রাণনাশের আশঙ্কা নাই। ভবিষ্যতের মনুষ্য, যদি সনাতনের সন্ধান পাইয়া থাকেন, তাহা হইলে তড়িঘড়ি করিবেন না। বাক্সটির পাশেই ইহা খুলিবার একটি চাবি পাইবেন। বাক্সটি খুব সন্তর্পণে খুলিবেন। সনাতনকে কী অবস্থায় দেখিতে পাইবেন তাহা অনুমানের বিষয়। আমি সে-বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করিতে পারিব না। তাহার গাত্রে একটি সবুজ প্রলেপ মাখানো আছে। মুখে ও নাকে নল দেখিবেন। বাক্সটি খুলিয়া খুব সন্তর্পণে কিছুক্ষণ বায়ু চলাচল করিতে দিবেন। সনাতনের শিয়রে একটি শিশিতে একটি তরল পদার্থ রাখা আছে। শত বা শতাধিক বৎসর পর তাহা হয়তো কঠিন আকার ধারণ করিবে। শিশিটি আগুনের উপর ধরিলেই পুনরায় উহা তারল্য প্রাপ্ত হইবে। সনাতনকে হাঁ করাইয়া এই শিশি হইতে সামান্য তরল পদার্থ তাহার মুখে ঢালিয়া দিবেন। তৎপর নাকের ও মুখের নল খুলিয়া দিবেন। অনুমান করি, সনাতন অতঃপর চক্ষু মেলিবে। জগদীশ্বরের কৃপায় যদি সত্যই সে চক্ষু মেলিয়া চাহে এবং পুনরুজ্জীবিত হয় তাহা হইলে আমার গবেষণা সার্থক হইয়াছে বলিয়া ধরিতে হইবে। কিন্তু সেই সাফল্যের আস্বাদ লাভ করিবার জন্য আমি তখন ধরাধামে থাকিব না। মহাশয়, পূর্বেই বলিয়াছি, সনাতন অতীব দুষ্ট প্রকৃতির লোক। পুনরুজ্জীবিত হইয়া সে কী আকার ও প্রকার ধারণ করিবে তাহা আমার অনুমানের অতীত। তবে তাহাকে যে সকল প্রলোভন দেখাইয়াছি তাহার ফলে সে যে আমার অনুসন্ধান করিবে তাহাতে সন্দেহ নাই। ঈশ্বর প্রসাদাৎ আমি তখন পরলোকে। সনাতনের বাহানা আপনাদেরই সামলাইতে হইবে। আমি শ্রীঅঘোর সেন সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে এই বিবরণ দাখিল করিলাম।”
সুবুদ্ধি হতবুদ্ধি হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কী করবে বা করা উচিত, তা প্রথমটায় বুঝতে পারল না। তবে কৌতূহল জিনিসটা বড়ই সাঙ্ঘাতিক। শত বিপদের ভয় থাকলেও কৌতূহলকে চেপে রাখা কঠিন।
চাবিটি জায়গামতোই পাওয়া গেল। সুবুদ্ধি চাবিটা নিয়ে বাক্সের গা-তালায় ঢুকিয়ে ঘুরিয়ে দিল। তারপর ধীরে ধীরে ডালাটা তুলে ফেলল। কী দেখবে, কাকে দেখবে ভেবে ভয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল সুবুদ্ধি। তারপর চোখ খুলে হাঁ করে চেয়ে রইল।
অঘোর সেন তাঁর বিবরণে যা লিখেছেন তা যদি সত্যি হয় তা হলে লোকটা দেড়শো বছরেরও বেশি ঘুমিয়ে রয়েছে এবং লোকটার বয়স একশো আটাত্তর। সেই তুলনায় সবুজ রঙের লোকটাকে নিতান্তই ছোঁকরা দেখাচ্ছে। একটু রোগাভোগা চেহারা ঠিকই। তবে দেড়শো বছর ধরে মাসে মাত্র এক ফোঁটা করে অমৃতবিন্দু খেয়ে বেঁচে থাকলে রোগা হওয়ারই কথা। কিন্তু তেমন সাঙ্ঘাতিক রোগা নয়। লোকটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বুকের ওঠানামা বা শ্বাস চলাচল বোঝাই যাচ্ছে না।
সুবুদ্ধিকে চমকে দিয়ে হঠাৎ লোকটা সেই অস্বাভাবিক চিকন স্বরে ডেকে উঠল, “অঘোরবাবু! অঘোরবাবু! আপনি কোথায়?”
সুবুদ্ধি আর ভয় পেল না। সে ভাল করে লোকটার আপাদমস্তক দেখে নিল। না, লোকটা জেগে নেই। তবে অহরহ অঘোরবাবু সম্পর্কে দুশ্চিন্তা রয়েছে বলে ঘুমের মধ্যেই অঘোরবাবুকে খুঁজে নিচ্ছে।
শিয়রের শিশিটা তুলে নিয়ে প্রদীপের আলোয় দেখে নিল সুবুদ্ধি। তরলটা সত্যিই জমে গেছে। শিশিটা প্রদীপের শিখার ওপর সাবধানে ধরল সুবুদ্ধি। মিনিট দুয়েকের মধ্যে তরলটা গলে গেল।
সনাতনকে হাঁ করাতে বেগ পেতে হল না। শরীরের জোড় আর খিলগুলো বেশ আলগা হয়ে গেছে। অর্ধেকটা ওষুধ সনাতনের মুখে ঢেলে দিল সুবুদ্ধি। তারপর নাক আর মুখ থেকে নল সরিয়ে নিল।
সনাতনের জেগে উঠতে সময় লাগবে। কিন্তু এই ঘুমন্ত লোকটার গলার স্বর পাতালঘর থেকে ওপরে কী করে গিয়ে পৌঁছত সেটা একটু অনুসন্ধান করে দেখল সুবুদ্ধি। তৃতীয় আর-একটা রবারের নল থেকে একটা চোঙার মতো জিনিস বেরিয়ে বাক্সে সনাতনের মুখের সামনেই ‘ফিট করা আছে। নলের অন্য প্রান্ত একটা ড্রামের ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে ঘরের কোণে। সেখান থেকে ফের ওপরে উঠে ঘরের ছাদের ভেতরে গিয়ে অদৃশ্য হয়েছে। এটা বোধ হয় দেড়শো বছর আগেকার একটা পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম। হয়তোবা অঘোর সেনেরই উর্বর মাথা থেকে বেরিয়েছিল। সনাতনের হদিস যাতে ভবিষ্যতের মানুষ জানতে পারে সেইজন্যই বোধ হয় ব্যবস্থা করে রেখে গিয়েছিলেন।
একটু আগে যে গুণ্ডা লোকটা তাকে মেরে গর্তে ফেলে দিয়েছিল সেও অঘোর সেনের বাড়িই খুঁজছিল। কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় সুবুদ্ধি একটু দুশ্চিন্তায় পড়ল। অঘোর সেনের পাতালঘরের খবর কি তা হলে আরও কেউ-কেউ জানে?
সনাতনের চোখের পাতা কম্পিত হতে লাগল আরও আধঘণ্টা পর, শ্বাস দ্রুততর হতে লাগল। সুবুদ্ধি নাড়ি দেখে বুঝল, নাড়ির গতিও ক্রমে বাড়ছে।
আরও ঘণ্টাখানেক বাদে সনাতন মিটমিট করে তাকাতে লাগল। প্রদীপের আলোটাও যেন ওর চোখে লাগছে।
সুবুদ্ধি সনাতনের মুখের ওপর একটু ঝুঁকে বলল, “কেমন আছেন সনাতনবাবু?”
সনাতন পটাং করে চোখ মেলে তাকে দেখেই খোলা ভুতুড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “ভূ-ভূ-ত! ভূ-ভূত নাকি রে তুই? খবরদার, কাছে আসবি না। গাম… গাম… গাম… গাম…”
সুবুদ্ধি একটু লজ্জা পেল। ধুলোমাটিতে মাখা তার চেহারাখানা যে দেখনসই নয় তা তার খেয়াল ছিল না। খুব বিনয়ের সঙ্গে সে বলল, “যার নাম করতে চাইছেন তিনি গাম নন, রাম।”
সনাতন আতঙ্কের গলায় বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, রামই তো! রাম নামে ভয় খাচ্ছিস না যে বড়? অ্যাাঁ!”
“ভূত হলে তো ভয় পাব! আমি যে ভূতই নই আজ্ঞে।”
“তবে তুই কে?”
“আমার নাম সুবদ্ধি রায়। চিনবেন না। পরদেশি লোক।”
“ডাকাত নোস তো!”
“আজ্ঞে না। ডাকাত হতে এলেম লাগে। আমার তা নেই।”
সনাতন চোখ পিটপিট করতে করতে বলল, “অক্ষয়বাবু কোথায় বল তো! অক্ষয়বাবুর কাছে আমি পাঁচ হাজার টাকা পাই।”
সুবদ্ধি বুঝতে পারল, অনেকদিন ঘুমিয়ে থাকায় সনাতনের কিছু ভুলভাল হচ্ছে। ঘুমের মধ্যে অঘোরবাবুর নামটা ঠিকঠাক বললেও এখন জেগে ওঠার পর স্মৃতি কিছুটা ভ্রষ্ট হয়েছে। সুবদ্ধি মাথা চুলকে বলল, “অক্ষয়বাবু বলে কাউকে চিনি না। তবে অঘোরবাবু বলে একজন ছিলেন।”
সনাতন বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, অঘোরবাবুই তো! তিনি কোথায়?”
“তিনি এখন নেই আজ্ঞে।”
সনাতন খ্যাঁক করে উঠল, “নেই মানে? কোন চুলোয় গেছেন? সনাতন বিশ্বাসের জলার জমিটা কিনব সব ঠিকঠাক হয়ে আছে। সোমবার টাকা দেওয়ার কথা।”
সুবদ্ধি একটু দোটানায় পড়ে বলল, “আজ্ঞে, যতদূর জানি, সনাতন বিশ্বাস আপনারই শ্রীনাম। নিজের জমি কি নিজে কেনা যায়? আমি অবশ্য তেমন জ্ঞানগম্যিওলা লোক নই।”
সনাতন চোখ বড়-বড় করে বলল, “আমার নাম সনাতন বিশ্বাস! হ্যাঁ, সেরকম যেন মনে হচ্ছে। আজ এত ভুলভাল হচ্ছে কেন কে জানে! অঘোরবাবুর ওষুধটা খেয়ে ইস্তক মাথাটা গেছে দেখছি। আচ্ছা, আমি একটা কলসির মধ্যে শুয়ে আছি কেন বল তো!
“কলসি! আজ্ঞে কলসির মধ্যে শোওয়া কঠিন ব্যাপার। এ হল গে যাকে বলে বাক্স। কফিনও বলতে পারেন।”
“হ্যাঁ, বাক্সই বটে। বাপের জন্মে কখনও বাক্সে শুইনি বাপ। এ নিশ্চয়ই এই বিটকেলে অঘোরবাবুর কাণ্ড। লোকটা একটা যাচ্ছেতাই।”
“যে আজ্ঞে।”
“এখন রাত কত হল বল তো?”
“তা শেষরাত্তিরই হবে মনে হয়।”
“বলিস কী? সেই সকালবেলাটায় ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াল এর মধ্যেই শেষ রাত্তির! আজব কাণ্ড। “
মাঝখানে যে দেড়শো বছর কেটে গেছে সেটা আর ভাঙল না সুবুদ্ধি।
“ওরে, আমাকে একটু ধরে তোল তো, শরীরটা জুত লাগছে না। মাথাটাও ঘুরছে। আরও একটু শুয়ে থাকতে পারলে হত, কিন্তু তার জো নেই। গোরুগুলোকে জাবনা দিয়ে মাঠে ছেড়ে আসতে হবে। তারপর গঞ্জে আজ আবার হাটবার। মেলা কাজ জমে আছে।”
“আজ্ঞে এই তুলছি।” বলে সুবুদ্ধি সনাতনকে ধরে তুলে বসাল। একটু নড়বড় করলেও সনাতন বসতে পারল। চারদিকটা প্রদীপের আলোয় চেয়ে দেখে বলল, “বড় ধুলো ময়লা পড়েছে দেখছি! সকালবেলাটায় তো বেশ পরিস্কার ছিল।”
“আজ্ঞে, ধুলোময়লার স্বভাবই ওই, ফাঁক পেলেই ফাঁকা জায়গায় চেপে বসে। আর ফাঁকটা অনেকটাই পেয়েছে কি না।”
সনাতন বিরক্ত হয়ে বলল, “ধরে ধরে একটু নামা তো বাপু, একটু দাঁড়িয়ে মাজাটা ছাড়াই। এই বিচ্ছিরি বাক্স থেকে বেরনোও তো ঝামেলার ব্যাপার দেখছি “
সুবদ্ধি সনাতনকে পাঁজা-কোলে তুলে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে দিতেই সনাতন হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল, “ও বাবা, হাঁটুতে যে জোর নেই দেখছি?
“ভাববেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। দেড়শো বছরের পাল্লাটার কথাও তো ভাববেন।”
সনাতন অবাক হয়ে বলল, “দেড়শো বছর। কিসের দেড়শো বছর রে পাজি?”
“মুখ ফসকে একটা বাজে কথা বেরিয়ে গেছে। জিরিয়ে নিন, পারবেন।”
তা পারল সনাতন। আরও আধঘণ্টা বসে থেকে, তারপর সুবুদ্ধির কাঁধে ভর দিয়ে লগবগ করতে করতে দাঁড়াল। তারপর বলল, “নাঃ, বড্ড খিদে পেয়ে গেছে। বাড়ি গিয়ে একটু পান্তা না খেলেই এখন নয়।”
“হবে, হবে। বাড়ি যাবেন সে আর বেশি কথা কী? এটাও নিজের বাড়ি বলে ধরে নিতে পারেন। কথায় আছে বসুধৈব কুটুম্বকম।”
নাক সিঁটকে সনাতন বলল, “হুঃ এটা একটা বাড়ি! অঘোর পাগলের বাড়ি হল গোলোকধাঁধা। মাথার গণ্ডগোল না থাকলে কেউ মাটির নীচে ঘর করে? তা ছাড়া লোকটা ভূতপ্রেত পোষে।”
“তা বটে। তা এই অঘোর সেনের খপ্পরে আপনি পড়লেন কী করে?”
“পড়েছি কি আর সাধে? পাঁচটি হাজার টাকা পেলে জলার জমিটা কেনা যাবে। তা অঘোরবাবু বলল, কী একটা ওষুধ খেয়ে একটু ঘুমোলে পাঁচ হাজার টাকা দেবে। তা হ্যাঁ রে, জমিটা কার তা মনে পড়ছে না কেন বল তো!”
“পড়বে। একটু ঝিমুনির ভাবটা কাটতে দিন।”
“পড়বে বলছিস? আচ্ছা আমার বউ, ছেলে, বাপ, মা কারও নামই কেন মনে পড়ছে না বল তো! অঘোরবাবু আমাকে কী ওষুধই যে খাওয়াল।”
“আচ্ছা সনাতনবাবু, হিক সাহেব বলে কারও কথা আপনার মনে আছে?”
“থাকবে না কেন? সকালে তো এই ঘরেই দেখেছি। তোকে চুপি-চুপি বলে রাখি, ওই হিক সাহেব কিন্তু আস্ত ব্ৰহ্মদত্যি।”
“বটে। কিরকম ব্যাপার বলুন তো?”
সনাতন চারদিকটা চেয়ে দেখে নিয়ে বলল, “ও মনিষ্যি নয় রে।”
“তা হলে কী?”
“বললুম না, ব্রহ্মদত্যি বা দানো। ইয়া উঁচু চেহারা, দত্যিদানোর মতো মস্ত শরীর। দেখিসনি?”
“আজ্ঞে না। ও না দেখাই ভাল।”
“যা বলেছিস। তা হিক সাহেব কোথা থেকে আসে জানিস? আকাশ থেকে। তার মস্ত একটা কৌটো আছে। সেই কৌটোটা যখন আকাশ থেকে নামে তখন নন্দপুরে বিনা মেঘে বিদ্যুৎ চমকায়।”
সুবুদ্ধি অবাক হয়ে বলল, “কৌটোতে কী থাকে আজ্ঞে?”
“কেন, হিক নিজেই থাকে। ব্যাটা প্রেতলোক থেকে নেমে আসে, আবার প্রেতলোকেই ফিরে যায়। বড় সাঙ্ঘাতিক লোক। ব্ৰহ্মদত্যিটার সঙ্গে মাখামাখি করেই তো অঘোর সেনের মাথাটা বিগড়োল। নইলে একটু ঘুম পাড়াবার জন্য কেউ পাঁচ হাজার টাকা কবুল করে? হেঃ হেঃ হেঃ… কিন্তু তোকে এসব কথা বলছি কেন বল তো! তুই ব্যাটা আসলে কে? দেখে তো মনে হচ্ছে, এই মাত্র খেতে নিড়েন দিয়ে এলি।”
“আজ্ঞে ওরকমই কিছু ধরে নিন। এবার একটু জোর পাচ্ছেন শরীরে?”
“পাচ্ছি।”
“তা হলে এবার পা তুলতে হচ্ছে কর্তা। এই গর্তের ভেতর থেকে এবার না বেরোলেই নয়। কাজটা শক্ত হবে।”
সনাতন একটু হাঁটাহাঁটি করল নিজের পায়েই। একটু টালমাটাল হচ্ছিল বটে। কিন্তু কয়েকবারের চেষ্টায় পেরেও গেল। বলল, “কিন্তু অঘোরবাবু টাকাটা তো এখনও দিল না? গেল কোন চুলোয়?”
সুবুদ্ধি দেখে নিয়েছে এখান থেকে বেরনোর ওই একটাই পথ, যেটা দিয়ে সে নেমে এসেছে। ভরসা এই যে, এ ঘরে দূরদর্শী অঘোরবাবু শাবল টাবলের জোগাড় রেখেছেন, ভবিষ্যতে দরকার হতে পারে ভেবেই। নইলে, ল্যাবরেটরিতে শাবল থাকার কথা নয়। একটা টেবিল থেকে শিশি বোতল সরিয়ে সেটাকে দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করাল সুবুদ্ধি। তার ওপরে সনাতনের বাক্সটাও রাখল। তারপর দরজার ফোকরটা নাগাল পেতে কোনও কষ্টই হল না।
সনাতন হাঁ করে কাণ্ডটা দেখছিল। বলল, “সিঁড়িটা ছিল যে! সেটার কী হল?”
সুবুদ্ধি বলল, “সিঁড়ি! আজ্ঞে সে আমি জানি না। চলে আসুন। এখন মেলা গা ঘামাতে হবে।”
সনাতনকে দরজার চৌকাঠে দাঁড় করিয়ে সুবুদ্ধি খুব সাবধানে শাবল দিয়ে ওপরকার মাটি সরাতে লাগল। একটু অসাবধান হলেই ওপর থেকে হুড়মুড় করে মাটির চাপড়া ঘাড়ে এসে পড়বে। তবে এসব কাজে সে খুব পাকা লোক। মাটি সরিয়ে সরিয়ে একটু একটু করে একটা ফোকর তৈরি করতে লাগল।
সনাতন ভারী বিরক্ত হয়ে বলল, “এসব কী ব্যাপার রে বাপু বল তো! এই তো কালকেও দিব্যি ফটফটে সিঁড়ি ছিল, এখানে! সেটা মাটি-চাপা পড়ল কীভাবে? ভূমিকম্প-টল্প কিছু হয়ে গেল নাকি?”
“ভূমিকম্পই বটে। দেড়শো বছরের পাল্লা তো চাট্টিখানি কথা নয়।”
সনাতন চটে বলল, “বারবার দেড়শো বছর দেড়শো বছর কী বলছিস বল তো! তুই কি পাগল নাকি রে?”
“পাগল তো ছিলুম না কতা, তবে এখন যেন একটু-একটু হতে লেগেছি। এমন অশৈলী কাণ্ড জীবনে দেখিনি কি না।”
“একটা কথা কিন্তু তোকে সটান বলে রাখছি বাপু, সেই পাঁচটি হাজার টাকা কিন্তু আমার চাই। অঘোর সেন কোথায় পিটটান দিল জানি না। তাকে না পেলে তোর কাছ থেকেই আদায় করব।”
“টাকা টাকা করে হেদিয়ে মরবেন না সনাতনবাবু। আগে তো গর্ভগৃহ থেকে বেরোন, তারপর টাকার কথা হবেখন।”
“মঙ্গলবার আমার জমির টাকা দিতে হবে, মনে থাকে যেন।”
“কত মঙ্গলবার এল আর গেল। মঙ্গলবারের অভাব কী? মেলা মঙ্গলবার পাবেন।”
সুবুদ্ধি খুব ধীরে-ধীরে মাটির চাঙড় ভাঙতে লাগল।
ধীরে-ধীরে ওপরের দিকটা উন্মুক্ত হচ্ছে। সেই গুণ্ডাটা কি ওপরে ওত পেতে আছে? থাকলেও চিন্তা নেই। সুবদ্ধির হাতে এখন শাবল। দরকার হলে শাবলের খোঁচায় ব্যাটাকে কাবু করা যাবে।
শেষ চাঙড়টা ধপাস করে ভেঙে ওপর থেকে ঝুরঝুর করে খানিক বালি আর সিমেন্টের গুঁড়ো ঝরে পড়ল। সুবুদ্ধি চোখ ঢেকে রেখেছিল। ধুলোবালি সরে যেতেই দেখতে পেল, ওপরে গর্তের মুখে ভোরের আবছা আলো দেখা যাচ্ছে। সুবুদ্ধি হাত নীচের দিকে বাড়িয়ে বলল, “আসুন সনাতনবাবু।”