Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পটললাল ও মধুবালা || Tarapada Roy

পটললাল ও মধুবালা || Tarapada Roy

পটললাল ও মধুবালা

০১. মধুবালা

কুলবালা গো কুলবালা।
রাখো তোমার কুসুমমালা।
তুমি নওগো মধুবালা।

.

কড়েয়া রোড, পার্ক সার্কাসের হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার নকুল শুকুল ওরফে সহদেব শুক আজ সকাল থেকে স্মৃতিমধুরসে নিমজ্জিত হয়ে আছেন।

পাঠক-পাঠিকাদের স্মরণ থাকতে পারে যে, ডাঃ সহদেব শুক শুধু চিকিৎসক নন, তিনি ঝানু গোয়েন্দা ও সংগীতবিদ। গোয়েন্দাগিরির সময় তিনি তার নাম ও পদবির ইংরেজি আদ্যক্ষর দুটি, অর্থাৎ মিঃ এস এস ব্যবহার করতে ভালবাসেন এবং ওইভাবেই পরিচিত হতে চান। যদিও অনেকেই তাকে সহদেব ডাক্তার বা শুধু ডাক্তার বলে সম্বোধন করে। আগে গোয়েন্দাগিরির সময়ে এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করতেন, এখন মানিয়ে নিয়েছেন।

সহদেববাবু সংগীতচর্চাতেও পারঙ্গম। তার গানের ক্যাসেট আছে। সেই গানগুলি তিনি নিজেই রচনা করেছেন, নিজেই সুর দিয়েছেন এবং নিজেই গেয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিজের ক্যাসেট নিজেই পয়সা খরচ করে বার করেছেন। এদিক থেকে তিনি হাল আমলের গায়কদের পূর্বসূরি।

.

যা বলছিলাম, আজ সকাল থেকে সহদেববাবু স্মৃতিরসে আপ্লুত হয়ে আছেন। আজ রবিবার সকালে তিনি রোগী দেখেন না।

গত মাস থেকে সহদেব ডাক্তার কেবল টিভির কানেকশন নিয়েছেন। দূরদর্শন পর্যবেক্ষণ করার মতো তার খুব যে অবসর আছে, তা নয়। টাকাও খুব কম নয়। কানেকশন নিতে পাঁচশো টাকা লাগে, তারপর মাসে একশো টাকা লাগে।

অবশ্য হোমিওপ্যাথ চিকিৎসা করে সহদেববাবু ভালই উপার্জন করেন। এরকম টাকা অল্পবিস্তর খরচ করতে তাঁর গায়ে লাগে না।

সবচেয়ে বড় কথা টাকার কথাটা তেমন কিছু নয়। কেবল টিভি নেয়ার পর ডাক্তার সহদেব শুকের জন্মান্তর ঘটে গেছে।

মেদিনীপুরের এক মহকুমা শহরের পাশের এক গ্রামের নকুল শকুল নামে একটি বালক পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে শহরের ইস্কুলে পড়তে আসত।

পটললাল কাহিনিমালার একাগ্র পাঠক-পাঠিকারা হয়তো খেয়াল করবেন এই নকুল শকুলই পরবর্তীকালে নিতান্ত পেশাগত কারণে যুক্তিসংগত ভাবে নাম ও পদবি অদল-বদল করে সহদেব শুক হয়েছিলেন। (পটললাল ও মিস জুলেখা দ্রষ্টব্য।)

নকুল শকুল ওরফে সহদেব শুক তখন ক্লাস এইটে পড়েন। ইস্কুলের নাম জগজ্জনী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়। তাঁর তখন বয়েস বারো-তেরো। ওই বয়সেই তিনি একজন তুখোড় গোলকিপার। শুধু ক্লাস টিমেই নয় স্কুল টিমেও তিনি গোলকিপার, যা সাধারণত নাইন টেনের ছেলেদের মধ্যে থেকেই নির্বাচন করা হয়।

কিন্তু এর পরেও আছে। শহরের শ্রেষ্ঠ ফুটবল টিম স্বাধীন স্পোর্টিং ক্লাবেরও তিনি বাঁধা গোলকিপার। অবশ্য সে টিমে আরও একজন গোলরক্ষক আছেন, তিনি হলেন নিনি মহামাত্র। এন। পাত্র নামে কলকাতায় বহুকাল এরিয়ান্সের বি টিমে খেলেছেন।

যে সময়ের কথা বলছি তখন নিনি মহাপাত্র মহোদয়ের বয়েস চুয়াল্লিশ, নকুল শকুলের বয়েস চৌদ্দ। শকুলের ওজন একমণ, মহাপাত্রের ওজন দুমণ। শকুলের উচ্চতা সোয়া পাঁচ, মহাপাত্রের উচ্চতাও সোয়া পাঁচ।

বয়েস এবং ভারী শরীরের জন্য গোলকিপার হিসেবে এন মহাপাত্রের কিছু অসুবিধে থাকলেও নকুল শকুল যেখানে তার পাতলা শরীর দিয়ে একটু ফুট প্রস্থ আটকাতে পারতেন, সেখানে দু মণি শরীরে নিনি মহাপাত্র দু ফুট এলাকা জুড়ে গোলপোস্টে দাঁড়িয়ে থাকতেন।

ডাঃ সহদেব শুক কখনও কখনও ফুটবল মাঠে এখনও খেলা দেখতে যান কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই নিজে আর খেলার চেষ্টা করেন না। কিন্তু তার অবচেতন মনে কোথাও নিনি মহাপাত্রের প্রভাব রয়েছে। সেই প্রভাবেই হয়তো তার বর্তমান ওজন এখন দুমণ ছাড়িয়ে গেছে।

দুই বিঘা জমি নামক বিখ্যাত কবিতায় রবীন্দ্রনাথ দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে সমান হইবে টানা এরকম ভূমিলোভী এক বাবুর কথা বলেছিলেন। সহদেব শুক তত খারাপ বাবু নন, জমি লোভী নন, তবে তিনি নিজেই গায়ে গতরে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে সমান হইবে টানা হয়ে গেছেন।

সহদেব বাবু নিজে ডাক্তার হয়েও মেদবৃদ্ধির কারণে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়েছিলেন। নানারকম খারাপ ভাল, মল-মূত্র-রক্ত ইত্যাদি বহুবিধ পরীক্ষার পরে বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, খাওয়া কমাতে হবে, ব্যায়াম করতে হবে, হাঁটাহাঁটি করতে হবে।

কয়েকবছর আগে সহদেব বাবুর এক মক্কেল নৃত্যগীত পটিয়সী যাত্ৰানায়িকা জুলেখা অতিরিক্ত বাংলা মদ ও চোলাই এবং সেই সঙ্গে আনুষঙ্গিক চাট খেয়ে প্রভূত মেদশালিনী হয়ে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত আর নাচতে না পেরে যাত্রাপার্টি ছেড়ে সার্কাসের দলে যোগদান করেন, যেখানে তিনি বুকে হাতি তোলার কাজ করতেন।

সহদেববাবুর দুরবস্থা এখনও সে পর্যায়ে পৌঁছায়নি। স্থূলদেহ নিয়ে ডাক্তারির তেমন অসুবিধে নেই, সংগীত রচনা বা চর্চার জন্যেও মোটা হলে বাধা নেই। অবশ্য গোয়েন্দাগিরির কাজে কিছু দৌড়ঝাঁপ প্রয়োজন পড়ে তবে সে ধরনের কাজ সাধারণত তিনি এড়িয়ে যান।

এদিকে কেবল টিভি নেওয়ার পর থেকে সহদেববাবুর হাটাচলা অনেক কমে গেছে। আগে সকালে উঠে ময়দানে হাঁটতে যেতেন। কিন্তু ওই সময়ে কেবল টিভির একটা চ্যানেলে পুরনো দিনের হিন্দি গান হয়। গান শোনার নেশা ধরে গেছে তার।

নেশা ধরে গেছে বললে অবশ্য ভুল বলা হয়। এই নেশা সহদেববাবুর বহুদিনের পুরনো। প্রথম যৌবনে তিনি হিন্দি সিনেমার পোকা ছিলেন। কী সব নায়িকা ছিল তখন, সুরাইয়া, নার্গিস, মধুবালা।

এর মধ্যে অবশ্য এই শেষের জনেরই প্রতি তাঁর অধিক অনুরাগ ছিল।

সেই আয়েগা-আয়েগা গান, মহল ছবিতে। অশোককুমার গায়ক, নায়িকা মধুবালা, জাফরির চৌকো ফাঁক দিয়ে আলো আঁধারিতে মধুবালার ঢলঢল মুখ, সে হল সহদেব শুক যখন নকুল শুকুল ছিলেন সেই প্রথম যৌবনের প্রথম প্রেম।

কাঁথি শহরে কাকার বাড়িতে থেকে স্কুলে ক্লাস নাইনে। চুরি করে মহল ছবি পাঁচবার দেখেছিলেন নকুল শকুল। অশোককুমার-মধুবালার ডায়ালগ মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল স্কুল ছাত্র নকুলের।

(সহদেব শুক ওরফে নকুল শকুল প্রসঙ্গ বেশ জটিল। যাঁরা পটললাল ও মিস জুলেখা বইটি পড়েননি বা ভুলে গেছেন, একবার দেখে নেবেন।)।

সেই মহল থেকে শুরু। এর পরে বহুদিন মধুবালা জ্বরে ভুগেছিলেন সহদেববাবু। অশোককুমারের সঙ্গে মধুবালার আরেকটা বই দেখেছিলেন হাওড়া ব্রিজ। সেই বইয়ের শুটিং হাওড়া ব্রিজের ওপরে হয়েছিল। তখন সহদেব কলেজে পড়েন। রাতের বেলা ব্রিজে উঠে সে বইয়ের শুটিং দেখতে গিয়ে পুলিশের লাঠি খেয়েছিলেন।

তবে সহদেব সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন মধুবালার চলতি কা নাম গাড়ি দেখে। সেই বইতেও অশোককুমার ছিলেন কিন্তু নায়ক ছিলেন কিশোরকুমার। অশোককুমারের সব ভাইই চলতি কা নাম গাড়ি ছবিতে ছিলেন।

সেই ছবিতে কিশোরকুমারের সঙ্গে মধুবালার একটা নেচে নেচে গান, কী যেন লাইনগুলো ছিল তার,

হাল ক্যায়সা হ্যায় জনাব কা,
কেয়া খেয়াল হ্যায় আপকা।

সহদেববাবুকে একেবারে মাতিয়ে দিয়েছিল।

সেই সময়ে সহদেববাবুর বিয়ের প্রস্তাব আসে। ভাল বংশ, সুন্দরী পাত্রী, লেখাপড়াও ভাল, মাধ্যমিকের ছাত্রী পদ্মবালাকে তিনি বিয়ে করেননি বরং তার বদলে পদ্মবালার নাম একটু ঘুরিয়ে গান লিখেছিলেন তিনি। নিজেই সুর দিয়েছিলেন সে গানে, নিজের মনে মনেই গাইতেন,

কুলবালা গো, কুলবালা।
রাখো তোমার কুসুমমালা।
তুমি নওগো মধুবালা।
কুলবালা গো,…

০২. পটললালের প্রবেশ

তুতু-তু তুতু তারা
ফাঁস গিয়া দিল বেচারা।

এ কাহিনি পটললাল ও মধুবালার। সেই দিক থেকে গল্প এখনও আরম্ভ হয়নি। অথচ ভূমিকা খুব বড় হয়ে গেল। সে যা হোক গল্প এমন কিছু বড় নয়। পাঠক-পাঠিকাদের তেমন কিছু অসুবিধে হবে না।

এটা একটা গোয়েন্দা কাহিনি। গোয়েন্দা কাহিনির নিয়ম হল গোয়েন্দার কথা সাত কাহন করে বলা।

আমরা ডাঃ সহদেব শুকের কড়েয়া রোডের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি।

রবিবারের সকালবেলা। কড়েয়া রোডের বাড়ির একতলায় চেম্বারের পাশে ড্রয়িংরুমে বসে মনোযোগ দিয়ে কেবল টিভি দেখছেন। একটু আগে প্রাতরাশ সেরেছেন, কলা, ডবল ডিমের ওমলেট, জোড়া মাখন টোস্ট সহকারে। এখন ঘন দুধ-চিনি দিয়ে গরম কফি আস্তে আস্তে চুমুক দিয়ে পান করছেন।

বেশ আরামদায়ক পরিবেশ। সবচেয়ে আনন্দের কথা, টিভিতে ডাঃ সহদেব শুকের যৌবনের অতিপ্রিয় সেই মধুবালা অভিনীত চলতি কা নাম গাড়ি বইটা হচ্ছে।

আজ বহুকাল পরে ছবিটা দেখে সহদেববাবু অভিভূত হয়ে গেছেন। ছবি দেখতে দেখতে তার বারবার মনে পড়ছে, তার যৌবনকালের সেই স্বরচিত গানটি, কুলবালা গো কুলবালা, তুমি নওগো মধুবালা।

গানটি নিজের মনে ভঁজতে ভঁজতে সেই সঙ্গে মধুবালার ছবি দেখতে দেখতে সহদেব স্থির করলেন, তার পরের গানের ক্যাসেটটা এই গান দিয়েই আরম্ভ করবেন। শেষের দিকের লাইনগুলো মনে পড়ছে না। সে যা হোক নতুন করে লিখে নিলেই হবে।

ছবিটা এখন মারাত্মক জায়গায় এসে পৌঁছেছে। একটা মোটর গ্যারেজের মধ্যে মধুবালা আর কিশোরকুমার প্রেমের লুকোচুরি খেলা খেলছেন। নিজের গানের সুর ভঁজা বন্ধ করে ব্যর্থ হয়ে সহদেব ছবিটা দেখতে লাগলেন।

এমন সময় মূর্তিমান রসভঙ্গ হয়ে শ্রীযুক্ত পটললালের প্রবেশ। রোগীদের চেম্বার থেকে সরাসরি ড্রয়িংরুমের মধ্যে চলে এসেছেন পটললাল।

গোয়েন্দাপ্রধান মিঃ এস এস অর্থাৎ সহদেববাবু এত মনোযোগ দিয়ে, অভিনিবেশ সহকারে এই রকম একটা পুরনো রদ্দি হিন্দি ছবি দেখছেন এটা দেখে পটললাল একটু বিস্মিত হলেন।

ইতিমধ্যে ব্রেক হয়েছে। একটি নারকেল তেলের বিজ্ঞাপনে এক ভদ্রমহিলা নারকেল তেল কিনতে এসে প্রকাশ্য বিপণিতে নিজের মাথার চুল খুলে দেখাচ্ছেন আর এটা দেখে এক ব্যক্তি তো-তো করছেন।

বিজ্ঞাপন থেকে চোখ সরিয়ে সহদেব পটললালের দিকে তাকালেন।

পটললাল সব সময়েই একটা গোলমাল বাধিয়ে আসেন। এবারে নিশ্চয় তাই হয়েছে।

কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে পটললালের?

পটললালের চেহারা সাজপোশাক ঠিক কোনওদিনই ভদ্রলোকের মতো ছিল না। কিন্তু এরকম ভ্যাগাবন্ড চেহারায় সহদেব তাকে কখনও দেখেননি।

পটললালের চোখ-মুখ বসে গেছে। মাথায় বাবরি চুল। লম্বা জুলফি, বাটারফ্লাই গোঁফ। পরনে সাতরঙা, ময়লা নাইলনের গেঞ্জি, কালো ফুলপ্যান্ট। গলায় মাদুলি, হাতে স্টিলের তাগা। এ ধরনের চেহারার, সাজপোশাকের লোক দেখলেই ভয় হয়। মনে হয় এখনই ধার চাইবে, বলবে, দাদা, পনেরোটা টাকা হবে নাকি।

পটললাল কিন্তু টাকা চাইলেন না। উলটো দিকের সোফায় বসে বললেন, স্যার খুব গোলমাল।

তখন ছোট পর্দায় ছবিটা আবার শুরু হয়েছে। গভীর রাতে মধুবালার বাড়িতে চুপিসারে কিশোরকুমার প্রবেশ করেছেন। হাতের ইশারায় পটললালকে থামিয়ে সহদেব বললেন, দাঁড়ান, আগে বইটা শেষ হোক।

পটললালের আর তর সইছিল না। তার গোলমালের আশু সমাধানটা বোধহয় খুব জরুরি।

পটললাল বসে বসে উশখুশ করতে লাগলেন। কিন্তু গোয়েন্দাপ্রবর মিস্টার এস এসের কোনও চিত্তবৈকল্য ঘটল না। তিনি একাগ্র দৃষ্টিতে চলতি কা নাম গাড়ি দেখে যেতে লাগলেন।

বাধ্য হয়ে পটললাল উঠে দাঁড়ালেন, গোয়েন্দা স্যারের দৃষ্টি কোনও রকমে আকর্ষণ করে বললেন, স্যার, বাইরে মধুবালা একা একা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আপনি যদি বলেন তো মধুকে ঘরের মধ্যে ডেকে আনি।

পটললালের আর কোনও কথা সহদেব ডাক্তারের কানে যায়নি শুধু মধুবালা শুনেছিলেন। টিভির পর্দায় এখন মধুবালার দোর্দণ্ডপ্রতাপ অভিভাবক হম্বিতম্বি করছেন, সে দিক থেকে চোখ না সরিয়ে সহদেব বললেন, মধু? মধুবালা? মধুবালা আমার বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে? মিস্টার পটললাল আপনার কি মাথা খারাপ হল। উনি তো বহুকাল গত হয়েছেন।

ড্রয়িংরুম থেকে বেরোতে বেরোতে পটললাল বললেন, স্যার, এ মধুবালা সে মধুবালা নয়। এখনই ডেকে নিয়ে আসছি।

পটললালের মধুবালাকে নিয়ে ফিরে আসতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল।

সহদেব ডাক্তারের বাড়ির বাইরে ফুটপাথে যেখানে ওপরের দেওয়ালে সাইনবোর্ড টাঙানো আছে,

আর চিন্তা নাই।
ইঁদুরের কামড়ের অমোঘ ঔষধ;
দূর-দূর ইঁদুর
পরীক্ষা প্রার্থনীয়:
ডাঃ সহদেব শুক।

এই সাইনবোর্ডের মধ্যে একপাশে একটি করালদন্ত, কুম্ভীর বদন ইঁদুরের রঙিন ছবি আঁকা আছে, সেই ইঁদুরটির অতি দীর্ঘ লেজ নীচের দিকে নেমেছে।

সেই ইঁদুরের লেজের নীচের সইসই মধুবালাকে পটল দাঁড় করিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। এ তো আর মধ্যমগ্রামের কলোনি এলাকা নয়, কলকাতা শহরের পার্ক সার্কাস অঞ্চল। পটললাল মধুবালাকে সেই ইঁদুরের লেজের নীচে দাঁড় করিয়ে বলে গিয়েছিলেন, নট নড়ন চড়ন নট ফট।

কিন্তু পটললাল ফুটপাথে এসে দেখলেন মধুবালা সাইনবোর্ডের নীচে নেই। চিন্তিতভাবে একটু সামনের দিকে এগোতে দেখলেন কড়েয়া রোডের মোড়ে একটা ঘোড়া-নিম গাছের নীচে সিমেন্টের বাঁধানো বেদিতে বসে শ্রীমতী মধুবালা এক কানসাফাইওয়ালাকে দিয়ে কান পরিষ্কার করাচ্ছে।

পটললালের মতো সাতঘাটের জল খাওয়া, পোড় খাওয়া লোক জীবনে কোনওদিন কোনও মহিলাকে প্রকাশ্য রাস্তায় কান পরিষ্কার করতে দেখেনি।

তা ছাড়া এ কী দৃশ্য?

কামিজ হাঁটুর ওপরে তুলে, দুই পা ছড়িয়ে চোখ বুজে পরম আরামে মধুবালা কর্ণ কয়ন করছে।

পটললাল গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, এই বাবলি, এটা কলকাতার রাস্তা, কাপড়-চোপড় ঠিক করে বোস।মধুবালা তথা বাবলি তখন জীবনে প্রথমবার কর্ণকয়নের আবেগ অনুভব করছে, মধ্যে মধ্যে অত্যধিক আবেগে সাফাই-শিল্পীর দক্ষ হাতের মুঠি চেপে ধরে উঃ, আঃ করছে।

পটললালের চেঁচামেচিতে এতক্ষণে মধুবালা চোখ খুলল। তারপর আধো আধো গলায় বলল, কী বিরক্ত করছ পটলদা, একটু সুখ করতে দাও।

মধুবালার জন্যেই পটললালের সহদেব ডাক্তারের কাছে আসা, এখন মধুবালাই দেরি করছে। পটললাল খুব রেগে গেলেন কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। সে সাহসও তার নেই। বাঙালির চোপাকে তিনি খুব ভয় পান। একেবারে চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার করে ছেড়ে দেবে।

সুখ করা শেষ হতে মধুবালার সঙ্গে কান সাফাইওয়ালার তুমুল কলহ শুরু হয়ে গেল। একেবারে যাকে বলে তুলকালাম কাণ্ড।

জুতো পালিশওয়ালাদের, কান সাফাইওয়ালাদের ট্রেড-ট্রিক হল প্রথমে একটা সাধারণ দাম বলা, যথা দু টাকা, তারপরে পালিশ করতে গিয়ে অস্পষ্টভাবে খদ্দেরকে বলা, ক্রিম দিয়ে দেই, খদ্দের অতি সচেতন না হলে চুপ করে থাকবে। কিন্তু এই ক্রিম মানেই দু টাকার পালিশ পাঁচ টাকা হয়ে গেল।

মাথা মালিশওয়ালা, জুতো পালিশওয়ালা তারাও একই কায়দা করে, প্রথমে দু টাকা তারপরে মাথা হাতে নিয়ে খদ্দেরকে বলে স্পেশাল, মানে পাঁচ টাকা। কাজ শেষ হলে যখন খদ্দের ভাবছে দু টাকা দিতে হবে সে বলে, পাঁচ টাকা। পরিণামে গোলমাল অনিবার্য।

আজ কান পরিষ্কার করার লোকটিও সেই বুদ্ধিই করছিল। কিন্তু তার কোনও ধারণা ছিল না। আজকের খদ্দের বিষয়ে। বাবলি ওরফে যাত্রায় নবাগতা মধুবালা এমন ভাষায় গালাগাল শুরু করল যে তা শুনলে মরা মানুষ উঠে বসবে। কান সাফাইয়ের লোকটির বাংলা ভাষা তেমন রপ্ত নয়, তবুও সে যা বুঝল তাতে বিনা বাক্য ব্যয়ে উচিত প্রাপ্য দু টাকা পর্যন্ত ফেলে বাক্স গুটিয়ে পিঠটান দিল।

তবুও মধুবালা তাকে ছাড়ে না। ওড়না কোমরে বেঁধে সন্ত্রস্ত লোকটির পিছু পিছু ছুটল। মধুবালার বক্তব্য, বদমাইসের মুখে কী একটা খারাপ জিনিস ঘষে না দিয়ে ছাড়বে না। পটললাল বহু কষ্টে তাকে নিবৃত্ত করল।

রাস্তায় তখন বেশ ভিড় জমে গেছে। সোমত্ত যুবতীর উত্তাল দেহ আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গভঙ্গি সহকারে অশ্লীল গালাগাল জনতা খুবই উপভোগ করছিল। পটললাল মধুবালার হাত ধরে টেনে সহদেব ডাক্তারের বাড়িতে নিয়ে এলেন। অতি উৎসাহী দুয়েকজন পিছু নিয়েছিল, মধুবালা একবার ফোঁস করে তেড়ে যেতেই তারা উধাও হল।

কেবল টিভিতে এই মাত্র চলতি কা নাম গাড়ি শেষ হয়েছে। সেই অসামান্য শেষ দৃশ্যের রেশটি, যেখানে মধুবালাসহ কিশোরকুমার, অশোককুমার, অনুপকুমার সকলেই ভাঙা গাড়িতে গান গাইতে গাইতে চলে যাচ্ছে, আবার মনের মধ্যে গেঁধে গেছে সহদেব ডাক্তারের।

এমন সময় মধুবালাকে সঙ্গে করে পটললাল ফিরে এলেন। দূরদর্শনের পর্দায় তখন অতিশয় হাল আমলের নায়িকা উদয় হয়েছেন। তিনি যেটুকু কাপড় পরে আছেন, সেও নাচের তালে তালে উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে মোহময়ী সুরে অর্থহীন মাদকতাভরা গান–

তুতু-তু, তুতু-তারা
ফাস গিয়া দিল বেচারা।

০৩. কালো টাকা

ফরসা ফরসা মুখে কালো কালো চশমা,
ফরসা ফরসা পকেটে কালো কালো টাকা।

পটললাল ও মধুবালা সহদেববাবুর ড্রয়িংরুমে এসে যখন বসল তখনও মধুবালা ফুঁসছে এবং সেই সঙ্গে হাঁফাচ্ছে।

স্বাভাবিকভাবেই সহদেববাবুও জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? কী হল?

পটললাল বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই মধুবালা বলল, একটা বেজম্মাকে একটু কড়কে দিলাম।

মধুবালার ভাষা ব্যবহার দেখে সহদেব ডাক্তার একটু থমকিয়ে গেলেন। ইতিপূর্বে জুলেখা ও মমের সঙ্গে তার আলাপ পরিচয় হয়েছে, কিন্তু তাদের ভাষা খুব সংযত ছিল।

এ মেয়েটির চেহারা, শরীরের খাঁজ-ঊাজগুলো যেমন টানটান, সালোয়ার-কামিজ যেমন রবারের পোশাকের মতো আঁটসাট, মুখ চোখের মধ্যেও উগ্র যৌনতা। কথাবার্তায় সেটা আরও মালুম হল।

মধুবালাকে কিছুক্ষণ অবলোকন করে পটললালের দিকে তাকিয়ে সহদেব ডাক্তার বললেন, কী খবর পটলবাবু? আপনার যে দেখাই নেই। আজকাল আপনি কোন লাইনে আছেন? কী করছেন?

পটললালের মনে একটা খটকা ছিল আগের সেই কালো পমেরেরিয়ান কুকুর হারিয়ে যাওয়ার কেসে গোয়েন্দার ফি দেওয়া হয়নি হয়তো মিঃ এস এস এবার প্রথমেই তাই নিয়ে ধরবেন।

কিন্তু সহদেব ডাক্তারের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করে আর ওষুধ থেকে ভাল আয় হয়, তার অন্য সত্তা গোয়েন্দা এস এস-এর আয় নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই।

আগেরবারের পাওনার কথাটা না ওঠায় পটললাল একটু আশ্বস্ত হলেন এবং সহদেব ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তরে খুব বিনয় সহকারে বললেন, আমি আর কী করব? আমার কি কিছু করা সম্ভব?

সহদেব ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, মিস জুলেখা? তার কী খবর?

পটললাল বললেন, জুলেখা দুবাই থেকে আর ফিরছে না। সেখান থেকে এক বেদুইন নাকি তাকে কিনে নিয়ে গেছে। এখন সে মরুদ্যানে খেজুর ঝোঁপের মধ্যে এয়ার কন্ডিশন ঘরে থাকে।

দুবেলা খেজুরের চাটনি, উটের দুধের ফিরনি আর দুম্বার মাংস খায়।

খাদ্যের বর্ণনা শুনে সহদেব ডাক্তার বললেন, সর্বনাশ!

পটললাল বললেন, জুলেখার কথা আর বলবেন না স্যার। আপনি মধুবালার একটু হিল্লে করে দিন। তা হলে আমার হয়ে যাবে।

সহদেব ডাক্তার চট করে মধুবালার সমস্যায় মাথা গলাতে চাইলেন না। তিনি পটললালের কাছে আবার জানতে চাইলেন, তা হলে এখন কিছু করছেন না। নিজের খাই খরচা চালাচ্ছেন কী করে?

পটললালকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় দেখেছেন সহদেব ডাক্তার, তাই স্বাভাবিক কারণেই এরকম প্রশ্ন তিনি তাকে করতে পারেন, যদিও সাধারণত এই জাতীয় প্রশ্ন কোনও ভদ্রলোককে করা যায় না।

তবে সেই প্রচলিত অর্থে পটললালও তেমন ভদ্রলোক নন, চিরদিনই উঞ্ছবৃত্তি করে তার চলে, ভদ্র সমাজের প্রান্ত সীমানায় তার আনাগোনা। মেয়েমানুষদের মধ্যে যেমন হাফ-গেরস্থ আছে, তেমনিই পুরুষ মানুষদের মধ্যে আছে হাফ-ভদ্রলোক। শ্রীযুক্ত পটললাল পাল হলেন একজন হাফ ভদ্রলোক।

পটললাল সেটা জানেন এবং এতে তাঁর বিশেষ কিছু আসে যায় না। সহদেব ডাক্তারকে অকপটে তিনি যা বললেন, সেটাই এর প্রমাণ।

পটললাল বললেন, কালো টাকার কারবার করি।

সহদেব ডাক্তার বিস্মিত হলেন, মুখে বললেন, কালো টাকা ত কোটি কোটি টাকার ব্যাপার। আপনার অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে না কোটি কোটি টাকার কারবার করছেন?

পটললাল বললেন, সে ধরনের বড় বড় কালো টাকার ব্যাপার আমার নয়। আমার সামান্য দু টাকার ব্যাপার।

মধুবালা এতক্ষণ আপনমনে নিজের কামিজের কোনা পাকিয়ে কান চুলকাচ্ছিল, এতে যে তার নাভি ইত্যাদি দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল অন্যদের, সে নিয়ে তার ভ্রুক্ষেপ ছিল না। এবার পটললালের কথায় সে কামিজ নামিয়ে একটু মুখ বিকৃত করে বলল, ছিঁচকে।

পটললাল এই বিশেষণে খুব বিচলিত হলেন বলে মনে হল না। বরং সহদেব ডাক্তারকে বললেন, আমার স্টোরিটা একটু শুনুন স্যার।

এসব ব্যাপারে সহদেব ডাক্তারের কোনও ধৈর্যের অভাব হয় না। গোয়েন্দাগিরিতে সাফল্যের চাবিকাঠি হল মনোযোগ দিয়ে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু দেখা এবং শোনা। সেই রীতি মেনেই চোখ বুজে সহদেব ডাক্তার পটললালের কাহিনি শুনলেন।

সে এক অবিশ্বাস্য কাহিনি। পটললাল আবার কোনও কথা সংক্ষিপ্ত করে গুছিয়ে বলতে পারেন। পাঠক-পাঠিকারা গোয়েন্দা নন। এই দীর্ঘ ব্যাপারে তাদের ধৈর্যচ্যুতি হতে পারে এই আশঙ্কায় আমি পটললালের গল্পটি ডালপালা হেঁটে গুছিয়ে বলছি।

পটললাল এখন থাকেন নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে বাংলা থিয়েটারের এক মধ্যবয়সি অভিনেত্রীর কাছে পেয়িং গেস্ট হিসেবে। ঠিক পেয়িং গেস্টও নয়। লিভ টুগেদারও বলা যায়। এ ধরনের লিভ টুগেদার। আমাদের দেশে চিরকালই ছিল। জমিদার বাড়ির প্রৌঢ় প্রবাসী গোমস্তামশায় থাকতেন কালীবাড়ির হৃষ্টপুষ্টা পরিচারিকার সঙ্গে। বাজারের গুড়ের আড়তের সরকারবাবু বসবাস করতেন আগের সরকারবাবুর বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে। বহুকাল ধরে এসব চলে আসছে, এসব মোটেই সাহেবি কেতা নয়। সুতরাং পটললালকেও দোষ দেওয়া যায় না।

প্রতিদিন সকালে চা বিস্কুট খেয়ে পটললাল বাজারের থলে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। দুজনের সংসারের দৈনিক বাজার করার দায়িত্ব তার। বাজারের পয়সাটাও তাকেই যে করে তোক জোগাতে হয়। সেটা বর্তমান অবস্থায় পটললালের পক্ষে খুব সোজা কাজ নয়।

পটললালের বহুদিনের অভ্যেস বাজারে ঢোকার মুখে নিত্যরঞ্জন টি স্টলে বসে একটা ডাবল-হাফ চা খাওয়া। ডাবল-হাফ চা আজকাল কলকাতায় দু-চারটি পুরনো দোকান বাদ দিলে, আর পাওয়াই যায় না। তাই একালের পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাই, ডাবল-হাফ হল চায়ের লিকার কম, দুধ বেশি, চিনি বেশি। শক্তি বর্ধক পানীয় এটা। কলকাতারই আবিষ্কার ওই পানীয় বহুদশক ধরে এই শহরের ক্লান্ত নাগরিকদের উজ্জীবিত করেছে।

নিত্যরঞ্জন টি স্টলে পটললাল যে শুধু চা খেতেই যান তা নয়। ওখানে থিয়েটার-যাত্রার লাইনের অনেক তালেবর ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়। কখনও কখনও কাজকর্মের কিছু সুলুক-সন্ধান পাওয়া যায়।

একদিন সকালে বহুকাল পরে নিতাইবাবুর সঙ্গে পটললালের দেখা। নিতাইবাবু কৃতকর্মা লোক। থিয়েটারের প্রম্পটার থেকে যাত্রার মালিক হয়েছিলেন। একবার এক নায়িকার আত্মহত্যার মামলায় ফেঁসে গিয়ে বছর দশেক আগে নিতাইবাবু ফেরার হয়ে যান।

তারপরে এতদিন বাদে তার সঙ্গে এই দেখা। নিতাইবাবু বললেন, তিনি এখন ওড়িয়া যাত্রা করছেন। কটকে অফিস করেছেন। বাংলা যাত্রার মতো অত ঝুট-ঝামেলা নেই। পাবলিক ভাল, অভিনেতা-অভিনেত্রী গোলমেলে নয়। নায়কেরা কথা রাখে।

নিতাইবাবু পটললালের এলেম জানতেন। তিনি পটললালকে কটকে চলে আসতে বললেন। বললেন, যা হোক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

পটললাল নিতাইবাবুর কাছে তার ঠিকানা চাইতে হাতের কাছে কোনও কাগজ না থাকায় চায়ের দোকানের মেঝে থেকে একটা পুরনো খবরের কাগজের ঠোঙা তুলে তার থেকে এক টুকরো কাগজ চৌকো করে ছিঁড়ে নিজের মানিব্যাগ থেকে একটা ছোট ভোতা পেনসিল বার করে কটকের ঠিকানাটা লিখে দিলেন।

পটললাল ঠিকানার কাগজটা পকেটে নিয়ে বাজার করতে চলে গেলেন। বাজার করে বাড়ি ফিরে এসে পকেটে খুঁজতে গিয়ে দেখলেন কাগজটা নেই।

বাজারে পড়ে গেল নাকি। এদিকে পকেটে একটা দু টাকার নোট রয়ে গেছে। এটা হওয়ার কথা নয়। পটললালের দৈনিক বাজারের বাজেট বারো টাকা। দুশো গ্রাম রুই মাছের বাচ্চা ছয় টাকা, তরকারি চার টাকা, শোকলা দু টাকা। দৈনিক টায়ে-টোয়ে বাজার। চা খাওয়ার জন্যে এক টাকার একটা কয়েন আলাদা করে রাখা থাকে।

আজ আবার নিতাইবাবু চায়ের দামটা দিয়ে দিয়েছেন। সেই জন্যে কয়েনটা আছে। সঙ্গে একটা ময়লা, ছেঁড়া দু টাকার নোট।

আজকাল সব দু টাকার নোটেরই এই অবস্থা। এক টাকা, পাঁচ টাকাও তাই। তবে সে নোটগুলো দুর্লভ। ছোটখাটো কেনাবেচা চলছে ময়লা দু টাকার নোটে। ছেঁড়া একেবারে, আশ্চর্য তবুও চলে যাচ্ছে।

হঠাৎ পটললালের মনে হল নিতাইবাবুর ঠিকানা লেখা খবরের কাগজের ময়লা ঘেঁড়া অংশটা দু টাকার নোট হিসাবে নিজের অজান্তে চালিয়ে দিয়েছেন।

তারপর থেকে পটলবাবুর বুদ্ধি খুলে গেছে। বাসায় খবরের কাগজ রাখা হয় না। রাস্তাঘাটে যেখানে খবরের কাগজের টুকরো, ভেঁড়া ঠোঙা কুড়িয়ে পান তুলে পকেটে করে বাসায় নিয়ে আসেন। সেগুলোকে দু টাকার নোটের মাপে কাটেন তারপরে জলে ভেজান। শুকিয়ে গেলে উনুনের ছাই মাখান। পারলে একটু কেরোসিন তেল, একটু মাছের ঝোল বা উদ্বৃত্ত ডাল ছিটিয়ে দেন, যেদিন যেমন সম্ভব। তারপর তিন ভাঁজ করে চালের হাঁড়িতে রেখে দেন। প্রতিদিন বাজারে যাওয়ার সময়ে সেই হাঁড়ি থেকে গোটা ছয়েক কাগজের টুকরো নিয়ে চলে যান, বারো টাকার বাজার ভালভাবে চলে যায়।

পটললাল কবুল করলেন, আমি জানি, জিনিসটা অন্যায়। কিন্তু স্যার, কখনও ওই বারো টাকার বেশি জোচ্চুরি করি না।

পটললালের কথা শুনে সহদেব ডাক্তার তাজ্জব হয়ে গেলেন। বললেন, এ তো সাংঘাতিক কথা। বাজারের নোট দেখে আজকাল অবশ্য কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু ধরা পড়লে জাল টাকা চালানোর দায়ে আপনার জেল হয়ে যাবে।

পটললাল বললেন, ঠিক জাল টাকা নয় স্যার, কালো টাকা বলতে পারেন। কালো টাকার জন্যে কারও জেল হয় না।

সহদেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পটললালের কথায় মধুবালা ফিকফিক করে হেসে উঠল। তার দিকে তিনি কটমট করে তাকাতেই সে তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা কালো চশমা বের করে সেটা চোখে দিল। ঘরের মধ্যে হঠাৎ সানগ্লাস চোখে দেওয়ার কী প্রয়োজন পড়ল সহদেব ডাক্তার বুঝতে পারলেন না।

এদিকে নির্বিকারভাবে চশমাটা চোখে দিয়ে হাতব্যাগ থেকে একটা ছোট গোল আয়না বের করে নিজের চশমা পরিহিতা মুখশ্রী দেখতে দেখতে মধুবালা ভুল সুরে, ভুল হিন্দি উচ্চারণে গাইতে লাগল,

গোরি গোরি মুখমে
কালি কালি চশমা।..

তারপর মধুবালা হঠাৎ গান থামিয়ে পটললালকে এক ধমক দিয়ে বলল, পটলদা বাজে গল্প রেখে এবার আমার কেসটা বলো।

০৪. মধুবালার সমস্যা

রূপ সুহানা লাগতা হ্যায়
চাঁদ পুরানা লাগতা হ্যায়।

মধুবালার আচরণে পটললাল রীতিমতো বিরক্ত বোধ করলেন। কিন্তু সহদেব ডাক্তার এটাও বুঝতে পারলেন যে পটললালের মতো দুর্বল চরিত্রের ব্যক্তির পক্ষে মধুবালার মতো খলবলে যুবতাঁকে আয়ত্তে রাখা কঠিন।

পটললাল একটু সামলিয়ে নিয়ে সহদেব ডাক্তারকে বললেন, এবার তা হলে মধুবালার সমস্যাটার কথা বলি।

সহদেববাবুরও তাড়াতাড়ি আছে। ছুটির দিনের সকাল হলেও এগারোটা বেজে গেছে, এর পরে স্নান খাওয়া আছে, বিশ্রাম আছে। সহদেব ডাক্তার রবিবার বিকেলে অল্প কিছুক্ষণ চেম্বারে বসেন, রোগী দেখেন। বিকেল চারটে বাজার আগে থেকেই রোগী আসতে থাকে।

তবে পটললাল মধুবালার বিষয়ে বলা আরম্ভ করার আগে সহদেব ডাক্তারের দুয়েকটা জিজ্ঞাসা ছিল, তিনি পটললালের কাছে জানতে চাইলেন, মিস মধুবালার নাম কি পিতৃদত্ত? বাবা-মার দেওয়া?

পটললাল ঘাড় নেড়ে বললেন, না। না স্যার। আমাদের লাইনে সন্ন্যাসীদের মতো বাড়ির নাম চলে না। নতুন নাম দেওয়া হয়।

সহদেববাবু স্মৃতি রোমন্থন করে বললেন, হ্যাঁ। আপনার গিন্নি তো শ্রীলেখা থেকে জুলেখা হয়েছিলেন।

পটললাল তাড়াতাড়ি সহদেববাবুকে থামিয়ে বললেন, জুলেখার কথা বাদ দিন স্যার। মধুবালার কথা বলছি। ও হল বিহারের দেহাতি মেয়ে। মধুপুরের কাছে বাড়ি ছিল। আগে নাম ছিল, বোধহয়, রাধা সিং। ডাক নাম ছিল বাবলি। এই বলে পটললাল মধুবালার দিকে তাকাল।

মধুবালা অপাঙ্গে হেসে সম্মতি জানাল। সে সহদেব ডাক্তারের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে রইল।

মধুবালা চশমাটা খুলে নিয়েছে। তার মুখের দেহাতি বন্যতা, শ্যামকায়ার নিখুঁত বাঁধন রীতিমতো চিত্ত বিভ্রমকারী, মোহ সঞ্জারী। ঘনীভূত এই যৌন রসায়নের দিক থেকে সহদেব ডাক্তার তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলেন।

পটললাল বললেন, বাবলি মধুপুর থেকে এসেছে তাই নাম রাখা হয়েছে মধুবালা। যাত্রা পিতামহ দুকড়ি দত্ত মশায় নিজে এই সব নাম দেন। আজকাল পুরনো দিনের হিরোইনদের নাম চলছে। দুকড়ি দত্ত যে যে জায়গায় থেকে এসেছে জায়গার নামে তার নাম মিলিয়ে দেন। বাবলি মধুপুর থেকে এসেছে তাই নাম হয়েছে মধুবালা। নাগেরবাজার থেকে একটা মেয়ে এসেছে, তার নাম দেওয়া হয়েছে নার্গিস। পুরসুরা থেকে খুকু এসেছে, সে এখন সুরাইয়া, দারুণ নাম করেছে।

আধুনিক নার্গিস, সুরাইয়া, মধুবালাদের এই নাম বৃত্তান্ত শুনে গোয়েন্দাপ্রবর চমকৃত হলেন। একটু থেমে থেকে তারপর বললেন, এইবার মধুবালার সমস্যাটা বলুন।

দেখা গেল, মধুবালার সমস্যাটা অভাবনীয়। কারও এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে সহদেব ডাক্তার কখনওই ভাবেননি।

যাত্রায় করুণ রসের খুব প্রাবল্য। মধুবালার তাতে কোনও অসুবিধে হয় না। সে ইচ্ছে করলেই কপাল চাপড়িয়ে কাঁদতে পারে। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে গড়াগড়ি যেতে পারে, মুহূর্তের নোটিশে চোখে জল আনতে পারে।

বীর রস বা রৌদ্ররসেও বেশ পারঙ্গমা। সে চিৎকার করে খামোশ কিংবা চোপরও বললে যাত্রার আসরে ঘুমন্ত শিশুরা কঁকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে জেগে ওঠে।

এসব তেমন বড় কথা নয়। পালার আসরে সব ছোটবড় অভিনেতাই এটা করে, করতে পারে।

কিন্তু মিস মধুবালার প্রধান উৎকর্ষ হল শৃঙ্গার রসে বা আদি রসে। প্রেম ও প্রণয়ের দৃশ্যে শুধু নয়, ঘনিষ্ঠ শয্যা দৃশ্যে। ধর্ষণ ও বলাৎকারের দৃশ্যে। মধুবালার নাকি তুলনা হয় না। ব্যভিচারিণী, বিপথগামিনী রমণীর ভাল চরিত্র পেলে মধুবালা একেবারে ফাটিয়ে দিতে পারে।

কিন্তু সকলের তো সব বিষয়ে যোগ্যতা থাকতে পারে না। একেকজনের একেক ব্যাপারে অসুবিধে থাকে।

মধুবালার অসুবিধে হল হাস্যরস নিয়ে। মধুবালা হাসতে পারে না।

মধুবালা বিষয়ে বক্তব্য এই পর্যায়ে আসার পর হঠাৎ পটললালের কী খেয়াল হল। সহদেব ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলেন, স্যার মধুবালার একটা বেডসিন দেখবেন? আপনি ওই বড় সোফাটার ওপরে চলে যান, গিয়ে শুয়ে পড়ুন, মধুবালা আপনার সঙ্গে বেডসিন করে দেখাবে।

দেখা গেল মধুবালাও প্রস্তুত। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে বড় সোফার এক পাশে হাত-পা এলিয়ে শুয়ে পড়ল।

সহদেব ডাক্তার রীতিমতো অপ্রস্তুত। জীবনে ছোটখাটো দু-চারটে সিন বা গান যে কখনও করেননি তা নয়, কিন্তু বেডসিন করার মনোবল তার মোটেই নেই। তিনি শশব্যস্ত হয়ে জানালেন, না। না। তার দরকার নেই।

সহদেববাবুর ব্যাপার-স্যাপার দেখে খুবই নিরাশ হয়ে পড়ল মধুবালা। সে ধীরে ধীরে সোফার ওপরে শোয়া অবস্থা থেকে বসা অবস্থায় নিজেকে নিয়ে এল। এই নিয়ে আসা, রীতিমতো সময় নিয়ে, নানা রকম শারীরিক কায়দা কৌশল করে। অ্যাডালট মার্কা সিনেমার নায়িকারা বিশেষ বিশেষ দৃশ্যে যেমন করে, মধুবালাও তাই করল।

গোয়েন্দা বা গীতিকার কিংবা চিকিৎসক যাই হোন না সহদেববাবু রক্তমাংসের মানুষ। তিনি বুঝতে পারলেন এরপর উত্তেজনা দমন করা কঠিন হয়ে যাবে। এরপর হয়তো বেডসিন করার লোভ দেখা দিতে পারে।

তাই উত্তেজনাটা চাপা দেওয়ার জন্যে সহদেববাবু পটললালকে বললেন, মধুবালার আসল সমস্যাটা তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন তো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

পটললাল আর দেরি করলেন না। সরাসরি বলে ফেললেন, হাসলে মধুবালার হেঁচকি ওঠে, হেঁচকি ক্রমাগত উঠতেই থাকে। এমনিতে ছোটখাটো চাপা হাসি, চোখের কোণে কামনা মদির হাসি, ঠোঁটে লালসাময় হাসি। এগুলোতে মধুবালার তেমন অসুবিধে হয় না। কিন্তু হো-হো করে, হা-হা করে, গলা খুলে চেঁচিয়ে হাসলেই মধুবালার হেঁচকি ওঠে।

এ কথা শুনে সরল বালকের মতো সহদেব ডাক্তার বললেন, হো-হো করে, হা-হা করে চেঁচিয়ে হাসার দরকার কী? একজন মহিলার পক্ষে এভাবে হাসাটা মোটেই শালীন নয়।

পটললাল বললেন, শালীন-অশালীন নিয়ে মধুবালা মাথা ঘামায় না। নিজের আনন্দে তো ও হাসে না। ও হাসে পেটের দায়ে।

পেটের দায়ে হাসে? একটু অবাক হলেন যেন সহদেব ডাক্তার।

পটললাল বললেন, আজ্ঞে ঠিক তাই। এবার বাহাদুর অপেরায় মধুবালা সাইন করেছে। বাহাদুর অপেরার বুড়ো কর্তা তিনু পুরকায়েত মধুবালাকে বলে দিয়েছেন, কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি, রতিকলা যা কিছু করতে চাও আমি আছি। তিনুবাবু খুব রক্ষণশীল ব্যক্তি, তাঁর কথা হল স্টেজে ওসব বেলেল্লাগিরি চলবে না। এবার তিনি যে নতুন পালা নামাচ্ছেন তার নাম, রানি আসে, হাসতে হাসতে।

রানি আসে হাসতে হাসতে বইয়ের পাতায় পাতায়, পরতে পরতে হাসি। পড়তে গিয়ে প্রম্পটার থেকে পরিচালক পর্যন্ত হেসে গড়িয়ে পড়ে।

ওই নাটকেরই মুখ্য স্ত্রী চরিত্রে রানির ভূমিকা পেয়েছে মধুবালা। রীতিমতো অট্টহাসির পার্ট। এটাই মধুবালার জীবনে প্রথম বড় সুযোগ।

মধুবালা কিন্তু একবারের জন্যেও তিনুবাবুকে বলেনি বা জানতে দেয়নি যে হাসলে তার হেঁচকি ওঠে। তা হলে তিনুবাবু হয়তো তাকে নায়িকার ভূমিকা থেকে কিংবা পালা থেকেই সরিয়ে দেবেন।

ওদিকে নায়িকার পার্ট করতে গিয়ে যদি প্রাণ খুলে, গলা খুলে হাসতে হয় তা হলে প্রথম দৃশ্য থেকেই মধুবালার হেঁচকি উঠতে থাকবে, দ্বিতীয়-তৃতীয় দৃশ্য নাগাদ হেঁচকি তুলতে তুলতে স্টেজে বসে পড়বে। পুরো পালা বরবাদ হয়ে যাবে।

মধুবালার সমস্যাটা সত্যিই জটিল।

কিছুক্ষণ চুপ করে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলেন পটললাল।

কিন্তু মধুবালা কি কাউকে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার সুযোগ দেয়। সে এমন চুলবুল করতে লাগল যে তাতে সহদেব ডাক্তারের কেন পুরাকালের মুনি-ঋষিদের ধ্যানভঙ্গ হয়ে যেত। এই হাঁটু মুড়ে বসছে, পরক্ষণেই মাথার ওপরে হাত তুলে দেহবল্লরী বিকশিত করে এলো খোঁপা ঠিক করছে।

অবশেষে সহদেব ডাক্তার বললেন, আমাকে একদিন সময় দিতে হবে। আপনারা কালকে আসুন পটললাল বাবু। তবে আমাকে একটু ওই আপনাদের বুড়ো কর্তা তিনুবাবুর ঠিকানা আর ফোন নাম্বারটা দিয়ে যাবেন।

তিনুবাবুর ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দিয়ে চলে যাওয়ার সময় পটললাল বললেন, তিনুকর্তার কাছে বিশেষ কিছু সুবিধে হবে না স্যার।

সহদেব বললেন, দেখি।

মধুবালার সঙ্গে বেরিয়ে যেতে যেতে পটললাল আরেকটা কথা বললেন, স্যার, কালকে আমার একটু অসুবিধে আছে।

সহদেব বললেন, ঠিক আছে, পরশু আসুন।

পটললাল বললেন, কিন্তু স্যার, মধুবালার ব্যাপারটা একটু জরুরি। দুয়েকদিনের মধ্যেই ওর পালার মহড়া শুরু হয়ে যাবে।

একটু বিরক্ত হয়ে সহদেব ডাক্তার বললেন, আমাকে কী করতে হবে বলুন।

পটললাল মধুবালার সঙ্গে জনান্তিক একটু কথা সেরে নিয়ে বললেন, স্যার, ও যদি কাল সন্ধ্যাবেলা একলা আসে?

সন্ধ্যায় মধুবালা একাকিনী। একটু ইতস্তত করে তারপর ভয়ের এবং দ্বিধার ভাবটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সহদেব ডাক্তার বললেন, ঠিক আছে।

০৫. মধুর সমাধান

তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত…
নেহি তুছকো কোই হোঁশ
তুছ পর যৌবনকা যোশ যোশ…

হৃদয়ের মধ্যে একটা দেহজ আবেগ বহুদিন পরে জাগিয়ে দিয়ে মধুবালা পটললালের সঙ্গে চলে গেল। এক কালে জুলেখার সাহচর্যে এরকম হয়েছিল। তখন বয়েস পাঁচ বৎসর কম ছিল।

এ বয়েসে কি আর এসব পোষায়।

মনটাকে শান্ত রাখার জন্যে মধুবালাকে বাদ দিয়ে মধুবালার সমস্যাটা নিয়ে ভাবতে লাগলেন সহদেব সারা দিন, সারা সন্ধ্যা ভাবলেন।

বার কয়েক চিৎপুরে তিন পুরকায়েতকে ফোনে ধরার চেষ্টা করলেন। কিন্তু লাইনে পেলেন না। তিনু কর্তা রবিবার ফোন ধরেন না, কোনও যন্ত্রপাতি স্পর্শ করেন না।

সহদেব ডাক্তার এটা বুঝেছেন তাঁর এই মামলার নিষ্পত্তির চাবি কাঠি তিনু কর্তার হাতে রয়েছে। তিনু কর্তাকে যেকোনও ভাবে হাসির পালা করা থেকে নিরস্ত করতে পারলে মধুবালাকে রক্ষা করা যায়।

চিন্তা করতে করতে সহদেব ডাক্তারের রাতের ঘুম চটে যায়। শেষ রাতের দিকে হালকা মতন একটু ঘুম আসে। একটা গোলমেলে স্বপ্ন দেখে সহদেব ডাক্তারের স্বপ্ন ভেঙে গেল। তিনি সমুদ্রের নীল নীল বড় বড় ঢেউয়ের মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন, মধুবালা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে তীরে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে।

আজ বহুদিন পরে সকালবেলা সহদেব হাঁটতে বেরোলেন। ঘণ্টাখানেক খোলা বাতাসে মাথা ও শরীর ঠান্ডা করে বাড়ি এসে প্রথমেই ফোন করলেন তিনু পুরকায়েতকে।

তিনু কর্তা নিজেই ফোন ধরলেন। গাঁজা খাওয়া খ্যান খ্যান গলা। অনেকটা সাবেক দিনের নবদ্বীপ হালদারের মতো।

সহদেববাবু নিজের পরিচয় গোপন রেখে বললেন, আমি সাপ্তাহিক এত রঙ্গ বঙ্গ দেশে পত্রিকার সম্পাদক বলছি। আপনার নতুন পালার খবর নিচ্ছিলাম।

তিন কর্তা পত্রিকার লোক উপযাচক হয়ে খবর নিচ্ছে শুনে বেশ খুশি হলেন বলে মনে হল। বললেন, আমরা এবার মারমার কাটকাট, দম ফাটা হাসির পালা করছি। রানি আসে, হাসতে হাসতে।দর্শকেরা চেয়ার থেকে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে যাবে। এমন একটি সুরসিকা নায়িকা পেয়েছি মশায়, কী বলব। দেহাতের আসল চালানি জিনিস।

গম্ভীর হয়ে সহদেব ডাক্তার বললেন, যা দিনকাল পড়েছে কর্তা। হাসির পালা কি চলবে? জীবনে কোথাও তো আর হাসি নেই।

তিনু কর্তা বললেন, সেই জন্যেই তো চলবে। লোকে একটু হাসুক। আর কতকাল পকেটের পয়সা খরচ করে লোকে গোমড়া মুখে বুক চাপড়ানি, শাখা ভাঙা, সিঁদুর মোছা দেখবে।

চুপ করে থাকাই এ ক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের কাজ বুঝে নিয়ে সহদেববাবু চুপ করে থেকে তিনু কর্তার কথায় হু হু করে সায় দিতে লাগলেন।

তিনুবাবু বলে চললেন, ওই সব বস্তাপচা মাল মশাই, সতীনের ছেলের বড় গলা, সাপের সঙ্গে বাঘিনীর দেখা, ডাইনি আমার শাশুড়ি মা আর চলবে না মশায়। জানেন আমার বইতে দেড়শো কমিক রিলিফ, বাহাত্তুরটা হাসির সিচুয়েশন। তা ছাড়া অন্তত একশো জোক, তারাপদ রায়ের জ্ঞানগম্যি আর শোধবোধ থেকে সাক্ষাৎ টোকা।

সহদেববাবু বলতে যাচ্ছিলেন, ও বই দুটোও আগাগোড়া টোকা। তা না বলে বিনা বাক্যব্যয়ে টেলিফোনটি নামিয়ে রাখলেন। হাস্যরসের রীতিমতো অ্যাকিউট কেস, এই রোগ সারানোর সাধ্য তার নেই।

রোগ সারানোর কথাটা মাথায় আসতেই কিন্তু সহদেব ডাক্তার চলমান হয়ে উঠলেন। তিনি ভুল দিক থেকে কেসটার ব্যাপারে এগোচ্ছিলেন। গোয়েন্দা হিসেবে নয়, একজন হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক হিসেবে পুরো ব্যাপারটা দেখতে হবে। মধুবালাকে একজন রোগিণী হিসেবে চিকিৎসা করলে, যার অসুখটা হল হাসলেই হেঁচকি ওঠে সমস্যাটা সমাধান হতে পারে।

যেমন ভাবা তেমনই কাজ। ইংরেজি-বাংলা মোটা মোটা চার ভলিউম মেটিরিয়া মেডিকা আছে ডাক্তার সহদেব শুকের। বহুদিন পরে ধুলো ঝেড়ে সহদেব সেগুলো খুলে বসলেন। সারাদিন ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন, কিন্তু কোথাও পেলেন না হাসলে হেঁচকি উঠলে কী চিকিৎসা করা উচিত সে বিষয়ে কোনও চিকিৎসা, ওষুধপত্রের নির্দেশ।

ক্লান্ত হয়ে বিকেলের দিকে চেম্বারেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সহদেববাবু। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখেন অন্ধকার হয়ে গেছে। কাজের লোকটিকে ডেকে এক কাপ চা দিতে বললেন আর বললেন, আজ সন্ধ্যায় রোগী দেখব না। রোগীদের বলে দিন ডাক্তারবাবুর শরীর খারাপ করেছে।

সন্ধ্যার একটু পরেই মধুবালা এল। একটা বন্য দেহাতি কালো জলের নদীর মতো সে প্রবেশ করল সহদেববাবুর ড্রয়িং রুমে। নীল ফুল ফুল ছাপ সুতির একটা খাটো ফ্রক পরনে, সেটাও পাতলা কাপড়ের। থই থই করছে যৌবন। সোফায় এসে বসতে হাঁটুর ওপরে উঠে গেল ফ্রকের ঝুল।

সহদেব ভয় পেয়ে গেলেন, কোনও একটা পাগলামি না করে বসি। মধুবালাকে কী বলবেন সেটাও বুঝতে পারছেন না। এমন সময় তার খেয়াল হল ডাক্তার তথা গোয়েন্দা হিসেবে তাঁর একবার যাচাই করে দেখা উচিত মেয়েটার হাসলে কেমন হেঁচকি ওঠে।

মধুবালাকে সহদেব বললেন, একটু হাসো দেখি।

মধুবালা বলল, হঠাৎ হাসব কেন?

সহদেব বললেন, হঠাৎ নয়, হাসলে তোমার কেমন হেঁচকি ওঠে সেটা দেখতে হবে।

মধুবালা বলল, আমার তো হাসিই আসে না।

সহদেব বললেন, তবু একটু চেষ্টা করো।

মধুবালা বলল, পারব না। হেঁচকি উঠবে ভয়ে আমার হাসি আসে না।

ডাক্তার হিসেবে সহদেব ভেবে দেখলেন, যদি এর হেঁচকি ওঠাটা সারিয়ে দেওয়া যায় হাসির অসুবিধেটা নিশ্চয় থাকবে না। হেঁচকির নানারকম চিকিৎসা আছে, সেটা নিয়ে সমস্যা হবে না।

কিন্তু মধুবালা কিছুতেই হাসে না। চোখের কোণে হাসির ঝিলিক ঠোঁটে চাপা হাসি কিন্তু যে হাসি তাকে পালায় হাসতে হবে, যে হাসি হাসলে তার হেঁচকি ওঠে সে হাসি সে কিছুতেই হাসে না। হাসতে গিয়ে থমকে যায়।

সহদেববাবু নানা কায়দা করলেন কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। তিনি মধুবালাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কি সেই বোকা মেয়ের কথা শুনেছ যে সব সময়েই না বলে।

মধুবালা বলল, না।

সহদেববাবু বললেন, তুমিই সেই বোকা মেয়ে।

এই রসিকতাতেও মধুবালা হাসল না। তবে সহদেব ডাক্তারের আন্তরিকতা তাকে স্পর্শ করল। সে বলল, আমাকে কাতুকুতু দিলে আমি হাসতে পারি।

সহদেববাবু খুশি হয়ে বললেন, ঠিক আছে কাতুকুতু দাও।

মধুবালা রাগ রাগ গলায় বলল, নিজেকে নিজে কাতুকুতু দিলে আমার হাসি পায় নাকি। আপনি আমাকে কাতুকুতু দিন।

এই ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা সহদেব ডাক্তার একটু আগেও ভাবেননি, তা হলে এতটা এগোতেন, কিন্তু এখন আর কোনও উপায় নেই। এরই মধ্যে মধুবালা এগিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কী আর করবেন। সহদেব খুবই সংকোচের সঙ্গে মধুবালাকে কাতুকুতু দিতে লাগলেন।

ধীরে ধীরে মধুবালার হাসির বেগ আসতে লাগল। শরীরের যে সমস্ত খাঁজে-ভাঁজে কাতুকুতু দিলে হাসি বেশি পায় সেই সব নিষিদ্ধ জায়গায় মধুবালা সহদেবের হাত চেপে চেপে ধরতে থাকল। তারপর প্রথমে ঝিরঝির বৃষ্টির মতো খিলখিল করে অবশেষে উদ্দাম পাহাড়ি ঝরনার মতো বারবার করে হাসতে লাগল।

আর সেই হাসতে হাসতেই মধুবালার হেঁচকি শুরু হল। আর সে কী হেঁচকি। একের পর এক গমকে গমকে, ধমকে ধমকে বিয়ারের বোতলের ফেনার মতো হেঁচকি তুলতে লাগল মধুবালা।

শেষ পর্যন্ত হেঁচকি আর সামলাতে না পেরে সহদেব ডাক্তারের গলা জড়িয়ে ধরল মধুবালা। ডাক্তারবাবু প্রৌঢ় বটে কিন্তু তিনু কর্তার চেয়ে অনেক যুবক। হেঁচকি তুলতে তুলতে সহদেব। ডাক্তারের গায়ের ওপর এলিয়ে পড়ে গেল মধুবালা।

০৬. অতঃপর

পুরনো মধু নতুন মধু
কোন মধুটি সেরা!

অতঃপর আর কিছুই নয়।

আপনারা যা ভাবছেন তা মোটেই নয়। সহদেব ডাক্তার মোটেই দুর্বল চরিত্রের লোক নন।

তিনি একটু কষ্ট করে মধুবালার হাত ছাড়িয়ে চেম্বারে গিয়ে একটা কড়া ডোজ হোমিওপ্যাথিক ওষুধ এনে মধুবালাকে খাইয়ে দিলেন। অত্যন্ত তেজি ওষুধ। এক ডোজেই মধুবালার হেঁচকি ওঠা বন্ধ হয়ে গেল। সে চোখ বুজে হেঁচকি তুলছিল। এবার চোখ খুলে বলল, বাবা, যেমন তেজ, তেমন কড়া।

এখন থেকে মধুবালা তার হ্যান্ডব্যাগে সহদেব ডাক্তারের ওষুধ এক শিশি রেখে দেয়। রিহার্সালের আগে এক ডোজ খেয়ে নেয়। তারপর অনায়াসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেসে যায়। হাসতে হাসতে লাট হয়ে যায়।

মধুবালার ইচ্ছে ছিল যে একদিন তার রিহার্সাল দেখতে সহদেব ডাক্তারকে ডাকে। কিন্তু তিনু কর্তার ভয়ে সেটা সাহস পায়নি।

পটললাল মধ্যে একদিন এসেছিলেন। তিনি কটক চলে যাচ্ছেন নিতাইবাবুর খোঁজে, সেখানে ওড়িয়া যাত্রায় ভাগ্যান্বেষণ করবেন। বলে গেলেন, মধুবালা রইল। আপদে বিপদে পড়লে দেখবেন।

মধুবালা অবশ্য আর আসেনি। কিন্তু তাতে জিতেন্দ্রিয় ডাক্তার সহদেব শুকের কিছু আসে যায় না। তিনি আবার কেবল টিভিতে আসল মধুবালার পুরনো ছবি দেখছেন আর গান রচনা করছেন। এই তো কাল রাতেই লিখেছেন,

নিজের মনে নিজে নিজেই
করছি আমি জেরা,
পুরনো মধু নতুন মধু
কোন মধুটি সেরা?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress