লক্ষ্মীপুজো
০৯.
আগামীকাল লক্ষ্মীপুজো। আজ-ই সকালে কর্বুরের কাকু কুরুবক, কাকি এবং কিরি পৌঁছেছে। বাগানের মধ্যে ঠাকুরদালান। দুর্গাপুজোর আগে থাকতেই ঝকঝক তকতক হয়েছে। পেতল । তামার সব জিনিস পালিশ করার জন্যে বাইরে থেকে এনে লোক লাগানো হয়েছে। বারান্দার কার্নিশে লাগানো আংটা থেকে ঝোলানো রট-আয়রনের ফ্রেম থেকে অর্কিড ও সিজন ফ্লাওয়ার ঝোলানো হয়েছে। পিদিমদানিতে রেড়ির তেল আর সলতে পড়েছে। শ্যাণ্ডেলিয়ার এর সব কটি বালব পরীক্ষা করে দেখে, খারাপ বালব বদল করা হয়েছে।
বাড়িতে দুর্গাপুজোই হয় না। অন্য সব পুজোই হয়, যথা–লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, সরস্বতী পুজো, বিশ্বকর্মা পুজো হয় খাদানে খুব জাঁকজমক করে।
কালকে বড়োবিল বড়োজামদা থেকে অনেকেই আসবেন। জামশেদপুর থেকেও কাকার ঘনিষ্ঠরা আসবেন অনেকে। তাঁরা গেস্টকটেজ-এ থাকবেন। এবারে পুজো অক্টোবরের মাঝামাঝি পড়েছিল। তাই গরম একেবারেই নেই। এবারে লক্ষ্মীপুজো রবিবারে পড়েছে তাই আজ শনিবার বলে কাকুরা সকালেই এসে পড়তে পেরেছে, অন্যান্য বছর লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন রাতে আসে।
শিখীও এসেছে বড়োজামদা থেকে। জটাদা, পচাদা, গোয়েল সবাই আসবে কাল। লক্ষ্মীপুজোর ভোগ হয় টাটিঝারিয়াতে ভুনিখিচুড়ি, বাদাম, কিশমিশ, কড়াইশুটি দেওয়া, আর কড়াইশুটির চপ। আলু ও বেগুন ভাজা। যাঁরা ভাত খান না রাতে, তাঁদের জন্যে লুচি এবং ধোকা এবং ছানার তরকারি। মিষ্টি দু-তিনরকম তো থাকেই।
আজকের মতো কাজকর্ম সব সামলে নিয়েছেন মা-কাকিমারা কাজের লোকজনের সাহায্যে। প্রসাদের জোগাড় করতে হবে সকাল থেকে। বড়োবিলের বড়োজামদার অনেকে আসবেন, মেয়েরা। অপাদিও আসবেন। আজও এসেছেন অপাদি। সর্বগুণসম্পন্না মহিলা। স্বামীহারা হয়েছেন গতবছর। মা-কাকিমার বন্ধু বিশেষ। এখন ওরা কর্বুরের লাইব্রেরি-ঘরের সামনের বারান্দাতে বসে আছে। মা, বাবা, কাকু, কাকি, অপাদি, শিখী, কবু। কিরি, ফটকার সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলছে বাংলার সামনের দিকে লনে, আলো জ্বেলে। এদিকের আলো সব নিভোনো। কাল কোজাগরি পূর্ণিমা। শুক্লা চতুর্দশীর চাঁদের আলোতে চরাচর ভেসে যাচ্ছে। আকাশময় তারারা উজ্জ্বল হয়েছে। এ বছর খুব বৃষ্টি হওয়াতে শরতের রূপ অনবদ্য হয়েছে। বাগান থেকে নানা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। তারসঙ্গে যুক্ত হয়েছে মা, কাকিমা, অপাদি ও শিখীর মাখা সুগন্ধ। মা-কাকিমার পাউডার বা সাবান বা পারফিউমের গন্ধ চেনে কর্বুর। চেনে অনাত্মীয়াদের সুগন্ধ। যেমন গৈরিকা, ঐশিকা, শিখী বা অপাদির। মেয়েরা চান করে উঠে পাটভাঙা শাড়ি পরলে তাঁদের কাছে গেলেই ভালো লাগায় মরে যায় কর্বুর সেই ছেলেবেলা থেকেই।
চাঁদের আলোতে দেখলে চেনা মানুষকেও অচেনা মনে হয়। যেমন অন্ধকারেও হয়। অসুন্দরকেও চাঁদের আলোতে সুন্দর বলে মনে হয়, অগায়ককে গায়ক বলে। মন্টিকাকা, করুণাজ্যাঠাও এসেছেন জেঠিমা ও কাকিমাদের নিয়ে।
বাবা বললেন, একটা গান শোনা তো কবু। অনেকদিন তোর গান শুনি না।
মা বললেন, কবু তো গাইবেই কিন্তু অপাকে তো পাওয়া যায় না। অপার গান-ই আগে শুনি। সেই লক্ষ্মীবন্দনার গানটা শোনাও তো অপা।
অপাদির অন্য দশজন মহিলার মতো গানের ব্যাপারে কোনো ন্যাকামি নেই। বলামাত্রই গান করেন উনি। অপাদি ধরে দিলেন, এসো সোনার বরণ রানি গো, এসো শঙ্খকমল করে/ এসো মা লক্ষ্মী, বসো মা লক্ষ্মী, থাকো মা লক্ষ্মী ঘরে।
বড়ো ভালো গানটি। গান শেষ হতে না হতেই কোথা থেকে একটি লক্ষ্মীপেঁচা এসে বসল তো বসল বড়ো স্থলপদ্ম গাছটার-ই ওপর। একটা চাপা গুঞ্জন উঠল সমবেত পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে। কিছুক্ষণ থেকে, পেঁচাটা উড়ে গেল।
করুণাজ্যাঠা বললেন, কত ষড়যন্ত্র করে আমার বাড়ির বাগানে একবারও একে আনতে পারলাম না আর দেখ গপা-আর কুরু তোদের বাগানেই সে উড়ে এল। দেবতারাও যদি তেলা মাথাতে তেল দেন তাহলে আমরা যাই কোথায়? আরও ধনাগম হবে অচিরে। অতিউত্তম।
সকলেই হেসে উঠলেন।
কবু চুপ করে রইল। কাকি একবার চাইল কর্বুর দিকে, অন্যদিকে চেয়ে থেকেও বুঝতে পারল কবু।
করুণাজেঠিমা বললেন, শিখী, তুই একটা নিধুবাবুর গান শোনা।
-গলাটা আজ ভালো নেই।
বলল, শিখী।
মা বললেন, জানি তো। তবু গা, দিদি বলছেন।
শিখী ধরল, কী করে কলঙ্কে যদি সে আমারে ভালোবাসে/আমি যাতনা বাঁধা সদা সে পড়িল সেই ফাঁসে।
কবু গান শুনতে শুনতে কুমডিতে চলে গেল মনে মনে। ঐশিকাকে দেখতে পেল কল্পনাতে তার সামনে বসে ওই গানটিই গাইছে। তফাতটা তখন-ই বুঝেছিল। তবে তফাতটা যে, এতখানি সে এখন বুঝল। ঐশিকার ক্লাস-ই আলাদা। সামাজিক, পারিবারিক পটভূমি তো একজন মানুষের জীবনে অনেকখানি। তা সকলে স্বীকার করুন আর নাই করুন। তারপরে যাকে বলে Schooling, তার ওপরেও অনেকখানি নির্ভর করে। ঐশিকা গানও গায় শিখীর চেয়ে অনেক-ই ভালো। তা ছাড়া, যে-কথাটা সে কারওকেই বলতে পারেনি কিন্তু নিজে একদিন অনুক্ষণ অনুভব করেছে তা হল, ঐশিকার কাছে গেলেই ও যেমন শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করেছে, তেমন মহড়া দিতে দিতে শিখীর এত কাছে গতদেড়মাস ধরে থেকেও করেনি। ঠিক এইরকম শারীরিক অনুভূতি ওর জীবনে অন্য কোনো নারীর সম্বন্ধেই হয়নি।
গান শেষ হলে, সকলে নানা কথা বলছিলেন। কর্বুরের কানে কিছুই যাচ্ছিল না। ওর দু চোখের সামনে ঐশিকার খোলা চুলের সুগন্ধি মেঘ, ওর কানে তার বুদ্ধিদীপ্ত সরস কথোপকথন, ওর নাকে সেই ফিরদৌস আতরের গন্ধ।
বুলকু চাটুজ্যে অর্থাৎ ঐশিকাদের দাদু, মায়ের বাবা কী করতেন জানে না কর্বুর। সত্যিই তিনি কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি এক এক নাতনির জন্যে রেখে গেছেন কি না তাও জানে না, জানতে চায় না। তবে ঐশিকা গৈরিকার বাবা ব্যানার্জিসাহেব একজন গ্রেট লোক সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। কথায় কথায় তাঁর সেটা মন্দ হয় না বাক্যবন্ধটি ভোলবার নয়। মানুষটা, ছুটিতে এসে নিজেকে কী করে আনওয়াই করতে হয়, তা জানেন। আর মেয়েরা যদি রসবোধ পেয়ে থাকে, তো বাবার কাছ থেকেই পেয়েছে।
চলে যাওয়ার পর ওদের আর কোনো খবর পায়নি। কারওকে জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা করেছে। ও তো খাদান থেকে ফিরেছে মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে। কাকু-কাকির সঙ্গে কথা হওয়ার তেমন সুযোগও হয়নি।
করুণা হঠাৎ বললেন, আরে বুলকু চাটুজ্যে চলে গেল। জানো গপা?
বাবা বললেন, কে বুলকু চাটুজ্যে?
আরে বি কে চ্যাটার্জি। কলিয়ারি কিং ছিলেন। তা ছাড়া, মস্ত বড়ড়া স্টিভেডর। কত শত কোটি টাকার মালিক তা ঈশ্বর-ই জানেন। কিন্তু সকালে তার নাম করলেই হাঁড়ি ফাটে এমন ই বদনাম ছিল তার।
বাবা হয়তো চিনতেন।
কর্বুর বাবা বললেন।
গর্জন কাকা তো অবশ্যই চিনতেন। মিত্র এস কের এস কে মিত্র, কোডারমার, ক্রিশ্চান মাইকা কোম্পানির রামকুমার আগরওয়ালা আর তার ভাইয়েরাও ভালো করে চিনতেন। তবে, মানুষটা অনেস্ট ওয়েতে পয়সা করেছিল। করলে কী হয়, ওয়ান-পাইস-ফাদার-মাদার। সারাজীবন সবাইকে টাইট করে দিতে দিতে কখন যে, প্যাঁচ-ই কেটে যায় তা তো বোঝা যায় না। তাকে টাইট দিয়েছিল তার একমাত্র মেয়ের জামাই।
তারপরেই কী মনে পড়তে বললেন, কুরুবক কোথায়? তুমি চেন না? শোনোনি বুলকু চাটুজ্যের কথা?
-না তো!
কর্বুর সব শুনেও চুপ করেছিল।
জেঠু বললেন, টাটাতে তোমার যে বস গো, সেই তো বুলকু চ্যাটার্জির জামাই।
-ব্যানার্জিসাহেব! না, না, তাঁর স্ত্রী তো কবেই চলে গেছেন!
-হ্যাঁ। সে তো জানিই। মেয়ে দুটিকেও হিরের টুকরো করে তুলেছে, বুলকু চাটুজ্যের কোনোরকম কথাই না শুনে। সে চেয়েছিল দুই সুন্দরী নাতনির জন্যে দুটি ঘরজামাই নিয়ে আসে। দুটিকেই আঠারো-উনিশেই বিয়ে দিতে চেয়েছিল। যা রেখে যাবেন তা তো চারপুরুষ বসে খেলেও পাঁচপুরুষের জন্যেও থাকবে কিছু। কিন্তু ঘোলা বাঁড়ুজ্যে অন্য চরিত্রের মানুষ। সে তার শ্বশুরমশাইয়ের কোনো প্রভাব-ই মেয়েদের ওপরে পড়তে দেয়নি। তবে যাওয়া আসা ছিল। বুড়োর চোখের মণি ছিল ওই দুই নাতনি। নাতনিরাও দাদুকে ভালোই বাসত কিন্তু তাদের আপব্রিঙ্গিং নিজে হাতে করেছে। ঘোঁলা বাড়জ্যের মতো চরিত্র আমি বেশি দেখিনি।
কর্বুর জিজ্ঞেস করল ক্ষৌণিশ ব্যানার্জির ডাকনাম বুঝি ঘোলা?
–তা নইলে আর বলচি কার কথা। ডাঁটিয়াল।
তাঁর প্রয়োজন-ই বা কী? তাঁর টেক হোম পে কত জানেন করুণাদা? রুসি মোদীর সঙ্গে বনত না। সে চলে যাওয়াতে এখন ব্যানার্জিসাহেবকে আটকাবার কেউই নেই। তাঁর পয়সাই কে খায় তার ঠিক নেই! মেয়ে দুটিও তো হাইলি কোয়ালিফায়েড। তারাও বাবার পয়সার প্রত্যাশা করে না।
–তোমাদের কোনোই ধারণা নেই কুরু, বুলকু চ্যাটার্জি কী পরিমাণ ধনী।
মন্টিকাকা প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বললেন, ব্যাপারটা জমেছে ভালোই। লক্ষ্মীপুজোর রাতে লক্ষ্মীপেঁচা আর ধন-দৌলতের আলোচনাই তো সঠিক বিষয় আলোচনার। এদিকে চা-ও তো এসে গেল। কর্বুর গান কি আজ শোনা হবে না?
মন্টিকাকার একটি কন্যা আছে, নিবেদিতা, সে মোটেই সুবিধের নয়। সুবিধের নয় মানে–চেহারা, ছবি ভালোই কিন্তু একেবারে পুলিশ সার্জেন্ট। কর্বুরের ওপরে মন্টিকাকার যে নজর আছে, তা সে অনেকদিন-ই আঁচ করেছে। তবে সুখের বিষয় এই যে, মা। মন্টিকাকিমাকে একেবারে পছন্দ করেন না। সেইটিই কর্বুরের রক্ষাকবচ।
কর্বুর বলল, আজ সকাল থেকেই আমার গলাতে ভীষণ ব্যথা। তা ছাড়া ইণ্ডিকার এ.সি. টাএত এফেক্টিভ, আগে বুঝতে পারিনি, গলা একেবারে ধরে গেছে। ধরে রয়েছে।
–তাহলে আর কী? চা খেয়ে আমরা একে একে উঠি। কালকে বাড়ির পুজো সেরে এখানে আসব খিচুড়ি খেতে।
নিশ্চয়ই আসবেন।
কর্বুরের মা বললেন, শর্বাণী আর মেয়েকেও নিয়ে আসবেন।
নিশ্চয়ই আনব।
মন্টিকাকা বললেন।
একে একে সবাই-ই উঠলেন। কর্বুরও উঠে সকলকে টাটিঝারিয়ার গেট অবধি পৌঁছে দিল। কর্বুরের বাবা ছেলেবেলা থেকেই শিখিয়েছেন এটি। উনি বলতেন, কেউ কারও বাড়িতে খেতে আসেন না। একটু আদর-যত্ন, আসুন-বসুন, একটু আপ্যায়নের জন্যেই আসেন। প্রত্যেককে বাইরের গেট অবধি পৌঁছে দেবে।
কর্বুর শিখীকে বলল, তুমি যাবে কীসে? কাকাবাবু নিতে আসবেন?
-না। আমি অটোতে চলে যাব।
–রাতের বেলা অটোতে যাবে কী? চলো আমিই ছেড়ে দিয়ে আসছি।
পাশে দাঁড়ানো কাকি বলল, তোমার সঙ্গে আমার দরকার আছে কবু। তোমার কাকাকে বলো, নয়তো একজন ড্রাইভারকে বললা-না। সবাই তো গুলতানি করছে সারভেন্টস কোয়ার্টারে।
এমন সময়ে একটা লাল-রঙা মারুতি এসে দাঁড়াল গেট-এ।
কর্বুর বলল, আরে রহমত খাঁ। তোমার হাতে বাজবাহাদুরের রূপমতাঁকে এই রাতের বেলা ছেড়ে দেওয়া কি নিরাপদ হবে? আকাশে এমন চাঁদ, বাতাসে এমন গন্ধ।
–সেইজন্যেই তো হবে কবু দাদা।
গোয়েল বলল।
-তব ঠিক হ্যায়। সামহালকে লে যানা রূপমতীকো।
–বিলকুল। আপ বে-ফিক্কর রহিয়ে।
–আচ্ছা শিখী, আবার এসো। তোমার দেওয়া বইটা পড়েছি। খুব ভালো বই। আর আজ তো গানটি শুনলাম-ই। কী আর বলব! ধন্যবাদ দিয়ে তোমাকে ছোটো করব না।
–চলি কবুদা। একদিন সময় করে এসো-না আমাদের বাড়িতে। গানবাজনা হবে।
শিখী বলল।
–আমাকেও বলবে তো?
গোয়েল বলল।
–তোমাকে না বললে আমি যাবই না।
কর্বুর বলল।
শিখী কিছু না বলে, কর্বুরের খুলে দেওয়া দরজা দিয়ে সামনের বাঁ-দিকের সিট-এ গিয়ে বসল।
-চলো দাদা।
-হ্যাঁ। সামহালকে যা না।
সবাই চলে যাওয়ার পরে কর্বুর আর তার কাকি ফিরে আসছিল। ভারি ভালো লাগছে। এখন। সেই চন্দ্রাতপের নীচে এখন চাঁদের আলো আর ছায়ার সাদা-কালো বুটি-কাটা গালচে পাতা। একটি পিউ কাঁহা বাংলোর পেছনে চন্দ্রালোকিত প্রান্তরে পাগলের মতো ডাকতে ডাকতে চলে গেল।
কর্বুর জিজ্ঞেস করল, ওদের দাদুর কাজ কি হয়ে গেছে?
–হ্যাঁ কবেই তো হয়ে গেছে।
–ফিরে এসেছে ওরা জামশেদপুরে?
–হ্যাঁ। ফিরে, ঐশিকা তো চলেও গেছে দিল্লিতে। সত্যি! ওদের দাদু আর মরার সময় পেলেন না!
–দিল্লিতে কোনো টিভি কোম্পানিতে জয়েন করতে। ছ-মাস ট্রেনিং-এ থাকবে তারপর ভারতবর্ষের কোনো বড়োশহরে পোস্টিং হবে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। ভারতবর্ষের বাইরেও পাঠাতে পারে।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল কর্বুর। লক্ষ করল পদ্মা।
–আর গৈরিকা? সে কবে যাচ্ছে স্টেটস-এ?
–ঠিক জানি না। সম্ভবত সামনের মাসে।
–ওঁরা কী বললেন?
–কী সম্বন্ধে?
–আমার খিদমদগারিতে সন্তুষ্ট তো! কাকার মানহানি হয়নি তো?
–বাবা : মানহানি কী? কাকার প্রমোশন-ই হয়ে যাবে হয়তো। ব্যানার্জিসাহেব তো তোমার প্রশংসাতে পঞ্চমুখ। বারে বারে বলছেন জেম অফ আ বয়, গৈরিকাও যে কত প্রশংসা করল।
–আর অন্যজন?
–তাঁর মন ঠিক বুঝতে পারলাম না। তিনি তাঁর বাবার কথা আর দিদির কথা শুনে গেলেন। তোমার সম্বন্ধে অবশ্য বলেছেন শুধুমাত্র একটিই বাক্য।
-সেটা কী?
বলেছেন, আ ভেরি নাইস পার্সন।
–লিখে দিতে বললে না কেন কাকি? ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখতাম সার্টিফিকেটটি।
একটু রাগ-রাগ গলাতে বলল কর্বুর।
বাংলোর কাছে যখন পৌঁছেছে প্রায় ওরা, তখন বুকের ভেতর থেকে একটি খাম বার করে কাকি বলল, তিনি দিল্লি যাওয়ার আগে এই চিঠিটা দিয়ে গেছেন তোমাকে দিতে।
–খাম জুড়ে সেলোটেপ লাগিয়ে তার ওপরে আবার সই করেছেন যাতে কেউ খুলে না পড়তে পারে।
-কে খুলে পড়ত?
–আমিই পড়তে পারতাম। যার জন্যে চুরি করি, সেই বলে চোর। আমিই আলাপ করালাম, এখন আমিই পর হয়ে গেলাম।
–চিঠিটা তুমিই রাখো। তুমি পড়ে, আমাকে দেবে মনে করলে দিয়ো।
–কী লিখেছে আগে দেখো। চিঠিটা তো বড়ো নয়। প্রেমপত্র হলে বড়ো হত। তবে আতর মাখা হাত বুলিয়েছে খামের ওপরে। আঃ কী সুন্দর গন্ধ। এত পাতলা চিঠি। মনে হয় ভদ্রতার চিঠিই হবে। ওদের ভদ্রতার তো কোনো তুলনা নেই।
–হ্যাঁ।
–বিশেষ করে ব্যানার্জিসাহেবের। হি ইজ আ ফাস্ট রেট জেন্টলম্যান। কলকাতা থেকেই। লিখেছিলেন আমাকে।
আমি যাই। স্নান করব কাকি।
কর্বুর বলল।
শোনো, খেতে আসতে দেরি কোরো না। কাল খুব সকালে উঠতে হবে আমার আর দিদির। অনেক-ই কাজ। পুজোর দিন।
তারপর বলল, দরজা বন্ধ করে, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে তারপর চিঠিটা খুলে বিছানাতে শুয়ে পোড়ো৷ ইশ। ঐশিকাটা একটা থার্ডক্লাস মেয়ে। আর একটু বড়োচিঠি লিখতে পারল না।
কর্বুর বারান্দাতে উঠে তার ঘরের দিকে যেতে যেতে মনে মনে বলল, চিঠির ওজন আর চিঠির ভার তো কথা নয়। কী লিখেছে সে, দেখাই যাবে।
ঘরে গিয়ে চিঠিটাকে লেখার টেবিলের ওপরে রেখে ঘরের দরজা বন্ধ করে সে বাথরুমে গেল।
অনেক অনেকদিন পরে ঈষদুষ্ণ জলে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে স্নান করতে করতে, সাবান মাখতে মাখতে সে গুনগুনিয়ে গান গাইতে লাগল–কী করে কলঙ্কে যদি সে আমারে ভালোবাসে। তারপর আয়নার সামনে নিরাবরণ নিজেকে ভালো করে দেখল বহুদিন পর। নিজেকে দেখে ওর নিজেকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করল। মুখটা আয়নাতে অচেনা মনে হল। কে যেন উত্তেজনা মেশা লজ্জার আবির মাখিয়ে দিয়েছে তার মুখে। এ মুখকে সে আগে জানেনি। এ এক প্রেমিকের মুখ।
পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে, চুল আঁচড়ে, ব্রাইলক্রিম মেখে, ওডিকোলন গালে ঘাড়ে বুকে লাগিয়ে সত্যি সত্যিই বিছানাতে এসে শুয়ে, বুকের নীচে বালিশ দিয়ে চিঠিটা খুলল। হালকা নীল-রঙা প্যাডে বাঁ-দিকের ওপরে ইংরেজিতে ছাপা Oishika Banerjee… ঠিকানা নেই, ফোন নাম্বার নেই। তবে ডানদিকে তারিখ আছে, আর স্থান আছে। নীলডি, জামশেদপুর, বিহার।
স্যার
আমি ভালো চিঠি লিখতে পারি না। বাংলাতে তো পারিই না, যদিও সেটা গর্বের কথা নয়।
এইটুকু বলার জন্যেই এই চিঠি যে, কবু, তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। সত্যি কথা বলতে কী, এত ভালো, এর আগে, আর কারওকেই লাগেনি।
পরিযায়ী পাখির-ই মতো হয়তো একবছর পরে আবার উড়ে যাব তোমার কাছে। আমার বাঁ-পায়ের মধ্যমাতে একটা রুপোর চুটকি পরিয়ে দেওয়া তোমার উচিত ছিল। অনেক পাখির মধ্যে আমাকে যদি তখন চিনতে না পারো।
তোমার সঙ্গে আমার অনেক-ই কথা ছিল। দাদু চলে গিয়েই সব গুবলেট হয়ে গেল। আর বাপি আর একজন ডিসটার্কিং এলিমেন্ট। অথচ বাপিই যে, আমাদের সব।
আমার দিল্লির ঠিকানা, ফোন নাম্বার, ফ্যাক্স নাম্বার সব দিলাম। আমার চিঠিটা যে, পেয়েছ সেটুকুই শুধু জানাবে Fax করে। তারপরে চিঠি লিখবে। চিঠির আজও কোনো বিকল্প নেই। স্যার। এই ফ্যাক্স আর ই-মেইল-এর দিনেও।
যদি আসতে পারো, তো কবে আসবে, কোথায় উঠবে তা রেসিডেন্স-এ ফোন করে জানাবে। আমাকে রোজ-ই সকাল আটটার মধ্যে করলে পাবে।
তোমার সঙ্গে এতকথা আছে যে, তা ফোনে বা একটামাত্র চিঠিতে বলা যাবে না। অথচ কথা ক-টি খুবই জরুরি। বেশিদিন অপেক্ষা করা যাবে না।
আমার সঙ্গে তোমারও যদি কোনো কথা না থাকে, তাহলে এসো না।
আসছ কী আসছ না, জানিয়ো। দেওয়ালির সময়ে এলে সময় দিতে পারব। ছুটি থাকবে দু-দিন। এলে খুশি হব।
ভালো থেকো।
Take care! Regards
ইতি-পরিযায়ী, ওই যা।
শ্রীকর্বুর সেন
টাটিঝারিয়া, চড়ই-চড়াই,
বড়োবিল, ওড়িশা
.
১০.
রাতে খাবার টেবিলে ওরা সকলে খেতে বসেছিল। গর্জনবাবু ওরফে গপা, কর্বুরের বাবা, খেয়ে নিয়েছেন আগেই। মা আর কাকু পাশাপাশি বসেছেন। কর্বুর আর কাকি, অন্যদিকে পাশাপাশি।
ডালের বাটিটা নিজের দিকে টেনে কবু বলল, মা, আজ দিল্লি থেকে একটা জরুরি ফ্যাক্স এসেছে। আমাকে কালীপুজোর আগে একবার দিল্লি যেতে হবে। বুঝেছ?
-ওমা! তাই?
–হ্যাঁ।
-কী কাজে যাবি?
কুরুবক জিজ্ঞেস করল।
–এক্সপোর্ট পোমোশান কাউন্সিল-এর এম.ডি. ডেকেছেন। আমাদের কোম্পানিই হয়তো অ্যাওয়ার্ডটা পেতে পারে এবারে। গুজব শুনছিলাম। ঠিক নেই অবশ্য।
–বাঃ। তাই নাকি? সব-ই ভালো খবর। এবারে লক্ষ্মীপুজো তো একেবারে জমে গেল দেখছি।
পদ্মা কর্বুরের মুখের দিকে চাইল একবার। তারপর কর্বুরকে সার্ভিংঙ্গুন দিয়ে ডাল ঢেলে দিতে দিতে বলল, খবর যখন শুভ, তখন দেরি না করাই ভালো। শুভস্য শীঘ্রম।
বলেই, টেবিলের নীচে বাঁ-হাতটা নামিয়ে কর্বুরের ঊরুতে খুবজোর চিমটি কাটল একটা পদ্মা।
উঃ।
বলে উঠল কর্বর।
মা বললেন, কী হল?
-লঙ্কা! লঙ্কা।
বলল, কর্বুর।
-সত্যি! এতবার বলি এদের, ডালে শুকনো লঙ্কা না দিতে কথা কি শুনবে এরা! মিষ্টি কিছু খা একটা। সন্দেশ খাবি?
–সন্দেশের চেয়েও মিষ্টি তোমার কাছে কিছুই কি নেই দিদি?
–কী যে হেঁয়ালি হেঁয়ালি কথা বলিস তুই আজকাল পদ্মা, বুঝি না কিছুই।
–বুঝবে দিদি, বুঝবে। আমি সব-ই বুঝিয়ে দেব।
কুরুবক চকিতে একবার পদ্মার মুখে তাকাল।
এক নিঃশব্দ হাসিতে তার মুখ ভরে উঠল।
কর্বুরের কাকি পদ্মা বলল, অ্যাওয়ার্ডটা কোম্পানি পেলে তো ভালোই। আমাদের কবুও একটা অ্যাওয়ার্ড পাবে, ইনডিভিজুয়াল পারফরমেন্সের জন্যে।
কর্বুর মা বললেন, তাই নাকি? ওঁকে বলব তো কথাটা কাল ভোরেই।
কবু কথা না বলে, মুখ নামিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে খেতে লাগল, এমনইভাবে, যেন জীবনে মুগের ডাল খায়নি কখনোই।
[এই উপন্যাসের সব চরিত্রই কাল্পনিক। উপন্যাসে উল্লিখিত কোনো চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবের কোনো চরিত্রর কোনো মিল পরিলক্ষিত হলে তা সম্পূর্ণই দুর্ঘটনাপ্রসূত বলেই জানতে হবে।]— লেখক।