পরিযায়ী
তিন তলা বাড়িটা একেবারে ফাঁকা লাগে এখন।
অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ পদস্থ সরকারি অফিসার নন্দীবাবু আর স্ত্রী শুধুমাত্র এখন এই বড় বাড়িটার বাসিন্দা।
তাঁদের একমাত্র ছেলে সৌভিক আর ছেলের বউ তৃণা অনেকদিন ধরে ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা।
দুজনেই ওখানে চাকরি করে আর একমাত্র নাতি সৌম্য ব্যাঙ্গালোরের স্কুলে পড়াশোনা করে।
সৌভিক আর তৃণা ব্যাঙ্গালোরে সেটেল্ড, ওখানে ফ্ল্যাট কিনেছে ।
কলকাতায় এখন আর ওরা স্থায়ীভাবে আসতে চায় না।
ওরা বলে কলকাতায় ভালো চাকরি বাকরির সুযোগ নেই, আর সবথেকে বড় কথা ওদের মতে এখানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের ভালো পরিবেশও নেই, আর উপার্জনের সুযোগও নেই।
ওরা বছরে দুবার আসে, তখন বাড়িটা নাতি সৌম্যর দাপাদাপিতে একটু প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, তারপর তারা ব্যাঙ্গালোরে চলে যাবার পরে আবার যে কে সেই।
সৌম্য আর তৃণা অনেকবার বলেছে বাড়িটাতে একতলায় অন্তত ভাড়া দিতে তাতে আর কিছু না হোক বাড়িতে তো কিছু লোকজন থাকবে। আর তাছাড়া বাবার আর মায়ের বয়স হচ্ছে যেকোনো সময় তাঁরা অসুস্থ হতে পারেন।
বাড়িতে লোকজন থাকলে অসুখ-বিসুখ হলে কমসে কম ডাক্তারবাবুর চেম্বারে বা হাসপাতালে তো নিয়ে যেতে পারবে ওনাদের।
ব্যাঙ্গালোরে সেই অসুখ-বিসুখের খবর গেলে, ওখান থেকে কলকাতায় আসতেও তো বেশ সময় লাগবে।
তাই বাড়িতে ভাড়া দেওয়ার কথা বলেছে সৌভিক আর তৃণা।
কিন্তু নন্দী বাবু এত শখ করে বাড়ি করেছেন,এই বাড়ির কোন অংশের ইট ,পাথর ,টালি খারাপ হয়ে গেলে বা ভেঙ্গে গেলে তার খুব খারাপ লাগে। সেই বাড়িতে ভাড়া দেবেন ,তারা কি রকম ভাবে ব্যবহার করবে, ঠিকমতো যত্ন করবে কিনা, ঘরের, এইসব চিন্তায় নন্দীবাবু ঘর ভাড়া দিতে রাজি নন।
নন্দীবাবু আর ওনার স্ত্রী প্রায়ই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন, ‘যে কলকাতা তথা বাংলা একসময় এ রাজ্যে তো বটেই অন্য রাজ্যেরও অনেক চাকরি প্রার্থী এবং কর্মপ্রার্থীদের গন্তব্য স্থান ছিল ,সেই কলকাতা তথা বাংলার এরকম অবস্থা হয়েছে কেন?
কলকাতায় বা বাংলায় সেরকম ভাবে আইটি হাব,কল কারখানা , অফিস কাছারি হল না কেন ?
আর আগে যেসব কলকারখানার অফিস কাছারি ছিল সেগুলোও তো ক্রমে ক্রমে অন্য শহরগুলোতে চলে গেল , আর অনেক অফিস কাছারি আর কলকারখানা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। আর সেইসব বন্ধ কলকারখানার জমিতে প্রোমোটারদের তৈরি করা ছোট বড় ফ্ল্যাট, সোসাইটি লক্ষ্য, কোটি টাকা দিয়ে বিক্রি হয়েছে আর হচ্ছে।
আজ মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ, পুণে, মাদ্রাজ এমনকি ঘরের পাশে ভুবনেশ্বর পর্যন্ত যেভাবে উন্নতি করেছে, অফিস কাছারি, আইটি হাব ,কল কারখানা হয়েছে কলকাতা তার পাশে অনেক পিছিয়ে পড়েছে, কেন?
এটা কি রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব না রাজনৈতিক দলাদলি , না ট্রেড ইউনিয়নের নামে উগ্র রাজনৈতিক আন্দোলন ,না কর্মসংস্কৃতির অভাব, নাকি রাজনৈতিক ফায়দা তোলবার জন্য বড় শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার নামে তাদের এক প্রকার রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেওয়া, নাকি দুর্নীতি ,সিন্ডিকেট আর প্রতি পদে মস্তান-লুম্পেন ,দালাল , কাটমানি আর সরকারি লাল ফিতের ফাঁস , তথাকথিত রাজনৈতিক দাদা দিদিদের অত্যাচারের জন্য হয়েছে?
তবে যে যে কারণ ষগুলোর জন্যই হোক না কেন তাতে এই রাজ্যটা, এই শহরটা এবং এই রাজ্যের , এই শহরের,অধিবাসী, বিশেষ করে তরুণ তরুণী , শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীদের জন্য যে বিশাল ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে এবং কয়েকটা প্রজন্ম যে এর ফলে অনেক পিছিয়ে পড়েছে এবং পড়ছে, সে বিষয়ে তো কোন সন্দেহ নেই।
এই রাজ্যে, এই শহরে শুধু যে শিক্ষিত মানুষ চাকরি পাচ্ছে না তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী শুধু তাই তো নয়।
সঠিক পরিকাঠামো এবং কাজের অভাবে রাজমিস্ত্রি , জোগাড়ের কাজ করা মানুষ,কাঠের মিস্ত্রি ,বিউটি পার্লারে কাজ করার জন্য ,সোনার দোকানে কাজ করার জন্য কর্মচারী, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, এমনকি গৃহ কর্ম সহায়িকা, মালির কাজ, রান্নার কাজ বা আয়ার কাজ করার জন্যও অনেকেই ট্রেন বোঝাই করে এই রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে, অন্য শহরে, এইসব কাজ পাওয়ার জন্য গেছে এবং যাচ্ছে।
তার কারণ এই রাজ্যের থেকে দিল্লি, মুম্বাই ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ ,পুণে, মাদ্রাজ , ভুবনেশ্বর এইসব জায়গায় কাজের সুযোগ আর মজুরি অর্থাৎ রোজগারের সুযোগ অনেকটাই বেশি।
যারা বেশি উপার্জনের চাকরিতে আর কম সময়ের মধ্যে বা ট্রেনের টিকিট না পেয়ে ফ্লাইটে যায়, আর যারা হয়তো কম উপার্জনের কাজে বা ট্রেনের টিকিট কনফার্ম পাওয়ার জন্য ট্রেনে যায় , উভয়ের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা অনেকটা একই ,উভয়ই পরিযায়ী।
কোরোনাকালে এর ভয়ঙ্কর অন্য দিকগুলো আমরা সকলেই দেখেছি ,কমবেশি,’ বললেন নন্দীবাবু।
নন্দীবাবুর স্ত্রী বললেন, ‘আমাদের এই রাজ্যে অনেকেই তো দেখি,বিভিন্ন শ্রী আর ভান্ডার থেকে কম বেশি কিছু টাকা পেয়ে বেশ সন্তুষ্ট আছে। ‘
নন্দীবাবু বললেন,’ এইসব তো সামাজিক ও সরকারি অনুদান।
বেশিরভাগ কর্মক্ষম মানুষ সহজে আর বিনা পরিশ্রমে অনুদান চায়না, তারা চায় কাজের সুযোগ।
তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী সৎভাবে কাজ পেয়ে, কাজ করে উপার্জন করতে ,আর সেই বিষয়ে সরকারের অনেকটাই দায়িত্ব আছে।
যদি মানুষকে অন্তত তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী উপার্জনের সুযোগ দেওয়া যেত, তরুণ তরুণদের কাছে এই রাজ্যেই তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করে দিল্লি মুম্বাই ব্যাঙ্গালোর হায়দ্রাবাদ পুনে এইসব শহর গুলোর মত উপার্জনের সুযোগ থাকত তাহলে আজ হয়তো সৌভিক আর তৃণা দের মতো হাজার হাজার তরুণ তরুণীকে এইরকম পরিযায়ী হতে হতো না,আর আমাদের মতো অনেক বাবা মাকেই হয়তো প্রবীণ বয়সে এইরকম একা অসহায় হয়ে যেতে হতনা ,আমাদের এই বাড়িটার মত।’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলার পর নন্দীবাবু একগ্লাস জল খেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।