অনেক জটিল রহস্যের উন্মোচন
দ্বিতীয় স্তর
এ যাবৎ কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে থেকে অনেক জটিল রহস্যের উন্মোচন দেখেছি। কিন্তু কখনও নিজেকে জড়িয়ে ফেলিনি। আমি থেকেছি নিছক দর্শকের ভূমিকায়। কিন্তু এবার নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলাম। আসলে আমার গাড়িতে পার্স ফেলে গিয়ে চন্দ্রিকাই আমাকে যেন জড়িয়ে গেছে তার শোচনীয় মৃত্যুর সঙ্গে।
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ডার্লিং! আমার ধারণা, তোমার মগজে প্রচুর পরগাছা গজাতে শুরু করেছে। উপড়ে ফেলো।
হাসবার চেষ্টা করে বললাম, ওপড়ানো শক্ত। মাথা ঝিমঝিম করছে।
বরং ছাদে গিয়ে বসবে চলো। আমার ছাদের বাগানটিকে হালদারমশাই শুন্যোদ্যান নাম দিয়েছে। শুন্যোদ্যানে কিছুক্ষণ কাটালে মগজ শূন্য হবে। ওপরে বিশাল আকাশ। ওঠো!
বাড়িতে থাকলে কর্নেল তার ছাদের বাগানে দুবেলা কাটান। অদ্ভুত কিম্ভুত সব উদ্ভিদের পরিচর্যা করেন। উনি যখন থাকেন না, তখন কাজটা ষষ্ঠী চমৎকারভাবে করে। সে বলে, আমি গাঁ-গেরামের মানুষ দাদাবাবু। শউরে হওয়া আমার উচিত নয়। ভাগ্যিস বাবামশাই ছাদে বাগানখানা বাইনেছিলেন। পেরানটা শান্ত হয় সেখানে ঢুকলে। ষষ্ঠী গ্রামের মানুষ বলেই গাছপালার প্রতি ওর হয়তো নাড়ির টান।
সে কফির পেয়ালা নিতে এসে বলল, আপনারা বেরুবেন নাকি?
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বেরুব।
তাইলে আপনাদের শীগগির বেরুলেই ভাল হয়। সাড়ে চারটে বাজে। বাগানে জল দিতে হবে। নেট হয়ে যাচ্ছে।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, নেট হলেও ক্ষতি নেই। গতরাত্রে খুব বৃষ্টি হয়েছে।
তবু–
ওরে হতভাগা! আমরা বাগানের দিকেই বেরুচ্ছি। কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, ঘণ্টাখানেক পরে আবার কফি চাই কিন্তু।
ওপরে গিয়ে শেডের তলা থেকে খুরপি আর কিসের একটা প্যাকেট নিলেন কর্নেল। আমি একটা বেতের চেয়ার নিয়ে গিয়ে ভোলা জায়গায় বসলাম। চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটের পাশে ছাদের বাগানটার কথা মনে পড়ে গেল। ওলসন হাউসের ছাদে ওই বাগানটা কি চন্দ্রিকাই করেছিল? প্রশ্নটা না করে পারলাম না।
কর্নেল একটা বিদঘুঁটে গড়নের ক্যাকটাসের কাছে হাঁটু দুমড়ে বসলেন। বললেন, চন্দ্রিকা এখনও তোমার পিছু ছাড়েনি দেখছি।
একটু চটে গিয়ে বললাম, কী আশ্চর্য! আপনার ছাদের বাগানে এসে ওই বাগানটার মনে পড়া কি স্বাভাবিক নয়?
স্বাভাবিক। কর্নেল গর্বিত ভঙ্গিতে বললেন, তাই বলে আমার বাগানের সঙ্গে তুলনা কোরো না! জয়ন্ত! এখানে পৃথিবীর কত দুর্গম অঞ্চল থেকে আনা বিচিত্র সব প্ল্যান্ট আছে তুমি তো ভালই জানো। যাই হোক, কলকাতার একটা সুন্দর বিকেলকে খুনখারাপির ভাবনা দিয়ে নোংরা কোরো না।
সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ টানতে থাকলাম। কিন্তু বারবার গতরাতের দৃশ্যটা ভেসে উঠে আমাকে উত্তেজিত করছিল। কলগার্ল হোক, মানুষ তো! কে তাকে অমন নৃশংসভাবে খুন করল? এ খুনের উদ্দেশ্য কী?
আগাগোড়া কাহিনীর আকারে ঘটনাগুলো পর-পর সাজানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু বারবার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। কোনও পূর্ণাবয়ব পারম্পর্যময় কাহিনী গড়ে তোলা অসম্ভব মনে হচ্ছিল। শুধু একটা ব্যাপার স্পষ্ট, চন্দ্রিকার পার্সে লুকোনো চিরকুটে লেখা কথাগুলো যদি কোনও রহস্যময় কোড হয়, সেটাই তার মৃত্যুর একমাত্র কারণ। ডিস্কোর পাঠানো লোকটাকে গুলি করে মেরে খুনী চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটের চাবি হাতিয়েছিল। তারপর চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটে এসে তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়েছে। চন্দ্রিকা চিৎকার করে কারও সাহায্য চায়নি কেন? খুনী তার চেনা লোক কি না, এ-ও একটা পয়েন্ট। তবে এখন মনে হচ্ছে, ওই চিরকুটটা হাতানোই তার উদ্দেশ্য ছিল।
ষষ্ঠী কফি এনেছিল।-কফি খেতে খেতে আবার চিন্তাগুলো ফিরে এসেছিল। আবার এলোমেলো ঘটনার ঝড় আমাকে অস্থির করে ফেলল। হঠাৎ একটা পয়েন্ট মাথায় এসে গেল। খুনী থিয়েটার থেকে চন্দ্রিকাকে বৃষ্টির মধ্যে অনুসরণ করে এসে বাড়ির কাছাকাছি অপেক্ষা করছিল কি? তা হলে আমার গাড়ির পিছনে তার গাড়ি ছিল। তারপর সম্ভবত আড়ি পেতে সে সব শোনে এবং ডিস্কোর পাঠানো লোকটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। লোডশেডিং এবং বৃষ্টি তার সুযোগ করে দিয়েছিল। স্পষ্ট দেখা যায়, বর্ষাতিপরা একটা লোক। তার গাড়ি আছে।
প্রশ্নটা কর্নেলের কাছে তুললাম। উনি সেই কাগজের প্যাকেট থেকে একটা ফুলগাছের গোড়ায় কিছু ছড়াচ্ছিলেন। আমার কথা শুনে আবাক চোখে তাকালেন। কি সর্বনাশ! তুমি মারা পড়বে দেখছি। না–তার মানে, তুমি পাগল হয়ে যাবে বলতে চাইছি। সাবধান ডার্লিং! কক্ষনো রহস্য নিয়ে ছেলেখেলা করতে নাই।
ছেলেখেলা কেন বলছেন?
হ্যাঁ। রহস্য নিয়ে অহেতুক চিন্তাভাবনা করাটাই ছেলেখেলা। রহস্য ফর্দাফাঁই করতে হলে অবশ্য একটা থিওরি গড়ে তোলা দরকার। তারপর তথ্য হাতড়াতে হয়। তথ্য থিওরির সঙ্গে না মিললে নতুন থিওরি গড়ো। কিন্তু তোমার কোনও থিওরিই নেই। আছে শুধু বিক্ষিপ্ত কিছু তথ্যকে কেন্দ্র করে গড়া নিছক একটুকরো ধারনা। অথচ একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবে, আমাদের সামনে একটা বিশাল কালো পর্দা টাঙানো। পর্দার আড়ালে অনেক কিছু ঘটছে। কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কর্নেল খুরপি রাখতে গেলেন শেডে। আপাতত কোনও থিওরি গড়ে তোলা অসম্ভব, জয়ন্ত। তাই এই কেসে আমি শুধু তথ্য আর ঘটনার দিকে লক্ষ্য খছি। যাই হোক, একটু পরে আমরা বাইরে বেরুব। আরও তথ্য পেতে চাই বলেই প্রচুর ছোটাছুটি করতে হবে। তোমার মতিগতিথেকে বুঝেছি, তুমি তাতে পিছপা নও।
কর্নেল তাঁর জোরালো অট্টহাসিটি হাসলেন।
সাড়ে ছটা বাজে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, কোথায় যাবেন বলুন?
শ্যামবাজার এরিয়ায়।
চন্দ্রিকার সেই অ্যাডভোকেটের কাছে নাকি?
হ্যাঁ।
ওর কার্ডটা আপনি রেখে দিয়েছেন তা হলে?
নাহ। টুকে রেখেছি ঠিকানাটা। সার্কুলার রোডে পৌঁছলে কর্নেল ফের বললেন, ঠিকানাটা ডিস্কোরও দরকার হয় কি না জানতে চেয়েছি। তাই কার্ডটা পার্সেই রেখেছিলাম।
সারা পথ ট্রাফিক জ্যাম। কর্নেলের কাছে কলকাতার অলিগলি প্রায় যাকে বলা চলে নখদর্পণে। পাঁচমাথার মোড় পেরিয়ে বাগবাজারে, তারপর কর্নেলের নির্দেশে একটা গলি-রাস্তায় ঢুকলাম। তখন সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। গলিটায় কোনওক্রমে দুটো গাড়ি পরস্পরকে পেরিয়ে যেতে পারে। একটা লোক অলক সেনগুপ্তের বাড়ি দেখিয়ে দিল। এমন এঁদো গলিতে বিশাল বনেদি বাড়ি দেখে তাক লেগে গেল। গেটের অবস্থা অবশ্য ভাঙাচোরা। নামেই গেট। কোনও কপাট বা গরাদ দেওয়া আগড় নেই। সামনে একটুকরো খোলা জায়গা। সেখানে গাড়ি দাঁড় করলাম।
গাড়ি থেকে বেরুতেই সামনের বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসেদ্ধাকা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। পরনে ফতুয়া আর ধুতি। উনিশ শতকের প্রতীক বলা যায়। সিঁথি করে আঁচড়ানো চুল। হাতে একটা ছড়ি দেখতে পেলাম। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটেন মনে হলো। কর্নেল নমস্কার করলে উনি বিনীতভাবে নমস্কার করে বললেন, কোত্থেকে আসা হচ্ছে মশাইদের?
আমরা অলকবাবুর সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনিই কি—
আজ্ঞে, ঠিকই ধরেছেন। আসুন! ভেতরে আসুন।
ঘরের ভিতরে একধারে তক্তপোশের ওপর ধবধবে সাদা চাঁদরে ঢাকা গদি আর কয়েকটা তাকিয়া। কয়েকটা আলমারিতে আইনের বইপত্র ঠাসা। ঘরের অন্য অংশে অফিস ধরনের টেবিল চেয়ার পাতা। আমাদের গদি দেখিয়ে বসতে বললেন অলকবাবু। নিজে একটা চেয়ার টেনে সামনে বসলেন। মুখে অমায়িক হাসি। কর্নেল তাঁর নেমকার্ড দিলে চশমার কাছে ধরে খুঁটিয়ে পড়ে বললেন, কর্নেল নিলাদ্রি সরকার? আপনি কর্নেল?
রিটায়ার্ড।
হুঁ, তা নেচারিস্ট মানে?
প্রকৃতিচর্চা করি।
অলকবাবু সকৌতুকে হাসলেন। কিন্তু আমি তো আইনচর্চা করি কর্নেলসায়েব। প্রকৃতির সঙ্গে আইনের সম্পর্ক তো থাকার কথা নয়।
এক্ষেত্রে আছে। কর্নেলও কৌতুকের ভঙ্গিতে বললেন। রাঙাটুলি প্রকৃতির স্বর্গ। কাজেই–
অলকবাবু চমকে উঠলেন। রাঙাটুলি? রাঙাটুলির চৌধুরীবাড়িতে আমার জানাশোনা ছিল। বটুক চৌধুরী এম এল এ ছিলেন। ওঁদের ফ্যামিলির অনেক কেস আমি লড়েছি। বটুকবাবুর ছেলে রথীন খুন হয়েছিল। খামোকা রথীনের বউকে অ্যারেস্ট করল পুলিশ। রথীনের বউ আবার আমার আরেক মক্কেল হরনাথ সিংহের মাসতুতো ভাই অজয়ের মেয়ে।
চন্দ্রিকা রায়?
চেনেন নাকি? অলকবাবু আরও অবাক হয়ে গেলেন। ব্যাপারটা খুলে বললে, ভাল হয়।
বটুকবাবুর ভগ্নীপতি অমরেন্দ্র সিংহরায় আমার বন্ধু। সেই সূত্রে চন্দ্রিকাকে চিনি।
অ। কিন্তু চন্দ্রিকা তো নিখোঁজ হয়ে গেছে কবছর আগে।
জানি। আমি ওর বাবা অজয়বাবুর সম্পর্কে জানতে চাই।
অজয় তো কবে মরে গেছে। অজয়ের স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে হরনাথের কাছে উঠেছিল। হরনাথই ভুলটা করেছিল। রথীন হারামজাদার হারামজাদা। জেনেশুনে মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিয়েছিল। তো আপনি অজয় সম্পর্কে জানতে চান। অমরেন্দ্রর কাছে আমার চেয়ে ভাল জানতে পারবেন।
আপনি বলুন, প্লিজ!
অলকবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, বুঝেছি। আপনি মিলিটারিতে ছিলেন। কাজেই অজয় সম্পর্কে আপনার আগ্রহের কোনও কারণ আছে। কিন্তু সে তো সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ব্যাপার। নতুন করে এতবছর পরে ফাঁইল ধুলল কে?
কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন, সি বি আই।
হুঁ, । তা-ই বলুন। আপনারা সি বি আই অফিসার। দেখুন কর্নেলসায়েব, আমি একজন লইয়ার। কাজেই আই মাস্ট কোঅপারেট উইদ ইউ। অজয় সম্পর্কে আমি যেটুকু জানি, তা আমার মক্কেল হরনাথের সূত্রেই জানি। অজয় রাঙাটুলির মিলিটারি বেসে কন্ট্রাক্টর ছিল। পরে কী কারণে নাকি কন্ট্রাক্টারি যায়। জেল খাটতেও হয়েছিল। শুনেছি জেলে থাকা অবস্থাতেই সে মারা পড়ে।
অজয়বাবুর স্ত্রী বেঁচে আছেন কি?
নাহ্। সে কবেকার কথা। চন্দ্রিকা তখন বাচ্চা মেয়ে। এখন চন্দ্রিকার বয়স বোধ করি পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। বেশিও হতে পারে।
হ্যাঁ। বেবিফেস যাকে বলে। বয়স বোঝা যায় না। কর্নেল একটু হেসে বললেন, চন্দ্রিকার হয়ে আপনি কলকাতায় মামলা লড়েছিলেন। তার মানে রথীনবাবু খুন হয়েছিলেন কলকাতায়?
ঠিক বলেছেন। বেহালায় রথীন থাকত। শুনেছি, অমরবাবুর ছেলেও বেহালায় থাকত। পাশাপাশি বাড়িতে থাকত ওরা। তো সি বি আইয়ের কেসটা কিসের কর্নেল সায়েব?
অজয়বাবুকে ব্রিটিশ সরকার কী অপরাধে ফাঁসিয়েছিলেন, তা নিয়ে তদন্ত উঠেছে।
কার তদ্বিরে? বটুকবাবু তো শুনেছি বেঁচে নেই। কে গভর্মেন্টকে চাপ দিল এতদিন পরে?
আমাদের জানার কথা নয়। আমরা শুধু অজয়বাবু সম্পর্কে তথ্য খুঁজে বেড়াচ্ছি।
বুঝেছি। চিন্তিত মুখে অলকবাবু বললেন, চন্দ্রিকাকে খুঁজে বের করুন। বাবার কথা সে-ই আমার চেয়ে ভাল বলতে পারবে। রথীনকে খুনের দায়ে তাকে খামোকা পুলিশ ফাঁসিয়েছিল। তারপর মেয়েটা রাতারাতি নিখোঁজ হয়ে গেল।
আপনি সম্ভবত আর প্র্যাকটিস করেন না?
করি না। আমার ছেলে করে। আমি অবশ্য কনসাল্ট্যান্টের কাজকর্ম করি আজকাল। কোর্টে ছোটাছুটি আর এ বয়সে সম্ভব নয়। আপনাদের জন্য চা বলি?
থ্যাংকস। কর্নেল হাত তুলে নিষেধ করলেন। বাই এনি চান্স, আজ কেউ চন্দ্রিকা প্রসঙ্গে আপনার কাছে কথা বলতে এসেছিল কি?
অলকবাবু মাথা নাড়ালেন। না তো! কেন?
যদি কেউ আসে, পাত্তা দেবেন না–আমার অনুরোধ। আই মিন, সি বি আইয়ের পক্ষ থেকে এটা রিকোয়েস্ট।
না, না! কী বলছেন? অলকবাবু ব্যস্তভাবে বললেন, পাত্তাই দেব না।
আমাদের কথাও যেন বলবেন না প্লিজ!
কক্ষনো না। নেভার! আই অ্যাম আ ল-অ্যাবাইডিং সিটিজেন অব দিস কান্ট্রি। তাছাড়া আমি লইয়ার। আই অ্যাসিওর ইউ কর্নেলসাহেব!…
.
ফেরার পথে বললাম, বড় অদ্ভুত ব্যাপার। মনে হচ্ছে, এবার আপনি একটা মহাভারত রহস্যে হাবুডুবু খাবেন। অসংখ্য এপিসোড!। অসংখ্য ট্র্যাজেডি। কোনটার সঙ্গে কোনটার সম্পর্ক আছে, খুঁজে বের করাই কঠিন। কিন্তু শুরু সামান্য একটা পরগাছা থেকে।
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, তুমি ঠিক ধরেছ। তোমাকে গতরাত্রে বলেছিলাম অর্কিডের একটা ফুল থেকে ৪৭ লক্ষ বীজকণিকা ছড়িয়ে যাওয়ার কথা।
বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়াসহ।
য়ু আর ড্যাম রাইট, ডার্লিং।
সত্যি বস্! আমি কোনও খেই পাচ্ছি না।
কর্নেল চুপ করে গেলেন। চোখ বন্ধ। দাঁতে কামড়ানো চুরুট। সারা পথ আর মুখ খুললেন না। আমি মহাভারতরহস্য থেকে এবার দুরে সরে থাকার চেষ্টা করছিলাম।
ভেবেছিলাম, কর্নেলকে বাড়ি পোঁছে দিয়ে কেটে পড়ব। মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু কর্নেল আসতে দিলেন না। তেতলার অ্যাপার্টমেন্টে ডোরবেলের সুইচ টিপলে ষষ্ঠী দরজা খুলে দিল। তারপর চাপাস্বরে বলল, নালবাজারের নাহিড়িসায়েব এসে বসে আছেন বাবামশাই!
বসে আছে! বলিস কী রে?
আজ্ঞে। কোফি করে দিয়েছি। খাচ্ছেন।
কর্নেল ড্রয়িংরুমে ঢুকে বললেন, তোমাকে আশা করছিলাম অরিজিৎ। বিশেষ করে তোমার বন্ধু ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে জানার পর।
ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার অরিজিৎ লাহিড়ি হাসলেন। হাতে প্রচুর সময় ছিল। তাই অন্তত ষষ্ঠীর সুস্বাদু কফিটা খেয়ে যাই ভেবেছিলাম। এই যে জয়ন্তবাবু! কেমন আছেন মশাই? অনেকদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই।
বললাম, কর্নেলের পাল্লায় পড়লেই আমার সঙ্গে রেগুলার দেখা হবে মিঃ লাহিড়ি!
কর্নেল বসে বললেন, বেলেঘাটার ওখানে ক্যানেলে একটা বডি পাওয়া গেছে তো?
হ্যাঁ। আমাদের অফিসাররা বলছেন, ডিস্কোসাহেবের লোক কিন্তু আপনি জেনে গেছেন–
কী নাম?
স্বপন দাশ। ইয়ং ম্যান। নিউমার্কেটে একটা ভিডিও ক্যাসেটের দোকান আছে। বাড়ি তালতলা এরিয়ায়। ক্রিমিন্যাল তো বটেই। অরিজিৎ কফিতে চুমুক দিয়ে ফের বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার! পকেটে একটা দিশি পিস্তল পাওয়া গেছে। তার মানে, নিরস্ত্র ছিল না। অথচ নিজেই মাথার পিছনে গুলি খেয়ে মারা পড়েছে। পয়েন্ট টোয়েন্টি টু রিভলভারের গুলি। রাত্রে বৃষ্টি পড়েছিল খুব। তাই খালের ধারে গাড়ির টায়ারের দাগ পাওয়া গেছে। দরজা খুলে গড়িয়ে বডি খালে ফেলেছে।
তাহলে বলা যায়, ওলসন হাউসের কাছেই কেউ ওত পেতে ছিল!
তাই মনে হচ্ছে।
আমি বললাম, ঠিক এই কথাটাই কর্নেলকে বলছিলাম। কর্নেল বললেন, এটা নাকি আমার নিছক ধারণা?
অরিজিৎ গম্ভীর মুখে বললেন, আমাদেরও নিছক ধারণাই। উই আর নট শিওর।
ইন্দ্রজিৎবাবু ডিস্কোর সঙ্গে ডুয়েল লড়তে চান। কর্নেল টুপি খুলে টাকে হাত মুলোতে বুলোতে বললেন। ডিস্কোর পরিচয় তুমিও সম্ভবত জানো না অরিজৎ!
নাহ্। দ্যাটস্ ওনলি নেম টু মি।
কোনও হিন্ট পাওনি তার সম্পর্কে?
শুধু এটুকু জানি, তার নাকি অনেক ডামি আছে। কোনটা রিয়্যাল ডিস্কো, তা নাকি কেউ-ই জানে না। অরিজিৎ হাসলেন। মাঝেমাঝে আমার মনে হয়, নামটাই একটা গুজব। ভূতের মতো। হয়তো অত্যন্ত সাধারণ কিংবা চেনা কেউ এই নাম নিয়ে অদ্ভুত খেলা খেলছে। যাই হক, ডিস্কো ইজ আ মিস্ট্রি। কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন বডি পাওয়ার খবর?
ডিস্কো জানিয়েছে।
অ্যাঁ?
হ্যাঁ ডার্লিং! ডিস্কোর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে। তবে জানি না সেটা
অমি কি না।
অরিজিৎ মুচকি হেসে বললেন, জয়ন্তবাবুদের কাগজে এক ভদ্রলোক আপনার ডার্লিং বলা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।
আমি বললাম, পড়েছেন? কর্নেলের ইংরেজি বলাতেও ওঁর আপত্তি!
ভিন্নরুচির্হি জনাঃ! অরিজিৎ সিগারেট ধরিয়ে বললেন, আমার মতে, ডার্লিং বলাটা কর্নেলের একটা টিপিক্যাল ফিচার। এটাই ওঁর বৈশিষ্ট্য। ডার্লিং বলছেন না কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, এটা অকল্পনীয়। তাছাড়া ঐতিহাসিক কারণে তো বটেই, আরও নানা কারণে ইংরেজি বলাটা আমাদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। ভারতের মতো একটা বহুভাষী দেশে ইংরেজি ছাড়া চলে না। তাছাড়া-ফর এক্সজাম্পল, এমকিউজ মি কথাটা বাংলা করলে কী অদ্ভুত শোনাবে ভাবুন।
অরিজিৎ ইংরেজি নিয়ে কিছুক্ষণ বক্তৃতা চালিয়ে গেলেন। ষষ্ঠী আমাদের জন্য কফি আনল। অরিজিৎ বললেন, এই যে ষষ্ঠীর কফি!। এছাড়া কর্নেলকে কল্পনা করাই তো অসম্ভব। সেই সমালোচকের অবস্থা সত্যি অনাথের মতো। আই ফিল– পিটি ফর হিম।
কর্নেল বললেন, অনাথ? অনাথ কেন?
প্রেসিডেন্সিতে আমার এক বন্ধু ছিল অনাথ নামে। ইন্দ্রজিৎও তাকে চিনত। ইংরেজি শুনলে চটে যেত। কিন্তু উত্তেজনার সময় সে কী সাংঘাতিক ইংরেজি বলত ভাবা যায় না।
অরিজিৎ! অনাথরা অনেক সময় পরগাছা হয়ে ওঠে।
অরিজিৎ একচোট হেসে বললেন, ইন্দ্রজিৎ পরগাছা নামে একটা নাটক করেছে। আমাকে দেখতে যেতে বলেছিল। শুনলাম, আপনি দেখে এসেছেন। নাটকে কি অনাথ নামে কোনও চরিত্র আছে?
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন, নাহ্। তবে অনাথ–অনাথ.. বলে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন কর্নেল। জাদুঘরসদৃশ এই ড্রইংরুমের কোণার দিকে গিয়ে ওঁর ছোট্ট সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ড্রয়ার খুললেন। একটা নোটবই বের করতে দেখলাম। পাতা উল্টে কিছু দেখে নিয়ে ফিরে এলেন। ইজিচেয়ারে বসে বললেন, হ্যাঁ। অনাথবন্ধু রায়। অরিজিৎ তোমাদের সেই বন্ধুর নাম কি অনাথবন্ধু রায় ছিল?
অরিজিৎ একটু ভেবে নিয়ে বললেন, পদবি মনে নেই। তবে অনাথবন্ধু বটে। খুব খেয়ালি ধরনের ছেলে ছিল মনে পড়ছে। ওকে আমরা সবসময় উত্ত্যক্ত করতাম।
রাঙাটুলিতে গিয়ে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ইনিও খেয়ালি। পরিবেশদূষণ নিয়ে আন্দোলন করে বেড়ান নানা জায়গায়। জানি না ইন্দ্রজিৎবাবুর নাটকের আইডিয়া ইনিই যুগিয়েছিলেন কি না।
অরিজৎ ঘড়ি দেখে বললেন, যাক্, ওসব কথা। যেজন্য এসেছিলাম, বলি। প্রথমত, বেলেঘাটার ক্যানেলে ডিস্কোর লোক স্বপনের ডেডবডি পাওয়ার কথা তো আপনি জেনেছেন। স্বয়ং ডিস্কোই জানিয়েছে। তবে দ্বিতীয় ঘটনা হলো, বেলা দুটোর পর ওলসন হাউস থেকে আমরা পুলিশ তুলে নিয়েছিলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ হ্যারি ওলসন থানায় ফোন করে জানান, দোতলার একটা মেয়ে ওঁকে এইমাত্র বলে গেল, চন্দ্রিকার ফ্ল্যাটে কেউ ঢুকেছে। তখনই অশোক গুপ্ত গিয়ে এনকোয়ারি করেন। কিন্তু চন্দ্রিকার ঘর আগের মতোই তালাটা আছে। দোতলার সেই মেয়েটি ওঁকে অবশ্য জোর দিয়ে বলেছে, লোডশেডিংয়ের সময় নাকি লোকটাকে ওপরে উঠতে দেখেছিল। অশোকবাবুর মতে, চন্দ্রিকার কোনও পুরনো খদ্দের। কারণ লোকটা ডিস্কোর চেলা হলে দোতলার মেয়েটি চিনতে পারত।
আর কিছু?
নাহ্। তবে অশোকবাবু আমাকে ঘটনাটা জানানোর পর আমার মনে হচ্ছে, চন্দ্রিকার এমন কোনও ডকুমেন্ট আছে, যা খুনী এখনও হাতাতে পারেনি। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। আপনার চোখের দৃষ্টি অন্যরকম। হয়তো আপনিই সেটা আবিষ্কার করতে পারবেন।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, চন্দ্রিকার খুনী ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ওর ঘরে যেটা খুঁজছে, সেটা বেহাত হয়ে গেছে। চন্দ্রিকা বুদ্ধিমতী মেয়ে ছিল।
কিন্তু ডকুমেন্টটা কী হতে পারে?
একটা সাংকেতিক সূত্র লেখা কাগজ।
অরিজিৎ ভুরু কুঁচকে বললেন, আপনার হাতের তাস আপনি আগে দেখাতে চান না জানি। কাজেই আর কোনও প্রশ্ন করব না। শুধু একটা রিকোয়েস্ট, ডিস্কোকে বলুন, ইন্দ্রজিৎকে আর যেন উত্ত্যক্ত না করে। সৌরভ নাট্যগোষ্ঠী নিয়েই বেচারার যা কিছু উচ্চাকাঙক্ষা। সব সময় প্রাণনাশের ঝুঁকি থাকলে ওর নাটক করা বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া ইতিমধ্যে ওর দলে নাকি ডিস্কোর চর ঢুকেছে।
চন্দ্রিকা বেঁচে নেই। কাজেই ডিস্কো আর ইন্দ্রজিৎবাবুর পেছনে লাগবে কেন? কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে নিয়ে বললেন, তোমাকে জানানো উচিত, ইন্দ্রজিৎবাবুই বরং ডিস্কোর পেছনে লেগেছেন।
অরিজিৎ হেসে উঠলেন। আসলে চন্দ্রিকার সঙ্গে ওর এমোশনাল অ্যাফেয়ার ছিল বলে আমার ধারণা। তাই ডিস্কো বা তার লোক চন্দ্রিকাকে মেরেছে ভেবেই ইন্দ্রজিৎ খাপ্পা। আমি ইন্দ্রজিৎকে বলেছি, তুমি নির্ভয়ে নাটক চালিয়ে যাও। আর যেন কলগার্লদের ছায়া মাড়িও না। দলের কাকেও ডিস্কোর চর সন্দেহ হলে তাড়িয়ে দাও। ব্যস! ফুরিয়ে গেল।
একটা কথা, অরিজিৎ!
বলুন।
কিছুদিন আগে ওলসন হাউসে পুলিশ হানা দিয়েছিল। সত্যিই কি নার্কোটিকস পাওয়া গিয়েছিল কলগার্লদের কাছে?
অরিজিৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, নাহ্। ওটা পাবলিক খাওয়ানো খবর। জাস্ট আ শো বিজনেস।
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির অনুরোধে তুমিই হানার ব্যবস্থা করেছিলে কি?
হুঁ! অরিজিৎ সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুঁজে বললেন, ইন্দ্রজিতের ধারণা, ডিস্কো ওকেই ওয়ার্নিং দিতে চন্দ্রিকাকে ওর প্রেমিকা এবং চর ভেবে খুন করেছে। ইন্দ্রজিৎ আজ বলছিল, হানা দেওয়াটা ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু পরে যা ঘটল, দেখা যাচ্ছে চন্দ্রিকাকে খুনের উদ্দেশ্য ভিন্ন। কাজেই এখন ব্যাপারটা যা দাঁড়াল, হচ্ছে ডিস্কো বনাম ইন্দ্রজিতের দ্বন্দ্বের সঙ্গে চন্দ্রিকার মার্ডারের কোনও সম্পর্ক নেই দেয়ার ইজ আ থার্ড ম্যান।
দ্যাটস রাইট। কর্নেল চোখ বুজে হেলান দিলেন।
আমি চলি কর্নেল! আমরা থার্ড ম্যানকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। আপনিও করুন। তবে ডিস্কোকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেবেন, ইন্দ্রজিতের সঙ্গে ওর শত্রুতার আর কারণ নেই। আমি ইন্দ্রজিৎকে একই কথা বলেছি।
অরিজিৎ লাহিড়ি চলে যাওয়ার পর বললাম, ডিস্কোকে ফোন করবেন না?
কেন? লাহিড়িসায়েব ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে মিটমাট করিয়ে দিতে বলে গেলেন।
সমস্যা হলো জয়ন্ত, ডিস্কোর ডামি আছে অনেকগুলো। যতক্ষণ না আসল ডিস্কোকে পাচ্ছি, ততক্ষণ ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে তার মিটমাট করানোর চেষ্টা বৃথা। কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে একটু হাসলেন। ফের বললেন, মানুষের ছায়ার সঙ্গে তো আর রক্তমাংসের মানুষের মিটমাট করিয়ে দেওয়া যায় না। ডিস্কো এখনও ছায়া। ছায়াটা কার এটাই প্রশ্ন।
ফোনে ডাকুন ডিস্কোকে। বলুন সশরীরে হাজির হতে।
সে আসবে না। পাঠাবে তার ডামিকে।
আপনি নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?
আমি নিশ্চিত। ভুলে যেও না, স্বয়ং অরিজিও স্বীকার করে গেল, ডিস্কো তার কাছে একটা নাম মাত্র।
তাহলে এবার তৃতীয় লোকটিকে খুঁজে বের করাই আপনার প্ল্যান নিশ্চয়?
হ্যাঁ। কর্নেল চোখ বুজে বললেন। তাকে চিনতে পারলেই কে প্রকৃত ডিস্কো জানা যাবে সম্ভবত।
আমি উঠি কর্নেল।
যাবে? আচ্ছা। কর্নেল অন্যমনস্কভাবে কথাটা বললেন।….
.
কোথায় যেন পড়েছিলাম, Beware of those thoughts come in night! রাতের চিন্তা সম্পর্কে সাবধান! বিছানায় শোয়ার পর চিন্তা এসে আমাকে উত্ত্যক্ত করছিল। কোনও রহস্য নিয়ে চিন্তা আমার কাছে নতুন কিছু নয়–অন্তত কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সান্নিধ্যে আসার পর থেকে। কিন্তু সেই সব চিন্তা আলতো ছুঁয়ে গেছে মাত্র। আজ রাতের চিন্তা মাছির ঝাঁকের মতো মগজে ভনভন করছিল। অবশেষে মরিয়া হয়ে একটা বোঝাঁপড়ার জন্য আমার জানা তথ্যগুলো কাগজে লিখে ফেললাম।
পটভূমি ১: রাঙাটুলির জনৈক অজয় রায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক ঘাঁটিতে কন্ট্রাক্টর ছিলেন। কোনও অপরাধে তাঁর জেল হয়। জেলেই তিনি মারা যান। তাঁ স্ত্রী শিশুকন্যা চন্দ্রিকাকে নিয়ে স্বামীর মাসতুতো দাদা হরনাথ সিংহের কাছে আশ্রয় নেন। হরনাথ চন্দ্রিকার বিয়ে দিয়েছিলেন এম এল এ বটুক চৌধুরীর ছেলে রথীনের সঙ্গে। রথীন কলকাতায় থাকার সময় খুন হয়ে যায়। স্বামীর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে চন্দ্রিকা জড়িয়ে পড়ে। আইনজীবী অলকবাবুর দ্বারস্থ হয়। তারপর সে কোনও ঘটনাচক্রে ডিস্কোর পাল্লায় পড়ে। মামলা থেকে বেঁচে গেলেও কলগার্লের ভূমিকায় তাকে নামতে হয়েছিল। তারপর তার নাট্য পরিচালক ইন্দ্রজিতের সঙ্গে চেনাজানা হয় এবং নাটকে নামার সুযোগ পায়। কিন্তু ডিস্কো নাকি এটা চায়নি। ইন্দ্রজিৎকে হুমকি দেয়। ইন্দ্রজিৎ কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের দ্বারস্থ হন তাঁর বন্ধু ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ির পরামর্শে। বোঝা যায়, বহ্মপী ডিস্কোর পরিচয় জানতেই ইন্দ্রজিৎ কর্নেলের দ্বারস্থ হন। ইন্দ্রজিৎ বলছিলেন, নিজের হাতে ডিস্কোকে শাস্তি দেবেন।
পটভূমি ২ : চন্দ্রিকাকে সম্প্রতি কেউ অদ্ভুত ভাষায় উত্ত্যক্ত করছিল। চাই চিচিং ফাঁক বলত কি সে? যাইহোক, ইন্দ্রজিতের মুখে কর্নেলের পরিচয় পেয়ে চন্দ্রিকা গতরাতে কর্নেলকে অনুসরণ করে আসে এবং ইচ্ছে করেই (?) পার্সটা আমাদের গাড়িতে ফেলে যায়। পার্সের ভেতর অদ্ভুত কোড লেখা একটা চিরকুট পাওয়া গেছে। এর পর চন্দ্রিকা তার ফ্ল্যাটে খুন হয়েছে। ডিস্কো যার হাতে ডুপ্লিকেট চাবি পাঠিয়েছিল, তার নাম স্বপন। সে-ও খুন হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চন্দ্রিকা প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে, কে হালদারের দ্বারস্থ হয়েছিল। তাঁকে বলেছিল, তার কোনো বিপদ (খুন) হলে রাঙাটুলির হরনাথকে খবরটা জানাতে হবে।
পটভূমি ৩ : রাজনীতি করা লোক রাঙাটুলির বটুক চৌধুরীর ভগ্নিপতি অমরেন্দ্র সিংহরায়কে সম্প্রতি কে বা কারা অদ্ভুতভাবে উত্ত্যক্ত করছে। চাই চিচিং ফাঁক (?) লেখা চিরকুট ফেলেছে অমরেন্দ্রর ঘরের দরজায়। অমরেন্দ্র এবং বটুক চৌধুরীর মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। বটুকবাবুও সম্ভবত (?) খুন হয়েছিলেন। এদিকে বটুকবাবুর ছেলে রথীন থাকত কলকাতায়। অমরেন্দ্রর ছেলে হেমেন্দ্রর বাড়ির পাশেই সে থাকত। হেমেন্দ্রর সঙ্গে তার বাবা অমরেন্দ্রর নাকি ভাল সম্পর্ক নেই (কর্নেলের বক্তব্য)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বটুকবাবুর নাম করে উড়োচিঠি লিখে অমরেন্দ্রর এক কর্মচারী যোগেন অমরেন্দ্রকে ভয় দেখাত। গত বছর কর্নেল তাকে ধরিয়ে দেন অর্থাৎ উড়োচিঠির রহস্য ফাঁস হয়। কেন যোগেন এ কাজ করত? কর্নেল জানাননি আমাকে।
এই সময় ফোন বেজে উঠল। বিরক্ত হয়ে ফোন তুলে অভ্যাসমতো বললাম, রং নাম্বার।
রাইট নাম্বার ডার্লিং!
কর্নেল! কী ব্যাপার? রাত বারোটা বাজে।
তুমি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকে চারবার কেউ ফোন করে আমাকে বলেছে, চাই চিচিং ফাঁক। দারুণ ইন্টারেস্টিং নয়?
আমিই কিন্তু বলেছিলাম কথাটা চাই চিচিং ফাঁক।
তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করছি।
কিন্তু শুধু এই কথাটা জানাবার জন্য এত রাতে নিশ্চয় ফোন করছেন না?
তুমি বুদ্ধিমান জয়ন্ত! ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। বিকেলে আমার অ্যাপার্টমেন্টে এসেছিলেন। তখন তুমি ছিলে। কিন্তু উনি এখনও বাড়ি ফেরেননি।
বলেন কী? কে জানাল আপনাকে?
ওর স্ত্রী অরিজিৎকে ফোন করেছিলেন। অরিজিৎ ওঁর খোঁজে পুলিশ লড়িয়ে দিয়েছে। একটু আগে আমাকে অরিজিৎ ফোনে জানাল, এত রাতে ডিসটার্ব করার জন্য দুঃখিত। যা-ই হোক, ইন্দ্রজিৎবাবুর নিখোঁজ হওয়ার চেয়ে অদ্ভুত ঘটনা, অরিজিৎই বলল যে, ইন্দ্রজিৎবাবুর স্ত্রী মৃদুলা রাঙাটুলির মেয়ে। কথায় কথায় অরিজিৎকে সেটা জানিয়েছেন মৃদুলা। অরিজিৎ যেহেতু আমার কাছে তখন রাঙাটুলির ইকোলজিস্ট অনাথবন্ধু রায়ের কথা শুনেছিল, তাই রাঙাটুলি কথাটা ওর মনে ছিল। তবে কথাটা অরিজিৎ নেহাত ক্যাজুয়ালি আমাকে জানাল। অরিজিৎকে আমি অমরেন্দ্র সিংহরায়ের কথা জানালাম না।
ব্যস্! এ যে তাহলে রাঙাটুলি রহস্য হয়ে উঠল।
নাহ্। পরগাছা রহস্য।
তার মানে?
মানে জানতে হলে সকাল আটটার মধ্যে আমার কাছে চলে এসো। ছাড়ছি। গুড নাইট। হ্যাঁভ আ নাইস স্লিপ, ডার্লিং!
ফোন রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ সিগারেট টানছিলাম। উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবছিলাম, ইন্দ্রজিৎবাবুকে ডিস্কো খতম করে ফেলেনি তো? কিন্তু তার চেয়ে ভয়ের কথা, এবার কর্নেলকেই ভুতুড়ে ফোনে চাই চিচিং ফাঁক বলে কেউ উত্ত্যক্ত করছে। ডিস্কো নয় বলেই মনে হচ্ছে। সে হলে সোজাসুজি চার্জ করে বসত কর্নেলকে, আমার এই জিনিসটা চাই। চিচিং ফাঁক এই সাংকেতিক কথা বলার পাত্র নয় সে। তাছাড়া সে কর্নেলকে উত্ত্যক্ত করবেই বা কেন? কী লাভ হবে তাতে? এ নিশ্চয় অরিজিৎ লাহিড়ি যে তৃতীয় লোকের কথা বলছিলেন, তারই কাজ।….
.
সকালে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখি, একটা প্রকাণ্ড বই খুলে বসে আছেন। বইয়ের পাতায় চোখ রেখেই বললেন, আজ সব কাগজে কলগার্ল খুন হেডিংয়ে চন্দ্রিকার খবর বেরিয়েছে।
বললাম, চোখ বুলিয়েছি। খুঁটিয়ে পড়িনি। ছাঁচে ফেলা খবর। কিন্তু আপনি এই সক্কালবেলা রহস্য ছেড়ে বইয়ে ডুব দিতে গেলেন দেখে অবাক লাগছে।
কর্নেল বইটা রেখে একটু হেসে বললেন, এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ব্রিটিশ আর্মিবেসের রেকর্ড। কোথায়-কোথায় সামরিক ঘাঁটি করা হয়েছিল, সেই সব ঘাঁটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
বুঝলাম, রাঙাটুলি আর্মিবেসের তথ্য খুঁজছেন। কিন্তু কেন?
নিছক কৌতূহল। বলে কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরালেন। একটু পর ফের বললেন, ইন্দ্রজিৎবাবুর স্ত্রী মৃদুলা একটু আগে ফোন করেছিলেন।
ইন্দ্রজিৎবাবু বাড়ি ফিরেছেন কি?
নাহ্। মৃদুলা কাগজে চন্দ্রিকার খবর পড়ে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। চন্দ্রিকাকে উনি চিনতেন। কিন্তু চন্দ্রিকা কলগার্ল হয়েছে জানতেন না। বললেন যে, ওঁর স্বামীর সঙ্গে চন্দ্রিকা মাঝেমাঝে ওঁদের বাড়িতে যেত। সেই নিয়ে কোনও সন্দেহ জাগার কথা নয়। কারণ সৌরভ নাট্যগোষ্ঠীর আরও মেয়ে ওঁর স্বামীর সঙ্গে যেত। রিহার্সাল হতো ওঁদের বাড়িতেই।
ষষ্ঠী আমার জন্য কফি আনল। কফি খেতে খেতে বললাম, মৃদুলা তো রাঙাটুলির মেয়ে! চন্দ্রিকা সম্পর্কে নতুন কিছু জানতে পেরেছে ওঁর কাছে?
ফোনে বেশি কথা বলা যায় না। কর্নেল আস্তে বললেন, কফি খেয়ে নাও। বেরুব। মৃদুলা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির বাড়ি লেকের কাছাকাছি। ফ্ল্যাটবাড়ি নয়, দোতলা বনেদী বাড়ি। গেটে লেখা আছে সৌরভ। একজন তাগড়াই গড়নের যুবককে সম্ভবত আমাদের জন্যই দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন মৃদুলা। তার পরনে জিনস। ফিল্মহিবোর কেতা আছে হাবভাবে। নমস্কার করে বলল, আসুন স্যার! ভেতরে গাড়ি রাখার জায়গা আছে।
সে গেট খুলে দিল। ছোট্ট লনের পর পোর্টিকো। সেখানে গাড়ি রেখে আমরা নামলাম। কর্নেল বললেন, আপনি কি সৌরভ নাট্যগোষ্ঠীর অভিনেতা?
যুবকটি হাসল। হ্যাঁ, স্যার! পরগাছা নাটকে আপনি গাবুর রোলে ছিলেন?
যুবকটি একটু অবাক হয়ে বলল, আপনি ঠিকই চিনেছেন স্যার। আমার নাম, সুশান্ত সেন। আপনার সব কথা স্যার, মৃদুলাদি বলেছেন আমাকে।
কর্নেল ঘরে ঢুকে বললেন, কী সব কথা? এই মানে–আপনি ডিটেকটিভ অফিসার …
কর্নেল জিভ কেটে বললেন, ছি, ছি! আমি ডিটেকটিভ নই। কথাটা একটা গালাগাল। কারণ টিকটিকি কথাটা ডিটেকটিভ থেকে এসেছে। যাই হোক, মিসেস
ব্যানার্জিকে খবর দিন।
সুশান্ত আরও অবাক হয়ে ভেতরে গেল। ঘরটা আধুনিক ছাঁদে সাজানো। রুচির ছাপ আছে। একটু পরে সুশান্ত ফিরে এসে বলল, মৃদুলাদি আসছেন। ফোনে কথা বলছেন কার সঙ্গে।
সুশান্তবাবু, আপনি কিন্তু অসাধারণ অভিনয় করেন। আপনার অভিনয় দেখে
আমি মুগ্ধ। তো আপনি থাকেন কোথায়?
সুশান্ত একটু ইতস্তত করে বলল, আমি এ বাড়িতেই থাকি স্যার। ইন্দ্রদা আমাকে অনেক কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন। ধরুন, রিহার্সালের ব্যবস্থা করা হলো, বুকিং, নানা জায়গায় কন্ট্যাক্ট করা। ম্যানেজার বলতে পারেন।
চন্দ্রিকা রায় তো আপনাদের দলেই অভিনয় করত?
সুশান্ত চমকে উঠল। হ্যাঁ কাগজে দেখলাম মার্ডার হয়েছে। কিন্তু–
চন্দ্রিকা কলগার্ল ছিল, জানতেন না?
আজ্ঞে। তবে স্যার, আমার বরাবর কেমন একটা সন্দেহ হতো। চন্দ্রিকার হাবভাব দেখেই কেমন লাগত। তবে ফেবোসাস টাইপের মেয়ে ছিল।
সে থেমে গেল। মৃদুলা এসে নমস্কার করে বসলেন। চেহারায় উদ্বেগের ছাপ প্রকট। ঠোঁট কামড়ে ধরে আত্মসম্বরণ করে আস্তে বললেন, মিঃ লাহিড়ির সঙ্গে কথা বলছিলাম। সুশান্ত আপনার আসার খবর দিল। মিঃ লাহিড়িকে জানালাম আপনি এসেছেন। উনি বললেন, ফ্র্যাংকলি সব কথা যেন আপনাকে বলি। উনি সুশান্তর দিকে ঘুরে বললেন, চা করতে বলে এসেছি। গিয়ে দেখ তুমি।
সুশান্ত চলে গেলে মৃদুলা চাপা স্বরে বললেন, আমার হাজব্যান্ডকে কিডন্যাপ করেছে। এই দেখুন, কিছুক্ষণ আগে লেটার বক্সে সুশান্ত চিঠিটা পেয়েছে।
খামে ভরা চিঠিটা ওঁর মুঠোয় দুমড়ে গিয়েছিল। কর্নেল বের করে ভাঁজ সোজা করলেন। ঝুঁকে গেলাম ওঁর দিকে। দেখলাম, লেখা আছে :
ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জি আমাদের হাতে বন্দি। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে রাঙাটুলির ভবানীমন্দিরে এক লক্ষ নগদ টাকা পৌঁছে দিলে তাকে ছেড়ে দেব। পুলিশকে জানালে আমরা জেনে যাব এবং সঙ্গে সঙ্গে আপনার স্বামীকে গুলি করে মারব। রাঙাটুলির ভবানী মন্দির কোথায় আপনি জানেন।
ডিস্কো।
কর্নেল চিঠিটা পড়ে বললেন, আপনি কি লাহিড়িসায়েবকে এই চিঠির কথা জানালেন?
মৃদুলা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, না।
সুশান্তবুকে নিশ্চয় জানিয়েছেন?
হ্যাঁ। সুশান্ত এই ফ্যামিলিরই একজন।
কী করবেন ভেবেছেন?
সুশান্তর সঙ্গে পরামর্শ করেছি। সুশান্ত আজই টাকা নিয়ে যাবে। আমিও সঙ্গে যাব। কারণ ভবানীমন্দির সুশান্ত চেনে না।
এত নগদ টাকা যোগাড়-করতে পারবেন?
কর্নেলের কথার ওপর মৃদুলা দ্রুত বললেন, আমি ম্যানেজ করতে পারব।
ডিস্কো কে আপনি জানেন?
না। তবে সুশান্ত বলছিল, ইন্দ্রজিতের কাছে নামটা শুনেছে। বলে একটু দ্বিধার পর মৃদুলা ফের বললেন, সুশান্ত ওর বডিগার্ড। কিন্তু গতকাল ও সুশান্তকে নিয়ে বেরোয়নি। সেই ভুলের জন্যই এ অবস্থা। আমি ওকে একা বেরুতে বারণ করেছিলাম।
আপনি তো রাঙাটুলির মেয়ে। চন্দ্রিকা রায়কে চিনতেন নিশ্চয়?
সুন্দরী মহিলার চেহারায় মুহূর্তের জন্য বিকৃতি ফুটে উঠল। বিকৃত মুখে বললেন, ডেঞ্জারাস মেয়ে। ইন্দ্রজিৎ? আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম। নিজের স্বামীকে যে মেয়ে তোক দিয়ে মার্ডার করাতে পারে, তার চরিত্র কেমন ভেবে দেখুন।
চন্দ্রিকার স্বামীকে আপনি চিনতেন?
মুখোমুখি আলাপ ছিল না। শুনেছি, নিরীহ গোবেচারা প্রকৃতির ছেলে ছিল। তবে ভীষণ মদ খেত–হয়তো ফ্রাস্ট্রেশনের জন্য। তাছাড়া ওর বাবা ছিলেন এম এল এ। সেই জন্য খারাপ লোকেরা ওকে খুব এক্সপ্লয়েট করত। বটুকবাবুকেও রথীনের বোকামির জন্য বিব্রত হতে হতো।
আপনি নিশ্চয় বটুকবাবুর ভাগ্নে হেমেন্দ্রকে চেনেন?
মৃদুলার চোখ জ্বলে উঠল। আমার সন্দেহ, হেমেনদাই ডিস্কো।
কেন সন্দেহ?
চন্দ্রিকার সঙ্গে হেমেনদার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রথীনকে মার্ডারের পেছনে তারও হাত ছিল। ইন্দ্রজিৎ আমাকে বলেছিল এ সব কথা খুলে বলাই উচিত আপনাকে। আমার স্বামীভদ্রলোক এই যে বিপদে পড়েছে, সেটা অকারণ নয়। মৃদুলার মুখে আবার বিকৃতি ফুটে উঠল। চন্দ্রিকাকে নিয়ে হেমেনদার সঙ্গে ইন্দ্রজিতের রেষারেষি চলছিল। ইন্দ্রজিৎ আমাকে বলত চন্দ্রিকার জীবন হেমেনই নষ্ট করেছে। এদিকে হেমেনদা একদিন আমাকে টেলিফোনে বলছিল, ইন্দ্রজিৎ চন্দ্রিকার জন্য বিপদে পড়বে। ওকে যেন সাবধান করে দিই।
আপনি ইন্দ্রজিৎবাবুকে বলেছিলেন সেকথা?
মৃদুলা মুখ নামিয়ে আস্তে বললেন, হ্যাঁ। শুনে ও খেপে গেল। ভীষণ ঝগড়াঝাঁটি হলো আমার সঙ্গে। ইন্দ্রজিতের যুক্তি হলো, চন্দ্রিকার অভিনয় ক্ষমতা নাকি অসাধারণ। সে তার সৌরভ নাট্যগোষ্ঠীর অ্যাসেট হয়ে উঠবে ভবিষ্যতে। আমি বুঝতে পারি না কিছু।
সুশান্ত এল। বাড়ির পরিচারিকার হাতে ট্রে। কর্নেল একটু হেসে বললেন, আমি এক চুমুক খাব মাত্র–আপনার অনারে। জয়ন্ত পুরো কাপ খাও।
মৃদুলা সুশান্তকে বললেন, তুমি এখনই পার্ক স্ট্রিট থানায় গিয়ে দেখতো ইসমাইল এখনও কেন এল না গাড়ি নিয়ে। লাহিড়িসায়েব বললেন, বলে দিয়েছেন ওদের। যাবে আর আসবে কিন্তু। সাড়ে বারোটায় ট্রেন। ভুলে যেও না।
সুশান্ত বেরিয়ে গেল। কর্নেল বললেন, ইন্দ্রজিৎবাবুর গাড়ি?
মৃদুলা বললেন, হ্যাঁ। গতরাতে ওর গাড়িটা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মোড়ে পাওয়া গিয়েছিল। তখন টেলিফোনে আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মোড়ে পাওয়া গেছে? গত রাতে?
হ্যাঁ। লাহিড়িসায়েব খবর দিয়েছিলেন। লোক পাঠিয়েছি সঙ্গে সঙ্গে।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, আপনি যখন ডিস্কোকে টাকা দিয়ে ইন্দ্রজিৎবাবুর মুক্তি চেয়েছেন, তখন আর আমার কিছু করার নেই। তো–
মৃদুলা ওঁর কথার ওপর বললেন, আমি রিস্ক নিতে চাই না। টাকার চেয়ে প্রাণের দাম বেশি। ওঁর চোখে জল এসে গিয়েছিল। হাতের চেটোয় মুছে ফের বললেন, যদি ভালয়-ভালয় ওকে ফিরিয়ে আনতে পারি, আর নাটক করতে দেব না। কত অচেনা মেয়ে ওর গ্রুপে নাটক করতে আসে। হয়তো আবার কারও জন্য ও বিপদে পড়বে।
কর্নেল বললেন, একটা প্রশ্ন। আপনার বাবার নাম কী?
আমার বাবা একজন সায়েন্টিস্ট। একসময় অধ্যাপনা করতেন। ছেড়ে দিয়ে কী সব রিসার্চ করেন। আমার বাবা ভীষণ খেয়ালি মানুষ। আসলে আমার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা কেমন যেন হয়ে গেছেন। কোথায় কোথায় বনজঙ্গল পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান।
বাই এনি চান্স, আপনার বাবার নাম কি অনাথবন্ধু রায়?
মৃদুলা আস্তে বললেন, হ্যাঁ। আপনি চেনেন?
কাগজে ওঁর লেখা পড়েছি। ইকোলজিস্ট উনি।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। মৃদুলা বললেন, আপনাকে কষ্ট দিলাম। সকাল অব্দি জানতাম না টাকার জন্য ইন্দ্রজিৎকে কিডন্যাপ করেছে। তা হলে আপনাকে আসতে নিষেধ করতাম।
কর্নেল পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে বললেন, শুধু একটা চিঠির ওপর ভরসা করে আপনি অত টাকা নিয়ে যাবেন? ধরুন যদি কোনও থার্ড পার্টি এই ঘটনার সুযোগে টাকাটা হাতাতে চায়?
মৃদুলা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। শান্তভাবে বললেন, আমি বোকামি করছি না কর্নেল সায়েব! চিঠিটা পাওয়ার পরে টেলিফোনে কিডন্যাপার ইন্দ্রজিতের মুখ দিয়ে বলিয়েছে, টাকা না দিলে ওরা ওকে মেরে ফেলবে। আমার স্বামীর গলার স্বর আমি চিনি। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছি।
আই সি। কর্নেল একটু হাসলেন। ঠিক আছে চলি! বলে জোরে পা ফেলে বেরিয়ে এলেন।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গেটের কাছে গেলে এবার সুশান্তের বয়সী অন্য একটি যুবক গেট খুলে দিল। আর একজনকে গেটের পাশে বসে থাকতে দেখলাম। রাস্তায় পৌঁছে বললাম, ইন্দ্রজিৎবাবুর থিয়েটারের লোকেরা সবাই ওঁর বাড়িতে থাকে। নাকি?
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, সেটা অস্বাভাবিক কিছুনয়। তবে ইন্দ্রজিত্যাবুর এই বিপদের দিনে ওঁর কাছের মানুষ যারা, তারা ছুটে আসতেই পারে। যাক গে, মহিলাকে কেমন মনে হলো?
শক্ত মনের মানুষ। স্ট্রং নার্ভ। ভেঙে পড়েননি।
ওঁর বাবা অনাথবাবু একেবারে বিপরীত। রাঙাটুলিতে আলাপ হয়েছিল।
কাল রাত্রে আপনি বলছিলেন। কিন্তু উনিই যে ইন্দ্রজিৎবাবুর শ্বশুর, এটা আমাকে চমক দেবার জন্যই কি আপনি গোপন রেখেছিলেন?
কর্নেল সে-কথার জবাব না দিয়ে বললেন, ভদ্রলোক পরিবেশদূষণ এবং মানুষের ন্যাচারাল হ্যাঁবিটাট নিয়ে রীতিমতো আন্দোলন করছেন খনি অঞ্চলে। তবে আমাকে একটা অর্কিড প্রজাতির খোঁজ দিয়েছিলেন, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। কর্নেল হঠাৎ বললেন, বাঁদিকের রাস্তায় চলো। শর্টকাট হবে।
ওদিকে কোথায় শর্টকাট হবে?
আমরা সোজা চৌরঙ্গি এলাকায় যাব। জয়া ট্রেডিং এজেন্সির অফিসে।
সেখানে কী?
অমরেন্দ্রবাবুর ছেলে হেমেন্দ্রর সঙ্গে দেখা করতে চাই।…
.
একটা বহুতল বাড়ির দশতলার পুরোটা নিয়ে জয়া ট্রেডিং এজেন্সি। বিশাল কারবার না থাকলে এমন সাজানোগোছানো অফিস করা যায় না। প্রচুর কর্মচারী আর উর্দিপরা বেয়ারা নিয়ে কর্মব্যস্ত একটা আধুনিক প্রতিষ্ঠান। রিসেপশনের কাউন্টারে সুন্দরী যুবতী মোতায়েন। মিঠে হাসিতে মিশিয়ে ফুরফুরে ইংরেজি বলছে। উচ্চারণে মার্কিনি ঢং। অর্থাৎ আনুনাসিক স্বর।
এক মিনিট পরেই একজন বেয়ারা এসে আমাদের নিয়ে গেল মালিকের চোরে।
হেমেন্দ্রবাবুর বয়স আন্দাজ করলাম চল্লিশ বিয়াল্লিশের বেশি নয়। সপ্রতিভ ঝকঝকে চেহারা। চিবুকে দাড়ি। মুখে পাইপ। কর্নেলকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর দিয়ে হাত বাড়ালেন।
করমর্দনের পর কর্নেল আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। হেমেন্দ্র একটু হেসে বললেন, আমি তো ভেবেছিলাম কর্নেলসায়েব এতক্ষণ রাঙাটুলিতে মামাবাবুর ভূতের পেছনে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন।
কর্নেল বললেন, যেতাম। একটু বাধা পড়ে গেল। তো পরশু রাতে তোমার বাবা কীভাবে বাড়ি ফিরেছিলেন?
সে এক কেলেংকারি! হেমেন্দ্র হাসলেন। আমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে জলে আটকে গেলাম। ইঞ্জিনে জল ঢুকে গাড়ি বিগড়ে গেল। ওই অবস্থায় গাড়ি ফেলে রেখে কাছাকাছি একটা গ্যারাজে গিয়ে লোক ডেকে–সে এক বিশ্রি ঝামেলা। বাড়ি ফিরলাম গ্যারাজের একটা গাড়ি নিয়ে। তখন রাত প্রায় একটা। ফিরে দেখি, শালা ঘুমোচ্ছন। জানতাম, আমার অপেক্ষা করবেন না। কিন্তু এই ট্রাজেডির মধ্যে একটা কমেডিও আছে। আমার গাড়ি জলে ডুবেছিল আপনার বাড়ির কাছাকাছি। আসলে শর্টকাটে আসতে গিয়েই পড়লাম অগাধ জলে।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে নাকি?
হ্যাঁ। সি দা ফান। তার ওপর লোডশেডিং সারা এলাকায়।
এই রাস্তাটায় আজকাল এক কোমর জল জমে যায়। কর্নেল চুরুট ধরিয়ে ললেন, তুমি কি ওলসন হাউস চেনো? ওই রাস্তায় বাড়িটা পড়ে।
হেমেন্দ্র একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। ওলসন হাউস! নামটা চেনা মনে হচ্ছে। হ্যাঁ–আজই কাগজে পড়েছি। একটা মার্ডার হয়েছে ওই বাড়িতে। আপনি–
হ্যাঁ। আমি ইন্টাররেস্টেড। চন্দ্রিকাকে তুমি চিনতে।
হেমেন্দ্র একটু চুপ করে থেকে আস্তে বললেন, চিনতাম। দ্যাটস আ লং স্টোরি। কিন্তু আমি আজ কাগজ পড়েই জানলাম চন্দ্রিকা ওই বাড়িতে থাকত এবং কলগার্ল হয়ে উঠেছিল। আশ্চর্য লাগছে, চন্দ্রিকা মাঝে মাঝে আমার অফিসেও আসত। চাকরির জন্য বলত। কিন্তু আমি জানতাম, ওর নামে ওর স্বামীকে মার্ডারের চার্জ আছে। তাছাড়া ওকে তো ছোটবেলা থেকেই চিনি। ওর স্বামী রথীন আমার মামাতো ভাই ছিল। কিন্তু আমার পক্ষে ওর জন্য কিছু করা সম্ভব ছিল না।
তুমি ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির সঙ্গে ওকে মিশতে বারণ করতে শুনেছি।
কে বলল? হেমেন্দ্রর চোখ জ্বলে উঠল। ইন্দ্রজিৎ বলল আপনাকে?
ইন্দ্রজিৎকে ডিস্কো নামে কোন মাফিয়া ডন কিডন্যাপ করে এক লাখ টাকা চেয়েছে।
হেমেন্দ্র চমকে উঠলেন। বলেন কী! কে ডিস্কো?
বললাম তো, মাফিয়া ডন। ওলসন হাউসের কলগার্লদের মালিক।
হেমেন্দ্র আবার একটু চুপ করে থেকে বললেন, ইন্দ্রজিতের সঙ্গে আপনার আলাপ আছে মনে হচ্ছে। সে বলেছে আমি চন্দ্রিকাকে ওর সঙ্গে মিশতে বারণ করতাম?
না। ইন্দ্রজিৎবাবুর স্ত্রী।
মৃদুলা? মৃদুলা–আশ্চর্য তো!
উত্তেজিত হয়ো না প্লিজ। কর্নেল একটু হেসে বললেন, মৃদুলা ভুল বুঝতেই পারেন। কিন্তু ইন্দ্রজিতের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কেমন ছিল, তোমার মুখেই জানতে চাই।
কফি খান, বলছি।
হেমেন্দ্র সুইচ টিপে ঘণ্টা বাজালেন। একজন বেয়ারা এলে তাকে কফি আনতে বললেন। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে হাসবার চেষ্টা করলেন। মৃদুলাকে নিশ্চয় ইন্দ্রজিৎ ভুল বুঝিয়েছে। ইন্দ্রজিৎ নাটক করে। নিজেকে শিল্পী বলে। কিন্তু এটা ওর চরিত্রের অন্য দিক। মুখোশ বলতে পারেন। আপনি কি জানেন ইন্দ্রজিৎ এক সময় ট্রেড ইউনিয়ন করত ধানবাদ এরিয়ায়? ও ধানবাদেরই ছেলে। আমার মামাবাবু বটুক চৌধুরী এম এল এ ছিলেন আপনি তো জানেন। মামাবাবুও ট্রেড ইউনিয়ন করতেন। সেই সূত্রে ইন্দ্রজিৎ রাঙাটুলিতে মামাবাবুর বাড়ি যাতায়াত করত। তারপর মৃদুলার সঙ্গে কী ভাবে প্রেম-টেম করে ফেলে। মৃদুলার বাবা তখন পাটনা য়ুনিভার্সিটির অধ্যাপক। ইন্দ্রজিৎ মৃদুলাকে নিয়ে কলকাতা চলে আসে। বিয়ে করে। ট্রেড ইউনিয়ন করেই ইন্দ্রজিৎ প্রচুর পয়সা কামিয়েছিল। মামাবাবু জানতেন ইন্দ্রজিৎ রাজনীতিতে তাঁকে ডোবাবে। তাই তার সংশ্রব এড়িয়ে চলতেন। আমি নিজের কানে শুনেছি, মামাবাবু জনসভায় চিৎকার করে ইন্দ্রজিতের দুর্নীতির মুখোশ খুলে দিচ্ছেন। এ জন্যই আমার সন্দেহ, ইন্দ্রজিৎ মামাবাবুর বিরুদ্ধে কলকাতায় বসে কলকাঠি নেড়েছে। গত বছর মামাবাবু নিখোঁজ হয়ে যান। তারপর ড্যামের জলে ওর বডি পাওয়া যায়। ইন্দ্রজিৎ পুরনো রাগ ঝাড়তেই ওর একসময়কার চেলাদের দিয়ে মামাবাবুকে মার্ডার করিয়েছিল। এবার বুঝুন, ইন্দ্রজিতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী ধরনের ছিল।
কফি এল। হেমেন্দ্র বললেন, কফি খান। আরও বলছি।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, কিন্তু কলকাতায় তোমার সঙ্গে ইন্দ্রজিতের যোগাযোগ ছিল। প্লিজ এক্সপ্লেন ইট।
যোগাযোগের প্রশ্নই ওঠে না। আমার বাড়ির পাশেই রথীন একটা বাড়ি করেছিল। আমি আমার ঘর থেকে দেখতে পেতাম ইন্দ্রজিৎ রথীনের সঙ্গে মদ খাচ্ছে। চন্দ্রিকাও ওদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। কাজেই রথীনকে আড়ালে সাবধান করে দিতাম ইন্দ্রজিৎ সম্পর্কে। কিন্তু রথীনের আর্থিক অবস্থা ক্রমশ পড়ে এসেছিল। ইন্দ্রজিৎ ওকে মদ যোগাত। আমি চন্দ্রিকাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম। চন্দ্রিকাও আমার ওপর খাপ্পা হয়েছিল। চন্দ্রিকা ছিল যাকে বলে স্পয়েল্ড চাইল্ড। এক রাত্রে দেখি, রথীন মাতাল হয়ে লনে পড়ে আছে। আর চন্দ্রিকা ইন্দ্রজিতের সঙ্গে ….. সরি। আমার খারাপ কথাবার্তা বলা অভ্যাস নয়।
তুমি ইন্টারভেন করেছিলে কি?
হ্যাঁ। আফটার অল রথীন আমার মামাতো ভাই।
তুমি মৃদুলাকে ফোন করে বলেছিলে—
হ্যাঁ। মৃদুলাকে বলেছিলাম, ওর স্বামী চন্দ্রিকাকে যেন অ্যাভয়েড করে। আসলে চন্দ্রিকার বদনাম দিয়ে ভয় দেখিয়েছিলাম মৃদুলাকে।
রথীন খুন হয়েছিল কীভাবে?
বাড়িতেই ওর গলাকাটা ডেডবডি পাওয়া যায়। চন্দ্রিকা উধাও। বডি পচে গন্ধ ছুটছে। তখন ব্যাপারটা জানা যায়। কাজেই স্বভাবত চন্দ্রিকাকে পুলিশের সন্দেহ হয়।
তুমি বলছিলে, চন্দ্রিকা তোমার কাছে চাকরির জন্য আসত।
ইদানিং আসত। রথীন খুন হয়েছে ছ-সাত বছর আগে।
কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়ার ভেতর বললনে, রথীনের খুন হওয়া সম্পর্কে তার বক্তব্য জানতে চাওনি?
হেমেন্দ্র উত্তেজিত ভাবে বললেন, কেন চাইব না? হঠাৎ যেদিন প্রথম এল, আমি সেইদিনই চার্জ করেছিলাম ওকে। কেঁদে ফেলল। তারপর বলল, সে-রাতে এর সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়েছিল। রথীন ওকে মেরেছিল। চন্দ্রিকা নিজের কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যায়। রথীন তখন মাতাল অবস্থায় ছিল। গালাগালি দিয়ে দরজা ভেতর থেকে এঁটে দেয়। তারপর কী হয়েছে, চন্দ্রিকা জানত না।
চন্দ্রিকা কোথায় আশ্রয় নিয়েছিল তারপর?
চন্দ্রিকার কথা আমি বিশ্বাস করিনি। বলেছিল, ও নাকি ওর এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গিয়েছিল–বিডন স্ট্রিটের ওদিকে কোথায় যেন। ওর জ্যাঠামশাই হরনাথবাবুর অ্যাডভোকেটকে ওর সেই আত্মীয় নাকি অ্যাপ্রোচ করেছিলেন। কারণ চন্দ্রিকার নামে তখন হুলিয়া করেছে পুলিশ। দ্যাটস আ লং স্টোরি। চন্দ্রিকার কথার সত্যি মিথ্যে বোঝা কঠিন ছিল আমার পক্ষে।
চন্দ্রিকা এরপর ইন্দ্রজিতের পাল্লায় পড়েছে তুমি কী ভাবে জেনেছিলে?
চন্দ্রিকা একদিন কথায় কথায় বলেছিল, ইন্দ্রজিতের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে আবার। আমি চাকরির ব্যবস্থা না করে দিলে সে ওর নাটকের দলে ঢুকবে। চন্দ্রিকাকে নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না। কাজেই আমি বলেছিলাম, চান্স পেলে ছেড়ো না। আসলে আমি ওকে এড়াতে চেয়েছিলাম।
কর্নেল হাসলেন। গত পরশু রবিবার সন্ধ্যায় ইন্দ্রজিতের নাটক দেখতে গিয়েছিলে তুমি। আমি তোমাকে দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু নাটক শেষ হওয়ার পর ভিড়ে আর দেখিনি।
হেমেন্দ্র চমকে উঠলেন। তারপর শুকনো হেসে বললেন, হ্যাঁ। আপনাকেও দেখেছি। সামনে গেস্টের সিটে ছিলেন। তবে নাটক শেষ হওয়ার পর আমিও ভিড়ে আপনাকে আর খুঁজে পাইনি। বৃষ্টি পড়ছিল বলে বাড়ি চলে গেলাম। গিয়ে শুনি, বাবা আপনার বাড়িতে এসেছেন। গাড়ি পাঠাতে বলেছেন। তখন–
তুমি ডানদিকে দ্বিতীয় সারিতে ছিলে।
হেমেন্দ্র ব্যস্তভাবে বললেন, চন্দ্রিকা শনিবার অফিসে ফোন করেছিল। ও সত্যিই ইন্দ্রজিতের নাটকে চান্স পেয়েছে। আমি নাটকটা দেখলেও খুশি হবে। কিছুক্ষণ পরে একটা লোক এসে গেস্টকার্ড দিয়ে গেল। কাজেই নিছক কৌতূহলে আমি নাটক দেখতে গিয়েছিলাম।
একা গিয়েছিলে!
হেমেন্দ্র আবার শুকনো হাসলেন। চন্দ্রিকা আমার স্ত্রীর পরিচিত। কাজেই দুটো কার্ড পাঠালেও আমি একা যাওয়া উচিত মনে করেছিলাম। বলে উনি ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলেন। ঘড়ি দেখে বললেন, আপনি ডিটেকটিভ কথাটা শুনলে চটে যান। কাজেই কথাটা বলছি না। কে চন্দ্রিকার মার্ডার-মিস্ট্রি সলভ করার জন্য আপনাকে অ্যাপ্রোচ করেছে? ইন্দ্রজিৎ?
নাহ্। চন্দ্রিকা।
হেমেন্দ্র টেবিলের ওপর ঝুঁকে এলেন। চন্দ্রিকা বুঝতে পেরেছিল তাকে মার্ডার করা হবে?
চন্দ্রিকার কাছে একটা মূল্যবান কাগজ ছিল। সে বুঝতে পেরেছিল, ওটা কেড়ে নেওয়ার জন্য তাকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। কর্নেল একটু হেসে ফের বললেন, বাই এনি চান্স, তুমি রবিবার রাতে নাটক শেষ হওয়ার পর ওর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলে?
হেমেন্দ্র আস্তে বললেন, হ্যাঁ। ওকে গ্রিনরুমে না পেয়ে চলে এসেছিলাম। গেটের কাছে দেখি, চন্দ্রিকা একটা ট্যাক্সিতে চাপছে। ইন্দ্রজিৎ দৌড়ে গেল ওর কাছে। তারপর দেখলাম, ট্যাক্সি চলে গেল। ইন্দ্রজিতের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে আমার ছিল না। তাই আমি আমার গাড়ির কাছে চলে গেলাম। দ্যাটস অল। কিন্তু চন্দ্রিকার মূল্যবান কাগজটা কী?
জানি না।
চন্দ্রিকাকে কেউ মার্ডার করে সেটা হাতিয়েছে?
তা-ও জানি না। আর তোমার সময় নষ্ট করব না। এবার তোমার বাবার কথায় আসা যাক। শুধু একটা প্রশ্ন। তোমার বাবার ঘরের সামনে কে একটা কাগজ ফেলে গেছে। তাতে লেখা আছে চাই চিচিং ফাঁক।
বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সাইকিক পেশ্যান্ট হয়ে পড়েছেন।
চাই চিচিং ফাঁক কথাটা তুমি শুনেছ এর আগে?
নেভার। সব বাবার পাগলামি।
আচ্ছা, উঠি। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। একটু হেসে বললেন, চন্দ্রিকার খুনীকে ধরার জন্য তোমার সহযোগিতা ভবিষ্যতেও দরকার হতে পারে, হেমেন। আশা করি, পাব।
সিওর। উঠে দাঁড়ালেন হেমেন্দ্র। তারপর বিদায় অভ্যর্থনার ভঙ্গিতে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন আমাদের….
.
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললাম, হেমেনবাবুর বক্তব্য শুনে খটকা লেগেছে আমার।
কর্নেল বললেন, কী খটকা?
পরশু রাতে উনিই চন্দ্রিকাকে ফলো করেছিলেন এবং ওঁর ভয়েই চন্দ্রিকা আমাদের গাড়িতে লিফট নিয়েছিল বলে আমার সন্দেহ হচ্ছে।
আর কিছু?
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের চন্দ্রিকা খুন হওয়ার সময় হেমেন্দ্র কাছাকাছি ছিলেন। গাড়ি জলে আটকে গিয়েছিল।
কর্নেল একটু পরে বললেন, ডিস্কোর পরিচয় না জানা পর্যন্ত হেমেনকে আমি ক্লিন সার্টিফিকেট দিচ্ছি।
ফিল্মে দেখেছি এই ধরনের বিগ বিজনেসম্যান আড়ালে মাফিয়া ডন হয়। তাদের অনেক ডামি থাকে।
কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। তারপর বললেন, এ বেলাও আমার বাড়ি তোমার লাখের নেমন্তন্ন। না ডার্লিং। রহস্যের পাঁকে হাবুডুবু খাচ্ছি। তুমি সঙ্গে থাকলে ভরসা পাই। মাঝে মাঝে আমাকে তুমি জেরায় জেরবার করবে কিন্তু। কোনও খটকা লাগলে বলবে। তাতে আমার দৃষ্টি পরিষ্কার হবে।
কর্নেলের বাড়ি পৌঁছে গাড়ি পার্কিং জোনে রাখলাম। কর্নেল বললেন, ভেবো আমার অম্নে ভাগ বসাবে। ষষ্ঠীকে বলা আছে।
তেতলায় ডোরবেলের সুইচ টিপলে ষষ্ঠী দরজা খুলে দিল। বলল, নালবাজারের নাহিড়িসায়েব ফোং করেছিলেন। আপনাকে ফোং করতে বলেছেন।
কর্নেল বললেন, করছি ফোং। তুই খাবার রেডি কর। আজ আমি স্নান করব না। জয়ন্ত, তুমিও কোরো না। বাইরে থেকে ঘেমে তেতে এসে সে-বেলা আর স্নান করা উচিত নয়। নাকি করবে?
বললাম, আমি স্নান করেই বেরিয়েছি আজ।
ফাইন। বলে কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। এনগেজড টোন নিশ্চয়। কিছুক্ষণ পরে আবার ডায়াল করলেন। এবার সাড়া পেয়ে বললেন, অরিজিৎ? ….কী? …হ্যাঁ। তারপর? ….বলো কী? …হ্যাঁ। লোক রাখার ব্যবস্থা করাই ঠিক। …অবশ্য। রাতেও থাকবে।….থ্যাংকস। ছাড়ছি।
ফোন রেখে কর্নেল বললেন, হ্যারি ওলসনের কাজের লোকটাকে ডিস্কোর এক চেলা এসে হুমকি দিয়েছে। সে প্রাণ নিয়ে কেটে পড়েছে। ওলসনকেও শাসিয়ে গেছে, পুলিশের কাছে বেফাঁস কিছু বললে খতম করে ফেলবে। এমনকি আমার নাম করে বলেছে, ওই বুড়ো ঘুঘুকেও কিছু বললে বডি ফেলে দেবে। ভয়ে ওলসনসায়েব কাঠ। ভাগ্যিস, আজ ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর অশোকবাবু ওলসন হাউসে আবার গিয়েছিলেন। ওলসন তাঁকে জানিয়েছেন। তারপর এখন সারাক্ষণ পুলিশ থাকছে ওলসন হাউসে।
রাগ হলো। বললাম, ডিস্কোর ফোন নাম্বার তো আপনার জানা। পুলিশকে বলছেন না কেন? ওই নাম্বার কার, সেটা টেলিফোন দফতর থেকে জেনে নিক। পুলিশকে সব গোপন নাম্বার জানাতে ওঁরা বাধ্য।
সময় হলে বলব। ডিস্কোর সঙ্গে আমার আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার দরকার এখনও শেষ হয়নি। যাক্ গে। বাথরুমে গিয়ে আগে একটু জলস্পর্শ করি।….
খেতে বসে বললাম, একটা পয়েন্ট আপনার দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
কর্নেল তাকালেন।
ওলসনসায়েব বলছিলেন, চন্দ্রিকা ডিস্কোকে হুমকি দিয়ে কথা বলত।
হুঁ। বলত। তাতে কী?
চন্দ্রিকা ব্ল্যাকমেল করত না তো ডিস্কোকে?
হয়তো করত। কিন্তু ব্ল্যাকমেল কিসের ভিত্তিতে করত, সেটা যতক্ষণ না জানা যাচ্ছে ততক্ষণ ব্ল্যাকমেল কথাটা মাথায় রাখা উচিত নয়।
ধরুন, পুলিশকে তার আসল পরিচয় ফাঁস করে দেব বলে হুমকি দিত।
কর্নেল মুর্গির ঠ্যাং কামড়ে ধরে বললেন, তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ডিস্কো নাকি গভর্নমেন্টের ওপরমহলে প্রভাবশালী লোক।
তাহলে হেমেনবাবুর ডিস্কো হওয়ার চান্স আছে।
কেন?
তার মামা বটুক চৌধুরী ছিলেন এম এল এ। এদিকে হেমেনবাবুর বাবার সঙ্গে তাঁর শ্যালকের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল এবং হেমেনবাবুর সঙ্গে তাঁর বাবার সম্পর্ক নাকি ভাল নয়–আপনিই বলছিলেন। সম্পর্ক খারাপের কারণ হেমেনবাবুর সঙ্গে বটুকবাবুর ঘনিষ্ঠতা। এই হলো আমার থিওরি। অর্থাৎ হেমেনবাবু মামার সাপোর্টার ছিলেন। এতে তাঁর বাবা ক্ষুব্ধ হতেই পারেন।
সম্পর্ক খারাপ বলতে এমন কিছু খারাপ নয়– কর্নেল ঠ্যাং চিবুতে চিবুতে বললেন, তত খারাপ হলে ছেলের বাড়িতে উঠবেন কেন? আসলে অমরেন্দ্রর সঙ্গে হেমেন্দ্রর সম্ভবত পারিবারিক কোনও বিষয়ে মতান্তর আছে। এটা আমি আঁচ করেছিলাম, হেমেনবাবুর দিদি সুনন্দার কথায়। সুনন্দা বলেছিল, হেমেনের সন্দেহ, বাবা সব প্রপার্টি আমাকে এবং সত্যকামকে উইল করে দিয়েছেন। হেমেনের টাকার অভাব নেই। কিন্তু টাকার ওপর ভীষণ লোভ আছে। সুনন্দার ভার্সান এটা। এদিকে অমরেন্দ্রর বক্তব্য হলো, হেমেন সুনন্দাকে দেখতে পারে না। পারিবারিক দ্বন্দ্ব বলা চলে। এমনটা হয়েই থাকে। ও! তোমাকে বলতে ভুলেছি, সুনন্দা এবং হেমেন এক মায়ের সন্তান নন। সুনন্দার মা মারা যাওয়ার পর অমরেন্দ্র দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বটুক চৌধুরীর বোন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী এবং হেমেনের মা।
কর্নেল বরাবর বলেন, খাওয়ার সময় কথা বলা উচিত নয়। কিন্তু আজ তাঁর নিয়মের ব্যতিক্রম দেখে বুঝতে পারছিলাম, সত্যিই তিনি রহস্যে হাবুডুবু খাচ্ছেন। রাঙাটুলির সিংহরায় পরিবারের পুরনো কাহিনী শোনাচ্ছিলেন। আমি শুনছিলাম না। ডিস্কোর মূর্তি হেমেন্দ্রের চেহারায় আরোপ করছিলাম। চমৎকার খাপ খাচ্ছিল। এমনকি, চন্দ্রিকার ডিস্কোকে ব্ল্যাকমেল করার থিওরিও মানিয়ে যাচ্ছিল। কারণ হেমেন্দ্রের আমদানি রফতানির কারবার আছে। এই সুযোগে নিষিদ্ধ ড্রাগের কারবার চালানো অসম্ভব নয়। চন্দ্রিকা কি ব্ল্যাকমেল করার ব্যাপারে ইন্দ্রজিতের সাহায্য নিয়েছিল?
ইন্দ্রজিতের তদ্বিরেই কিন্তু ওলসন হাউসে পুলিশ হানা দিয়েছিল। অরিজিৎ লাহিড়ি অবশ্য বলছিলেন, নার্কোটিকস পাওয়া যায়নি এবং ওটা পাবিলকখাওয়ানো উড়ো খবর। তার মানে, ডিস্কো এত প্রভাবশালী যে ডি সি ডি ডি রও কিছু করার ক্ষমতা নেই।
তাছাড়া হেমেন্দ্র সিংহরায়ের মতো বড় ব্যবসায়ীরাই তো রাজনৈতিক দলের ফান্ডে মোটা চাঁদা জোগান। অতএব হেমেন্দ্রর ডিস্কো হওয়ার চান্স উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আরও একটা পয়েন্ট। কর্নেলের কাছে জানা গেল, সুনন্দা বলেছিলেন, হেমন্দ্রের টাকার ওপর ভীষণ লোভ। অর্থাৎ ভদ্রলোক অর্থলোলুপ। কাজেই নগদ এক লক্ষ টাকার জন্য ইন্দ্রজিৎকে কিডন্যাপ করার ঘটনা থেকে সন্দেহের কাঁটা হেমেন্দ্রের দিকেই ঘুরে যাচ্ছে। আবার ইন্দ্রজিৎকে কিডন্যাপ করে বুঝিয়ে দেওয়াও হলো, সাবধান! আমার পিছনে লাগতে এসো না। …
খাওয়ার পর ড্রয়িংরুমে গিয়ে কর্নেল চুরুট টানছিলেন এবং আমি সোফায় লম্বা হয়েছিলাম। আমার থিওরি ওঁকে গেলানোর চেষ্টা করছিলাম। কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে শুনছিলেন এবং মাঝে মাঝে হুঁ দিচ্ছিলেন।
সেই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল বললেন, জয়ন্ত। ফোন ধরো।
ফোন তুলে সাড়া দিলাম। মহিলা কন্ঠে কেউ বলল, এটা কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের ফোন?
হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?
আপনি কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছেন?
নাহ্। আপনি কে?
কর্নেলসায়েব কি নেই?
আছেন। কিন্তু আপনি কে বলছেন?
প্লিজ! কর্নেলসায়েবকে দিন না! আমি তাঁর সঙ্গেই কথা বলতে চাই।
মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে কর্নেলকে বললাম, কোনও মহিলা। নাম বলছেন না। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।
কর্নেল হাত বাড়িয়ে ফোন নিয়ে বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। তারপর বেশ কিছুক্ষণ ক্রমাগত হ্যাঁ, হুঁ করে গেলেন। শেষে বললেন, থ্যাংক। রাখছি। তারপর ফোন রেখে দিলেন।
বললাম, ডিস্কোর কোনও মেয়ে চেলা নিশ্চয়?
কর্নেল হাসলেন। ভদ্রভাষায় বলা চলে, ডিস্কোচক্রের প্রাক্তন সদস্যা। এই একটা ব্যাপার আমি বরাবর দেখে আসছি, জয়ন্ত, আমি কোনও রহস্যসমাধানে নামলে জানা-অজানা অনেক লোক আড়াল থেকে আমাকে ক্ল যোগাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু সমস্যা হলো, এই সুযোগটা আমার প্রতিপক্ষও নিতে ছাড়ে না এবং ভূল পথে ছোটাতে চায়। চেজিং আফটার আ রেড হেরিং টার্মটা আমার মুখে বহুবার শুনেছ। সোজা বাংলায় বলা চলে আলেয়ার পিছনে দৌড়ানো। কেউ কেউ আলেয়া তৈরি করে রহস্যের অন্ধকারে।
এই মহিলাও কি আলেয়ার দিকে ছোটাতে চাইছেন আপনাকে?
কর্নেল মাথা নাড়ালেন গম্ভীর মুখে। জানি না।
কী বলল, বলতে আপত্তি আছে?
বলল, সে একসময় ওলসন হাউসে থাকত। চন্দ্রিকাকে চিনত। চন্দ্রিকা নাকি ডিস্কোর খুব বিশ্বস্ত ছিল। নার্কোটিকসের কারবার আছে ডিস্কোর। চন্দ্রিকাকে ডিস্কো ওই কারবারেই নাকি ব্যবহার করত। কমাস আগে নার্কোটিকসের একটা পেটি চন্দ্রিকার ঘরে ডিস্কোর লোক এসে দিয়ে যায়। চন্দ্রিকার ঘর থেকে সেটা আশ্চর্যভাবে হারিয়ে যায়। আসলে চন্দ্রিকাই নাকি সেটা হাপিজ করেছিল। সেই নিয়ে ডিস্কোর সঙ্গে চন্দ্রিকার বিবাদ বাধে। কিন্তু ডিস্কো চন্দ্রিকাকে ঘাঁটাতে সাহস করেনি, পাছে চন্দ্রিকা সব ফাঁস করে দেয়। তাছাড়া ইন্দ্রজিৎ ব্যানার্জির সঙ্গে চন্দ্রিকার চেনাজানা ছিল। ইন্দ্রজিৎবাবুরও নাকি গভর্নমেন্টের ওপরমহলে যোগাযোগ আছে। পুলিশে তো আছেই, তাছাড়া কোন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও নাকি ওঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তাই ডিস্কো সাবধানে চন্দ্রিকাকে ট্যাল্ করত। তারপর ডিস্কো মরিয়া হয়ে চন্দ্রিকাকে খতম করেছে বলে মেয়েটির ধারণা।
নাম কী মেয়েটির? নাম বলল না। চন্দ্রিকার সুত্রে ইন্দ্রজিৎবাবুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। জিৎবাবু তাকে ওলসন হাউসের পাপপুরী থেকে–, পাপপুরী শব্দটাই বলল মেয়েটি–
উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম শুনতে শুনতে। দ্রুত বললাম, ইন্দ্রজিৎবাবু ওকে পাপপুরী থেকে উদ্ধার করেছিলেন। এই তো?
হ্যাঁ। এখন সে সৌরভ নাট্যগোষ্ঠীর অভিনেত্রী। ভদ্র জীবনযাপন করছে। ইন্দ্রজিৎবাবুর প্রতি সে কৃতজ্ঞ।
আপনার নাম ঠিকানা পেল কোথায় বলল না?
ওলসনসায়েব তার চেনা। তাই ওঁকে ফোন করে সব কথা বলেছে। উনি তাকে আমার ফোন নাম্বার এবং নাম ঠিকানা দিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
তা হলে ব্যাপারটা আলেয়া নয় কর্নেল।
কেন নয়?
ওলসন বলছিলেন, তাঁর সন্দেহ, তাঁর ফোন ডিস্কো ট্যাপ করেছে। কাজেই আজ তাঁর কাজের লোক এবং তাঁকে ডিস্কোর চেলাদের হুমকি দেওয়ায় বোঝা যাচ্ছে, এই মেয়েটির কথা ডিস্কো জেনে গেছে। আমার ভয় হচ্ছে, মেয়েটির কোনও বিপদ না হয়। ইন্দ্রজিৎবাবু এখন ডিস্কোর কবলে।
কর্নেল চোখ বুজে আস্তে বললেন, আমি সে-কথা ভাবছি না। ভাবছি, চন্দ্রিকার সঙ্গে আলাপের ব্যাপারটা কেন ইন্দ্রজিৎবাবু বানিয়ে বলেছে আমাকে? জয়ন্ত, আমি অসত্যভাষীদের পছন্দ করি না। বিশেষ করে আমার সাহায্য যারা চায়, তারা আমাকে কিছু গোপন করলে আমি আর তাদের পাত্তা দিই না।