ওই যেখানে শিরীষ গাছে
ঝুরু-ঝুরু কচি পাতার নাচে
ঘাসের ‘ পরে ছায়াখানি কাঁপায় থরথর
ঝরা ফুলের গন্ধে ভরভর —
ওই খানে মোর পোষা হরিণ চরত আপন মনে
হেনা-বেড়ার কোণে
শীতের রোদে সারা সকালবেলা ।
তার ই সঙ্গে করত খেলা
পাহাড়-থেকে-আনা
ঘন রাঙা রোঁয়ায় ঢাকা একটি কুকুর – ছানা ।
যেন তারা দুই বিদেশের দুটি ছেলে
মিলেছে এক পাঠশালাতে , একসাথে তাই বেড়ায় হেসে খেলে ।
হাটের দিনে পথের কত লোকে
বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে যেত , দেখত অবাক-চোখে ।
ফাগুন মাসে জাগল পাগল দখিন হাওয়া ,
শিউরে ওঠে আকাশ যেন কোন্ প্রেমিকের রঙিন-চিঠি-পাওয়া ।
শালের বনে ফুলের মাতন হল শুরু ,
পাতায় পাতায় ঘাসে ঘাসে লাগল কাঁপন দুরুদুরু ।
হরিণ যে কার উদাস-করা বাণী
হঠাৎ কখন শুনতে পেলে আমরা তা কি জানি ।
তাই যে কালো চোখের কোণে
চাউনি তাহার উতল হল অকারণে ;
তাই সে থেকে থেকে
হঠাৎ আপন ছায়া দেখে
চমকে দাঁড়ায় বেঁকে ।
একদা এক বিকালবেলায়
আমলকীবন অধীর যখন ঝিকিমিকি আলোর খেলায় ,
তপ্ত হাওয়া ব্যথিয়ে ওঠে আমের বোলের বাসে ,
মাঠের পরে মাঠ হয়ে পার ছুটল হরিণ নিরুদ্দেশের আশে ।
সম্মুখে তার জীবনমরণ সকল একাকার ,
অজানিতের ভয় কিছু নেই আর ।
ভেবেছিলেম , আঁধার হলে পরে
ফিরবে ঘরে
চেনা হাতের আদর পাবার তরে ।
কুকুর – ছানা বারে বারে এসে
কাছে ঘেঁষে ঘেঁষে
কেঁদে-কেঁদে চোখের চাওয়ায় শুধায় জনে জনে ,
‘ কোথায় গেল , কোথায় গেল , কেন তারে না দেখি অঙ্গনে । ‘
আহার ত্যেজে বেড়ায় সে যে , এল না তার সাথি ।
আঁধার হল , জ্বলল ঘরে বাতি ;
উঠল তারা ; মাঠে-মাঠে নামল নীরব রাতি ।
আতুর চোখের প্রশ্ন নিয়ে ফেরে কুকুর বাইরে ঘরে ,
‘ নাই সে কেন , যায় কেন সে , কাহার তরে । ‘
কেন যে তা সে-ই কি জানে । গেছে সে যার ডাকে
কোনো কালে দেখে নাই যে তাকে ।
আকাশ হতে , আলোক হতে , নতুন পাতার কাঁচা সবুজ হতে
দিশাহারা দখিন হাওয়ার স্রোতে
রক্তে তাহার কেমন এলোমেলো
কিসের খবর এল ।
বুকে যে তার বাজল বাঁশি বহুযুগের ফাগুন-দিনের সুরে —
কোথায় অনেক দূরে
রয়েছে তার আপন চেয়ে আরো আপন জন ।
তারেই অন্বেষণ ।
জন্ম হতে আছে যেন মর্মে তারি লেগে ,
আছে যেন ছুটে চলার বেগে ,
আছে যেন চল-চপল চোখের কোণে জেগে ।
কোনো কালে চেনে নাই সে যারে
সেই তো তাহার চেনাশোনার খেলাধুলা ঘোচায় একেবারে ।
আঁধার তারে ডাক দিয়েছে কেঁদে ,
আলোক তারে রাখল না আর বেঁধে ।