রাতে রোজকার মতো দাবা খেলতে বসে
রাতে রোজকার মতো দাবা খেলতে বসে জয়ধ্বনি বললেন, “বুঝলে লাহিড়ী, তুমি বয়সকালে অনেক শেয়াল-টেয়াল মেরেছ। বটে, রোগাপটকা লোকদের ধরে ধরে এনে কুস্তিতেও হারিয়েছ, কিন্তু আমার নাতি জয়পতাকা আজ যা কাণ্ড করেছে শুনলে তোমার নিজের জন্য দুঃখ হবে।”
শ্যাম লাহিড়ী খুব গম্ভীর মুখে বললেন, “তোমার নাতির ঘটনা সবই শুনেছি। কিন্তু বয়সকালে আমি মোটেও শেয়াল মারিনি। মেরেছি পাগলা হাতি আর মানষুখেকো বাঘ।”
জয়ধ্বনি খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “রাখো রাখো। মেরেছ তো বন্দুক দিয়ে। ভারী বাহাদুরি। বাঘের তো দাঁত-নখ ছাড়া কিছু নেই, হাতি বেচারার সম্বল শুধু গায়ের জোর আর গুঁড়, তাদেরও যদি রাইফেল বন্দুক থাকত তা হলেও না হয় বুঝতাম। পারবে আমার নাতির মতো খালি হাতে লড়তে? আমি তো জয়পতাকাকে একটা সোনার মেডেল দেব বলেছি। একটু আগে ঊ্যাড়া পিটিয়ে গেল, শুনেছ? জয়পতাকাকে পরশু নাগরিক সংবর্ধনাও দেওয়া হবে।”
“শুনেছি। আরও শুনেছি, ওইদিনই আবার জয়পতাকাকে নিন্দা করে আর-একটা সভায় একটা প্রস্তাবও নেওয়া হবে। ওই মর্কট ব্যোমকেশ দুটো সভারই সভাপতি।”
“কিছু লোক হিংসেয় জ্বলেপুড়ে মরছে। তারাই করছে ওসব।”
শ্যাম লাহিড়ী একটা বড় শ্বাস ফেলে বললেন, “জয়পতাকা খুব ভাল ছেলে। শুনেছি তার অঙ্কের মাথা খুব সাফ।”
“শুধু অঙ্ক? অঙ্ক ম্যাথমেটিক্স অ্যালজেব্রা, জিওমেট্রি, পাটীগণিত, জ্যামিতি, অ্যারিথমেটিক, বীজগণিত কোনটায় নয় বলো! শুনেছি ভূগোল, ইতিহাস এসবও তার মাথায় খুব খেলে। বিজ্ঞান বলে বিজ্ঞান, সায়েন্স বলল সায়েন্স, কোনটায় সে কার চেয়ে কম?”
শ্যাম লাহিড়ী গম্ভীর মুখে বললেন, “দ্যাখো জয়ধ্বনি, তুমি সেই যে কাশীর টোলে সংস্কৃত শিখে এসেছিলে, তারপর আর দুনিয়ার কিছুই শেখোনি।”
জয়ধ্বনি ফের খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “যে সংস্কৃত শিখেছে তার আবার কিছু শেখার আছে নাকি? সংস্কৃত হচ্ছে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, দুপাতা ইংরেজি, দুপাতা অঙ্ক শিখলেই বুঝি চতুর্ভুজ হওয়া যায়? এই যে তুমি এত শিখলে, গাদাগাদা পড়া মুখস্থ করলে, তা পারলে ব্যোমকেশের মতো মুখ্যর সঙ্গে এঁটে উঠতে? তুমি এত শিখে বুড়ো বয়সে ঘরে বসে বসে লেজ নাড়ছ, আর ওদিকে ব্যোমকেশ পৌরপিতা হয়ে কত জায়গায় দাবড়ে বক্তৃতা দিয়ে আসর গরম করে বেড়াচ্ছে।”
শ্যাম লাহিড়ী মৃদু মৃদু হেসে বললেন, “ভুলে যাচ্ছ কেন যে, এটা কলিযুগ! কলিযুগে কী হয় জানো? যত ভাল লোক সবাই মাথা নিচু করে থাকে। আর খারাপ, মুখ্য, অপদার্থরা দাবড়ে বেড়ায়।”
“ওসব হচ্ছে হিংসুটেদের মতো কথা। ব্যোমকেশের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে তুমি এখন কলিযুগের দোহাই দিচ্ছ। কলিযুগ তো কী? এই কলিযুগেই তো আমার নাতি কত বড় একখানা কাণ্ড করে দেখাল।”
শ্যাম লাহিড়ী নিমীলিত চোখে চেয়ে বললেন, “তোমার নাতি হল সাক্ষাৎ কল্কি অবতার। তা সেই জাম্বুবানটা কালুর পিঠে চেপে গেলই বা কোথায়?”
“সে কালুকে দেশছাড়া করে তবে ফিরবে।”
শ্যাম লাহিড়ী মৃদু একটু হেসে বললেন, “তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, কালুর কত বয়স তা জানো?”
জয়ধ্বনি একটু বিপাকে পড়ে মাথা চুলকে বললেন, “কালুর বয়স! তা মন্দ হবে না। অনেককাল ধরেই তো তাকে দেখছি।”
“আমার হিসেবমতো সত্তরের ওপর। আশির কাছাকাছি।”
“তা হবে, তাতে কী?”
“তোমার নাতি যে কালুকে জব্দ করেছে বলে খুব বড়াই করছ, তুমি কি জানো যে, কালুর চোখে ছানি এসেছে। তার ব্লাডপ্রেশারও বেশ হাই! হার্টেরও একটু গোলমাল আছে। সে সুস্থ সবল এবং তরুণ হলে জয়পতাকা কি তাকে কাবু করতে পারত?”
জয়ধ্বনি হাঁ করে কিছুক্ষণ শ্যাম লাহিড়ীর দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “কালুর চোখে ছানি? প্রেশার!! হার্ট-ট্রাবল? ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পাওনি? তোমার সঙ্গে দাবা খেলতে বসাই আমার ভুল হয়েছে। আমি চললুম।”
এই বলে রাগ করে জয়ধ্বনি দাবার খুঁটি হাটকে-মাটকে দিয়ে উঠে পড়লেন।
শ্যাম লাহিড়ী খুব শান্ত গলায় বললেন, “তোমার রাগের কারণও জানি। এই চালটা তুমি বাঁচাতে পারতে না। আমার গজ পরের চালেই তোমার রাজা-মন্ত্রী একসঙ্গে ধরত, সেই ভয়েই না উঠে পড়লে।”
জয়ধ্বনি রাগের চোটে লাটুর মতো বোঁবোঁ করে দুটো চক্কর খেয়ে নিয়ে বললেন, “আমাকে ঘাঁটিও না বলছি লাহিড়ী। রাজা-মন্ত্রী ধরলেই হল? আমি তোমার ও চাল অনেক আগেই দেখে নিয়েছি। রাজা-মন্ত্রী ধরলে ঘোড়া দিয়ে চাল চাপা দিতুম। তারপর বোড়ে ঠেললেই তোমার গজ লেজ তুলে পালিয়ে যেত, যেমন আমার নাতির পাল্লায় পড়ে কালু পালিয়েছে। বুঝলে?”
শ্যাম লাহিড়ী গম্ভীর হয়ে বললেন, “রাগ কোরো না। বোসো। কালু পালিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তোমার নাতিকে পিঠে নিয়েই পালিয়েছে। ব্যাপারটা আমার সুবিধের ঠেকছে না। যতদূর খবর পেয়েছি, কালু জয়পতাকাকে পিঠে নিয়ে উত্তর দিকে গেছে। ওদিকটায় পটাশগড়ের জঙ্গল। জায়গাটার খুব সুনাম নেই, তুমিও জানো।”
জয়ধ্বনি এবার একটু নরম হলেন। বসলেনও। তারপর বললেন, “পটাশগড়ের জঙ্গলেই যে ঢুকেছে তার তো কোনও প্রমাণ নেই।”
শ্যাম লাহিড়ী মাথা নেড়ে বললেন, “নেই। তবে তোমাকে যা বললুম তা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিও না। কালুর চোখে ছানি পড়েছে কি না বা তার রক্তচাপ আছে কি না, তা জানি না। কিন্তু খ্যাপা ষাঁড় খুবই ভয়ঙ্কর। তার দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকে না। যদি পটাশগড়ের জঙ্গলেই ঢুকে থাকে, তা হলে একটু ভাবনার কথা। তোমার নাতি যত বীরই হোক, তাকে আমি বেজায় ভীতু বলেই জানি।”
জয়ধ্বনি এবার চিন্তিত মুখে কোঁচার খুঁট দিয়ে মুখোনা মুছে বললেন, “এ তো বেশ ভাবনায় ফেললে ভায়া।”
শ্যাম লাহিড়ী খুবই বিষণ্ণ মুখে বললেন, “আমি যখন শিকার করতুম তখনও পারতপক্ষে পটাশগড়ের জঙ্গলে যেতুম না। যেবারকয়েক ওখানে ঢুকেছি, প্রতিবারই নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছে।”
“কীরকম অভিজ্ঞতা?”
“শুনলে তুমি তোমার নাতির জন্য দুশ্চিন্তা করবে।”
জয়ধ্বনি একটু খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “ওটা বলে তো দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিলে। পটাশগড় সম্পর্কে আমিও নানারকম শুনে আসছি বহুকাল ধরে। তা বলে বিশ্বাস করিনি।”
শ্যাম লাহিড়ী মৃদু হেসে বললেন, “তুমি হচ্ছ কুনো বীর। ঘরে বসে ধারণা তৈরি করো, বিশ্বাস করো না ভাল কথা, কিন্তু পটাশগড়ের জঙ্গলে তুমি ঢোকোওনি কোনওদিন। কেন ঢোকোনি জানো? ভয়ে।”
জয়ধ্বনি মহা খাপ্পা হয়ে ফের উঠে পড়লেন, “ভয়! ভয়! আমাকে তুমি ভয়ের কথা বলছ? যদি ভীতুই হতুম হে, তা হলে আমার নাতি আজ এত বড় বীর বলে নাম করতে পারত না। আর জঙ্গলেই বা কেন আমাকে যেতে হবে হ্যাঁ! আমি কাঠুরে না মউলি, না তোমার মতো শেয়াল-তাড়য়া শিকারি যে জঙ্গলে-মঙ্গলে ঘুরে নিজেকে বড় বীর বলে জাহির করতে হবে? আর তোমার বীরত্বও খুব জানা আছে। সেবার ফাগু সিং যখন কুস্তি লড়তে এল, সেবার তো বাপু ন্যাজ দেখিয়েছিলে। ঘর থেকে বারটি পর্যন্ত হলে না। ফাগু সিং লজ্জায়, ঘেন্নায় শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বলে গেল, লাহিড়ীবাবুকে আমি বীর বলে শুনেছিলুম। আরে ছছাঃ, এ তো দেখছি এক নম্বরের ডরফোক লোক।”
শ্যাম লাহিড়ী চোখ বুজে ছিলেন। মৃদুমৃদু মাথা নেড়ে বললেন, “ফাগু সিং যখন এসেছিল তখন আমি এ-শহরে ছিলুম না। যদি থাকতুম, তা হলে ফাগু সিংকে বৃন্দাবন দেখিয়ে দিতুম।”
“ছিলে না মানে? আলবাত ছিলে! তবে ঘরের মধ্যে পালিয়ে ছিলে।”
“বোসো হে বোসো। নিজেকে বীর বলে জাহির করার কোনও দরকারই নেই আমার। বিশ বাইশ বছর আগেকার খবরের কাগজ খুললে দেখতে পাবে যে, ফাগু সিংকে আমি অন্তত চারবার হারিয়েছি। সে এ-শহরে এসেছিল শেষবারের মত আমাকে হারানোর চেষ্টা করতে।”
কথাটা যে মিথ্যে নয় তা জয়ধ্বনি জানেন। বাস্তবিকই ফাগু সিং-এর মতো দুর্দান্ত কুস্তিগিরকে একসময়ে শ্যাম লাহিড়ী পটাপট হারিয়ে দিতেন। তবু জয়ধ্বনি ফের টেবিলে চাপড় মেরে বলেন, “সবাই জানে রামগড়ের জঙ্গলে তুমি যে বাঘটা মেরেছিলে সেটা ফোকলা ছিল। তার একটাও দাঁত ছিল না। সেই বাঘটাকে তুমি ম্যান ইটার বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলে।
শ্যাম লাহিড়ী মাথা নাড়তে-নাড়তে বললেন, “রামগড়ের বাঘটা মোটেই ফোকলা ছিল না। তার দুটো সামনের দাঁত কোনও কারণে ভেঙে গিয়েছিল। তাতে মানুষ খেতে তার কোনও অসুবিধে হত না। সে কড়মড় করে হাড়গোড় গুঁড়িয়েই মানুষ খেত।”
জয়ধ্বনি হার মানার লোক নন। সতেজে বললেন, “আর ইংরেজি বলতে পারো বলে যে তোমার বড় অহঙ্কার, সেটাও ঠিক নয়। ব্যোমকেশ তো সেদিনও বলছিল, শ্যাম লাহিড়ী সাহেবদের সঙ্গে খুব ফটাফট ইংরেজি বলে বটে, কিন্তু সব ভুল ইংরেজি। শুনে সাহেবরা আড়ালে হাসে।”
“ইংরেজি ভুল বলি না ঠিক বলি তা ধরার মতো বিদ্যে ব্যোমকেশের পেটে নেই। সেটা তুমিও জানো। খামোখা চটেমটে আমার ওপর ঝাল ঝাড়ছ কেন? মাথা ঠাণ্ডা করে বসে আসল কথাটা শোনো।”
জয়ধ্বনি ফুঁসছিলেন। তবে বসেও পড়লেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে এরকম ঝগড়া রোজই হয়। মাঝে-মাঝে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। আবার গুটিগুটি এ-ওঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়ে লাজুক লাজুক মুখ করে, হাঁক দেন, “ভায়া, আছ নাকি?” জয়ধ্বনির মাথাটা একটু বেশি গরম, শ্যাম লাহিড়ী ভারী ঠাণ্ডা মাথার লোক।
জয়ধ্বনি বসে কোঁচা দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, পটাশগড়ের কথা কী যেন বলছিলে? যা-ই কেন বলো না, ওসব কথায় আমার কিন্তু তেমন বিশ্বাস নেই।”
“বিশ্বাস করা না করা তোমার ইচ্ছে। তবে জায়গাটা সুবিধের নয়।”
জয়ধ্বনি চিন্তিতভাবে বললেন, “বাঘ-ভালুকের ভয় অবশ্য আছে। কিন্তু আমার ধারণা, কালু খুব চালাক ষাঁড়, সে জয়পতাকাকে পিঠে নিয়েই ঠিক ফিরে আসবে।”
“তাও আসতে পারে। তবে আধঘণ্টা আগে খবর পেলুম, কালু ফিরে এসেছে। বাজারে ঢুকে কার যেন সাতটা মোচা চিবিয়ে খেয়েছে। সঙ্গে কয়েক কেজি চালও সাপটে নিয়েছে। এখন বটতলায় বসে জিরেন নিচ্ছে।”
জয়ধ্বনি পাংশুমুখে বললেন, “তা হলে?”
“সেইটেই তো কথা।”
“আমার মনে হয়, জয়পতাকা কালুর পিঠ থেকে নেমে হেঁটে বাড়ি ফিরে গেছে।”
“অসম্ভব নয়। তবে যদি বাড়ি না ফিরে থাকে তা হলে ঘাবড়ে যেও না।”
জয়ধ্বনি বুক ফুলিয়ে বললেন, “মোটেই ঘাবড়ে যাইনি। জয়পতাকা যে বীরত্বের কাজ করেছে তাতে আমার স্থির বিশ্বাস, সে বিপদে পড়লেও বেরিয়ে আসতে পারবে।” শ্যা
ম লাহিড়ী খুশি হয়ে বললেন, “শাবাশ!”
এই সময়ে কাজের লোক এসে বলল, “হেডসার বিষ্ণুবাবু দেখা করতে এসেছেন।”
শ্যাম লাহিড়ী তটস্থ হয়ে বললেন, “নিয়ে আয়।”
বিষ্ণুবাবু একা নন, সঙ্গে আরও দু’জন মাস্টারমশাই এসে ম্লানমুখে ঢুকলেন। বিষ্ণুবাবু বললেন, “জয়পতাকাকে নিয়ে কালু পটাশগড়ের জঙ্গলে ঢুকেছিল বলে খবর পেয়েছি। রাখাল ছেলেরা দেখেছে। কালু একটু আগে ফিরে এলেও জয়পতাকা ফেরেনি। আমরা বেশ ভাবনায় পড়েছি। কাল ছুটি বটে, কিন্তু পরশু থেকে স্কুলে অঙ্ক করানোর ভাল লোক নেই।”
জয়ধ্বনি ফুঁসে উঠে বললেন, “শুধু অঙ্কই বা কেন, অ্যারিথমেটিক, জিওগ্রাফি, জিওমেট্রি, অ্যালজেব্রা, ম্যাথমেটিকস, ভূগোল, ইতিহাস, সায়েন্স, হিস্টরি, বিজ্ঞান এসবও তো সে পড়ায়।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
শ্যাম লাহিড়ী একটু ভেবে বললেন, “যদি গড়-ভুতুয়ার পাল্লায় পড়ে না থাকে তা হলে চিন্তা নেই।”
“গড়-ভুতুয়াটা কী বস্তু হে!”
“গড়-ভুতুয়া নামটা আমারই দেওয়া। পটাশগড়ের জঙ্গলে একটা পুরনো কেল্লা আছে বলে শোনা যায়। এমনিতে সেখানে যাওয়া যায় না। তবে গড়-ভুতুয়া ধরলে যেতেই হয়। সেটা ভারী মিস্টিরিয়াস জায়গা।”
জয়ধ্বনি বিরক্ত হয়ে বললেন, “আহা, গড়-ভুতুয়াটা কী জিনিস সেটা বলবে তো! ভূত নাকি?”
“তার চারদিকে গহিন চোরাবালি। একটা মাত্র সরু পথ আছে। কিন্তু সেটা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। গড়-ভুতুয়া যদি নিয়ে যায় তো ভাল, কিন্তু বেরোবার সময় সে কিছুতেই পথ দেখায় না। তখনই বিপদ। আমার চেনা-জানা তিনটে সাহেব সেখান থেকে আর ফেরেনি।”
জয়ধ্বনি উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন, “আমি ওসব গাঁজাখুরিতে বিশ্বাস করি না। কিন্তু এর একটা বিহিতও তো করা দরকার।”
বিষ্ণুবাবু বললেন, “স্কুলের বড় ছেলেরা অবশ্য সবাই লাঠি-সোটা, টর্চ, হ্যারিকেন নিয়ে পটাশগড়ের জঙ্গলে গেছে। শহরের আরও কিছু ডাকাবুকো লোকও আছে তাদের সঙ্গে। খুঁজে পেলে নিয়ে আসবে।”
শ্যাম লাহিড়ী চিন্তিত মুখে একটা দাবার ঘুটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন।
জয়ধ্বনি উঠে পড়ে বললেন, “তা হলে আমিও ঘরে বসে থাকতে পারব না। আমার নাতির যদি বিপদ হয়, তা হলে আর আমার বেঁচে থাকার মানেই হয় না। আমি চললুম।”
শ্যাম লাহিড়ী বললেন, “গেলেই তো হবে না। আটঘাট বেঁধে যেতে হবে। বোসা জয়ধ্বনি। আমিও তৈরি হয়ে নিই।”
“তুমি যাবে!”
“আমার যাওয়াটা বিশেষ দরকার। পটাশগড়ের জঙ্গলে আমি তবু বারকয়েক গেছি, অন্য সবাই আনাড়ি।”
জয়ধ্বনি বসে লাঠিটা বাগিয়ে ধরে বললেন, “যদি বাঘে তাকে ধরে তো পিটিয়ে ছাতু করব।”
শ্যাম লাহিড়ী মৃদু হেসে বললেন, “জঙ্গলে মেলা বড় গাছ আছে। তার একটায় উঠে পড়লে বাঘ তেমন কিছু করতে পারবে না। জয়পতাকা বুদ্ধিমান ছেলে। কিন্তু আমার ভয় অন্য। গড়-ভুতুয়া বড় পাজি জিনিস। লোককে বেভুল ভুলিয়ে-ভালিয়ে গড়ে নিয়ে তোলে। আমাকেও চেষ্টা করেছিল। সেবার আমার হাউন্ড কুকুর জিমি সঙ্গে থাকায় বেঁচে যাই। সে আমার প্যান্ট কামড়ে ধরে টেনে নিয়ে এসেছিল। থাকগে সেসব কথা। শুনুন। বিষ্ণুবাবু, আমি পটাশগড়ের জঙ্গলে যাচ্ছি। কিন্তু সঙ্গে ব্যোমকেশকেও যেতে হবে। আপনারা তাঁকে গিয়ে বলুন।”
বিষ্ণুবাবু বললেন, “উনি যাবেন বলে মনে হয় না। ভারী ভীতু লোক। তার ওপর কাল ওঁর দু-দুটো সভা। একটা জয়পতাকা সংবর্ধনা সভা, আর-একটা জয়পতাকা ধিক্কার সভা। উনি এখন দু-দুটো বক্তৃতা মুখস্থ করছেন।”
শ্যাম লাহিড়ী গম্ভীর মুখে বললেন, “তা বললে চলবে না। ব্যোমকেশকে গিয়ে বলুন যে, সে যদি না যায় তা হলে সে কাপুরুষ বলে ভোটারদের কাছে রটিয়ে দেব, ভোটাররা আর তাকে ভোট দেবে না।”
বিষ্ণুবাবু উঠতে উঠতে বললেন, “আমাদেরও যেতে হবে কি?”
শ্যাম লাহিড়ী মাথা নেড়ে বললেন, “অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট, আপনি বরং যাদের পটাশগড়ে পাঠিয়েছেন তাদের ডেকে আনার ব্যবস্থা করুন। যদি তাকে গড়-ভুতুয়াই ধরে থাকে, তবে বেশি লোক গিয়ে লাভ নেই।”
“মোটে আপনারা তিনজন যাবেন?”
“তাই যথেষ্ট। আর কাউকে যেতে হবে না।”
জয়ধ্বনি বলে উঠলেন, “তা হলে ব্যোমকেশকেই বা নিচ্ছ কেন?”
“তাকে একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার। লোকটা হিংসে করে। তার ওপর লোকটা বেজায় ভীতু। পেটে বিদ্যে নেই, কেবল বক্তৃতার জোরে টিকে আছে। বক্তৃতার জোরেই পৌরপিতা হয়েছে। সত্যিকারের কাজ কিছু করেনি। আহাম্মকটাকে দিয়ে কিছু করাতে হবে।”
এই বলে শ্যাম লাহিড়ী উঠে তৈরি হতে গেলেন। ভিতরের ঘরে পোশাক পালটাতে এসেই কিন্তু শ্যাম লাহিড়ীর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি ভালই জানেন, জয়পতাকাকে যদি গড়-ভুতুয়া ধরে থাকে তা হলে পটাশগড়ের জঙ্গল তন্নতন্ন করে খুঁজলেও লাভ নেই। পটাশের ওই অদ্ভুত কেল্লায় কেউ এমনিতে পৌঁছতে পারে না। গড়-ভুতুয়া যদি পথ চিনিয়ে না নিয়ে যায়, তা হলে পরিশ্রমই সার হবে। তা বলে ঘরে হাত-পা গুটিয়ে থাকাও চলে না। তাঁর বন্ধু জয়ধ্বনিকে এখন ব্যস্ত রাখা দরকার। নইলে নাতির চিন্তায় লোকটার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতে পারে।
বাইরে বেরোবার পোশাক পরে পকেটে একটা ছয়ঘরা রিভলবার ভরে নিলেন শ্যাম লাহিড়ী। হাতে টর্চ আর নাল পরানো লাঠি। দুশ্চিন্তায় তাঁর বুকটা শুকিয়ে আছে। জয়পতাকাকে তিনি কোলেপিঠে করেছেন। খুব বিনয়ী, বুদ্ধিমান, ভাল ছেলে। পটাশের কেল্লায় যদি তাকে গড়-ভুতুয়া নিয়ে ফেলে থাকে, তা হলে উদ্ধারের আশা একরকম নেই। ওই কেল্লা নিয়ে অনেক কিংবদন্তি আছে। কিন্তু কিংবদন্তিগুলোও পরস্পরবিরোধী। এই পর্যন্ত মোট ত্রিশ-চল্লিশজন লোক পটাশের গড় দেখতে পেয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু কেউ বলে, গড়ের চারপাশে যে চোরাবালি আছে তা বোঝবার উপায় নেই। লতাপাতা ঘাসের চাঙড় দিয়ে এমন ঢাকা থাকে যে পা দেওয়ার পর বোঝা যায় ঘাসের নিচে চোরাবালি আছে। অনেকে বলে, কেল্লাটাও লতাপাতায় ঢাকা একটা ধ্বংসপ মাত্র। আবার কেউ বলে চোরাবালির ওপর লতাপাতা মোটেই নেই। আর কেল্লাটা মোটেই ধ্বংসস্তূপ নয়, রাত্রিবেলা সেখানে উজ্জ্বল আলো দেখা যায়, ডিনারের ঘন্টার শব্দ পাওয়া যায়। কয়েকজন সাহেব একবার পটাশগড়ের জঙ্গল জরিপ করে মানচিত্র তৈরি করেছিল। সেখানে চোরাবালির কথা আছে, কিন্তু কেল্লার উল্লেখই নেই। অথচ সেই দলেরই একজন সাহেব নাকি এক সন্ধেবেলা ‘ডিনার খেতে যাচ্ছি বলে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গিয়ে আর ফেরেনি। তার সঙ্গীদের সন্দেহ, লোকটা হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়ে চোরাবালিতে ডুবে মরেছে। শ্যাম লাহিড়ীর নিজের অভিজ্ঞতা অবশ্য সেই পাগলা-সাহেবের সঙ্গেই মেলে। তিনি একবার পাগলা হাতির খবর পেয়ে পটাশগড়ের জঙ্গলে ঢুকেছিলেন। সঙ্গে জিমি ছিল। সেই সময়ে সন্ধেবেলা তিনিও বাতাসে উড়ো একটি কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন ‘ডিনারের সময় হল। নানা বেভুল রাস্তায় ঘুরপাক খেতে-খেতে যখন চোরাবালির প্রান্তে পৌঁছে গেছেন এবং একটি অন্ধকার ধ্বংসস্তৃপ দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেছেন, সেই সময়ে জিমি তাঁর প্যান্ট কামড়ে ধরে প্রবল প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। অল্পের জন্য তিনি বেঁচে যান। জিমিই তাঁকে পথ দেখিয়ে একরকম টানতে টানতে নিয়ে আসে জঙ্গলের বাইরে।
বেরোবার মুখে বিষ্ণুবাবু এসে ম্লান মুখে বললেন, “ব্যোমকেশবাবু যেতে পারবেন না। তাঁর একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর। কম্বল মুড়ি দিয়ে কোঁ-কোঁ করছেন।”
শ্যাম লাহিড়ী একটু হেসে বললেন, “বলুন গিয়ে, পৌরপিতা হিসেবে তাঁর কিছু কর্তব্য আছে। যদি ভয় খেয়ে থাকেন, তবে তাঁর বদনাম হবে। তিনি যদি একান্তই না যান, তা হলে এবার মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনে আমি তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াব।”
বিষ্ণুবাবু চলে গেলেন।
দশ মিনিটের মাথায় শ্যাম লাহিড়ীর বাড়ির সামনে একটা রিকশা এসে থামল। ব্যোমকেশবাবু প্রকাণ্ড একখানা লাঠি হাতে লাফ দিয়ে নেমে বেশ চেঁচিয়ে রাস্তার লোককে শুনিয়ে বললেন, “শহরের সবচেয়ে বড় বীর ছেলেটা জঙ্গলে হারিয়ে গেল এটা কি ইয়ার্কি নাকি? যতদিন আমার দেহে প্রাণ আছে ততক্ষণ এরকম কাণ্ড বরদাস্ত করব না। ভাইসব, এই আমি চললুম জয়পরাজয়বাবুকে ফিরিয়ে আনতে। না, না, কঠোর কর্তব্যকর্মে আপনারা কেউ আমাকে বাধা দেবেন না। আমি যাবই।”
এই বলে ব্যোমকেশ বাঁদুরে টুপিটা খুলে একগাল হেসে শ্যাম লাহিড়ীকে বললেন, “দাদাও যাচ্ছেন বুঝি? বাঃ বাঃ, বেশ হল।” শ্যাম লাহিড়ী গম্ভীর হয়ে বললেন, “তোমার নাকি খুব জ্বর?”
ব্যোমকেশ মাথা চুলকে বললেন, “লোকে সারাক্ষণ এসে এত জ্বালাতন করে যে, ওসব একটু বানিয়ে বলতেই হয়। অপরাধ নেবেন না। দিনরাত লোকসেবা করে করে হাড়ে ঘুণ ধরে গেল। তা দাদা কি সত্যিই ইলেকশনে দাঁড়াবেন? আপনি দাঁড়ালে তো আমার আশা নেই।” শ্যাম লাহিড়ী জবাব দিলেন না।